বিশ্ব-আলেমদের মতে ইসলামে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র বৈধ

গান হারাম ?   ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ হারাম ? ‘আমি বাংলার গাই’ কঠিনভাবে ইসলাম-বিরোধী ? ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, ‘কান্দে হাছন রাজার মন ময়না’ অশ্লীল শিল্প ? ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া’ এবং বাংলার মায়েদের মধুকণ্ঠে ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ সবই হারাম ?  আচ্ছা !  খুঁজেপেতে দেখা-ই যাক তাহলে ! 

******************************************
সূত্র:- সঙ্গীত অংশ - সার্চ "উসমানীয় সাম্রাজ্য" - https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%89%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF

উসমানীয় অভিজাতদের শিক্ষাক্ষেত্রে উসমানীয় ধ্রুপদি সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কয়েকজন সুলতান নিজেরাই শিল্পী ও সুরকার ছিলেন। সুলতান তৃতীয় সেলিম তন্মধ্যে অন্যতম। এখনও তার সুর প্রচলিত রয়েছে। বাইজেন্টাইন, আর্মেনিয়ান, আরবি ও ফারসি সঙ্গীত উসমানীয় সঙ্গীতের উপর প্রভাব ফেলেছে। গঠনগতভাবে এই সঙ্গীত উসুল নামক এককের উপর প্রতিষ্ঠিত যা অনেকটা পশ্চিমা সঙ্গীতের মিটারের মত।
ছায়ানাটক কারাগুজ ও হাজিভাত উসমানীয় সাম্রাজ্যব্যপী প্রচলিত ছিল।

আনাতোলিয়া ও মধ্য এশিয়ার বাদ্যযন্ত্র যেমন বাগলামা, ওদ ইত্যাদি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র যেমন ভায়োলিন, পিয়ানো ব্যবহার শুরু হয়। রাজধানী ও অন্যান্য স্থানের মধ্যে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকায় সাম্রাজ্যে পৃথক দুইপ্রকার সঙ্গীত জন্মলাভ করে। এগুলো ছিল উসমানীয় ধ্রুপদি সঙ্গীত ও লোক সঙ্গীত। প্রদেশসমূহে বিভিন্নপ্রকার লোক সঙ্গীত সৃষ্টি হয়। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সঙ্গীতের অঞ্চলগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল, বলকান-থ্রেসিয়ান তুরকু, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তুরকু, এজিয়ান তুরকু, মধ্য আনাতোলিয়ান তুরকু, পূর্ব আনাতোলিয়ান তুরকু ও ককেসিয়ান তুরকু। কিছু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত শৈলী ছিল উসমানীয় সামরিক ব্যান্ড, রোমা সঙ্গীত, বেলি নাচ, তুর্কি লোক সঙ্গীত।

ঐতিহ্যবাহী ছায়া নাটককে বলা হত কারাগুজ ও হাজিভাত যা সাম্রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত ছিল। এর চরিত্রগুলো সে সংস্কৃতির সকল নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে উপস্থাপন করত।[১৫০][১৫১] একজন পুতুল পরিচালক এটি পরিচালনা করতেন। তিনি সকল চরিত্রের স্বরে কথা বলতেন। এর উৎপত্তি স্পষ্ট না তবে ধরা হয় যে মিশরীয় বা এশিয়ান প্রথা এর উদ্ভব হয়েছে।

******************************

কোরাণে হালাল-হারামের স্পষ্ট তালিকা আছে। গান হারাম হলে সে-তালিকায় গানের কথা অবশ্যই থাকত। সঙ্গীতের আরবি শব্দ “মুসিকি” সারা কোরানের কোথাও নেই। গানকে হারাম করতে কোরাণের বাহানা করা হয় দু’টো আয়াত দিয়ে (১) সুরা লোকমান ৬ এর :- “অবান্তর কথাবার্তা ও (২) বনি ইসরাইল আয়াত ৬৪ (আল্লাহ শয়তানকে বলছেন):- “তুই তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে সত্যচ্যুত করে তাদেরকে আক্রমণ কর”।

ওই 'অবান্তর কথাবার্তা' ও 'আওয়াজ'-ই নাকি সংগীত। কথাটা মতলবি ও উদ্ভট তা বাচ্চাও বোঝে। এজন্যই বিশ্ব-মুসলিম শব্দদুটোর ওই অর্থকে বাতিল করেছে। গানের বিপক্ষের দুটো হাদিস দেখাচ্ছি, এমন আরো আছে যেগুলোর ভিত্তিতে দাবী করা হয় ইসলামে সংগীত হারাম, শুধু ইসলামী-গান ও দফা বাজানো হালাল। তাও শুধু পুরুষকণ্ঠে।

