1 of 3
কথা উঠেছে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে গিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করা নিয়ে । কথাটা ধর্মীয় রাজনীতি বলা হলেও বিষয়টা ইসলামের নামে রাজনীতি, যাকে অনেকে মৌদুদিবাদও বলেন। সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও সংবিধানে বিসমিল্লাহ্। আমরা জানি বাহাত্তরে অবৈধ হবার পরেও পঁচাত্তরের পথ ধরে ধর্মীয় রাজনীতি আবার ফিরে এসেছে। সেই খিড়কি দরজা বন্ধ না করে আমরা বাহাত্তরের প্রধান ফটক বন্ধ করব কোন ভরসায়? মৌদুদিবাদের কৌশল বিশ্লেষণ করে পাল্টা কৌশল উদ্ভাবন না করে রাজনৈতিক ঘাঁটাঘাঁটি করলে লাভ হবে না। তার প্রাথমিক কৌশল রাজনীতি-নিরপেক্ষ। সরকারে সে না থাকলেও, নির্বাচনে না জিতলেও এমনকি সাংবিধানিকভাবে সে অবৈধ হলেও তার অসংখ্য মাদ্রাসা থেকে গত কয়েক দশকে অসংখ্য সমর্থক বেরিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামরিক বাহিনীতে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও ষ্ট্রীটপাওয়ারে তাকে শক্তিশালী করেছে, ভবিষ্যতে আরও করবে। সাথে আছে অজস্র পেট্রোডলারে গড়া ইসলামি লেবেল লাগানো মৌদুদিবাদী সংগঠনগুলো, অজস্র বইপত্র ও দেশে কামানো অঢেল টাকার শক্তি। আরো সাথে আছে মধ্যপ্রাচ্য-প্রবাসী বাংলাদেশীরা (৩০ লক্ষ?) যাঁরা প্রায় সবাই মৌদুদিবাদে বিশ্বাসী। এঁরা আর্থিক প্রতিপত্তিতে এবং আরও বহু হাজার মাদ্রাসা গড়ে নিজেদের অঞ্চলকে সেই তত্ত্বে প্রভাবিত করেছেন। এসব শক্তিতে বহু বছর ধরে মৌদুদিবাদই আসল ইসলাম হিসেবে জাতির চোখের সামনে বড় করে ধরা আছে। কিন্তু তার মুখোশ খুলে ইসলামের শান্তিময় ব্যাখ্যা প্রচারের কোন সংগঠন নেই বা থাকলেও দুর্বল।
তার কৌশলের ওপর বিস্তারিত লেখার সুযোগ এখানে নেই, কিন্তু বলা দরকার সে বড়ই সুদক্ষ খেলোয়াড়। আপাততঃ সে একটু কাদায় পড়লেও তাকে ছোট করে দেখাটা আমাদের জন্য হবে মারাত্মক আত্মঘাতী। অন্যের ব্যর্থতার ফসল ঘরে তুলতে এবং অন্যের দ্বারা নিজের মতলব উদ্ধারে সে ওস্তাদ। দেশে বিএনপির ঘাড়ে চড়ে স্বার্থ উদ্ধার ছাড়াও পাকিস্তান শারিয়া-রাষ্ট্র হওয়া, আমাদের সংবিধানে ‘‘বিসমিল্লাহ’’ বা ‘‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’’ যোগ করা এসব গণবিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্তও নির্বাচিত সাংসদরা আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক করে নেননি, নিয়েছে সামরিক স্বৈরশাসকরা। তুর্কিস্থানে কামাল পাশা, বাহাত্তরে শেখ মুজিব ও মিসরের নাসের সাংবিধানিকভাবে তাকে নিষিদ্ধ করার পরেও ওই প্রতিটি দেশে সে ফিরে এসেছে প্রবলতর শক্তিতে। মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ অংশ গ্রাস করার পর এখন সে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে পুরোটাই এবং ইউরোপের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করছে। পশ্চিমা সিষ্টেমের সাহায্যে সে কিছু নাদান পশ্চিমাদের-ই সহায়তায় ক্রমাগত পশ্চিমা সিষ্টেম ভাঙ্গছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক অনেক কারণেই আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না, প্রতিপক্ষ একদিন ক্ষমতায় আসবেই। এসেই তারা তড়িৎগতিতে আবার মৌদুদিবাদকে সাংবিধানিক বৈধতা দেবে। এটা ঠিক, জাতি একাত্তরের অভিজ্ঞতা ও মরমীয়া ইসলামের উপলব্ধি দিয়ে মৌদুদিবাদকে এখনো ঠেকিয়ে চলেছে। এটাও ঠিক, আমাদের সাংস্কৃতিক শক্তি, নুতন প্রজন্মের প্রবল আধুনিকায়ন ও উদীয়মান নারীশক্তিও তার প্রবল প্রতিপক্ষ। কিন্তু প্রধান প্রবেশদ্বার নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন কৌশলে খিড়কি দরজা ব্যবহারে সে অভিজ্ঞ ও দক্ষ। পাকিস্তানের মতো তার ধূর্ত কৌশলে ধীরে ধীরে ইসলামের শান্তিময় ব্যাখ্যায় ঘুণ ধরিয়ে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
