স্বপ্ন!

Written on 28 March 2024. Posted in Literature :: Bangla

(সংক্ষেপিত – এর চেয়ে সংক্ষেপ করলে নষ্ট হয়ে যাবে – পুরোটা পাওয়া যাবে আমার বই ‘‘বাংলার কথা কই’’-তে।)

**************************************************
তিরিশ বছর আগের আবুধাবী। আজকের মত দীপাম্বিতা সৌধশ্রেণী সংকলিতা নয়, ছোট ছোট কুঁড়েঘরে ঢাকা শহরে কয়েকটা মাত্র দালান। দুই কামরার এক ব্যাচেলর মেসে একদিন সান্ধ্য আড্ডা জমেছে তুমুল। ধড়াম করে দরজা খুলে ঢুকল কেউ, ধড়াম করে দরজা বন্ধ করল। রুদ্ধশ্বাসে দু’চোখ তার আতংকে বিস্ফারিত। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে সে। সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে রাস্তা পার হতে গিয়ে কানের কাছ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেছে মাইক্রোবাস, একটু এদিক ওদিক হলেই মাথা ফেটে যেত। তারপর আড্ডায় এই রকম কথা হল।

‘‘জাপানী স্কুলের মাইক্রোবাস, নাম লেখা আছে গায়ে। স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছিল বাসায় পৌঁছে দিতে’’।
‘‘বৃটিশ অ্যামেরিকান সবাই নিজেদের স্কুল বানিয়েছে এখানে, নিজস্ব মাইক্রোবাসে বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করে’’।
‘‘কিন্তু আমাদের বাংলাদেশীদের স্কুল নেই’’।
‘‘আমাদের বাংলাদেশীদের স্কুল নেই কেন?’’
‘‘আমাদেরও স্কুল চাই’’।
‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, – আমাদেরও স্কুল চাই …… ’’।

সারা রাত ধরে মরুতামসের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল নামহীন কিছু কিশোরের স্বপ্ন- ‘‘আমাদেরও স্কুল চাই’’। সারারাত ধরে গুরুত্বপুর্ণ সভা করল আকাশের গ্রহ-তারা ফিসফিস করে, তারপর অলক্ষ্যে কোথাও কিছু একটা সিদ্ধান্ত হল। পরদিন সেই ছেলেগুলো তাদের স্বপ্ন গিয়ে হাজির জালাল ভাইয়ের বাসায়। সিলেটের সুদর্শন যুবক, পাওয়ার হাউসের ইঞ্জিনিয়ার। কি? না – আমাদেরও স্কুল চাই। মন দিয়ে তিনি শুনলেন কথাগুলো, যেন দিব্যচোখে দেখলেন এবং স্পর্শ করলেন স্বপ্নটা। তার কিছুদিন পর সদলবলে সবাই গিয়ে পড়লেন গোলাম রহমানের অফিসে, স্কুল প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেবার জন্য।

কিছু লোক থাকে যাদের বয়স অনুমান করা অসম্ভব। ছিপছিপে এ বুড়ো এ বয়েসেও রূপবান সরস, যেন আঙ্গুর থেকে কিসমিস হয়েছেন। সিলেটের লোক, পুর্ব পাকিস্তান সরকারের চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। রিটায়ার করতেই বাঙালী ধনকুবের জহুরুল ইসলাম তাঁকে হাইজ্যাক এনে বসিয়ে দিয়েছে তার আবুধাবীর বিখ্যাত কনষ্ট্রাকশন কোম্পানি বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের কর্ণধার হিসেবে। কিন্তু এই কর্ণধার বলতে গেলেতাদের কর্ণ ধরেই তাড়িয়ে দিলেন। বললেন – ‘‘বড় কাজ করতে চাও, শুরুতেই ভজঘট? যাও, গো ব্যক। আমার সেক্রেটারিকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বানাও, সেই মোতাবেক এসে দেখা কর।

বাইরে এসে বিনয় ভুরু কুঁচকে সন্দেহে বলল – ‘‘বুড়া হালায় আমাগো অপমান করল নাকি রে’’? কামাল দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘‘বুঝতাছি না দোস্ত’’।

