ভ্যালেন্টাইন টোনাটুনি (সত্য ঘটনা)

Written on 29 March 2024. Posted in Literature :: Bangla

টোনা টুনি
(সত্য ঘটনা) ২৩শে মে, ৪২ মুক্তিসন (২০১২)


Image: Tona Tuni

ভ্যালেন্টাইন টোনাটুনি !! (সত্য ঘটনা)
হাসান মাহমুদ 
 
অনেক বছর আগে, ব্যতিব্যস্ত কাজ করছি আবুধাবী সেন্ট্রাল হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের অফিসে - ল্যাবের ভেতর ব্যতিব্যস্ত আমার টেকনিশিয়ান টেকনোলজিস্টের দল। ফোন বাজল, ওধারে মহিলা:-
 
"হাসান মাহমুদ বলছেন?"
"বলছি !"...
"একজনের কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বর পেয়েছি. আমাকে একটু হেল্প করতে হবে"।
 
হাসি পেল। হাসপাতাল এমন একটা জায়গা, সবাইকে কখনো না কখনো এখানে আসতেই হয়। আমার ওপরে আবুধাবীর শুধু বাংলাদেশী নয়, পুরো বাঙালী সমাজের অখণ্ড অধিকার, নানা রকম 'হেল্প করা' আমার লেগেই আছে। ছোটখাটো আইনও ভাঙ্গতে হয় কখনো। বললাম -
"বলুন!"
"আমি গতকাল ঢাকা থেকে এখানে ছেলের সংসারে এসেছি, - আগামী সপ্তাহে ফিরে যাব। এক পেশেন্টকে দেখতে চাই” ।
“চলে আসুন ভিজিটিং আওয়ারে, কোনো অসুবিধে নেই"।
"না, ভিজিটিং আওয়ারে না। আমি আসতে চাই যখন বাইরের কেউ থাকবে না।"
 
একটু ধাক্কা খেলাম. বললাম – "কোন পেশেন্ট"?
 
নাম শুনে চুপ হয়ে গেলাম। পেশেন্ট ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গভীর কমা'তে লাইফ সাপোর্টে আছেন। আমার ল্যাবের রিপোর্ট বলছে জীবনের আর কোনো আশা নেই, ডাক্তারেরাও জবাব দিয়ে দিয়েছে। এখানে তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা আছে, এখন শুধু লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে উনাকে চলে যেতে দেবার অপেক্ষা। বললাম:-
"উনি তো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, ওখানে অনেক রেস্ট্রিকশন !!"
 
মিনতিভরা কন্ঠে তিনি বললেন – "দেখুন, উনাকে শুধু একটিবার দেখার জন্য আমি এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। অফিস ছুটি দিচ্ছিল না, রিজাইন করে এসেছি। প্লিজ, প্লি--জ একটা ব্যবস্থা করে দিন!!”
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল - "চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন?"
“কি করব – ছুটি দিচ্ছিল না। আমার এত বছরের চাকরী !”
 
বুঝলাম, জীবন এমন এক দাবী করেছে যাকে উপেক্ষা করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। বললাম-
“যখন বাইরের কেউ থাকবে না......তাহলে তো মাঝরাতে আসতে হয়"।
"তাই আসব”।
"রাত বারোটায় আসুন - আমি ইমার্জেন্সির গেটে থাকব।
"আচ্ছা। আমি সবুজ শাড়ী পরে আসব, চিনতে পারবেন"।
 
রাত বারোটায় তিনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন, সবুজ শাড়ী পরা। আইসিইউ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাসিমুখে ছুটে এল হেড নার্স সুমাইয়া, বলল -“কি ব্যাপার বিগ ব্রাদার, এত রাতে"? বললাম পেশেন্ট দেখতে এসেছি। সুমাইয়া মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গেল।
 
নাকেমুখে বিভিন্ন যন্ত্র থেকে লাগানো নানা রকম পাইপ আর টিউব, ধীরে বইছে নি:শ্বাস। চোখদুটো আগের মতই বন্ধ। সরু টিউবের ভেতর দিয়ে হাতের সুঁচে শরীরে ঢুকছে টিপিএন ফ্লুইড, টোটাল প্যারেন্টারেল নিউট্রিশন। আস্তে তিনি বসলেন বেডের পাশে চেয়ারে। পেশেন্টের হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন-
"টোনা ! শুনতে পাচ্ছ? আমি তোমার ছোটবেলার টুনি"!!
 
