ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার: সফল জঙ্গীবাদ উচ্ছেদ প্রকল্প ও আহলে হাদিস

০৯ ডিসেম্বর ২০১৯ - উগ্রবাদবিরোধী জাতীয় সম্মেলনে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট-প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন (১) জঙ্গিদেরকে ডি-র‌্যাডিক্যালাইজ অর্থাৎ বুঝিয়ে শুনিয়ে উগ্রতা থেকে বের করার মেকানিজম তাঁদের নেই বললেই চলে, এবং (২) ধৃত জঙ্গীদের ৯০% এর বেশী জঙ্গী ইসলামী সংগঠন ‘আহলে হাদিস-এর সদস্য।

তাঁকে অজস্র ধন্যবাদ, তিনি জঙ্গী ও জঙ্গীবাদের পার্থক্য, জঙ্গী সমস্যার চরিত্র ও নিজেদের সীমাবদ্ধতা সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। এর ভিত্তিতে প্রশাসন ও আলেমদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশ জঙ্গীমুক্ত হবে কি হবেনা। এ বিষয়ে আমাদের দীর্ঘকাল ধরে মৌলবাদ-বিরোধী ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক তাত্বিক ও ময়দানের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা প্রশাসনের কাজে লাগতে পারে। 

২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ - আবারও ৬ জঙ্গী ধরা পড়েছে। ধরা না পড়লে আবার যে কোনো মুহূর্তে আরেকটা হলি আর্টিসান হতে পারত, আবার অনেকগুলো রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকত। সরকারী হিসেবে এখনো আরও কয়েকটি জঙ্গী দল সক্রিয়। অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিক এখনো ভয়াবহভাবে অরক্ষিত। জঙ্গীবাদ উচ্ছেদে অনেকে অনেক প্রস্তাব করেছেন, তার প্রায় প্রতিটিতেই কিছু পথনির্দেশ আছে। সরকারও চেষ্টা করছে কিন্তু শেকড়টা রয়েই যাচ্ছে। অনেকে বলছেন জঙ্গীবাদ উচ্ছেদ করতে হলে "প্রকৃত ইসলামের রূপ” তুলে ধরতে হবে। কিন্তু "প্রকৃত ইসলাম" কি তা নিয়ে আলেমদের মধ্যেই বিপুল মতভেদ। এ সত্যটা আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি যে, জঙ্গীদের কাছে ওদের আদর্শই "প্রকৃত ইসলাম" এবং ইসলামের শান্তিময় ব্যাখ্যার পাশাপাশি আরেকটা ব্যাখ্যা আছে যা ওদের হিংস্রতার চালিকাশক্তি। সে ব্যাখ্যার দলিল নীচে দেয়া হল। জঙ্গীদের উগ্রতার কারণে নিরপরাধের প্রাণহানী ছাড়াও দুনিয়ায় ইসলামের একটা ভয়ংকর ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর নিরসন হওয়া দরকার।

(১) আলেমরা জঙ্গীদের তীব্র সমালোচনা করছেন কিন্তু জঙ্গীরা তাঁদের কথা মানছেনা। কাজেই তাঁদের জঙ্গী-বিরোধীতার পাশাপাশি সহায়ক হিসেবে আমাদের অন্য পন্থা যোগ করতে হবে। সেটা হল, জঙ্গীদের দলিল দিয়েই ওদের চোখ খুলে দেয়া। বাংলাদেশে ওদের প্রধান উদ্দেশ্য গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে শারিয়া আইন ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু আলেম ও মুসলিম বিশেষজ্ঞ শত শত দলিল দিয়ে অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন ইসলামের উদ্দেশ্য "ইসলামিক স্টেট্" অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয় বরং "স্টেট্ অফ ইসলাম" অর্থাৎ শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা। এঁদের মধ্যে আছে বিখ্যাত আলেম উলামাদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন "নাহদাতুল উলামা", তাঁদের বইয়ের নাম "The Illusion of an Islamic State" - ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম। ২০১৩ সালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল চার কোটি। এরকম মুসলিম গবেষক আরও অনেক আছেন যেমন ড. বাসাম তিবি, ড. আবদুল্লাহ আন নাঈম, ড. খালেদ আবু আল ফাদেল, ড. হাশিম কামালি ইত্যাদি। জঙ্গীদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজ করতে তাঁদের বইগুলো অপরিহার্য্য। সেসব গবেষণার অনেকটা সংকলন করা আছে "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" বইতে (৪র্থ সংস্করণ)। প্রশাসন ও সুশীল সমাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে বইটি পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলে থাকার সময় মাননীয়া শেখ হাসিনা যখন আমেরিকা এসেছিলেন তখন মি: জামাল হাসান তাঁকে বইটি উপহার দিয়েছিলেন। ওটা ছিল ১ম সংস্করণ, নাম ছিল "ইসলাম ও শারিয়া"।

