আবদুল গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য ও তার প্রতিক্রিয়া

আবদুল গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য ও তার প্রতিক্রিয়া - ইসলাম-সম্মত বনাম ইসলাম-বিরোধী

গত ০৩ জুলাই ২০১৫ নিউ ইয়র্কের অনুষ্ঠানে জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে। সমস্যা হয় ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বোঝাবুঝিতে। আমরা জনাব চৌধুরীর বক্তব্য খুঁটিয়ে দেখেছি এবং তাতে ইসলাম-বিরোধীতার লেশমাত্র পাইনি। কেন তা ব্যাখ্যা করছি।

• জনাব চৌধুরীর বক্তব্য ছিল সংস্কৃতির আদান-প্রদান নিয়ে যার প্রধান অনুসঙ্গ ভাষার উদাহরণ হিসেবে আরবী ও বাংলা এসেছে। আরবী ভাষাটা ইসলাম সৃষ্টি করেনি, আরব-বাসীদের চিরকালের ভাষা ওটা। ইসলাম গ্রহণ করার পর সাহাবীরা প্রায় কেউই নাম বদল করেন নি এটা ঐতিহাসিক সত্য। শুধু রসুল (স)-এর পিতা-ই নন, হজরত আবুবকরের (রা) -এর আসল নাম আবদুল্লাহ ইবনে আবু কুহাফাহ, আবু হোরায়রা'র আসল নাম আবদুল রহমান ইবনে সাখর। আবদুল্লাহ ও আবদুল রহমান মানে আল্লাহ'র দাস। "দাস" যেহেতু স্রষ্টারই হয়, তাই প্যাগানদের "আল্লাহ" ওদের স্রষ্টাকেই নির্দেশ করে।

• বিড়ালের বা ছাগলের বাবা শুনে যাঁরা আহত হয়েছেন তাঁদের বলি, মধ্যপ্রাচ্যে "আবু" শাব্দিক অর্থে “বাবা”, আর সাংস্কৃতিক অর্থে উপাধির মতন। আমাদের কাছে উদ্ভট লাগতে পারে কিন্তু স্নেহভাজন কাউকে আদর করে "আবু" বলাটা ওদের কাছে একেবারেই স্বাভাবিক। আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলাম হওয়া নিষিদ্ধ কিন্তু আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিতে গোলাম নবী, গোলাম মওলা, গোলাম আলী, বন্দে আলী এসব নাম দিব্যি চলেছে। বিশ্ব-মুসলিমের অনেকের কাছে এসব নাম উদ্ভট মনে হবে। মাটিতে ঘুমনোর সময় হজরত আলীর (রা) গায়ে মাটি লেগেছিল - রসুল (স) আদর করে তাঁকে ডেকেছিলেন "আবু তোরাপ" - মানে মাটির বাপ, তোরাপ মানে মাটি – (সহি মুসলিম ৫৯২৪, সহি বুখারী ৫ম খণ্ড ৫৩ ও ৮ম খণ্ড ২২৩ ও ২৯৭)। আবু হোরায়রা বিড়ালকে ভালবাসতেন, রসুল (স) তাঁকে আবু হোরায়রা অর্থাৎ বিড়ালের বাপ বলেছিলেন বলে ও নামটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হজরত আবু বকর(রা) ছোটবেলায় পোষা ছাগলদেরকে এত ভালবাসতেন যে তাঁর পিতা কাপড় ব্যবসায়ী আবু কুহাফাহ তাঁকে আদর করে ডাকতেন "আবু বকর" - অর্থাৎ ছাগলের বাপ - ওটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

• অনেকের মতে নবীদের মধ্যে যাঁরা রিসালা অর্থাৎ গ্রন্থ পেয়েছেন তাঁরা একইসাথে নবী ও রসুল দুইই। "রসুল"-এর মানে "দূত" বা "সংবাদবাহক" এটাও অনেকে বলেন। রিয়াদের জাদুঘরে নেহেরু'র সম্মানে "শান্তির রসুল" প্ল্যাকার্ড আছে, এ থেকে আমাদের কি কিছুই শেখার নেই?

• আল্লাহ'র প্রায় সব নামই বিশেষণ, গুণভিত্তিক (রহমান, রহীম) বা কর্মভিত্তিক (কাহহার, রাজ্জাক)। প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায় স্রষ্টার ওপরে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান-শব্দ গুলো ব্যবহার করে। আমরা বলি "আল্লাহ রহমান" অর্থাৎ দয়ালু, খ্রীস্টানরা বলে "গড ইজ মার্সিফুল" অর্থাৎ দয়ালু। কথা তো একই হল।

