(Bdnews24.com-এ ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত আমার নিবন্ধে অঙ্গদানের পক্ষে আরো ইসলামী সূত্র যোগ করে এটা লিখেছি যাতে অন্ধবিশ্বাসীরাও অঙ্গদান করতে উৎসাহী হন :- https://bangla.bdnews24.com/opinion/75axy75qfq
ইসলামে অঙ্গদান : ওই কিডনিটা কোথায় যাবে? (উৎসর্গ - সারাহ ইসলামকে)
হাসান মাহমুদ
**********************
প্রশ্ন। পরকালের শাস্তি ও পুরস্কার সবই দেহ-নির্ভর যেমন দোজখের আগুন ও বেহেশতের খাদ্য-পানীয় তহুরা শরাব। সহি বুখারি অষ্টম খণ্ড, হাদিস ৫৩১ (ও ১ম খণ্ড ১১৫, ২য় খণ্ড ২২৬, ৪র্থ খণ্ড ৫৬৮ ও ৬৫৬, ৬ষ্ঠ খণ্ড ১৪৯ ও ২৬৪, ৭ম খণ্ড ৭৩৫, ৮ম খণ্ড ২৩৭, ৫৩১, ৫৩২, ৫৩৩, ৫৩৪):- “ইবনে আব্বাস বলিয়াছেন, রসূল (স.) বলিয়াছেন তোমরা খালি পায়ে হাঁটিয়া আল্লাহর সম্মুখীন হইবে নগ্ন এবং খৎনা-বিহীন ভাবে”।
অর্থাৎ কেয়ামতে মানুষ শরীর নিয়ে উঠবে। এবারে ধরুন, কোনো খুনি-ধর্ষকের কিডনি এক মুসলিম দরবেশকে দেওয়া হলো কিংবা কোনো দরবেশের কিডনি এক খুনি-ধর্ষককে দেওয়া হলো। ইসলাম ধর্মবিশ্বাস মাফিক খুনি-ধর্ষক দোযখে যাবে আর মুসলিম দরবেশ বেহেশতে যাবেন।
তাহলে প্রশ্ন: ওই কিডনিটা কোথায় যাবে?
*******************************
১৮ জানুয়ারি ২০২৩ - শৈশবের অনারোগ্য ব্যাধিতে ১৯ বছর বয়সে সারাহ ইসলাম দুনিয়া ছেড়ে গেলেন, অমর হয়ে রইলেন "দেশের প্রথম মরণোত্তর অঙ্গদানকারী" হিসেবে কিডনি ও চোখ দান করে। তাঁর কিডনি নিয়ে দুজন মানুষ মৃত্যু থেকে বেঁচে গেছেন ও তাঁর দুই কর্নিয়া নিয়ে দুজন ফিরে পেয়েছেন তাঁদের দৃষ্টি। আশা করি তাঁর এই মহৎ উদাহরণে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই মরণোত্তর কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গ দান করবেন, কারণ দেশে বহু মানুষ সুস্থ অঙ্গ নিয়ে মারা যান অথচ তাঁদের অঙ্গ পেলে বহু রোগী সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতেন।
কোরান-হাদিসে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু নেই। বিষয়টার সাথে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রীয় আইন, গণমানস ও এর পক্ষে-বিপক্ষে ইসলামী ধর্মবিশ্বাস। ব্যাপারটার ইসলামী আঙ্গিক আমরা সংক্ষেপে তিনভাগে দেখব (ক) বিরোধিতা, (খ) সমর্থন, ও (গ) জটিলতা। আদি ইসলামী কিতাবগুলোতে প্রায়ই বিপরীত সিদ্ধান্তের দলিল পাওয়া যায় বলে আলেমরা বিপরীত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। তাই আমাদের দেখতে হবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বা হুকুমের পেছনে প্রজ্ঞাটা কি এবং তাতে জীবনের বা সমাজের কি মঙ্গল/অমঙ্গল।
(ক) অঙ্গদানের বিরোধীরা বলেন:-
(১) জীবিত বা মৃত শরীরের ক্ষতি করা, আত্মহত্যা বা অঙ্গদানের অধিকার মানুষের নেই। কারণ শরীর আল্লাহর তরফ থেকে আমানত মাত্র, এর মালিক মানুষ নয় বরং আল্লাহ।
(২) হাদিসে মৃতদেহকে সম্মান দিয়ে বলা হয়েছে "মৃতের ও জীবিতের হাড় ভাঙ্গা একই কথা" - আবু দাউদ হাদিস ৩২০১। এর সমর্থনে আছে নবীজী (স)বলেছেন "মৃতকে অসম্মান করিওনা কারণ তাহাতে জীবিত আহত হয়" - তিরমিযী হাদিস ১৯৮৯।
(৩) অসুখে চুল পড়ে গেলে এক নারী রসূলকে (স) জিজ্ঞাসা করল সে পরচুলা পড়তে পারবে কি না, তিনি তাতে নিষেধ করলেন - বুখারী ৭ম খণ্ড হাদিস ৮১৭, ৮১৮ ও ৮২৪।
কাজেই অন্যের অঙ্গ ব্যবহার ও জীবিত বা মৃতদেহকে কাটাছেঁড়া করা যাবেনা। তবে "গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সীমিত ক্ষেত্রে এটা করা যেতে পারে………নইলে মানবদেহ এক সময় ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হবে, তখন জীবন্ত মানুষকে হত্যা করে এই নিকৃষ্ট ব্যবসা চালানো হবে" - আত-তাহরিক, ফেব্রুয়ারী ২০১০।
