কবিতায় “ইসলামের অপমান”! হাসান মাহমুদ
আমি প্রধানত: ইসলাম নিয়ে লিখছি, অন্যেরা তাঁদের ধর্মের উপরে লিখতে পারেন। সাহিত্যে ইসলামকে অপমান করা হয়েছে (ক) ১২০০ বছর আগে ইটালিয়ান কবি দান্তে'র "ডিভাইন কমেডি"-তে। ওটা সুদীর্ঘ মহাকাব্য - আমি ছোট ছোট শের শায়েরীর কথা বলছি, (খ) ১৯২৩ সালে নবীজির ওপরে ব্যাঙ্গাত্মক 'রঙ্গিলা রসূল' এবং (গ) ১৯৮৮ সালে সালমান রুশদির "দি স্যাটানিক ভার্সেস" বইতে। আরো থাকতে পারে। কিন্তু কবিতার ব্যাপারটা আলাদা কারণ কবিরা নানারকম কাব্যিক অস্পষ্টতা ব্যবহার করেন। শব্দটা আছে কোরানের অন্যতম উপেক্ষিত আয়াতে - সূরা ইমরান ৭। যেমন অনুপ জালোটা’র বিখ্যাত গজল:-
"পিয়া করতে হ্যাঁয় ছুপ কর শেখ ভি রোজানা রোজানা - চলে আ’তে হ্যাঁয় আধি রাতকো ম্যায়খানা রোজানা"।
আক্ষরিক অনুবাদ:- "মাওলানাও প্রতিদিন চুপি চুপি মদ খান, তিনি প্রতি মাঝরাতে চলে আসেন শুঁড়িখানায় (মদের দোকানে)।
কাব্যমানস পরিশীলিত না হলে কোন মুমিন এটা আক্ষরিক অর্থে বুঝবে এবং ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে এর গীতিকার সুরকার গায়ককে খুন করতে পারে। আসলে কিন্তু গীতিকার বলছেন মওলানা মাঝরাতে সবার অলক্ষ্যে মসজিদে আসেন এবং ইবাদতে মগ্ন হন। কবিদের এমন এক্সপ্রেশন অনেক, যেমন নজরুলের- "খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে"। এগুলোকে প্রতীকী বা মায়াসাহিত্য বলা যাবে কি? এমন কবিতা দিয়ে ওমর খৈয়াম, রুমী, মির্জা গালিব, মীর তকী মীর, হাফিজ সিরাজী’র মত অনেকে এখনো বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছেন। কবিতায় বোঝা যায় তাঁরা আস্তিক ছিলেন, তাহলে তাঁরা কি বলতে চেয়েছিলেন এই রহস্যময় পংক্তিগুলোতে?
"মহাকবি হাফিজ, আজও মহাবিশ্বে প্রভাব ফেলে তাঁর সৃষ্টিকর্ম" - প্রথম আলো ০২ নভেম্বর ২০২৩। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনূদিত "হাফিজের কবিতা" বই থেকে কিছু কবিতার দু-চার লাইন দেখাচ্ছি:-
1-. "মদ পুজো" - থেকে:-
সুরা পান করা অতি সৎ কাজ, এই কথা মনে রেখো হে হাফিজ - সংকল্পের মুখটা ঘোরাও, যেদিকে রয়েছে ওই ভালো চিজ,
2-. "হে দিশারী" – থেকে:-
এইখানে এসো এ পানশালায়, উপাসনালয়ে যেও নাকো মোটে - কুকর্মে যারা হাত কালো করে তারাই ওসব জায়গায় জোটে,
যেহেতু দৈব অনুকম্পায় কেবলমাত্র পাপীদেরই হক - আমরাই যাব স্বর্গে - যা ভাগ ! ঈশ্বরজ্ঞানী ধর্মযাজক !!
3-. "শরাবখানায়" – থেকে :-
আমার পাপের চেয়ে ঢের বড় খোদার সে ক্ষমাসুন্দর রূপ - কেন ফাঁস করো সে গুপ্তকথা? মুখে ছিপি আঁটো! একদম চুপ!!
4-. "সুবাতাস" - থেকে:-
যদি হাফিজের একটি গজল নিয়ে শুকতারা আসমানে মাতে - যদি নাচে যীশুখ্রীষ্ট সে সুরে আশ্চর্যের কি আছে তাতে?
