লাব্বায়েক্!!

লাব্বায়েক্!!   হাসান মাহমুদ

দুই ছেলে হজ্বে যাবে তাই নিয়ে মাহবুব সওদাগরের বাড়ী খুব ব্যস্ত। বড়ো ছেলে ছোটাছুটি করছে কিন্তু ছোটকে নিয়ে মহাসমস্যা। ছোটবেলা থেকেই তার রঙ্গরসের পাল্লায় পড়ে সবাই অস্থির। বাবা প্রস্তুতির কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলে -
"হচ্ছে বাবা হচ্ছে, চিন্তা কোরনা। এ বছর যাদের হজ্ব কবুল হবে তাদের মধ্যে আমারাও থাকব ইনশা আল্লাহ্”।
 
বাবা আশ্বস্ত হন কিন্তু ছোটবৌ হয়না। তার বাবাও হজ্ব করেছে, সে জানে হজ্বে যেতে হলে কতো জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়। কিন্তু স্বামী তার মহা আরামে গা’এলিয়ে আছে, যোগাড়যন্ত্রের কোন খবরই নেই। জিজ্ঞেস করলেই হেসে বলে –“আমারটা আমি করছি - তুমি তোমারটা গুছিয়ে নাও তো, শেষে তোমার জন্য দেরী না হয়”।
 
বৌ ত্রস্তে এটা ওটা গোছায় কিন্তু মনে গেঁথেই থাকে সন্দেহটা। তারপর একদিন বড় চলে গেল হজ্বের ক্যাম্পে বৌয়ের হাত ধরে। বাবা ছোটকে জিজ্ঞেস করলেন -
 
“তোর হজ্ব-ক্যাম্প, ফ্লাইট, এসবের কিছুই তো বললি না”।
ছোট হেসে বলে - ‘‘ক্যাম্পে কেন যাব। বাড়ি থেকে সোজা হজ্বে যাব - ব্যবস্থা সবই হচ্ছে - তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তো বাবা’’।
 
বাবা নিশ্চিন্ত হলেন। রওনা হবার সময় বাবা বুকে জড়িয়ে দোয়া করলেন, মা অশ্রুসিক্ত চোখে ছেলে-বৌয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কি বললেন বোঝা গেল না। গাড়ির ড্রাইভার ডিগ্গির মধ্যে স্যুটকেস পুরে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। মা’কে জড়িয়ে ধরে কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে ছোট বলল -
 
"মা, পাঁচদিন পর ফিরব। দোয়া কোর আর শুটকি রান্না করে রেখো”।
বাবা অবাক হলেন – “পাঁচদিন পর ফিরবি?’’
"হ্যাঁ বাবা, হজ্ব করেই ফিরব। ঠাট্টা নয় বাবা - সত্যি বলছি”।
 
বৌয়ের কানে গেল কথাটা। সে জানে পাঁচদিনে হজ্ব করে ফেরা যায় না। কিন্তু সে এও জানে স্বামী যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে কথাটা বলেছে নিশ্চিন্ত হয়েই বলেছে। যা সে বলেছে তা করবে। কিন্তু কি করে করবে? পেছনের সিটে বসল দু’জন - গাড়ী চলা শুরু করলে বৌ জিজ্ঞেস করে:-
 
"আমরা কোথায় যাচ্ছি গো? হ্যাঁ?’’
"কোথায় আবার, হজ্বে যাচ্ছি”।
"এভাবে কেউ হজ্বে যায়? আসলে কোথায় যাচ্ছি সত্যি করে বলোনা!’’
ছোট হেসে বলে - ‘‘হজ্বেই যাচ্ছি। সবুর করো, একটু পরেই দেখতে পাবে”।
 
বৌ খুব সবুর করল। গাড়ী এসে দাঁড়াল বাস ষ্টেশনে। বৌ বলল –
 
“এ তো বাস ষ্টেশন ! বাসে করে হজ্বে যাচ্ছি?’’
“হ্যাঁ। পথে কিছু কষ্ট করতে হবে - পারবে তো?’’
বৌ বলল - “আমরা হজ্বে যাচ্ছি না। বাসে করে কেউ হজ্বে যায় না। ছি ছি, সবাইকে এভাবে ঠকালে”?
“কাউকে ঠকাইনি। এ বছর যাদের হজ্ব কবুল হবে তাদের মধ্যে আমারাও থাকব ইনশা আল্লাহ"।
 