এই বিরোধীতা-তত্বের মধ্যে ফাঁক আছে তিনটে।
প্রথমতঃ, জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে আমরা অবশ্যই দেহকে কাটাছেঁড়া করি। যেমন গ্যাংগ্রীন হলে সেই অঙ্গ বা অ্যাপেন্ডিসাইটিস হলে অ্যাপেন্ডিক্স কেটে ফেলি এই বাস্তবতাকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ, মৃত বা মৃত্যুপথযাত্রীর অঙ্গ শরীরে লাগিয়ে অসংখ্য মৃত্যুমুখী রোগী বেঁচে যাবেন এই মহৎ বাস্তবতাকে নির্মমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এভাবেই আমরা ধর্মপালনের উদগ্র তাড়নায় কেতাবের অক্ষরে বন্দী হয়ে ধর্মের নামে মানুষের ওপর অত্যাচার উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। একেই অনন্য ইসলামী স্কলার ড. হাশিম কামালী বলেছেন লিটারালিজম, অক্ষরের কারাগার - "প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স" পৃষ্ঠা ২০১, ২১৯ ও ২২৩। এই কারাগারে বন্দী হয়ে আমরা বুঝতে অক্ষম হই অঙ্গদান মৃত্যুমুখী মা বা সন্তানকে বাঁচিয়ে তাদেরকে পরস্পরের কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমরা বুঝতে অক্ষম হই অন্যের কিডনি দিয়ে গরিব কিডনি রোগীকে বাঁচালে সে তার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাবে। ছেলেটা বড় হয়ে হবে ইউনিভার্সিটির ডীন আর মেয়েটা হবে আদালতের বিচারক। পক্ষান্তরে কিডনি না পেলে সে মরে যাবে, তার অশিক্ষিত ছেলেটা বড় হয়ে হয়তো হবে মাদকসেবী ধর্ষক আর অশিক্ষিত মেয়েটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে!
পরমাণবিক শক্তি দিয়ে বানানো যায় ইলেকট্রিসিটি, প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ ইত্যাদি এবং পরমানবিক বোমা যার একমাত্র কাজ গণহত্যা করা। ধর্মও তাই, তার জ্বলন্ত উদাহরণ অঙ্গদানের পক্ষে ও বিপক্ষের ইসলামী বয়ান। এ দুয়ে'র কোনটা ভালো?
তৃতীয়তঃ, মানবদেহ ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হবে, জীবন্ত মানুষকে হত্যা করা হবে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। এক - সিরাজগঞ্জে কিডনীর জন্য শিশুকে অপহরণ ও খুন করা হয়েছে - ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ বিডিনিউজ২৪.কম। দুই - কাতারে হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশনের "অঙ্গদান" আহ্বানে ২৯৩৫ জন বাংলাদেশি সহ ২৩,০০০ লোক নিবন্ধন করেছে – “কাতারে ৩০০০ বাংলাদেশির অঙ্গদান” - কালের কণ্ঠ ১৮ অক্টোবর ২০১৪।
তা বেশ।
সমাজে কিছু বিচ্ছিন্ন অপরাধ ঘটে যেমন মায়ের হাতে সন্তানের খুন। কিছু অপরাধ "সামাজিক প্রবনতা" যেগুলো সর্বদাই ঘটে যেমন ঘুষ খাওয়া। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে "সামাজিক প্রবণতা" হিসেবে চালিয়ে দেয়াটা প্রতারণা মাত্র। অঙ্গের জন্য মানুষ খুন বা গণহারে অঙ্গদানের ঘটনা বিশ্বে গত বছরে কয়টা ঘটেছে? পাঁচটা? দশটা? মোটেই নয়। অথচ বিশেষজ্ঞ বলছেন "কিডনিদাতার অভাবে প্রত্যেক বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যান" - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান - "সারাহ ইসলাম : মরে গিয়েও অমর এক তরুণী" – www.eyenews.news- ২১ জানুয়ারি ২০২৩।
তাহলে? মানুষ কেতাবের অক্ষরে বন্দী হয়ে থাকবে, নাকি ধর্মের যে মূল স্পিরিট মানব-কল্যাণ সেটার পক্ষে থাকবে?
(খ) অঙ্গদানের প্রতি সমর্থন। আল্লাহ মানুষের জীবন বাঁচানোকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন?
