“ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি খুঁড়ে জঙ্গীদের বের করা হবে” – র্যাব-প্রধান বেনজীর আহমেদ, প্রথম আলো ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে এবং সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন। এদিকে তনু, মিতু, সাগর-রুনি, নুসরাত, পলি, আবরার, শিশুহত্যা, ছাত্র রাজনীতি ইত্যাদি অসহ্য ঘটনাবলীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জাতির মন-মানস। অনেকে তো খবর পড়াই ছেড়ে দিয়েছেন। বসে নেই জঙ্গীরাও, গোপনে অস্ত্র ও হত্যা পরিকল্পনা চালিয়েই যাচ্ছে তারা। এই সেদিনও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকহ ধরা পড়েছে তারা (বিডিনিউজ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৫ ও ১৭ অক্টোবর ২০১৯ – গাবতলী, সাভার, ফতুল্লা)। তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট – ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। নররক্তের জ্বালানি-চালিত গগনপোতের স্বর্গভিযানে তারা বদ্ধপরিকর।
এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি তিনটে, (১) মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহদের মতো নিজেদের রাজ্যে, (২) গণতান্ত্রিক পন্থায়, যেমন বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো করছে, ও (৩) বাংলাদেশের জঙ্গীরা এই পথের অনুসারী- সশস্ত্র সংগ্রাম যা তালেবানেরা করেছিল আফগানিস্তানে। প্রশাসন খেয়াল করলে ভালো হয়, গ্রেপ্তার, বিচার, শাস্তি- এসব দিয়ে সম্পূর্ণ জঙ্গী উচ্ছেদ কখনোই হবেনা। ইসলামের জঙ্গী ব্যাখ্যা যতদিন থাকবে ততদিনই জঙ্গী জন্মাতে থাকবে। উচ্ছেদ করতে হবে ইসলামের জঙ্গী ব্যাখ্যা এবং অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন কিভাবে সেটা সম্ভব। তাদের গবেষণা সংকলন করা আছে শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি বইতে, ওটা ইন্টারনেটে ফ্রি দেয়া আছে।
ইসলামী রাষ্ট্রপন্থীরা দাবি করেন তারা ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ অর্থাৎ প্রথম চার খলিফার আদর্শে রাষ্ট্র চালাবেন। আচ্ছা ধরুন, আমরা জনগণ তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ম্যাণ্ডেট দিলাম। তখন তারা কী করবেন? আমরা জানি প্রথম চার খলিফা আমৃত্যু ক্ষমতায় ছিলেন এবং চার রকম ভিন্ন পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাই জানতে হবে প্রস্তাবিত ইসলামী রাষ্ট্রে (ক) রাষ্ট্রপ্রধান আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকবেন কিনা, এবং (খ) সেই চার পদ্ধতির কোনটা অনুসরণ করে কেউ রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এবং অন্য পদ্ধতিগুলো বাতিল হবে কিনা।
পদ্ধতিগুলো হল:-
(১) সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মত অনুযায়ী রসূল (স) জনগণের ওপর নেতা নির্বাচনের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন,
(২) হযরত আবুবকর (রা) ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হযরত ওমরকে (রা) পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন,
(৩) হযরত ওমর (রা) ছয় সাহাবীর কমিটি করে তাদের মধ্যে থেকে খলিফা নির্বাচনের ভার দিয়েছিলেন, সে কমিটি হযরত ওসমানকে (রা) খলিফা নিযুক্ত করেছিল,
