আ-লীগের ইসলামি রাজনীতি

সেপ্টেম্বর ২০১২

নারী-নীতি বাস্তবায়নের ইসলামি রাজনীতিতে আ-লীগ হাড়ভাঙ্গা আছাড় খেল। খেলার নিয়ম না জেনে খেলতে গেলে এরকমই হয়। সুশীল সমাজ, বিচার বিভাগ ও সাংস্কৃতিক সমাজের সমর্থন, প্রবল-নির্বাচন বিজয়, ইসলাম-ব্যবসায়ীদের প্রতি জাতির চরম বিতৃষ্ণা, জাতির প্রবল আধুনিকায়ন, উদীয়মান নারীশক্তি এসব প্রগতিশীল শক্তির ওপরে আ-লীগ আস্থা রাখেনি। নারীনীতি-বিরোধী ইসলাম-ব্যবসায়ী জামাত ও আমিনী দলকে ঠেকাতে সে আরেক ইসলাম-ব্যবসায়ী ইনকিলাবী দলকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন করেছে, এমনকি সরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা ওই আমিনী দলেরই দাবী। অথচ বাংলাদেশে একটা বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। বসতে পাবার সাথে সাথে ইনকিলাবি দল শোবার অধিকার দাবী করেছে, সরকারী ফতোয়া বোর্ড গঠন করতে হবে (সম্পাদকীয় ১৪ই মে ২০১১)।  

শারিয়াপন্থীদের আরেকটা কৌশল হলো তারস্বরে চিৎকার করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা যেমন আমরা আগে বাঙালি না মুসলমান ইত্যাদি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করার অপচেষ্টাও আছে।  অথচ কারামুক্তির পর বাংলাদেশে আসার আগে বঙ্গবন্ধু প্রথমে লন্ডনে যান - সেখানে এই ইন্টারভিউয়ের ১ মিনিট ১২ থেকে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন- "দি আল্টিমেট এচিভমেন্ট অফ দিস স্ট্রাগল ইজ ক্রিয়েশন অফ এন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সভরেইন পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ" :-  https://www.youtube.com/watch?v=2Gi5VkMxLsA

অনেক আগেই একইরকম আরেক দাবী উঠেছে যে বায়তুল মুকারমের খতিবকে প্রধান বিচারপতি’র মর্যাদা দেয়া হোক- ১৩ জুলাই ২০০৮। আরেকটু চাপে পড়লে আ-লীগ ওদের ওই দাবীগুলোও পুরণ করে ফেলতে পারে। ওরা অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিশ্চয় কারণ ওদের চালই হল সরকারের ওপরে নারীবিরোধী এক দলের চাপ প্রয়োগ করে নারী-বিরোধী অন্য দলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীবিরোধী এজেণ্ডার বাস্তবায়ন। ওদের অন্য এজেণ্ডা হল বায়তুল মুকাররম, ইসলামি ফাউণ্ডেশন ইত্যাদির মত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতিয় ফতোয়া বোর্ড ইত্যাদি সরকারী সংগঠন বানিয়ে সেগুলো দখল করা। সেই সাথে অসংখ্য মাদ্রাসা এবং ইসলামের নামে ব্যাংক, ইন্সিয়োরেন্স, হাসপাতাল, এনজিও ইত্যাদি অজস্র বেসরকারী সংগঠন তো আছেই যেগুলোর প্রায় সবই ওদের দখলে। সামরিক বাহিনী ও সরকারী পদেও ওদের সমর্থক কম নেই। সব মিলিয়ে আমাদের এখন কি আরেকটা পাকিস্তান, ইরাণ, মিসর বা আফগানিস্থান হবার অপেক্ষা ? বিশেষ করে ওরা যেখানে নামাজ বাধ্যতামূলক আইন না বানালে সামরিক অভ্যুত্থানের উস্কানী দিয়ে রেখেছে? (ইনকিলাব ২৩ মে ২০০৭)

মুখে যাই বলুক সামরিক স্বৈরশাসন ওদের খুব পছন্দ। জনগণের ম্যান্ডেট ওরা কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেনা তা ওরা ভাল করেই জানে। তাই অন্যের দ্বারা নিজেদের এজেণ্ডা বাস্তবায়নই ওদের সফল পদ্ধতি। রাজনৈতিক সমর্থনের ঘুষ হিসেবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বৈরশাসক জিয়াউল হক, জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও বি-এন-পি ওদের উপহার দিয়েছে রাজনৈতিক বৈধতা, শারিয়াভিত্তিক সংবিধান, সংবিধানে ইসলামি শব্দাবলী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা। এখন আ-লীগও সেই কাতারে সামিল হল, কাজেই ওদের আর সরাসরি ক্ষমতায় যাবার দরকারই নেই।