Jamal Hasan presents the book to the Honorable Sheikh Hasina

জামাল হাসান মাননীয়া শেখ হাসিনাকে বইটি উপহার দিচ্ছেন

"শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" বইয়ের "শারিয়া আইনের উদাহরণ" এবং "আইনে আইনে বিরোধ" অধ্যায় দুটোতে শারিয়া আইনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু কেতাব থেকে আইন নম্বর সহ অজস্র আইনের উদ্ধৃতি আছে যা জঙ্গীদের চোখ খুলতে সাহায্য করবে। যেমন:-

  • তওবা করলে গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারীদের শাস্তি হবে না (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ১৩)। কিংবা,
  • খুন-জখম চুরি-ডাকাতি মদ্যপান ইত্যাদি (হুদুদ) মামলায়, নারীদের চাক্ষুষ সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। (হানাফি আইন পৃঃ ৩৫৩; শাফি’ই আইন #o.24.9, ক্রিমিন্যাল ল’ ইন্ ইসলাম অ্যাণ্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড পৃঃ ২৫১, মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরাণ পৃঃ ২৩৯, পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৪, বিধিবদ্ধ ১ম খণ্ড, ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড, ধারা ৫৭৬)। কিংবা,
  • খুন-জখম চুরি-ডাকাতি মদ্যপান ইত্যাদি (হুদুদ) অপরাধের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের শাস্তি তো দূরের কথা তাঁর বিরুদ্ধে মামলাই করা যাবেনা (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড আইন নং ৯১৪ গ এবং হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৮৮)। কিংবা,
  • খুন-জখম চুরি-ডাকাতি মদ্যপান ইত্যাদি (হুদুদ) হুদুদ মামলায় নারী-বিচারক অবৈধ।

এরকম অজস্র। গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গীদেরকে বইটার ওই অধ্যায় দুটো প্রিন্ট করে দিলে ওরা নিশ্চয়ই বুঝবে, যেই আইন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা খুন করছে খুন হচ্ছে ওটা ইসলামী হতে পারেনা এবং ওটা দিয়ে রাষ্ট্র চালানো অসম্ভব। সেক্ষেত্রে ওদের কেউ কেউ জঙ্গীবাদ থেকে ফিরে আসবেই এবং সেটা হবে অন্য জঙ্গীদের জন্য শিক্ষামূলক। এক প্রাক্তন তালিবান যোদ্ধা সহ প্রাক্তন কয়েকজন জঙ্গী এখন জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয়, তাদেরকে আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাছাড়া, আল্লাহ এক রসূল (স) এক কোরান এক হলেও বিভিন্ন শারিয়া আইনের (মযহাব) মধ্যে ব্যাপক বিরোধ আছে যার অনেক উদাহরণ "আইনে আইনে বিরোধ" অধ্যায়ে দেয়া আছে। এমন মামলাও আছে যাতে মালিকি আইনে অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড অথচ হানাফী আইনে বেকসুর খালাস। এগুলো জানলে আশা করা যায় জাতির ও জঙ্গীদের চোখ খুলবে।      

গ্রামভিত্তিক সফল "জঙ্গীবাদ উচ্ছেদ" প্রকল্প:-  

পদ্ধতিটা শান্তিপূর্ণ, সরল এবং সফল। এতে নেই কোন হুংকার, নেই আর্থিক লেনদেন বা নেতৃত্বের কোন্দল। গ্রামবাসীদের কম্পিউটার নেই এবং তারা টিভিতে রোম্যান্টিক নাটক-মুভি দেখতে পছন্দ করে। এগুলো মাথায় রেখে আমরা রোম্যান্টিক গল্পের কাঠামোতে ইসলামী ও শারিয়া সূত্রসমৃদ্ধ দুটো শর্ট ফিল্মও বানিয়েছি, "নারী" ও "হিল্লা"। ওগুলো ইন্টারনেটে আছে, নির্মাণ করেছেন রাকিবুল হাসান আর অভিনয়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও ইলোরা গহর। ২০১১ সালে আমরা ঢাকার রাজনীতি, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার ঢক্কানিনাদ থেকে বহুদূরে এক গহন গহীন গ্রামে একটা ডিভিডি প্লেয়ার আর ডিভিডিতে মুভি দুটো কপি করে পাঠাই। সেখানে আমাদের কর্মীর বাসায় সপ্তাহে দুতিনবার পনেরো-বিশ-তিরিশজন গ্রামবাসী নারী-পুরুষ ডিভিডি চালিয়ে মুভি দুটো দেখে। এতে বিনোদনের পাশাপাশি তাদের শারিয়া আইন, ইসলামী রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। মোটামুটি এক মাসে পুরো গ্রামের মানুষ সচেতন হবার পর ডিভিডি প্লেয়ার আর মুভির ডিভিডিটা অন্য গ্রামে দেয়া হয়। এভাবে গত নয় বছরে পঞ্চাশটাও বেশী গ্রামের মানুষ সচেতন হয়েছে, এখন ওসব গ্রাম থেকে কারো জঙ্গী হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।  গ্রামবাসীদের কম্পিউটার ইন্টারনেট নেই তাই পুরো আন্দোলনটা করতে হয়েছে কর্মীদের সাথে আমাদের সাপ্তাহিক টেলিফোনে নির্দেশের মাধ্যমে, রিপোর্টও এসেছে টেলিফোনেই।