টোনা ? ছোটবেলার টুনি ?? আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম আর পুরো আকাশটাও যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল আমার মাথার ওপর। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি। এ শরীর এতদিন বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি শত আহ্বানে তার বন্ধু বান্ধবের, স্ত্রীর, এমনকি সন্তানদেরও। সেটা এখনো পড়ে আছে একই রকম নিস্প্রাণ। ওই শরীর, ওই মন কি আর কখনো কারো ডাকে সাড়া দেবে? তিনি ফিসফিস করে বললেন-
 
“তোমার অসুখের কথা শুনে ঢাকা থেকে তোমাকে দেখতে এসেছি!"
 
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। আগের মতই কাঠ হয়ে পড়ে আছে পেশেন্ট। ওটা মৃত শরীরে জীবন্ত আত্মা নাকি জীবন্ত শরীরে মৃত আত্মা বলা কঠিন। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই নিথর দেহের অতলান্তে নড়তে শুরু করেছে সুগভীর রহস্যময়, মায়াময় কি যেন। মহিলা গভীর মমতায় ফিসফিস করে বললেন–
 
"আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ ! আমার কথা না শুনে তুমি পারবে না। সেই সবুজ শাড়ীটা তুলে রেখেছিলাম ! এত বছর পর আজ আবার পরেছি!!”
 
অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কোন সুদুর অতীত থেকে অজস্র স্মৃতিময় কত বছরের ক্ষুধার্ত বাল্যপ্রেম ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বোমার মত বিস্ফোরিত হল হতচেতন দেহের ভেতরে। থরথর করে কেঁপে উঠল দেহ, নড়ে গেল নাক-মুখের পাইপ, হাতের সুঁচ নড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। আতংকে চীৎকার করে উঠলাম- "সুমাইয়া !!!" ছুটে এল নার্সের দল কিন্তু সেই ভূমিকম্প থামায় কার সাধ্য। মহিলা ধরে আছেন তাঁর হাত, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
 
"শান্ত হও, শান্ত হও টোনা! আমি তোমার পাশে আছি তো....তোমার টুনি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যায়নি ....শান্ত হও....! ”
 
কি এক নিবিড় প্রশান্তিতে স্থির হয়ে এল দেহ, রুদ্ধশ্বাসে আমি তাকিয়ে আছি। পেশেন্টের হাতের একটা আঙ্গুল থিরথির করে কাঁপছে। তাঁর শৈশবের আদরের টুনিকে অনির্বচন কিছু বলতে চাইছে বুঝি ! মহিলা অনেক আদরে সেই আঙ্গুলটা ছুঁয়ে রইলেন। যেন দুটো টোনাটুনি পাখী জীবনের শেষবার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কোন অজানা ভাষায় কথা বলছে। এদিকে নার্সের চোখে ফুটে উঠেছে মিনতি আর বিরক্তি। মহিলা সেটা বুঝলেন। ক্ষুধার্তের মতো, বুভুক্ষুর মতো হাত বুলোলেন অচেতন রোগীর বুকে, চোখে মুখে গালে কপালে, তারপর অত্যন্ত দ্রুত পেশেন্টের কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে খুব নীচুস্বরে কি যেন বললেন।

কি বললেন এক টুনি তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী টোনার কানে কানে?

আমি জানিনা। কেউ তা জানবেনা কোনোদিনই।

বাইরে ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সে চোখে ফুটে উঠেছে অনুরোধ। আস্তে করে বললাম – "কেউ জানবে না।"
 
মহিলা যেন নিজের মনে বললেন - "আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না”। তারপর একটু থেমে বললেন – “আপনাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ"।
 
আমি চুপ করে রইলাম, ট্যাক্সি চলে গেল।
 
আজ এই এতো বছর পরেও আমি যেন এখনো পাথরের মূর্তির মত হতবাক দাঁড়িয়ে আছি রহস্যময় সেই দিগন্তবিস্তৃত মরুভুমির বালুর ওপর .... সেই মাঝরাতে খোলা আকাশের নীচে......
***************************************************************
পেশেন্টের লাইফ-সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়েছিল পরদিন, তিনি চলে গিয়েছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে। এই ক'টা দিন হয়ত জীবনের শেষবারের মতো তাঁর ছোটবেলার আদরের টুনির কণ্ঠ শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল নিউইয়র্ক বাসী Belal Beg ভাইয়েরও। হাসপাতালে দীর্ঘ চাকরীকালে কিছু অবিশ্বাস্য মেডিক্যাল মিস্ট্রি দেখেছি, এটা তার একটা। 


 

Print