[আমার বই - "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি"-র একটি অধ্যায়]
হাসান মাহমুদ
ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মহীনতা
কশনারীতে লেখা আছে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ সেকুলারিজম্-এর অর্থ হল এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা যা ধর্মবিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। এর কারণও আছে। হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মীয় রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিতিবিরক্ত জনগণ ঘৃণা ও গণবিক্ষোভের দ্বারা ধর্মীয় রাষ্ট্র উৎখাত করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মের স্থান নেই। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা প্রাচীনকাল থেকে বলেছেন ইবনে রুশ্দের মত দার্শনিকেরাও (উইকিপিডিয়া)। কিন্তু “নিরপেক্ষতা” শব্দের অর্থ যাঁরা বলেন “হীনতা” তাঁরা বলতে চান বিবেকহীন লোক আসলে বিবেক-নিরপেক্ষ লোক, প্রাণহীন দেহ আসলে প্রাণ-নিরপেক্ষ এবং বৃষ্টিহীন মরু আসলে বৃষ্টিনিরপেক্ষ মরুভূমি। কথাটা মতলবি তা ব্যাখ্যার দরকার হয় না।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রত্যেকের মানবাধিকার সুরক্ষিত এবং আইনের চোখে সবাই হুবহু এক তা সে রাস্তা-পরিষ্কারকারী হোক বা দেশের প্রেসিডেণ্ট হোক। অথচ ধর্মরাষ্ট্রে ‘‘রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে আদালতী কার্যক্রম’’ ধারার উদ্ধৃতি দিচ্ছি ঃ- (রাষ্ট্রপ্রধান) ‘‘হদ্দ-এর আওতাভুক্ত কোন্ অপরাধ করিলে (ডাকাতি, চুরি, মদ্যপান, মানুষ-খুন, যৌন-ব্যাভিচার ইত্যাদি লেখক) তাহার বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যাইবে না’’ বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড আইন নং ৯১৪ গ (উদ্ধৃতি শেষ) এবং হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৮৮। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এরকম ভয়াবহ আইন হয় না। তওবা করলেই গণহত্যাকারীর শাস্তি মাফ বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ১৩, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এরকম ভয়াবহ আইনও হয় না। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম মহিলা গভর্নর ডঃ শামশাদ আখতার ব্যাংকের কিছু বিশেষ দলিলে সই করতে পারবেন না এটাও ঘটে ধর্মীয় রাষ্ট্রেই, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এটা কল্পনাও করা যায় না দৈনিক ডন ২৯-০৯-২০০৮ কেউ কেউ বলেন এসবের ব্যাখ্যা আছে। আমরা খুঁজে দেখেছি এসবের কোনোই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই, থাকতে পারে না। তাছাড়া দুনিয়ায় প্রতিটি ধর্মের আলাদা ধর্মীয়রাষ্ট্র হ’লে বিশ্ব-মানবসমাজ ধর্মের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে পারস্পরিক ঘৃণাভিত্তিক মারাত্মক হানাহানির মধ্যে পড়ে যাবে। এসব কারণ ছাড়াও ন্যায় ও যুক্তির আলোকে অসংখ্য মুসলিম কোরাণের ভিত্তিতে ও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে ধর্মে রাজনীতি এবং রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম মেশানোকে প্রচণ্ড ধর্ম-বিরোধী মনে করেন।
ধর্মীয় রাষ্ট্র হাজার হাজার বছর সময় পেয়েছিল নিজেদের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার, এখনো পাচ্ছে কিছু দেশে। কিন্তু কিছু হাতেগোনা শাসকের সময় ছাড়া এর ইতিহাস ভারাক্রান্ত হয়ে আছে জনগণের দুর্ভোগে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে, নারীর অশ্র“ আর রক্তে। ভ্রান্তিময় মানুষ যখন ঐশী ধর্মের মালিক হবার অপচেষ্টা করে তখন এসব হতে বাধ্য। এক ধর্মের ধর্মরাষ্ট্র বানাবার চেষ্টা করলে দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মের আলাদা রাষ্ট্রকে বৈধ ও উৎসাহিত করা হয়। ইউরোপ-অ্যামেরিকা-অষ্ট্রেলিয়ায় ওরা