কেস ষ্টাডি - শারিয়া আইনে যেভাবে ধর্ষিতার শাস্তি হয়

কেস ষ্টাডি - শারিয়া আইনে যেভাবে ধর্ষিতার শাস্তি হয়

হাসান মাহমুদ

Complete article in easy to read pdf format.

দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে, ধর্ষণের খবর উঠলেই এক মহল থেকে শারিয়া আইনের দাবী করা হয়। এ নিবন্ধে আমরা কেস স্টাডি করে দেখব শারিয়া আইনে কেন ধর্ষক মুক্তি পায় ও ধর্ষিতার শাস্তি হয়। কেস ষ্টাডি কখনো মিথ্যা বলেনা।

(১) সোমালিয়ার শারিয়া কোর্ট ২০০৮ সালে ১৩ বছরের গণধর্ষিতা আয়েশা দুহুলো'কে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, জাতিসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল বান কি মুন তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন - অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট ও অজস্র সূত্র,

(২) নাইজেরিয়াতে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ১৩ বছরের বারিয়া ইব্রাহিম মাগাজু গর্ভবতী হয়ে পড়লে সে শারিয়া কোর্টে বলে যে তাকে তিনজন পুরুষ ধর্ষণ করেছে। কিন্তু সে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে পারেনি। শারিয়া কোর্ট তাকে "বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার"-এর জন্য ১০০ টি চাবুক এবং ওই ৩ জন পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করে তাদের মানহানী করার জন্য আরো ৮০ টি চাবুকের শাস্তি দিয়েছে - অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট ও অজস্র সূত্র,

(৩) পাকিস্তানে শারিয়া কোর্টের রায়ে ১৯৭৯ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ২৭ বছরে তিন হাজারের বেশী ধর্ষিতারা দশ বারো বছর জেল খেটেছেন - অজস্র সূত্র।

অবিশ্বাস্য !

যখন একই ধরণের মামলায় বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে একই রায় দেয়া হয় সেক্ষেত্রে নিশ্চয় এর গূঢ় কোনো কারণ আছে। ব্যাপারটা এভাবে বুঝে নেয়া যাক। কিছু মতভেদ আছে কিন্তু সাধারণভাবে হুদুদ অপরাধ হল খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, জ্বেনা, মানহানী, মদ্যপান ও ইসলাম ত্যাগ। কেউ কেউ এতে ধর্ষণ ও রাষ্ট্রদ্রোহীতা (হিরাবা) যোগ করেছেন। এখন আমরা ধাপে ধাপে এগোব যাতে শারিয়া-ম্যাথটা স্পষ্ট হয়। ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে আমাদের আলেমদের মাথার তাজ প্রয়াত জনাব শাহ আবদুল হান্নান সহ ছয়জন আলেম প্রধানতঃ হানাফী কেতাবের ভিত্তিতে তিন খণ্ডের "বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন" সংকলন করেন, প্রকাশক ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ। আমি বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন-কে নিবন্ধে সংক্ষেপে "বি-ই-আ" লিখছি। প্রথমেই, শারিয়ায় ধর্ষণ কাকে বলে?

• “কোনো পুরুষ বা নারী বলপ্রয়োগ করিয়া পর্যায়ক্রমে কোনো নারী বা পুরুষের সহিত সঙ্গম করিলে তাহা জেনা হিসেবে গণ্য হইবে। বলপ্রয়োগকারী জেনার শাস্তি ভোগ করিবে যদি বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়” - বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৪ ও ১৩৪খ।

দেখা যাক কি দিয়ে "বলপ্রয়োগ" প্রমাণ হবে।

• এই কেতাবসমূহের আইনগুলো একত্রিত করলে এই আইন দাঁড়াবে, - “ব্যাভিচার সহ সব হুদুদ মামলাগুলোতে নারীসাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়” – বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩ ও ১৪৯; আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা সত্যায়িত শাফি কেতাব "উমদাত আল সালিক" আইন 0.13.1 ও 0.24.9; মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরান পৃষ্ঠা ২৩৯, ৯২৮; ‘দ্য পেনাল ল অব ইসলাম’ পৃষ্ঠা ৪৪; হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৫৩; ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড’ পৃষ্ঠা ২৫১। কেতাবে যে শব্দবাক্যে ধর্ষণ ও জ্বেনার বর্ণনা আছে তা এখানে প্রকাশের যোগ্য নয়, পৃষ্ঠার স্ক্যান চাইলে আমাকে মেসেঞ্জারে ইনবক্স করুন।