(অন্য ধর্মের একটাই দেখালাম, এমন অনেক আছে)
5-."নাম আছে তাই"- থেকে:-
পূজারীর কাছে কখনো করোনা আমাদের নামে নিন্দেমন্দ - কেননা তারাও আমাদেরই মত সন্ধান করে পরমানন্দ !
হাফিজ, থেকো না বসে তিলার্ধ মদ ও বধূর সংগবিহীন - চেয়ে দেখো ফোটে জুঁই ও গোলাপ এসে গেছে রোজা ভাঙ্গবার দিন,
6-. "গভীর নিশীথে' - থেকে:-
পেয়ালায় তিনি যাই ঢেলে দেন গিলে ফেলি এক গণ্ডূষে সব, - হোক গে’ তা পরব্রহ্ম কিংবা - দ্রাক্ষাফলের মজানো আসব,
7-. "নাম আছে তাই" - থেকে:-
গলায় ফুলের মালা, হাতে মদ প্রেয়সী এসেছে আমার সকাশ - এমন মধুর দিনে মনে হয় রাজাও আমার কাছে ক্রীতদাস,
8-. "ভেতরে করুণা" - থেকে:-
কাল রাতে পানশালার দুয়োরে গিয়েছি যখন চোখে ঘুমঘোর - মদে ছিল ভেজা নামাজে বসার - আসন এবং গায়ের কাপড়,
9-. "প্রেম সহজ না" - থেকে:
বুড়ো মাঝি বলে নামাজ পড়ার আসনে ছুটুক মদের ফেয়ারা, সদগুরু নয় অজ্ঞ সে জানে সঠিক লক্ষ্যে চলবার ধারা,
10-. "নাম আছে তাই"- থেকে:-
আমি যে মাতাল ছিটগ্রস্ত করে ছোঁক ছোঁক বামাচারী চোখ, - মানছি, কিন্তু দেখাও শহরে আমার মতন নয় কোন লোক?
11-. "ঢের ভালো হতো" - থেকে:-
"ঢের ভালো হতো নামাবলীটলি বন্ধক দিয়ে কিনলে শরাব, - এসব অর্থহীন হাবিজাবি শরাবে ডোবালে হত কিছু লাভ।
ভেবে দেখি আজ সব দিক থেকে ব্যর্থ জীবন ঘুরে দোরে দোরে, ভালো হতো পানশালার কোনায় মদ খেয়ে যদি থাকতাম পড়ে,
12-. "মাতাল" - থেকে:-
হাফিজ তোমার বুকের মধ্যে যে কোরান আছে তুলে নিয়ে হাতে, - বলছি সত্য : তোমার যে গান - তার জুড়ি আর নেই দুনিয়াতে,
13-. “স্বর্গে যা নেই” - থেকে:-
গানে আর মদে জমা ও আড্ডা, ভবরহস্য হাতড়ে কি লাভ? - বুদ্ধির পথে চললে কখনো পাবে না কেউ এ ধাঁধার জবাব,
14-. "মাতাল" – থেকে:-
মাতালকে মিছে দিও নাকো গাল, মুখ সামলে হে শেখ! হুঁশিয়ার!! - কারণ তাহলে হবে অধর্ম - লঙ্ঘিত হবে বিধান খোদার,
15-. "বাউল হরিণ" - থেকে:-
বলো, আর্তের কে ত্রাণকর্তা? কে দীনবন্ধু? যদি মিতাহারী - খিজির দেখান পথ তো সহজে এই দূরত্ব লংঘাতে পারি।
মনে করো যাকারিয়ার উক্তি আল্লার কাছে তার প্রার্থনা, - তুমিই তো প্রতিপালক সবার - নিঃসন্তান আমাকে রেখো না,
16-. "স্বাগতম" – থেকে:-
হে খোদা! শুরুর সে শুভদিনটি কাফেলাকে যেন নিরাপদে রাখে, - দুশমন যেন ধরা পড়ে জালে বন্ধু নিত্য যেন পাশে থাকে
**********************************
অন্যান্য সূত্র থেকে:-
17-. দুরকম সূরা আছে এ জগতে, একটি বোতলে একটি কোরানে, - দুটোতেই করে বদ্ধ মাতাল - দুটোতেই তৃষা মেটেনা পরানে,(উচ্চারণ আলাদা কিন্তু বানান এক),
18-. মোল্লাপুরুত মাতালের নামে সদাই করেন নিন্দেমন্দ - কেন হে? মাতাল তো তাঁদেরই মতো সন্ধান করে পরমানন্দ!
