শিবিরকে “পিটিয়ে ঠিক করে দেব”?

আকাশকুসুম তত্বকথা নয়, বাস্তবের কথা বলছি। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রায় এক বছর ধরে এক পাইলট প্রজেক্টে কাজ করছে একাগ্র এক কর্মী বাহিনী। গবেষণা বই ও মুভি'র মাধ্যমে ইসলামী ও জামাতি কেতাব থেকে কয়েকশ' দলিল দিয়ে দেখানো হচ্ছে জামাতের ইসলাম অর্থাৎ মৌদুদিবাদ কোরানের কোন কোন আয়াতকে বিকৃত করেছে, কোথায় রসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কোথায় নিজেদেরই কথার উল্টো মেরেছে, হাদিসের নামে রসুলকে কি ভয়াবহ অপমান করেছে ও মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভয়ানক এক হিংস্র নারী-বিরোধী প্রগতি-বিরোধী অপতত্ব সৃষ্টি করেছে। কর্মী বাহীনির অক্লান্ত চেষ্টায় গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, মানুষ সজাগ হয়েছে, নারীরা ক্ষিপ্ত ও সোচ্চার হয়েছে, কয়েকটা গ্রাম জামাত-ফ্রী করা সম্ভব হয়েছে। কয়েকটা গ্রাম যদি জামাত-ফ্রী হতে পারে সারা দেশই হতে পারে। দরকার শুধু উপযুক্ত অস্ত্রের উপযুক্ত প্রয়োগ। পুরো রিপোর্ট আর কিছুদিন পরে দেব।

গত ক'মাস ধরে দেশে শিবির ও পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটছে। শিবিরকে জামাত অনেক মোটর বাইক দিয়েছে যা দিয়ে ওরা বিভিন্ন হরতালে পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা করেছে, পুলিশও কৌশল করে বেশ কিছু শিবির-নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের রিম্যাণ্ডে নিয়ে গুরুতর অত্যাচার করেছে। এতে সুশীল সমাজসহ পরিচিত বেশীরভাগ মানুষ আনন্দিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য একাত্তরে জামাতের কসাইপনাই এর জন্য দায়ী। কিন্তু আমি অন্যদিকে হতাশ হয়েছি। শিবির হল ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক দল,ওক্ষেত্রে "পিটিয়ে ঠিক করে দেব" আপাত আকর্ষণীয় হলেও ওটা বরং ব্যাকফায়ার করে, অত্যাচারে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। নি:সন্দেহে, ছাত্রলীগ ছাত্রদলের মত শিবিরেরও হিংস্রতার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু লীগ-দলের ক্রাইম থেকে শিবিরের ক্রাইম আলাদা। লীগ-দল ক্রাইম করে ব্যক্তিগত স্বার্থে, শিবির করে ধর্মবিশ্বাস থেকে।

শিবিরের তো ফুল দেখে ফুল আর গান শুনে গান হয়ে ওঠার বয়স। এই মায়াময় বযসে যখন ওদের প্রকৃতির ও বিজ্ঞানের রহস্য নিয়ে কৌতুহলী হবার কথা, গান-বাজনা কবিতায় বিভোর থাকার কথা তখন ওরা জীবন বাজী রেখে এত কষ্ট করছে কেন, এত হিংস্র হচ্ছে কেন আর এত অত্যাচারই বা সইছে কেন? মিসরে পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে ওদের ক্রমাগত পেটানো হয়েছে – ওদের দলকে বেআইনী করে নেতাদের ফাঁসী পর্য্যন্ত দেয়া হয়েছে কিন্তু আজ ওরা গণভোটে জনগনের সমর্থনে সরকারী ক্ষমতায় আসীন। অবিশ্বাস্য সত্য হল আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ জিন্নাহ'র পাকিস্তান, নাসেরের মিসর, ড: মোসাদ্দেকের ইরাণ, সুকর্নো'র ইন্দোনেশিয়া, কামালের তুর্কীস্থান সবই আজ ওদের দখলে। এই ভয়াবহ ধর্মীয়-রাজনৈতিক ডিগবাজী সম্ভব হল মাত্র একটা কারণে। ওইসব নেতারা রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করেছিলেন সংবিধান ও সামরিক বাহীনির শক্তিতে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে তাঁরা ভ্রান্ত ছিলেন। ওই নেতারা ইসলামী দলিল ধরে ধরে জনগনকে শেখাননি কেন ইসলামের জামাতি ব্যাখ্যা আসলে কোরান-রসুলের বিরোধী এবং সেই মরীচিকার পেছনে ছুটে বিশ্ব-মুসলিমের, বিশেষত: নারীদের কি সর্বনাশ হয়েছে। শেখালে জনগনই ওর বিরুদ্ধে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে যেত যেমন হয়েছে তাতারস্থানে। ওখানকার গ্র্যান্ড মুফতি সুফী মানুষ, জনগনকে জামাতি-ইসলাম সম্বন্ধে তিনি সতর্ক করে রেখেছেন, সেই গণপ্রতিরোধের জন্যই ওখানে বিশ্ব-জামাত নাক গলাতে পারে নি। এ থেকে শিক্ষা না নিলে আমরাও একদিন মিসরের মত জনতার ভোটেই শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারি। আমাদের জনগণ এখনো জানে না কেন আমাদের সুফিদের প্রতিষ্ঠিত অরাজনৈতিক ইসলামই কোরান-রসুল মোতাবেক বেশী বৈধ, কেন জামাতের ইসলাম ইসলাম-বিরোধী।

