তুরস্কের হায়া সোফিয়া – ইসলামের বিজয়?

তুরস্কের হায়া সোফিয়া – ইসলামের বিজয় ??

হাসান মাহমুদ - 18 July 2020

https://bangla.bdnews24.com/opinion_bn/archives/62835

প্রশ্নটা উঠেছে এবং সময়ই এর জবাব দেবে। বস্তুত; বহুদিন ধরে বিশ্ব-মানব তাদের সীমিত সম্পদের (সময়, জ্ঞান, অর্থ, চিন্তা, প্রচেষ্টা ইত্যাদি) বেশিরভাগই ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক সমস্যা সমাধানে নয় (দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা ইত্যাদি) বরং নিজেদেরই সৃষ্ট সমস্যার পেছনে (যুদ্ধ, সুইসাইড বম্বিং, পুঁজিবাদের শোষণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি)। এ কেমন সেরা সৃষ্টি?

সংক্ষেপে পটভূমি:

৫৩৭ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান কনস্টান্টিনোপলে তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইমারত এই 'হায়া সোফিয়া' গির্জা তৈরি করেন। দীর্ঘ ৯১৬ বছর ওখানে (বিভিন্ন সময়ে অর্থোডক্স ও ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের) উপাসনার পর ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান মুহাম্মদ ফতেহ কনস্টান্টিনোপল দখল করে খ্রিস্টান প্রতিকৃতিগুলো কোরানের আয়াত দিয়ে ঢেকে ওটাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গির্জাটা ব্যক্তিগত টাকায় কিনেছিলেন। বেচাকেনার সেই দলিল তুর্কি সরকারের কাছে আছে, ওটার কপি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক খেলাফত উচ্ছেদ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ৪৮১ বছর ওখানে মুসলিমদের ইবাদতের পর ১৯৩৪ সালে তিনি ওটাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। তারপর ১০ জুলাই ২০২০, 'এই গির্জাকে জাদুঘর বানানো ভুল ছিল' সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এটিকে মসজিদ বানানোর আদেশে সই করেছেন। স্বভাবতই এ নিয়ে তুমুল আন্তর্জাতিক, ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া হয়েছে, পক্ষ-বিপক্ষের দলিলপত্র, যুক্তি ও স্কলারদের বক্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও ইন্টারনেটে ব্যাপক কুরুক্ষেত্র চলছে।

বিরোধী পক্ষের বক্তব্য:

"অটোমান সম্রাট যা করেছিল সেটা ছিল লজ্জাজনক, অপমানজনক এবং সুস্পষ্ট গুনাহ….. এখন তুরস্ক আবার সেটাই করল, লজ্জাজনক, অপমানজনক এবং সুস্পষ্ট গুনাহ" -প্রাক্তন কূটনীতিক বর্ষীয়ান ইমাম শেখ ইমরান হোসেন, যার কয়েক মিলিয়ন অনুসারী আছে।

যেহেতু বিষয়টা জরুরি ছিল না তাই বিশ্ব-মহামারীর দুঃসহ দুর্যোগের মধ্যে হঠাৎ এই নতুন বিতর্ক অনেককেই বিরক্ত করেছে। সব সমাজেই সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত আছে, তুরস্কের খ্যাতনামা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক ইয়ালদিরাই ওগুর বলেছেন "তুরস্কের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে পাশ্চাত্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে"। আমিরাতের যুব ও সংস্কৃতি মন্ত্রী এবং ন্যাশন্যাল কমিটি ফর এডুকেশন অ্যান্ড সায়েন্স-এর চেয়ারপার্সন বিদুষী নারী নুরা বিনত মুহাম্মদ আল কাবি বলেছেন বিশ্বের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো বিশ্বমানবের সম্পদ, এগুলোকে সংরক্ষণ করা উচিত।

তুরস্কের বিপক্ষে সোচ্চার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি গেজেট, আল আরাবিয়া, আরব নিউজ ইত্যাদি সংবাদপত্রের কিছু কলামে এরদোয়ানকে 'মুনাফেক', 'উগ্রপন্থী' বলা হয়েছে। তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকসহ অনেক মুসলিমের মতে বিশ্বময় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের উত্থানের এই বৈরীকালে তুরস্কের উচিত ছিল হযরত ওমরের (র) আদর্শ অনুসরণ করা। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা জেরুজালেম জয় করলে তিনি সেখানে যান। শহরের পাদ্রী সোফ্রোনিয়াস তাকে গির্জার ভেতর নামাজ পড়ার করার আমন্ত্রণ জানালে তিনি বলেন সেখানে নামাজ পড়লে ভবিষ্যতে মুসলিমরা এই অজুহাতে গির্জাকে মসজিদ বানিয়ে ফেলতে পারে। তিনি গির্জার বাইরে নামাজ আদায় করেন যেখানে পরে 'মসজিদে ওমর' নির্মিত হয়।