তার মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য তাকে সাংবিধানিকভাবে অবৈধ করাটা শর্ট টার্ম টাস্ক হতে পারে, লং টার্ম নয়। তার সমস্ত প্রতারণা ও হিংস্রতা যে উৎস থেকে উঠে তা হল তার অপদর্শন। সেই অপদর্শনের দলিল সম্বন্ধে গণসচেতনতাই তার ফিরে আসার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারে। দরকার শুধু ইসলাম ও মৌদুদিবাদের দলিলগুলো থেকে জাতিকে দেখানো কিভাবে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কোরান, রসুল, ন্যায়বিচার ও নারী অধিকারের সাথে, কোরান-রসুল ও ইসলামকে সে যতটা অপমান করেছে আর কেউ তা করেনি। যেমন, তার আইনে আছে তওবা করলে গণহত্যা, গণধর্ষণ, সম্পত্তি লুন্ঠনকারীদের শাস্তি হবে না.... বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খন্ড ধারা ১৩। অর্থাৎ বাংলাদেশ শারিয়া-রাষ্ট্র হলে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হবে না কারণ তারা ‘‘তওবা’’ করবে। আরেকটা উদাহরণ-শারিয়া আইন মোতাবেক শারিয়া-রাষ্ট্রে খুনজখম, চুরি, ডাকাতি, পরকীয়া ইত্যাদি অপরাধে সবার শাস্তি হবে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের শাস্তি হবে না... বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খন্ড ধারা ৯১৪ গ। খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, মদ্যপান, পরকীয়া মামলায় নারীসাক্ষী অবৈধ - বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড ধারা ৫৭৬।
এ দলিলগুলো মৌদুদিবাদের মৃত্যুবাণ। কারণ এই শারিয়া কেতাব তাদেরই লেখা এবং বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশনের প্রকাশিত। এরকম অজস্র দলিল আছে যা দেখালে যাঁরা অন্ধবিশ্বাসে তার ইসলাম-বিরোধী অপতত্ত্বের খপ্পরে পড়েছিলেন তাঁদের অন্ততঃ বড় একটা অংশ শুধু সরেই আসবেন না বরং তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তেমন অনেককে আমি চিনি। এগুলো স্কুল-কলেজের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম ইসলামি জ্ঞানের শক্তিতে তাকে উচ্ছেদ করতে পারে। ক’মাস আগে দেয়া আদালতের এ পরামর্শ সরকারের গ্রহণ করা উচিত। তাতারস্থানে ইসলামি নেতৃত্ব জনগণকে মৌদুদিবাদের ভয়াবহতা শিখিয়েছেন, জনগণই মৌদুদিবাদের বিরুদ্ধে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই একই বীজ আমাদের ইসলাম প্রচারকেরাও আমাদের আকাশে বাতাসে মাটিতে পানিতে দিয়ে গেছেন, বীজটাতে দলিলের মাধ্যমে গণসচেতনতার পানি ঢালা দরকার।
দু’টো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের কোনই ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার - (১) ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার কারণ কি? মুক্তিযুদ্ধে এক জামাতের হিংস্র কর্মকাণ্ডের কারণে বাকী সবার ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ হবার যুক্তি ধোপে টেকে কি? (২) জামাতি ও জামাত-সমর্থক দৈনিকগুলো তারস্বরে যে যুক্তি দেখাচ্ছে, বহু দেশে এমনকি ভারত-ইউরোপ-আমেরিকাতে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল আছে। বাংলাদেশে কেন নিষিদ্ধ হবে, এ দাবী ভিত্তিহীন কেন? চলবে...
