“বিশ্বকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রধারণা থেকে বের হতে হবে” - মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আব্দুল হামিদ

মোহাম্মদ আবদুল হামিদ

“বিশ্বকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রধারণা থেকে বের হতে হবে” - মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আব্দুল হামিদ  - প্রথম আলো ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭।  এ নিবন্ধ ২১ অকটোবর ২০১৭ তারিখে বিডিনিউজ২৪.কম-এ "ধন্যবাদ, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ! " নামে ছাপা হয়েছে:- https://bangla.bdnews24.com/opinion/51147

***********************************************

অজস্র ধন্যবাদ মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আব্দুল হামিদ। দেশব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামী রাষ্ট্রধারণার ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের মধ্যে আপনার মন্তব্য “বিশ্বকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রধারণা থেকে বের হতে হবে” অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে যেখানে দেশে শারিয়া আইনের অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রধারণার পক্ষে জনসমর্থন বেড়ে চলেছে (পিউ ও রিজল্ভ সংগঠনের জরীপ)। যেহেতু চিন্তার সংঘাতই অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি তাই এ ব্যাপারে জনগণকে দুপক্ষের যুক্তি ও ইতিহাসের শিক্ষায় শিক্ষিত করার সমূহ দরকার আছে।

এক ধর্মের ধর্মরাষ্ট্র বানাবার চেষ্টা করলে দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মের আলাদা রাষ্ট্রকে বৈধ ও উৎসাহিত করা হয়। দুনিয়ায় অসংখ্য ধর্মের ধর্মীয়রাষ্ট্র হলে বিশ্বমানবসমাজ ধর্মের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ভ্রান্তিময় মানুষ যখন ঐশী ধর্মের মালিক হবার অপচেষ্টা করে তখন এসব হতে বাধ্য। ভারতে হিন্দুরা কিংবা ইসরাইলে ইহুদীরা কিংবা পশ্চিমে খ্রীষ্টানরা ওদের ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আমাদের ওপরে ওদের আইন চাপিয়ে দিলে আমাদের যে ভয়ানক অবস্থা হবে তার জন্য দায়ী কে হবে ? আমরা ওদের ওপরে আমাদের আইন চাপাব আর ওরা আমাদের ওপরে ওদেরটা চাপাতে পারবে না, এ দাবীই বা করি কি করে? এসব কারণ ছাড়াও অসংখ্য মুসলিম এমনকি আলেম-উলামা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী সংগঠন "নাহদালাতুল উলামা" কেন ইসলামী রাষ্ট্রতত্বের ঘোর বিরোধী তা দেশবাসীকে জানানো দরকার। তাঁদের প্রকাশিত "দি ইলিউশন অফ অ্যান ইসলামীক স্টেট"(ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম) বইটা ছড়ানো দরকার।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রত্যেকের মানবাধিকার সুরক্ষিত এবং আইনের চোখে সবাই এক। অথচ ধর্মরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান ‘‘হদ্দএর আওতাভুক্ত কোন অপরাধ করিলে তাহার বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যাইবে না’’ -বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড আইন নং ৯১৪ গ এবং হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৮৮। হদ্দ আইন হল ডাকাতি, চুরি, মদ্যপান, খুন- জখম, মানহানী, যৌন-ব্যাভিচার ইত্যাদি। এটাও দেখুন, তওবা করলেই গণহত্যাকারীর শাস্তি হবেনা -বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ১৩। এসব আইন দিয়ে কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে ? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এরকম ভয়াবহ আইন হয় না। ধর্মীয় রাষ্ট্র হাজার হাজার বছর সময় পেয়েছিল নিজেদের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার, এখনো পাচ্ছে কিছু দেশে। কিন্তু কিছু হাতেগোনা শাসকের সময় ছাড়া এর ইতিহাস ভারাক্রান্ত হয়ে আছে জনগণের দুর্ভোগে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে, নারীর অশ্রু আর রক্তে। অতীতে ভারতের হিন্দুরাষ্ট্রের কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সূত্র “প্রাচীন ভারত, সমাজ ও সাহিত্য” - ডঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য্য। 

