জঙ্গি উচ্ছেদে শরিয়া আইন

দেশে ইসলামের নামে জঙ্গি-বিস্ফোরণ ঘটেছে। সরকার প্রচণ্ড বিক্রমে জঙ্গি দমন ও নিধন করছে। কিন্তু শুধু বিষফল নিধন করেই স্থায়ী সফলতা আসবে না যদি বিষবৃক্ষ উচ্ছেদ করা না হয়।

জঙ্গিরা চায় কী? দেশ ও দুনিয়া যেভাবে চলছে তাতে ওরা অত্যন্ত বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ। ওদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা মানুষ খুন করে হলেও শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যে ‘আল্লাহর আইন’ প্রতিষ্ঠা করতে ওরা খুন করছে খুন হচ্ছে সে আইনগুলো ওরা যদি একটিবার পড়ে দেখত, তাহলে ওরা এ সর্বনাশা পথে পা বাড়াত না, বুঝতে পারত ওদের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে কী মারাত্মক ষড়যন্ত্র হয়েছে।

এখানে সেরকম কিছু আইনের উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

১. ‘রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা’ আইনে যে আটটা শর্ত আছে পুরুষ হওয়া তার অন্যতম। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৩য় খণ্ড ধারা ৯০০।

২. তওবা করলে গণহত্যাকারী, গণধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজকারীদের শাস্তি হবে না। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৩।

৩. ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে হুদুদ মামলা করা যাবে না। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ১৮৮ এবং ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৩য় খণ্ড নং ৯১৪গ।

হুদুদ মামলা হল খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মদ্যপান, মানহানী ও ইসলাম ত্যাগ।

৪. হুদুদ মামলায় নারী-সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। হানাফি আইন, পৃষ্ঠা ৩৫৩, শাফি’ই আইন ০.২৪.৯, ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড’ পৃষ্ঠা ২৫১, মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত ‘বাংলা কোরান’ পৃষ্ঠা ২৩৯, ‘পেনাল ল অব ইসলাম’ পৃষ্ঠা ৪৪, ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড ধারা ৫৭৬।

৫. হুদুদ মামলায় নারী-বিচারক অবৈধ। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ২য় খণ্ড ধারা ৫৫৪।

(৬) (স্বামীর) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড, ধারা ৩৪৪।

৭. বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১১, ধারা ১৪৯। দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নিচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৩৬১, শাফি’ই আইন ০.২৪.৩.৩, পেনাল ল অব ইসলাম পৃষ্ঠা ৪৬, ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৬৩।

৮. কোনো কারণে ধর্ষকের শাস্তি মওকুফ হইলে ধর্ষক ধর্ষিতাকে মোহরের সমান টাকা দিবে। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৩০১; শাফি’ই আইন এম.৮.১০।

৯. খাবার, বাসস্থান ও পোশাক দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে শুধুমাত্র বাধ্য স্ত্রীকে, অবাধ্য স্ত্রীকে নয়। এর বাইরের সব খরচ এমনকি ডাক্তারের, ওষুধের বা সৌন্দর্য্য-চর্চার খরচ ইত্যাদি হবে স্বামীর করুণা ও দয়া। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ১৪০; শাফি’ই আইন এম.১১.৪।

১০. “স্ত্রীর যে প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর জিম্মায় ওয়াজিব (বাধ্য), তা চারটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ– আহার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থান। স্বামী এর বেশি কিছু স্ত্রীকে দিলে অথবা ব্যয় করলে তা হবে অনুগ্রহ, অপরিহার্য নয়।” মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত ‘বাংলা কোরান’, পৃষ্ঠা ৮৬৭। বলাই বাহুল্য, স্ত্রী অবাধ্য কি না সেটা ঠিক করবে স্বামী নিজেই।

১১. বাবা-মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনির মৃত্যুদণ্ড হবে না। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ৬৫ ক ও খ; শাফি’ই আইন ০.১.২.৪।

১২. হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলবে না, চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে – বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড ধারা ৬০০)। এতে মুশকিল হল, চুরি-ডাকাতি-খুনের চাক্ষুষ সাক্ষী প্রায়ই পাওয়া যায় না, পারিপার্শ্বিক প্রমাণেই অপরাধীর শাস্তি হয়। এ আইন হলে বহু অপরাধীর শাস্তি হবে না।

১৩. তাৎক্ষণিক তালাকের পর স্ত্রী খাবার-বাসস্থান কিছুই পাবে না। সাধারণ তালাকের পর স্ত্রী তিন মাসের জন্য খোরপোষ পাবে। তারপর তারা কোথায় যাবে কী খাবে তার উল্লেখ নেই। হানাফি আইন, পৃষ্ঠা ১৪৫; শাফি’ই আইন এম.১১.১০, ১ ও ৩, পৃষ্ঠা ৫৪৬।

১৪. “কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না।” পেনাল ল অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪৯।

১৫. নিহতের পুত্র ও কন্যা থাকলে খুনিকে মাফ করতে শুধু পুত্ররাই পারে, কন্যারা নয়। ‘শরিয়া দি ইসলামিক ল’, ড. আবদুর রহমান ডোই, পৃষ্ঠা ২৩৫। এর মধ্যে রক্তমূল্যের দাবিও থাকার কথা।

১৬. আত্মীয়ের বাসা থেকে চুরি করলে বা মেজবানের বাসা থেকে মেহমান চুরি করলে তার হুদুদ শাস্তি হবে না। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৫৬ ও ১৫৭।

(১৭) বিবাহিতা যুদ্ধ-বন্দিনীদের বিয়ে তৎক্ষণাৎ বাতিল হয়ে যাবে। শাফি’ই আইন ০.৯.১৩।