2 of 3
পরের প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধে এক জামাতের হিংস্রতার জন্য বাকী সব ধর্মীয় ও ইসলামি রাজনীতি কেন নিষিদ্ধ হতে হবে।
বিষয়টা আসলে একাত্তরও নয়, জামাত বা মুক্তিযুদ্ধও নয় এবং ইসলামও নয়। বিষয়টা হল ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করাকে নিষিদ্ধ করা। রাষ্ট্রক্ষমতা হলো চুড়ান্ত ক্ষমতা। বহুজাতিক বহুমাত্রিক বহুধারণার বিশ্বে সেই চুড়ান্ত ক্ষমতা কোনো বিশেষ ধর্মের একমাত্রিক ধ্বজাধারীদের হাতে তুলে দেয়া যায় না। এই একমাত্রিকতার কারণেই ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলো হাজার হাজার বছর সময় পাবার পরেও তাদের বৈধতা প্রমাণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের স্রষ্টাকে তুষ্ট করতে যত সর্বগ্রাসীভাবে ও যত উল্লাসের সাথে মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে ততটা আর কোনো কারণে করেনি - প্যাষ্কেল। অতিতে হিন্দুরাষ্ট্রে নরবলি-সতিদাহ সহ নারী ও অছ্যু rদের ওপরে এবং খ্রীষ্টান রাষ্ট্রে ডাইনি-পোড়ানো, দার্শনিক বিজ্ঞানীদের অত্যাচার-হত্যা ছাড়াও ইনকুইজিশন অর্থা r ভিন্নমতের ওপরে ভয়াবহ গণহত্যা ও অত্যাচার হয়েছে। সেজন্যই জনতা ভৈরব গর্জনে ধর্মীয় রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা বানিয়েছিল। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুসলিম-খেলাফতও বিশ-বাইশটি ‘‘আমিরুল মু’মেনীন’’ বংশের গৃহযুদ্ধ, বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ, গুপ্তহত্যা, সুফি ও দার্শনিক বিজ্ঞানীদের ওপরে অত্যাচার-হত্যা সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের রক্তে রক্তাক্ত। ইসলাম-ব্যবসায়ীরা শেয়াল কুমিরকে তার বাচ্চা দেখানোর মতো ওই ব্যতিক্রমগুলোকেই বারবার জাতির সামনে তুলে ধরেন।
ধর্মীয় রাষ্ট্র বলতে বিশ্বে এখন শুধু কিছু শারিয়া-রাষ্ট্র আছে এবং তারাও মানবাধিকারের দিক দিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেখানে মানবাধিকার লংঘনকে ক্রাইম হিসেবেই দেখে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করে সেখানে ধর্মীয় রাষ্ট্র সেটাকে ধর্মের নামে বৈধ করে। হিন্দুরাষ্ট্রে মনু’র, খ্রীষ্টান রাষ্ট্রের ক্যানন ল’ এবং শারিয়া-রাষ্ট্রে শারিয়া আইনগুলো তার প্রমাণ। এর সাথে গত কয়েক দশকে যোগ হয়েছে ‘‘শারিয়া-পুলিশ’’ যার অত্যাচারে বিশেষ করে নারীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এদের কাজ হলো পিস্তল হাতে ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ানো কোন নারী একটু টাইট পোষাক পড়লো, কার একটু চুল বেরিয়ে আছে হিজাব থেকে, কে কার সাথে কোথায় যাচ্ছে, কে নামাজ পড়ছে না, কে রোজা রাখছে না ইত্যাদি। এমনিতেই পিস্তল হাতে পড়লে মানুষের অহংবোধ বেড়ে যায় তার ওপরে ধর্মের মালিকানা পেলে তো কথাই নেই। দেশে দেশে এদের অত্যাচারের কাহিনী ভয়ংকর, একটা বলছি। ক’বছর আগে সৌদী আরবে মেয়েদের স্কুলে ব্যাপক আগুন লাগলে মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে আসে, তাতে তাদের মাথা থেকে স্কার্ফ পড়ে যায়। এই কারণে শারিয়া-পুলিশ তাদেরকে পেটাতে পেটাতে আবার জ্বলন্ত স্কুলে ঢুকিয়ে দেয়, যারা বাইরে থেকে সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল তাদেরকেও পিটিয়ে সরিয়ে দেয়। ফলে অনেক মেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ধর্মীয় রাষ্ট্রে ধর্মীয় উগ্রতা এমন উদগ্রই হয়ে থাকে।
যেহেতু বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি বলতে ইসলামের নামে রাজনীতি বোঝায়, এবং যেহেতু সেই ক্ষেত্রে জামাতের নামই আসে প্রথম তাই জামাতের দর্শন সম্বন্ধে জাতির জানা প্রয়োজন। যাঁর অপদর্শনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জামাত গঠিত হয়েছে (ইন্ট্রোডিউসিং জামাতে ইসলামি বাংলাদেশ পৃষ্ঠা ৫) সেই মওলানা মৌদুদি শান্তিময় ধর্ম ইসলামকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে পরিণত করেছেন, হেদায়েতের কেতাব কোরাণকে আইনের বই করেছেন, রসুলকে প্রেসিডেÏট আর সেনাপতি করেছেন এবং আল্লাহ-রসুল-কোরাণের নামে সন্ত্রাসকে বৈধ করেছেন। প্রচুর উদাহরণ আছে, একটা দিচ্ছি তাঁর তাফহিমুল কুরাণ গ্রন্থে সুরা নিসা’র আয়াত ২৪-এর ব্যাখ্যার সারাংশঃ-
‘‘যুদ্ধবন্দিনীরা বৈধ কেননা তাদের বিবাহ বাতিল হইয়া যায়। সরকার কোনো সৈন্যকে যেই বন্দীনি দিবে শুধুমাত্র তাহার সাথেই যৌন সম্পর্ক করিতে পারিবে সে নারীর ধর্ম যাহাই হোক না কেন। দাসীর সংখ্যার কোনো নিির্দষ্ট সীমা নাই, বাচ্চা হইলে সেই বন্দিনীকে বিক্রয় করা যাইবে না’’ - www.islamicstudies.info/tafheem.php?sura=4&verse=23&to=25|
অর্থা r বাচ্চা না হলে বা হবার আগে পর্য্যন্ত তাকে বিক্রী করা যাবে। এগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এগুলোই মৌদুদিবাদ। যুদ্ধবন্দিনীদের বিবাহ বাতিল হইয়া যায় এটা শারিয়া আইনেও আছে- উমদাত আল্ সালিক আইন নং o.9.13. প্রশ্ন হলো ওরা ওদের ধর্মীয় বিধানে বিয়ে করেছে, সেই বিয়ে বাতিল করার তুমি কে? মতলবটা পরিষ্কার ধরা আছে তথাকথিত ‘‘সহি’’ হাদিসে, সুনান আবু দাউদ হাদিস নং ২১৫০ মুসলিম সৈনেরা বন্দিনীদেরকে ধর্ষণ করত, কখনো কখনো তাদের স্বামীদের সামনেই এবং ‘‘কোন কোন সৈন্য তাহা পছন্দ করিত না’’। বুখারি ৩য় খণ্ড ৭১৮, মুসলিম ৩৪৩২ ইত্যাদিতেও বন্দিনী-ধর্ষণের কথা আছে। এসব ইসলামের ওপরে কলংক ছাড়া আর কিছু নয়, আমাদের মঙ্গলের জন্যই এসব বাদ দিয়ে শুধু ভালোগুলো রাখতে হবে। যাঁরা এগুলো জেনে বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ হবেন তাঁদের প্রতি আবেদন জানাই এগুলো আমাদেরই কেতাব, এগুলোর মুখোমুখি হতেই হবে আমাদের। ইসলামি রাজনীতির ভিত্তিই হল ওই ধরণের হাদিস আর শারিয়া আইনগুলো, তাকে সমর্থন করার আগে ওগুলো পড়ে দেখুন। এ ধরণের অপতত্ত্বকে দেশ পরিচালনার ভার দেয়া যায় না।
