খেলাফতের মোহময় ভ্রান্ত বয়ান

খেলাফতের মোহময় ভ্রান্ত বয়ান  - হাসান মাহমুদ 

Dr.jpg

দেশে জনগণের কষ্টের শেষ নেই। মরিয়া জনগণের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র তথা খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে। জনগণকে জানানো দরকার দেশে ও তৃতীয় বিশ্বে যেটা চলছে সেটা ফরমালিন মার্কা ভেজাল গণতন্ত্র, আসল গণতন্ত্র আছে আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ বিশ্বের সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত- জরিপ:https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/305-2024-10-05-15-37-34

বিকল্পের খোঁজে মরিয়া জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের মায়াময় স্বপ্নীল চিত্র। অনতিক্রম্য এ স্বপ্নের আকর্ষণ, দুর্বার এর হাতছানি। ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলামী শব্দাবলী, যেমন আল্লাহর আইন, নবীজির (সা) সুন্নত, মদিনা রাষ্ট্র, খোলাফায়ে রাশেদীন, মুসলিম খিলাফত, সৎলোকের শাসন ইত্যাদি। আমাদের মত দেশে মুসলিম-গণমানসে এসব স্বপ্নময় শব্দ-বাক্যের প্রভাব হ্যামিলনের বাঁশির মত প্রচন্ড।

ইতিহাসের শিক্ষা কি? অনেক বিশ্ব-আলেম খেলাফতের ব্যাপারে কি আপত্তি করেছেন, কেন করেছেন এবং কেন সেটা জাতির কাছে লুকিয়ে রাখা হয়?

কল্পনা করুন আমাদের উপর একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির গণহত্যা অর্থাৎ মুসলিমের হাতে মুসলিমের গণহত্যা। খেলাফতের ইতিহাস খুলুন, দেখবেন সেখানে বয়ে চলেছে দুটি ভিন্ন স্রোতের সমান্তরাল ধারা। এক - জ্ঞান বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য ও বিস্ফোরিত উন্নতি, একের পর এক দিগ্বিজয়ী আবিষ্কার যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানের জ্ঞান জগত এবং যা পশ্চিমা বিশ্বের সবাই সম্মানের সাথে স্বীকার করেন। দুই - শত শত বছর ধরে মুসলিমের হাতে মুসলিমের রক্তাক্ত ও বেদনার্ত গণহত্যার অজস্র দলিল। এই নিবন্ধের শেষে তার কিছুটা তালিকা দেয়া আছে, সূত্রে উল্লেখিত ভিডিওগুলো সম্পূর্ণ দেখার অনুরোধ রইল।

  1. ইমাম গাজ্জালীর বেদনার্ত চিঠি:- “বাদশাহদের প্রায় সব জমিজমা ও প্রাসাদ (রিয়েল এস্টেট) অবৈধভাবে অর্জিত। কাহারো উচিত নহে এসব সুলতানকে মুখ দেখানো বা তাহাদের মুখ দেখা। তাহাদের অত্যাচারের জন্য তাহাদিগকে ঘৃণা করা উচিত, তাহাদের অস্তিত্বকেই নিন্দা করা উচিত, তাহাদের প্রশংসা করা উচিত নহে...তাহাদের রাজপ্রাসাদ ও সাজ-পোশাককে নোংরা ও অনৈসলামিক ঘোষণা করা উচিত”... তিনি সকল মন্ত্রীদিগকে চিঠিতে লেখেন যে, “স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করিয়াছে। আমি এইস্থান ত্যাগ করিয়া যাইতেছি যাহাতে স্বৈরতন্ত্রের এই নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড আমাকে দেখিতে না হয়” – “এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেণ্ট ইন্ ইসলাম” - পৃষ্ঠা ৬২-৬৩।

    GAZZALI_-_TYRANNY_OF_KHELAFAT.png

  1. Thoughts on Re-Establishing a Khilafa | Shaykh Dr Yasir Qadhi:-(https://www.google.com/search?sca_esv=ea89727b02e8330d&rlz=1C1CHBF_enCA911CA911&q=Is+dr.+Qadhi+member+of+North+American+Fiqh+Council? &spell=1&sa=X&ved=2ahUKEwiw8MqGmPiIAxWWjYkEHSfaPC4QBSgAegQIChAB&biw=1236&bih=552&dpr=1.1