উল্লেখ্য, কাগজে আসেনা কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে মাঝে মাঝে এখনো তিন তালাকের ঘটনা ঘটে কারণ অনেক আলেম তিন তালাকের বিরোধী হলেও কিছু ইমাম ওটাকে সমর্থন করেন (তাঁদের ওয়াজ দেখে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি)। এ যাবৎ আমাদের কর্মীরা "হিল্লা" মুভিটি দেখিয়ে ছয়টি হিল্লা  বিয়ে বন্ধ করেছে, তার মধ্যে চারটে বন্ধ করেছেন ওই ইমামরাই যাঁরা হিল্লা’র ফতোয়া দিয়েছিলেন। আমাদের কর্মীরা তাঁদেরকে "হিল্লা" মুভি দেখিয়েছিল, তাঁরা মুভিতে দেখানো সূত্র মিলিয়ে ফতোয়া ফিরিয়ে নিয়েছিলেন (সূরা বাকারা ২২৯, ২২৯, সহি মুসলিম ৩৪৯১, ৩৪৯২, ৩৪৯৩, সুনান আবু দাউদ ২১৯৪ ইত্যাদি অনেক সূত্র মোতাবেক তাৎক্ষণিক তালাক অবৈধ। তাছাড়া সূরা ত্বালাক আয়াত ২ মোতাবেক সাক্ষীরও দরকার যা তিন তালাকে প্রায়ই থাকেনা)। বাকী দুই ইমামকে মানাতে হয়েছিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল, গ্রামের সম্মানিত মুরুব্বী এঁদের মাধ্যমে।      

যে পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে পঞ্চাশ ষাটটা গ্রাম জঙ্গীবাদ-মুক্ত হয়েছে সেটা পরীক্ষিত পদ্ধতি, সেটা দিয়ে সারা দেশ জঙ্গীবাদ-মুক্ত হতে পারে।

২. জনাব মো. শফিকুল ইসলাম জঙ্গীদের সাথে তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বলেছেন ধৃত জঙ্গীদের ৯০% এর বেশী আহলে হাদিস-এর সদস্য। দেশে আহলে হাদিস-এর আলেম অনেক, তাঁদের অনুসারীও অসংখ্য। স্বভাবত:ই তাঁরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। আমরা জানি আহলে হাদিস সহ দেশের সবগুলো ইসলামী দলগুলোই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু এই জঙ্গীরা তো জঙ্গী হয়ে জন্মায়নি, তারা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উৎস দ্বারা এ হিংস্রতায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে। ভালো হয় যদি সরকার ও আলেমরা অনতিবিলম্বে সেই উৎসগুলোকে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করেন। জঙ্গীরা আলেমদের শিক্ষা ভুল বুঝে থাকলে তাদের ভুল শোধরানো এবং আর কেউ যাতে ভুল না বোঝে তা নিশ্চিত করা আলেমদেরই দায়িত্ব।   

জঙ্গীদের "ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা"-র ধর্মতাত্বিক ডায়নামিক্সটা বুঝে নিলে আমরা সফল পদক্ষেপ নিতে পারব। সেটাই দেখা যাক এবার।

৩. বিশ্ব-মুসলিম বিভিন্ন ফিরকা তরিকায় বিভক্ত হয়েছে কারণ কোরান-রসূলকে (স) বিভিন্নভাবে ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার একটি ব্যাখ্যা হল, শারিয়া আইনভিত্তিক বিশ্ব-ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাই ইসলামের লক্ষ্য ও কোরান-রসূলের (স) হুকুম। এই ব্যাখ্যাই জঙ্গী-মানসের মূল চালিকাশক্তি।    