ঈহুদী-খ্রীষ্টান রাষ্ট্র বানিয়ে আমাদের ঘাড়ে ওদের শারিয়া চাপিয়ে দিলে কোটি কোটি মুসলমানের কি দুর্দশা হবে আর তার জন্য কে দায়ী থাকবে ? ভারতের মুসলমানদের জন্য কি সর্বনাশের কথা, মওদুদি ভারতে হিন্দু-রাষ্ট্র সমর্থন করেছেন “যদি সেখানে মুসলমানদের সাথে শূদ্র-র মত ব্যবহার করা হয় তবুও” (মুনির কমিশন রিপোর্ট)। এই কি মওদুদি’র বিশ্ব-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ? কিংবা “যদি সেখানে মুসলমানদের অধিকার থাকে যেমন ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের আছে” (শাহ আবদুল হান্নান আন্তর্জাল আলোচনা ফোরাম)। কথাটা ঠিক নয়। শারিয়া আইনগুলো পড়ে দেখুন, শারিয়া-রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, পাকিস্তান-ইরাণ-নাইজেরিয়ার অমুসলিমদেরকে জিজ্ঞেস ক’রে দেখুন, ভারত ও ইসরাইলে মুসলিমদের জিজ্ঞেস ক’রে দেখুন তাদের সম্মান ও মানবাধিকার কি অন্যায় ও নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করা হয়েছে । এ হবেই কারণ এ না-হলে ধর্মরাষ্ট্রই হয় না। “শারিয়া আইনের উদাহরণ” পরিচ্ছেদে দেখিয়েছি অতীতের হিন্দু-রাষ্ট্রে (মূল নাম সনাতন ধর্ম) কত অন্যায় ও হিংস্র আইন প্রয়োগ করা হতো আবার দিচ্ছি (সূত্র ঃ প্রাচীন ভারত, সমাজ ও সাহিত্য ডঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য্য) ঃ
ক্স বিধবাকে মৃত স্বামীর সাথে পুড়িয়ে মারার আইন (অথর্ববেদ ১৮/৩/৩)।
ক্স “পিতামাতার জন্য কন্যা অভিশাপ” (ঐত্তরীয় ব্রাহ্মণ ৬/৩/১৩)।
ক্স “লাঠি দিয়ে স্ত্রীকে মেরে দুর্বল করা উচিত যাতে শরীরের ওপরে তার কোনো অধিকার না থাকে” (শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/২/১৩)।
ক্স সর্বগুণান্বিতা নারীও অধমতম পুরুষের চেয়ে অধম” (তৈত্তরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
ক্স “পুত্র-কন্যার সামনে স্বামী উপপতœী আনা বা বেশ্যাগমন করতে পারবে কিন্তু স্ত্রীর সামান্য পদস্খলনে সমাজ কঠোর দণ্ড দেবে” (মৈত্রায়নী-র বিভিন্ন আইন ও তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
ক্স “কালো পাখি, শকুন, নেউল, ছুঁচো, কুকুর ও নারী হত্যার প্রায়শ্চিত্ত একই” (আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/৯/২৩/৪৫)।
ক্স “নারীকে অবরুদ্ধ রাখো, নাহলে তার শক্তিক্ষয় হবে” (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪/১/১/৩১)।
ক্স একটি যজ্ঞে “সদ্যোজাত পুত্রকে ওপরে তুলে ধরা হয়, কন্যাকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়” (তৈত্তরীয় সংহিতা ৬/৫/১০/৩)।
ক্স “উত্তম নারী হল ‘যে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্র-সন্তানের জন্ম দেয় ও স্বামীর কথার ওপরে কথা বলে না’ ” (ঐত্তরীয় ব্রাহ্মণ ৩/২৪/২৭)।
ক্স “সন্তান না জন্মালে ১০ বছর পর ও পুত্র না জন্মালে ১২ বছর পর স্ত্রীকে ত্যাগ করা যাবে” (আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/১০-৫১-৫৩)।
ক্স “যার স্ত্রীর চেয়ে পশুর সংখ্যা বেশি সে সৌভাগ্যবান” (শতপথ ব্রাহ্মণ ২/৩/২/৮)।
ভয়াবহ ব্যাপার, কল্পনা করলেও গা’ শিউরে ওঠে। ইউরোপের গীর্জা-রাষ্ট্রের অত্যাচারও ছিল ভয়ংকর।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ঐতিহাসিক শক্তির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তবে তা জাতির দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে। মীর জাফর বা কুইসলিং নাম দ’ুটোর আদি অর্থ ভারী চমৎকার কিন্তু তা এখন এতই ঘৃণিত যে কোন বাঙালি বা নরওয়েবাসী তার ছেলের ও-নাম কোনদিনও রাখবে না। রাজাকার বা আল্ বদর শব্দেরও ওই দশা। বাস্তবে এখন সেকিউলারিজম-এর অর্থও বদলে গেছে আমূল। দুনিয়াময় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো এখন ধর্মের বিরোধী তো নয়ই বরং সাংবিধানিকভাবে সব ধর্মকে রক্ষা ও সহায়তা করে। আমাদের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশন। বায়তুল