শিবিরও সেটা জানে না। ওরা শিবির হয় আদর্শের অমোঘ আকর্ষণে। চারদিকে বাড়ছে অত্যাচার আর দুর্নীতি। সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। দেশের একটা ক্ষেত্র নেই যেখানে মারাত্মক রকম দুর্নীতি নেই। বাড়ছে দুর্বলের ওপর শক্তিমানের খোলামেলা অত্যাচার। বাড়ছে সমাজে চোর ডাকাত, খুনী ধর্ষকদের গর্বিত পদচারণা,বাড়ছে রাজনীতিতে ক্রিমিন্যালদের উদ্ধত রাজত্ব । পুলিশ আর RAB প্রায়ই নিরপরাধের ওপর কি অত্যাচার করে তা সবাই জানে। নারীরা হয়ে পড়েছে অরক্ষিত, বাড়ছে ধর্ষকদের গর্বিত উপস্থিতি। ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজী, সন্ত্রাস, গুমখুন, অপহরণ, পরকীয়া, যৌন-অনাচার আর মাদক। এ অবস্থায় তারুণ্যের মনে ক্ষোভ আর ক্রোধ জমবেই, বিকল্প সে খুঁজবেই ।

 ক'দশক আগে সে বিকল্প ছিল বামতত্ত্ব, লক্ষ তরুণ ঝুঁকে পড়ত সেদিকে। এখন সেটা নেই,তার জায়গা দখল করেছে ইসলামী রাষ্ট্রের তত্ত্ব। ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্পে এতে আছে "আল্লার আইন"-এর শক্তিশালী ও মোহময় আকর্ষণ, আছে ইহকাল পরকালে মহামুক্তির আহ্বান, আছে বেহেশতের হাতছানি। আছে রসুলের মদীনা "রাষ্ট্র", আছে মদীনা-সনদ, আছে চার খলিফার উদাহরণ, আছে হাজার বছরের খেলাফত-ঐতিহ্যের স্বপ্ন, আছে ইসলামী রাষ্ট্রের চেষ্টা না করলে দোজখে যাবার প্রচণ্ড ব্ল্যাকমেইলিং। অথচ ওগুলোর প্রত্যেকটি কোরান-রসুল মোতাবেকই কেন অবৈধ তা শিবিরকে জানতে দেয়া হয় না। সেই সাথে আছে ওদের চেষ্টার বিরুদ্ধে যে কোনো বাধাকে "যে কোনো উপায়ে" পরাজিত করা (একাত্তরে জামাত সেটাই করেছে) এবং সেই সাথে আছে “ইসলামী রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠায় যেকোনো কষ্ট-অত্যাচার সহ্য করার, এমনকি প্রাণ পর্য্যন্ত বাজী রাখার সুগভীর তৃপ্তি। সেটা ওদের কাছে ইবাদত। এই ধর্মীয় আবেগের শক্তি প্রচণ্ড। সরকার বা পুলিশ এমনকি কোনো সৈন্য বাহিনীরও সাধ্য নেই তার গায়ে আঁচড় ফেলে, পরাজিত করা তো দুরের কথা। ইতিহাসের শিক্ষাই এই যে অত্যাচার করে কোনোদিন কোনো ধর্মবিশ্বাসকে পরাজিত করা যায় নি, যাবেনা ।