কিন্তু আ-লীগ বোঝেনা সে যতই টুপি-দাঁড়ি-হিজাব পরুক, যতই হজ্জ্ব ওমরাই করুক, যতই তসবি-টেপা ছবি ছাপুক ইসলামি হবার প্রতিযোগিতায় আমীনি-ইনকিলাবীদের সামনে সে কখনোই টিকতে পারবে না। ওরা পরষ্পরের ফেইথ-কাজিন, সময়মত আমের শাঁস ও দুধ ঠিকই পরস্পরের সাথে মিলে যাবে আর আঁটিটা অর্থাৎ জাতি সহ আ-লীগ শুধু দুরে নিক্ষিপ্তই হবে না বরং ওরা একযোগে সবার ওপরে ঝঁপিয়ে পড়বে। গালগল্প নয়, এটা অন্যান্য দেশে হয়েছে। আ-লীগ বোঝেনি যে ইনকিলাবিরা আমীনিদের চেয়ে কম নারীবিরোধী নয় এবং ওরা কখনোই নারীনীতি সমর্থন করবে না। ওদের চরম নারী-বিরোধীতার প্রমাণ আছে ওদের দৈনিক ইনকিলাবেইঃ-

(১) ‘‘ইসলামে নারীদের যথার্থ মর্যাদা দেয়া হয়েছে কিন্তু পুরুষদের সমমান দেয়া হয়নি। নারীদের পুরুষের অধীন করা
হয়েছে’’ - ১২ নভেম্বর ২০০৫।

(২) নারীরা জাতির অর্ধেক অথচ রাজনীতিতে নারীর ৩৩% আসন শরিয়ত-বিরোধী - ২৬ মে ২০০৭।

(৩) গায়িকা ও নারী-আবৃত্তিকার নিষিদ্ধ - ০৫ জুলাই ২০০৮।

(৪) নারীদের বিপক্ষে অবস্থান ও নোংরা ভাষায় গালাগালি - ২৩শে জুলাই ২০০৮, ০৩ ডিসেম্বর ২০০৫, ১১ ও ২২ জুলাই ২০০৫, ২৮ আগষ্ট ২০০৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৫, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০০৫, ৩০ ডিসেম্বর ২০০৫(?), ১৫ সে প্টেম্বর ২০০৭.

(৫) নারী-নীতিমালার বিপক্ষে খোলাখুলি শক্ত অবস্থান - ১৯ মে, ২০০৬, ১৪ মার্চ ২০০৮

(৬) নারীরা শুধুমাত্র নারী সংক্রান্ত বিষয়ে আইনবিদ হতে পারবেন, তাও অভিভাভকের সম্মতিক্রমে – ০৮ মার্চ ২০১০।

(৭) নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হোক, এ প্রস্তাব - ১৩ জুলাই ২০০৮

অজস্র উদাহরণের লম্বা তালিকা। নিজেদের মধ্যে কিছু অন্যান্য বিরোধ থাকলেও সব ইসলাম-ব্যবসায়ীদের তাত্ত্বিক লক্ষ্য এক, তা হল শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আমার বই ও অজস্র নিবন্ধে আমি দলিল-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছি সেই লক্ষ্যে বিরোধীপক্ষকে মিথ্যা বলে ঠকানো এমনকি হত্যা করা পর্য্যন্ত ওদের শারিয়া আইন ও অপদর্শনে শুধু জায়েজ নয় বরং ওদেরই ভাষায় একেবারে ‘‘বাধ্যতামূলক’’। একাত্তরে নিজের জাতির ওপরেই জামাতের কসাইপনা কিংবা এখন মুখমিষ্টি কথায় আ-লীগকে ঠকানো কোন বিচ্ছিন ঘটনা নয়, এর শেকড় আছে ওদের অপধর্মতত্ত্বেই। আ-লীগের জানা দরকার রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মব্যবসায়ীকে মাথায় তুলে শেষ পর্য্যন্ত কেউ পার পায় নি, জাতির সুশীল-সাংস্কৃতিক সমাজ ও নারীদেরকে তার চরম মূল্য দিতে হয়েছে। পাকিস্তান, ইরাণ, আফগানিস্থান মিসর তার প্রমাণ। বাংলাদেশে ওদের কৌশল ধুর্ত, দক্ষ এবং রাজনীতি-নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকলে তো ভালই কিন্তু না থাকলেও দেশকে ক্রমশঃ ওরা সফলভাবেই শারিয়া-রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ওদের শত শত একাগ্র, কর্মতৎপর ও ধনী সংগঠন জাতির চোখের সামনে ধরে রেখেছে শুধুমাত্র ওদেরই ইসলামি-ব্যাখ্যা যা নারী-বিরোধী শারিয়াভিত্তিক রাজনৈতিক ইসলাম। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা আছে যার প্রায় প্রতিটিতে পড়ানো হয় নারী-বিরোধী শারিয়াভিত্তিক রাজনৈতিক ইসলাম। তারা ইসলামের নামে অসংখ্য নারী-বিরোধীর জন্ম দিচ্ছে। দশ বছরে এ সংখ্যা যা দাঁড়াবে তার প্রচণ্ড প্রভাব জাতি এড়িয়ে যেতে পারবে না। এইসব ছাত্ররা প্রায়ই যোগ দেয় সরকারী চাকুরীতে ও সামরিক বাহিনীতে। প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করার জন্য তাদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে খবর উঠেছে। 