  • জীবন্ত বিধবাকে মৃত স্বামীর সাথে পুড়িয়ে মারার আইন - অথর্ববেদ ১৮/৩/৩।
  • পিতামাতার জন্য কন্যা অভিশাপ -ঐত্তরীয় ব্রাহ্মণ ৬/৩/১৩।
  • লাঠি দিয়ে স্ত্রীকে মেরে দুর্বল করা উচিত যাতে শরীরের ওপরে তার কোনো অধিকার না 

থাকে - শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/২/১৩।

  • সর্বগুণান্বিতা নারীও অধমতম পুরুষের চেয়ে অধম” -তৈত্তরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২।
  • পুত্রকন্যার সামনে স্বামী উপপত্নী আনা বা বেশ্যাগমন করতে পারবে কিন্তু স্ত্রীর সামান্য 

পদস্খলনে সমাজ কঠোর দণ্ড দেবে”- মৈত্রায়নীর বিভিন্ন আইন ও তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২।

  • কালো পাখি, শকুন, নেউল, ছুঁচো, কুকুর ও নারী হত্যার প্রায়শ্চিত্ত একই

- আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/৯/২৩/৪৫।

  • নারীকে অবরুদ্ধ রাখো, নাহলে তার শক্তিক্ষয় হবে -শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪/১/১/৩১।
  • একটি যজ্ঞে “সদ্যোজাত পুত্রকে ওপরে তুলে ধরা হয়, কন্যাকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়- তৈত্তরীয় সংহিতা ৬/৫/১০/৩।
  • উত্তম নারী হল ‘যে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় ও স্বামীর কথার ওপরে 

কথা বলে না’ ” -ঐত্তরীয় ব্রাহ্মণ ৩/২৪/২৭।

  • সন্তান না জন্মালে ১০ বছর পর ও পুত্র না জন্মালে ১২ বছর পর স্ত্রীকে ত্যাগ করা যাবে

- আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/১০-৫১-৫৩।

  • যার স্ত্রীর চেয়ে পশুর সংখ্যা বেশি সে সৌভাগ্যবান - শতপথ ব্রাহ্মণ ২/৩/২/৮।

ভয়াবহ ব্যাপার, কল্পনা করলেও গা’ শিউরে ওঠে। ইউরোপের গীর্জারাষ্ট্রের অত্যাচারও ছিল ভয়ংকর।

ডিকশনারীতে লেখা আছে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ সেকুলারিজম্এর অর্থ হল এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা যা ধর্মবিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। এর কারণও আছে। হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মীয় রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিতিবিরক্ত জনগণ ঘৃণা ও গণবিক্ষোভের দ্বারা ধর্মীয় রাষ্ট্র উৎখাত করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মের স্থান নেই। বাস্তবে এখনসেকিউলারিজমের-এর অর্থও বদলে গেছে আমূল। ঠিক যেমন “মীর জাফর” শব্দটার অর্থ চমৎকার কিন্তু তা এখন এতই ঘৃণিত যে কোন বাঙালি তার ছেলের ও নাম রাখেওনি কোনদিন রাখবেও না। রাজাকার বা আল্ বদর শব্দেরও ওই দশা। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো এখন ধর্মের বিরোধী তো নয়ই বরং সাংবিধানিকভাবে সব ধর্মকে রক্ষা ও সহায়তা করে।


আমাদের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশন। বায়তুল মুকাররমের সমস্ত খরচ দেয় আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। ইউরোপ-আমেরিকা-ক্যানাডা-অস্ট্রেলিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলোর অজস্র টাকা ও সহায়তায় মুসলিম অভিবাসী, ইসলামি সংগঠন, মসজিদ-মাদ্রাসা, ওয়াজ-মহফিল, রেডিও-টিভি চ্যানেল, এমনকি শারিয়া-ব্যাঙ্ক, শারিয়া-মিউচুয়াল ফাণ্ড, শারিয়া-ইকুয়িটি ইত্যাদি গত কয় দশকে বিস্ফোরিত হয়েছে কয়েকশ’ গুণ। মধ্যপ্রাচ্যের কোটি কোটি দিনার-দিরহামকে কোন ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বাধা দেয়নি হাজার হাজার মসজিদ ও ইসলামি সংগঠন বানাতে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী ইসলামী রাষ্ট্রপন্থী দৈনিক থেকে:-