১৮. যুদ্ধবন্দিনীদের সঙ্গে দৈহিক সংসর্গ করা (অর্থাৎ ধর্ষণ – লেখক) বৈধ। মউদুদি, তাফহীমুল কুরআন, সুরা নিসা আয়াত ২৪ এর ব্যাখ্যা।

১৯. মদ্যপানের সাক্ষী হতে হবে শুধুমাত্র দুজন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য। মেয়েদের বা পুরুষ-মেয়েদের মিলিত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ১৭৪।

২০. স্বামী তার স্ত্রীকে যখন ইচ্ছে তখনই তাৎক্ষণিকভাবে পুরো তালাক দিতে পারবে। কোনো কোনো কেতাবে আছে অত্যাচারের চাপে, নেশার ঘোরে বা হাসি-ঠাট্টাতে ‘তালাক’ উচ্চারণ করলেও পুরো তালাক হয়ে যাবে। হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৮১ ও ৫২৩, শাফি’ই আইন এন.৩.৫, ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ১ম খণ্ড ধারা ৩৫১, ৩৪৭, ৩৪৯, ‘বেহেশতি জেওর’ (দ্বীন কি বাতেঁ – মওলানা আশরাফ থানভি) আইন নং ১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫।

২১. “যে কোনো কর্মের বাস্তব সংঘটনই উহাকে অপরাধকর্মে পরিণত করে। বাস্তবে সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কর্মের জন্য কাহাকেও দায়ী করা যায় না।” ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৩য় খণ্ড ধারা ১২৮২।

অর্থাৎ হামলা বা খুন করার আগে জঙ্গিদের বা ডাকাতদের গোপন পরিকল্পনা-বৈঠক বন্ধ করা যাবে না। এ আইন হলে অপরাধীদের পোয়াবারো। কিন্তু অনেক সময়ই গুপ্তচরের সাহায্যে পুলিশ চুরি-ডাকাতি বোমাবাজি-খুন-গণহত্যা প্লেন-হাইজ্যাকের পরিকল্পনা আগে থেকেই জেনে ফেলে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। এতে জনগণের জানমালের সুরক্ষা হয় এবং অপরাধীরা ভয় পায়।

এই শারিয়া আইনগুলো দেখানো হয়েছে প্রধানত: ১. হানাফি আইনের বই ‘হেদায়া’, যেটা ইংল্যাণ্ডের ব্যারিস্টারি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত, ২. শাফি আইনের বই ‘উমদাত আল সালিক’, যেটাকে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সই ও স্ট্যাম্প দিয়ে সত্যায়িত করেছে, ৩. বি-ই-আ, বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, ৪. পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শরিয়া সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. আবদুর রহমান ডোইয়ে ‘শরিয়া দি ইসলামিক ল’, ৫. মওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা ‘কোরান’, ৬. ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড’, (৭) ‘পেনাল ল অফ ইসলাম’ ইত্যাদি থেকে।

‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ ও মওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত ‘বাংলা কোরান’ হাতের কাছেই আছে, ‘উমদাত আল সালিক’ এখন অন লাইনে ফ্রি পাওয়া যায়, আপনারা আইনগুলো মিলিয়ে দেখতে পারেন। হানাফী আইনের বই ‘হেদায়া’ এখনও অনলাইনে আসেনি।

এখন আপনারাই বলুন এসব আইন দিয়ে কি একটা রাষ্ট্র চালানো সম্ভব? তওবা করলেই গণহত্যাকারী, গণধর্ষণকারীদের শাস্তি হবে না? কেন হবে না? চোখের সামনে খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি হবে আর ‘নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়’? কেন? কোরান কোথায় নারীর সাক্ষ্য নিষিদ্ধ করেছে? রাসুল (সা.) কোথায় করেছেন? নারীরা বিচারক হতে পারবেন না কেন? স্বামীর কেন অধিকার থাকবে স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক তালাক দেওয়ার? কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোনো মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না কেন? নারী নেতৃত্ব তো কোরানেই বৈধ করা আছে, মুসলিম-বিশ্বের ইতিহাসেও অন্তত ১২ জন রানীর সফল ও দীর্ঘ শাসন আছে। ‘(স্বামীর) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে’ কেন? খুলুন কোরান, সুরা ত্বালাক, আয়াত ২: “তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিতে চাও তখন দুইজন সাক্ষী রাখিবে।”

শরিয়াতে এ রকম আরও শত শত ইসলামবিরোধী, নারীবিরোধী, মানবতাবিরোধী আইন আছে। জঙ্গিদের উৎসই হল এসব আইন প্রতিষ্ঠা করার বিভ্রম। এই বিভ্রমের কারণেই কোটি কোটি মুসলিম এমনকি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইসলামি সংগঠন ‘নাহদালতুল উলামা’ শরিয়া আইনের কঠিন বিরুদ্ধে। জাতিকে যদি এসব আইন দেখানো যায়, তবে আশা করা যায়, জাতি ওই ‘আল্লাহর আইন’-এর বিভ্রম থেকে বেরিয়ে আসবে, জঙ্গিপনার শেকড় উচ্ছেদ হবে। বিষবৃক্ষের শেকড় অক্ষত রেখে ডালপালা কেটে লাভ নেই। কারণ ওই শেকড় থেকে আবার ডালপালা গজাবে।

সূত্র বিশেষে আইনের কিছু পার্থক্য দেখা যায়, কারো দরকার হলে শরিয়া বইয়ের আইনগুলোর পৃষ্ঠার ছবি পাঠানো যেতে পারে। 

লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.

হাসান মাহমুদওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস রিফর্ম মুভমেন্ট আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য

http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/46629

Print