দু’দিন পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট মাফিক রাজকীয় নাস্তায় ভরপুর টেবিল আর তার সুগন্ধে ম’ ম’ অফিস ঘর। সেই থেকে প্রায় দু’বছর নেতৃত্ব দিলেন তিনি। প্রথম কাজ দিলেন, কত ছাত্র জোগাড় করা যাবে, শিক্ষক কারা হবে, স্কুল কোথায় হতে পারে এসব রিপোর্ট দিতে। সপ্তাহ প্রচুর ঘোরাঘুরি করে সন্ধান পাওয়া গেল এক রত্নখনির। কাজী ওবায়েদ ভাই কারো জন্য অপেক্ষা করেন নি, বন্ধু-বান্ধবের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিজের উদ্যোগে অনেক আগেই এক বাসায় ক্লাশ শুরু করেছেন বাচ্চাদের বাংলা শেখানোর। কেউ কি কোনদিন মনে রাখবে আবুধাবীর মরুতে সেই প্রথম ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছিল অ-তে অজগর, আ-তে আম, ই-তে ইঁদুর, ঈ-তে ঈগল…………….! কাজী ওবায়েদ ভাই সেই পথিকৃৎ। সেই দুর্দিনে তাঁর বাংলা-ক্লাশের আটাশ জন মনে হল আটশ’ বাচ্চা। পরের মিটিং-এ গদ গদ খুশীতে গোলাম রহমানকে রিপোর্ট দেয়া হল- আটাশ জন ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেছে। যেন হাতে চাঁদ পাওয়া গেছে! আর ভাবীরা সবাই বড় বড় পরীক্ষা পাশ করে এসে কেবল ঘন্টা ধরে ফোনে আড্ডা দেন আর দাওয়াত খান, তাঁরা খুশী মনে রাজী হয়েছেন বিনে পয়সায় মাষ্টারী করতে।

ভেটো দিয়ে বসলেন নেতা। বিনামূল্যের মাষ্টার দিয়ে শিক্ষা হয় না। ওসব ফাঁকিবাজী চলবে না, মাষ্টারদের বেতন দিতে হবে। মাথায় বাড়ি সবার। বলে কি লোকটা! এমন বোকামীর কোন মানে হয়, বিশেষ করে ভাবীরা নিজেরাই যখন পয়সা ছাড়া রাজী! কিন্তু উপায় নেই – ভাবীদের বলা হল নামমাত্র হলেও কিছু বেতন নিতেই হবে। ভাবীরা অগত্যা রাজী হলেন, মাসে পাঁচশ’ দিরহাম করে নেবেন তাঁরা প্রত্যেকে। পরের সপ্তাহের মিটিং-এ আবার ভেটো দিয়ে বসল বুড়ো, অন্যান্য স্কুলে সর্বনিম্ন কি বেতন দেয় সে খবর নিয়ে এস। হুবহু সেই বেতনই দিতে হবে, তোমরা নিশ্চয়ই চাওনা যে আন্তর্জাতিক সমাজে বাঙ্গালী স্কুলকে কেউ মিসকিন বলুক?

এ কথা তো ভাবেনি কেউ! না, নিশ্চয়ই সেটা কেউ চায় না। উপস্থিত সস্তার লোভে এই জরুরী কথা ভোলেন নি আমাদের দূরদর্শী নেতা। অন্যান্য স্কুলে খবর নিয়ে আবার সবার মাথায় বজ্রাঘাত হল। ইউরোপ-অ্যামেরিকা-জাপানের কথা থাক, পাকিস্তানী স্কুলের মাষ্টারদের বেতনটাই বারো-তেরোশ’ দিরহাম মাসে। অত পয়সা কোত্থেকে আসবে? পরের মিটিং-এ রিপোর্ট দিয়ে মুখ হাঁড়ী করে বসে রইল সবাই, কিন্তু উৎফুল্ল হয়ে উঠল বুড়ো। সিদ্ধান্ত লেখা হল, মাষ্টাররা মাসে ওই বেতনই পাবেন। কে যেন খুশী হয়ে বলল, তার মানে আপনার কোম্পানী এ টাকাটা দেবে? শুনে হাই পাওয়ারের চশমার ভেতর থেকে জ্বলজ্বলে আলুচেরা চোখে তাকালেন তিনি। বললেন, দয়ার দান নেবে না বাংলাদেশ স্কুল। আর, উপহার নিতেও যোগ্যতা চাই, ওটা এখনো নেই আমাদের।

