রসুলের "কলমার দায়ে" জামাত . . .

রসুলের "কলমার দায়ে" জামাত...

একাত্তরের মত জামাত আবার ইসলামী কার্ড খেলছে। জামাত প্রজন্ম-চত্ত্বরের সমস্ত নেতানেত্রীর ওপরে নাস্তিক মুরতাদ ঘোষণার অস্ত্র প্রয়োগ করেছে, উদ্ধৃতি:- "বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও পবিত্র ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারী নাস্তিকদেরকে পুলিশ প্রহরায় শাহবাগে রাতদিন নৈরাজ্য সৃষ্টির পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, ঈমানদার ব্যক্তিদের ওপর নির্বিচারে গুলী চালিয়ে সরকার মূলত নাস্তিকদের পক্ষ অবলম্বন করেছে"-(সংগ্রাম, বিভিন্ন তারিখ)। এতে সে কোরান-রসুলের কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ লঙ্ঘন করছে তা দেখাচ্ছি।

জামাতের দাবী নিহত ব্লগার রাজীব নাকি নাস্তিক ছিল, সে দাবী ও তার খুনীদের ধর্মীয় সুত্র ও তাদের মনস্তত্ব নিয়ে পরে লিখব। আপাতত: যদি ধরেও নেই সে নাস্তিক-ই ছিল তবু সেজন্য বাকী সবাইকে নাস্তিক বলাটা গুরুতর অপরাধ দেশের আইনেও, শারিয়া আইনেও। অতীতে জামাতের ক'জন নেতাকর্মী নারী, বেশ্যা ও মাদক ঘটনায় ধরা পড়েছে, সেজন্য জামাতের সব্বাই কি মদখোর আর বেশ্যাগামী হয়ে গেছে? মোটেই নয়। দেশ-বিদেশের প্রজন্ম চত্বরের নেতৃত্বে দু'একজন নাস্তিক হয়ে থাকলেও প্রায় প্রত্যেকে শুধু আস্তিকই নয় বরং বিশ্বাসী মুসলমান। তাদেরকে ঢালাওভাবে নাস্তিক অপবাদ দিয়ে জামাত আল হুজরাত ১১ ও হুমাজাহ ১ সরাসরি লঙ্ঘন করেছে। এগুলো অপবাদের ওপরে এবং হুদুদের মধ্যে পড়ে। এ অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ; আইনে এর শাস্তির বিধান আছে। চত্বর-নেতৃত্ব এ নিয়ে জামাতের বিরুদ্ধে ক্লাস-স্যুট করতে পারেন।

যে আন্দোলনের কোথাও ধর্মের বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারিত হয়নি, যেখানে কোরান দিয়ে শুরু করা হয়েছে, যেটাতে সারা জাতি অংশ নিচ্ছে বন্যার মত দেশে-বিদেশে, যে লক্ষ মানুষের মধ্যে আছেন পর্দা, হিজাব নিকাব পরিহিতা এমনকি সম্পুর্ণ মুখঢাকা মহিলারাও, আছেন বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, জামাতের প্রতি জুতো উঁচিয়ে আছেন মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা মাওলানা আলেমের দল, সেই মহান আন্দোলন "নাচ-গান, চরিত্র হনন, বেলেল্লাপনা ও ফাঁসির দাবিতে উত্তাল কর্মসূচি"? আশ্চর্য্য নয়, অনেক আলেম মাওলানার মত খেলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদীও বলেছেন, "জামাতকে আমাদের মতো ঘৃণা আওয়ামী লীগও করে না"। এই ধরণের ইসলাম-বিরোধী বহু বহু অপকর্ম জামাতকে সুস্পষ্ট মুরতাদ বানিয়েছে; কিন্তু তা বলার অধিকার কোরান-রসুল আমাদের দেন নি। নাহলে আমি যেসব ইসলামী সংগঠনের সাথে কাজ করি তাদের লেটারহেডে জামাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুরতাদ ঘোষণা করা যেত।


কারণ কে মুসলমান তা ঠিক করার সম্পুর্ণ অধিকার শুধুমাত্র তার নিজেরই, সে অধিকার অন্য কাউকে দেন নি কোরান-রসুল। বরং অন্যকে অমুসলমান বলার বিরুদ্ধে তর্জনী তুলে নিষেধ করা আছে। রসুলের সময়ে কিছু মুনাফিক ইসলাম গ্রহনের ভান করত, এর ওপরে কোরানে একটা সুরা আছে, মুনাফিকুন। এদিকে আমরা দেখি রসুল নির্দেশ দিলেন -"যাহারা নিজেদের মুসলমান বলিয়া দাবী করে তাহাদের তালিকা বানাও"। সাহাবীরা তালিকা বানালেন, সংখ্যাটা রেওয়ায়েত অনুযায়ী ৫০০ থেকে ১৫০০ (সহি বুখারী ৪র্থ খণ্ড হাদিস ২৯৩, ২৯৪)। এদের মধ্যে নিশ্চয়ই মুনাফেকরাও ছিল "যারা নিজেদের মুসলমান বলিয়া দাবী করে"। রসুল সেটা অবশ্যই জানতেন কিন্তু তিনি কাউকে অমুসলিম ঘোষণা করেন নি। তিনি জানতেন সেটা করলে চিরকাল "যারা নিজেদের মুসলমান বলিয়া দাবী করে" এমন অনেককেই কিছু ভ্রান্ত মুসলিম অমুসলিম বলবে। তিনি মেনে চলেছেন আল কোরান সুরা নিসা আয়াত ৯৪ যার মর্মবাণী ওই একই, কেউ নিজেকে মুসলমান হিসেবে সালাম দিলে "তাহাকে বলিওনা তুমি মুসলমান নও"। কোরানের এই সুস্পষ্ট হুকুম লঙ্ঘন করে স্বয়ং রসুলের ভাষায় "কলমা'র দায়ে" পড়ে গেছে খোদ জামাতই, প্রজন্ম চত্বর নয়।