ওদের আছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান মসজিদ, প্রতি শুক্রবারে জনতাকে প্রভাবিত করার সুযোগ যা তারা পুরোটাই নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও নেবে।

মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী দেশে বানিয়েছেন অসংখ্য মাদ্রাসা। এটা শারিয়াপন্থীদের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। সে পরিকল্পনা এখন বেশ সফল, এক নিমেষে বহু হাজার যুদ্ধংদেহী তরুণকে রাস্তায় নামানোর প্রচণ্ড ষ্ট্রীট পাওয়ারের অধিকারী ওরা। এ বাহিনী আগামী বছরগুলোতে অনেক বাড়বে এবং সর্বত্র এর চাপ অনুভুত হবে। এ চাপ ঠেকানোর পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে অনুপস্থিত।

ওদের আছে নিজস্ব দলীয় পত্রিকা - এবং সেগুলোতে ইসলামের নামে গোয়েবল্সীয় পদ্ধতিতে প্রচারিত হচ্ছে শারিয়া-প্রচার। পক্ষান্তরে ইসলামি দলিলের ভিত্তিতে ওদের প্রচারণার ভিত্তিহীনতা, কোরাণ-বিরোধীতা, ইসলাম-বিরোধীতা ও অসততাকে তুলে ধরার তেমন কোন পত্রিকা নেই। চেষ্টা করে দেখা গেছে অনেক পত্রিকা এসব দলিল জাতির সামনে তুলে ধরতে ভয় পায়।

শারিয়াপন্থীদের আর একটা বিরাট সাফল্য হল এরা জনগণ, সরকার, মিডিয়া, টিভি-রেডিয়ো-সংবাদপত্র প্রকাশনা সহ সারা জাতিকে ভয় পাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। এটা আরো বাড়বে বৈ কমবে না।

অসংখ্য মওলানা-মুফতি-মোল্লা নিয়ে দেশজুড়ে যে অনিয়ন্ত্রিত আলেম-সমাজ গড়ে উঠছে তাঁদের প্রায় সবাই নারী-নীতির বিরোধী। এঁদের যোগ্যতার কোন দৃশ্যমান মাপকাঠি নেই, জাতির বা সরকারের কাছে জবাবদিহিতাও নেই। এঁদের বেশীরভাগই আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার কিছুই জানেন না কিন্তু অবলীলায় বিশ্বের তাবৎ সমস্যার ইসিলামী সমাধান পেশ করে থাকেন। নিজামী-মুজাহিদী’র মন্ত্রিত্বের ঘুষবিহীন সামান্য শাক দিয়ে অপদর্শনের সে বিশাল মাছ ঢাকা যাবে না। ক্রমাগত দুর্বল সরকারের সুযোগে তাঁরা ধীরে ধীরে সরকারী নীতির নির্দেশক হয়ে উঠছেন এবং আরও উঠবেন। তাঁদের সিদ্ধান্েতর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করলে সামাজিক দিক দিয়ে নেমে আসবে ‘‘মুরতাদ’’ ফতোয়ার খড়্গ ও ক্যাডারদের হুমকি-অত্যাচার। কারো সাধ্য হবেনা তা প্রতিরোধ করার। সরকারে প্রত্যক্ষভাবে থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলেও কিংবা আংশিকভাবে থাকলেও তাঁরা এক অদৃশ্য সরকার চালাবার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। এর মধ্যেই বিভিন্ন ব্যাপারে সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বায়তুল মুকাররমে গিয়ে গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা তাঁরা ইমাম-খতিবদের ডেকে সেক্রেটারিয়েটেই নিতে পারতেন। এভাবে সুযোগ দিতে থাকলে ইরাণের শুরায়ে নিগাহ্বান-এর মত বায়তুল মুকাররমকে ছায়া-সংসদ করে তোলা হবে, কোন সরকার সেটা ঠেকাতে চাইবে না বা চাইলেও পারবে না।

আমাদের বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজও সুশীল বালকের মত ইসলামকে ব্যাখ্যা অধিকার ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। তাঁরা বিশ হাজার পৃষ্ঠার বই পড়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অর্থনীতিবিদ হবেন কিন্তু দশ হাজার পৃষ্ঠার ইসলামি দলিল পড়ার সময় নেই। তাঁরা ভোগেন ভয়ংকর অহংরোগ, গর্ব, একগুঁয়েমী, ‘‘একলা চলো’’ নীতি ও সাংগঠনিক ব্যর্থতায়। টাকার জোর বা আন্তর্জাতিক সমন্নয়ও তাঁদের নেই।

