শারিয়া আইনের সংস্কার অসম্ভব কেন ?
হাসান মাহমুদ
ফ্যাক্ট ১: - বৈশ্বিক কনসোর্টিয়াম 'রিজলভ নেটওয়ার্ক'- এর বাংলাদেশে গবেষণা জরিপে '৮০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা মনে করেন শরিয়াহ আইন থাকলে দেশে দুর্নীতি কমবে…। ২০১১-১২ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপেও একই সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল'। দৈনিক প্রথম আলো ২৬ জানুয়ারি, ২০২২। (শারিয়া আইন এবং ইসলামী রাষ্ট্র সমার্থক – লেখক)।
ফ্যাক্ট ২: - ১৭ জুন ২০২১ তারিখে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল 'ফেইস দ্য পিপল' আয়োজিত আমার সাথে ইসলামী রাষ্ট্র বিষয়ক আলোচনায় বর্ষীয়ান আলেম কামালউদ্দীন জাফরী বলেছেন - "পুরাতন যেগুলো গৎবাঁধা যে সমস্ত ফিকাহের কিতাব, যেমন- আমার কাছেও একটা আছে, এর মধ্যে মাঝে মাঝে অনেক ভুল আমি লক্ষ্য করেছি। এগুলো নতুন করে দেখতে হবে। বর্তমান অবস্থাটা কি তার প্রেক্ষিতে কোনটা আমাদের জন্য প্রযোজ্য। আমরা হুদুদের মধ্যে এদিক সেদিক করতে পারবোনা, বাকিগুলো তো আমাদের এখতিয়ার দেওয়া আছে সুতরাং এই প্রেক্ষিতে ফিকাহকে নতুন করে আমরা সাজাতে পারবো, ইনশাআল্লাহ এর মধ্যে কোন সন্দেহ নাই”। এ অনুষ্ঠানের জন্য 'ফেইস দ্য পিপল'-কে ধন্যবাদ, ইন্টারনেটে প্রায় দশ লাখ মানুষ এটা দেখেছেন- link- https://www.facebook.com/facethepeoples/videos/779164182747471
আপনারা "শারিয়া আইনের উদাহরণ"-এ দেখেছেন বেশ কিছু শারিয়া আইন অন্যায়, অত্যাচারী ও মানবতা বিরোধী এবং এগুলোর সংস্কার আবশ্যক (https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/214-2023-03-24-00-05-10)। মউদুদীও বলেছেন এক সময় মুসলিমদের:- "তলোয়ার ও কলম সর্বোচ্চ শাসক ছিল। কিন্তু তারপর তাহাদের প্রচেষ্টার প্রাণশক্তি দুর্বল হইয়া পড়িল ও তাহারা শারিয়াকে পরিবর্তিত সময়ের উপযোগী করিয়া ব্যাখ্যা করিবার সক্ষমতা হারাইল" - "দি সিক নেশনস অফ দি মডার্ন এজ" - পৃষ্ঠা ৮। কিন্তু মউদুদীর কি কোন ধারণ ছিল "শারিয়াকে পরিবর্তিত সময়ের উপযোগী করিয়া ব্যাখ্যা" করতে গেলেই আলেমদের সামনে কি বিপুল পাহাড় প্রমান বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিছু "সহি" হাদিস ও ইসলামী দলিল? আলেমরা কি সেটা অতিক্রম করতে পারবেন?
