ইসলামে পুনর্বিবাহ - জানা অজানা

ইসলামে পুনর্বিবাহ - জানা অজানা

০৩ এপ্রিল ২০২১ -   https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/65895

শৈশবে আপনার বাবা-মা'র সংসার ভেঙে গেলে আপনার কেমন লাগত? কিভাবে বড়ো হতেন? আতংকে শরীর শিউরে উঠছে, তাই না?

গত মাসে বৌয়ের সাথে আবদুল্লা'র বিধি মোতাবেক পুরো তালাক হয়ে গেছে, এখন ওরা আবার সংসার করতে চায়। ওদের চার বছরের একটা ছেলে আর দু'বছরের একটা মেয়ে আছে। ওই অসহায় শিশুদুটোর চোখের দিকে তাকান।

কি মনে হয়?

চলুন, সামনে এগুনো যাক।    

জানা পর্ব

ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদের কয়েকটি পদ্ধতি আছে যেমন বিভিন্ন পদ্ধতিতে স্ত্রীকে স্বামীর তালাক দেয়া বা স্ত্রী আদালতে আবেদন করে শারিয়ার "খুলা" আইনের মাধ্যমে সম্ভব হলে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করা। পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলেমদের কিছুটা মতভেদ আছে, কিন্তু এ নিবন্ধের বিষয় হল চূড়ান্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর একই স্বামী স্ত্রীর পরস্পরের সাথে পুনর্বিবাহ। এরকমটা ঘটে বাস্তবে। অনেক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রী মনে করেন তালাকের সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল, সংসারটা চালিয়ে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তো তাদের জন্য এর বিকল্প নেই, বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বাবা মা দুজনই দরকার। তখন তাদের পুনর্বিবাহের জন্য বিশ্ব-মুসলিম অতীত বর্তমানে মেনে চলেছে সংশ্লিষ্ট শারিয়া আইন যা বানানো হয়েছে সূরা বাকারা আয়াত ২২৯ ও ২৩০-এর ভিত্তিতে। সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে দিচ্ছি :-

“তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে ……..যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে এরপর সেই পুরুষের পক্ষে সেই স্ত্রী হালাল হবেনা যে পর্যন্ত না সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে উভয়ের পুনরায় মিলিত হওয়াতে গুনাহ নেই"।

অর্থাৎ তালাক পুরো হয়ে গেলে তারা সরাসরি পরস্পরকে আবার বিয়ে করতে পারবে না, স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে করতে হবে। এটাই আমরা জানি, এটাই প্রচলিত। কিন্তু ঠিক কি চরিত্রের স্বামীর কোন সে ঘটনায় বাকারা আয়াত ২২৯ নাজিল হয়েছিল? ইরানের নিশাপুরে ১০০০ সালের দিকে জন্মেছিলেন বিখ্যাত ইমাম আল ওয়াহিদি, তাঁর সুবিখ্যাত কেতাব "আসবাব আল নুজুল" (“আয়াত নাজিলের শ্রেষ্ঠ বিবরণ”) ইসলামে দলিলের এক অনন্য নির্ভরযোগ্য কেতাব যাতে কোরানের অনেক আয়াতের পটভূমি ধরা আছে। সংক্ষেপে কেতাবের ২৩ পৃষ্ঠা থেকে সূরা বাকারা আয়াত ২২৯-এর পটভূমি তুলে দিচ্ছি। ইসলামে "ইদ্দত" হল অন্যত্র বিয়ের আগে স্ত্রীর অপেক্ষা-কাল, সাধারণত: তিন মাসিক। 

"(বর্ণনাকারী অনেক সাহাবীদের সনদ) বলিয়াছেন, 'ইহাই প্রচলিত ছিল যে, স্ত্রীকে তালাক দিবার পর ইদ্দত শেষ হইবার পূর্বে স্বামী তাহাকে ফিরাইয়া লইতে পারিত, হাজার বার তালাক দিলেও (অর্থাৎ যতবার ইচ্ছা - লেখক)। এক বিশেষ সাহাবী (কেতাবে সাহাবীর নাম নেই - লেখক) তাহার স্ত্রীকে তালাক দিল এবং ইদ্দত শেষ হইবার ঠিক আগে তাহাকে ফিরাইয়া লইল। ইহার পরপরই সে আবার স্ত্রীকে তালাক দিল এবং বলিল - 'আল্লাহ'র কসম! আমি তোমাকে ফিরাইয়াও লইব না এবং কখনোই অন্য কাহাকে বিবাহ করিতেও দিবনা'। তখন মহান আল্লাহ নাজিল করিলেন - 'তালাক উচ্চারণ অবশ্যই দুইবার; ইহার পর তাহাকে সম্মানের সহিত রাখিবে কিংবা সদয়ভাবে মুক্ত করিতে হইবে' (মাস্ট বি রিটেইন্ড ইন অনার অর রিলিজড ইন কাইন্ডনেস)”। 