তাহলে? টাকাটা আসবে কোত্থেকে? নেতা-ই সমাধান দিলেন। আপাততঃ অর্ধেক বেতন ক্যাশ নেবেন মাষ্টাররা, বাকী অর্ধেক খাতায় লেখা থাকবে দেনা হিসেবে। যদি কোনদিন স্কুল নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তবে সে দেনা শোধ করতে হবে সর্বপ্রথম, অন্য কোনোকিছু করার আগে। চিঠি লিখে দিলেন তিনি, মদিনা জায়েদের আরবী স্কুলের হেডমাষ্টারের কাছে। সকাল আটটা থেকে বেলা দু’টো পর্য্যন্ত তোমাদের আরবী স্কুল, – তার পরে পুরো দালানটা খালি পড়ে থাকে। আমাদের অনুমতি দাও, আমরা বাংলাদেশ স্কুল খুলব চারটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্য্যন্ত। তখনো আবুধাবীতে স্কুল-বোর্ডের আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠে নি, হেডমাষ্টারই স্কুলের সর্বেসর্বা। এ হেন অনুরোধ হেডমাষ্টারের জীবনে এই প্রথম, আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল লোকটা। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, এ আর বলতে! তালিমই মানুষকে মানুষ বানায়, না হলে মানুষ জামাল (উট) থেকে যায়। যাও, বিকেল থেকে স্কুল তোমাদের সম্পত্তি। পানি বিজলী সব ফ্রী করাই আছে সরকার থেকে, দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি ও সব দেখাশোনা করবে, সম্ভব হলে ওকে দু’চার দিরহাম ‘‘বাখ্শিস্’’ দিও। দারোয়ানটা ইয়েমেনী, বাসা তার স্কুলের পাশেই।

সেই একটা আশ্চর্য্য দিন এসেছিল মরুভুমিতে, সেই এক মাহেন্দ্রক্ষণে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ স্কুল। সুস্মিত বিষ্ময়ে সেদিনের সুর্য্য দেখেছিল, স্কুলের আঙ্গিনায় বালুর মধ্যে আনন্দে ছুটোছুটি করছে আমাদের আটাশটা বাঙ্গালি বাচ্চা। বাংলায় হাসছে বলছে, খুনসুটি করছে, দৌড়দৌড়ি করে খেলছে, আর স্কুলের ক্লাসে বাংলায় পড়া শেখাচ্ছেন বাঙ্গালী শিক্ষয়িত্রী, অ তে অজগর, আ তে আম…………! মরুর বালুতে যেন অদৃশ্য এক শহীদ মিনার ফুটে উঠছে, হাজার মাইল সুদুরে ঢাকার শহীদ মিনারের মুখে তখন তৃপ্তির মৃদুহাসি। হাসি তখন জালাল ভাই ওবায়েদ ভাইয়ের মুখেও। আজ এত বছর পরেও এসব স্মৃতি মনে হলে চোখে পানি এসে যায়। এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন কিছু উৎসাহিত অভিভাবক। সবচেয়ে উল্লসিত সেই ইয়েমেনী দারোয়ান, মহা উৎসাহে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে, ওদের ফেলা ময়লা হাসিমুখে পরিস্কার করছে। লক্ষ দিরহামেও শোধ হত না ওই বিদেশী লোকটার ওই অযাচিত øেহ, ওই সহাস্য পরিশ্রম – ক’টা দিরহামই বা ওকে দেয়া গেছে!

ফয়জুল্লা ভাবী (পতির নামে সতির নাম হল বিদেশে বাঙ্গালী সংস্কৃতি) হলেন হেড মিষ্ট্রেস, আবুধাবীতে চালু হয়ে গেল বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল, যেন উৎসবের বন্যা বয়ে গেল শহরে। এতদিন যাঁরা পড়শোনার অসুবিধের জন্য বৌ-বাচ্চাদের দেশ থেকে আনতেন না, এবার তাঁরা ইমিগ্রেশন অফিসে ছুটলেন পরিবারের ভিসার জন্য। গোলাম রহমানের বশবিদ্যায় বাংলাদেশ এমব্যাসী আর জনতা ব্যাংকে শুরু হয়ে গেল চাঁদাবাজী। ওখানে পা’ ঠেকালেই দিতে হচ্ছে পাঁচ দিরহাম করে স্কুল-চাঁদা। প্রবাহে আসতে থাকল দিরহাম, অনতিবিলম্বে শোধ হয়ে গেল ভাবীদের বকেয়া বেতন।