পারবেন না।
কেন পারবেন না তার উদাহরণ অজস্র, দুটো দেখাচ্ছি। এ নিবন্ধে "বি-ই-আ" হল আমাদের ইসলামী বিশেষজ্ঞ জনাব শাহ আবদুল হান্নান সহ ৬ জন আলেমের কমিটি দ্বারা প্রধানত: হানাফী আইন থেকে সংকলিত তিন খণ্ডের "বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন", প্রকাশক বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন।
উদাহরণ ১: - শারিয়া আইনে পরিকল্পিত হত্যার (কতলে আমদ) শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বাবা মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না। (বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৬৫ ক ও খ ; শাফি’ই আইন পৃঃ ৫৮৪ − Law #o.1.2.4
স্পষ্টতই এটা অন্যায় আইন। কিন্তু এ আইনকে সংশোধন করতে গেলেই আলেমদের বাধা হয়ে দাঁড়াবে সহি তিরমিজি ১৪০৫, ১৪০৬ ও সুনান ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড হাদিস ২৬৬২। এর সমর্থনে আছে সহি তিরমিযী হাদিস ১৪০৪ (দিয়াত বা খুনের রক্তমূল্যের প্রেক্ষাপটে)। ওই উদ্ভট ও অন্যায় কথাটা নাকি নবী (সা:) বলেছেন !! এখন, আলেমরা কী করবেন? ওই হাদীসগুলোকে বাতিল করার সাহস রাখেন তাঁরা ? যাহোক, আমরা বিশ্বাস করি অমন একটা অন্যায় উদ্ভট কথা আমাদের নবীজী (স) বলতে পারেন না ।
উদাহরণ ২: কোনো অমুসলিমকে খুন করলে মুসলিম খুনির মৃত্যুদণ্ড হবেনা, পেনাল ল অফ ইসলাম পৃ- ১৪৯।
স্পষ্টত এটাও অন্যায় আইন কিন্তু এ আইন সংশোধন করতে গেলেই আলেমদের সামনে এসে দাঁড়াবে ৪টি ইসলামী দলিল:-
ক. মদিনা সনদ, – 'দ্য ফার্স্ট রিটন কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্ল্ড' (পৃথিবীর প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র) – ড. মুহম্মদ হামিদুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৪৫: – 'কোন অবিশ্বাসীকে খুন করার বদলে কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে খুন করিবে না'- ধারা ১৪।
খ. সুনান আবু দাউদ হাদিস ২৭৪৫ – 'কোনো অবিশ্বাসীকে খুন করিবার জন্য অবশ্যই কোনো বিশ্বাসীর মৃত্যুদণ্ড হইবেনা',
গ. শারিয়া আইনের অন্যতম স্তম্ভ ইমাম শাফি-র রিসালা – 'কোনো অমুসলিমকে খুন করার জন্য কোন মুসলিমের মৃত্যুদণ্ড হইবে না'। (al-Shafii's Risala – Treatise on the Foundations of Islamic Jurisprudence- পৃষ্ঠা ১৪২)।
ঘ. হযরত আলীর (রা) বর্ণনায় সহি বুখারী ৪র্থ খণ্ড হাদিস ২৮৩: 'কাফেরকে হত্যা করার জন্য কোনো মুসলমানকে হত্যা করা উচিত নহে'।
আলেমরা তাহলে কী করবেন? ওই দলিলগুলোকে বাতিল করার সাহস রাখেন তাঁরা ? রাখেন না। এরকম অন্যায় শারিয়া আইনগুলো কে, কবে, কেন এবং কোন অধিকারে শারিয়া কেতাবে লিখলেন সে প্রশ্ন তোলার সাহসও তাঁরা দেখান নি কোনোদিন। ইসলামী আন্দোলনের অজস্র তরুণ আমাকে মেসেঞ্জারে জানিয়েছেন আলেম জাফরীর কথা সঠিক। ইসলামী রাষ্ট্রপন্থিদের তুলনায় তাদের সংখ্যা কম, কিন্তু 'স্নো-বল এফেক্ট'- এ বাকি অংশের মধ্যে এই উপলব্ধি ছড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। অনুষ্ঠানের পরে 'শারিয়া কি বলে আমরা কি করি' বইয়ের লিংকে ক্লিক হয়েছে অজস্র:- https://hasanmahmud.com/index.php/books/sharia-ki-bole
যেহেতু অনেক শারিয়া আইন হাদিস-ভিত্তিক তাই হাদিসের কথা আসবেই। হাদিস এক অনন্য ও মৌলিক গ্রন্থ, পৃথিবীর আর কোনো ধর্মবিশ্বাসীদের এমন রত্নভাণ্ডার নেই। এ নিয়ে 'অনলি কোরান' (যারা হাদিসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন) দলের সাথে আমি বহুবার বিতর্ক করেছি। কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্যি যে অতীত-বর্তমানে অনেক বিশেষজ্ঞ বিশেষ কিছু হাদিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেনI যেমন:
