মুরতাদ-হত্যার পক্ষে বিপক্ষে

মুরতাদ-হত্যার পক্ষে বিপক্ষে

হাসান মাহমুদ

Dr. Taha Jabir Alalwani states in his “APOSTASY DURING THE  PROPHET’S LIFE” :- “It is an established fact that never in his entire life did the Prophet put an apostate to death. Al-Shafi‘i states: Never did the Prophet fail to respect the bounds set by God in relation to anyone who lived in his day”. Link:-  https://www.jstor.org/stable/j.ctvk8w22r.7?searchText=&searchUri=&ab_segments=&searchKey=&refreqid=fastly-default%3A4f9b56a5aed0d7a488289d0ba006bd0e&seq=24

(ইসলাম কোন ইঁদুর-মারা কল নয় যে এতে ঢোকা যাবে কিন্তু বেরুনো যাবে না)

আল্লাহ ও  রসূলের (স) দেয়া গাইডলাইন :-

(ক) আল্লাহ বলছেন:-"সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা"- সূরা হাক্কাহ ৪৪, ৪৫ ও ৪৬। একই নির্দেশ এগুলোতেও :- বনী ইসরাইল ৭৩-৭৫, আশ-শুরা ২৪ ও ইউনুস ১৫।

(খ) নবীজী (স) বলেছেন :- "আমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয় তাছাড়া (অন্য কিছুর) অনুসরণ করি না" - সূরা আনাম ৫০। একই নির্দেশ এগুলোতেও :- আনাম ৫০ ও ১০৬, আরাফ ২০৩, ইউনুস ১৫ ও ১০৯, আম্বিয়া ৪৫, আহযাব ২ এবং আহকাফ ৯। 

অর্থাৎ নবীজীর (স) অধিকার ছিলোনা কোরানের বিরুদ্ধে যাবার, কাজেই কোরান-বিরোধী সব হাদিস ও দলিল পরিত্যাজ্য।

(গ) সংক্ষেপে - মুআয বিন জাবালকে (র) ইয়েমেনের শাসক হিসেবে পাঠানোর সময় রসূল (স) বললেন: "কোনো মামলার ফয়সালা কিভাবে করবেন"? তিনি উত্তর দিলেনঃ "কোরান দিয়ে করব"। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: “কোরানে না পেলে"? জাবাল (র) বললেনঃ "আপনার সুন্নাহ দিয়ে করব"। নবীজী (স) বললেন :- “যদি সুন্নাহ-এও না পান" ? জাবাল (র) বললেন :- আমি যথাসাধ্য ইজতিহাদ করব"। রসূল (স) তখন তার বুকে চাপ দিয়ে আল্লাহর শুকুর করলেন - সুনান আবু দাউদ হাদিস ৩৫৮৫।

অর্থাৎ কোরানে সমাধান পেলে হাদিসে যেতে হবেনা।  

সামনে এগুনো যাক   ********************************

  • কোরান মোতাবেক মুরতাদের কোন পার্থিব শাস্তি নেই এবং ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ আছে।
  •  আইনদাতা ও বিচারক হিসেবে নবীজী (স) অনেক অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছেন কিন্তু অন্য কোনো অপরাধ নেই শুধুমাত্র ইসলাম ছেড়ে দেবার কারণে তিনি কাউকে কোনোই শাস্তি দেননি। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইব্ন মাজাহ, এই পুরো সহি সিত্তায় অমন একটা হাদিসও পাওয়া যায়নি। বরং একাধিক ইসলাম ত্যাগকারীকে তিনি সামনে পেয়েও কোনো শাস্তি দেননি এমন একাধিক হাদিস সহি সিত্তায় আছে।

মুরতাদ তাকে বলা হয় যে আগে মুসলমান ছিল কিন্তু এখন ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে। মুরতাদ দু’রকমের, ফিতরি ও মিলি। ফিতরি − ফিতরা মানে স্বভাবজ। স্বাভাবিকভাবে মুসলিম হয়ে জন্মে ইসলাম ছেড়ে দিলে হয় মুরতাদ ফিতরি। মুরতাদ মিলি হলো সে, যে অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করে তারপর ছেড়ে দিয়েছে। শারিয়া আইনে মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া আছে। মূল শব্দটা হল ‘রাদ্’। এর সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলো ইরতাদা, রিদ্দা এবং মুরতাদ সবই হল স্বকর্ম। নিজে থেকে না বললে বা না করলে বাইরে থেকে কেউ কাউকে স্বকর্ম করাতে পারে না। যেমন আত্মহত্যা যে করে সে-ই করতে পারে, অন্যেরা খুন করতে পারে কিন্তু কাউকে আত্মহত্যা করতে পারে না। ঠিক তেমনি মুরতাদও নিজে ঘোষণা করতে হয়, অন্য কেউ করিয়ে দিতে পারে না।

