ইসলামী শারিয়া : চিরন্তন, নাকি পরিবর্তনযোগ্য ?
দ্রব্যমূল্যের মত কিছু বাস্তব আমরা ইচ্ছে করলেও এড়াতে পারি না। তেমনি, আপনি আমি আমরা এখন এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছি যার মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। PEW এবং রিজলভ কনসর্টিয়াম জরিপে এসেছে দেশে ৮০% এর বেশি লোক শারিয়া আইন চান। এ অবস্থায় শারিয়া সম্বন্ধে গণসচেতনতার বিকল্প নেই।
** - আল্লাহ আমাদেরকে "শারিয়া" দিয়েছেন - সূরা মায়েদা ৪৮, আশ শুরা ১৩, জাসিয়া ১৮।
**- “রাষ্ট্রীয় আইন”-এর আরবি "কানুন" কোরানেও নেই, হাদিসেও নেই। তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে কি দিয়েছেন? আল্লাহ তো কিছু ভুলে যান না - মরিয়ম ৬৪, ত্বহা ৫২।
**- "শারিয়া" শব্দের আক্ষরিক অর্থ বালুর ওপরে তৈরি পানির কাছে যাবার পথ।
**- মরুভূমিতে পানির কাছে যাওয়া মানে জীবনের কাছে যাওয়া। কাজেই "শারিয়া" শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থ আখেরাতে নাজাত পাবার পথ, সেজন্যই ইংরেজিতে স্কলাররা একে বলেন THE WAY - পথ। অর্থাৎ আল্লাহ আমাদেরকে নাজাত পাবার আধ্যাত্মিক পথ দিয়েছেন।
*********************************
সজল রোশনের সাথে আমার সিরিজ অনুষ্ঠান # ১৬ - জানুয়ারী ১৫, ২০২৪.
Youtube:- https://www.youtube.com/watch?v=TdJeJQZBfq4,
Facebook - https://www.facebook.com/sajalroshaninc/videos/1546673176144921
ইসলামী শারিয়া : চিরন্তন, নাকি পরিবর্তনযোগ্য ?
জবাব - YES, and NO.
ইতিহাস কি বলে, খলীফারা কি করেছেন, স্বয়ং নবীজি কি করেছেন?
** - গত অনুষ্ঠানে আমরা ইমাম গাজ্জালী থেকে দেখেছি শুরুতে সাহাবীরা শারিয়া ফিকাহ এগুলোকে আধ্যাত্মিক অর্থে ব্যবহার করতেন যা কোরানের মর্মবাণী ছিল। কিন্তু তিনশো বছর পর তাঁর সময়ে দেখা গেল শারিয়া ফিকাহ এগুলো আধ্যাত্মিকতাহীন রাজনৈতিক হয়ে "মানুষ প্রতারণার জালে আবদ্ধ হচ্ছে" - এহহিয়া উলুমুদ্দীন ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৫০, ৫১।
**- মাওলানা মওদুদী তাঁর "ইসলামিক ল এন্ড কনস্টিটিউশন" বইয়ের 140 পৃষ্ঠায় বলেছেন পৃথিবীর সব মুসলিম একসাথে হলেও কোরআন রসুলের সুস্পষ্ট নির্দেশ বিন্দুমাত্র বদলাতে পারবে না। কিন্তু সেই মওদুদীই তাঁর "দি সিক নেশনস অফ দি মডার্ন এজ" পৃষ্ঠা ৮ বলেছেন:-
একসময় মুসলিমদের কলম ও তলোয়ার “রুলড সুপ্রিম” - সর্বোচ্চ শাসক ছিল - কিন্তু তাদের পতন হলো কারণ তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোতে শারিয়াকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলো না। অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শারিয়াকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
** - তাঁর "তাফহিমুল কুরাণ"-এ মায়েদা ৪৮-এর ব্যাখ্যাতে প্রশ্ন তুলেছেন - ইসলাম তো এক কিন্তু তাহলে বিভিন্ন নবীদের কেতাবে ইবাদত, হালাল-হারাম ও সামাজিক বিধি-বিধান আলাদা কেন? তিনি জবাব দিচ্ছেন- স্বয়ং আল্লাহ বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন জাতির ও বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াবার জন্য আইনের ধারা বদলেছেন”:- https://islamicstudies.info/tafheem.php?sura=5&verse=44&to=50
এর জোরালো সমর্থন আছে "প্রিন্সিপলস অব্ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স" কেতাবে (ডঃ হাশিম কামালি- পৃষ্ঠা ২০৩) “নবী (দঃ)-এর সময়েই কোরান ও সুন্নাহ-তে কিছু সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পরিবর্তন করা হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনই ইহার মূল কারণ”।