ক. বানর অবৈধ যৌনসঙ্গম করিয়াছে (committed Illegal sexual intercourse)" – সহি বুখারী ৫ খন্ড হাদিস ১৮৮,
খ. প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের আয়াত, এবং এক নারীকে নবীজি (সা:) অনাত্মীয় বয়স্ক পুরুষকে স্তন্যপান করানোর নির্দেশ দিয়েছেন, এই আয়াতগুলো ছাগলে খেয়েছে বলে আমাদের কোরানে নেই – ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড ১৯৪৩, ১৯৪৪ ও সহি মুসলিম ৩৪২৪ থেকে ৩৪২৯, ৬টি হাদিস,
গ. জনাকীর্ণ রাস্তায় হযরত মুসা (আ) নগ্ন হয়ে দৌড়োচ্ছেন (নাউযুবিল্লাহ) – সহি বুখারী ১ম খণ্ড হাদিস ২৭৭,
ঘ. সাহাবী জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা) বলছেন হযরত মুহম্মদকে (সা:) সেদিনের পর আর কখনো নগ্ন দেখা যায়নি (নাউযুবিল্লাহ) – সহি বুখারী ১ম খণ্ড হাদিস ৩৬০,
ইত্যাদি অজস্র। আমরা তো জানি নগ্নতা হলো অশ্লীলতা এবং অশ্লীল আদেশ শয়তান দেয় – বাকারা ১৬৯। অনেকে সহ্য করতে পারবেন না বলে আর উদাহরণ দিলাম না। কিন্তু আমাদের কেতাবের মুখোমুখী আমাদের হতেই হবে এই সত্যটা বুঝেছিলেন আর কেউ নয়, বুঝেছিলেন বিশ্ব-মুসলিমের অনন্য নেতা কোরানে হাফেজ তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তাইয়্যেপ এরদোগান। সেজন্যই হাদিসগুলো বাছাই করে সহি হাদিসের পরিচ্ছন্ন সংকলন করার প্রস্তাব করেছিল তুর্কি সরকার ২০০৪ সালে। অনেক লিংক পাবেন ইন্টারনেটে 'TURKISH HADITH PROJECT' নামে, উদ্ধৃতি:-
"২০০৪ সালে তৎকালীন তুরস্কের ধর্মমন্ত্রী মেহমেত আয়দিন এই নতুন হাদিস সংকলন তৈরির প্রস্তাব করেন। এই প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষকতা পাইয়াছে।"
এখন এটা করছেন সৌদি প্রিন্স মুহম্মদ বিন সালমান। আশা করি এই কাজটা একদিন পূর্ণ হবে, তখন অবধারিতভাবে তার প্রভাব হাদিস-ভিত্তিক শারিয়া আইনেও পড়বে।
পাদটীকা
ধর্মবিশ্বাসীরা প্রায়ই ধর্মবিশ্বাসকে নিজের ব্যক্তিসত্তার সাথে গুলিয়ে ফেলে তাদের বিশ্বাসটাকেই 'আমি' করে তোলেন এবং বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র পরিবর্তনকে নিজের পরাজয় মনে করে প্রাণপনে প্রতিরোধ করেন। অথচ ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। আমরা জেনে বা না জেনে বহু বিষয়ে আমাদের বিশ্বাসকে ক্রমাগত আপডেইট করে চলেছি, এটাই জীবন। ধর্মের মূল কল্যাণবাণী অক্ষুণ্ণ রেখে ধর্মবিশ্বাসের শুদ্ধতর স্তরে উন্নীত হতে হলে এই আপডেট অপরিহার্য। অনেক ইমামই সেটা করেছেনI ইমাম শা'ফি করেছেন। ( 'al-Shafii's Risala – Treatise on the Foundations of Islamic Jurisprudence' পৃষ্ঠা ৭), ইমাম মালিকও করেছেন, জানতে চার ইমামদের ওপরে অনন্য কেতাব 'দি ফোর ইমামস' – আবু জাহরা, পৃষ্ঠা ৮০ দেখুন।
দুটি ক্ষেত্রে আমাদের আলেমরা সমাজের কল্যাণ করেছেন:- (১) 'বেহেশতী জেওর কেতাব' যাতে জঘন্য যৌন অশ্লীল কথাবার্তা আছে তা বাতিল করেছেন, ও (২) তাৎক্ষণিক তালাকের মতো নারী-বিরোধী কুপ্রথার বিরুদ্ধে অনেক আলেম সোচ্চার হবার ফলে ওটা এখন প্রায় উচ্ছেদ হয়ে গেছে।
সেজন্য তাঁদের ধন্যবাদ, কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি। আজ অথবা কাল সেগুলো তাদের করতেই হবে, যত দেরি হবে ততই ধর্মীয় অপব্যাখ্যার বীভৎসতার কাছে ধর্মের শান্তিবাণী পরাজিত হবে। আলেমদের প্রতি জাতির সম্মান শর্তহীন নয়, তাদের দায়িত্ব আছে ইসলামের উৎস থেকে ইজতিহাদের মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ তুলে আনার। তাঁরা পরস্পরকে গালাগালি না করে সেদিকে দৃষ্টি দিলে জাতির কল্যাণ হবে।
****************************
এই নিবন্ধের মূল নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল "ইসলামী রাষ্ট্র: জরিপ বনাম বর্ষীয়ান আলেমের মন্তব্য" নামে (06 March 2022), লিংক :- https://bangla.bdnews24.com/opinion/comment/68765