মদিনা সনদ কি কোন দেশের গঠনতন্ত্র হতে পারে? - হাসান মাহমুদ
এটা একটা নিরপেক্ষ একাডেমিক আলোচনা। চলুন বিখ্যাত কিছু সূত্রের ভিত্তিতে দেখা যাক দলিলটাকে:- (১)নবীজীর (সা) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনী “সিরাত”(ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক), (২)সহি বোখারী (৩) সহি সুনান আবু দাউদ, (৪) ইমাম শফি'র বিখ্যাত কেতাব ‘রিসালা’ (৫)ডঃ হামিদুল্লাহ'র বিখ্যাতবই ‘দ্য ফার্স্ট রিটন কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্লড’, (৬) মওলানা মুহিউদ্দিনের বাংলায় অনুদিত কোরাণ শরীফ, (৭) আমাদের ইসলামী ফাউণ্ডেসনের প্রকাশিত বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন, (৮)দ্য পেনাল ল’ অব্ ইসলাম।
নবীজী (সা) ৬২২ সালে মদিনায় হিজরত করার পরের বছরই একটা দলিল তৈরি করে মদিনার অমুসলিমদের কাছে প্রস্তাব করেন, এটা আছে“সিরাত”-এর ২৩১-২৩৪ পৃষ্ঠায়। এর নাম ‘দ্য কভেন্যাণ্ট বিটুঈন দ্য মুসলিমসঅ্যাণ্ড দ্য মেডিনিয়ান্স অ্যাণ্ড দ্য জিউস’ অর্থাৎ ‘মুসলিম ও মদিনাবাসী, এবং ইহুদিদের মধ্যে কভেন্যাণ্ট।’ কভেন্যাণ্ট শব্দের অর্থ গঠনতন্ত্র নয়, অর্থ হল agreement, contract, treaty, promise, and pledge অর্থাৎ চুক্তি, কথা দেয়া, প্রতিজ্ঞা, ইত্যাদি। মূল আরবিতে এ-দলিলের নাম দেয়া আছে ‘সহিফা’। এর অর্থও গঠনতন্ত্র নয়, এর অর্থ হল প্রোগ্রেসিভ ডকুমেণ্ট, অর্থাৎ ‘ক্রমাগত বিবর্তনশীল দলিল’। ‘সিরাত’ থেকে ভাবানুবাদ-উদ্ধৃতি দিচ্ছি:-
“মুজাহির ও আনসারদের বিষয়ে রসুল একটি চুক্তি লেখেন যাহাতে তিনি ইহুদিদের সাথে ‘বন্ধুত্বসুলভ চুক্তি’ (friendly agreement)করেন এইভাবে:- “ইহা রসুল মুহম্মদের পক্ষ হইতে মুমিনগণ, কুরাইশ মুসলিমগণ এবং মদিনার যাহারা তাহাদের পরে আসিয়া যোগ দিয়াছে ও পরিশ্রম করিয়াছে তাহাদের ভিতরে সম্পর্ক স্থির করিতে। তাহারা সকলে এক উম্মা।”
এখানে বিশ্বাসী বলতে ইহুদি-খ্রীষ্টানকে বুঝায় কারণ তারা আল্লাহ-তে বিশ্বাস করে এবং ‘মদিনায় যাহারা তাহাদের পরে আসিয়া যোগ দিয়াছে’ বলতে মুজাহিরদেরকে বুঝায়। ডঃ হামিদুল্লাহ'র বই ‘দ্য ফার্স্ট রিট্ন্ কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্লড’ অর্থাৎ ‘বিশ্বের প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র’-এ মোট ৫২টি ধারার কথা বলা হলেও ৪৭টি ধারার উদ্ধৃতি আছে। তিনি বলেছেন:- “রসুল একটি দলিল লিখেন যাহাতে শাসক/শাসিতের দায়িত্ব ও অধিকারের এবং অন্যান্য বিষয়ের বিবরণ ছিল...তিনি লিখেন একটি দলিল (Deed)যে দলিল নিজেকে ‘কিতাব’ বা ‘সহিফা’ বলিয়াছে”- পৃষ্ঠা ৪ ও ১২।
দলিলের ধারাগুলো প্রধানত: (১)যুদ্ধ ও শান্তিচুক্তি, (২)মুসলিম-অমুসলিমের পারস্পরিক সম্পর্ক ও (৩) বিচার-আচারে নবীজীর কর্তৃত্ব, এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেখুন, মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরাণ, পৃষ্ঠা ৪৮, ৩৩৫ ও ১৩৪৯:-