Surah An Nisa Quote

 

 Picture1

 

আদালত হল আইনজীবীদের কুরুক্ষেত্র - সেখানে "ন্যায়পরায়ণ পুরুষ কে" তা নিয়ে অন্তহীন বাকযুদ্ধ হবে। যাহোক, এর সাথে যোগ করুন :-

• “হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলিবে না” - বিইআ ২য় খণ্ড ধারা ৬০০। অর্থাৎ আঙুলের ছাপ, ডিএনএ ইত্যাদি চলবেনা। কেতাবের তত্ব নয়, বছর বিশেক আগে লাহোর শারিয়া কোর্ট ডিএনএ-টেস্ট নাকচ করেছিল যে কারণে অপরাধীর শাস্তি হয়নি। এখন অবশ্য পাকিস্তানে ডিএনএ-টেস্ট গ্রহণযোগ্য।

• “জেনা ও ধর্ষণ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ না হইলে জেনাকারীর শাস্তি হইবেনা যদি সে অস্বীকার করে” - বিইআ প্রথম খণ্ড ৩০১ পৃষ্ঠা।
সুস্পষ্ট আইন। ধর্ষক তো অপরাধ অস্বীকার করবেই, এবং আদালত তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
আচ্ছা, মনে করুন কোনো চারজন পুরুষ বোবা বা মেথর বা রাস্তা-ঝাড়ুদারের সামনে ধর্ষণ হল। সেক্ষেত্রেও, চাক্ষুষ সাক্ষী থাকা সত্বেও আদালত ধর্ষককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। কারণ:-

• “বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়”, “দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নীচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।” - বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৪৯, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৬৩; হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৩৬১; শাফি আইন o.24.3; পেনাল ল’ অব ইসলাম পৃষ্ঠা ৪৬।
অর্থাৎ ধর্ষকের শাস্তি কেবলমাত্র তখনই হতে পারে যদি কোনো সত্যবাদী সুমহান ধর্ষক শারিয়া কোর্টে ধর্ষণের স্বীকারোক্তি দেয়। তা না হলে ধর্ষককে শাস্তি দেবার কোনো উপায় নেই। এর সাথে মিলিয়ে নিন -

• “হুদুদ মামলায় নারী বিচারক হতে পারবে না” - বিইআ ২য় খণ্ড ধারা ৫৫৪। এজন্যই ইরাণের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ও ডক্টর শিরীন এবাদী-কে তাঁরই আদালতে বিচারক থেকে কেরানি বানানো হয়েছিল। কি বীভৎস! তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।
এবারে দেখা যাক শারিয়া কোর্ট ওই হাজার হাজার ধর্ষিতাকে কেন শাস্তি দিয়েছে।

(১) ধর্ষিতা ধর্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছে,

(২) ধর্ষককে শাস্তি দিতে ধর্ষণ প্রমাণ হওয়া দরকার। আইন মোতাবেক সেই প্রমান হল চারজন ন্যায়পরায়ণ পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য যাঁরা বোবা বা “সমাজের নীচুস্তরের” নন,

(৩) ধর্ষিতা সেই প্রমান আনতে ব্যর্থ হয়েছে, বিচারক অভিযুক্ত পুরুষকে নিরপরাধ ঘোষণা করে খালাস দিতে বাধ্য হয়েছেন,

(৪) এরপর অভিযুক্ত পুরুষ ধর্ষিতার বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা করেছে। কারণ মামলার কারণে সমাজে তার সম্মান ধুলায় মিশে গেছে। মনে রাখতে হবে, মানহানীর মামলাও হুদুদ পর্যায়ের অপরাধ।

(৫) বিচারক ধর্ষিতাকে মানহানীর শাস্তি দিতে বাধ্য হয়েছেন।

প্রেসিডেণ্ট মুশাররফ ২০০৬ সালে ৩০০০+ ধর্ষিতাকে মুক্তি দিয়েছেন ১০/১২ বছর কারাভোগের পর - ভোরের কাগজ, ৯ জুলাই ২০০৬। এই নারীদের জীবনের স্বপ্ন ছিল, সংসার ছিল সন্তানরা ছিল। সবকিছু ধ্বংস করেছে এই শারিয়া আইন। সেই কারাগারের সময়ে তাদের অনেকের স্বামীরা নুতন বিয়ে করেছে।