২০০৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট-এ জামাত ঘোষণা দিয়েছে দেশ জুড়ে মহাশারিয়া কোর্টের জটাজাল বানানো হবে। গ্রাম উপজেলার নিয়ন্ত্রনে, উপজেলা জেলার নিয়ন্ত্রনে, এভাবে আটষট্টি হাজার শারিয়া-কোর্টের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের খতিবের হাতে। অর্থাৎ আটষট্টি হাজার শারিয়া-কোর্টের জালে মাছের মত আটকে যাবে দেশের ভবিষ্যৎ। সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে কিন্তু সম্ভবতঃ এর নাম দেয়া হবে ইসলাম পরামর্শ ব্যবস্থা, মানুষ ইচ্ছে হলে নিক ইচ্ছে না হলে না নিক্! ওদিকে টহল দিয়ে বেড়াবে বেসরকারী শারিয়া-পুলিশ, ‘‘স্বেচ্ছাসেবক’’ নাম নিয়ে। গালগল্প নয়, অন্যান্য শারিয়া-দেশে নামাজ-রোজা-দাঁড়ী-বোরখা নিয়ে ভয়াবহ দোজখ সৃষ্টি করেছে এই হিংস্র শারিয়া-বাহিনী। কেউ শারিয়া কোর্টে না গিয়ে দেশের কোর্টে গেলেই ছুটে আসবে মুরতাদ-ফতোয়ার চাবুক। স্বাধীন-চিন্তা ও ভিন্নমতের ওপরে নেমে আসবে ব্ল্যাসফেমি আইনের খÍগ, জনগণের সাধ্য হবেনা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। বন্ধু তো দুরের কথা ভাই ভাইয়ের কাছেও মন খুলে কথা বলতে ভয় পাবে মানুষ। গল্প নয়, এরকম হয়েছে অন্যান্য দেশে।

ভেতরে ভেতরে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আ-লীগের উচিত নারীনীতি কেন ইসলাম-সমর্থিত, এর বিরোধীতা কেন ইসলাম-বিরোধী, অন্যান্য মুসলিম দেশে মওলানাদের সমর্থনে কি ইসলামি পদ্ধতিতে সাংবিধানিকভাবে নারীনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে ব্যাপারে কিছু পড়াশুনা করা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।

এটা এখনও সম্ভব এবং এর বিকল্প নেই।

একটানা কয়েক দিন হরতাল হয়ে গেল। বাস-গাড়ী পুড়ল, নাটোরে ছ’জনের পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী মোশারফকে আমের ট্রাক বের করার অপরাধে হরতালকারীরা পুড়িয়ে মারল – ডেইলি ষ্টার ১২ জুলাই ২০১২। ঢাকার হরতালে পুলিশের প্রতি উচ্চপদ রাজনীতিকের স্কুল-কলেজ মার্কা উষ্কানী-মাস্তানী এবং প্রতিদানে পুলিশের ন্যাক্কারজনক বর্বরতাও আমরা ইন্টারনেটে দেখলাম। এই তান্ডব দেখে ধর্মদুর্বৃত্তদের হরতালে আতংকিত নেতাদের পালিয়ে থাকা এবং ‘‘হরতালে যোগ না দিলে বৌ তালাক হয়ে যাবে’’ এ ফতোয়াও দেখা গেল - জনকন্ঠ ১১ জুলাই ২০১২। গুরুত্বপুর্ণ ইমপ্যাক্ট হল, পুলিশের পৈশাচিকতায় বিএনপি’র ‘‘অত্যাচারিত’’ ভাবমুর্তি প্রতিষ্ঠিত হল যদিও তাদের আমলেও এরকম হয়েছে। রাজনীতিতে ‘‘অত্যাচারিত’’ ভাবমূর্তি এক শক্তিশালী অস্ত্র, যা আমরা বাহান্নোতে দেখেছি বরকাত-সালামের রক্তে, উনসত্তরে দেখেছি আসাদের রক্তমাখা সার্টে। বিদেশেও এর অজস্র উদাহরণ আছে। আতংকের কথা হল, রাজনৈতিক হিংস্রতা যেভাবে বেড়ে গেল তাতে ওরা ক্ষমতায় এলে আ-লীগ ও সুশীল সমাজের ওপরে কেয়ামত নেমে আসবে। আ-লীগ ইসলামি রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানে না কিন্তু তাতে লম্ফ দিয়ে পড়েছে। ফল হয়েছে মারাত্মক।