(৪) হযরত ওসমান (রা) হঠাৎ নিহত হলে হযরত আলীর (রা) বিকল্প ছিলনা, তিনি খলিফা হয়েছিলেন। স্মর্তব্য, সিরিয়ার গভর্নর মাবিয়া’র নেতৃত্বে (তাঁকে “রা.” বলা যাবে কিনা তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে) মুসলিম বিশ্বের একটা অংশ হযরত আলীকে (রা) খলিফা বলে স্বীকার করেনি।
এর কোন পদ্ধতিটা আমরা নেব আর কোনটা বাতিল করব? নাকি সবগুলোই নেব? এছাড়াও আছে নেতা নির্বাচনের সংকট। নিচে দেখুন ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোর সমর্থক এই আলেমদের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক কী। আমি সম্মানিত আলেমদের চরিত্রহনন করতে চাইনা। তাই তাদের নাম উল্লেখ করছিনা। আমি শুধু নেতৃত্বের সমস্যাটা চিহ্নিত করছি। ইউটিউবের শত শত উদাহরণ থেকে দশটা দেখাচ্ছি:-
১. অমুক মওলানা বলেছেন তমুক বিখ্যাত বর্ষীয়ান আল্লামা “এই এই পশুর বাচ্চা”। বর্ষীয়ান আল্লামা ও পশুদুটোর নাম উল্লেখ করছিনা, আপনারা বুঝে নেবেন।
২. অমুক হাফেজ বলেছেন তমুক মওলানা “হারামজাদা”,
৩. অমুক আল্লামা বলেছেন তমুক মওলানা “বুড়া শয়তান”,
৪. অমুক মওলানা তমুক আলেমকে “উচিত শিক্ষা” দিলেন,
৫. অমুক মুফতি তমুক মওলানাকে “আইক্কা ওয়ালা বাঁশ” দিলেন,
৬. অমুক মওলানা তমুক আলেমকে “জুতা পেটা” করলেন,
৭. অমুক মওলানার “ফাঁসি চাই”দাবী করলেন তমুক আলেম,
৮. অমুক মুফতি তমুক মওলানাকে “বাংলাওয়াশ” করলেন,
৯. অমুক মওলানার প্রতি তমুক আলেম – “তুই ব্যাটা কে”??
১০. বিশালকায় আলেম তো ওয়াজে একের পর এক অন্যান্য মওলানা/আলেম/মুফতিদেরকে হুংকারে হুংকারে “কাফের” ফতোয়া দিয়েই যাচ্ছেন। তাকে আবার আরেক মওলানা গালি দিয়ে বলছেন – “কুত্তায় কামড়াইলে ইনজেকশন ল’!! হগগলরে দোজখে পাঠাইয়া হে অ্যাকলা মুমিন ব্যাহেস্তে যাইব”!
এই হল অবস্থা।
জঙ্গীদের বলছি, আচ্ছা ধরে নিলাম আমরা জনগণ আপনাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের ম্যাণ্ডেট দিলাম, তারপর? রাষ্ট্রনেতা নির্বাচনে আপনারা দেশকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে ফেলে দেবেন। কারণ ওই পরষ্পরবিরোধী আলেমদের প্রত্যেকের অসংখ্য সমর্থক আছে। আমি জুজুর ভয় দেখাচ্ছি না। মুসলিম ইতিহাসে এর অজস্র উদাহরণ আছে, কাবা শরীফ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ইমাম, এমনকি বড়পীর জিলানী (র) পর্যন্ত এই ফিতনার হাত থেকে রেহাই পাননি। এই যুগশ্রেষ্ঠ দরবেশের বিরুদ্ধে ইমাম হৌজের নেতৃত্বে এক হাজার ইমাম “কাফের” ফতোয়ায় সাক্ষর করেছিল। টঙ্গীতে তবলিগী দুই দলের ভয়ানক সংঘর্ষ এই বিপর্যয়ের ইঙ্গিত মাত্র (হাজার হাজার তবলীগির মারামারির ময়দানে একই দাঁড়ি টুপি একই পোশাকে উনারা শত্রু-মিত্র চিনলেন কী করে সেটা একটা রহস্য বটে!)। আলেমদের কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে বাকিদের কী অবস্থা করবেন তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয়না। কারণ তাদের একের মতে অন্য আলেম ও তাদের অনুসারীরা হয় পথভ্রষ্ট অথবা ইসলাম ত্যাগকারী মুরতাদ।
‘খাঁটি মুসলিম’ কে তাহলে? আপনি, নাকি আমি ? ওরা, নাকি তারা? ‘কে মুসলিম’ এ প্রশ্নের জবাব আছে দেশের সর্বোচ্চ ১০ জন আলেমদের ভাষ্যে – কে মুসলিম?