কি হবে যদি ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ধর্ষণ করেন? খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, মদ্যপান ইত্যাদি হুদুদ অপরাধ করেন? এক্ষেত্রে শারিয়া আইনটা হল :-
“হুদুদ-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ করিলে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যাইবেনা" - বি-ই-আ ৩য় খণ্ড ৯১৪গ ও হানাফি আইন হেদায়া পৃঃ ১৮৮।

 Picture2


ব্যাস - ইসলামী ন্যায়বিচারের চ্যাপ্টার ক্লোজড।


এজন্যই কোটি কোটি মুসলিম এবং বহু ইসলামি বিশেষজ্ঞ ও সংগঠন শারিয়া আইনের তীব্র বিরোধী। এজন্যই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শরিয়া সমর্থক ও বিশেষজ্ঞ ড. হাশিম কামালি ব্যাকুল হয়ে বলেছেন: “আমি সবাইকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি শারিয়াকে এ যুগে চালাইতে হইলে অবশ্যই প্রচণ্ড ঘষামাজা করিতে হইবে………সেই যুগে যে উদ্দেশ্যে শরিয়ার উসুল বানানো হইয়াছিল উহা এখন অনেক কারণেই তাহা অর্জন করিতে অক্ষম।” - ‘প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’ পৃষ্ঠা ১৩, ৫০০, ৫০৪।
ধর্ষণের পাকিস্তানী আইনটাও অত্যন্ত স্পষ্ট। পাকিস্তান হুদুদ অর্ডিন্যান্স আইন # ৭ - ১৯৭৯ সাল, সংশোধিত আইন নং ৮ - ১৯৮০ সাল - উদ্ধৃতি:-

"হুদুদ শাস্তির যোগ্য জ্বেনা ও জ্বেনা বিল জাবর (ধর্ষণ)-এর প্রমান হিসেবে দরকার হবে:- আইন নং ৮ক - কোর্টে ধর্ষকের স্বীকারোক্তি, অথবা ৮খ - চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলিমের চাক্ষুষ সাক্ষ্য"।

কালতামামী (১) ও (২) :-

() বলা হয় এই "চার পুরুষের সাক্ষ্য" আইনটা বানানো হয়েছে কোরানের ভিত্তিতে:-

(ক) নিসা ১৫:- "তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা অশ্লীল কাজ করবে, তাদের সম্পর্কে তোমাদের মধ্য হতে চারজন সাক্ষী রাখ"।

(খ) নূর ১৩ :- "তারা (অর্থাৎ অপবাদদাতাগণ) এ বিষয়ে কেন চারজন সাক্ষী উপস্থিত করল না? সুতরাং তারা যখন সাক্ষী উপস্থিত করল না, তখন আল্লাহর নিকট তারাই মিথ্যুক"।

ওই আয়াতদুটো, বিশেষ করে সূরা নূর ১৩ এসেছিল (আয়েশা রা:) নারীদেরকে জ্বেনার মিথ্যা অপবাদ থেকে বাঁচাতে, এগুলো নারীবান্ধব আয়াত। ধর্ষণের সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্কই নেই। আসলে পুরো কোরানে কোথাও ধর্ষণের কোনো উল্লেখই নেই। সেই নারীবান্ধব আয়াতদুটোকে পেঁচিয়ে এই উদ্ভট ও হিংস্র নারী-বিরোধী আইন বানানো হয়েছে। এটা কিভাবে হল তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে “শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি”বইতে।

() "যদি ধর্ষণের চারজন মুসলিম পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষী না থাকে তবে ধর্ষিতার উচিত অভিযোগ না করে চুপ করে থাকা" - পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর তৎকালীন আমির সৈয়দ মুনাওয়ার হাসান - ০৭ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে প্রচারিত DARSTV টিভিতে প্রায় ৬ মিনিটের সাক্ষাৎকার, সার্চ - "Jamaat Islami Leader Encouraging Women Rape!!! Shocking”- আজ ০৯ মে ২০২৩ তারিখেও এটা ইউটিউবে আছে দেখলাম:

https://youtu.be/-Xul14hvBBg

Picture3  Picture4

 

 

 

Print