19 -. আঙ্গুর ফলটা কি স্বাস্থ্যকর! রস খাও তার, রস খাও আরো, - জ্ঞানেরও স্বাস্থ্য ভালো হবে ভায়া যদি ক'বছর রেখে খেতে পারো(আঙ্গুরকে কয়েক বছর ফার্মেন্ট করে ওয়াইন বানানো হয়),
20-.মোল্লারা বলে নাস্তিক আমি, নাস্তিক বলে মোল্লা আমি যে - থোড়াই কেয়ার! আমার ভেতরে - কে বিরাজমান আমি জানি নিজে!!
21-. লক্ষ টাকায় গয়া কাশী গিয়ে কর তুই পূজা মহা আনন্দে, - আমি দু' টাকার দু'কল্কি মেরে পৌঁছেই যাবো পরমানন্দে.....
&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&
এবার কবিদের তির্যক অভিব্যক্তি নিয়ে, ইন্টারনেটে পাওয়া। ১০ লাইনের একটা কবিতা দুলাইন করে লিখেছিলেন ভারতবর্ষের পাঁচজন বিখ্যাত কবি, ১৭৯৭ সালে জন্ম কবি মির্জা গালিব থেকে ১৯৩৬ সালে জন্ম কবি সাকি ফারুকী। গঠন দেখে আমার মনে হয়েছে সত্যি হতেও পারে।
1-. গালিব মসজিদে মদ খাওয়া শুরু করলে মুসল্লীরা বাধা দিয়ে বলল, মসজিদ আল্লাহর ঘর, মদ খাবার জায়গা নয়। গালিব তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন - 'শরাব পিনে দে মসজিদ মে ব্যায়ঠ কর। ইয়া ও জাগা বাতা যাঁহা খুদা নেহি।' অর্থাৎ আমাকে মসজিদে বসেই মদ খেতে দাও, নতুবা এমন জায়গা বলো যেখানে খোদা নেই।
2-. গালিব মারা যাবার বহুবছর পর জবাব দিলেন মহাকবি ইকবাল (1877) - 'ইয়া গালিব, মসজিদ খুদা কা ঘর হ্যায় - পিনে কি জাগা নেহি। তু কাফির কে দিলমে যা - ওঁহা খুদা নেহি।' অর্থাৎ "হে গালিব, মসজিদ খোদার ঘর, মদ খাবার জায়গা নয়। তুমি কাফিরের হৃদয়ে যাও, ওখানে খোদা নেই"।
3-. এরপর লিখলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি আহমদ ফারাজ – (1931) - 'কাফির কে দিল সে আয়া হুঁ দেখ কর - খুদা মওজুদ হ্যায় ওঁহা - উসসে পাতা নেহি।' অর্থাৎ" কাফেরের হৃদয়ে দেখে এসেছি - খোদা ওখানেও আছেন কিন্তু সে সেটা জানেনা"।
4-. এরপর লিখলেন ভারতের কবি ওয়াসি শাহ (1976) - -'খুদা তো মওজুদ দুনিয়া মে হর জাগা, - তু জান্নাত মে যা, ওঁহা পিনে সে মানা নেহি।' অর্থাৎ কবি এখানে জান্নাতের মদ 'শরাবান তহুরা'র কথা বলেছেন যেটা জান্নাতিরা ইচ্ছামত খাবে কিন্তু মাতাল হবেনা।
5-. কবি সাকি ফারুকী (1936) লিখলেন- 'পীতা হুঁ সাকি গাম-এ-দুনিয়া ভুলানে কে লিয়ে, - জান্নাত মে কৌন সা গাম হ্যায়, ইস লিয়ে ওঁহা মজা নেহি"। অর্থাৎ তিনি মদ্যপান করেন "গম" অর্থাৎ দুঃখ ভুলে থাকার জন্য। জান্নাতে তো কোনো দুঃখই নেই তাই সেখানে মদ্যপানের তৃপ্তিও নেই।
&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&