১৯৫৩ সালে মওলানা মউদুদীর লেখা ‘দি কাদিয়ানী প্রবলেম’ পুস্তিকাটি মুসলিমদেরকে আহমদী মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দিলে লাহোরে তিনদিনে প্রায় পনেরো হাজার নিরীহ আহমদী নিহত হন, আরো হাজারো আহত হন। এছাড়া তাদের প্রচুর ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়, হাজারো বিধবা ও এতিমের আর্তনাদ হাহাকারে কেঁপে ওঠে দেশ। এতে মউদুদীর ফাঁসির সাজা হয়, পরে সৌদির হস্তক্ষেপে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সবশেষে তিনি ছাড়া পান।
মউদুদী-জামাতের দাবি ছিল আহমদী মুসলিমদেরকে সাংবিধানিকভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করা হোক। কিন্তু কে ‘মুসলিম’ সেটা সংজ্ঞায়িত না করলে তো আর কে অমুসলিম” তা নির্ধারণ করা যাচ্ছেনা। তখন সরকার “কে মুসলিম” সেটা ঠিক করার জন্য প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুনির আহমেদের নেতৃত্বে “মুনির কমিশন” গঠন করেন। তাঁরা মওলানা মওদুদি সহ দেশের সর্বোচ্চ ১০ জন মওলানার সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে ১০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে প্রকাশ করেছিল ‘মুনির কমিশন রিপোর্ট’। বাংলাদেশে যে যা-ই বলুক এই সর্বোচ্চ মওলানারাই জাতির ইসলামী মানস গড়েছিলেন, তাদের মতামতকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। এই মওলানা/আলেমরা হলেন:-
১. মওলানা আবুল আ’লা মউদুদী, আমির, জামায়াতে ইসলামী,
২. মওলানা আহমদ আলী, প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ ইসলাম, মাগরিবী পাকিস্তান,
৩. মওলানা আবুল হাসনাৎ মুহাম্মদ আহমদ কাদরী – প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান
৪. মওলানা গাজী সিরাজুদ্দীন মুনীর
৫. মুফতি মুহাম্মদ ইদ্রিস, জামিয়া আশরাফিয়া, নীলা গামবাদ, লাহোর
৬. হাফিজ কিফায়াত হোসেন, ইদারা-ই হাকুক-ই তাহাফফুজ-ই শিয়া
৭. মওলানা আবদুল হামিদ বাদায়ুনী, কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট, জমিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান
৮. মওলানা মুহম্মদ আলী কান্দালভি, দারুস সাহাবীয়া, শিয়ালকোট
৯. মওলানা আমিন আহসান ইসলাহী
১০. সদর আঞ্জুমান আহমদিয়া’র রাবওয়াহ মওলানার লিখিত বক্তব্য।
অনেকে জেনে অবাক হবেন, মুনির কমিশন তাদের সিদ্ধান্তে লিখেছেন যে এই আলেমরা “কে মুসলিম” সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত হননি। মুসলিম নেতৃত্বের ভয়ংকর অন্তর্দ্বন্দ্বে আজ ক্ষতবিক্ষত বিশ্ব মুসলিম। এমনকি শুক্রবারও আফগানিস্তানে মসজিদে জুমা নামাজে বোমা বিস্ফোরণে নিহত ৬২, আহত না জানি কত, রানা প্লাজার মতো বিধ্বস্ত দালানের ভেতরে আটকে আছেন আরও না জানি কত। গত অগাস্টে শিয়া-সুন্নি শত্রুতায় কাবুলে বোমা মেরে খুন করা হয়েছে ৬৩ জনকে, পাকিস্তানে মসজিদের ভেতরে মুসলিমের হাতে খুন হয়েছে অসংখ্য মুসলিম। “ফিৎনা” শব্দটা খুঁজলে অতীতের একই অন্তর্দ্বন্দ্ব পাওয়া যাবে। আমাদের জঙ্গীগুরুরা কি এ থেকে শিক্ষা নেবেন?