“ইসলাম দেশ-জাতি নির্বিশেষে ইসলামের দর্শন ও কর্মপদ্ধতির পরিপন্থী সকল রাষ্ট্র ও সরকারকে পৃথিবী হইতে ধ্বংস করিতে চায়…….ইসলামের নীতি ও শিক্ষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন না করা পর্যন্ত আমাদের শাহাদা (কলমা পড়া) পূর্ণ হইবে না”- মওলানা মউদুদী, ‘ইসলামে জিহাদ’ পৃঃ ৬ ও ‘উইটনেস টু ম্যানকাইণ্ড’ পৃষ্ঠা ৩২।   

এটা ভাবা ভুল হবে যে মউদুদীই সর্বপ্রথম দাবীটা করেছেন। আসলে ১৪০০ বছর আগে সুরা তওবা আয়াত ২৯-এর ভিত্তিতে ইসলামকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ‘তলোয়ারের আয়াত’ নামে প্রসিদ্ধ সেই আয়াতটা হল - "তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবের (ইহুদী-খ্রীষ্টান) ঐ লোকদের সহিত যাহারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসুল যাহা হারাম করিয়া দিয়াছেন তাহা হারাম করে না এবং সত্যধর্ম গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তাহারা হাত জোড় করিয়া জিজিয়া প্রদান করে"। এর ভিত্তিতে ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে:-

“তখন আল্লাহ সুরা তওবা-তে (অমুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি ইত্যাদি - লেখক) সমস্ত বাধ্যবাধকতা বাতিল করিতে হুকুম করিলেন। এবং আদেশ করিলেন সকল মুশরিকদের এবং ইহুদী-খ্রীষ্টানদের সহিত যুদ্ধ করিতে যদি তাহারা ইসলাম গ্রহণ না করে অথবা স্বেচ্ছায় অপমানিতভাবে আত্মসমর্পণ করিয়া জিজিয়া কর না দেয় যাহা সুরা তওবা আয়াত ২৯-এ নাজিল হইয়াছে। সুতরাং, মুসলমানদিগকে চিরকালের জন্য পৌত্তলিক, ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাতিল করার বা সমঝোতায় আসিবার বা হিংস্রতা বাতিল করার অনুমতি দেওয়া হইল না যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানেরা তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি রাখে। সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে, প্রথমে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল। তারপর যাহারা মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যাহারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসনা করে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হইল ও পরে যুদ্ধকে বাধ্যতামূলক করা হইল”। সূত্র:- সহি বুখারী (অখণ্ড) পৃঃ ১০৮১, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মুহসিন খান-এর অনুদিত।

এর সমর্থনে কোরানের কিছু আয়াতের ব্যাখ্যাও করা হয়েছে (সূরা হাদীদ আয়াত ২৫ ইত্যাদি) এবং আবারও ওই ‘তলোয়ারের আয়াত’-এর উদ্ধৃতি দিয়েই "আল্লাহ'র আইন" বানানো হয়েছে, - মুসলিম খলিফা দুনিয়ার সব অমুসলিমকে আহ্বান জানাবেন ইসলাম গ্রহণের, সেটা না হলে জিজিয়া কর দেবার, তাতেও রাজী না হলে তারা ইসলাম গ্রহণ না করা পর্য্যন্ত ক্রমাগত অন্তহীন যুদ্ধ করার আদেশ - আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প ও স্বাক্ষরে সত্যায়িত শাফি আইনের কেতাব "উমদাত আল সালিক" পৃষ্ঠা ৬০২, ৬০৩ আইন নং ও.৯.৮ এবং ও.৯.৯।    

চূড়ান্ত লক্ষ্যনীয়, সূরা তওবার ওই আয়াত ২৯ নাজিল হয়েছিল একটা তাৎক্ষণিক যুদ্ধের পটভূমিতে। অথচ সেই তাৎক্ষণিক যুদ্ধের পটভূমিতে নাজিল হওয়া আয়াতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে ইসলামের চিরকালীন শাশ্বত চরিত্র। আত্মপ্রতারণা আর কাকে বলে! ইসলামের এই সংজ্ঞা দুনিয়ার সব অমুসলিমদের বিরুদ্ধে চিরযুদ্ধের আদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক প্রগতিশীল ইসলামী বিশেষজ্ঞ এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, একটার উদ্ধৃতি:- “কোরাণের একশ’টির বেশি মূল্যবোধের আয়াত যেমন দয়া, ক্ষমা, শান্তি, ন্যায়-ব্যবহার ও সহনশীলতাকে ‘তলোয়ারের আয়াত’ বাতিল করিয়াছে বলিয়া দাবি করা হয়…..ইহা হয়ত তখন কাজে লাগিয়াছে যখন মুসলমানেরা পৃথিবীতে রাজনৈতিক-সামরিক শক্তিতে অনন্য ছিল। কিন্তু ইহা তখনো যথার্থ ছিল না, এখনো এই পরিবর্তিত বিশ্বে ইহা গ্রহণযোগ্য নহে”- প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স, পৃঃ ৫০৭, ডক্টর হাশিম কামালি।       