পরিস্থিতির কারণে বিধান বদলের উদাহরণ অজস্র:-
- সূরা হুজরাত আয়াত ২ – নবীজির সামনে উঁচু গলায় কথা বলবে না - কোরানের এই হুকুম কি আপনি মানতে পারবেন আজ? পারবেন না, মানার সুযোগ নেই। সূরা আহযাব ৫৩:- নবী (সা) এর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীদেরকে বিয়ে করা যাবে না, কোরআনের এই হুকুম কি চিরন্তন? না, এই হুকুম সাহাবীদের পরে পরেই রহিত হয়ে গেছে।
- আজ বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে শারিয়া ভিত্তিক, কিন্তু কই কেউই তো দাসপ্রথা বা জিজিয়া কর চালু করেনি !! করবেও না।
- আমরা কি কখনো ভাবতেও পেরেছিলাম নামাজের আজান যা নবীজি স্বয়ং দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা কেউ বদলাবার ক্ষমতা রাখে? কিন্তু করোনার সময় মসজিদ থেকে “হাইয়ালাস সালাহ” অর্থাৎ “নামাজের জন্য এসো” বদলে গিয়ে “আস সালাতু ফিল বুয়ুতিকুম" অর্থাৎ “বাসায় নামাজ পড়ো” হয়েছে তো!
- হজ্ব প্রায় ৪০ বার বিভিন্ন কারণে একেবারেই বন্ধ বা প্রায় বন্ধ ছিল। ওহাবীদের যুদ্ধের জন্য হজ ১৮০৩ থেকে ১৮০৯ প্র্যাকটিক্যালি বন্ধ ছিল- "দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস" - স্যার উইলিয়াম হান্টার, পৃষ্ঠা ৪৭।
- মদ্যপান - কোরআনে শাস্তি নাই নিরুৎসাহিত করা আছে- বাকারা ২১৯। কিন্তু নবী (দঃ) মাতালের শাস্তি দিয়েছেন (ক)চল্লিশ চাবুক, তারপর সেই মাতাল কখনো (খ) দুইবার শাস্তির পর, (গ) কখনো তিনবার শাস্তির পর আবার মদ খেলে তিনি মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন এবং (ঘ) এক পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড রহিতও করেছিলেন – আবু দাউদ ৪৪৬৭, ৪৪৬৯, ৪৪৭০।
- ওমর (র) সেই সুন্নত বদল করে মাতালের শাস্তি আশি চাবুক করেন − আবু দাউদ ৪৪৬৬।
- নবী (স) জিজিয়া নিতেন (তওবা ২৯) কিন্তু হজরত ওমর (রা:) কিছু ব্যক্তি ও এক গোত্রের কাছ থেকে জিজিয়া নেয়া বন্ধ করেন – বিস্তারিত - মুহিউদ্দিন খানের অনুদিত বাংলা-কোরান, পৃষ্ঠা ৫৬৭। বিধান বদলের সূত্র কোরানেই আছে - নাসিক-মনসুখ তত্ত্ব - সূরা নাহল ১০১, বাকারা ১০৬। ডঃ হাশিম কামালী বলছেন – “নখস- এর উপলব্ধি আসিয়াছে মানুষের উপকারের জন্য সমাজের বিদ্যমান পটভূমি ও আইনের সমন্বয়ের প্রয়োজনে” – “প্রিন্সিপল্স্ অব্ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স" পৃষ্ঠা ২০৩।
- "সমাজের বিদ্যমান পটভূমি ও আইনের সমন্বয়" - অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ৫০৪ পৃষ্ঠায় বলছেন - “কোরাণ ধীরে ধীরে ২৩ বছর ধরিয়া নাজিল হইয়াছিল, ইহাতে প্রমাণ হয় যে কোরাণ সেই সময়ের পরিবর্তনগুলিকে গণনায় ধরিয়াছিল” ।
- ডঃ কামালী, পৃঃ ২০৩ - নবী (দঃ) মুয়ালাফা গোত্রকে জাকাতের যে অংশ দিতেন - সেটা হজরত ওমর (রা:) বন্ধ করেন।