“জার্মানীতেই বর্তমানে আড়াই হাজারের ওপর মসজিদ রয়েছে। সে-দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন তাঁর সরকার জার্মানীতে আরো মসজিদ তৈরি করবে। একই ঘোষণায় তিনি এ’ও জানান, জার্মানীর সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় জার্মান ভাষায় ইসলাম শিক্ষা দেয়া হবে ... এ বোধোদয় ফরাসী প্রেসিডেণ্ট সারাকোজীর মধ্যেও এসেছে ... উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে তিনি ফ্রান্সে ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অর্থ সহায়তা দিতে পারেন। বৃটেন ইতোমধ্যে মুসলমানদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য প্রদান করেছে ... ইতালীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ইতালীয় ইসলামি সংহতকরণ’ নামে ইতালীতে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান চালু করেছেন। এভাবে ইউরোপের প্রায় সব দেশই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে” (ইউরোপ ও ইসলাম - দৈনিক নয়া দিগন্ত - ২৩শে জুলাই, ২০০৮।

আমেরিকার ডলারে লেখা নেই “ইন্ গড উই ট্রাস্ট”? আদালতগুলোতে বাদী-বিবাদীকে ধর্মীয় শপথ নিতে হয় না? সাংসদ ও রাষ্ট্রপ্রধানকে ধর্মীয় শপথ নিতে হয় না ? ক্যানাডায় সাংবিধানিকভাবে ক্যাথলিক স্কুলে প্রচুর সরকারি টাকা যায় না ? সমস্ত ধর্মীয় স্কুলে সরকারি আর্থিক অনুদানের প্রস্তাব করেনি এক রাজনৈতিক দল ? বিলেতের সরকার রাষ্ট্রীয় ট্রেজারি থেকে শারিয়া-বণ্ড বাজারে ছাড়েনি ? আমেরিকার ট্রেজারী ইসলামি ব্যাঙ্কিং-এর অনুমোদন দেয়নি আমেরিকার সরকারি প্রতিষ্ঠান এ-আই-জি শারিয়া-ব্যাঙ্কিং অনুমোদন দেয়নি ? লণ্ডনের বিশাল মসজিদের জন্য দশ কোটি পাউণ্ড সরকারি অনুদানের প্রস্তাব ছিল না ? জার্মানীর কোলন-এ বৈধভাবে সুবিশাল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে না ? বিলেত ও জার্মানী তাদের আইনে মুসলিম নাগরিকদের জন্য বহুবিবাহের কিছু উপাদান গ্রহণ করেনি ? লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিল আটত্রিশ হাজার পাউণ্ড অনুদান দেয়নি কর্ডোভা ফাউণ্ডেশনকে ? সরকারগুলো পুলিশ দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধান করে না ? করে। বেলজিয়ামের ব্রাসেল্স্ শহরে

সরকার শারিয়ার বিরুদ্ধে মিছিল নিষিদ্ধ করেনি? এক টরণ্টো শহরেই রেজিস্টার্ড ইসলামি সংগঠন নেই একশ’ একুশটা ? আছে। অনানুষ্ঠিানিক আরো কয়শ’? ইংল্যাণ্ডে জার্মানীতে ফ্রান্সে প্রায় সাত হাজার বৈধ ইসলামি সংগঠন নেই? ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো সাধারণত বিশাল জমির ওপরে বিরাট দালান হয়, অনেক দেশে সাংবিধানিকভাবে সেগুলোর সম্পত্তি-কর ও পানি-বিজলির কর মওকুফ করা হয় না যার পরিমাণ বিপুল? সরকারগুলোর ক্ষমতা নেই এগুলোর প্রত্যেকটি বন্ধ করার? টরন্টো স্কুল বোর্ডে প্রতি অক্টোবর মাসে সরকারী খরচে "ইসলামিক ঐতিহ্য মাস"পালিত হয়না?