সেই শুরু। এরপরে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী বাড়ল, স্কুল-কমিটি বানানো হল, পরে কি এক কারণে মদিনা জায়েদ থেকে রোদা ক্লিনিকের পাশের আরবীস্কুলে চলে গেল আমাদের স্কুল। সেখানে শুধু বাচ্চাদের নিয়ে করা হল বিচিত্রানুষ্ঠান, সাথে রইলেন এমব্যাসীর কমার্শিয়াল অ্যাটাচী হেলাল ভাই আর রেহানা ভাবী। লেবার অ্যাটাচী সুগায়ক বোরহান ভাই আর তাঁর সুগায়িকা স্ত্রী স্কুলের একটা মর্মসংগীতই তৈরী করলেন। সাথে রইলেন আমাদের গ্রেট লালা-দা’ (সরিৎ কুমার লালা) ও তাঁর স্ত্রী অনন্যা গায়িকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বুলবুল মহলানবীশ। এদিকে প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ জানালেন আমরা যত টাকা তুলব তিনি তত টাকা দেবেন। অনেক টানাহ্যাঁচড়ার পর শেখের এক বাঙ্গালী বন্ধুর মাধ্যমে সরকার থেকে স্কুল তার নিজস্ব জমি পেল মরুর নামের এলাকায়, বিêিং তৈরীর নক্শা কম পয়সায় করে দিল শামসুল আলম ভাইয়ের আর্কিটেকচার কোম্পানি, তালপাতার সেপাই শরীর নিয়ে সিন্হা দা’ দিনরাত খাটলেন এ নিয়ে। তারপরে একের পর এক স্কুলের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কারা যেন, তারপরে টেলিফোনের পদস্থ অফিসার ফজলুর রহমান। আর তার পরে একই সাথে স্কুলের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আর বাংলা নাট্যগোষ্ঠির নেতা হলেন সকলের প্রিয় ডঃ জাফর সাদিক, অনন্য এক বাঙ্গালী দশভুজ।

বর্ষার পুকুরে প্রাণবন্ত কলমী শাকের মত স্কুল এতটাই বেড়ে উঠল যে পেশাগত শিক্ষাবিদের দরকার হল। বাংলাদেশ থেকে ভিসা দিয়ে আনানো হল ঢাকার শাহীন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা (?) বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মিঃ শাহীনকে। তাঁর অভিজ্ঞ হাতে একেবারে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলল বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল। দুঃখের কথা, প্রায় দু’বছর পর হজ্ব করতে গিয়ে তিনি পোষাক পাশপোর্ট পেছনে রেখে লুঙ্গী-চপ্পল পরে এমনই হারিয়ে গেলেন যে বহু চেষ্টাতেও আর কোনদিনই তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় নি। অনেক হাত বদলের পর কমিটির জি-এস হিসেবে শক্ত হাতে হাল ধরলেন নাসরুল ওয়াহিদ ভাই। কয়েক বছরের প্রচ¨ পরিশ্রম আর তীক্ষ্ম নেতৃত্বে স্কুলকে তুঙ্গে পৌঁছিয়ে তিনি বিদায় নিলেন ক্যানাডার নাগরিকত্ব নিয়ে।

আজ কয়েক একর জমির ওপরে সে স্কুলের সুবিশাল দালান। যে স্কুলের মাষ্টারের অর্ধেক বেতন খাতায় বাকী লিখতে হয়েছে, আজ সে স্কুলের অ্যাকাউন্টে ফিক্সড্ ডেপজিট আছে আ-ট ল-ক্ষ দিরহাম। আগে যে বাংলাদেশীরা পাকিস্তানী বা ভারতীয় অ্যাসোসিয়েশনের মিলনায়তনে বিচিত্রানুষ্ঠান করতে বাধ্য হত এখন তারা নিজেদের স্কুলে শক্তিশালী শব্দ-যন্ত্রের সুবিশাল মিলনায়তনে একুশে ছাব্বিশে আর ষোলই উদ্যাপন করে। আটাশ দিয়ে শুরু হয়েছিল যার, আজ সে স্কুলে প্রায় চার শ’ ছাত্র-ছাত্রী! ছোট্ট কিছু ক্লাস নিয়ে জন্ম হয়েছিল যার, আজ সে স্কুলে ঢাকা বোর্ডের এস-এস-সি পরীক্ষা হয়, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাও হয়!! ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্র আসে, ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে পরীক্ষার খাতা ঢাকা বোর্ডে ফেরৎ যায়। এমব্যাসীর অফিসারেরা পরীক্ষা হলে টহল দেন। এত সাফল্য, এত সুখ আমরা রাখব কোথায়!