মুরতাদের ওপরে কোরাণে কোথাও কোন পার্থিব দণ্ড নেই, আল্লাহ বলেছেন তিনি নিজেই তাকে শাস্তি দেবেন। সূত্র ইমরান ৮২, ৮৬, ১০৬, নাহল ১০৬, মুনাফিকুন ৩, তওবা ৬৬ ও ৭৪, নিসা ৯৪ − “যে তোমাকে সালাম করে তাহাকে বলিও না যে, তুমি মুসলমান নও।” বাকারা ২১৭ − “যদি কেহ বিশ্বাস হইতে ফিরিয়া যায় ও অবিশ্বাসী হিসাবে মরে, তবে ইহকাল পরকালে তাহাদের সমস্ত কাজ বৃথা হইবে ও তাহারা আগুনে জ্বলিবে।” সবশেষে নিসা ১৩৭ − “যাহারা একবার মুসলমান হইয়া পরে আবার কাফের হইয়া গিয়াছে, আবার মুসলমান হইয়াছে এবং আবার কাফের হইয়াছে এবং কুফরিতেই উন্নতি লাভ করিয়াছে, আলাহ তাহাদেরকে না কখনও ক্ষমা করিবেন, না পথ দেখাইবেন।”

অর্থাৎ কোরাণ মুরতাদকে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে। তাকে খুন করলে ‘আবার মুসলমান’ হবার সুযোগ সে পাবে না, সেই খুন সরাসরি কোরাণ লঙ্ঘন হয়ে যাবে। নবীজীর (স) ওহি-লেখক আবদুল্লা বিন সা’আদ-ও মুরতাদ হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল। এ হেন মহা-মুরতাদকেও নবীজী (স) মৃত্যুদণ্ড দেননি (ইবনে হিশাম-ইশাক পৃঃ ৫৫০) বরং হজরত ওসমান পরে তাকে মিশরের গভর্নর করেছিলেন। আরও বহু আয়াত মুরতাদ-হত্যার বিপক্ষে, যেমন : ইউনুস ৯৯ − “তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তি করিবে ইমান আনিবার জন্য?” কাহ্ফ ২৯ − “যার ইচ্ছে বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক।” নিসা ৮০ − “আর যে লোক বিমুখ হইল, আমি আপনাকে (হে মুহম্মদ!) তাহাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করি নাই।” নিসা ৯৪ − “যে তোমাদেরকে সালাম করে তাহাকে বলিও না যে তুমি মুসলমান নও।” বাকারা ২৫৬ − “ধর্মে জোর-জবরদস্তি নাই।” ইত্যাদি।

তবে মুরতাদ-হত্যার বিরুদ্ধে কোরাণের সবচেয়ে স্পষ্ট নির্দেশ আছে সুরা ইমরান- এর ৮৬ নম্বর আয়াতে। হারিথ নামে এক মুসলমান মুরতাদ হলে তার ওপরে নাজিল হয়েছিল এ আয়াত : “কেমন করে আলাহ এমন জাতিকে হেদায়েত দেবেন যারা ইমান আনার পর ও রসুলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেবার পর ও তাদের কাছে প্রমাণ আসার পর কাফের হয়েছে ?” নবীজী (স) তাকে কোন শাস্তিই দেননি (ইবনে হিশাম-ইশাক পৃঃ ৩৮৪)। Dr. Taha Jabir Alalwani states in his “APOSTASY DURING THE  PROPHET’S LIFE” :- “It is an established fact that never in his entire life did the Prophet put an apostate to death. Al-Shafi‘i states: Never did the Prophet fail to respect the bounds set by God in relation to anyone who lived in his day”. Link:-  https://www.jstor.org/stable/j.ctvk8w22r.7?searchText=&searchUri=&ab_segments=&searchKey=&refreqid=fastly-default%3A4f9b56a5aed0d7a488289d0ba006bd0e&seq=24