- ডঃ কামালী, পৃঃ ৩২৫ - চোরের হাত কাটতে হবে মায়েদা ৩৮। কিন্তু হযরত ওমর (রা:) দুর্ভিক্ষের সময় এটা বন্ধ করেছিলেন। পাকিস্তানসহ দুনিয়ায় এতগুলো শারিয়া-রাষ্ট্রের দু-একটা ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলো চোরের হাত কাটা বন্ধ করেছে।
- মুসলিম পুরুষ ইহুদি খ্রিস্টান নারীকে বিয়ে করতে পারবে- সূরা মায়েদা ৫। কিন্তু ওমর (রা:) এক সময় এটা বন্ধ করেছিলেন ডঃ কামালী, পৃঃ ৩২৫।
- ওমর (রা) কিছু মুসলিমের কাছ থেকে জিজিয়া নিয়েছিলেন তাদেরকে যুদ্ধ থেকে রেহাই দিতে, খ্রিস্টান গোত্র জুরাজিমাহ-এর কাছ থেকে জিজিয়া নেননি কারণ তারা মুসলিমদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করত - মো. কুতুবের বিখ্যাত বই ‘ইসলাম দ্য মিস্আণ্ডারস্টুড রিলিজিয়ন” পৃষ্ঠা ২৩৭।
- ওসমান (র) তামাত্তু হজ্জের পদ্ধতি বদল করলে হযরত আলী রা বলেছিলেন “আমি কারো কথায় রসূলের সুন্নত ছাড়বো না” - বুখারি ২য় খণ্ড হাদিস ৬৩৪।
- নবী (সাঃ) মৃত্যুকালে নেতা-নির্বাচন জনগণের ওপর ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আবুবকর (রা) উনার সুন্নত অনুসরণ না করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওমরকে (রা:)।
- হজরত ওমরও (রা:) ওই দুই পদ্ধতির কোনটাই না করে ছয় সাহাবীর কমিটি বানিয়ে তাঁদের ভেতর থেকে খলিফা নির্বাচনের আদেশ দিয়েছিলেন এবং সেভাবেই হযরত ওসমান (রা) খলিফা হয়েছিলেন
- কোরানে দাসপ্রথা বৈধ (সূরা মুহম্মদ ৪, মুমিনুন ৫, ৬ ইত্যাদি) ও অমুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া কর নেয়ার নির্দেশ আছে (তওবা ২৯)। কিন্তু উসমানি খলীফা ১৮৩৯ - ১৮৬৯ সালে "তানজীমাত সংস্কার" আইনে বন্ধ করেছে (ক) দাসপ্রথা (B) জিজিয়া কর (C) ব্যভিচার এবং ইসলাম ত্যাগের মৃত্যুদণ্ড। দলিলে উল্লেখ নেই কিন্তু সম্ভবত অন্য শাস্তি দিয়েছে।
- ড. আমিরা আজহারী সনবল –“উইমেন, দি ফ্যামিলি এন্ড ডিভোর্স ল’জ ইন ইসলামিক হিস্ট্রি”– এতে খেলাফত আমলের শারিয়া কোর্টে আইন বদলের উদাহরণ আছে। যেমন ১১৯ পৃষ্ঠায় আছে ইব্রাহিম ইসলামকে গালাগালি করে মুরতাদ হয়ে গেল। মুরতাদের বিয়ে এমনিতেই বাতিল হয়ে যায় তবু তার শ্বশুর মোস্তফা কোর্টে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করলে শারিয়া কোর্ট তাদের বিয়ে বাতিল ঘোষণা করে দেনমোহরের টাকা ফেরত দেওয়ার রায় দিল। এখানে আমরা মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড দেখিনা।
- খেলাফতের শেষদিক পর্যন্ত প্রায় হাজার বছর ধরে অমুসলিমদের কাছ থেকে :- (A) জিজিয়া নেয়া হতো, (B) তাদের সৈন্যবাহিনীতে নেয়া হতনা, (C) উচ্চপদে চাকরি দেয়া হতো না, (D) মামলা মোকদ্দমায় তাদেরকে ইসলামী শারিয়া কোর্টে আসতে হতো।
১৪০০ বছর পর ১৮৩৯ - ১৮৬৯ সালে উসমানিয়া খেলাফতে আমরা কি দেখি? ডঃ শেখ ওসামা হাসানের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বই - “ফ্রম ধিম্মিচুড টু ডেমোক্রেসি - ইসলামিক ল’, ননমুসলিমস এন্ড ইকুয়াল সিটিজেনশীপ” থেকে দেখাচ্ছি - কেউ এই অসাধারণ বইটা অনুবাদ করলে খুব ভালো হয়:-
(A) সব ধর্মের লোকদের সমান নাগরিক অধিকার,
(B) জিজিয়া বন্ধ, দাসপ্রথা উচ্ছেদ,
(C) অমুসলিমদেরকে সৈন্যবাহিনী এবং সরকারি চাকরিতে নেয়া শুরু ,