(১) মায়েদা ৩২ - "যে কারও জীবন বাঁচালো সে যেন সবার জীবন বাঁচালো"। অঙ্গদানে মানুষের জীবন বাঁচে, এটাই সর্বোচ্চ মহৎ কর্ম।
(২) নাহল ১০৬:- "কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরীর জন্যে হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহ্র গযব এবং তার জন্যে আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্যে নয় যাকে কুফরীর জন্যে বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত" - ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এর ব্যাখ্যায় মুফতি তাকি উসমানী বলেন - "অর্থাৎ, কারও যদি প্রাণের আশঙ্কা দেখা দেয়, হুমকি দেওয়া হয় কুফরী কথা উচ্চারণ না করলে তাকে জানে মেরে ফেলা হবে, তবে সে মাযূর। সে তা উচ্চারণ করলে ক্ষমাযোগ্য হবে। শর্ত হল, তার অন্তর ঈমানে অবিচলিত থাকতে হবে"।
(৩) মায়েদা ৩:- শুয়োরের মাংস হারাম। কিন্তু ওই একই আয়াতে আছে - "তবে কেউ পাপ করার প্রবণতা ব্যতীত ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হলে আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু"। ব্যাখ্যায় আছে "এখানে ক্ষুধার শেষ পর্যায়ের অবস্থায় উল্লিখিত হারাম খাদ্য ভক্ষণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে……..অর্থাৎ প্রাণ বাঁচানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন শুধুমাত্র ততটুকু ছাড়া বেশী যেন ভক্ষণ করা না হয়" - অনুবাদ ও তফসির - তাফসীরে আহসানুল বায়ান।
এসব কারণেই মুসলিম বিশ্ব অঙ্গদান গ্রহণ করছে, পিছু হটছে অঙ্গদান-বিরোধী ব্যাখ্যা। আল্লাহ আমাদেরকে অনেক কিছুই দিয়েছেন এবং সেগুলো ব্যবহার বা অপব্যবহার করার স্বাধীনতাও দিয়েছেন। এই স্বাধীনতাটা না থাকলে পরকালের বিচারটা অর্থহীন।
এ বিষয়ে আলেমদের আরো মতামত আছে।
(১) ড. জাকির নায়েক সহ অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান করা যাবে কিন্তু জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনট শর্ত আছে (ক) অঙ্গদাতার যেন শারীরিক ক্ষতি না হয়, (খ) অঙ্গটা গ্রহীতার উপকার হয়, হুজুগ বা শখে নয়, (গ) এতে কোনো আর্থিক লেনদেন থাকবেনা।
(২) শরীরের অদৃশ্য অঙ্গ (হার্ট, কিডনি ইত্যাদি) দান করা যাবে কিন্তু দৃশ্যমান অঙ্গ (চোখ, হাত-পা ইত্যাদি) দান করা যাবেনা।
যতদূর জানি বাংলাদেশে মরণোত্তর দেহদান করেছেন প্রয়াতদের মধ্যে ড. আহমেদ শরীফ, বাক শিল্পাচার্য অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক মহীরুহ ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ এবং জীবিতদের মধ্যে যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন "মরণোত্তর দেহদাতা সমিতি"। তাঁদের ধন্যবাদ।
উল্লেখ্য, কৃত্রিম রক্ত, বিভিন্ন বস্তু বা শরীরের স্টেমসেল থেকে কিছু অঙ্গ ও একটা অঙ্গের ৩ ডাইমেনশন্যাল কপি করে নুতন অঙ্গ বানানোর গবেষণা চলছে। এটা সফল হলে মানব দেহ থেকে অনেক অঙ্গই নিতে হবে না।
(গ)জটিলতা। শূকরের হৃৎপিণ্ড নিয়ে রোগী বেঁচে যেতে পারে, এ বিষয়ে আলেমদের সিদ্ধান্ত এখনো পাওয়া যায়নি।
** জানুয়ারী ২০২২- প্রচলিত পদ্ধতিতে হৃৎপিণ্ড নিতে অক্ষম থাকায় মেরিল্যান্ড হাসপাতালে ডেভিড বেনেট-এর শরীরে শূকরের জ্বিন বদলে দেয়া হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে পাকিস্তানী আমেরিকান ডক্টর মুহিউদ্দীনে নেতৃত্বে। উদ্ধৃতি :- "হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের পর সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন বেনেট।পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, ফিজিক্যাল থেরাপিতে অংশ নিয়েছেন, কনসার্ট উপভোগ করেছেন, এমন কি নিজের পোষা কুকুর লাকির সঙ্গে নিয়মিত হাঁটতেও বেরোতেন তিনি"- দৈনিক ইনকিলাব ১০ মার্চ, ২০২২। দুমাস পরে অন্য অসুখে তাঁর মৃত্যু হয়। BBC - https://www.bbc.com/bengali/news-59947868
** ব্রেনডেড দুই ব্যক্তির দেহে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির শল্যচিকিৎসকরা সফলভাবে দুটি শুয়োরের হার্ট প্রতিস্থাপন করেছেন - ১৩ জুলাই ২০২২ ZEE24- https://zeenews.india.com/bengali/health/new-york-university-surgeons-two-pig-heart-transplants-succeed-in-brain-dead-recipients_437252.html
******************************