হিংস্রতা ধর্মের ছদ্মবেশে সরকার কব্জা করতে চেষ্টা করবে এটা দূর অতীতে হলেও সাম্প্রতিক ইতিহাসে হয়নি। সে অভিজ্ঞতার অভাবে কোনো রাষ্ট্রের সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা নেই। যেসব দেশে ধর্মীয় রাজনীতি বৈধ সেসব সংবিধান বহু আগে তৈরী। বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র যেখানে সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল - মুক্তিযুদ্ধে ধর্মদুর্বৃত্ত ইসলাম-ব্যবসায়ীদের কসাইপনার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ফলে।

ঔপনিবেশিক আমল শেষে গুরুত্বপুর্ণ মুসলিম দেশগুলো স্বাধীনতা পাবার সময় পাকিস্তানের জিন্নাহ, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণো, মিসরের নাসের ও ইরানের ড. মোসাদ্দেক সবাই দেশে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করেন। তুরষ্কের কামাল পাশাও ১৯২৪ সালে খেলাফত উচ্ছেদ করে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করে সামরিক বাহিনীর ওপরে তা রক্ষা করার ভার দিয়ে যান। অথচ আজ ওই দেশগুলো শারিয়াবাজদের কব্জায় নিষ্পেষিত। পাকিস্তান মিসর নাইজিরিয়া ইতোমধ্যেই ধর্মীয় উগ্রদেশে পরিণত হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া সহ পুরো মুসলিম বিশ্ব সেপথে ধাবমান। এতগুলো জাতির একই সর্বনাশ হল কারণ একটাই - জনগণকে মওদুদিবাদের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষিত করার বদলে সংবিধান ও সামরিক বাহিনী দিয়ে মওদুদিবাদ রোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা। আ-লীগের উচিত দলের কাউকে এ ব্যাপারে উচ্চশিক্ষার্থে তাতারস্থানে পাঠানো। তাতারস্থানের প্রধান ইমাম সৌদি থেকে টাকা নিয়ে মসজিদ ইত্যাদি বানিয়েছেন কিন্তু সৌদি-শিক্ষিত ইমামদের ওয়ালেকুম সালাম বলে বিদায় করেছেন। তিনি জাতিকে মওদুদিবাদের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষিত করেছেন, - জাতিই এখন মওদুদিবাদের বিরুদ্ধে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে এটা না হলে আমরা পাকিস্তান হয়ে যেতে পারি।

সংসদে সংবিধানও পাশ হয়ে গেল - ধর্মনিরপেক্ষতা থাকল, ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হলনা এবং ইসলামি শব্দাবলী থেকে গেল। অর্থাৎ ‘‘কিছুটা বাংলাদেশ, একটু ইসলাম-ব্যবসা ও ইকটু পাকিস্তান’’, এই জগাখিচুড়ি হল। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবার হৈ হৈ নির্বাচনী ওয়াদার বজ্র আঁটুনিও ফস্কা গেরো হল। খুব সম্ভব আ-লীগ শারিয়াবাজদের সাথে সমঝোতা করেছে বাধ্য হয়ে। এক অসমর্থিত খবরে দেখলাম ওরা অপেক্ষায় ছিল, সুযোগ পেলেই দেশে মসজিদ-ভিত্তিক আন্দোলনের ঝড় তুলত বিশেষ করে শুক্রবারে জুমা নামাজের পর। খবরটা সত্যি হলে আ-লীগ নিজের ও জাতির পায়ে কুড়াল মেরেছে কারণ একবার ওদের চাপে পিছিয়ে গেলে ওদের মনোবল দশগুণ বেড়ে যায়। আমরা তো একাত্তর থেকেই মসজিদের মত শক্তিশালী সংগঠন ওদের হাতে ছেড়ে রেখেছি। আমাদের ধর্মদুর্বৃত্তরা মধ্যপ্রাচ্যের সৃষ্টি, সে চাপ আছে। ওবামা-সরকার আল কায়েদাকে ঠেকাতে মুসলিম ব্রাদারহূডের (বিশ্ব-জামাতের অপর নাম) সাথে হাত মিলিয়েছে, বাংলাদেশেও সে এটা দেখতে চাইবে। আ-লীগের সৈয়দ আশরাফ মিনমিন করে বলেছেন আগামী নির্বাচনে তাঁরা ক্ষমতায় গেলে বাহাত্তরের সংবিধান প্রতিষ্ঠা করবেন - ০৩ জুলাই জনকন্ঠ । এই রাজনীতিকেরা জাতিকে গর্দভ মনে করেন। সংসদে ৩৪৫ আসনের ২৯১ আসন পাওয়ার পরেও তাঁরা যা করতে পারেনি তা আর কখনোই পারবেন না, ওই নির্বাচন-বিজয় তাঁদের জন্য ‘‘অ্যাক্সিডেন্ট অফ হিষ্ট্রি’’ হয়ে থাকবে। এর মধ্যেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ সুশীল সমাজের প্রবন্ধ উঠছে ‘‘শেখ হাসিনা’র পাকিস্তান যাত্রা’’, ‘‘আধা-পাকিস্তান’’ ইত্যাদি শিরোনামে। ব্যক্তিগত সুত্রেও জেনেছি আ-লীগের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছে।