(D) অমুসলিমদেরকে তাদের নিজেদের ধর্মীয় কোর্ট ও স্কুলের অনুমতি (সার্চ “মিল্লেত সিস্টেম”)। সার্চ: - তানজীমাত কি ? তানজীমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংস্কারাবলি কী ছিল ? https://www.islamichistoryvirtualacademy.com/2022/07/What%20is%20Tanzimat%20The%20Reforms%20adopted%20in%20Ottoman%20Turkey%20during%20the%20Tanzimat%20movement.%20.html
কালতামামী
ইসলামী বিধানের এই যে বিশাল বিপুল পরিবর্তন, এগুলি তো বাইরের চাপে হয়নি! এগুলো তো খলিফারাই করেছেন!! কিন্তু তার মানে এই নয় যে পরিস্থিতি বদলে গেলে ইসলামের সবকিছুই বদলে দিতে হবে। এখানেই শারিয়া আইনের কনস্ট্যান্ট ভারসেস ভেরিয়েবলের কথা চলে আসে।
খেয়াল করুন !
কোরান, নবী সা এবং খলীফারা যে বিধানগুলো বদলেছেন সেগুলোর প্রত্যেকটি ব্যতিক্রমহীনভাবে এবং অবধারিতভাবে দুনিয়াদারীর বিধি-বিধান, ইবাদত বন্দেগীর নয়।
ইবাদত বন্দেগীর বিধান চিরকাল একই থাকবে - নামাজ চিরকাল পাঁচ ওয়াক্ত থাকবে, রমজানে রোজা চিরকাল থাকবে, চিরকাল একই থাকবে আমল এবাদত তাকওয়ার বিধানগুলো - ওগুলো কনষ্ট্যান্ট, শ্বাশ্বত।
কিন্তু দুনিয়া বদলের সাথে বদলেছে, বদলাচ্ছে, বদলাবে দুনিয়াদারীর বিধানগুলো – ওগুলো ভেরিয়েবল। দুনিয়াদারীর বিধান - সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি।
সমাজ-কল্যাণের জন্য এটাই করেছেন কোরান, নবী (সা), খোলাফায়ে রাশেদীন ও পরের খলিফারা। আমাদেরকেও তাঁদেরই অনুসরণ করতে হবে, এটা নুতন কিছু নয়।
**********************************
ADDED - 16 JULY 2024:-
ড. ইউসুফ কারজাভী'র "আধুনিক যুগ - ইসলাম, কৌশল ও কর্মসূচি" বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে নবীজি (সা) ও খলিফাদের বিধান বদলের অনেক উদাহরণ আছে। বইটা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের অনলাইন লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়- লিংক:- https://www.bjilibrary.com/615/6
আংশিক উদ্ধৃতি:-
খোলাফায়ে রাশেদীন যখন দেখেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. যে উদ্দেশ্যে একটি কাজ করেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ কাজ বা পদক্ষেপ মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল হবে না তখন তারা রাসূলের সা. সে কাজের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর একটি উদাহরণ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সা. খায়বর বিজয়ের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। কিন্তু ওমর রা. ইরাকের পল্লী অঞ্চল জয়ের পর তা করেননি। কারণ সে সময়ের প্রেক্ষিতে তার করা তিনি সমীচীন মনে করেননি। রাসূলের সা. অনেক সাহাবি ওমরের এ মতের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করেন, বিশেষ করে এ কারণে যে তাঁর সিদ্ধান্ত আক্ষরিক অর্থে সূরা আন্ফালের ৪১ নং আয়াতে বর্ণিত সাধারণ বিধিমালার পরিপন্থী ছিল। এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ আর জেনে রাখো যুদ্ধলব্ধ যা কিছু গণিমতস্বরূপ তোমাদের হস্তগত হয় তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্যে।
ওমর রা. এ বলে মন্তব্য করেনঃ আমি সম্পদকে বর্তমান ও ভবিষ্যতে মানুষের জন্যে যথেষ্ট মনে করছি। আপনারা কি চান আগামী প্রজন্ম এমন অবস্থঅয় পড়ুক যে তাদের জন্যে কিছুই রাখা হয়নি?