জাতিকে বুঝতে হবে জামাত ঠিক কি কারণে আমাদের ওপরে গণহত্যা-গণধর্ষণে পাকিস্তানকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে। কারণটা হলো ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে যে কোনো বাধাকে যে কোনো উপায়ে সরিয়ে দেয়াটা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক, এটা তাদের ইবাদতের মধ্যে পড়ে। মিথ্যা বলাও তার মধ্যে পড়ে, তাদের পরিভাষায় এর নাম ‘‘তা’ক্বিয়া’’। তাদের শারিয়া আইনেও আছেঃ- ‘‘যদি উদ্দেশ্যটি বাধ্যতামূলক হয় তবে সেই উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা বাধ্যতামূলক’’ - শাফি’ আইন নং r.৮.২ । ইসলামী রাজনীতির উদ্দেশ্য পরিষ্কার, শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই তারা যে দিনরাত মিথ্যা কথা বলে যা দেখে জাতি অভ্যস্ত, তার শেকড়ই ওখানে। অথচ আল্ কোরাণে সুষ্পষ্ট নির্দেশ আছে - ‘‘মিথ্যা হইতে দুরে থাক’’- সুরা হজ্জ্ব আয়াত ৩০।
এক ধর্মের রাষ্ট্র অন্য ধর্মের রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয় ও উ rসাহিত করে। পাকিস্তান শারিয়া-রাষ্ট্র ভারতে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী মৌলবাদকে ও ইসরাইলে ঈহুদী-রাষ্ট্রকে (যদিও সাংবিধানিকভাবে সেটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বৈধতা ও উ rসাহ দেয়। আমরা বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ইসলামি রাষ্ট্র বানাব অথচ ওদের দেশে করতে দেব না এ দাবী অন্যায় ও অবৈধ। তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব আছে বলেই তার প্রতিপক্ষ হিসেবে ইউরোপ অ্যামেরিকা অষ্ট্রেলিয়াতে খ্রীষ্টান-রাষ্ট্রতত্ত্বের জনপ্রিয়তা বাড়বার সম্ভাবনা রয়েছে। তেমন হলে এসব দেশে কোটি কোটি মুসলমানের ওপরে কি কেয়ামত নেমে আসবে তা বুঝতে আইনষ্টাইন হতে হয় না। ধর্মীয় রাজনীতিকে অবৈধ না করলে অসংখ্য ধর্মের অসংখ্য রাষ্ট্রে বিভক্ত পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে মানুষে মানুষে হানাহানিকে অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে বৈধ করা হয়। এসব কারণে এবং কোরাণ-রসুল মোতাবেক ইসলাম প্রচারকেরা ও অসংখ্য মুসলমান ইসলামে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি মেশানোর তীব্র বিরোধীতা করেছেন ও করেন।
এর পরে আমরা দেখব অন্যান্য কিছু দেশে ধর্মীয় রাজনীতি বৈধ হলেও আমাদের দেশে কেন অবৈধ হওয়া দরকার। কথাটা আপাততঃ স্ববিরোধী মনে হলেও আসলে তা নয়, এর পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ ও যুক্তি আছে।
চলবে... ১৮ই আগষ্ট ৪০ মুক্তিসন (২০১০)
3 of 3
এবারে আমরা দেখব অ্যামেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ইউরোপের কিছু দেশ ও ভারতসহ বিশ্বে অনেক দেশে ধর্মীয় রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও আমাদের মতো মুসলিম-প্রধান দেশে কেন তা নিষিদ্ধ করা দরকার। কথাটা আপাতঃদৃষ্টিতে যতোটা স্ববিরোধী মনে হয় আসলে ততোটাই সহজ। দুনিয়ায় বহু দেশে খ্রীষ্টান ও ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক দল আছে। ওরাও এদের অর্থা r ইসলাম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে চায়। এদের মতো ইহুদীরাও দাবী করে ওদের ধর্মবিশ্বাস আসলে ‘‘সামগ্রিক জীবনবিধান’’, হিন্দুদেরও অন্য কিছু মনে করার কারণ নেই। দু’পক্ষের অমিলও আছে। যেমন, ওদের আইনগুলো (হিন্দুদের মনু-আইন কিংবা ইহুদীদের হালাখা আইন) এদের শারিয়া আইনের মতো অতটা বিধিবদ্ধ (কোডিফায়েড) নয়, ধর্মীয় আইন না মানলে ‘‘মুরতাদ’’ হুংকারে হত্যার উষ্কানী ওদের নেই কিন্তু এদের আছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নিয়ন্ত্রণ সহ বিশ্বময় সংখ্যাহীন সংগঠনের রাজনৈতিক চাপ ওদের নেই কিন্তু এদের আছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো দেশে ওদের আইন চালু নেই কিন্তু এদের আছে (পাকিস্তান, ইরাণ, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্থান ইত্যাদি), ছাপ্পানোটা মুসলিম-প্রধান দেশের কেন্দ্রীয় সংগঠন ও-আই-সি’র আন্তর্জাতিক চাপের শক্তি ওদের নেই কিন্তু এদের আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের প্রধান বিষয় হলো ক্ষমতায় গিয়ে কে কি করবে কারণ ওর ওপরেই জনগণের ভালোমন্দ নির্ভর করে। বাস্তবে আমরা দেখি পশ্চিমা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবলভাবে রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণের পক্ষপাতী, রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ তারা মোটেই পছন্দ করে না। সেজন্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো কখনো তেমন ভোট পায় না। এমনকি ক্যানাডায় এক ধর্মনিরপেক্ষ দল যখন নির্বাচনে ঘোষণা করেছিল তারা সরকার গঠন করলে সব ধর্মের স্কুলে সরকারী অনুদান দেবে তখন বিশ্বাসী ইহুদী-খ্রষ্টানদের বড় অংশ তার প্রবল বিরোধীতা করেছিল। যদিও বহু আগে থেকে ক্যাথলিক স্কুলে সরকারী অনুদান যাওয়াটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে (এটাও অনেকে পছন্দ করে না) তার পরেও নির্বাচনে শুধু সেই দলই হারেনি তার দলীয় প্রধানও হেরেছিল এবং পরে তারা এ ভুল স্বীকারও করেছিল। অর্থা r পশ্চিমা দেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে গণসচেতনতার হিমালয় দাঁড়িয়ে আছে, সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ না হলেও এখানে ইহুদি বা খ্রীষ্টান রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নেই একথা বলা যায়। ধর্মীয় রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করা ওদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয় বলে সেই ব্যাপারে ওদের বিশ্বাসের চাপটাও নেই। কিন্তু মুসলিম-প্রধান দেশে সেকথা বলা যায় না, সেখানে এ ব্যাপারে গণসচেতনতা নেই, বিশ্বাসের চাপটাও অনেকেরই আছে। কাজেই দু’অঞ্চলের দু’রকম পদ্ধতি হওয়া দরকার। বলাই বাহুল্য, শারিয়া-ভিত্তিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা ইসলামের অঙ্গ এ তত্ত্বে অসংখ্য মুসলমান বিশ্বাস করেন না। তাঁরা ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করার ঘোর বিরোধী।