আর? আর আজ বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করে স্কুলের নিজস্ব দু’টো বিশাল আকৃতির বাস। তার সাথে ভাড়া করা আছে আরও পাঁচটা মাইক্রোবাস।

মাইক্রোবাস! সেই মাইক্রোবাস যা থেকে দীর্ঘ তিরিশ বছর আগে এই স্কুলের স্বপ্ন দেখেছিল কিছু নাম না জানা পরিচয়হীন বিত্তহীন কিশোর, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসাধ্যসাধনে আর সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেতারা। সেই স্বাপ্নিক কিশোরের দল এখন জীবনের ধাক্কায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে চারিদিকে, কারো চোখে আজ নুতন কোন স্বপ্ন ঝিকমিক করে কি না জানি না।


পৃথিবীতে শতকরা নিরানব্বই জন মানুষের শতকরা নিরানব্বইটা স্বপ্ন কখনো সফল হয় না। তবু স্বপ্ন থাকতে হয়, স্বপ্নই জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি। মরুভুমির ওপরে গর্বিত দাঁড়ানো ওই বিশাল স্কুল, সারি সারি ওই ক্লাশরুম, ওই ল্যাব – ওই মিলনায়তন – ওই বাংলা-বিদ্যাপিঠ আমাদের সেই স্বপ্ন, সেই দিকবর্তিকা। না-ই বা থাকল কোন ফটোগ্রাফ সেই স্বাপ্নিক কিশোরদের, না-ই বা থাকল কোন দলিল। না-ই বা মনে রাখল কেউ। কিচ্ছু আসে যায় না তাতে। ব্যাপারটা বিশাল, আরো অনেকের অবদান আছে নিশ্চয়ই। এ নিবন্ধে কোনো কোনো নাম নিশ্চয়ই বাদ পড়ে গেছে আমার অনিচ্চ্ছায় বা স্মৃতিভ্রংশে, – তাঁরা আমাকে ক্ষমা করবেন আশা করি। এই হল সেই স্বপ্ন যেখানে কেউ আওয়ামী লীগ বি-এন-পি নয়, জামাতি বা জামাত-বিরোধী নয়। জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী – এই এক জায়গা যেখানে সবাই মাতৃভুমির সন্তান, মাতৃভাষার সন্তান। এই একমাত্র জায়গা যেখানে গোলাম আজম আর ফতেমোল্লা হাতে হাত রেখে কাজ করবে । তাই তো বিদেশের বালুতে গড়ে উঠতে পেরেছে জাতির মর্মর বিদ্যাকেন্দ্র! আবুধাবীতে যদি হতে পারে, হতে পারে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যদি চোখে স্বপ্ন থাকে। স্কুল যদি হতে পারে, হতে পারে যে কোন বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান যদি চোখে স্বপ্ন থাকে। তখন যদি হতে পারে, হতে পারে এখনও – এবং সর্বদা সর্বত্র।

বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে অনেক স্বপ্নকেই বাস্তব মনে হয়, অনেক বাস্তবকেই স্বপ্ন মনে হয়। আবুধাবীর ওই বিশাল বাংলাদেশ স্কুলের বাস্তবকে যেন স্বপ্ন মনে হয় আজ এই তিরিশ বছর পর। ওখানে ছিলাম আমি…….. আমি, বিনয় আর কামালের সেই ভাড়া করা মায়াময় ভাঙ্গাবাড়িতে …….আমাদের সেই সন্ধ্যার আড্ডায়……জাপানি স্কুলের সেই মাইক্রোবাস আর সেই নাম না-জানা কিশোরদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন……….

আবুধাবীর অভ্রভেদী গর্বিত বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল!

 

 হাসান মাহমুদ ||

Print