প্রাচীন আরবীরা তাই করেছে এমন দলিল আমাদের কাছে নেই কিন্তু ওটাই তো স্বাভাবিক! কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের স্রষ্টার ব্যাপারে সর্বশ্রেষ্ঠ শব্দ ব্যবহার করবে না এটা কি সম্ভব? কারো কাছে বিপরীত দলিল থাকলে হুংকার না দিয়ে জাতির সামনে প্রকাশ করলেই তো হয়! অজস্র অবিশ্বাস্য তথ্যে ভরা মুসলিম ইতিহাস। সবাই তো সবকিছু জানেনা, পরস্পরের কাছ থেকে শিখে নেয়াটা খুব জরুরী। আলেম সমাজের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক, তাঁদের দায়িত্বও অনেক। কোনো মতভেদে প্রথমেই দেখতে হয় বলা-বোঝার মধ্যে কোনো ভুল হল কি না। তা না করে গালাগালি ও জনতাকে হিংস্রতার দিকে উসকিয়ে দিলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী। সবাই নিজের নিজের মাতৃভাষায় নামাজ পড়ুক এটা কেউ বিশ্বাস করবে না কিন্তু এ ফতোয়া দিয়েছিলেন স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (র)-(প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স -বিশ্ববিখ্যাত শারিয়াবিদ ড: হাশিম কামালী, পৃষ্ঠা ৩৫)।

• সবচেয়ে মারাত্মক হল মতভেদ হলেই "ইসলাম থেকে খারিজ", "মুরতাদ" ফতোয়াবাজী করা। বিশ্ব-মুসলিমের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে এই মারাত্মক বদভ্যাস। বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী'র (র)মত দরবেশ সহ (ভুমিকা, তাঁর বই ফতহুল গয়ব)বহু মুসলিম চিন্তাবিদ এই কালনাগীনির ছোবলের শিকার হয়েছেন, বিশ্ব-মুসলিমের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে। যাঁরা মুরতাদ ফতোয়া জারী করেন তাঁরা খেয়াল করেন না তাঁদেরকেও মুরতাদ বলার ইমাম আছেন। এতে ফিতনা বাড়ে, এজন্যই রসুল (স) বলেছেন কোনো মুসলিম অন্য মুসলিমকে ওরকম বললে তাদের একজন সত্যিই মুরতাদ (বুখারী ৮ম খণ্ড ১২৫)। আমরা কেন ভুলে গেলাম রসুল (স)-এর উদ্বিগ্ন সতর্কবাণী -"তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ? কে তোমাকে কলমা'র দায় হইতে মুক্ত করিবে, উসামা"? (সিরাত - ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক – পৃষ্ঠা ৬৬৭)

• মুরতাদ শব্দটার মূল হল "রাদ" যা হল স্বকর্ম। যেমন আত্মহত্যা বা আত্ম-সমালোচনা। এগুলো নিজে করতে হয়, বাইরে থেকে কেউ করিয়ে দিতে পারেনা। নিজে থেকে ঘোষণা না করলে তাকে মুরতাদ ঘোষণা করার বিরুদ্ধে কোরান (নিসা ৯৪) ও রসুল (স)-এর সুস্পষ্ট নিষেধ আছে। রসুল (স)-এর নির্দেশমত সাহাবীরা বানিয়েছিলেন মুসলমানের তালিকা, প্রায় ১৫০০ ছিল সেটা। তার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু মুনাফেক ছিল যারা মুসলিম সেজে ক্ষতি করতে চাইত। রসুল (স) তা জেনেও কাউকে সে তালিকা থেকে বাদ দেননি (বুখারী ৪-২৯৩)। তিনি জানতেন ওটা করলে ভবিষ্যতে কিছু মুসলিম অন্য মুসলিমকে অমুসলিম বলবে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মুসলিম সমাজ। কিন্তু তার পরেও মুসলিম ইতিহাস ভরে আছে পরস্পরের প্রতি কাফের মুরতাদ ফতোয়ায়।

জনাব চৌধুরীর প্রতি গালাগালি ও হুমকি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বে যখন খবর ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইসলামী সংগঠন জাতির নারীদের ক্লাস ৫-এর বেশী পড়তে দেবে না, তত্বাবধায়ক সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে যাতে সংবিধানে যোগ করা হয় নারীরা দেশের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না ইত্যাদি অজস্র নারী-বিরোধী চেষ্টা, তখন দেশের ও ইসলামের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়।
একটা জাতির জীবনে রাস্তাঘাট ব্যবসা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি সবই দরকার কিন্তু সবচেয়ে বড় দরকার মূল্যবোধ যেখানে ভয়াবহ ধ্বস নেমেছে। বর্তমানের মত হেদায়েতের দরকার জাতির জীবনে আর কখনো হয়নি। কাজটা প্রধানত: আলেম সমাজের। তাঁদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, জাতিকে হেদায়েত করুন। আমরা হেদায়েতকারী স্নেহপ্রবণ আলেম সমাজ চাই, হুঙ্কারী মওলানা চাইনা। হুঙ্কারী মওলানারা জাতির কি মারাত্মক ক্ষতি করে তার প্রমাণ পাকিস্তান।

এজন্যই কোরান-রসুল সতর্ক করে গেছেন - "ধর্মে বাড়াবাড়ি করোনা, এই করে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে" -(মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও মুসলিম ২৮০৩)।

এজন্যই বুঝি রসুল (স) বলেছিলেন উম্মতের জন্য তাঁর "সর্বাপেক্ষা বড় উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারী আলেমদের লইয়া"-(সহি ইবনে মাজাহ ৫-৩৯৫২)।

**************************

হাসান মাহমুদ ৯ জুলাই, ৪৫ মুক্তিসন (২০১৫)

লেখক ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস ফেসিং টুমরো'র জেনারেল সেক্রেটারী, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেসের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল'. 

 

Print