“রসুলুল্লাহ (সাঃ) মদীনা পৌঁছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সর্বপ্রথম মদীনায় ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত ইহুদী গোত্রসমূহের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না এবং কোন আক্রমণকারীকে সাহায্য করবে না। তারা আক্রান্ত হলে মুসলমানগণ তাদেরকে সাহায্য করবে। শান্তিচুক্তিতে আরও অনেক ধারা ছিল...ওহুদ যুদ্ধ পর্যন্ত তাদেরকে বাহ্যত এই শান্তিচুক্তির অনুসারী দেখা যায়... রসুলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আগমনের পর পার্শ্ববর্তী ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাথে এই মর্মে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না...মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিভঙ্গের অপরাধে বনী-কুরায়যা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বন্দি হয়েছে”।
তিনি ওটাকে গঠনতন্ত্র বলেননি, ‘শান্তিচুক্তি’-ই বলেছেন, এবং বারবার বলেছেন। এমনকি শারিয়ার কেতাবও ওটাকে ‘গঠনতন্ত্র’ বলেনি, বলেছে ‘মদিনা চুক্তি’ এবং ‘মদিনা সনদ’:- বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬০।
আরো দেখুন:- “কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রিয় নবী (সাঃ) আল্লাহতা’আলার নির্দেশক্রমে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং যুলুম ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদীনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মালবম্বী বিশেষত ইয়াহুদীদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন যা ইতিহাসে “মদিনা সনদ” নামে খ্যাত:- ইসলামী জীবন- “সন্ত্রাস নির্মুলে মহানবী সাঃ-এর শ্বাশ্বত কর্মসূচী”-মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ ভুঞা-দৈনিক ইনকিলাব ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০০৮।
নেতৃত্বটা নবীজীরই ছিল, কিন্তু সেটা ছিল শান্তিচুক্তি-ভিত্তিক। তাছাড়া প্রশ্ন আরো আছে। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে খুনির মৃত্যুদণ্ড হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শারিয়া আইনে আছে :-“ইসলামি রাষ্ট্রে কোন অমুসলিমকে হত্যার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হইবে না”:-দ্য পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ১৪৯ ও ইমাম শাফির ‘রিসালা’ - ১৪২ পৃষ্ঠা। আরো দেখুন সহি বোখারী ১ম খণ্ড হাদিস ১১১ এবং খণ্ড ৪-এর হাদিস ২৮৩ - মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মুহসিন খানের অনুবাদ - “আবু যুহায়রা বলেন ‘আমি আলী (রাঃ)-কে প্রশ্ন করিলাম, কোরাণের বাহিরে আপনার কোন জ্ঞান আছে কি ? আলী বলিলেন, না। তবে ... কোন অবিশ্বাসীকে খুন করিবার জন্য কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হইবে না।”
যে কোন লোক বুঝবে যে এ-আইন অন্যায়, এর শেকড় একেবারে রসুলে গিয়ে ঠেকানো হয়েছে, মদিনা সনদের:- “কেহ যদি কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করে ও তাহা প্রমাণিত হয়, তবে নিশ্চয়ই খুনীর মৃত্যুদণ্ড হইবে” (ধারা ২১)। কিন্তু “কোন অবিশ্বাসীকে খুন করার বদলে কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে খুন (ইয়াক্তালু) করিবে না” (ধারা ১৪) - দ্য ফার্স্ট রিট্ন্ কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্ল্ড, পৃষ্ঠা ৪৫ ও ৪৭ - মুহম্মদ হামিদুল্লাহ- ১৯৪১।