অর্থাৎ তালাক-বিয়ের চক্র দুবারের বেশী করা যাবেনা। এই হুকুম প্রসারিত হয়েছে পরের আয়াতেই - সেই স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করে সেখান থেকে বিধিমতো তালাক বা সেই স্বামীর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আগের অত্যাচারী স্বামীর বিন্দুমাত্র অধিকার নেই তাকে আবার বিয়ে করার, তাও আবার নারীর সম্মতিক্রমে- আয়াত ২৩০।     

অর্থাৎ স্ত্রীদের সম্মান, অধিকার ও জীবন নিয়ে অত্যাচারী স্বামীদের শতাব্দী প্রাচীন ইঁদুর-বেড়াল খেলার কুপ্রথাকে কোরান বজ্রাঘাতে উচ্ছেদ করেছে। আমি বুঝতে অক্ষম যাঁরা কোরানকে নারী-বিরোধী বলেন তাঁরা কেন এই দলিলগুলো উল্লেখ করেন না। অন্যদিকে, আয়াতটা অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে নারীর রক্ষাকবচ কিন্তু ওটা প্রয়োগ হয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে, এমনকি প্রেমময় স্বামীর ক্ষেত্রেও।

আয়াত ২২৯ ও ২৩০ এই যে - "যে পর্যন্ত না সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে"- নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল অন্য কাউকে বিয়ে করার বা না করার। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এর বর্বর প্রয়োগ আমরা দেখেছি তালাকের পর হিল্লা বিয়ের নামে নারীকে জোর করে অন্যের সাথে বিয়ে দিয়ে তার বিছানায় পাঠানো হত। এটা ইসলামের নামে ধর্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুখের বিষয় অনেক আলেম এ বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে শক্তিশালীভাবে দাঁড়ানোর ফলে ধীরে ধীরে এটা মোটামুটি উচ্ছেদ হয়েছে। আগের প্রজন্মরা যেটা ইসলামী মনে করে প্রয়োগ করতো, বর্তমান প্রজন্ম বুঝে গেছে আসলে ওটা ইসলামী নয়।  কিংবা ওটা কোরানের সেই অতীত সমাজের জন্য নির্দেশ যা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি যেমন অমুসলিমদের ওপরে জিজিয়া কর কিংবা দাসদাসীর বৈধতা। হতে পারে আমরাও এখন এমন কিছু ইসলামী মনে করে প্রয়োগ করছি কয়েক প্রজন্ম পরে মুসলিমেরা আর তা করবেনা। সমাজ এভাবেই এগোয়।     

অজানা পর্ব

অতীত বর্তমানের বেশ কিছু স্কলার ও আলেমদের এখানে ওখানে প্রকাশিত কিছু বিচ্ছিন্ন নিবন্ধে এটা আমি পড়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়নি, গণমানসে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটাই তুলে ধরছি , সূরা বাকারা আয়াত ২৩২:-

"যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও, তারপর তাদের ইদ্দৎ পূর্ণ হয়ে যায়, সে অবস্থায় তারা স্বামীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে তাদেরকে বাধা দিও না যখন তারা বৈধভাবে উভয়ে আপোষে সম্মত হয়"- তাইসিরুল কুরআন। 

  • Yusuf Ali: When ye divorce women, AND THEY FULFILL the term of their ('Iddat), do not prevent them from marrying their (former) husbands, if they mutually agree on equitable terms.
  • Sahih International: “And when you divorce women AND THEY HAVE FULFILLED their term, do not prevent them from remarrying their [former] husbands if they agree among themselves on an acceptable basis”.
  • Mustafa Khattab, the Clear Quran – “When you have divorced women AND THEY HAVE REACHED THE END of their waiting period, do not prevent them from re-marrying their ex-husbands if they come to an honourable agreement”.
  • Pickthall: “And when ye have divorced women AND THEY REACH their term, place not difficulties in the way of their marrying their husbands if it is agreed between them in kindness”.
  • Shakir: “And when you have divorced women AND THEY HAVE ENDED their term (of waiting), then do not prevent them from marrying their husbands when they agree among themselves in a lawful manner”.
  • Mohsin Khan: “And when you have divorced women AND THEY HAVE FULFILLED THE TERM OF THEIR PRESCRIBED PERIOD, do not prevent them from marrying their (former) husbands, if they mutually agree on reasonable basis”.
  • Arberry: “When you divorce women, AND THEY HAVE REACHED THEIR TERM, do not debar them from marrying their husbands, when they have agreed together honourably”.