শারিয়ার একটি ভয়ানক আইন হল, মুরতাদকে যে কেউ রাস্তাঘাটে খুন করতে পারে, তাতে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড, ধারা ৭২, Madina Charter clause 14 of 47 clauses)।  অর্থাৎ কোন ধর্মান্ধ মোল্লা - মুফতি কাউকে মুরতাদ ঘোষণা করলে তাকে খুন করতে অন্য ধর্মান্ধকে উৎসাহিত করা হয়। মুসলিম-বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটেছে এবং খুনীর শাস্তি হয়নি। মুরতাদের বিয়ে, সাক্ষ্য ও উত্তরাধিকারও বাতিল হয়ে যায়। পুরুষ-মুরতাদকে হত্যার সমর্থনে নামকরা বই হল মওদুদির “দ্য পানিশমেণ্ট অব্দি অ্যাপোস্টেট অ্যাকর্ডিং টু ইসলামিক ল’ ( The Punishment of the Apostate according to Islamic Law)।”

এ-বইতে প্রথমে মওদুদি বলেছেন, “কোরাণ ও সুন্নাহ এ-ব্যাপারে বিশেষ ব্যাখ্যা দেয় না।” কথাটা মিথ্যা, কারণ ওপরে কোরাণ-রসুলের স্পষ্ট উদাহরণ দেখানো আছে। তিনি বরং তাঁর তাফহিমুল কুরাণ-এ সুরা বাকারা ২১৭ আয়াতের সমর্থনে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে মুরতাদকে শুধুমাত্র “পরকালে আগুনে নিক্ষেপ করা হইবে।” এরপরে তিনি সুরা তওবা-র আয়াত ১১ ও ১২-এর উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেছেন ওখানে মুরতাদ হত্যার বিধান আছে।

আয়াত দু’টো হল − “যদি প্রতিশ্রুতির পর তাহারা তাহাদের শপথ ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে বিদ্রুপ করে তবে কুফর-প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ ইহাদের কোন শপথ নাই যাহাতে তাহারা ফিরিয়া আসে…এখানে ‘শপথ ভঙ্গ’ কোনমতেই রাজনৈতিক চুক্তি হইতে পারে না। বরং ইহার পটভূমি নির্দেশ করে যে, ইহার অর্থ ‘ইসলাম গ্রহণ ও পরে ইসলাম ত্যাগ করা’।” 

মওদুদির এই কথা কোরাণের সরাসরি লঙ্ঘন। সুরা তওবা’র উলেখ্য চুক্তি ও চুক্তিভঙ্গে মুরতাদের কোন কথাই নেই। এর পটভূমি হল মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে যুদ্ধবিরতি, যুদ্ধ-চুক্তিভঙ্গ ও যুদ্ধ-চুক্তি বাতিল। এটা আছে ইবনে হিশাম/ইশাক (সীরাত), তারিখ আল্ তাবারি এবং বহু ইসলামি ওয়েবসাইটে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি মওলানা মুহিউদ্দিনের বাংলা কোরাণ  ৫৫৩ ও ৫৫৬ পৃষ্ঠা থেকে :

“সুরা তওবার সর্বত্র কতিপয় যুদ্ধ, যুদ্ধ-সংক্রান্ত ঘটনাবলী এবং এ-প্রসঙ্গে অনেকগুলো হুকুম-আহাকাম ও মাসায়েলের বর্ণনা রয়েছে। যেমন আরবের সকল গোত্রের সাথে কৃত সকল চুক্তি বাতিলকরণ, মক্কা বিজয়, হোনাইন ও তাবুক যুদ্ধ প্রভৃতি…ষষ্ঠ হিজরী সালে …তাদের সাথে হোদায়বিয়ায় সন্ধি হয়…এরপর পাঁচ-ছয় মাস অতিবাহিত হলে এক রাতে বনু বকর গোত্র বনু খোজা’র উপর অতর্কিত হামলা চালায়…অর্থাৎ হোদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়ে যায়, যাতে ছিল দশবছরকাল যুদ্ধ স্থগিত রাখার চুক্তি…এখানে (১১নং আয়াতে) বলা হয় যে, কাফেররা যত শত্র“তা করুক, যত নিপীড়ন চালাক, যখন সে মুসলমান হয় তখন আলাহ (যেমন) তাদের কৃত অপরাধগুলো ক্ষমা করেন…আলোচ্য দ্বাদশ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, এরা যদি চুক্তি সম্পাদনের পর শপথ ও প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করে এবং ইসলামও গ্রহণ না করে, অধিকন্তু ইসলামকে নিয়ে বিদ্রূপ করে তবে সেই কুফর-প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর।” উদ্ধৃতি শেষ।