তুরস্কের বিপক্ষে রুশ অর্থোডক্স চার্চ-প্রধান ক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন, ভ্যাটিকানের পোপ 'ব্যথিত' হয়েছেন, ইউনেস্কো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রীসসহ বিভিন্ন দেশ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে৷ ইউনেস্কো জানিয়েছে কোনো আলোচনা না করে তুরস্কের এই একতরফা সিদ্ধান্তে ইউনেস্কো গভীরভাবে মর্মাহত, তুরস্ক যেন "ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্ট"-এর আইনগুলো মেনে চলে ('হায়া সোফিয়া' ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টের অন্তর্ভুক্ত)। জবাবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, "আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ আমরা ইউনেস্কোকে জানাব। তুরস্কের সিদ্ধান্ত দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। যেভাবেই হোক আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে অবশ্যই রক্ষা করব, তুরস্কের সার্বভৌমত্বকে লংঘন করে এমন মতামতকে আমরা জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করব"।

সমর্থক পক্ষের বক্তব্য:

তুরস্ককে সমর্থন জানিয়েছেন ড. জাকির নায়েক, ড. ইয়াসির ক্বাধী'র মতো বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী স্কলারেরা, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর, ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী সংগঠন 'মুহম্মদীয়াহ' ও 'নাহদাতুল উলামা' সহ আরো অনেকে।  ইন্দোনেশিয়ার সাংসদ সুরাহমান হেদায়েত, সাইপ্রাস, ইরান ও রাশিয়া বলেছে এটি তুরস্কের 'আভ্যন্তরীণ বিষয়।  বহু মুসলিম আবার এটাকে 'ইসলামের বিজয়' হিসেবে উল্লাস করছেন, সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ভারত বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির বানাচ্ছে, এতে অনেক ক্ষুব্ধ মুসলিম হায়া সোফিয়ার ঘটনাকে 'ভারতের ওপর সফল প্রতিশোধ' হিসেবেও দেখছেন। তুরস্ক-সমর্থকদের যুক্তি হল,

  • বিশ্বনন্দিত ইসলামী স্কলার ড. ইয়াসির কাধি বলেছেন বিজয়ী সুলতানের অধিকার ছিল গির্জা নিয়ে যা খুশি করার। তার পরেও তিনি জবরদখল না করে ওটা কিনে নিয়েছিলেন।
  • ড. জাকির নায়েক বলেছেন জেরুজালেমের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি ছিল যা এক্ষেত্রে ছিল না। কাজেই দুটোর তুলনা করা ঠিক নয়।
  • সম্প্রতি পশ্চিমা দেশে বহু গির্জা মসজিদ কমিটির কাছে বিক্রি করা হয়েছে,
  • জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া পুরনো মসজিদকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনা কেন অন্যায় হবে?
  • স্পেনসহ বহু দেশে অমুসলিমরা মুসলিমদেরকে পরাজিত করে বহু মসজিদকে গির্জা বানিয়েছে,
  • ইসরাইল ৭০০ বছরের পুরোন আল আহমার মসজিদকে নাইট ক্লাব বানাল তখন বিশ্ব-বিবেক কোথায় ছিল?
  • বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় ইউনেস্কো কী করছিল?

যুক্তিগুলো শক্তিশালী। তবে কিনা, শেষের উদাহরণগুলোও অপরাধ এবং এক অপরাধ দিয়ে অন্য অপরাধের বিচার করা যায় না। তাছাড়া, ইসরায়েল আল আহমার মসজিদকে নাইট ক্লাবে রূপান্তরিত করল, এই ন্যাক্কারজনক কাজের বিরুদ্ধে মুসলিম নেতারা কিছু করেননি কেন? ৫৬টা মুসলিম দেশের শক্তিশালী সংগঠন ও আই সি কিছু করেনি কেন? তাদের তো দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়ার কথা !

কালতামামি

১. অতীতে বিজয়ী রাজারা পরাজিত অঞ্চলের জমি বাড়িঘরসহ প্রতিটি জিনিস এমনকি পরাজিত জনগণেরও একচ্ছত্র মালিক হতো।  সেক্ষেত্রে তুরস্কে বিজয়ী সুলতান নিজেরই সম্পত্তি 'কিনে নিলেন', এ দাবী একান্তই ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন। 

২. হায়া সোফিয়া তো পাড়ার গির্জা ছিল না, ওটা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় খ্রীষ্টানদের সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় উপাসনালয়। যেমন আমাদের কাবা, পোপের ভ্যাটিক্যান, অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দির, তেমনি। এগুলো কেনাবেচার অধিকার কারো নেই, এগুলো অবশ্যই কেনাবেচার ঊর্ধে।

“As Greek Orthodox was the official religion of the Byzantines, the Hagia Sophia was considered the central church of the faith, and it thus became the place where new emperors were crowned.” - https://www.google.com/search?client=firefox-b-d&q=Was+Hagia+Sophia+central+church+of+world+Christianity?&spell=1&sa=X&ved=2ahUKEwiynJrbmL77AhUZlIkEHaxIASUQBSgAegQIBRAB&biw=1247&bih=564&dpr=1.09

“The Hagia Sophia stood as THE MOST IMPORTANT CHRISTIAN CHRUCH (emphasis mine) in the world from its construction under Justinian until until 1453 when Constantinople fell to the Ottomans” - https://www.catholicworldreport.com/2020/07/10/the-stones-of-the-hagia-sophia-will-still-cry-out/

পরাজয়ে অপমানিত কোনো ধর্মগুরু মহা আনন্দে অপমানকারীর কাছে নিজেদের উপাসনালয় বিক্রি করে দেবেন, এ কি হতে পারে ?  ড. ইয়াসির কাধি বলেছেন ওটা কেনা হলেও নিশ্চয় চাপ দিয়ে কেনা হয়েছে। আমি বলছি সেক্ষেত্রে ওটা অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পত্তি, এবং অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পত্তির ওপরে মসজিদ হতে পারেনা একথা তো আলেমরাই বলেন। কে কাকে ঠকাচ্ছে তাহলে ?

৩. এখন পশ্চিমা বিশ্বে যে গির্জাগুলো কিনে মসজিদ হয়েছে সেগুলো প্রধানতঃ ট্রাস্টের সম্পত্তি, অতীতে বিজয়ী রাজাদের মতো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।  

৪. 'সার্বভৌম' ও 'আভ্যন্তরীণ বিষয়' একথা ক্রিমিন্যালেরা বলে। একাত্তরে আমাদের ওপরে গণহত্যা গণধর্ষণ নিয়ে এবং জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উঠলে এই একই কথা বলেছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও গোলাম আজম। গত বছর ভারত কাশ্মীর গিলে খাবার পর জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিও একই আপ্তবাক্য আউড়েছেন - "কাশ্মীর আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়"।

না, অন্যায় কখনো কারো "অভ্যন্তরীণ বিষয়" হতে পারেনা। কারণ "Injustice anywhere is threat to justice everywhere" -মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। সেজন্যই আমরা ফিলিস্তিনের ওপরে ইসরাইলের অত্যাচারের বিরোধীতা করি। চীনে উইঘুর মুসলিমরা, পাকিস্তানে বেলুচরা, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, মিসর-নাইজেরিয়া-সিরিয়ার খ্রিস্টানরা, একাত্তরে আমাদের ওপরে পাকিস্তানের গণহত্যা গণধর্ষণ এগুলো কারো 'আভ্যন্তরীণ বিষয়' হতে পারেনা, বিশ্বমানবের অধিকার ও দায়িত্ব আছে এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর।

৫.  ছলের তো বাহানার অভাব হয় না, ইসলামের আগে আল আকসা মসজিদ ইহুদীদেরই উপাসনালয় ছিল! এদিকে ভারতে দিগগজ পণ্ডিতদের গবেষণায় "তাজমহলসহ ঊনত্রিশ হাজার মন্দির ভাঙিয়া মসজিদ বানাইবার তালিকা" আছে মোদী সরকারের লক্ষ লক্ষ উগ্র ধর্মান্ধের হাতে। এগুলোর ভিত্তিতে ইসরায়েল ও ভারত যদি আল আকসা ও ভারতের মসজিদগুলো মন্দির বা সিনাগগ বানায়, সেক্ষেত্রে আমরা চীৎকার প্রতিবাদ করলেই তারা তুরস্কের এই উদাহরণ ছুঁড়ে আমাদের কপালে আলু তুলে দেবে।  তুরস্কের এই উদাহরণে বিশ্বমুসলিমের অকল্পনীয় ক্ষতি হতে পারে।

সভ্যতা এগিয়েছে সখ্যের শক্তিতে, সংঘাতের নয়।  উপাসনালয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবিশ্বাস্য উদাহরণ রেখে গেছেন শিখ গুরু অর্জুন দেব। ১৫৮৫ সালে অমৃতসরে শিখদের সর্বোচ্চ উপাসনালয় স্বর্ণমন্দির নির্মাণে তিনি সেটার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়েছিলেন লাহোর থেকে মুসলিম দরবেশ শেখ মিয়া মীরকে ডেকে এনে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন চমৎকার উদাহরণটা কোথায় হারাল?  ইসলামের বিজয় জীবনে ও সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায়।  সেটা সৈন্যবাহিনী দিয়ে দেশ দখল বা কোর্ট-কাচারী করে ইমারত বিজয়েও নয়। অতীতে বিজয়ী রাজারা পরাজিতদের অজস্র উপাসনালয় ধ্বংস করেছে বা বদল করে নিজেদের করেছে। সেই প্রেতাত্মার বোঝা আমরা কেন বয়ে বেড়াব?

Print