আফগানিস্তানের পথে বাংলাদেশ? - ২  - (গণতন্ত্র কুফরী আকিদা?)

আফগানিস্তানের পথে বাংলাদেশ? - ২  - (গণতন্ত্র কুফরী আকিদা?)

হাসান মাহমুদ

শারিয়াপন্থীদের দাবি, গণতন্ত্র ইসলাম-বিরোধী কুফরি আকিদা। উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ পলিসি – “Give the Dog a bad name to hang him”. গণতন্ত্রকে যত রকম ভাবে সম্ভব বদনাম করে গণতন্ত্র-বিরোধী গণমানস গড়ে তোল যাতে ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রতিপক্ষ না থাকে। তাঁদের অনেকের দাবি, এ ব্যাপারে আলেমদের ইজমা আছে অর্থাৎ সব আলেমের মতে গণতন্ত্র কুফরী আকিদা। এবং বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তাঁদের কেউ কখনো ঘুণাক্ষরেও জাতিকে বলেন না যে এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে।   

দুনিয়া জানে দু'চারটা বিষয় বাদ দিলে তাবিজ-মাজার থেকে শুরু করে সঙ্গীত ভাস্কর্য ইত্যাদি পার হয়ে নামাজে হাত বাঁধা পর্যন্ত হাজারো বিষয়ে আলেমদের মতভেদ কখনো কম কখনো তীব্র। অগণিত উদাহরণের এটা একটা, - এক মওলানা চোখ পাকিয়ে চিৎকার করেছেন তবলিগে গেলে ঈমান থাকবে না, অন্য মাওলানা তাঁকে "ধুয়ে" দিয়েছেন।

কবি ঠিকই বলেছেন- "সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ" – দুনিয়াটা আসলেই ‘অতীব বিচিত্র’।  

লক্ষ্যণীয়, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে এমনভাবে ঘোরে যে তার একটা দিকই পৃথিবীর দিকে ধরা থাকে, চাঁদের ওই দিকটাই আমরা দেখি। কিন্তু চাঁদ সম্বন্ধে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে অন্য দিকটা অবশ্যই দেখতে হবে এটা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের সিংহভাগ যুক্তি কেন ভিত্তিহীন তা আসবে অন্য নিবন্ধে। আপাতত: বলি, জানিনা শারিয়াপন্থীরা কেন জাতিকে জানান না যে “ইসলাম বনাম গণতন্ত্র” নিয়ে বিশ্ব-আলেমরা দুই নয় বরং তিন দাবিতে বিভক্ত:-  

(এক) গণতন্ত্র কুফরী আকিদা,

(দুই) ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব একটি বিভ্রম,

(তিন) গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই     

(এক) “গণতন্ত্র কুফরী আকিদা”। দেশে শুধুমাত্র এই তত্ত্বটাই জোরেসোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিকে জানানোই হয়নি যে বাকি দু'দলেও বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী সংগঠন, বিশ্ববিখ্যাত আলেমরা এবং অসংখ্য মুসলিম আছেন যাঁদেরকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভবই নয় গোঁয়ার্তুমিও বটে। সত্যিকার আলেম কখনো গোঁয়ার হননা। “কুফরী আকিদা” দাবির দলে আমাদের মওলানারা ও ইসলামী দলগুলো, হিযবুত তাহরীর, মওলানা মওদুদী, সৈয়দ কুতুব ইত্যাদি। এর সমর্থন আছে অজস্র লেখকের কেতাবে। এ ব্যাখ্যা সর্বদা প্রচার হচ্ছে তাই বিস্তারিত বলছি না। এটা একটা প্রান্তিক দাবি অর্থাৎ এই দল ভিন্নমত সহ্য করেনা, এঁদের অনেকে ভিন্নমতকে গালাগালি করেন। লক্ষ্যণীয়, দেশে যেসব “তাগুত-বিরোধী” জঙ্গিরা বিচারকদেরকে খুন করেছে, সঙ্গীত কনসার্টে বোমা মেরে মানুষ খুন করেছে তারা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। অর্থাৎ মুখে যাই বলা হোক না কেন, ঘটনা প্রমাণ করে যে বাস্তবে ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব কোন ধর্মান্ধকে খুনি করে তুলতে পারে। শান্তিপূর্ণ শারিয়াপন্থীরা এই খুনিদেরকে ঠেকাতে পারেনওনি, পারবেনও না।  