সুরা তওবা ছাড়া আর মাত্র একটা সুরাকে মওদুদি মুরতাদ হত্যার সমর্থনে টানার চেষ্টা করেছেন, সেটা হল নিসা আয়াত ৮০। কিন্তু মওদুদির বোধহয় মনে নেই যে তিনি নিজেই তাঁর তফহিমুল কুরাণে সুরা নিসা ৮০-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন − “নবীজী’র প্রতি দায়িত্ব দেয়া হইয়াছে শুধুমাত্র আলাহ’র আদেশ-নির্দেশ লোকদের কাছে পৌঁছানো এবং তিনি তাহাতে ভালভাবেই সফল হইয়াছেন। তাহাদিগকে সত্যপথে বাধ্য করা তাঁহার দায়িত্ব ছিল না।”

তাহলে যে লোক মুসলমান থাকতে চায় না তাকে খুন করার ভয় দেখিয়ে মুসলমান রাখা সরাসরি কোরাণ-লঙ্ঘন ও নবীজী’র অপমান নয় ? তাছাড়া, তাঁর ব্যাখ্যাটি কোরাণের এত এত আয়াতের বিরুদ্ধে কেন গেল সেটা মওদুদির বলা উচিত ছিল।

কোরাণে সুবিধে করতে না পেরে মওদুদি আঁকড়ে ধরেছেন হাদিস - “নবীজী বলিয়াছেন যে ব্যক্তি ধর্মত্যাগ করে তাহাকে হত্যা কর” (বোখারী ২৮৫৪ নং হাদিস- মওলানা আবদুল জলিলের অনুবাদ)। ওটা ঠিক নয় কারণ ওতে কোনো লোকের নাম, জায়গা, ঘটনা ইত্যাদি নেই। বরং আমরা ওই হাদিসের উল্টোটা পাই “সিরাত”-এ (ইবনে হিশাম/ইশাক); উবায়রাক ছাড়াও নবীজীর সময়ে তিনজন মুরতাদের দলিল - হারিথ, নবীজীর ওহি লেখক ইবনে সা’দ, এবং উবায় দুল্লাহ − পৃষ্ঠা ৩৮৪, ৫২৭ ও ৫৫০। এদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড কেন, কোনো শাস্তিই দেননি রসুল।

আরওদেখুন সহি বুখারি ৯ম খণ্ড হাদিস ৩১৮- “জাবির বিন আবদুলা বলেন, এক বেদুইন আল্লাহ’র রসুলের কাছে বায়াত গ্রহণ করিল। পরে মদিনায় তাহার জ্বর হইলে সে আল্লাহ’র রসুলের নিকট আসিয়া বলিল ‘হে আল্লাহ’র রসুল, আমার বায়াত ফিরাইয়া দিন।’ রসুল সম্মত হইলেন না। তারপর সে আবার আসিয়া বলিল ‘হে আল্লাহ’র রসুল, আমার বায়াত ফিরাইয়া দিন।’ রসুল সম্মত হইলেন না। তারপর সে আবার আসিয়া বলিল ‘হে আল্লাহ’র রসুল, আমার বায়াত ফিরাইয়া দিন।’ রসুল সম্মত হইলেন না। তারপর সে মদিনা ছাড়িয়া চলিয়া গেল। ইহাতে আলাহ’র রসুল বলিলেন− “মদিনা একটি উনুনের মতো, − ইহা ভেজালকে বাহির করিয়া দেয় এবং ভালোকে পরিষ্কার ও উজ্জ্বল করে।”

এই যে স্বয়ং নবীজীর সামনে প্রকাশ্যে ইসলাম ত্যাগ, কোথায় শাস্তি ? আমাদের শারিয়াপন্থীরা কি ভেবে দেখেছেন কার বানানো শারিয়া আর কার বানানো ‘ইসলাম’-এর শিকার হয়েছেন তাঁরা ?”