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই ওরা কখনো ক্ষমতায় আসে তবে সেক্ষেত্রে কি হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাই হবে যা ভারতে চণ্ড ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় এলে হয়েছিল। তারা দেশকে হিন্দু-আইনভিত্তিক ধর্মীয় রাষ্ট্র বানায়নি, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বদলায় নি। ওটা ইহুদি-খ্রীষ্টান ধর্মীয় রাজনৈতিক দল বা বিজেপি কারো উদ্দেশ্যই নয়। এখানেই তাদের সাথে ইসলামি রাজনীতির মৌলিক পার্থক্য। ইহুদী-খ্রীষ্টান বিজেপি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ধ্বংস করতে নয়। অন্যদিকে ইসলামী রাজনীতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ধ্বংস করার জন্যই। ইসলামি রাজনীতি যখনি ক্ষমতা পেয়েছে অবিলম্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। করেছে কারণ ওটাই ওদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য। সেইসব তথাকথিত ইসলামি দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের কি শেখায়? এই শেখায়, ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রতিটি দেশের নারীরা ও অমুসলিমেরা নির্যাতিত হয়েছেন, ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে এবং বিশ্ব-মুসলিমের অগ্রগতি ব্যহত হয়েছে।
ধর্মীয় রাজনীতি কি গণতান্ত্রিক হতে পারে? না, পারে না। ‘‘জামাত কি গণতান্ত্রিক?’’ - এই বিষয়ে জামাতের বর্তমান তত্ত্বগুরু জনাব শাহ আবদুল হান্নানের সাথে আমার বিতর্ক হয়েছিল। উনি এক মন্ত্রনালয়ের প্রাক্তন সেক্রেটারী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমাদের ইসলামি ফাউণ্ডেশনের প্রকাশিত তিন খণ্ডের শারিয়া বই ‘‘বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন’’-এর লেখক কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য উনি। উনি দাবী করছিলেন জামাত গণতান্ত্রিক দল কারণ তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পালন করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। আমার দাবী ছিল জামাত গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু, তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পালন করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয় শুধু গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্যই। আমি একের পর এক দলিল দেখাচ্ছিলাম জামাতের দলিল থেকেই, আর উনি শুধু অভিমত পেশ করছিলেন। আলোচনাটা এখানে পাওয়া যাবেঃ-
http://www.mukto-mona.com/Articles/fatemolla/debate_hannan/hannan1.htm
এ নিবন্ধে যা বলেছি দলিল-প্রমাণ দিয়ে বলেছি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক সামাজিক বিবর্তনে কারো কথাই শেষ কথা নয়। অনেকে অন্যরকম ভাববেন সেটাই স্বাভাবিক। অহংবোধ বা অন্ধবিশ্বাসের নয়, হিংস্র-সংঘাতের তো নয়ই বরং চিন্তার সংঘাত-ই সামাজিক অগ্রগতির চালিকাশক্তি।
সবাইকে সালাম।
হাসান মাহমুদ
২৫ আগষ্ট ৪০ মুক্তিসন (২০১০)