আমেরিকা-ক্যানাডা ভিত্তিক "নর্থ আমেরিকান ফিকাহ কাউন্সিল"-এর চেয়ারম্যান, ''ইসলামিক সেমিনারি অফ আমেরিকা''র ডীন, টেক্সাসের "দি ইস্ট প্লেনো ইসলামিক সেন্টার"-এর রেসিডেন্ট স্কলার, "আল মাগরিব ইনস্টিটিউট"-এর প্রাক্তন ডীন ও রোডস কলেজের রিলিজিয়াস স্টাডি ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন শিক্ষক শেখ ডক্টর ইয়াসির কাধী খেলাফতের ব্যাপারে বলেছেন:- ১৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ড থেকে: - https://www.youtube.com/watch?v=eoijH_j7Fk4

"অতীত সম্বন্ধে আমাদের রঙিন ধারণা, খলিফারা ছিলেন ফেরেশতা। ইতিহাস পড়লে দেখবেন এটা সত্যি নয়। আপনি বুঝবেন যে মানুষ আসলে মানুষই। ক্ষমতায় থাকলে যা ইচ্ছা তা করার সুযোগ - বাস্তবে খেলাফত সম্বন্ধে এই যে অনুমান করে নেয়া যে তাতে শান্তি আসবে, আপনি ধরে নিচ্ছেন যে খলিফার আল্লাহ-ভীতি আছে, আসলে ........... ইতিহাস পড়ুন, ওটা ছিল ব্যতিক্রম, যেমন ওমর বিন আব্দুল আজিজ……..খোলাফায়ে রাশেদীনও ব্যতিক্রম.......... আমি আপনাদেরকে আন্দালুসিয়ান ইতিহাস বলছি। সেখানে যুদ্ধের বেশিরভাগ ছিল মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতা পাবার যুদ্ধ। আমি চ্যালেঞ্জ করছি, কেউ এটাকে ভুল প্রমাণ করতে পারবে না। বেশিরভাগ খলিফারা সাতশ’ বছর ধরে পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করেছে, সেটাই তাদের পতনের প্রধান কারণ। ভাই ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করেছে........... যান, ইতিহাস পড়ুন.... অতএব খেলাফত হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তাতে আমি সহমত নই। কেউ মনে করেন খলিফা সুপার পাওয়ার হবেন, মোটেই তা নয়। আন্দালুসিয়াতে মুসলমানদের উপর গণহত্যা হবার সময় তারা সাহায্যের জন্য উসমানিয়া খলিফার কাছে ভিক্ষা চেয়ে চিঠি লিখেছিল – ‘আমাদেরকে হাজারে হাজারে হত্যা করা হচ্ছে’ - কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। লক্ষাধিক মুসলিম বিতাড়িত হয়েছে, লক্ষাধিক খুন হয়েছে, বাচ্চাদের ধরে নিয়ে খ্রিস্টান বানানো হয়েছে, কিছুই করা যায়নি। অতএব খিলাফত থাকলে এগুলো হবে না, এই রঙিন বিশ্বাসের সাথে আমি সহমত নই। খিলাফত থাকাকালেই ক্রুসেডে আমরা আল আকসা মসজিদ হারিয়েছিলাম, এবং সেটা আবার জয় করেছিলাম যখন খিলাফত ছিল না - সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খিলাফত থেকে নয় বরং খিলাফত থেকে বের হয়ে নিজের আলাদা রাজ্য থেকে করে যুদ্ধ করেছিলেন........."।   

  1. “ইসলামী রাষ্ট্র ও শারিয়া আইন অলীক কল্পনা” - ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান "জয়তুনা ইন্সটিটিউট"-এর প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত আলেম শায়খ হামজা ইউসুফ :- https://www.youtube.com/watch?v=dUe5OsGbhM0