মওদুদির দেখানো আটটি হাদিসে নামধাম সহ কোন ঘটনারই উলেখ নেই, শুধু “নবীজী বলিয়াছেন মুরতাদকে খুন কর” এইধরনের বায়বীয় কথা আছে। এবারে মওদুদি নির্ভর করেছেন হজরত আবু বকরের (রা:) ওপরে। তিনি বলেছেন, দূরের কিছু গোত্র মুরতাদ হয়েছিল এবং হজরত আবু বকর (রা:) সৈন্য পাঠিয়ে তাদের পরাজিত করেছেন। কথাটা এত সহজ নয়, এর মধ্যে কথা আছে। মওদুদি হজরত আবু বকরের (রা:) চিঠি উল্লেখ করে তাঁকে এক হিংস্র হালাকু খান বানিয়ে ছেড়েছেন। হজরত আবু বকর (রা:) নাকি তাঁর সিপাহসালারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন − ‘ইসলাম কবুল না করলে কাউকে জীবন্ত ছাড়বে না, আগুন জ্বালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে এবং তাদের নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখবে।’

নবীজীর (স) ওফাত-এর পর স্বভাবত:ই কিছু বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। যারা নিরুপায় হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুসলমান হয়েছিল তারা তাদের ধর্মে ফিরে গেল। কেউ কেউ নবীত্ব দাবি করে বসল, তাদের কিছু ‘সাহাবি’ও গজাল। তবে প্রধান কারণ হল, নবীজীর (স) গাদির-এ খুম মাঠের বক্তৃতা ও অন্যান্য বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গোত্র মনে করত তিনি তাঁর পরে হজরত আলীকে (র) খলিফা ঘোষণা করেছেন। তাই তারা হজরত আবু বকরের (রা:) সরকারকে অবৈধ মনে করে জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, ইসলাম ত্যাগ করেনি (তখন সবার জাকাত বায়তুল মাল-এ জমা হত)।

হজরত আবু বকরের (রা:) এ-যুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক। সরকার-প্রধান হিসেবে তিনি বিরোধীদের সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধটা হয়েছিল তাঁর পাঠানো সেনাপতি কুরাইশ গোত্রের খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং মুসলমান গোত্র বনু ইয়ারবু-য়ের নেতা মালিক বিন নুয়াইরাহ-য়ের মধ্যে। মৃত্যুর আগে নবীজী মালিককে তার গোত্র থেকে জাকাত আদায় করতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর হজরত আবু বকর (রা:) খলিফা হলে মালিক তাঁর সরকারকে অবৈধ সরকার হিসেবে জাকাত দিতে অস্বীকার করে। যুদ্ধের ময়দানে মালিক খালিদকে স্পষ্টই বলে যে সে মুসলমান কিন্তু হজরত আবু বকরকে (রা:) মানে না কারণ খলিফা হবার কথা হজরত আলী’র। যুদ্ধে সে পরাজিত হয় এবং তার মাথার খুলিতে খালিদ বহুদিন খেয়েছে। মুসলমানের সাথে মুসলমানের যুদ্ধ ও খুন এই প্রথম, সারা মুসলিম সমাজ এতে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল। এমনকি হজরত ওমর পর্যন্ত খাপ্পা হয়ে বলেছিলেন “মুসলমানকে খুন করার জন্য খালিদের শাস্তি হওয়া উচিত” (সূত্র - বিখ্যাত লেখক আলী আবদুল রাজিক-এর “ইসলাম অ্যাণ্ড দ্য ফাণ্ডামেণ্টাল্স্ অব্ অথরিটি” পৃষ্ঠা ৫২০)।

এবারে মওদুদি সমর্থন নিয়েছেন অতিতের ইমামদের থেকে। হ্যাঁ, প্রায় প্রতিটি শারিয়া-ইমামই মুরতাদ-হত্যার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু আমরা সেটা প্রত্যাখ্যান করি কোরাণের ভিত্তিতে। আসল কথাটা হল, পরকীয়ার প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের মত মুরতাদ-হত্যার আইনও এসেছে ইহুদী কেতাব ডিউটেরনমি থেকে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি : “(যদি কেহ) বলে ‘চল আমরা অন্য স্রষ্টাকে সেবা করি’ … তবে তোমরা নিশ্চয় তাহাকে হত্যা করিবে … তাহাকে প্রস্তরের আঘাতে হত্যা করিবে …” ইত্যাদি।