ড্রাইভার ডিগ্গি থেকে বাসে তুলে দিল স্যুটকেসগুলো, মৃদুহেসে বলল -
"আপনেরে হাজার সালাম সার। আপনেরে হাজার হাজার সালাম সার। অ্যামতেই ধীরে ধীরে মুসলমানের চৌক্ষু খুইলা দিব আল্লায়”।
ছোট গম্ভীর স্বরে বলল - ‘‘সব রওনা হয়ে গেছে ঠিকমতো”?
“হ সার। শ্যাষের চালান রওনা করাইয়া দিছি পরশু”।
 
এসব শুনে কৌতুহলের চাপে বৌয়ের অজ্ঞান হবার অবস্থা কিন্তু স্বামীকে মনে হচ্ছে অচেনা। ওই বুকে কি যেন এক অস্থির ঝড়, - তার সদা দুরন্ত কৌতুকময় চোখ এখন যেন ফ্রেমে বাঁধা ঝড়ের ছবি। বাস চলা শুরু করলে বৌ বলল -
 
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?’’
“রংপুর”।
“রং - পু – র”?? আঁৎকে উঠল বৌ, - ‘‘রংপুর কেন? ওখানে তো আমদের কেউ নেই !!’’
 
স্বামী শক্ত করে চেপে ধরল বৌয়ের হাত। গভীর নিঃশ্বাসে বলল - ‘‘আমাকে ধরে থাকো। আমি একা পারব না, আমার পাশে থাকো"।
 
এবার বৌয়ের হাতও আঁকড়ে ধরল স্বামীর হাত, বুঝল গভীর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে যা আগে কখনো ঘটেনি। বাস চলছে সাভার পার হয়ে। স্বামী ব্যাগ খুলে বের করল খবরের কাগজ - একটা একটা করে খুলছে খবর পড়ছে ছবি দেখছে আর শক্ত দৃঢ় হয়ে আসছে তার চিবুক, ঠোঁটে শক্ত হয়ে চেপে বসছে ঠোঁট আর ঘন হয়ে আসছে তার নিঃশ্বাস।
 
দুপুরে রংপুরে বাস থেকে নেমে ঘটঘটে বেবিট্যাক্সীতে গ্রামের পথ। বিকেলে দুর গ্রামের কাছাকাছি আসতেই কানে এল জনতার হৈ হৈ। কাছে এসে বৌ দেখল দাঁড়িয়ে আছে চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ ভর্তি তিনটে ট্রাক। ভয়ংকর বন্যা চলছে উত্তরবঙ্গে। এখন ২০১৯ সাল, গত ১০০ বছরের সর্বোচ্চ উচ্চতায় ধেয়ে এসেছে হিংস্র বন্যার ঢল। ভেসে গেছে ধানের জমি আর হাঁস মুরগি, গরু বাছুর ছাগল মহিষ, বৌ বাচ্চা নিয়ে ডুবে যাওয়া বাড়ীর ছাদে বসে আছে অনাহার জর্জরিত লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ।
 
লুটিয়ে আছে হাড্ডিসার শিশুকন্যা, হাড্ডিসার বালক। অন্য এক আতংকে আতংকিত ক্ষুধার্ত যুবতি, তার দুচোখে অশ্রু। গত বন্যায় দু’টো নুন-ভাতের জন্য নোংরা ফড়িয়ার বিছানার দুঃসহ স্মৃতি আবার তার সামনে কালনাগিনীর ছোবল তুলে এদিক ওদিক দুলছে।
 
কিন্তু এখন জনতার ক্ষুধিত আর্তনাদ বদলে হয়েছে উৎসবের চীৎকার। ট্রাকের ওপর থেকে তরুণ-কিশোরের দল মহা উৎসাহে লোকজনের মধ্যে বিতরণ করছে চাল-ডাল আলু-লবণ তেল। ওড়নাটা কোমরে আচ্ছা করে পেঁচিয়ে ট্রাকের ওপরে দাঁড়িয়ে তাদের নেত্রীত্ব দিচ্ছে মাতবরের মেয়ে ফারহানা পিনু। তার মায়াময় চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বৌ মুগ্ধ চোখে দেখল মানুষের আনন্দ, তারপর দুষ্টুমি করে বললঃ-
 