কলমার দায় কি? উদ্ধৃতি দিচ্ছি রসুল (সাঃ)-এর বিখ্যাত জীবনী ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক থেকে, পৃষ্ঠা ৬৬৭। “উসামা বিন জায়েদ বলিয়াছে - ‘যখন আমি ও এক আনসার তাহাকে (মিরদাস বিন নাহিক নামে এক অমুসলিমকে - লেখক) আক্রমণ করিয়া পাকড়াও করিলাম তখন সে কলমা উচ্চারণ করিল। কিন্তু আমরা থামিলাম না এবং তাহাকে হত্যা করিলাম।’ রসুল (সাঃ) এর নিকট এই ঘটনা বর্ণনা করিলে তিনি বলিলেন - ‘কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, উসামা?’ আমি বলিলাম, ‘লোকটি শুধু মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিবার জন্য কলমা উচ্চারণ করিয়াছে।’ কিন্তু তিনি প্রশ্নটি করিতেই থাকিলেন এবং করিতেই থাকিলেন। তখন আমি ক্ষমা চাহিলাম ও বলিলাম আমি আর কখনোই তাহাকে খুন করিব না যে কলমা উচ্চারণ করিয়াছে। তিনি বলিলেন- ‘আমার (মৃত্যুর) পরেও তুমি এইকথা বলিবে তো ?’ আমি বলিলাম, ‘বলিব’।”

বড় বেদনা বড় কষ্টে নবীজী এও বলেছেন - “তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ?” - (ডঃ ত্বাহা জাবির আল্ আলওয়ানী - “দি এথিক্স অব্ ডিসএগ্রিমেণ্ট ইন্ ইসলাম” - ইমাম হাম্বলের মসনদ ৬ষ্ঠ খণ্ড ২৬০-র উদ্ধৃতি)

তুমি কি প্রজন্ম-নেতৃত্বের প্রত্যেকের বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ, হে জামাত!
কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, হে জামায়াতে ইসলামী?

জামাতের পরের অপরাধও মারাত্মক। প্রজন্ম নেতৃত্বকে ঢালাওভাবে নাস্তিক বলার সাথে সাথে তাদের মধ্যে যাঁরা মুসলিম তাঁরা জামাতের মতে "মুরতাদ" অর্থাৎ ইসলাম-ত্যাগী হয়ে গেছেন। জামাত-শিবির শারিয়া আইনে বিশ্বাস করে যাতে মুরতাদকে রাস্তা ঘাটে যে কোনো জায়গায় খুন করা তাদের জন্য বৈধই শুধু নয় বরং "ঈমানী" দাযিত্ব যে কথা রাজীবের খুনীরা বলেছে। এবং সে ক্ষেত্রে শারিয়া আইনে খুনী/খুনীদের শাস্তি হবে না। কাজেই, বাস্তবেই প্রজন্ম নেতৃত্বের মুসলিমরা খুন হবার হুমকি'র মধ্যে পড়ে গেছেন। এখন আর জামাতের সাংগঠনিক নির্দেশের দরকার নেই, রাজীবের খুনীদের মত যে কোনো উন্মাদ বা উন্মাদের দল যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এটা আবার তাদের বেহেশতে যাবার পথ - জামাত নিজেও আর এখন খুনীদের ঠেকাতে পারবে না। খুবই সম্ভব যে প্রজন্ম নেতৃত্ব এই চাপ অনুভব করছেন, হয়ত হুমকিও পেয়েছেন - সে হুমকি শুধু কথার কথা নয় এবং সেটা চলবে আজীবন। এ নিয়েও প্রজন্ম নেতৃত্ব জামাতের বিরুদ্ধে ক্লাস-স্যুট করতে পারেন।

*********************************************

হাসান মাহমুদ

০২ মার্চ, ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)

লেখক ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, দ্বীন রিসার্চ সেন্টার হল্যাণ্ড-এর রিসার্চ এসোসিয়েট, মুসলিমস ফেসিং টুমরো'র জেনারেল সেক্রেটারী, ফ্রি মুসলিমস কোয়ালিশন-এর ক্যানাডা প্রতিনিধি, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশীপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং খুলনা'র “সম্মিলিত নারীশক্তি”র উপদেষ্টা। শারিয়ার ওপরে বই "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" ও আন্তর্জাতিক প্রশংসিত ডকু-মুভি "হিল্লা", "নারী" ও "শারিয়া প্রহেলিকা" - শিক্ষকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে লণ্ডন ও টরন্টো'র স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষাক্লাসে দেখানো হয়। 

Print