ওপরের প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব ইতিবাচক, অর্থাৎ হ্যাঁ। এরই নাম ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ধর্মহীন বা ধর্মবিরুদ্ধ বলাটা প্রতারণামূলক অকৃতজ্ঞতা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি অবশ্যই আছে যেমন এর ভেতর থেকেই বুশ-ব্লেয়ার-এর মত গণহত্যাকরী দানব উঠে এসেছে, কিংবা দুর্নীতি, অস্ত্র ও পেশীশক্তির কারণে অনেক দেশে জনগণ ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারে না, ইত্যাদি। কিন্তু বহু দেশে এটা অত্যন্ত সফলও, সময়ের বিবর্তনে জনগণের শিক্ষা-সচেতনতায় ত্রুটিগুলো কেটে যাবে আশা করা যায়। কিন্তু “নিরপেক্ষতা” শব্দের অর্থ “হীনতা” হলে বলতে হয় বিবেকহীন লোক আসলে বিবেক-নিরপেক্ষ লোক, প্রাণহীন দেহ আসলে প্রাণ নিরপেক্ষ এবং বৃষ্টিহীন মরু আসলে বৃষ্টিনিরপেক্ষ মরুভূমি। দাবীটা ভিত্তিহীন তা ব্যাখ্যার দরকার হয়না। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রধান কাজই হল অন্য ধর্মের লোকদের চেয়ে নিজ ধর্মের অনুসারীদেরকে বেশি অধিকার ও সুবিধে দেয়া। না হলে সেটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রই হয় না। ফিলিস্তিনীরা কি ইসরাইলে সমান অধিকার পেতে পারে? পারে না। আমাদের জীবনকালেই ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা ধর্মের নামে দুটো দেশ বানিয়েছিলো, ইসরায়েল ও পাকিস্তান। দুটোই এখন সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। ভারতে হিন্দু রাষ্ট্রবাদীরা মুসলিমদের ওপরে কি তান্ডব চালাচ্ছে তা তো আমরা দেখছি।

ইসলামের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যাখ্যার যে দ্বন্দ্ব সে জটিলতায় আমার পাঠকদের আমি এখনই টেনে নেবনা যদিও সেটাও দরকার হবে ভবিষ্যতে। আপাতত: বিশ্বমুসলিমের ওপরে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার ফলাফল দেখা যাক কারণ যতই মিষ্টিমধুর বাগাড়ম্বর করা হোকনা কেন বৃক্ষের আসল পরিচয় তার ফলেই। ইতিহাসের শিক্ষা কি? ইসলামী ইতিহাসের যেকোনো ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলে কিংবা ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মুসলিম ইতিহাস মুসলিমের হাতে মুসলিমের ওপরে গণহত্যা, হত্যা, বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ, রক্তক্ষয় ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ। “খলিফা” নামধারী গণহত্যাকারীদের হাতে ইসলাম পড়লে কি সর্বনাশ হয়, ইমাম গাজ্জালী থেকে তার উদ্ধৃতি দিয়েছেন মওলানা মওদুদি:-

“বাদশাহদের প্রায় সব জমিজমা ও প্রাসাদ (রিয়েল এস্টেট) অবৈধভাবে অর্জিত। কাহারো উচিত নহে এসব সুলতানকে মুখ দেখানো বা তাহাদের মুখ দেখা। তাহাদের অত্যাচারের জন্য তাহাদিগকে ঘৃণা করা উচিত, তাহাদের অস্তিত্বকেই নিন্দা করা উচিত, তাহাদের প্রশংসা করা উচিত নহে…তাহাদের রাজপ্রাসাদ ও সাজ-পোশাককে নোংরা ও অনৈসলামিক ঘোষণা করা উচিত”… তিনি সকল মন্ত্রীদিগকে চিঠিতে লেখেন যে, − “স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করিয়াছে। আমি এইস্থান ত্যাগ করিয়া যাইতেছি যাহাতে স্বৈরতন্ত্রের এই নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড আমাকে দেখিতে না হয়” - এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেণ্ট ইন্ ইসলাম− পৃষ্ঠা ৬২-৬৩।