“ও !! হজ্বের টাকায় দান-ধ্যান হচ্ছে তাহলে?’’
“দান?’’ চকচক করে উঠল স্বামীর দু’চোখ - ‘‘কিসের দান? কাকে দান? ওরাও আশরাফুল মাখলুকাত, আপাততঃ একটু কষ্টে পড়েছে। আমিতো শুধু উপহার দিচ্ছি, মানুষের প্রতি মানুষের উপহার”।
 
মুগ্ধ বৌয়ের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল – “তুমি একটা ফেরেশতা”!
“না,ফেরেশতারা যাঁকে সেজদা করেছে, আমি তাঁর বংশধর বনি আদম। কোরাণ পড়ে দেখ, সুরা বনি ইসরাইল আয়াত ৬২"।
 
তারপর সে হঠাৎ তার সেই দুষ্টুমি-চোখে বললঃ-
“আসলে কি জানো? ব্যবসায়ীর ছেলে তো আমি. - উপহারের নামে আমি আসলে ব্যবসা করছি। ধারের ব্যবসা – শ-শ-শ-শ….কাউকে বোলনা যেন”!’
“ধারের ব্যবসা? এই বন্যার দেশে” ??
 
বিষ্ময়ে বৌয়ের কথা আটকে গেল গলায়। বাকচাতুরীতে স্বামী তার অনন্য, কিন্তু একের পর এক এত বিস্ময়ের ধাক্কা সে আর সামলাতে পারছে না।
 
“কিসের ধার? কাকে ধার ?’’
“বুঝলে না? আল্লাহকে ধার দিচ্ছি, অ-নে-ক লাভ হবে বৌ !’’
“আল্লাহকে ধার দিচ্ছ ? তওবা তওবা !’’
“তওবা মানে? আল্লাহ নিজেই তো মানুষকে ডেকে ডেকে ধার চাচ্ছেন" !
“আল্লাহ মানুষকে ডেকে ডেকে ধার চাচ্ছেন ? তওবা তওবা !’’
“আবার তওবা ? খুলে দেখ কোরাণ শরীফ – “এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম কর্জ, আর আল্লাহ তাকে দ্বিগুন বহুগুন বেশী করে দেবেন - সুরা বাকারা আয়াত ২৪৫”।
 
"কি??"  ছিটকে উঠল বৌ – "কি বললে"?
 
“এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম কর্জ আর আল্লাহ তাকে দ্বিগুন বহুগুন বেশী করে দেবেন - সুরা বাকারা আয়াত ২৪৫" !
“কি আশ্চর্য্য !! এই বন্যার সময়ে এ আয়াতের কথা কেউ দেশের সবাইকে বলে না কেন?’’
 
“বলা দরকার, রেডিয়ো-টিভি খবরের কাগজ সব জায়গায় বলা দরকার। ঢাকায় ফিরে পড়ে দেখো সুরা মুয্যাম্মিল ২০, আত্ তাগাবুন ১৭ আর আল্ হাদীদ ১১। ‘‘আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও....যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও তিনি তোমাদের জন্য তা দ্বিগুন করে দেবেন...... কে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ধার দেবে, এরপর তিনি তা বহুগুনে বৃদ্ধি করবেন, এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানিত পুরষ্কার”। এই তিন ট্রাকের ধার দিচ্ছি, রোজ হাশরে আমরা ছয় ট্রাকেরও বেশী সওয়াব পাব। তার সবটাই তুমি নিয়ে নিয়ো যাও!’’
 
হেসে ফেলল বৌ, মনে মনে স্বামীগর্বে আবার গরবিনী হল সে। স্বামী চলে গেল ট্রাকের কাছে। ছুটে এল মাতবর আর ইমাম - অনেক কথা হল তাদের মধ্যে। বৌ মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল মানুষের আনন্দ। ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেবার মতো আনন্দ আছে? ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেবার মতো ইবাদত আছে?
 
দিগন্তে তখন সুর্য্য ডুবুডুবু, মন্দ মন্থরে সন্ধ্যা নামছে। ঝোপের ডালে উড়োউড়ি করছে একটা ফড়িং, মাটিতে ঘোরাঘুরি করছে নামহীন দুটো পোকা আর পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে একদল পিঁপড়ে। কি যেন কি নিয়ে ওরা সবাই খুব ব্যস্ত।
 
বৌয়ের মনে হল, ওদের কেউ কি কখনো না খেয়ে মরেছে ?
 