** রসুল (স)বলিয়াছেন “আমার পরোয়ারদিগার আমাকে আদেশ করিয়াছেন সকল বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি উচ্ছেদ করিতে”- মিশকাত ৩১৮।

** রসুল (স) বলিয়াছেন – “কেয়ামতের ইঙ্গিত হিসেবে গায়িকা ও বিভিন্নরকমের বাদ্যযন্ত্রের আবির্ভাব হইবে”মিশকাত ৪৭০।

ইত্যাদি। কিন্তু তাঁরা কেতাব থেকে মাথাটা তুলে দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখতেন মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পুরো মুসলিম বিশ্ব তাঁদের ওই দাবী বর্জন করেছে, সবগুলো দেশ সংগীতে সয়লাব। কারণ অজস্র আলেম বলেছেন ইসলামে সংগীত হারাম নয়। উদাহরণ:-

(১) বাংলাদেশ আলেম সমাজের মাথার মুকুট প্রয়াত শাহ আব্দুল হান্নান বলেছেন :- "সঙ্গীত সহ বাঙালি সংস্কৃতির সবকিছুই আমরা নেব শুধু শিরিক ও অশ্লীলতা ছাড়া”। সঞ্চালক জিজ্ঞেস করেছেন, 'সেই ক্ষেত্রে আমরা কি মিউজিককে গ্রহণ করব'? উনি বলেছেন "এটা ড. কারজাভীর মত যে মিউজিক জায়েজ। তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আলেম। আমি মনে করি যে মিউজিককেই মেইন বানানো উচিত নয় বাট উই হ্যাভ টু এক্সেপ্ট ইট, গানের সাথে মিউজিকও জায়েজ”। সাক্ষাৎকারের ইন্টারনেট সার্চ :- “শাহ আব্দুল হান্নানের সর্বশেষ সাক্ষাৎকার : এমন কথা কেউ বলবেন না আর ! । Changetv.press। লিংক:- https://www.youtube.com/watch?v=Z4S76rjA6X0

(২) শাহ আব্দুল হান্নান যাঁকে বলেছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আলেম সেই ড. কারজাভী কি বলেন? বিশ্বের সব দেশে সেই দেশের মুফতি থাকে, কিন্তু "গ্লোবাল মুফতি" অর্থাৎ বিশ্ব-মুফতি ডক্টর কারযাভী “ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলার্স”-এর চেয়ারম্যান ছিলেন আরো অনেক কিছু ছিলেন। তিনি তাঁর "ইসলামে হালাল-হারামের বিধান" বইতে ৪০৬ থেকে ৪১১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ননা করেছেন, সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি :- “বহুসংখ্যক সাহাবী ও তাবেঈন গান শুনেছেন এবং কোন দোষ মনে করেননি……..নিষেধমূলক হাদীসগুলো সমালোচনার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেছেন - "গান হারাম হওয়ার পর্য্যায়ে কোন একটি হাদিসও সহি নয়। ইবনে হাজম বলেছেন - "এই পর্যায়ের সব বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত" -বইয়ের লিংক - ফ্রি ডাউনলোড-:-

https://jamaat-e-islami.org/publication/file/288_islame_halal_haramer_bidhan.pdf

হল ?

৩। মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রয়াত) গ্র্যান্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক (বিস্তারিতের জন্য সার্চ করুন " https://islamictext.wordpress.com/music-azhar-fatwa/) এর মতে- "অনৈতিক ও গুনাহ-এর কর্মকাণ্ডের সহিত যুক্ত না হইলে, কিংবা সেই বাহানায় মানুষকে হারামের দিকে না টানিলে, কিংবা মানুষকে ফরজ ইবাদত (আল ওয়াজিবাত) হইতে সরাইয়া (বা ভুলাইয়া) না দিলে সংগীত শোনা, সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, এবং বাদ্যযন্ত্র বৈধ"। 

৪। এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা এখানে আছে :- “হযরত দাউদ (আঃ)-এর আওয়াজ খুব মিষ্টি ছিল। তিনিই প্রথম হিব্রু সঙ্গীত সংকলন করেন এবং মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় বীণাকে আরও পরিশীলিত বাদ্যযন্ত্রে বিকশিত করেন” – (“The Prophet David (sws) had a very sweet sound. He is the first to compile Hebrew music and he developed the Egyptian and Babylonian harps into more sophisticated musical instruments” - https://www.shahbazcenter.org/is-music-haram.htm