ইমাম গাজ্জালীর ইসলামি ব্যাখ্যার সাথে অনেকের দ্বিমত থাকতেই পারে এবং ছিলও, কিন্তু খলিফাদের অত্যাচারে তাঁর হৃদয়ের বেদনা এতে ফুটে উঠেছে। বস্তুত প্রায় প্রতিটি ইমামই এই কষ্ট নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন যে, ইসলামের নামে ভয়াবহ শাসন চলেছে। নেতাদের প্রতি আহ্বান রইল তাঁরা যেন কোনকিছু না লুকিয়ে জাতিকে প্রকৃত ইতিহাস শেখান। এটা আমাদেরই ইতিহাস, এর মুখোমুখি না হয়ে উপায় নেই আমাদের। মুসলিম-সভ্যতার যা বিপুল অর্জন তা সেই কৌতূহলী, মানবদরদী এবং মেধাবী বৈজ্ঞানিকদের উপহার এখনো দুনিয়ার বৈজ্ঞানিকেরা স্মরণ করেন কৃতজ্ঞতার সাথে। হাতেগোনা দু’একজন জ্ঞানপিপাসু খলিফা ছাড়া এর সাথে মুসলিম খেলাফতের যোগ সামান্যই। ইউরোপের বিখ্যাত শারিয়া-সমর্থক বিশেষজ্ঞ বিলাল ফিলিপ-এর বই ‘দি এভল্যুশন অব্ ফিক্হ্’-এর ১০৭ ও ১৩৯ পৃষ্ঠা থেকে সংক্ষেপে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:- “এইভাবে ইসলাম ধর্মটি চার মজহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িল। কেহ এই মজহাবের কোনোটিকেও না মানিলে তাহাকে ইসলাম-ত্যাগী ধরা হইত। এই অতিরিক্ত রক্ষণ-প্রবণতা এতদূর গিয়াছিল যে কোনো এক মজহাব ছাড়িয়া অন্য মজহাবের অনুসারী হইলে তাহার শাস্তি হইতে পারিত। হানাফি মজহাবে শাফি- অনুসারীদের সহিত বিবাহ নিষিদ্ধ করিয়া আইনও করা হইয়াছিল।”

তথাকথিত "ইসলামী" রাষ্ট্রের এই অনাচার থেকে রেহাই পায়নি কাবা শরীফও। খেলাফতের দ্বন্দ্বে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সৈন্যেরা মক্কা আক্রমণ করে ভেঙে দিয়েছিল কাবার শরীফের দেয়াল, আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তার চাদরে। এই হল তথাকথিত "ইসলামী রাষ্ট্র"-এর তাণ্ডব, অস্বীকার করতে পারবেন তথাকথিত "ইসলামী রাষ্ট্র"-এর প্রবক্তারা? বিলাল ফিলিপ বলছেন, “এক মজহাবের অনুসারীরা অন্য মজহাবের ইমামের পেছনে নামাজ পর্যন্ত পড়িত না। এজন্য মসজিদের ভিতরে নামাজ পড়ার আলাদা জায়গা করা হইয়াছিল। কাবা ঘর পর্যন্ত বাদ যায় নাই। প্রত্যেক মজহাবের ইমামের জন্য কাবার চারিপাশে পৃথক চারটি মঞ্চ বানানো হইয়াছিল। আশ্চর্য যে, কাবা’র চারিপাশে এই পৃথক নামাজের জায়গা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অক্ষত ছিল। বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদি (সৌদি আরব ও সৌদী বাদশাহীর প্রতিষ্ঠাতা) ১৯২৪ সালের অক্টোবরে মক্কা বিজয় করিয়া মজহাব নির্বিশেষে একই ইমামের পিছনে নামাজে সব মুসলিমকে একত্রিত করেন।”

