শুধু আইনের শাস্তি দিয়ে ধর্ম-খুন বন্ধ করা অসম্ভব। ইসলাম হেদায়েতের ধর্ম। রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে কিন্তু হেদায়েত দিতে পারে না, কাজটা ধর্মগুরুদের।
ড: অভিজিত রায়ের খুনীদের প্রতি বিশ্ব-বিবেক ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাংলার অন্যতম বিজ্ঞানমনস্ক সন্তানটির মগজ পড়ে ছিলো রাস্তায়... যে মগজটাকে ওদের যত ভয়। প্রায় বিশ বছর আগে ওর নেতৃত্বে মুক্তমনা আমরাই বানিয়েছিলাম প্রজন্মকে শুদ্ধ আলোচনা বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম দেবার জন্য। ওর মেধা, বিশ্লেষণ ও তা উপস্থাপন করার ক্ষমতা অসাধারণ। প্রজন্মের চিন্তা চেতনাকে আরজ আলী মাতুব্বরের পর ও-ই বড় একটা ঝাঁকি দিয়েছে, চিন্তার সংঘাত সৃষ্টি করেছে যা সামাজিক অগ্রগতির চাবিকাঠি। মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে প্রায় বছর দশেক আগে আমি মুক্তমনা ছেড়েছি, কোনো পোষ্টও করিনি পড়িও নি। এ ধরনের খুন আগেও হয়েছে, কিভাবে তা বন্ধ করা সম্ভব সেটা বের করা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত জরুরী। অভি’র প্রতিষ্ঠিত মুক্তমনায় নাকি রসুল(স)-কে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা হত এবং তাকে নাকি হুমকি দেয়া হচ্ছিল। অভি'র বিপক্ষদলের অনেকে আমার ইনবক্সে তার উদাহরণ পাঠিয়েছে কিন্তু ওরা এত বেশী মিথ্যে প্রচার করে যে ওগুলো আমি ধরিনি। তাই মুক্তমনা-ভিত্তিক নয়, সাধারণভাবে বিষয়টাকে দেখা যাক।
কোটি কোটি লোক মানুষের শরীর হাতীর মাথা দেবতার আরাধনা করে। তাদেরকে ঠাট্টা অপমান করার অধিকার আমার আছে আর ইন্টারনেটের সুবিধে তো একেবারেই ফ্রি, টাইপ করে ছেড়ে দিলেই হল। কিন্তু আমি কেন তা করতে যাব। সুবিধে বা অধিকার প্রজ্ঞার সাথে প্রয়োগ করাই সভ্যতা। কাজেই যার যা ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে ধর্ম পালন করুক। প্রতিবাদ প্রতিরোধ ঠাট্টা অপমান তখনই করতে হবে যখন ধর্মের নামে অত্যাচার হয়।
এক – অভিকে যে কারণে খুন করা হল খুনীদের সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে ?
দুই- ধর্মব্যঙ্গ নিয়ে অন্য ধর্মের লোকেরা কি করেছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে?
তিন - কোরান-রসুল(স)ও মুসলিম ইতিহাসে এ ব্যাপারে কি বলা ও করা হয়েছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে? বাক স্বাধীনতা ও ধর্মব্যঙ্গ - এ সংঘাতের সমাধান কি আদৌ সম্ভব?
এক – অভিকে যে কারণে খুন করা হল খুনীদের সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে?
মোটেই হয়নি, ওদের পদ্ধতিটাই অচল। মূল উদ্দেশ্য রসুলের প্রতি ব্যঙ্গ বন্ধ করা, অভিকে খুন করে তা অর্জন করা তো যায়ই নি বরং এসব সন্ত্রাসের ফলে ভারত সহ পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাঙের ছাতার মত ইসলামের প্রতি ব্যঙ্গ-সাইট গজিয়ে উঠেছে অজস্র। এই সন্ত্রাসীরাই দুনিয়ায় ইসলাম-ভীতি ও ইসলাম-ব্যঙ্গের জন্য দায়ী। ওদের বিশ্বাস ওরা নবীর সুন্নত পালন করেছে। দলিলে পাওয়া যায় রসুল খুন করিয়েছিলেন কটাক্ষকারী কাব বিন আশরাফ, আবু আফাক, আসমা বিন্তে মারোয়ান, ইবনে কাত্তাল আর তার দুজন "ড্যান্সিং গার্লস"দের (একজন পালাতে পেরেছিল)। ওদের এ বিশ্বাস কেন ইসলাম-বিরোধী তা নীচে দিলাম, জাতিকে ও খুনীদেরকে এটা জানাতে হবে যাতে এমন খুন আর না হয়।
দুই- ধর্মব্যঙ্গ নিয়ে অন্য ধর্মের লোকেরা কি করেছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে?
