ইসলামে গণতন্ত্র বৈধ কেন

ইসলামে গণতন্ত্র বৈধ কেন

ডক্টর কারজাভী'র "ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা - তত্ত্ব ও প্রয়োগ" 

হাসান মাহমুদ

"বিশ্বে রাষ্ট্রব্যবস্থা" নিয়ে মুসলিম-বিশ্ব মোটাদাগে তিনভাগে বিভক্ত।  (১) একদল মনে করেন খেলাফত ফিরিয়ে আনতে হবে। এর আধুনিক নাম "ইসলামী রাষ্ট্র"-এর সমর্থনে প্রচুর সাহিত্য রচনা করেছেন মওদুদী সহ অনেকে। (২) এই দলের মুসলিম ও আলেমরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, ইনাদেরও অনেক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে যেমন আলেম উলামাদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন নাদলাতুল উলামা'র প্রকাশিত "দি ইলিউশন অফ ইসলামিক স্টেট্" অর্থাৎ "ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম"।  (৩) মাঝখানে  আরেক দলের অবস্থান যাঁরা "ইসলামী গণতন্ত্র"-এ বিশ্বাসী।  এই দলের অন্যতম নেতা ড- ইউসুফ কারযাভী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলার্স-এর চেয়ারম্যান এবং বিশ্বের  অন্যতম শীর্ষ ইসলামী নেতা ছিলেন। ইনদেরও অনেক কেতাব রয়েছে, যেমন ডক্টর কারজাভী'র "ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা - তত্ত্ব ও প্রয়োগ" যা আমি এ বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে করি।

খেলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রবক্তারা সর্বদাই সেই দেড় হাজার বছর আগের চার খলিফার শাসনকার্য বর্ণনা করেন। এটা  ঠিক যে আজ আমরা যেমন শাসন দেখতে চাই ঠিক তেমনই ছিল তাদের শাসন। কিন্তু তাঁদের পর গত দেড় হাজার বছরে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সুশাসন তো দূরের কথা তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র বা খেলাফত ছিল বিশ বাইশিটা "আমিরুল মুমেনীন" রাজবংশের পরস্পরের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ, গণহত্যা, গুপ্তহত্যা, বিদ্রোহ ও পাল্টা বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাস। এটা ড. কারজাভীও কিছুটা বলেছেন তাঁর বইয়ের ১৯১ ও ১৯২ পৃষ্ঠায়। এর মধ্যে মদীনাতে এজিদ বাহিনীর গণহত্যা ও গণধর্ষণও আছে যাতে এক হাজার মুসলিম নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। যে শাসন ব্যবস্থা গত দেড় হাজার বছর ধরে ব্যর্থ হয়েছে আজ হঠাৎ কোন ম্যাজিকের বলে সেটা সফল হবে সে প্রমাণ এখনো অনুপস্থিত। তাছাড়া শব্দেরও কারচুপি আছে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রবক্তারা বলেন "সার্বভৌমত্ব" আল্লাহর, গণতন্ত্রে আছে "জনগণ সার্বভৌম" - এটা হতে পারে না এটা কুফরী। তাঁদের এই দাবী আত্মপ্রতারণা মাত্র। কারণ তাঁরা ভালো করেই জানেন আল্লাহও দয়ালু আবার হাজী মুহাম্মদ মহসিনও দয়ালু, এ দুই "দয়ালু" সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা ঠিকই জানেন বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব একাত্তরের আগে ছিলনা, বাংলাদেশ না থাকলে সেটাও থাকবেনা কিন্তু আল্লাহর সার্বভৌমত্ব চিরকাল আছে থাকবে।

যাহোক, এখানে আমি ড. কারজাভীর বইয়ের কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করছি।  

"ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা - তত্ত্ব ও প্রয়োগ" :- এই বইয়ের ১৭১ পৃষ্ঠায় তিনি বলছেন- "সংক্ষেপে গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে জনগণ নির্বাচন করবে কারা তাদেরকে পরিচালনা করবে এবং কারা তাদের শাসক হবে, জনগণের মতামতকে পদদলিত করে তাদের অপছন্দনীয় কাউকে তাদের শাসক মনোনীত করা হবে না কিংবা তাদের অপছন্দনীয় কোন শাসনব্যবস্থা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।  সাথে সাথে শাসক যদি ভুল করে তাহলে তা পর্যালোচনা অধিকার জনগণের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং প্রয়োজনে তাকে পদচ্যুত করা বা পরিবর্তন করার অধিকারও থাকবে।  জনগণের অসন্তুষ্টি সত্বেও তাদের উপর কোন মতবাদ কিংবা রাজনৈতিক থেকে শুরু করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন নিয়ম কানুন তাদের উপর চাপানো হবে না যার সাথে তারা আদৌ পরিচিত নয় এবং যা তাদের মন:পুত নয়।  শাসকগোষ্ঠীর কেউ যদি উল্লেখিত মূলনীতির বিপরীত করে তাহলে তার প্রতিদান হচ্ছে যে, ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।  এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রে প্রকৃত মূলতত্ত্ব।  এখানে মানবতা যে সকল কর্মপদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে তা হচ্ছে নির্বাচন, জনগণের মতামতের যাচাই করণ, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অগ্রাধিকার, বহুদলীয় রাজনীতি, সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ, বিরোধীদলের অধিকার সংরক্ষণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ইত্যাদি।   সুতরাং উল্লেখিত মূলনীতি সম্বলিত এ গণতন্ত্র কি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক? কোথায় এ সংঘর্ষ ? কোরআন ও সুন্নাহর কোন মজবুত ভিত্তি করে এ ধরনের দাবি করা হয়ে থাকে ? গণতন্ত্রের মূল কথা নিয়ে কেউ যদি চিন্তা ভাবনা করে তাহলে দেখতে পাবে যে ইসলামের মূলনীতির সাথে এখানে কোন বৈপরীত্য নেই - পৃষ্ঠা ১৭১।

নারী -নেত্রীত্ব নিয়ে তিনি ২১৭ থেকে ২৪১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দীর্ঘ ও ব্যাপক আলোচনা করে নারী-নেত্রীত্বের বিরোধী প্রতিটি যুক্তিকে অত্যন্ত দক্ষভাবে পরাস্ত করে শেষে বলেছেন - "মুসলিম দলসমূহে আজকাল প্রায় ইজমা হয়েছে যে তারা প্রধানমন্ত্রীসহ সকল পদে দায়িত্ব পালন করতে পারে"।  অর্থাৎ তিনি নারী-নেত্রীত্বের পক্ষে কথা বলেছেন। আমাদের নারী-নেত্রীত্বের বিরোধী  আলেমদের উচিত ডক্টর কারজাভীর যুক্তিগুলোর বিপক্ষে তাঁদের কি বলার আছে তা জাতিকে জানানো যাতে জাতি বিষয়টার দুদিকই দেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।  

দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে ১৩ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে ড. কারজাভীর ওই বইয়ের ওপরে শাহ আবদুল হান্নান তাঁর ‘ইউসুফ কারজাবির রাষ্ট্রচিন্তা' নিবন্ধের শেষে লিখেছেন :- “তিনি মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের সব যুক্তি খণ্ডন করে বলেছেন, যা তারা আধুনিক গণতন্ত্রের সব পদেই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন (পৃ: ২১৭-২৪১)। তিনি অমুসলিমদের পক্ষেও একই ধরনের মতামত দিয়েছেন (পৃ: ২৬৯-২৭৮)।
এ বইটি সবাইকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি।

Link:-  https://web.archive.org/web/20150413022950/http:/dev.dailynayadiganta.com/detail/news/14542

সতর্কীকরণ - পশ্চিমা বিশ্বের কিছু সমস্যা নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কাজ করছেন - যেমন প্রাক-বিবাহ যৌনতা, বিয়েতে অনীহা, ক্রমবর্ধমান বিবাহ বহির্ভূত সন্তান ইত্যাদি। এসব বিষয়ে মুসলিম সমাজের সাথে সাংঘর্ষিক। 

Print