মুকাররমের সমস্ত খরচ দেয় আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। ইউরোপ-আমেরিকা-ক্যানাডা-অস্ট্রেলিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলোর অজস্র টাকা ও সহায়তায় মুসলিম ইমিগ্র্যাণ্ট, ইসলামি সংগঠন, মসজিদ-মাদ্রাসা, ওয়াজ-মহফিল, রেডিও-টিভি চ্যানেল, এমনকি শারিয়া-ব্যাঙ্ক, শারিয়া-মিউচুয়াল ফাণ্ড, শারিয়া-ইকুয়িটি ইত্যাদি গত কয় দশকে বেড়েছে কয়েক গুণ বললে ভুল হবেবিস্ফোরিত হয়েছে কয়েকশ’ গুণ। কোন ধর্মনিরপেক্ষ সরকার কোটি কোটি দিনার-দিরহামকে বাধা দেয়নি হাজার হাজার মসজিদ ও ইসলামি সংগঠন বানাতে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে শারিয়া’র সমালোচনা নিষিদ্ধ করে ক্রমাগত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে গত বছরগুলো থেকে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী আমাদের দৈনিক থেকেও ঃ
“জার্মানীতেই বর্তমানে আড়াই হাজারের ওপর মসজিদ রয়েছে। সে-দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন তাঁর সরকার জার্মানীতে আরো মসজিদ তৈরি করবে। একই ঘোষণায় তিনি এ’ও জানান, জার্মানীর সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় জার্মান ভাষায় ইসলাম শিক্ষা দেয়া হবে ... এ বোধোদয় ফরাসী প্রেসিডেণ্ট সারাকোজীর মধ্যেও এসেছে ... উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে তিনি ফ্রান্সে ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অর্থ সহায়তা দিতে পারেন। বৃটেন ইতোমধ্যে মুসলমানদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য প্রদান করেছে ... ইতালীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ইতালীয় ইসলামি সংহতকরণ’ নামে ইতালীতে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান চালু করেছেন। এভাবে ইউরোপের প্রায় সব দেশই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে” (ইউরোপ ও ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্ত ২৩শে জুলাই, ২০০৮)।
আমেরিকার ডলারে লেখা নেই “ইন্ গড উই ট্রাস্ট”? হ্যাঁ, লেখা আছে। আদালতগুলোতে বাদী-বিবাদীকে ধর্মীয় শপথ নিতে হয় না ? হয়। সাংসদ ও রাষ্ট্রপ্রধানকে ধর্মীয় শপথ নিতে হয় না ? হয়। ক্যানাডায় সাংবিধানিকভাবে ক্যাথলিক স্কুলে প্রচুর সরকারি টাকা যায় না ? যায়। সমস্ত ধর্মীয় স্কুলে সরকারি আর্থিক অনুদানের প্রস্তাব করেনি এক রাজনৈতিক দল ? করেছে। বিলেতের সরকার রাষ্ট্রীয় ট্রেজারি থেকে শারিয়া-বণ্ড বাজারে ছাড়েনি ? ছেড়েছে। আমেরিকার ট্রেজারী ইসলামি ব্যাঙ্কিং-এর অনুমোদন দেয়নি ? দিয়েছে। আমেরিকার সরকারি প্রতিষ্ঠান এ-আই-জি শারিয়া-ব্যাঙ্কিং অনুমোদন দেয়নি ? দিয়েছে। লণ্ডনের বিশাল মসজিদের জন্য দশ কোটি পাউণ্ড সরকারি অনুদানের প্রস্তাব ছিল না ? ছিল, সে ই-মেল আমরা পেয়েছি। জার্মানীর কোলন-এ বৈধভাবে সুবিশাল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে না ? হচ্ছে। বিলেত ও জার্মানী তাদের আইনে মুসলিম নাগরিকদের জন্য বহুবিবাহের কিছু উপাদান গ্রহণ করেনি ? করেছে। লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিল আটত্রিশ হাজার পাউণ্ড অনুদান দেয়নি কর্ডোভা ফাউণ্ডেশনকে ? দিয়েছে। সরকারগুলো পুলিশ দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধান করে না ? করে। বেলজিয়ামের ব্রাসেল্স্ শহরে সরকার শারিয়ার বিরুদ্ধে মিছিল নিষিদ্ধ করেনি ? করেছে। এক টরণ্টো শহরেই রেজিস্টার্ড ইসলামি সংগঠন নেই একশ’ একুশটা ? আছে। অনানুষ্ঠিানিক আরো কয়শ’? আছে। ইংল্যাণ্ডে জার্মানীতে ফ্রান্সে প্রায় সাত হাজার বৈধ ইসলামি সংগঠন নেই ? আছে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো সাধারণত বিশাল জমির ওপরে বিরাট দালান হয়, অনেক দেশে সাংবিধানিকভাবে সেগুলোর সম্পত্তি-কর ও পানি-বিজলির কর মওকুফ করা হয় না যার পরিমাণ বিপুল ? হয়। সরকারগুলোর ক্ষমতা নেই এগুলোর প্রত্যেকটি বন্ধ করার ? আছে, কিন্তু করেনি। এরই নাম ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীন বা ধর্মবিরুদ্ধ বলাটা প্রতারণামূলক অকৃতজ্ঞতা।