বাংলাদেশের হুংকারী মওলানা

০৬ই জানুয়ারী ৪২ মুক্তিসন (২০১২)


দেশে পঞ্চাশ বছর আগেও আমাদের ইমাম চাচারা ছিলেন হাস্যমুখ স্নেহপ্রবণ আর ক্ষমাশীল। তাই সব ধর্মের মানুষ তাঁদের অনেক শ্রদ্ধা করত। এখন কিছু মওলানা আছেন যাঁরা ইসলামের নামে হুংকার দেন ও ব্ল্যাকমেইলিং করেন, নীচে উদাহরণ দেখুন। তাঁরা সর্বদা ক্ষিপ্ত হবার কারণ বা বাহানা খোঁজেন। তাই জনগণের সম্মান হারিয়েছেন তাঁরা। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেলে এঁরা জাতির যে কি ভয়াবহ দুর্দশা করবেন তা পাকিস্তানের দিকে তাকালে বোঝা যায়। এই সেদিনও পাকিস্তানের সর্বোচ্চ জামাতি - জামাতে ইসলামের আমীর মুনাওয়ার হাসান টেলিভিশনে বলেছেন চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুস সাক্ষী না থাকলে ধর্ষিতা মেয়েদের উচিত অভিযোগ না করে বাড়ীতে বসে থাকা - ওটাই নাকি কোরানের আইন. কি ভয়ংকর কথা, ওই ইসলামের নামেই !! বাংলাদেশের শুভশক্তি এখন এই ইসলাম-বিরোধী চাপের মধ্যে পড়ে গেছে. যেন ইসলামের ব্যাখ্যা করার অধিকারটা শুধু তাঁদেরই - আর কেউ তা করলেই তাঁরা ছোবল মারেন। জানলেও মানেন না যে ওটা সরাসরি কোরাণ-রসুলের বিরুদ্ধে যায়। উদাহরণ দেখুনঃ- ‘‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন-এর প্রধান আমীরে শরিয়ত মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেন, গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিতর্কিত বিচারপতি গোলাম রব্বানী বলেছেন, ‘‘শারিয়া আইন স্বতঃসিদ্ধ কোন বিষয় নয় বরং সময়ের প্রয়োজনে ও অবস্থার বিবেচনায় এ আইন মানুষের জন্য পরিবর্তন করা যায়। বাংলাদেশে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেবার বিষয়টি স্থানীয় সরকারের সিদ্ধা†š—ই হতে পারে”…...‘‘নাস্তিক বিচারপতি গোলাম রব্বানীকে শাস্তি দিন” - দৈনিক সংগ্রাম ২১ ডিসেম্বর ২০১১। আর ইসলামের নামে ব্ল্যাকমেইলিং? দেখুনঃ- ‘‘সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা পুনর্বহাল না করা পর্য্যন্ত জানাজা বর্জন করার আহ্বান”- সংগ্রাম ০৫ জানুয়ারী ২০১২।


স্রেফ ব্ল্যাকমেইলিং। আমাদের জানাজা পড়ানোর জন্য উনাদের চেয়ে অনেক ভালো মুসলমান আমাদের মধ্যেই বহু আছেন। মনে আছে বেগম সুফিয়া কামালের কথা? কি বলেছিলেন এই মহিয়সী নেত্রী, দেহান্তরের আগে? তর্জনী তুলে বলেছিলেন তিনি - ‘‘ওই মওলানা যেন আমার জানাজা না পড়ায়”। এরই নাম যুদ্ধ, নিজের মৃতদেহকে ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার যুদ্ধ। মতে না মিললেই অন্য মুসলমানকে নাস্তিক-ছোবল দেয়াটা যাদের খাসলত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষাক্ত ছোবল থেকে পার পাননি অতিত-বর্তমানের বহু ইমাম এমনকি ইমাম আবু হানিফা-শাফি-তাইমিয়া-ইবনে হাজম থেকে ইবনে খালদুন হয়ে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী’র মত দরবেশ পর্য্যন্ত (বিখ্যাত বই ‘‘দি ফোর ইমামস্”-আবু যাহরা, মুসলিম-ইতিহাস ও বড়পীর সাহেবের ‘‘ফতহুল গয়ব” কেতাবের মুখবন্ধ) ।


কে মুসলিম? কে নাস্তিক? কি সুষ্পষ্ট আদেশ করেছে কোরাণ নিসা-৯৪-এ? ‘‘যে তোমাকে সালাম করে তাহাকে বলিও না যে, তুমি মুসলমান নও”! রসুল কি আদেশ করেছিলেন তাঁর সাহাবীদের? ‘‘যাও, যারা নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে তাদের তালিকা বানাও” - সহি বুখারী ৪র্থ খণ্ড ২৯৩, ২৯৪। সাহাবীরা বানিয়েছিলেন সেই তালিকা যার মধ্যে নিশ্চয় কিছু মুনাফেকও ছিল কারণ মুনাফেকের উল্লেখ আছে কোরাণে, হাদিসে ও ইতিহাসে। সেই তালিকার ক’জনের দাবী বাতিল করেছিলেন রসুল? কারও না, একজনেরও না। এ থেকে কিছুই কি শিক্ষা নেন নি এইসব ‘‘আমীরে শরিয়ত”-রা ? এত যে উনারা মওদুদি মওদুদি করেন, কি বলেছেন মওদুদি তাঁর ‘‘অন্যকে কাফের বলার নষ্টামি” বইতে? ‘‘অন্যকে কাফের বলা এক মারাত্মক ও ভয়াবহ নষ্টামী। উহারা ইসলামকে খণ্ড -বিখণ্ড করিয়া ফেলিয়াছে। মুসলিমের এত ক্ষতি সম্ভবতঃ আর কোন কারণে হয় নাই যাহা এই একটি কারণে হইয়াছে। কেহ মুসলিম কি না তাহা নির্ধারণ করার অধিকার অন্য কোন মানুষের নাই - তাহা শুধুমাত্র আল্লাহ’র কাছে সমর্পিত”।


