মানুষের জীবন কি ভিন্নমতের খেলার পুতুল? মাজহাবের বিরুদ্ধে মাজহাব !! - হাসান মাহমুদ – 24 Nov 2024
"আল্লাহর আইনে একই মামলায় এক আদালতে মৃত্যুদণ্ড, অন্য আদালতে বেকসুর খালাস - এমন দেখলে কেমন লাগবে আপনার? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এমন মামলা একাধিক। কে কাকে ঠকাচ্ছে তাহলে?
এ বিষয়ে শান্তিপূর্ণ অ্যাকাডেমিক আলোচনা দরকার। আমরা যেন না ভুলি, ভিন্নচিন্তার শালীন সংঘাতই অগ্রগতির চালিকাশক্তি। এই নিবন্ধের কেতাব ও দলিলগুলো এই লিংকে ২৩ নম্বরে ফেসবুক ও ইউটিউব লিংকে স্বচক্ষে দেখে নিতে পারেন:-
https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/261-2024-01-02-02-33-31
এ নিবন্ধে হানাফি কেতাব হলো ‘হেদায়া’ অনুবাদ চার্লস হ্যামিল্টন, ‘দি পেনাল ল' অফ ইসলাম’ মোহাম্মদ ইকবাল সিদ্দিকী, ‘শারিয়া দি ইসলামিক ল' ডঃ আব্দুর রহমান ডোই, ‘ড. কামালি’ হল ‘প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’, ‘শাফি কেতাব’ হল আল আজহার ইউনিভার্সিটি কর্তৃক সত্যায়িত শাফি কেতাব ‘উমদাত আল সালিক’, ‘বি-ই-আ’ হল বাংলাদেশের সম্মানিত ইসলামী স্কলার শাহ আবদুল হান্নান সহ ছয়জন আলেমের কমিটি কর্তৃক সংকলিত তিন খন্ডের "বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন", প্রকাশক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, শিয়া শারিয়া কিতাব 'ইসলামিক লজ' - আয়াতুল্লাহ সিস্তানি ইত্যাদি।
বিষয়টিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:-
(ক) একই মামলায় এক মাজহাবে মৃত্যুদণ্ড, অন্য মাজহাবে বেকসুর খালাস বা অন্য শাস্তি,
(খ) চাক্ষুষ সাক্ষী আছে কিন্তু তার সাক্ষ্য অবৈধ, তাই অপরাধীর শাস্তি হবে না,
(গ) একই মামলায় বিভিন্ন মাজহাবে বিভিন্ন রায়।
**********************************
(ক) একই মামলায় এক আইনে মৃত্যুদণ্ড, অন্য আইনে বেকসুর খালাস বা অন্য শাস্তি
- হানাফি আইনে অনুতাপ না করা পর্যন্ত নারী-মুরতাদের কারাবাস - পেনাল ল' অফ ইসলাম পৃষ্ঠা ১১১ কিন্তু শাফি’ আইনে মৃত্যুদণ্ড – শাফি আইন 8.2,
- সাক্ষী না থাকলে ব্যভিচারের মামলায় মালিকি আইনে গর্ভবতী কুমারীকে চাবুক ও বিধবাকে মৃত্যুদণ্ড কিন্তু হানাফি আইনে দুজনই বেকসুর খালাস, কারণ - উদ্ধৃতি - "জ্বেনার মত একটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রমাণের জন্য কুমারী বা স্বামীহীনা নারীর গর্ভধারণ যথেষ্ট নহে"- পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৭১ ও বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৯৯,
- রাষ্ট্রদ্রোহীতার শাস্তি হাম্বলি, শাফি’ ও মালিকি আইনে মৃত্যুদণ্ড কিন্তু হানাফি আইনে আজীবন কারাগার- ডঃ কামালি, পৃঃ ৩০,
- ইসলামী রাষ্ট্রে বিবাহিত অমুসলিম জ্বেনা করলে শাফি, মালিকি ও হাম্বলি আইনে মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু হানাফী আইনে একশ' বেত্রাঘাত – বি-ই-আ ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ৩৭০,
- ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক চুক্তিভুক্ত অমুসলিম রাষ্ট্রে গিয়ে অপরাধ করে ফিরে এলে হানাফি আইনে তার বিচার হবে না কারণ সেই দেশে শারিয়া নাই। কিন্তু মালিকি, শাাফি ও হাম্বলী আইনে তার বিচার হবে – বি-ই-আ ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ৩৬৬। অর্থাৎ খুন ধর্ষণের ক্ষেত্রে মালিকি শাাফি ও হাম্বলী আইনে তার মৃত্যুদণ্ড হবে এবং হানাফি আইনে তার বিচারই হবে না।
*************************
(খ) চাক্ষুষ সাক্ষী আছে কিন্তু তার সাক্ষ্য অবৈধ, তাই অপরাধীর শাস্তি হবে না,
এটা অত্যন্ত আশ্চর্য ব্যাপার। চোখের সামনে খুন-জখম চুরি-ডাকাতি ব্যভিচার-ধর্ষণ সহ সব অপরাধ হবে কিন্তু এত বেশি ক্ষেত্রে সেই সাক্ষীর সাক্ষ্য অবৈধ করা হয়েছে তার ব্যক্তিগত চরিত্র, পেশা বা খুঁটিনাটির ভিত্তিতে যে, - অজস্র ক্ষেত্রে অপরাধীকে শাস্তি দেয়াই অসম্ভব। সুদখোরের সাক্ষ্য অবৈধ - এ আইন প্রয়োগ হলে বাংলাদেশে কয়টা বৈধ সাক্ষী পাওয়া যাবে?
- হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৫৯, ৩৬০, ৩৬১ ৩৬৩, বি-ই-আ ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ৩১১ - সাক্ষ্য অবৈধ অন্ধের, দাসের, মুসলমানি না করলে এবং পেশাদার গায়িকার,
- দাস-দাসী, গায়িকা এবং নীচু ব্যক্তির (মেথর বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য অবৈধ- হেদায়া পৃঃ ৩৬১ ; শাফি’ই আইন o.24.3.3; পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৬; বি-ই-আ ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৬৩,
- কোন বোবা স্বচক্ষে খুন (বা অন্য অপরাধ) হতে দেখলো যেখানে আর কোনো সাক্ষী নেই। মালিকি আইনে তার সাক্ষীতে সেই খুনির মৃত্যুদণ্ড (বা অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে সেই দন্ড) হবে। কিন্তু হানাফি, শাফি’ ও হাম্বলি আইনে তার সাক্ষ্য অবৈধ, কাজেই খুনি (বা অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে সেই অপরাধী) মুক্ত হয়ে যাবে - বি-ই-আ ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ৩১১, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৩ (ফিকহুল ইসলামী ষষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা ৫৬৪, আলমগীরী তৃতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৪৬৪),
- কেউ কারো বিরুদ্ধে জ্বেনার অভিযোগ এনে আদালতে প্রমাণ করতে পারল না, সে আশী দোররার শাস্তি পেল এবং তওবা-ও করল। তারপর সে স্বচক্ষে একটা খুন (বা অন্য অপরাধ) হতে দেখল সেখানে আর কোনো সাক্ষী নেই। তার চাক্ষুষ সাক্ষ্যে মালিকি ও শাফি আইনে খুনীর মৃত্যুদণ্ড (বা অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে সেই দন্ড) হবে। কিন্তু হানাফি আইনে তার সাক্ষ্য অবৈধ, খুনী (বা অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে সেই অপরাধী) বেকসুর খালাস পাবে - মুসলিম জুরিসপ্রুডেন্স এন্ড দি কুরানিক ল' অফ ক্রাইমস - পৃষ্ঠা ১৪৬ - ড. মীর ওয়ালিউল্লাহ, সাবেক প্রিন্সিপ্যাল, ল' কলেজ, পেশোয়ার ইউনিভার্সিটি, এবং বি-ই-আ ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ৮২৫।
- ব্যভিচারের পুরুষ সাক্ষী নেই, এক বা একাধিক চাক্ষুষ নারীসাক্ষী আছে, সেই ব্যভিচারীর কোনই শাস্তি হবে না কারণ এক্ষেত্রে নারী-সাক্ষী অবৈধ - পেনাল ল অফ ইসলাম পৃষ্ঠা ৪৪, হানাফী ল হেদায়া পৃষ্ঠা ১৭৬ ও ৩৫৩, মুহিউদ্দিনের খানের অনূদিত বাংলা কোরান পৃষ্ঠা ২৩৯ ও ৯২৮,
- শাফি আইন o.8.7-এ ২০টি কর্মে এবং w.52.0-তে "প্রচন্ড মন্দকর্ম"-এর তালিকায় ৪৪২টি কর্মের অনেকগুলোতে মুসলিম মুরতাদ হয়ে যায়, মুরতাদের সাক্ষ্য অবৈধ। এছাড়া সাক্ষ্য অবৈধ কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির, মিথ্যাবাদীর, ফরজ বিধান ত্যাগকারীর ও সুদখোরের - বি-ই-আ ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৬২। এভাবে এত অসংখ্য লোকের সাক্ষ্য অবৈধ করে রাখলে বিচার কিভাবে হবে?