চমক ভাঙ্গল যখন স্বামী এসে বলল -
“জানো, আমার দেখাদেখি অন্যেরাও কিছু পাঠাচ্ছে”।
“বাহ্ ! আমার গয়নাগুলো থেকে কিছু নাহয়........’’
“সিওর, গুড ! শোন, মন দিয়ে শোন”।
 
বৌ মন দিয়ে শুনল, অশরীরী এক দৃঢ়কণ্ঠে তার স্বামী ফিসফিস করে উঠল -
“আমাদের বাড়িতে এককণা দানা থাকা পর্য্যন্ত মানুষের বাচ্চাকে না খেয়ে মরতে দেব না আমি’’।
 
গভীর মমতায় বৌ বলল – “এত অস্থির হয়ো না, বন্যা চিরদিন থাকবে না। মানুষ আবার উঠে দাঁড়াবে, ফসল ফলাবে, বৌ বাচ্চা নিয়ে ভালই থাকবে। তখন আমরা সত্যিকারের হজ্ব করতে যাব”।
“নিশ্চয়ই, হজ্বের তো বিকল্প নেই। ইট ইজ অনলি এ ম্যাটার অফ প্রায়োরিটি - এ'বছর মানুষের জান বাঁচাই, মেয়েগুলোকে ফড়িয়ার বিছানা থেকে বাঁচাই, আল্লা দিলে সামনে বছর আমরা হজ্বটা করবো ইনশা আল্লাহ”।
বৌ বলল - "ইনশাআল্লাহ" !
 
স্বামী চলে গেল ট্রাকের কাছে। সামনে ধু ধু বন্যার পানি, ওপরে অবারিত আকাশ। বৌ কল্পনায় দেখল এয়ারপোর্টে সাদা কাপড়ে হাজার হাজার আনন্দিত হজ্বযাত্রী হুড়োহুড়ি করে প্লেনে উঠছে আর বুকভরা তৃপ্তিতে বলছে ‘‘শুকুর আল্ হামদুলিল্লাহ”!!
ওদিকে দুরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট দুটো ক্ষুধার্ত ভাইবোন হাত ধরাধরি করে করুণ চোখে তা দেখছে।
 
ভাইটা আস্তে করে বলল - ‘‘বড় হইয়া ত’রে হজে লইয়া যামু”।
দ্বিধাগ্রস্ত বোনটা কি যেন ভাবল। তারপর ফিসফিস করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল - “ওইহানে ভাত আছে”?
 
বৌয়ের মাথা টলে উঠল।
 
মায়াময় গ্রামবাংলার হরিৎ-সোনালী কোলাজের আঁচলপ্রান্তে ধীরে নামছে গ্রামবাংলার মায়াময় সন্ধ্যা। চমক ভাঙ্গল যখন পেছন থেকে স্বামী এসে তার পাশে দাঁড়াল। বৌ চোখ তুলে দেখল স্বামীর দু’চোখে জ্বলছে হাজার জোনাকি। সেই জোনাকি-চোখ বৌয়ের দু’চোখে গেঁথে স্বামী বলল -
 
“জানো, নবীজি বলেছেন যার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে সে মুসলমান নয়। যে মুসলমানই নয় তার আবার হজ্ব কি ? চলো আমরা আগে মুসলমান হই”।
 
বৌ-এর হাত ছেড়ে সে সোজা হয়ে থমকে দাঁড়াল। পুরো নিঃশ্বাসটা বুকের ভেতরে টেনে একটু আটকে নিল যেন। তারপর দু’হাত সোজা ওপরে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সর্বশক্তিতে চীৎকার করে উঠল - ‘‘লাব্বায়েক....” !!
 
সেই ধ্বনি ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল বৌয়ের শরীর, দু’চোখ থেকে অঝোর অশ্রুর সাথে অস্ফুটকণ্ঠে তারও মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল - ‘‘লাব্বায়েক! আমি হাজির, আমি হাজির ইয়া আল্লাহ !!"
 
সুদূর পশ্চিমে দিগন্তবিস্তৃত মরুকেন্দ্রে তখন জলদমন্দ্রে ধ্বনিত হচ্ছে লক্ষ কণ্ঠের আকুতি - "লাব্বায়েক" !!!!
************************************************
এ গল্পের ছায়াভিত্তিতে নির্মিত শর্ট ফিল্মের ইউটিউব লিংক - PERCEPTION (বোধ) :-

Print