যে শারিয়াবাজদের চাপে আ-লীগ পিছিয়ে গেল দেশের কতটুকু মঙ্গল ওদের দ্বারা সম্ভব? মন-মানসে ওরা কতখানি বাঙালী? আজ পর্য্ন্ত তারা আবহ-বাংলার কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে? করে নি। উদীচী-ছায়ানটের বর্ষবরণে, বর্ষাবরণে গেছে? বসন্ত উৎসবে? যায় নি। বাংলার কবিগান, যাত্রাপালা, গম্ভীরা, বাউল গানের আসর, নবান্ন ইত্যাদি থেকে শুরু করে নৌকা-বাইচ পর্য্ন্ত কোনো একটা অনুষ্ঠানে গেছে, করেছে বা উৎসাহ দিয়েছে ওরা? না - কখনোই নয়। ওদের অনেক মাদ্রাসায় দেশের জাতীয় সঙ্গীতটা পর্যন্ত অচ্ছুৎ। শহীদ মিনারে নগ্ন পায়ে গিয়ে আমরা শ্রদ্ধাভরে ফুল দেব সেটাও ওদের অনেকের কাছে ‘‘শরিকী’’। ধর্মীয় উন্মাদনা কতখানি উগ্র হলে মাতৃভুমির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করে মানুষ? মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার মত প্রাচীন সভ্যতা যে কোন জাতির গর্ব। কিন্তু পাকিস্তানের সংসদে জামাত দাবী তুলেছিল স্কুল-সিলেবাস থেকে ওটা বাদ দিতে কারণ ওগুলো কাফেরদের বানানো (দি ডন, ২২শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭)।

এইসব ধর্মদুর্বৃত্তদের এজেন্ডাই হল স্বদেশকে মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ বানানো। ইনকিলাবের উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ইতিহাসবিদেরা ভির্মি খাবেনঃ- (১) ‘‘নুহ’’ (আঃ) যুগের মহাপ্লাবন থেকে বাংলার ইতিহাস ও ‘বঙ্গ’’ নামের উৎপত্তি শুরু হয়’’ - ২৫শে জুন ২০০৮(২) ‘‘এ অঞ্চলের জনগণ যে সেমিটিক আরবগোষ্ঠিরই অধঃস্তন পুরুষ তাতে আর সন্দেহ কি?’’ - ১২ নভেম্বর ২০০৭। (৩) আরবী আল্লাহ-র ভাষা - ০৯ই মে ২০১১ আতংকের কথা হল জাতির বহু বাচ্চাদের ওরা এভাবেই জাতিরই বিরুদ্ধে গড়ে তুলছে। ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলে এখন মাদ্রাসার সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার (বিতর্কিত)। দমকলের হোস পাইপের পানির মত ওরা সমাজে ক্রমাগত উগরে দিচ্ছে অসংখ্য শারিয়াবাজ। মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী এখন ৭৫ লক্ষ (ইনকিলাব ০৩ জুন ২০১১)। সংখ্যাটা কাছাকাছিও হলেও একবার কল্পনা করুন। ওরা প্রায় সবাই এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির ধর্মদুর্বৃত্তদের হাতে তৈরী এবং শিগগীরই ওরা সমাজে বেরোবে। ওদের পরে আরো বেরোবে। ওদেরও নাগরিক অধিকার আছে, ভোটের অধিকার আছে। জাতিকে এই সাইক্লোনের সম্মুখীন হতেই হবে একদিন। ডক্টর মুনতাসির মামুন জনকন্ঠে প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছেন – “মাদ্রাসার দু’টি ডিগ্রীকে প্রচলিত স্কুল-কলেজের ডিগ্রীর সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে যদিও দুটি আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমাদের ভর্তি ব্যবস্থায় ৬০% নম্বর রাখা হয়েছে ঐ দু’টি ডিগ্রীর ফলের ওপর। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের ছাত্রদের ৯০-৯৫ ভাগের কম নম্বর দেয় না। এবং যেহেতু তারা মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী, সেহেতু টিক চিহ্ন প্রশ্নে তারা নম্বর বেশি পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজ বিজ্ঞান প্রভৃতি অনুষদে এখন মাদ্রাসার ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিভিল প্রশাসনের ক্যাডারেও”