তাহলে ? আমাদের প্রজন্মের একটা অংশ কি এভাবে নিজের অজান্তে ইসলামের একটা ভয়ংকর অপতত্বের লেজুড় হতেই থাকবে, জাতির ওপর অভিশাপ হতেই থাকবে ? কোনো কি পথ নেই ওদের অন্তত: একটা অংশকে ফেরানোর? আছে, মোক্ষম পথ আছে। জীবনে কেউই ঠকতে চায় না। শিবিরকে জানানো সম্ভব যে ওদেরকে ঠকানো হয়েছে। ইসলামের যে অপব্যাখ্যাকে ইসলাম হিসেবে ওদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছে সেটা আসলে যে কোরান-রসুলের প্রতি কি নিদারুন বিশ্বাসঘাতকতা সেটা ওই কোরান-রসুল-শারিয়া এবং জামাতি বই থেকেই শত শত দলিল ধরে ধরে দেখালে নিশ্চয় ওদের অন্তত: একটা অংশ ইসলামের ওই অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে যা শুরুতে বলেছি। একাত্তরে সামরিক যুদ্ধে জিতবার পর একটা বড় ভুল করেছিলাম আমরা। জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান মসজিদটাই ছেড়ে রেখেছিলাম পরাজিত প্রতিপক্ষের হাতে। ওরা সেই সুযোগটাই পুরোপুরি নিয়েছে, সেই খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ছে জাতির মন মানসে, তৈরী করছে শিবির। তাই এখন ওদের বিরুদ্ধে জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ চলতে থাকুক, কিন্তু সেই সাথে দেখানো দরকার ধর্মীয় দলিলও।

কি দেখাব ওদের? কোন বক্তৃতা দেব না - শুধু দেখিয়ে যাব কোন সে ষড়যন্ত্রে এক আল্লাহ'র পাঁচ রকম "আল্লার আইন" হয়, সেগুলোর মধ্যে কত ব্যাপক সংঘাত। দেখাব, একই মামলায় এক "আল্লাহ'র আইন"-এ মৃত্যুদন্ড অন্য "আল্লাহ'র আইন"-এ বেকসুর খালাস। দেখাব, গণহত্যা-গণধর্ষণ লুটপাট অগ্নিসংযোগ (একেবলে হিরাবা - যাকিছু জামাত একাত্তরে করেছে) এসব ভয়ানক ক্রাইমের ক্রিমিন্যালেরা শারিয়া আদালতে কোনই শাস্তি পাবে না যদি তারা তওবা করে – বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড ধারা ১৩। কিংবা, ইসলামী রাষ্ট্রে খুন, জখম,চুরি, ডাকাতি পরকীয়া ইত্যাদির জন্য সবার শাস্তি হবে শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া - বিধিবদ্ধইসলামী আইন ৩য় খণ্ড ধারা ৯১৪ গ। এটা হানাফি আইন হেদায়াতেও আছে ১৮৮ পৃষ্ঠায়। এ রকম কোরান-রসুল বিরোধী নারী-বিরোধী শত শত হিংস্র আইন যদি জাতিকে ক্রমাগত দেখানো যায় তাহলে জাতি শক্তহাতে ইসলামের ওই বিকৃত ব্যাখ্যা প্রতিহত করে পারবে, শিবিরও নিশ্চয় বুঝতে পারবে যা তাদের "আল্লার আইন" বলে বিশ্বাস করানো হয়েছিল সেটা আসলে সাংঘাতিক ইসলাম-বিরোধী। তখন ওদের একটা অংশ এসব আইনের বিরোধীতা করবেই।

সেটাই করা হয়েছে তৃণমূল থেকে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে, এবং সেটা সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। সবাই মিলে ওই পদ্ধতিতে চেষ্টা করলে তাতারস্থানের মত আমাদের জনগণও দেশকে ইসলামের ছদ্মবেশী জামাতের ওই হিংস্র মৌদুদিসলামকে উচ্ছেদ করতে পারবে।

হাসান মাহমুদ

২৬শে ডিসেম্বর ২০১২ 

Print