মুনির কমিশন রিপোর্ট থেকে আলেমদের জবাবগুলো নীচে দেয়া হল, গবেষণায় আগ্রহীদের কাজে লাগতে পারে। পরের নিবন্ধে আসবে- “ইসলাম কী? – ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (৩)”।
***
আমি আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরছি মাত্র, এর কিছুই আমার নিজস্ব বক্তব্য নয়।
মওলানা আবুল আ’লা মউদুদী, আমির, জামায়াতে ইসলামী:
১. (ক) প্রশ্ন: কে মুসলিম ?
জবাব: সে মুসলিম যদি সে বিশ্বাস করে তৌহিদে, সকল নবীকে, আল্লাহ’র নাজিলকৃত সকল কেতাবে, ফেরেশতাকে ও কেয়ামতে।
(খ) প্রশ্ন: উপরোক্ত বিষয়গুলিতে বিশ্বাস প্রকাশ করাই কি মুসলিম হিসাবে দাবি করিবার এবং ইসলামে রাষ্ট্রে মুসলিম হিসাবে গণ্য করিবার জন্য যথেষ্ট?
জবাব: হ্যাঁ।
(গ) প্রশ্ন:- কেহ উপরোক্ত বিষয়গুলিতে বিশ্বাসের দাবি করিলে অন্য কাহারো কী তাহার বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার আছে?
জবাব: উপরে আমি যে পাঁচটি শর্ত উল্লেখ করিয়াছি তাহাই হইল ভিত্তি। ঐগুলির মধ্যে কেহ কোন পরিবর্তন করিলে সে ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যায়।
মওলানা আহমদ আলী, প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ ইসলাম, মাগরিবী পাকিস্তান
প্রশ্ন: কে মুসলিম ?
জবাব: সে মুসলিম যদি সে কোরান ও রসূল যাহা বলিয়াছেন তাহা বিশ্বাস করে। যে উপরোক্ত দুইটি বিষয় বিশ্বাস করে সে মুসলিম হইবার অধিকার রাখে। ইহার অধিক কিছু তাহার বিশ্বাস অথবা করিবার প্রয়োজন নাই।
মওলানা আবুল হাসনাৎ মুহাম্মদ আহমদ কাদরী – প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান (১৯৪৮):
প্রশ্ন: কে মুসলিম ?
জবাব:
(ক) তাহাকে অবশ্যই আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাস করিতে হইবে।
(খ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স) ও তাঁহার পূর্ববর্তী সকল নবীদিগকে বিশ্বাস করিতে হইবে।
(গ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স)-কে শেষ নবী হিসাবে বিশ্বাস করিতে হইবে।
(ঘ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স)-এর উপর নাজিলকৃত কোরানে বিশ্বাস করিতে হইবে।
(ঙ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স)-এর বিধি-নিষেধগুলিকে অবশ্য পালনীয় হিসাবে বিশ্বাস করিতে হইবে।
(চ) তাহাকে অবশ্যই কেয়ামতে বিশ্বাস করিতে হইবে।
প্রশ্ন: যে নামাজ পড়েনা সে কি মুসলিম?