4. উস্তাদ মুসা আল হাফিজ - "ইসলামী রাজনীতির আদ্যোপান্ত" - (১) ৬মিনিট ২০ সেকেন্ড থেকে:- বেশীর ভাগ খলিফা জালিম ফাসেক, সুন্নাহ ও কিয়ামের ব্যাপারে দায়িত্বহীন,   (২) ৭ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে - মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রক্তপাত হয়েছে খিলাফত নিয়ে - https://www.youtube.com/watch?v=eoijH_j7Fk4

*********************************

খেলাফতের ইতিহাস ভারাক্রান্ত হয়ে আছে মুসলিমের বিরুদ্ধে মুসলিমের অসংখ্য গৃহযুদ্ধে, এর সাথে ইসলামের কোনো যোগ নেই শুধু নামের খোলস ছাড়া। এগুলো আসলে ছিল বংশ পরম্পরায় রাজাদের রাজত্ব অর্থাৎ সালতানাত - ইসলামের খোলস পরিয়ে দেয়া হয়েছে খেলাফত বলে। আমরা শুধু যুদ্ধের কথাই পড়ি, কিন্তু খেয়াল করি না সেইসব কোটি-কোটি মৃতদেহ এবং সেই সাথে কোটি-কোটি আহতের আর্তনাদ, উজাড় বসতি ও অগণিত বিধবা-এতিমের হাহাকার। প্রথম তিন শতাব্দী দিচ্ছি, এর পরের কাহিনীও মোটামুটি একই রকম মর্মান্তিক।

  সাল                    মুসলিমের বিরুদ্ধে মুসলিমের যুদ্ধ

৬৬১ - আলী (রা) নিহত - সিরিয়ায় উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা,

৬৮০ - কারবালায় হোসেন (রা) ও পরিবারের অনেকে নিহত,

৬৮৩ - হাররা যুদ্ধ (Battle of Harrah) - মদীনাতে এজিদ-সৈন্যদের "তিন দিনের স্বাধীনতা"-য় নৃশংস গণহত্যা, সাথে গণধর্ষণে এক                                 হাজারেরও বেশি যুদ্ধশিশু জন্ম , পরে মক্কায়ও গণহত্যা ও কাবা'র ক্ষতি,

৬৮৪ - মক্কায় আবদুল্লা বিন জুবায়ের-এর খলিফা হবার ঘোষণা, র্মাজ রাহাত-এর যুদ্ধ,

৬৮৭ - ৬৯২  - মক্কায় জুবায়ের, কুফায় মুখতার ও সিরিয়ায় এজিদের বংশধর আবদুল মালিক,  একসাথে তিন খেলাফতের উদ্ভব।                                       রক্তাক্ত যুদ্ধে মুখতার ও জুবায়ের নিহত, কুখ্যাত নৃশংস  হত্যকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সাহাবী সহ লক্ষ লক্ষ                                              মুসলমানকে গণহত্যা,

৬৯৫ - জাজিরা, আহয়াজ ও কারুন-এর তিনটে যুদ্ধ

৭০২  - ইরাকে আশাথ বিদ্রোহ, দায়রুল জামিরা’র যুদ্ধ

৭০২ - ৭৩৭ - মুসলিম সৈন্যদের বহু দেশ জয় ও ফ্রান্সের সীমানায় পরাজয়, মুসলিমের গৃহযুদ্ধ  শুরু,

৭৪০  -(ক) ইরাবে শিয়া বিদ্রোহ। (খ) উত্তর আফ্রিকায় বারবার বিদ্রোহ

৭৪৩ - খোরাসানে শিয়া বিদ্রোহ

৭৪৪  - বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানে খলিফা ২য় ওয়ালিদ নিহত

৭৪৫ - খোরাসানে আবার শিয়া বিদ্রোহ, খারাজী দ্বারা কুয়া ও মসুল দখল

৭৪৬ - খোরাসানে আবু মুসলিমের বিদ্রোহ

৭৪৯  - ইস্পাহান ও নিহাওয়ান্দ-এর যুদ্ধ

৭৫০  - (ক) আব্বাসীয়-দের দ্বারা রক্তাক্ত গণহত্যায় উমাইয়া খেলাফত উচ্ছেদ, (খ) যাব-এর  রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