(দুই) “ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব একটি বিভ্রম”।

এটাও প্রান্তিক দাবি কিন্তু ইনারা শান্ত ও একাডেমিক। এই দলে আছেন আমেরিকার শায়খ হামজা ইউসুফ, ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে "মুসলিম এডুকেশন সেন্টার অফ অক্সফোর্ড"(MECO)-এর প্রতিষ্ঠাতা ইমাম ড. তাজ হারগে ইত্যাদি। ইন্টারনেটে "THE BIGGEST ISLAMIC ORGANIZATION OF THE WORLD" (বিশ্বের বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন) সার্চ করলে পাওয়া যাবে আলেম উলামাদের প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন "নাহদাতুল উলামা"; ২০২১ সালে এর সদস্য ছিল সাড়ে নয় কোটি, এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান ওয়াহিদ:- https://en.wikipedia.org/wiki/Nahdlatul_Ulama#:~:text='Revival%20of%20the%20Ulama'%2C,Islamic%20organization%20in%20the%20world

এই সংগঠনের প্রকাশিত বই “ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম” (THE ILLUSION OF AN ISLAMIC STATE), বইটা আমাজনে পাওয়া যায়। বইটি আমি একাধিকবার টিভি টকশো’তে দেখিয়েছি যাতে জাতি এর ওপরে গবেষণা করতে পারে:- https://www.amazon.ca/Illusion-Islamic-State-Radicalization-Muslim-Majority-ebook/dp/B004YR5ALE

ইনাদের মতে কোরানের "শারিয়া" হলো "পথ", এই শব্দকে ধর্মতাত্ত্বিক দিক দিয়ে স্বৈরশাসন এবং সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যাখ্যা করলে অবশ্যই স্বৈরশাসন এবং সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রক আইনের জন্ম হবে। এটা শারিয়ার ক্ষুদ্র ও খন্ডিত উপলব্ধি মাত্র - পৃষ্ঠা ১২৩, ১২৫, ১২৭ ইত্যাদি।   

অন্যান্য সূত্রেও আমরা এটাই পাই। "শারিয়া" শব্দের আক্ষরিক অর্থ বালুর উপর পশুদের পায়ে তৈরি পানির কাছে যাবার পথ; মরুভূমিতে পানির কাছে যাওয়া মানে জীবনের কাছে যাওয়া। আধ্যাত্মিক অর্থে "শারিয়া" হলো ঈমান, আকিদা, তাকওয়া, আকিদা, পরহেজগারি ইত্যাদির মাধ্যমে নাজাত পাওয়ার পথ। আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ কিছু ভুলে যান না - সূরা মরিয়ম ৬৪, ত্বহা ৫২। রাষ্ট্রীয় আইনের আরবি হল 'কানুন', আল্লাহ আমাদেরকে রাষ্ট্রীয় আইন দিলে কোরানে ‘কানুন’ শব্দটাই থাকতো কিন্তু শব্দটা কোরানে কোত্থাও নেই, সহি হাদীসেও আমি ওটা পাইনি।  

আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে 'শারিয়া' দিয়েছেন (সূরা আশ শুরা ১৩, জাসিয়া ১৮ ও মায়েদা ৪৮)। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী বলেছেন সাহাবীরা নাজাতের পথ হিসেবেই “ফিকাহ” অর্থাৎ “উপলব্ধি”-র মাধ্যমে শারিয়া পালন করতেন। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদীনের পর একসময় বাদশারা নিজেদের রাজত্বকে "ইসলামী" বৈধতা দেবার জন্য "ফিকাহ" শব্দটাকে আধ্যাত্মিক থেকে বদলে রাষ্ট্রীয় আইনের উৎস করে ফেলেন। তার কয়েকশ বছর পরে জন্মেছেন ইমাম গাজ্জালী- তিনি এই পরিবর্তনকে বলেছেন প্রতারণা অর্থাৎ ঠকবাজি। উদ্ধৃতি:-

“সে যুগে ফিকাহ্ শব্দের অর্থ ছিল পরকালের পথ, কু-রিপু’র সূক্ষ্ম বিপদাপদ ও ক্ষতিকর মাসলা সমূহ সম্পর্কে অবহিত হওয়া.......সত্যি কথা হল, অধিকাংশ বুযুর্গ মনীষী ফিকাহ্ শব্দকে আখেরাত বিষয়ক শাস্ত্রের অর্থেই ব্যবহার করতেন, কিন্তু এখন এ শব্দটি কেবল এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে মানুষ প্রতারণার জালে আবদ্ধ হচ্ছে” - ইমাম গাজ্জালী, এহিয়া উলুম আল দ্বীন ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৯-৫১ - অনুবাদক এম এন এম ইমদাদুল্লাহ, প্রকাশক বাংলাদেশ তাজ কোম্পানি লিমিটেড। 