৫। “হজরত ওসর (রঃ)-এর আবাদকৃত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় হইল বসরা। আরবি ব্যাকরণ, আরূয শাস্ত্র এবং সঙ্গীতশাস্ত্র এই শহরেরই অবদান”- বিখ্যাত কেতাব ‘আশারা মোবাশশারা’, মওলানা গরিবুল্লাহ ইসলামাবাদী, ফাজেল-এ দেওবন্দ, পৃষ্ঠা ১০৬।

৬। ইমাম গাজ্জালী - : ‘নবী করিম (সাঃ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) সম্পর্কে বলিয়াছেন- তাঁহাকে হযরত দাউদ (আঃÑ-এর সঙ্গীদের অংশ প্রদান করা হইয়াছে”- মুরশিদে আমিন, পৃষ্ঠা ১৭০, এমদাদিয়া লাইব্রেরী।

৭। মানুষের ইতিহাসে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় গায়কদের মধ্যে ছিলেন মিশরের উম্মে কুলসুম – তিনিই গিনিস বুকে ও ছিলেন। সেখানে আল আজহার ইউনিভার্সিটি আছে, কই কোনদিন কোন প্রতিবাদ হয়েছে বলে তো শুনিনি। মিশরের তিনটে পিরামিড আছে, উম্মে কুলসুমকে বলা হয় মিশরের চতুর্থ পিরামিড, তিনি পিতার কাছ থেকে কোরান শিখেছিলেন ও কোরানে হাফেজ ছিলেন। ভারতের উচ্চাঙ্গ সংগীত ভরপুর হয়ে আছে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান, বিসমিল্লা খান, আলী আকবর খানের মতো বহু মুসলিম ওস্তাদদের অবদানে। কাজেই সংগীত ইসলাম থেকে সরিয়ে নেয় একথাও ঠিক নয়।

নবী দাউদ (আঃ) কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বরও অত্যন্ত মধুর ছিল এর ভুরি ভুরি প্রমান আছে। হার্মোনিয়াম-তবলা-পাখোয়াজের সাথে গান হয় আমাদের ইসলাম প্রচারকদের দরগাতেও, এর নাম ‘সামা’। অথচ আমরাই একমাত্র জাতি যার গানের উৎসব রক্তাক্ত হয়ে যায় ঘাতকের অস্ত্রে। বুকের রক্ত ঢেলে নিজেদের সংস্কৃতি-সঙ্গীত রক্ষা করতে হয়, পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির এই উৎকট ও ভয়ংকর সমস্যাটা নেই। আমাদের শুনতে হয় গান হারাম, জাতি ভোগে অন্তর্দ্বন্দ্বে - গান গেয়ে গান শুনে গুনাহ্ করছি না তো !!

না, করছেন না। ইসলাম তো স্বাভাবিক ধর্ম, সঙ্গীত কি অস্বাভাবিক হতে পারে? পশু-পাখি-মাছেরা পশু-পাখি-মাছ হয়েই জন্মায় কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে মানুষের সুকুমার বৃত্তির দরকার হয়, সঙ্গীতই সেই সুকুমার বৃত্তি। সাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও তা সত্য। আর, বাড়াবাড়ি করা ? ‘গান হারাম’বলাই তো সেই বাড়াবাড়ি ! খোদ ইসলাম নিয়েই তো বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ (সুরা মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও নবীজীর বিদায় হজ্বের ভাষণ)। আপনার ইসলামের মালিকানা আর কারো হাতে ছেড়ে দেবেন না। মাথাটা নত করলেই ওরা আপনার পিঠে সুপারগ্লু লাগিয়ে ঠেসে বসবে। আপনি সোজা হয়ে দাঁড়ালে তা পারবে না। অন্যের মতামতের ফটোকপি হবার জন্য আমাদের মাথাটা দেয়া হয়নি। ঘাড়ের ওপর সারাজীবন বোঝার মতো বইতেও দেয়া হয়নি, কাজে লাগানোর জন্যই দেয়া হয়েছে।

সঙ্গীত আমাদের সসীম জীবনে এক টুকরো অসীমের ছোঁয়া। চারদিকের আকাশ-বাতাস সাগর-পর্বত গ্রহ-নক্ষত্র, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিপুল সুরস্রষ্টার মহাসঙ্গীত। তাই, গান শুনুন এবং বাচ্চাদের গান শোনান। গান করুন এবং বাচ্চাদের গান শেখান। গান যে ভালবাসে না সে মানুষ খুন করতে পারে।   

More details " গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম সাব্যস্তকারীদের দলীল ও ব্যাখ্যা ":- https://cscsbd.com/4771/ 

Print