********************************
(গ) একই মামলায় বিভিন্ন মাজহাবে বিভিন্ন রায়।
- রাষ্ট্রদ্রোহিতার (হিরাবা) শাস্তি - হানাফি আইনে কারাবাস কিন্তু অন্যান্য আইনে নির্বাসন - প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স - ড. হাশিম কামালি, পৃষ্ঠা ৩০,
- অমুসলিমদের কাছে কোরাণ বিক্রি হানাফি আইনে বৈধ (ভিন্নমত আছে) কিন্তু শাফি' আইনে অবৈধ - Law# k.1.1.e - Ref - সুরা ওয়াক্বেয়া, আয়াত - “কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া।
- অবিবাহিতদের পরকীয়ার জন্য চাবুকের শাস্তি। সেই পরকীয়াতে কন্যা জন্মালে তাকে সেই পিতা হানাফি আইনে বিয়ে করতে পারবে না কিন্তু শাফি’ আইনে পারবে (প্রিন্সিপল্স্ অব্ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স - ডঃ হাশিম কামালি, পৃঃ ২৯।
- ঠাট্টায়, নেশার ঘোরে বা চাপের মুখে স্বামী তালাক দিলে হানাফি আইনে বৈধ কিন্তু শাফি’ আইনে অবৈধ - শারিয়াহ দি ইসলামিক ল' - ড. আবদুর রহমান ডোই, পৃষ্ঠা ১৭৪, স্বামীকে কেউ জোর করে বা ভয় দেখিয়ে স্ত্রী-তালাকে বাধ্য করলে তা হানাফি আইনে বৈধ কিন্তু মালিকি, শাফি’ ও হাম্বলি আইনে অবৈধ - বি-আ-ই ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৯, শিয়াদের শারিয়া আইনে তাৎক্ষণিক তালাক অবৈধ - ইসলামিক ল'জ - আয়াতুল্লাহ সিস্তানি,
- পরস্পরের ব্যাপারে অমুসলিম জিম্মিদের সাক্ষ্য হানাফি আইনে গ্রহণযোগ্য কিন্তু শাফি ও মালিকি আইনে নয় - হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৬৩, বি-ই-আ ২য় খণ্ড আইন নং ৫৭৬,
- স্বামীর মাথা খারাপের রোগ হলে শারিয়া কোর্টে স্ত্রী’র বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করার অধিকার হানাফি আইনে নাই কিন্তু মালিকি, শাফি’ ও হাম্বলি আইনে আছে - (বি-আ-ই ১ম খণ্ড ধারা ৩৬৫,
- ইশতিহশান নিয়ে হানাফি ও শাফিদের দ্বন্দ্ব সুবিদিত - ডঃ কামালী পৃঃ ৩৩৯,
- কোরানের নির্দেশ হতে পারে নির্দিষ্ট (Specific - খাস) কিংবা সাধারণ (General - আম)। খাস নির্দেশগুলো হানাফি আইনে সবার জন্য বাধ্যতামূলক, কিন্তু মালিকি- শাফি-হাম্বলি আইনে নয় – ড. কামালি, পৃষ্ঠা ৩১,
- হানাফি মালিকি ও হাম্বলি আইন 'ইসতিহসান'কে (EQUITY অর্থাৎ সাম্য) গ্রহণ করেছে কিন্তু ইমাম শাফি, জুহরী এবং শিয়া আইন এটাতে প্রচন্ড আপত্তি তুলে সম্পূর্ণ বর্জন করেছে (SERIOUS OBJECTION) ড. কামালি পৃষ্ঠা ৩২৪, ৩৪৩,
- “ইমাম শাফি’ ইমাম মালিকের মতামতের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে ভিন্নমত পোষণ করিতেন” - ইমাম শাফি’র বিখ্যাত কেতাব ‘রিসালা’ পৃঃ ১৩।
এমন আরো আছে। আরেকটা আশ্চর্য আইন হলো - "হদ্দ- এর আওতাভুক্ত বিষয় যদি আল্লাহর অধিকারের সহিত সংশ্লিষ্ট হয় তবে সেই ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করিলে সাক্ষ্য প্রদানও করিতে পারে অথবা গোপনও করিতে পারে" - ধারা ৫৭৫ বি-ই-আ দ্বিতীয় খন্ড। ব্যাখ্যায় দুটি হাদিসের ভিত্তিতে বলা আছে - "যেমন চারিজন লোক দুইজন নারী-পুরুষকে জ্বেনায় লিপ্ত দেখিল। এই ক্ষেত্রে তাহারা ইচ্ছা করিলে ঘটনাটি গোপন রাখিতে পারে"।
দুনিয়ায় আর কোন আইনে ক্রাইম গোপন রাখার অনুমতি আছে কিনা আমি জানিনা। বরং কোরানের আদেশ সাক্ষ্য গোপন না করার - বাকারা ২৮৩:- "তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না এবং যে কেউ তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী।"
সবাইকে এসব নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি কারণ মানুষের জীবন অত্যন্ত পবিত্র, মানুষের জীবন ভিন্নমতের খেলার পুতুল নয়।
**********************************
Books download:-
**- Hanafi Law book ‘Hedaya’ - https://archive.org/details/hedayaorguide029357mbp
**- Shafi’ law book ‘Umdat Al Salik’ :- https://archive.org/details/relianceofthetravellertheclassicmanualofislamicsacredlaw
**- বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন - https://www.ebanglalibrary.com/books/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%9C/
**- Shariah The Islamic Law - https://archive.org/details/shariah-the-islamic-law
**- The Penal Law of Islam- https://www.slideshare.net/ccccccccdddddd/the-penal-law-of-islampdf