এত সমঝোতা করার পরেও আ-লীগ কি ওদের মন পেয়েছে? পায় নি, কেউ কোনদিন পায় নি। ওরা আ-লীগকে ছোবলের পর ছোবল মেরে চলেছে। দেখুন ০৩ জুলাই সংগ্রামের সম্পাদকীয়ঃ- ‘‘পঞ্চম সংশোধনী : রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ নিয়ে প্রতারণা’’। প্রতারণা কে কোথায় জাতির ও ইসলামের সাথে করছে তা করেছে তা তো আমরা একাত্তর থেকেই জানি। তাই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, ধর্মেও রাজনীতির ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। মসজিদে ওয়াজ মহফিলে রাজনীতি বন্ধ করা দরকার, এমনকি শিক্ষাঙ্গনেও। মাদ্রাসা, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা দরকার। দড়িকে সাপ মনে করলে ক্ষতি নেই কিন্তু সাপকে দড়ি মনে করলে অসুবিধা আছে। ওদের কপালও ভাল, কৌশলও অনেক। কিছু দেখাচ্ছিঃ-


১। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে মওদুদি’র জীবনি ঢুকিয়ে দিয়েছে - সমকাল ২৪ জুন ২০০৮।

২। আটকে পড়া বিহারীদের যারা একাত্তরে নাবালক ছিল কিংবা তার পরে জন্মেছে তাদের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে বলে ওদের ভোট একলাফে বেড়েছে ৩ লাখ - সংগ্রাম ২৪ মে ২৯৯৮।

৩। ফাজিল-কামিলকে ডিগ্রী ও মাষ্টার্সের সমমান আদায় - নয়া দিগন্ত ২২শে জুলাই ২০০৮।

৪। বাচ্চাদের মধ্যে বিনামূল্যে মওদুদি-বান্না’র বই বিতরণ করে তার ওপরে প্রতিযোগিতা ও পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা।

৫। মন্ত্রী থাকাকালীন ওরা প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বীমা ইত্যাদির সর্বত্র অসংখ্য শারিয়াবাজকে নিয়োগ দিয়েছে। সরকারে যত পরিবর্তনই আসুক না কেন এরা সর্বদা সর্বত্র তাঁদের প্রভাব খাটাবে বহু দৈনিকের সংবাদ যেমন ‘‘সর্বত্র জামাতের কালো থাবা’’ - ভোরের কাগজ ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৪।

৬। কিছু বিচারপতি, সুশীল ব্যক্তিত্ব ও সরকারী আমলাদের নিমন্ত্রণ করে এনে শারিয়া আইনের সমর্থনে বিশেষজ্ঞ-মার্কা বক্তব্য দেয়ানো যাঁরা শারিয়ায় বিশেষ অজ্ঞ।

৭। জেনে বা না জেনে মহারথীরাও মাঝে মাঝে ওদের টোপ গিলে থাকেন। ২০০৮ ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ বলেন দেশের দক্ষিণ এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে মসজিদ-কেন্দ্রিক বহুতল দালান বানানো হবে এবং সেগুলোর তত্ত্বাবধানে থাকবেন মসজিদের ইমাম ও তাঁর দল। ইসলামি আবেগের জনতার কাছে এটা আকর্ষণীয় এবং ধর্মদুর্বৃত্তরা একে স্বাগতঃ জানিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব ও অধিকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার পরিণাম ভয়াবহ হবেই।

৮। যখন স্বামীরা কাজে থাকেন তখন ওদের নারী-বাহিনী দ্বারে দ্বারে হানা দেয়। স্ত্রীরা অভদ্র হন না, তাদের ঘরে বসিয়ে কিঞ্চিৎ আথিতেয়তা করেন। এই সুযোগে তারা ওই স্ত্রীদেরকে ইসলামে ‘‘দীক্ষা’’ দেয়, অবশ্যই সেটা হজরত শাহ জালাল শাহ মখদুমের ইসলাম নয়, সেটা মওদুদিবাদী শারিয়াবাজী ইসলাম।

৯। কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা রোজা রেখে হরতালে নামবে- ১০ই জুলাই ইত্তেফাক। এর আগে কোরান হাতে নেমেছিল। অর্থাৎ ওরা নাগরিক অধিকারের সুযোগে ইসলামের বিভিন্ন ‘‘অস্ত্র’’ প্রয়োগ করার কৌশল করছে। এটা বেআইনী নয়। সরকার হার্ড লাইনে গিয়ে ওদের আপাততঃ প্রতিহত করতে পারে কিন্তু উচ্ছেদ করতে পারবে না কারণ ধর্মবিশ্বাসকে পুলিশ লেলিয়ে উপড়ানো যায় না।

ইত্যাদি এবং আরো অনেক আছে। এর সাথে কিঞ্চিৎ দান-খয়রাত, শীতবস্ত্র বিলানো, ইসলামের নামে বইমেলা, হাসপাতাল ব্যাংক ইসিওরেন্স ইত্যাদি অসংখ্য সংগঠন তো আছেই। এখনো ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী দ্বারা পরিত্যক্ত কিন্তু সময়ের সাথে ওদের শক্তি বাড়বে। অত্যন্ত গভীরে অত্যন্ত সুধীরে বাংলাদেশের শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে যাবার পদধ্বনি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। এটা সত্যি যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতি এখনো ওদের প্রতিরোধ করে চলেছে। কিন্তু পরিণাম নির্ভর করবে এটার ওপর - করাপ্ট রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে জাতি ইসলামের অরাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মদুর্বৃত্তদেরকে প্রতিহত করবে কি করবে না।

