পাকিস্তানের চাপাতিবাজ ও তার সুদুরপ্রসারী প্রভাব

Written on 19 April 2024. Posted in Islamic :: Bangla

০৬ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯, লাহোর। এক প্রেসের উল্টোদিকে দালানের কোণে লুকিয়ে আছে ইলমুদ্দীন। সবল সুঠাম উনিশ বছরের দুর্দান্ত তরুণ। ক্রোধে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে জ্বলে উঠছে তার তীব্র দুচোখ। হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতরে মারাত্মক চাপাতি। দুদিন আগে পুরো এক টাকা দিয়ে কিনেছে সে চাপাতিটা। ইস্পাতে তৈরী, অত্যন্ত শক্ত আর অত্যন্ত ধারালো। দরিদ্র কাঠমিস্ত্রীর ছেলে সে, ওই একটাকায় অনেকগুলো রুটি কেনা যেত। কিন্তু ইসলামের শত্রুকে খুন করতে সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রই তো তার চাই ! রাজপাল তার প্রকাশনা প্রেস থেকে ১৯২০ সালে লেখকের নাম ছাড়া বই বের করেছে - "রঙ্গীলা রসুল"। কারা যেন কোথায় হিন্দুদের সীতাকে পতিতা বানিয়ে লিফলেট ছেড়েছে বলে উড়ো একটা খবর এসেছে, তারই প্রতিবাদে এই বই। তুঙ্গে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম টেনশন, উৎকন্ঠিত সারা জাতি, - দাঙ্গা প্রায় লাগে লাগে। গল্প নয়, পাক-ভারতের আইন বদলের রক্তাক্ত ইতিহাস যার সাথে জড়িয়ে আছেন জিন্নাহ, কবি ইকবাল এবং আরো অনেক দিকপাল । ভারত উপমহাদেশকে ঝাঁকি দিয়ে গেছে এ ঘটনা, এর প্রভাব সুদুরপ্রসারী। 

ইলমুদ্দীনের একাগ্রতা টিকটিকির মত। বাল্বের কাছের উজ্জ্বল আলোতে ওই যে দেয়ালে বসে আছে একটা পোকা। দূর থেকে তার দিকে তীরের মত ছুটে এল টিকটিকিটা, কিছুটা দুরে এসে হার্ড ব্রেক করে থেমে গেল। দুচোখের দৃষ্টি তার তীরের মত ভেদ করে যাচ্ছে পোকাটাকে, তার চিন্তা চেতনায় এখন ওই পোকাটা ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই! এবারে অতি সাবধানে অতি সন্তর্পণে কয়েক পা এগিয়ে আবার থামল সে, জ্বলন্ত দুচোখ তার যেন পোকাটাকে গিলে খাচ্ছে। খেয়ালও নেই তার লেজ ওপরে উঠে পাক খেয়ে যাচ্ছে সাপের মত।

তারপরেই ছোট্ট একটা লাফ। নির্ভুল। এবং নির্মম।

ইলমুদ্দীনের ধ্বকধ্বক চেতনাতেও এখন রাজপাল ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু সেই সবশেষের নির্ভুল ও নির্মম আঘাতের অপেক্ষা। ওই, ওই যে - রাজপাল নিশ্চিন্তে এসে ঢুকল প্রেসে। সে জানে না তার ঘাড়ে নি:শ্বাস ফেলছে আজরাইল। ঝড়ের বেগে প্রেসে ঢুকল ইলমুদ্দীন, চোখের পলকে চাপাতি বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজপালের ওপর - সর্বশক্তিতে তার বুকের ভেতর চাপাতি ঢুকিয়ে নব্বই ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিল। কিছু বুঝবার আগেই ঢলে পড়ল রাজপাল - শক্তিশালী তরুণের চাপাতি তার বুকের হাড় ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে পুরো হৃৎপিণ্ডটা বাইরে এনে ফেলেছে। চিৎকার করে ছুটে এল কর্মচারীর দল, রাজপালের মৃতদেহের পাশে রক্তমাংস মাখা চাপাতি হাতে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে ইলমুদ্দীন। দাঁড়িয়ে থাকল যে পর্য্যন্ত না পুলিশ তাকে নিয়ে গেল।

১৯২৩ সালে সেশন কোর্টে কারাদণ্ড হলেও আপীল কোর্টে ছাড়া পেয়ে গেল রাজপাল কারণ ভারতীয় আইনে কোনো ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ বা ব্যক্তিত্বকে অপমানের বিরুদ্ধে আইন নেই। এদিকে ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত খুনের মামলা চলল ইলমুদ্দীনের বিরুদ্ধে, তার পক্ষে কবি ইকবালের অনুরোধে লড়লেন স্বয়ং জিন্না এবং তার পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুললেন কবি ইকবাল ও কিছু আলেম। আজকের পাকিস্তান অঞ্চলে হিরো হয়ে গেল ইলমুদ্দীন। মামলাটা এত স্পষ্ট ছিল যে জিন্না জীবনে এই একটা মামলা হেরে গেলেন, ইলমুদ্দীনের ফাঁসী হয়ে গেল ৩১শে অক্টোবর ১৯২৯ সালে।

এর পরে ধর্মকে অপমান করার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ একটা আইন বানায়, পরে ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের ২৫৯খ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের এবং ১৯৮৫ সালে ২৫৯গ ধারায় মৃত্যুদণ্ডের আইন করা হয়।

১. এখানেই পাকিস্তানের সাথে আমাদের আকাশ পাতাল তফাৎ। আমাদের চাপাতিবাজেরা জাতির ঘৃণার পাত্র কিন্তু ইলমুদ্দিন এখনো পাকিস্তানে বিরাট হিরো। তার নামে পার্ক, হাসপাতাল ও রাস্তা আছে।

২. ব্যঙ্গকারীকে খুন করা এসেছে হাদিস থেকে। কোরানের নির্দেশ হল ব্যঙ্গকারী থেকে দুরে সরে যাওয়া অর্থাৎ উপেক্ষা করা - নিসা ১৪০।

৩. ধর্মানুভুতি আইন উদ্ভটই শুধু নয়, বিপজ্জনকও। পাকিস্তান তার প্রমাণ, সেখানে অনেক নিরপরাধের জীবন এ আইনের আঘাতে ধবংস হয়ে গেছে। কেউ ধর্মকে অপমান করে কিছু বলেছে বা করেছে তার "সাক্ষী" টাকা বা হুমকি দিয়ে যোগাড় করাটা কোনো ব্যাপারই না। আইন-আদালত দলিল প্রমাণের জায়গা। কে কার কোন কথায় কি মতলবে কতখানি "অপমানিত" বোধ করবে তা কিভাবে প্রমাণ হবে? অন্য ধর্মকে গালাগালি করা তো আছেই, তার সাথে অন্য মুসলিমকে গালাগালি করা, কাফের মুরতাদ ফতোয়া দেয়া আমাদের অনেক আলেমেরই স্বভাব। সরকারের ক্ষমতা নেই তাঁদের ওপরে এ আইন প্রয়োগ করার। বাক্-স্বাধীনতার বিকল্প নেই, ওটা রেখেই সমাধান বের করতে হবে যা আইন দিয়ে অসম্ভব। 


হাসান মাহমুদ 

০৮ই নভেম্বর - ৪৫ মুক্তিসন (২০১৫ সাল )

Print