এই হলো অবস্থা। যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম আবু হানিফাকে, ইমাম তাইমিয়াকে জেলখানা ভেতরে হত্যা করেছিল "ইসলামী রাষ্ট্রের" খলীফারাই। ইমাম শাফি, ইমাম মালিক, ইমাম হানবলের ওপরে মর্মান্তিক অত্যাচার করেছিল "ইসলামী রাষ্ট্রের" খলীফারাই। ইমাম মালিকের সমর্থকরা ইমাম শাফি’কে এত মর্মান্তিকভাবে প্রহার করেছিল যে তাতেই তিনি কয়েকদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন − চার ইমামের ওপরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কেতাবের একটা “দ্য ফোর ইমামস” − আবু যাহরা, পৃঃ ২৭৩। এ-বইটা দুনিয়ার সর্বোচ্চ গবেষকেরা সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, যেমন ইখওয়ানুল মুসলেমীনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নার নাতি ডঃ তারিক রামাদান। এই খেলাফত ফিরে পেতে চাই আমরা?   কখনোই নয় ! 

শারিয়া অতীতে ন্যায়ভিত্তিক বিচার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল একথাও ঠিক নয়। আইনগুলো পড়ে দেখুন, ও-আইনে ন্যায় বিচার হওয়া সম্ভব নয়। অসংখ্য আইন ও মামলার উদ্ধৃতি দিয়ে ডঃ আমিরা আজহারি তাঁর ‘উইমেন, দ্য ফ্যামিলি অ্যাণ্ড ডিভোর্স ল’জ ইন ইসলামিক হিস্ট্রি’ বইতে দেখিয়েছেন অতীতেও শারিয়া-রাষ্ট্রে মুসলিম নারীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এমনকি তাঁদের ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দেবার জন্য শারিয়া কোর্ট নতুন এক কোরাণ-বিরোধী ফর্ম বানায় যাতে নারীরা বাধ্য হয়ে সই করত। উদাহরণ দিচ্ছি- “…তালাকের পর মোহর আদায় করা স্ত্রীদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ছিল……সতেরো ও আঠারো শতাব্দীতে প্রচুর খুলা হইত। খুলা পদ্ধতিতে স্ত্রীকে যে কোন প্রাপ্য, এমনকি স্ত্রীর নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণও পরিত্যাগ করিতে হইত। এই জন্য খুলার দলিলে এক অতিরিক্ত কাগজ সংযোজিত করা হয়। উহাতে সন্তানদের নাম, পিতার নাম ও সন্তানদের খরচের ব্যাপারে (স্বামীর দায়িত্ব নাই, এই ব্যাপারে - লেখক) স্ত্রীর স্বীকৃতির কথা লিখা থাকে। ভিদিন অঞ্চলের হাওয়া খাতুন ১৭৮৩ সালে স্বামীকে খুলা-তালাক দেয়। তাহাকে মোহরের ৪০০০ অ্যাক্সেসের (তৎকালীন তুর্কী টাকা) অপরিশোধিত ১০০০ অ্যাক্সেস এবং ভরণপোষণের অর্থ পরিত্যাগ করিতে হয়…। জুলাই ১৮০২ − ইস্তাম্বুলের হালিমা খাতুন আসিয়া দাবি করিল যে মোহর পরিত্যাগ করিবার জন্য তাহার স্বামী আহমেদ তাহাকে খুলার জন্য চাপ দিতেছে…। দুর্নীতিপরায়ণ কাজিরা ষড়যন্ত্র করিত ও ঘুষ খাইত” (পৃঃ ৮৯, ৯২, ১০০, ১০৪, ইত্যাদি)।

ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ইহুদী-খ্রীষ্টানদের পাদ্রী-রাবাইরাও বানায়নি, গীর্জাতেও বানানো হয়নি। ওগুলো সংসদে বসে বানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা যাঁরা আধুনিক বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত, বাইবেল-এ নয়। সমাজ-বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধানকে পরিবর্তন করছেন জনগণের নির্বাচিত সাংসদেরাই, গীর্জার পাদ্রী-রাবাইরা নন। ঠিক যেমন বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বহু কষ্টের গবেষণায় বানিয়েছে বহু ওষুধ যা আমাদের প্রাণ রক্ষা করে বা দালান-ব্রিজ-কারখানা ও শিল্পায়নের প্রযুক্তি দেয়। তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি “ইহুদী-খ্রীষ্টানদের শয়তানি ষড়যন্ত্র” ও “কুফরি আকিদা” হয় তবে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের আবিষ্কৃত টুথব্রাশ চিরুণি থেকে শুরু করে বক্তৃতার মাইক বাস ট্রাক কাপড় হিটার এয়ারকণ্ডিশনার জুতো মাথাব্যথার ট্যাবলেট বুড়ো বাবা-মা’র ইনসুলিন কম্পিউটার রেডিও টিভি গাড়ি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি হাজারো ওষুধ সবই “ইহুদী-খ্রীষ্টানদের শয়তানি ষড়যন্ত্র” এবং “কুফরি আকিদা” হতে হয়।

শারীয়াপন্থীরা দাবী করেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মহীনতা। যেখানে মানুষের জীবন ঘিরে আছে হাজারো ধর্মনিরপেক্ষ উপাদানে সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা দাবী করলে মিথ্যাকে জায়েজ করা হয়। এই মিথ্যার সাথে যোগ হয়েছে আল্লাহ-রসূলের নামে ভয়াবহ তথাকথিত "ইসলামী" রাষ্ট্রের আইন:-  

  • • “যদি উদ্দেশ্যটি বাধ্যতামূলক হয় তবে মিথ্যা বলা বাধ্যতামুলক”-শাফি আইন নং আর.৮.২। অর্থাৎ যিনি ধর্মীয় রাষ্ট্রকে বাধ্যতামূলক মনে করেন তাঁর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা, এই মিথ্যা বলাও বাধ্যতামূলক। তাই এ-উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, জঙ্গীতন্ত্র, বিদেশ থেকে গোপন অর্থ-সমাগম, গোপন অস্ত্রশিক্ষা, গোপন জঙ্গীসাহিত্য ইত্যাদির ব্যাপারেও মিথ্যা বলা বাধ্যতামুলক। কি ধরণের ইসলাম এটা? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ওরকম ইসলাম বিরোধী আইন হয়না, সেখানে হয় “তোমরা সাক্ষ্য গোপন করিও না… মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকো ... সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না” - বাকারা ২৮৩ ও ৪২, মায়েদা ১০৬, ইমরাণ ১৬১, সুরা হজ্ব ৩০ ইত্যাদি। সে নির্দেশ লঙ্ঘন করলে কি হবে ? “তাদের মিথ্যাচারের দরুণ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আজাব”- বাকারা ১০।

কাজেই, “বিশ্বকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রধারণা থেকে বের হতে হবে”, হবেই ! সেই সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথাও মনে রাখতে হবে। দেশ ধর্ষকের স্বর্গরাজ্য হবে, ব্যাংক লোপাট হবে, দুর্বৃত্তদের দাপটে ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগনের নাভিশ্বাস উঠবে, সরকারী ক্যাডার ও রাজনীতিবিদেরা নির্লজ্জভাবে ক্রমাগত দখল করবেন সরকারী সম্পত্তি, নদী খাল আর হিন্দুদের সম্পত্তি, সংসদে গালাগালি হবে, সরকারের প্রতিটি বিভাগ দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে অথচ জনগণ বীতশ্রদ্ধ মরিয়া হয়ে বিকল্প খুঁজবে না তা হয়না মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বিশেষ করে সে বিকল্প যদি "আল্লার হুকুম" বলে প্রচার করা হয়। আর সেই কারণেই এই বীতশ্রদ্ধ মানুষগুলোকে এতো সহজে আল্লাহ-রসুলের নামে ইসলাম বিরোধী আইন দিয়ে প্ররোচিত করা যায় !!

হাসান মাহমুদ ০১ অক্টোবর ৪৭ মুক্তিসন (২০১৭)

 

 

Print