বিশ্ব-মুসলিমের একাংশ এখনো ১৪০০ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক প্রতারণার শিকার। এখন প্রশ্ন ওঠে আল্লাহ যা বলেননি সেটা ইসলামে ঢুকে গেল কিভাবে। এর জবাব আছে মাওলানা আহমদ হাসান রচিত "দি ডকট্রিন অফ ইজমা" ("ইজমা'র মূলনীতি"- ভারতের বৃহত্তম ইসলামী কেতাবের প্রকাশক দিল্লির কিতাব ভবনে পাওয়া যায়) বইয়ের ১৬পৃষ্ঠায়, কমেন্টে পৃষ্ঠার স্ক্যান দেওয়া হলো। সংক্ষেপে, দশম শতাব্দীর দিকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, কোরানের কোন আয়াত বা রাসুলের কোন সুন্নত যদি আলেমদের ইজমার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে কোরান-রসুলের ওই আয়াত ও সুন্নত বাতিল হয়ে গেছে। । এই তথ্যের উল্লেখ আছে ড. হাশিম কামালী'র "প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স" বইয়ের ২০৩ পৃষ্ঠা এবং ইমাম তৌহিদি'র " দি ট্রাজেডি অফ ইসলাম" বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠায়।  এই ক্ষমতাবলে কোরান-রাসূল বিরোধী অনেক কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার কিছু নমুনা আমি দেখিয়েছি।

IJMA_-_1.jpg

ইমাম তৌহিদি'র " দি ট্রাজেডি অফ ইসলাম" বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠা:- 

TAWHIDI_-_IJMA.jpg

(তিন) গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই   

 এই দলে রয়েছেন আমাদের আলেমদের প্রিয় ইসলামিক স্কলার প্রয়াত শাহ আবদুল হান্নান। গণতন্ত্রের সমর্থনে তাঁর ‘ইউসুফ কারজাবির রাষ্ট্রচিন্তা' নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক নয়া দিগন্ত ১৩ এপ্রিল ২০১৫ এবং একই নামে ক’বছর পর দু’বার সংক্ষিপ্ত আকারে। অরিজিনাল লিংকটা মুছে গেছে কিন্তু পূর্ণ নিবন্ধটা আছে এখানে:- https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/waliashraf/30029358

এই দলে আরও আছেন ড. আব্দুল আজিজ সাচেদিনা, তাঁর বই -"দি ইসলামিক রুট অফ ডেমোক্রেটিক প্লুরালিজম" (বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের ইসলামী উৎস), আছেন ড. ইউসুফ কারজাভী যিনি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলারস-এর চেয়ারম্যান, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অফ ফতোয়া এন্ড রিসার্চ-এর প্রেসিডেন্ট, মুসলিম ব্রাদারহুড-এর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংকিং এর অন্যতম নেতা এবং “মুসলিম বিশ্বের নোবেল” খ্যাত বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার প্রাপ্ত। তাঁর বই "ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা - তত্ত্ব ও প্রয়োগ" এবং "আধুনিক যুগ : ইসলাম - কৌশল ও কর্মসূচি"। তিনি "ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা - তত্ত্ব ও প্রয়োগ" বইয়ের ১৭২ পৃষ্ঠায় বলেছেন:-

"উল্লেখিত মূলনীতি সম্বলিত এ গণতন্ত্র কি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক? কোথায় এ সংঘর্ষ ? কোরআন ও সুন্নাহর কোন মজবুত ভিত্তি করে এ ধরনের দাবি করা হয়ে থাকে ? গণতন্ত্রের মূল কথা নিয়ে কেউ যদি চিন্তা ভাবনা করে তাহলে দেখতে পাবে যে ইসলামের মূলনীতির সাথে এখানে কোন বৈপরীত্য নেই"।QARZAVI_-_SUPPORTS_DEMOCRACY.png

বইটা জামাত-শিবিরের অনলাইন লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়:-
https://www.bjilibrary.com/4508
https://www.icsbook.info/pdf-book/393   

যতদিন শারিয়াপন্থীরা ঝগড়াঝাটি গালাগালি না করে অ্যাকাডেমিক গবেষণা করে উল্লিখিত বইগুলোর বক্তব্য খন্ডন না করছেন ততদিন তাঁদের দাবি বাতিল থাকবে।    

**- ঘটনা আরো ঘটবে কিন্তু দাবি ওটাই থাকবে - ইসলামী রাষ্ট্র চান?

আইন দেখান!  আইন না দেখানো পর্যন্ত  কিন্তু জাতিকে প্রতারণার মধ্যে রাখা হবে।

Print