এর অর্থ, ওমর রা. আগামী প্রজন্মের কথা ভেবেই উপরোক্ত বিবেচনা করেছেন যা মুসলিম উম্মাহর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার লক্ষ্যে এক চমকপ্রদ পদক্ষেপ। যেন আগামী প্রজন্মের স্বার্থ উপেক্ষা করে কেবল বর্তমান প্রজন্ম বিলাসী জীবনযাপন করতে না পারে। হযরত ওমরের এ পদক্ষেপ নেয়ার পেছনে যুক্তির ভিত্তি ছিল সূরা আল হাশরের ১০ নং আয়াত। যেখানে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে গণিমতের মাল বণ্টনের বিধান উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ আর যারা তাদের পরে এসেছে। ইমাম ইবনে কুদামা রাসূলুল্লাহর সা. এবং ওমরের পদক্ষেপের মধ্যে পার্থক্যের ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ উভয়ে সেটাই করেছেন যা তাদের সময়ের জন্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মনে হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সা. এর কোনো কোনো কাজ সুন্নাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীদের জন্য তা বাধ্যতামূলক নয়। তাঁর সাহাবিরা কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয় বিবেচনায় রেখে এর বিপরীত কাজ করেছেন। তাহলে পরবর্তী মুসলমানদের পদক্ষেপ কেন তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে যারা তাদেরও পরে আসবে?
কোনো দৃষ্টান্ত আইনগত বাধ্যবাধকতার যথার্থ কারণ হতে পারে না। দৃষ্টান্ত কেবল সংশ্লিষ্ট স্থান, কাল ও পরিস্থিতির জন্য পর্যাপ্ত। এসব উপাদান যদি পরিবর্তিত হয় তবে তার ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে মুল বিষয় হচ্ছে, আমাদের আগের যে সব ব্যবস্থা ও বিধান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আমাদের সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য উপযোগী ব্যবস্থা মূল গ্রন্থ ও আমাদের উদার শরীয়াহর লক্ষ্যের আওতার মধ্য থেকেই বেছে নিতে হবে।…………………………………………… কোনো নতুন জিনিস বা আবিষ্কারের বিরুদ্ধে ইসলাম বিদআত নামে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে এরূপ ধারণা করা ভুল। প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্ভেজাল দ্বীনি বিষয়ে কিছু উদ্ভাবনেই কেবল বিদআত হতে পারে। যেমন ঈমান, ইবাদত ও এগুলোর শাখা প্রশাখা। কিন্তু জীবনের পরিবর্তনশীল বিষয়গুলো যেমন রীতি, ঐতিহ্য, প্রথা, প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি এগুলো আলেমদের ভাষায় ‘জনগণের’ আওতায় পড়ে, যার ব্যাখ্যা আমরা পাই ইমাম আল শাতিবীর ‘আল-ইতিসাম’ গ্রন্থে। একারণেই রাসূলের সা. সাহাবিরা অনেক কিছু করেছেন যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. করেননি। যেমন আল-কোরআনের অনুলিপি লিখন, রেজিস্টার খাতাপত্র ব্যবহার, ভূমি কর আরোপ ও জেলখানা নির্মাণ। রাসূলের সা. সাহাবিদের পরবর্তী মুসলমান তাবেঈনরা তাদের সময়ে এমন কিছু করেছেন যা তাদের পূর্ববর্তী সাহাবিরা করেননি। যেমন মুদ্রা তৈরী, ডাক সার্ভিস প্রবর্তন ইত্যাদি।
(আদিতে বিয়ের কোন দলিল ছিলোনা, দুজন সাক্ষীই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু পরে বিয়ে দলিলে নিবন্ধিত করার আইন চালু হয় - হাসান মাহমুদ)।