তাঁর আতঙ্ক আসলে অন্য জায়গায়। জনগণ যদি একবার জেনে ফেলে শারিয়ায় কোনো একটা কোরাণ-বিরোধী আইন আছে তাহলে তারা ধীরে ধীরে শারিয়ার অনেক আইনেরও কোরাণ-বিরোধী চরিত্র জেনে ফেলবে, শারিয়া ‘আল্লাহ'র আইন’ এ-কথার পায়ের নীচে মাটি থাকবে না। তখন শারিয়াভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই ওই বইতে তিনি বলেছেন (সংক্ষিপ্ত) − “মুরতাদের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা কোনকালেই ছিলনা। যে-ব্যাপারে ক্রমাগত ও অবিচ্ছিন্ন সাক্ষ্যের সমর্থন রহিয়াছে উহার প্রতি যদি সন্দেহ জন্মায় তাহা হইলে সে সন্দেহ একটি বা দুইটি সমস্যায় সীমাবদ্ধ থাকিবে না, ইহা এমন পর্যায়ে চলিয়া যাইবে যে মুহম্মদের (স) জীবনের উদ্দেশ্য পর্যন্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হইবে।”

ইউরোপিয়ান ফতোয়া ও গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য বিশ্ব-বিখ্যাত শারিয়া সমর্থক ডঃ জামাল বাদাওয়ী পর্যন্ত এটা স্বীকার করে বলেছেন − “কোরাণের কোন আয়াতেই মুরতাদের দুনিয়ায় শাস্তির বিধান নাই। কোরাণ বলে, এই শাস্তি শুধুমাত্র পরকালেই হইবে” − (ফতোয়া কাউন্সিলের ওয়েবসাইট)।- এমনকি আমাদের বাংলাদেশ শারিয়ার তাত্ত্বিক গুরু জনাব প্রয়াত শাহ আবদুল হান্নানও বলেছেন − “অতিতের অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞের মতে সৈয়িদ মওদুদি প্রাচীন মতে (অর্থাৎ মুরতাদের মৃত্যুদণ্ডে − লেখক) বিশ্বাস করিতেন। বর্তমানের বেশির ভাগ ইসলামি বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে তাঁহার সহিত বা প্রাচীন বিশেষজ্ঞের সহিত একমত নহেন। যখন কোন বিষয়ে মতভেদ হয় বা একাধিক মতামত হয় তখন কোন একজন বিশেষজ্ঞের ইজতিহাদকে মানিতে কেহ বাধ্য নহে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বিষয়ে সৈয়িদ মওদুদির সহিত একমত নহি” (ইণ্টারনেট, বাংলারনারী আলোচনা ফোরাম − ৭ এপ্রিল, ২০০৬)।

 ডঃ ইউসুফ কারজাভি আগে এই শারিয়া আইনের সমর্থক ছিলেন  http://en.wikipedia.org/wiki/European_Council_for_Fatwa_and_Research, সম্প্রতি তিনি মত বদলিয়ে এর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন (দৈনিক সংগ্রাম ২৮শে মার্চ ২০০৬ ও দৈনিক ইনকিলাব ১৪ই এপ্রিল ২০০৬)। ক্যানাডায় মওলানা আল্ আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মুবিন শেখ। তিনিও বলেছেন মুরতাদ হত্যার শারিয়া আইন কোরাণ-বিরোধী। মুসলিম খেলাফতে ১৭২৮ সালের শারিয়া-কোর্টের সিসিল দলিলে আমরা দেখি জয়নাবের পিতা মোস্তফা কোর্টে বলেন যে জয়নাবের স্বামী ইব্রাহীম ইসলামি ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসকে অভিশাপ দিয়েছে, কাজেই তাদের তালাক হওয়া উচিত। দু’জন সাক্ষী দ্বারা এটা প্রমাণিত হলে কোর্ট বিয়ে বাতিলের রায় দিয়ে ইব্রাহীমকে আদেশ দিয়েছে মোহরের অর্থ ফিরিয়ে দিতে (উইমেন, দ্য ফ্যামিলি অ্যাণ্ড ডিভোর্স ল’জ্ ইন্ ইসলামিক হিস্ট্রি − ডঃ আমিরা আজহারী সনবল, পৃষ্ঠা ১১৯)। এ ফতোয়া বা রায়ে আমরা মৃত্যুদণ্ড দেখি না।