এটা ইসলামের ন্যায়বিচারের সুস্পষ্ট বিরোধী। প্রথমত::- এমন অন্যায় প্রস্তাব করা নবী-রসুল তো দূরের কথা, কোন বিবেকমান মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত:, মদীনায় তখন মোটামুটি দশ হাজার লোকের বাস (ডঃ হামিদুল্লাহ- পৃঃ ১৩), আর মুসলমানের সংখ্যা দুশো'র মত -দ্য প্রসেস অব্ ইসলামিক রেভল্যুশন - মওদুদি, পৃঃ ৪২। অর্থাৎ অমুসলিমরা ৯৮% আর মুসলিমরা মাত্র ২%। ওটা ঐ অমুসলিমদেরই ভিটেমাটি পৈতৃক জায়গা, ওরা আগে থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই দশ হাজার লোক ও তাদের শক্তিশালী নেতারা নিজেদেরই দেশে বসে নিজেদেরই বিরুদ্ধে এই অপমানকর চুক্তিতে কেন রাজী হবে মাত্র দু’শো জনের সাথে যার বেশির ভাগ বিদেশী ? প্রশ্নই ওঠে না। ওরা নবীজীকে (সা) রসুল বলেই মানেনি, তাঁর নেতৃত্ব মানবে কেন ? ওদের নেতারা হঠাৎ করে সংখ্যালঘুর বিদেশী নেতার কাছে তাদের পুরনো নেতৃত্ব ছাড়বে কেন ? নেতা কখনো নেতাগিরি ছাড়তে চায় ? তাছাড়া, কারো পক্ষেই নূতন দেশে গিয়ে প্রথমেই হঠাৎ করে পুরো একটা জাতির নেতৃত্ব ও শাসন শুরু করাটা অসম্ভব। এ সামাজিক শাসন নবীজী অবশ্যই করেছিলেন তবে শুরুতেই নয় বরং কয়েক বছর সংগ্রামের পরে মদিনার এবং অন্যান্য অমুসলিম গোত্রগুলোকে তাঁর আওতায় এনে।
ঐ শান্তিচুক্তি রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র হতে পারে না; কারণ:-
(১) গঠনতন্ত্র তৈরিই হয় দুই বা বেশি পক্ষের আলোচনা-বিতর্ক করে। নবীজী (সা)কোন পক্ষের সাথে, এমনকি কোন মুসলমানের সাথেও আলোচনা করে নয় বরং আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারবলে নিজে থেকে এককভাবে এটা তৈরি করেছিলেন,
(২) আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের মাধ্যমে পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলে সেটা গঠনতন্ত্রই নয়। এ-দলিলের ওপরে কি আলোচনা বা পরিবর্তনের সুয়োগ ছিল? না, ছিল না এবং দলিলটায় কোন পরিবর্তন হয়ওনি,
(৩) গঠনতন্ত্র ক্রমাগত প্রয়োগ ও পরিমার্জন করতে হয়। নবীজী এ-দলিল কি ক্রমাগত প্রয়োগ করেছিলেন ? না, করেননি,
(৪) চার খলীফারা কি সনদের ধারাগুলো হুবহু প্রয়োগ করেছিলেন ? না, করেননি।
(৫)একতরফা ঘোষণায় চুক্তি বাতিল করা যায় কিন্তু আলোচনা ছাড়া গঠনতন্ত্র বাতিল করা যায় না। অমুসলিমরা এ-চুক্তি ভঙ্গ করলে “ওবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী প্রকাশ্যভাবে তাদের সাথে চুক্তি বিলোপ ও অসহযোগের কথা ঘোষণা করেন” - মওলানা মুহিউদ্দিনের বাংলা-কোরাণ পৃঃ ৩৩৬,
(৬) চোদ্দশ’ বছরের মুসলিম খেলাফতে কি ওই ধারাগুলো হুবহু রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ হয়েছে ? না, হয়নি।প্রয়োগ হয়নি কারণ ওটা বাতিল হয়েছিল।।
তাহলে ?
গঠনতন্ত্র এবং রাষ্ট্র দু’টো শব্দই সাম্প্রতিক। কোন শব্দের জন্মের হাজার বছর আগে তার প্রয়োগ অসম্ভব, এটা বুঝতে কি আইনস্টাইন হতে হবে? দুনিয়ায় ম্যালেরিয়ার আবির্ভাব হবার আগে কি আপনি কুইনিন আবিষ্কার করতে পারেন ? আগুন আবিষ্কারের আগে কি রান্না করা সম্ভব ? দাঁত ওঠার আগে কি চিবানো সম্ভব? রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে হাজারো নিয়মকানুন থাকতে হয়, ওই সনদে কয়টা আছে ? ধারাগুলো পড়লে স্পষ্টই দেখা যায় কিছু ধারায় সামান্য কিছু অন্য উপাদান আছে কিন্তু মূলত দলিলটা একটা শান্তিচুক্তি মাত্র। তাছাড়া ও ধরনের চুক্তি ওটাই প্রথম নয় - ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে পারেন। আমার বইতে সেগুলো আমি দিয়েছি।
মদিনা সনদের ৪৭ টি ধারা:- https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/65-why-not-madina-shonod