(Emphasis mine).  কোন ঘটনায় নাজিল হয়েছিল সূরা বাকারা আয়াত ২৩২?

1.  "আসবাব আল নুজুল" কেতাব থেকে সংক্ষেপে , পৃষ্ঠা ২৪: -

 সাহাবী মাকাল বিন ইয়াসার তার বোনকে তার কাজিনের সাথে বিয়ে দিল, যে স্বামী পরে সেই স্ত্রীকে তালাক দিল। তারপরে তারা আবার বিয়ে করতে চাইলে ক্রূদ্ধ মাকাল তাতে প্রচণ্ড বাধা দিল। তখন এই আয়াত নাজিল হয় - "যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করে, তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না"। আয়াত নাজিলের পরে মাকাল সম্মত হয় ও আবার তাদের বিয়ে হয়।         

2 . সার্চ - সূরা বাকারা: ২২৮-২৩৬ নম্বর আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও ঘটনা (পর্ব-১০),  মাওলানা ওমর ফারুক - ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম, ১৩ জানুয়ারি ২০২০:- "আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করে নেয়, তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে করতে বাধা দান করো না। এ উপদেশ তাকেই দেয়া হয়েছে যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে। এর মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। (আয়াত-২৩২) ।

শানে নুযুল : হজরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি তার ভগ্নিকে জনৈক মুসলমান ব্যক্তির কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার কাছে যতদিন জীবন যাপন করার করলেন। পরে তার স্বামী তাকে এক তালাক দেয়। ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি তাকে ফিরিয়ে নেননি। কিন্তু এরপর স্বামীও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন আর তার স্ত্রীও স্বামীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাই অন্যান্য প্রস্তাবকারীদের মধ্যেও তাকে আবার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তখন ভাই মাকাল (রা.) তাকে বলল হে ইতর! এই নারীর মাধ্যমে তোমাকে আমি সম্মান দিয়েছিলাম তাকে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম কিন্তু তুমি তাকে তালাক দিয়ে দিলে। আল্লাহ কসম! তুমি আর কখনো তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। রাবী বলেন, আল্লাহ তায়ালা জানতেন এই স্ত্রীর প্রতি তার স্বামীর টানের কথা এবং এই স্বামীর প্রতি ওই নারীর টানের কথা। তখন আল্লাহ পাক উক্ত আয়াত নাজিল করেন। মাকাল এ আয়াত শোনার পর বললেন, আমার পরওয়ারদিগারের আদেশ শুনেছি এবং তা শিরোধার্য করে নিচ্ছি এর পর তিনি উক্ত ভগ্নিপতিকে ডেকে আনলেন এবং বললেন, তোমরা কাছে আমি আমার বোনকে পুনরায় বিয়ে দিচ্ছি আর আমি তোমার সম্মান করছি। (তিরমিযি-২:১১, মুখতাছার-১:২)" - উদ্ধৃতি শেষ।    

তাহলে? এই পদ্ধতিতে কোরান রসূল (স) মানাও হল, সংসারটা বেঁচে গেল, বাচ্চারা ভয়াবহ ট্রমা থেকে বেঁচে গেল। কোনটা ভালো ?

কান পেতে শুনুন দিগন্তের ওপর হতে ভেসে আসছে কার কণ্ঠস্বর - "দুইটি প্রেমময় হৃদয়ের মধ্যে বিবাহ হইতে উত্তম আমি আর কিছু দেখি না" - সহি (সুনান)ইবনে মাজাহ, ৩য় খণ্ড হাদিস ১৮৪৭।

এর সাথে যোগ করুন -

“…তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ্ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না ………দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি” - সূরা বাকারা ১৮৫ ও হজ্ব ৭৮।

সবাইকে সালাম। 

Print