বাইবেলের প্রতি অনেক ব্যঙ্গ হয়েছে হচ্ছে, এমনকি নিউইয়র্কে বোতলের মধ্যে প্রস্রাবের ভেতর যীশুর মুর্তি প্রদর্শনের মত ভয়াবহ ব্যঙ্গ হয়েছিল।পুরো খ্রীষ্টান জগৎ কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কোথাও কোনো হিংস্রতা হয়নি বলে ওটা ওখানেই মরে গেছে, পরে আর হয়নি। মনে আছে, এক লোক তার ছেলেকে এনে নবীজীকে বলল- এ এত মিষ্টি খেতে চায়, একটু বুঝিয়ে বলুন। তখন নবীজী বলেছিলেন পরের সপ্তাহে এসো। পরের সপ্তাহে লোকটা এল, নবীজী ছেলেকে বোঝালেন, ছেলে মিষ্টি বন্ধ করল। লোকটা অবাক হয়ে কিজ্ঞেস করল নবীজী তো ছেলেটাকে আগের সপ্তাহেই বোঝাতে পারতেন। নবীজী হেসে বলেছিলেন - বাপু, আমি নিজেই তো মিষ্টি খেতে পছন্দ করি এবং খাই। গত এক সপ্তাহে আমি ওটা কমিয়েছি, তাই বোঝাবার বৈধতা আমার হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর বাণী হল অন্যকে যা করতে বল, আগে নিজেরা তাই কর। বহু বছর মধ্যপ্রাচ্যে খবরের কাগজগুলোতে ঈহুদী ধর্ম নিয়ে ক্রমাগত জঘন্য ঠাট্টা-তামাশা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কোন সরকার, মসজিদ বা সুশীল সমাজ তার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেনি। এটা হল হজরত দাউদ (আ) অর্থাৎ ডেভিড'স ষ্টার , ইহুদীদের ধর্মপ্রতীক যেমন আমাদের চাঁদতারা। সবারই ধর্মীয় প্রতীক তার কাছে অত্যন্ত সম্মানের নয়? ইসরাইল একটা গনহত্যাকারী দানব রাষ্ট্র তা দুনিয়া জানে, আঘাত করলে ইসরাইল রাষ্ট্রকে কর, ওদের ধর্মগ্রন্থকে কেন?
তিন - কোরান-রসুলে(স)এ ব্যাপারে কি বলা হয়েছে ও তাতে কি লাভ-লোকসান হয়েছে? বাক স্বাধীনতা ও ধর্মব্যঙ্গ - এ সংঘাতের সমাধান কি আদৌ সম্ভব?
পুরো ব্যাপারটাই বিদ্রুপ নিয়ে। ইসলামের প্রতি ব্যঙ্গ হলে আমাদের মনে লাগে। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা তো প্রতিবাদীর চরিত্র প্রমাণ করে। ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-সমস্যার শ্বাশ্বত সমাধান শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, শুধু এখনকার জন্য নয়, সর্বকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য চোদ্দশ বছর আগে দিয়ে রেখেছে ও আল্ কোরাণ। আশ্চর্য্য এই যে সেই নির্দেশ ইহুদী-খ্রীষ্টানেরা মেনে চলেছে বলেই ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু ব্যতিক্রম থাকবেই, কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের প্রতি ব্যঙ্গও মরে যাবে অন্তত: কমে যাবে যদি আমরা রসুলের মিষ্টি খাওয়ার উদাহরণ অনুসরণ করি, অন্য ধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ বন্ধ করি। আর যদি পালন করি হুকুমদাতার হুকুম -
‘‘কোরাণের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারী করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহ’র আয়াতসমূহের প্রতি অস্বীকৃতিজ্ঞাপন ও বিদ্রূপ হতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না যতক্ষন না তারা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়’’ - নিসা ১৪০।
খুনীরা কোরানের এই সুস্পষ্ট কলমাকে অভিজিত রায়ের কলমের কাছে পরাজিত করে দিয়েছে, যদি সে ব্যঙ্গ করেও থাকে তবুও। সে হুকুম না মেনে তারা - ‘‘তা নাহলে তোমরাও তাদেরই মত হয়ে যাবে’’ - পরের আয়াত!! এর চেয়ে কথা স্পষ্ট হয় না।
কোরাণের হুকুমটা মৌদুদীবাদীদের পছন্দ নয় কিন্তু এর চেয়ে কার্য্যকর উপায় কি তা কেউ বলে দিক। খুন করে কেউ কোনদিন ধর্ম-বিদ্রুপ ঠেকাতে পারবে না। কোরানে কোথাও নেই ব্যঙ্গকারীকে কতল কর, ওটা আছে হাদিসে। আর, হাদিস হল অরক্ষিত দলিল, ওতে জঘন্য, হাস্যকর ও উদ্ভট অনেক কিছু আছে। অন্যদিকে, কি বলছে সংরক্ষিত দলিল কোরান (হিজর ৯)? খুনীরা আল্লাহ'র কালামকে বিদ্রূপকারীর কলমের কাছে পরাজিত করেছে - "বিদ্রূপকারীদের জন্য আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট"- হিজর ৯১। খুনীদলের পোষ্টিং-এ হিন্দু দেবদেবীর অপমান ব্যঙ্গের বন্যা এই কালামকে সরাসরি পরাজিত করেছে - "তোমরা তাদেরকে মন্দ বোলনা যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত: আল্লাহকে মন্দ বলবে"- আনাম ১০৮। তাইতো - "রসুল বললেন: হে আমার পালনকর্তা ! আমার সম্প্রদায় এই কোরআন-কে পরিত্যাগ করেছে" - আল ফুরকান ৩০। আল্লাহ'র এ কালামকে খুনীরা তাদের জন্য সত্যি বলে প্রমাণ করল।
কাজেই আমরা হয় কোরান মেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, কিংবা হাদিস মেনে খুন খারাবী করতে পারি।
কোনটা ভাল?
* * *
হাসান মাহমুদ - ০৫ মার্চ ৪৫ মুক্তিসন (2015)
লেখক ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস ফেসিং টুমরো, ক্যানাডা'র জেনারেল সেক্রেটারি এবং আরো কিছু ইসলামী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত।