একটি বিতর্ক প্রায়শই উত্থাপিত হয় যার কোনো প্রয়োজন নেই কিংবা এ বিতর্কে আজ আমাদের কোনো লাভ হবে না, তা হচ্ছে ইসলামে সশস্ত্র জিহাদের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক। তা ইসলামের ধর্ম বিশ্বাস, পবিত্র স্থান ও ভূখণ্ড রক্ষার্থে আত্মরক্ষামূলক জিহাদ হবে নাকি বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রসারে আক্রমণাত্মক জিহাদ হবে। সমসাময়িককালের বহু স্কলার এ বিষয়ের ওপর লিখেছেন এবং তারা দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন। জিহাদ হবে আত্মরক্ষামূলক এ মতের সপক্ষে রয়েছেন সাইয়েদ মুহাম্মদ রশীদ রিদা, শায়খ মাহমুদ শালত, শায়খ মুহাম্মদ আবু জাহরা, শায়খ মুহাম্মদ আল গাজালী ও শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ আল মাহমুদ প্রমুখ।
তাদের যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে আল-কোরআনের বহু সংখ্যক আয়াতঃ আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে সীমা লঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভঅলোবাসেন না (সূরা আল বাকারাঃ ১৯০)। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ সুতরাং তারা যদি তোমাদের থেকে নিবৃত্ত থাকে ও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদেরকে শান্তি প্রস্তাব দেয় তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ রোখেননি (সূরা আন নিসাঃ ৯০)।
অন্যমতের পক্ষে রয়েছেন মাওলানা সাইয়েদ আবূল আলা মওদূদী, শহীদ সাইয়েদ কুতুব প্রমুখ।
তাদের যুক্তির ভিত হচ্ছে তলোয়ারের আয়াত (আয়াতুস সাইফ)। তাদের দাবি অনুযায়ী এ আয়াত পূর্বেকার সকল আয়াত রদ করে দিয়েছে এবং যে পরিস্থিতিতে এগুলো নাজিল হয়েছিল তার অবসান ঘটেছে। তবে তারা খোদ তলোয়ারের আয়াত প্রশ্নেও দ্বিমত পোষণ করেছেন, কারণ কোরআনের কোন আয়াতটি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতে পারে তা সর্বসম্মতভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি।
বর্তমান তিনটি কারণে এ ইস্যু নিয়ে বিতর্কের আর প্রয়োজন নেইঃ
প্রথমত, আমরা মুসলমানরা জিহাদের দায়িত্ব পালন করিনি যা ইসলামী দেশগুলোর প্রত্যেকের জন্যে ফরজ। বিশেষ করে দখলদার ও আগ্রাসীদের হাত থেকে মুসলিম ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা। আর এ মুসলিম ভূখণ্ডগুলো হচ্ছে ফিলিস্তিন, ইরিত্রিয়া, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান, তাসখন্দ, বোখারা, সমরখন্দ, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, সোভিয়েত ইউনিয়নের [১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগের অবস্থা। এখন ছয়টি মুসলিম প্রজাতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরঘিজিয়া, কাজাখিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান।] অন্যান্য মুসলিম প্রজাতন্ত্র এবং চীন, ইথিওপিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের অন্যান্য স্থান। কোনো মুসলমানই ইসলাম বিরোধী শক্তির হাত থেকে এসব দেশ উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার বিপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে পারে না। আর তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য আল্লাহর সিদ্ধান্ত আল-কোরআনের এ আয়াতঃ আর তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছ না এবং ঐ সব দুর্বল নির্যাতিত ও অত্যাচারিত পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য যারা প্রার্থনা করছে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে এ জনপদ থেকে উদ্ধার করুন যার অধিবাসীরা অত্যাচারী, আর আমাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক দাঁড় করিয়ে দিন যিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে কাউকে পাঠান যিনি সাহায্য করবেন (সূরা আন নিসাঃ ৭৫)।
মুসলিম উম্মাহ এ বাধ্যতামূলক আত্মরক্ষামূলক কর্তব্য পালন করেনি, তাহলে এখন আক্রমণাত্মক জিহাদের কথা কিভাবে উঠতে পারে?
দ্বিতীয়ত, আক্রমণাত্মক জিহাদ হচ্ছে এর প্রবক্তাদের মতে আল্লাহর বান্দাদের পথে যে শক্তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজে মুসলমানদেরকে বাধা দেয়ার অপচেষ্টা চালায়, তাদেরকে অপসারণ করা। কিন্তু আজ আমাদের পথে কেউ বাধা হতে পারে না যদি আমরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আমাদের দাওয়াত সারা বিশ্বে অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। মৌলিক, লিখিত ও অডিও-ভিডিও মাধ্যমে সকল ভাষায় বিশ্বের সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া যায়। বর্তমানে রেডিও, টেলিভিশন, বইপত্র, সংবাদপত্র ও বিশ্বের সকল দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাধ্যমে দাওয়াতের বাণী পৌঁছে দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের লোকদের অবহেলা অন্তহীন। আমরা যদি খৃস্টান মিশনারীদের সাথে আমাদের কাজ কর্মের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে, তারা তাদের ধর্মমত প্রচারের জন্যে অন্তত এক হাজার ভাষা-উপভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মিশনারীকে পৃথিবীর চতুর্দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের প্রচারাভিযান এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে তারা এখন আমাদেরকেও খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার ইচ্ছে পোষণ করছে যেন আমরা তাদের অনুসরণ করে চলি।
তৃতীয়ত, আমরা সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে পরনির্ভলশীল। যাদের বিরুদ্ধে আমরা আক্রমণাত্মক জিহাদ শুরু করতে চাই তারাই সবরকম অস্ত্র তৈরী করে এবং আমাদের কাছে বিক্রি করে। এটি যদি তারা না করত, তাহলে তাদের মোকাবিলায় আমরা নিরস্ত্র, প্রতিরক্ষাহীন এবং কোনো কিছুই করতে সক্ষম নই। এ যদি অবস্থা হয়, তাহলে সারা বিশ্বকে আমাদের দাওয়াতের আওতায় আনার জন্যে কিভাবে আক্রমণাত্মক জিহাদের কথা বলতে পারি। যখন আমরা কেবল সেই অস্ত্রই সংগ্রহ করতে পারি যা তারা আমাদেরকে দেয় এবং সেই সব অস্ত্রই কেবল আমাদের হাতে আসতে পারে যেগুলো তারা আমাদের কাছে বিক্রি করতে রাজী নয়।
*************************************************************