এই শেকড় থেকেই থেকেই বিশ্ব-ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শারিয়া ডক্ট্রিনের জন্ম যা জঙ্গীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। এ ডক্ট্রিনে জঙ্গী-গুরুরা এমন সম্মোহনী শব্দাবলী ব্যবহার করেন যার প্রভাব ভক্ত মুসলমানের মনে হ্যামিলনের বাঁশির চেয়েও প্রবল। যেমন কোরানের কিছু আয়াত ও হাদিস (সূরা মায়েদা ৪৪, বাকারা ২০৮, "তলোয়ারের ছায়ার নীচে বেহেশত”- সহি বুখারী হাদিস ২৮১৫ ইত্যাদি)। টগবগে মুসলিম তরুণের পক্ষে এই প্রচণ্ড ঐশী আহ্বান উপেক্ষা করা অসম্ভব, এবং এর সাথে আছে 'মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী'-র দুর্বার আকাঙ্খা - কারো বা আছে ৭২ হুরীর স্বপ্ন। সমস্যা ও দুর্নীতি জর্জরিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপক্ষে মুসলিম সমাজে এসব শব্দ সর্বরোগ নিবারণী বেহেশতী বিকল্পের স্বপ্ন-সঞ্চার করে।  সেই সাথে বিশ্বময় ইন্টারনেটে  ইসলাম-বিদ্বেষীদের নোংরা পোষ্ট, সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজের শোষণের বিরুদ্ধে ক্রোধ, অমুসলিমদের দ্বারা মুসলিম নিগ্রহ (যদিও তারা অমুসলিমদের ওপর মুসলিমদের অত্যাচারের ব্যাপারে নীরব) ইত্যাদি তো আছেই।

৪. কালতামামী:-

বিশ্বাসীদের অকল্পনীয় দক্ষতা আছে নিজের ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তি বা বাহানায় ডিফেণ্ড করার। যে লোক বিশ্বাস করে প্রাচীন ভারতে অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছিল তার প্রমাণ গণেশের হাতীর মাথা মানুষের দেহ তাকে সে বিশ্বাস থেকে নড়ানো মুরগীর দাঁতের মতোই অসম্ভব। কাজেই জঙ্গিদেরকে "তোমাদের ইসলাম আসলে ইসলাম নয়" বলে লাভ হবেনা। তার চেয়ে অনেক কার্যকর ওদেরকে এবং জাতিকে শারিয়া কেতাব থেকে আইনগুলো দেখিয়ে আলোকিত করে তোলা।

এক নুতন বছর এসেছে আমাদের জীবনে। এ বছর হোক শুধু জঙ্গীমুক্ত নয় বরং জঙ্গীবাদ-মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পরীক্ষিত পদ্ধতির প্রয়োগ যেখানে কোরান রসূলের (স) নামে বইবেনা নিরীহের রক্তস্রোত, ইসলাম হবেনা বদনাম। হ্যাঁ, সময় খারাপ এখন। কিন্তু একাত্তরের রক্তক্ষতে অর্জিত আমাদের মাতৃভূমি তো একটা বাগান, তাই না? 

বাগান হোক না শত, ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত - নামহীন কোনো ফুল ফুটবেই,

দূর দুরান্ত থেকে, যুগ যুগান্ত থেকে - কলিতে অলিরা এসে জুটবেই! 

তীক্ষ্ণ খরার পরে, খালবিল নদী ভরে - উত্তাল জল ছল ছলবেই,

ক্ষুদ্র মরণ শেষে, রুদ্র জীবন এসে - জীবনের রূপকথা বলবেই !

হোক পথ দু:সহ, দুর্গম ভয়াবহ - দু'এক পথিক পথ চলবেই,

বোধের বন্ধদ্বারে, নিকষ অন্ধকারে - বিদ্রোহী কিছু দীপ জ্বলবেই  !!

ইসলামের নামে হিংস্রতার বিরূদ্ধে দেশের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠুক এই বিদ্রোহী দীপ সেই প্রত্যাশায় সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও সালাম ....

হাসান মাহমুদ

https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/59166

Print