ওই কোরাণ-রসুলের নির্দেশেই, ওই সাহাবীদের অনুকরণেই বর্তমানের বাস্তবে নারীদের সমান উত্তরাধিকার আমরা প্রবলভাবে সমর্থন করি। কোরাণ-রসুল-খলীফাদের এই ইসলামি পদ্ধতি বিস্তারিত দেয়া আছে আমার ‘‘শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি” বইতে। সে নির্দেশ লংঘন করে এইসব ‘‘আমীরে শরিয়ত”-রা বিশ্ব-মুসলিম সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। এদের কারণেই তো রসুল বলেছেন - ‘‘আমার উম্মতের জন্য আমার সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারী ইমামদের নিয়া”- সহি ইবনে মাজাহ ৫খণ্ড ৩৯৫২।


এত হুলুস্থুলের কি আছে? উত্তরাধীকারের ব্যাপারে মতভেদ হয়েছে মাত্র, তাই বলে কাউকে খুনের দিকে ঠেলে দিতে হবে? জনাব রব্বানী জন্মসুত্রে মুসলমান। তাঁকে নাস্তিক বলার সাথে সাথে তিনি ওদের দৃষ্টিতে পরিণত হয়েছেন ‘‘মুরতাদ”-এ, শারিয়া আইন মোতাবেক তাঁকে খুন করা অত্যাবশ্যক। মুরতাদকে যে কোন মুসলমান যে কোন জায়গায় খুন করতে পারে এবং খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না - বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড আইন# ৭২ । এরকম হয়েছে মুসলিম বিশ্বে, আদালত মুরতাদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তকে মুক্ত করে দেবার পরে তাকে খুন করেছে হুংকারী কোন মওলানার জঙ্গী চ্যালা-চামুণ্ডা এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দুরের কথা কোনই শাস্তি হয় নি। কিছু মওলানাদের অনুসারীদের মধ্যে ইসলামের নামে নিরপরাধ মানুষ-খুন করার ধর্মোন্মাদ বাংলাদেশে আছে। জনাব রব্বানীর সেরকম কিছু যেন না হয়, হলে সে দায়িত্ব নেবেন তাঁরা ?


স্বয়ং রসুলের কথা অনুযায়ী তাঁরা ভয়াবহভাবে কলমা’র দায়ে পড়ে গেছেন। দেখুনঃ- ‘‘উসামা বিন জায়েদ বলিয়াছে, - ‘যখন আমি ও এক আনসার তাহাকে (মিরদাস বিন নাহিক নামে এ অমুসলিমকে যাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছিল - লেখক) আমাদের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করিয়া পাকড়াও করিলাম তখন সে কলমা উচ্চারণ করিল। কিন্তু আমরা থামিলাম না এবং তাহাকে হত্যা করিলাম। রসুলের নিকট ইহা বর্ণনা করিলে তিনি বলিলেন - ‘কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, উসামা ? আমি বলিলাম - ‘লোকটি শুধু মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচার জন্যই কলমা উচ্চারণ করিয়াছে’। কিন্তু তিনি প্রশ্নটি করিতেই থাকিলেন এবং করিতেই থাকিলেন। তখন আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিলাম আমি আর কখনোই তাহাকে খুন করিব না যে কলমা উচ্চারণ করিয়াছে’। তিনি বলিলেন - ‘আমার (মৃত্যুর) পরেও তুমি এই কথা বলিবে তো?’ আমি বলিলাম - ‘বলিব’- (রসুলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনি “সিরাত” - ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক - পৃষ্ঠা ৬৬৭)। অন্য সুত্র ইমাম হাম্বলের মসনদ ৬ষ্ঠ খণ্ড ২৬০ পৃষ্ঠাতে পাওয়া যায় রসুলের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন - ‘‘তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ?’’ - এথিক্স অফ ডিসএগ্রিমেন্ট ইন ইসলাম - ডঃ ত্বাহা জাবির আল্ আলওয়ানী।


আজ যাঁরা অন্য মুসলমানের ওপরে নাস্তিক-মুরতাদের হুংকার দেন তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছি মওদুদি যে হাদিস উল্লেখ করেছেন - রসুল বলেছেন যখন একজন মুসলমান অন্য মুসলমানকে ইসলাম-ত্যাগী বলে তখন ওই দুইজনের মধ্যে একজন ইসলাম-ত্যাগী। সবশেষে মনে করিয়ে দিচ্ছি রসুলের বড় কষ্টের সেই উচ্চারণ- ‘‘তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ? কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, হে নাস্তিক-মুস্তাদ ঘোষণাকারী?’’

*******************************************************************

লেখক ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, ফ্রীমুসলিমস্ কোয়ালিশন-এর ক্যানাডা-প্রতিনিধি, আমেরিকান ইসলামিক লীডারশিপ কোয়ালিশন-এর সদস্য, দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, হল্যাণ্ড-এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস-এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল’।
 

Print