সচেতন মুসলমানের চিন্তা এখন দুশ্চিন্তায়,দুশ্চিন্তা উদ্বেগে ও উদ্বেগ আতংকে পরিণত হয়েছে। সরকার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন পাশ করতে যাচ্ছে। এখন কে কোন মতলবে বা কার কোন কথায় "উফ!বড্ড লেগেছে !!" বলে চীৎকার করে উঠবে আর সেই হ্যাপা আদালতকে সামলাতে হবে,কত নিরপরাধের সর্বনাশ হবে কে জানে। আপাত:দৃষ্টিতে আইনটা আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু এর ছোবল কি বিষাক্ত,সাধারণ মানুষকে এর জন্য কি চরম মূল্য দিতে হয় এবং এপথে চলে অন্য দেশের কি সর্বনাশ হয়েছে তা জানা জাতির অত্যন্ত দরকার। পাকিস্তানে এ আইন আছে। লাহোরে গরীব খৃষ্টান মেথরপট্টির বছর তেরোর এক মেয়ে কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী - ভালো করে হাঁটতেও পারে না। সে বাসার ময়লা পোটলায় করে রাস্তার ময়লার জায়গায় ফেলে এল,মওলানা সেই পোটলা খুলে তাতে পুড়ে যাওয়া কিছু কোরানের পৃষ্ঠা পেল । কেয়ামত নেমে এল মেথর পট্টিতে। হুংকারী মওলানার নেতৃত্বে সগর্জনে ছুটে এলো "তৌহিদী" জনতা -এখন ব্ল্যাসফেমী আইনে মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া নেমে আসবে ওদের ওপর। কেউ ভেবেও দেখল না গরীব অশিক্ষিত খ্রীষ্টান মেথরের বাসায় কোরাণ আসবেই বা কেন, বালিকা সেটা পোড়াতেই বা যাবে কেন,আর মওলানা সেই ময়লার পোটলা খুলতেই বা যাবে কেন। পুড়ে ছাই হয়ে গেল গরীবের বসতি -পুরো খ্রীষ্টান সমাজ ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে কোথায় গেল কে জানে। পরে তদন্ত-রিপোর্টে জাতি আকাশ থেকে পড়ল, মওলানাই ওটা সাজিয়েছে ওদের জমি দখল করার জন্য।
এ হল হাজারটার একটা। কেউ ইসলাম নিয়ে,আল্লাহ ,রসুল (দ:)বা কোরাণ নিয়ে খারাপ কথা বলেছে -তার চারজন সাক্ষী থাকলেই ব্যাস, পুলিশ তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য -বিচারক শাস্তি দিতে বাধ্য। আমাদের মত দুর্নীতিপরায়ণ দেশে টাকা থাকলে চারটে কেন চল্লিশটা "চাক্ষুষ" সাক্ষী জোগাড় করা ডালভাত যারা আদালতে হলফ করে বলবে তারা নিজের কানে অমুককে ইসলাম, কোরান বা রসুল(দ")-এর বিরুদ্ধে এই এই কথা বলতে শুনেছে। অভিযুক্তের কি মহা সর্বনাশ হবে তখন? পাকিস্তানে ব্যবসার,জমিজমার,প্রেমের কিংবা স্রেফ ঝগড়ার কত হাজার প্রতিপক্ষ এই আইনের পাল্লায় পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে কে জানে, আমার জাতি এখন সেই মর্মান্তিক নিয়তির সম্মুখীন।
আইন হল যুক্তিতর্ক ও সাক্ষী-প্রমাণের ব্যপার, আইনকে হতে হয় স্বচ্ছ ও প্রমাণযোগ্য। ধর্মানুভুতি আবেগের ব্যাপার -কে কার কোন কথায় কতখানি "আঘাত" পাবে সেটা মাপা বা প্রমাণ-অপ্রমাণ করাও অসম্ভব। আবেগের স্বচ্ছতা মুরগীর দাঁতের মতই অসম্ভব, তাছাড়া কোটি কোটি মানুষের মতামতের মধ্যে সংঘাত হবেই। যা দেখা যায় না প্রমাণ করা যায় না তার ওপরে আইন বানালে তার অপপ্রয়োগ হতে বাধ্য। মওলানাদের মধ্যে চিরকালই প্রচুর সংঘাত আছে,সেটা কত ভয়ংকর হতে পারে তার প্রমাণ দিচ্ছি।
১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে মৌদুদী'র চটি বই "দি কাদিয়ানী প্রবলেম" মানুষকে আহমেদী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার ফলে লাহোরে তিন দিনে পনেরো হাজার আহমেদীকে গণহত্যা করা হয়। এতে মৌদুদীর ফাঁসীর শাস্তি হয়,পরে সৌদি যুবরাজের অনুরোধে প্রেসিডেন্ট মৌদুদীকে ক্ষমা করেন। তখন সরকার চীফ জাস্টিস মুনীরের অধীনে "মুনির কমিশন" গঠন করেন যার কাজ হল ইসলাম কি তা ঠিক করা। কমিশন দেশের সর্বোচ্চ মওলানাদের সাথে আলাদাভাবে বছর তিনেক আলোচনা করে ৪০২ পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করেন। তার ২২৭ পৃষ্ঠায় আছে। "ইসলাম কাকে বলে" সে ব্যাপারে এই মওলানাদের মতামত এতই পরস্পরবিরোধী যে এঁদের যে কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হলেই ব্যাস, তিনি মুরতাদ হুঙ্কারে বাকী প্রত্যেকের কল্লা কেটে ফেলবেন। দেশে সাধারণ মানুষকে তো বটেই, মওলানারা কি এখন একে অপরকেও নাস্তিক মুরতাদ বলে গালাগালি করছেন না? এই জগঝম্পের মধ্যে ওই মারাত্মক আইন !! জাতি একটা গভীর গাড্ডায় পড়ল- জামাত এখন অট্টহাসী হাসছে নিশ্চয় ! সরকার জাতিকে কয়েকশ' বছর পিছিয়ে দিল।
গত ৬৫ বছরে জামাত যার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও করতে পারেনি তা আওয়ামী লীগ এক ঝটকায় করে ফেলল। এ হল ওয়ান ওয়ে লেন,এ আইন একবার পাশ হলে আর ফেরানো যায় না।
হাসান মাহমুদ
০৪ এপ্রিল ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)