জবাব: হ্যাঁ, কিন্তু যে নামাজকে অস্বীকার করে সে মুসলিম নহে।
মওলানা গাজী সিরাজুদ্দীন মুনীর:
আমি তাহাকে মুসলিম মনে করি যে কলেমাতে তাহার বিশ্বাস প্রকাশ করে – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’, এবং রসূলের উদাহরণ অনুযায়ী জীবন যাপন করে।
মুফতি মুহাম্মদ ইদ্রিস, জামিয়া আশরাফিয়া, নীলা গামবাদ, লাহোর:
ফার্সি শব্দ ‘মুসলমান’ দিয়া যে ‘মুসলিম’ বোঝানো হয় তাহা ও ‘মুমিন’-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। ‘মুমিন’ শব্দের পরিপূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে, মুমিন কে তাহা বুঝাইতে আমাকে পাতার পর পাতা লিখিতে হইবে। কেহ আল্লাহ’র আনুগত্য প্রকাশ করিলে সে মুসলিম হয়। তাহার উচিত বিশ্বাস করা তৌহিদে, নবীগণের নবীত্বে ও বিচার দিনে। কেহ আজান বা কুরবানীতে বিশ্বাস না করিলে সে ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যায়। একইভাবে, ‘তাওয়াতির’-এর মাধ্যমে অন্যান্য বহু কিছু আমাদের রসূল হইতে পাওয়া গিয়াছে। মুসলিম হইতে গেলে তাহাকে এগুলিও বিশ্বাস করিতেই হইবে। এগুলির তালিকা দেওয়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
হাফিজ কিফায়াত হোসেন, ইদারা-ই হাকুক-ই তাহাফফুজ-ই শিয়া:
সেই ব্যক্তি মুসলমান বলিবার যোগ্য যে বিশ্বাস করে তৌহিদে, নবুয়তে ও কেয়ামতে। এই তিনটিই মূল ভিত্তি যাহা মুসলমান হইবার জন্য মান্য করিতেই হইবে। এই বিষয়ে শিয়া ও সুন্নির মধ্যে কোনোই তফাৎ নাই। এই তিনটি বিধানে বিশ্বাস করা ব্যতীত মুসলমান বলিয়া গণ্য করিতে হইলে ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ নামে অন্যান্য বিষয় রহিয়াছে যাহা মানিতেই হইবে। এইগুলি সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করিতে হইলে আমার দুই দিন লাগিবে। উদাহরণ হিসাবে বলিতে পারি ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’-এর অন্তর্ভুক্ত পবিত্র গ্রন্থের প্রতি সম্মান, ওয়াজুব-ই নামাজ, ওয়াজুব-ই রোজা, শরীয়ত মোতাবেক ওয়াজুব-ই হজ্ব এবং অন্যান্য অসংখ্য বিষয়।
মওলানা আবদুল হামিদ বাদায়ুনী, কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট, জমিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান (১৯৭০):
(ক) যে ব্যক্তি ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’-এ বিশ্বাস করে সে-ই মোমিন এবং প্রত্যেক মোমিনের অধিকার আছে মুসলমান হিসাবে গণ্য হইবার।
(খ) প্রশ্ন: ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ কি ?
জবাব: যে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভে এবং আমাদের রসূলের (স) রিসালতে বিশ্বাস করে সে ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ পুরন করে।
(গ) প্রশ্ন: মুসলিম বা অমুসলিম হইবার জন্য আরকান (পাঁচটি স্তম্ভ) ব্যতীত অন্য কিছু আছে কি?
জবাব: অবশ্যই আছে।
(ঘ) প্রশ্ন: তাহা হইলে, কেহ যদি আরকান ও আমাদের রসূলের (স) রিসালতে বিশ্বাস করে কিন্তু অন্যের জিনিস চুরি করে, অন্যের সম্পত্তি খেয়ানত করে, প্রতিবেশির স্ত্রীর দিকে কুদৃষ্টি দেয় এবং উপকারীর প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতার অপরাধ করে তবে তাহাকে কি আপনি মুসলিম বলিবেন না?
জবাব: এইগুলি সত্বেও সে মুসলিম, যদি সে উপরোক্ত বিশ্বাসগুলিতে বিশ্বাসী হয়।
মওলানা মুহম্মদ আলী কান্দালভি, দারুস সাহাবীয়া, শিয়ালকোট।
কেহ রসূল (স)-এর নির্দেশ মানিয়া সবগুলি ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ পালন করে সে-ই মুসলমান।
প্রশ্ন: ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’এর সংজ্ঞা কি ?