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় কিছু ত্র“টি অবশ্যই আছে যেমন এর ভেতর থেকেই বুশ-ব্লেয়ার-এর মত গণহত্যাকরী দানব উঠে এসেছে, কিংবা দুর্নীতি, অস্ত্র ও পেশীশক্তির কারণে অনেক দেশে জনগণ ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারে না, ইত্যাদি। কিন্তু বহু দেশে এটা অত্যন্ত সফলও, সময়ের বিবর্তনে জনগণের শিক্ষা-সচেতনতায় ত্র“টিগুলো কেটে যাবে।
ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ইহুদী-খ্রীষ্টানদের পাদ্রী-রাবাইরাও বানায়নি, গীর্জাতেও বানানো হয়নি। ওগুলো সংসদে বসে বানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা যাঁরা আধুনিক বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত, বাইবেল-এ নয়। সমাজ-বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধানকে সংসদে বসে পরিবর্তন করছেন জনগণের নির্বাচিত সাংসদেরাই, গীর্জার পাদ্রী-রাবাইরা নন। ঠিক যেমন বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বহু কষ্টের গবেষণায় বানিয়েছে বহু ওষুধ যা আমাদের প্রাণ রক্ষা করে বা দালান-ব্রিজ-কারখানা ও শিল্পায়নের প্রযুক্তি দেয়। তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি “ইহুদী-খ্রীষ্টানদের শয়তানি ষড়যন্ত্র” ও “কুফরি আকিদা” হয় তবে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের আবিষ্কৃত টুথব্রাশ চিরুণি থেকে শুরু করে বক্তৃতার মাইক বাস ট্রাক কাপড় হিটার এয়ারকণ্ডিশনার জুতো মাথাব্যথার ট্যাবলেট বুড়ো বাবা-মা’র ইনসুলিন কম্পিউটার রেডিও টিভি গাড়ি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি হাজারো ওষুধসবই “ইহুদী-খ্রীষ্টানদের শয়তানি ষড়যন্ত্র” এবং “কুফরি আকিদা” হতে হয়।
যেখানে মানুষের জীবন ঘিরে আছে হাজারো ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করাটা অজ্ঞতা বা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কি হতে পারে আমি জানি না। “নিরপেক্ষতা” শব্দের অর্থ ”হীনতা” করলে মিথ্যাকে জায়েজ করা হয়। এই মিথ্যার সাথে যোগ হয়েছে, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাক্ষ্য গোপন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হইয়াছে” বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩১। বলাই বাহুল্য, এই “কোনো কোনো ক্ষেত্র”-টা আসলে কি তার তালিকা দেয়া হয়নি। তাই এ-উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র, জঙ্গীতন্ত্র, বিদেশ থেকে গোপন অর্থ-সমাগম, গোপন অস্ত্রশিক্ষা, গোপন জঙ্গীসাহিত্য ইত্যাদি জানার পরেও “সাক্ষ্য গোপন রাখার উৎসাহ প্রদান করা হইয়াছে”। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ওরকম আইন হয়না, সেখানে হয় “তোমরা সাক্ষ্য গোপন করিও না” বাকারা ২৮৩, মায়েদা ১০৬, ইমরাণ ১৬১ ইত্যাদি।
এর সাথে এটাও দেখা দরকার “যদি উদ্দেশ্যটি বাধ্যতামূলক হয় তবে মিথ্যা বলা বাধ্যতামুলক” শাফি আইন নং আর.৮.২ ইত্যাদি। অর্থাৎ যিনি ধর্মীয় রাষ্ট্রকে বাধ্যতামূলক মনে করেন তাঁর জন্য এ উদ্দেশ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা, এই মিথ্যা বলাও বাধ্যতামূলক।
“মিথ্যা বলা বাধ্যতামুলক” আইনও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হয় না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হয় “মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকো ... সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না” সুরা হজ্ব ৩০ এবং বাকারা ৪২।
সে নির্দেশ লঙ্ঘন করলে কি হবে ?
“তাদের মিথ্যাচারের দরুণ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আজাব” বাকারা ১০ ॥