৭৫৫  - খোরাসানে আবার বিদ্রোহ

৭৬২ - ইব্রাহিম ও নাফ্উজ জাকিয়া-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ

৭৬৭ - সিজিলমাসা-য় খারেজী শাসনের শুরু

৭৭২  - উত্তর আফ্রিকায় জানবি-র যুদ্ধ, মরক্কোতে বিদ্রোহী রুস্তমিদ খেলাফত শুরু

৭৮৮ - মগরেব-এ ইদ্রিসিদ খেলাফত শুরু

৭৯৯ - খাজার-দের বিদ্রোহ দমন

৮০০ - উত্তর আফ্রিকায় আঘলাবিদ খেলাফত শুরু

৮০৩ - ইমাম জাফর বার্মাকি-র খুন

৮১৪ - খলিফা হারুন রশীদের মৃত্যুতে দুই পুত্র আল্ আমিন ও আল্ মামুনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ,  আল্ আমিন নিহত

৮১৫ - ইবনে তুবা-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ, কয়েক বছর যুদ্ধের পর সেনাপতি হুরমুজান নিহত

৮২০ - খোরাসান-এ তাহিরিদ খেলাফত শুরু

৮২৭ - মুতাজিলা-দের সাথে অন্যান্যদের বিরোধ শুরু

৮৩৭ - জাট (ভারতের নয়) বিদ্রোহ

৮৩৮ - আজারবাইজান-এ বাবেক বিদ্রোহ দমন

৮৪৩ - তাবারিস্তান-এ মাজাইর বিদ্রোহ

৮৬১ - বিদ্রোহী অভ্যুত্থানে খলিফা মুতাওয়াক্কিল নিহত

৮৬৪ - তাবারিস্তান-এ যায়দি খেলাফত শুরু

৮৬৬ - খলিফা মুতাসিম বিতাড়িত, নূতন খলিফা মুতা’জ

৮৬৭ - সিস্তান-এ সাফারিদ খেলাফত শুরু

৮৬৮ - মিশরে তুলুনিদ খেলাফত শুরু

৮৬৯ - খলিফা মুতা’জ বিতাড়িত, নূতন খলিফা দাসী-পুত্র আল্ মুহতাদি,

৮৭০ - তুর্কী বিদ্রোহে আল্ মুহতাদি নিহত, নূতন খলিফা আল্ মুতামিদ,

৮৭৩ - রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তাহিরিদ খেলাফতের উচ্ছেদ,

৮৭৪ - দক্ষিণ ইরাকে জাঞ্জ বিদ্রোহ,

৮৯১ - কেন্দ্রীয় খেলাফত অস্বীকার করে ইয়েমেন, বাহরায়েন ও উত্তর আফ্রিকায় কারমাতিয়ান  শাসনের উদ্ভব, - "Qarmaṭ and his                            theologian brother-in-law ‘Abdān prepared southern Iraq for the coming of the Mahdi by creating a military and                        religious stronghold. Other such locations grew up in Yemen, in Eastern Arabia (Arabic Bahrayn) in 899, and in                           North Africa".

৮৯৭ - কারমাতিয়ান দ্বারা বসরায় গণহত্যা,

৯০৫ - মসুল ও জাজিরা-য় হামদানিদ খেলাফত শুরু, মিশরে তুলুনিদ খেলাফতের উচ্ছেদ,

৯০৮ - সামানিদ খেলাফত দ্বারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাফারিদ খেলাফতের অবসান॥

এর সাথে দেখে নিন "শারিয়া – অতীতের দলিল" অধ্যায়:- http://www.shariakibole.com/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%b2/

চোদ্দশ’ বছরে মুসলমানের হাতে মুসলমানের গণহত্যা ১৯৭১ সালেও শেষ হয়নি। মোটামুটি এটাই তথাকথিত খেলাফতের ইতিহাস, যে কোনো ইতিহাসের মতো এখানেও বিভিন্ন দলিলে স্থান ও সালের কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

Print