জবাব:- ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ সেইসব দরকারী বিষয় যাহা ধর্মীয় জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক সকল মুসলমানের জানা আছে।
প্রশ্ন:- ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ এর সংখ্যা কত?
জবাব: উহা এতো বেশী যে উল্লেখ করা অসম্ভব। আমি নিজেই সেগুলি গণনা করিতে পারিব না। সালাত, সাওম এইগুলিকে ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ হিসাবে উল্লেখ করা যাইতে পারে।
মওলানা আমিন আহসান ইসলাহী:
দুই প্রকার মুসলমান আছে – রাজনৈতিক (সিয়াসি) ও প্রকৃত (রিয়্যাল, হাকিকী)। রাজনৈতিক মুসলমান হইতে হইলে তাহাকে অবশ্যই (ক) বিশ্বাস করিতে হইবে আল্লাহ’র একত্বে, (খ) বিশ্বাস করিতে হইবে রসূল (স) শেষ নবী অর্থাৎ জীবনের সর্ববিষয়ে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক (ফাইনাল অথরিটি), (গ) বিশ্বাস করিতে হইবে সকল মঙ্গল ও অমঙ্গল আল্লাহ হইতে আসে, (ঘ) বিশ্বাস করিতে হইবে কেয়ামতে, (ঙ) বিশ্বাস করিতে হইবে কোরান আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত শেষ কিতাব, (চ) মক্কায় হজ্ব করিতে হইবে, (ছ) জাকাত দিতে হইবে, (জ) মুসলমানের মত নামাজ পড়িতে হইবে, (ঝ) ইসলামী সমাজের সকল বাহ্যিক রীতিনীতি মানিয়া চলিতে হইবে, এবং (ঞ) সাওম রাখিবে। এই সকল শর্ত মানিলে সে ইসলামী রাষ্ট্রের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের অধিকারী হইবে। এই দশটি শর্ত শুধুমাত্র প্রকাশ করাই মুসলমান হইবার জন্য যথেষ্ঠ, কেহ জীবনে তাহা পালন করুক বা না করুক। কেহ প্রকৃত মুসলমান হইতে হইলে তাহাকে আল্লাহ ও তাহার রসূলের (স) সকল হুকুম যেইভাবে দেয়া হইয়াছে সেইভাবে পালন করিতে হইবে।
প্রশ্ন: আপনার মতে শুধুমাত্র ‘মর্দ-ই সালেহ’-ই মুসলমান?
জবাব: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: তাহা হইলে আপনার মতে রাজনৈতিক (সিয়াসি) মুসলমানের জন্য বিশ্বাস করাই যথেষ্ঠ, কিন্তু প্রকৃত (রিয়্যাল, হাকিকী) মুসলমানের ক্ষেত্রে শুধু বিশ্বাসই নহে পালন করাও জরুরী?
জবাব: না, আপনি ঠিকমত বুঝেন নাই। সিয়াসি মুসলমানের জন্যও পালন করা জরুরী, আমি বলিতে চাই কেহ যদি মুসলমান হইবার শর্তগুলি বাস্তবে পালন না করে, সে সিয়াসি মুসলমানের বহির্ভূত নহে।
প্রশ্ন: কোনও রাজনৈতিক (সিয়াসি) মুসলমান যদি আপনার বর্ণিত প্রযোজনীয় শর্তগুলিতে বিশ্বাস না করে, তাহাকে কি আপনি বেদ্বীন বলিবেন?
জবাব: না, আমি তাহাকে শুধু বে-আমল বলিব।
সদর আঞ্জুমান আহমদিয়া’র রাবওয়াহ মওলানার লিখিত বক্তব্য
যে রসূল (স)-এর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত এবং কলেমা তৈয়ব-এর ওপর তাহার বিশ্বাস প্রকাশ করে সে-ই মুসলমান।
***
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করোনা, এই করে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে (মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও বিদায় হজের বাণী)।
- ১৯ অক্টোবর, ২০১৯