কোরাণের অপব্যাখ্যা করে বিশ্ব-মুসলিমকে কি ভয়ানকভাবে পৃথিবীর সমস্ত অমুসলিমদের বিপক্ষে যুদ্ধংদেহী করে দাঁড় করানো হয়েছে দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। যেমন, কোরাণ সুরা আরাফ-এর আয়াত ১৭২-কে অপব্যাখ্যা করে বলা হয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ মুসলমান হয়ে জন্মায় (বহু সূত্র, এবং দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ই মে, ২০০৬)।- যাঁরা এ অপব্যাখ্যা করেন তাঁরা কি খেয়াল করেছেন, এ-ব্যাখ্যায় পৃথিবীর প্রতিটি অমুসলিম ‘মুরতাদ’ হিসেবে শারিয়া মোতাবেক হত্যার যোগ্য ?

ইসলাম কি ইঁদুর-মারা কল যে এতে ঢোকা যাবে কিন্তু বেরুনো যাবে না ? যেখানে অসংখ্য অমুসলিম মুসলমান হচ্ছে সেখানে দু’চারজন ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা উপেক্ষা করলেই তো “লা ইকরাহা ফিদ্বীন” (ধর্মে জবরদস্তি নেই)−এর মর্যাদা রক্ষা হয় ! এ-মর্যাদা নবীজী কিভাবে রক্ষা করেছেন তা দিয়ে শেষ করছি:

“উসামা বিন জায়েদ বলিয়াছে − ‘যখন আমি ও এক আনসার তাহাকে (মিরদাস বিন নাহিক নামে এক অমুসলিমকে যার গোত্রের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছিল –লেখক) আমাদের অস্ত্র দিয়া আক্রমণ করিয়া পাকড়াও করিলাম তখন সে কলমা উচ্চারণ করিল। কিন্তু আমরা থামিলাম না এবং তাহাকে হত্যা করিলাম।’ রসুলের নিকট আসিয়া আমরা এই ঘটনা বর্ণনা করিলে তিনি বলিলেন − ‘কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, উসামা ?’ আমি বলিলাম, ‘লোকটি শুধু মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিবার জন্য কলমা উচ্চারণ করিয়াছে।’ কিন্তু তিনি প্রশড়বটি করিতেই থাকিলেন এবং করিতেই থাকিলেন। তখন আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম এবং বলিলাম আমি আর কখনোই তাহাকে খুন করিব না যে কলমা উচ্চারণ করিয়াছে। তিনি বলিলেন − ‘আমার (মৃত্যুর) পরেও তুমি এইকথা বলিবে তো ?’ আমি বলিলাম, ‘বলিব’।”(রসুলের সবচেয়ে বিখ্যাত জীবনী ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক থেকে, পৃষ্ঠা ৬৬৭)।- অর্থাৎ নবীজী মুরতাদ-ঘোষণার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের গ্যারাণ্টি চেয়েছেন। সে গ্যারাণ্টি দিতে হবে প্রতিটি মুসলমানকে।

কলমার দায় বড় দায়, কলমার অপমান ইসলামের অপমান! অন্য সূত্রে ইমাম হাম্বলের মসনদ ৬ষ্ঠ খণ্ড ২৬০-র উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায় নবীজীর তীক্ষন প্রশ্ন − ‘তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ?’ - (বহু হাদিসের সুত্রে ডঃ ত্বাহা জাবির আল্ আলওয়ানী − “দি এথিক্স অব্ ডিসএগ্রিমেণ্ট ইন্ ইসলাম)।- আজ যাঁরা মুরতাদ ঘোষণার হুঙ্কার দেন তাঁদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই নবীজীর বড় বেদনা বড় কষ্টের সেই উচ্চারণ : ‘তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ ?’ কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, হে মুরতাদ-ঘোষণাকারী ?

 

Print