অনেক ভালো কাজ করলেও আ-লীগের জনপ্রিয়তা এখন পতনোন্মুখ, এবং ভবিষ্যত নির্বাচনে সে এরকম প্রবল বিজয় আর পাবে বলে মনে হয়না। পরবর্তি নির্বাচনে আ-লীগ হেরে গেলে দেশের প্রবল ইসলামিকরণ অবধারিত এবং আ-লীগ, নারী-সমাজ ও সুশীল সমাজের ওপর জামাতের খড়গ নেমে আসবে। কিন্তু তার পরেও কেন বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতে বাংলাদেশ শারিয়া রাষ্ট্র হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ সেটা অন্য নিবন্ধে আলোচনা করব।

নিয়তির কালখেলা বোঝা দায়. যে জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম সংসদের প্রথম বক্তৃতায় সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলেন পাকিস্তান হবে ক্যানাডা বা বিলেতের মত আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র - যে মৌদুদী খোলাখুলি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিল এবং বলেছিল জিন্নাহ নাকি "কায়েদে আজম'' নয়, সে "কাফের-এ আজম" সেই পাকিস্তান আজ মৌদুদীবাদী জামাতি-কব্জায় নিষ্পেষিত. এতেই প্রমাণ হয় ষড়যন্ত্রময় রাজনৈতিক ঘোলাজলে মাছ তো মাছ, কুমীর পর্য্যন্ত শিকার করতে ওরা কত দক্ষ. ভেল্কিবাজীর এমন উল্টাপুরাণ ওখানে যদি হতে পারে আমরা এমন কি মহাশক্তিধর পালোয়ান যে এখানেও তা হবে না?

ওদের বেশ কিছু কৌশল রাজনীতি-নিরপেক্ষ. তার মানে ওরা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক সমাজের শারিয়া-করণ চলতেই থাকবে. একটা উদাহরণ দিচ্ছি. দেশের লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসাগুলোর যেটা যে দলেরই হোক না কেন সবাই শারিয়া-রাষ্ট্রে বিশ্বাসী. তারা শর্তসাপেক্ষে স্ত্রী-প্রহার ও পুরুষের ইচ্ছেমত বিয়ে তালাক সমর্থন করে, তারা জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে রাখায় বিশ্বাসী. এই ভাবধারার লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীকে ওই মাদ্রাসাগুলো প্রতি বছর সমাজে উগরে দিচ্ছে এবং তারা অদৃশ্য হয়ে উবে যাচ্ছে না. তারা কোথাও না কোথাও আছে এবং সমাজকে শারিয়ার দিকে ঠেলার চেষ্টা করছে. খেয়াল করুন, ইসলাম-ব্যবসায়ী সংগঠন (জামাত ইত্যাদি) ছাড়াই কিছু সাধারণ পাবলিকের উদ্যোগে সমাজের শারিয়াকরণ এগিয়ে চলেছে, যা তিরিশ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না. জনগনের একটা অংশ নিজেদের উদ্যোগেই জবরদস্তি অন্যের ওপরে শারিয়া প্রয়োগ করছে. যেমন, গ্রামে এক বৃদ্ধার স্বামী মারা যাবার তিরিশ দিন পরে সে ঢাকায় তার প্রথম নাতনী'র জন্মদিনে আসতে চেয়েছিল, লোকেরা তাকে বাধা দিয়েছে. কারণ শারিয়া মোতাবেক বিধবা চল্লিশ দিন পর্য্যন্ত বাড়ীর বাইরে যেতে পারবে না. আইনটা শারিয়াতে আছে কিন্তু এ আইন বানানোর সময় পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, এখন ওটা আর প্রয়োগ করা যায় না. আবার কখনো এমন কিছু প্রয়োগ করা হয় যা শারিয়া আইনে মোটেই নেই কিন্তু তারা ওটাকে শারিয়া মনে করছে. যেমন কোথাকার এক মোল্লা জবরদস্তি ঘোষণা করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে মসজিদের সামনে দিয়ে নারীদের হেঁটে যাওয়া বন্ধ করেছিল, পুলিশের গুঁতো খেয়ে সে শায়েস্তা হয়েছে.

এভাবে চললে একদিন মিসর বা পাকিস্তানের মত বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শারিয়া রাষ্ট্র চাইবে (পাকিস্তানে প্রায় ৮২%, মিসরে প্রায় ৬৬%), তখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই আমরা শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে যাব. এখনো সময় আছে, শারিয়াকরণের কিছু পদ্ধতিকে এখনো ফেরানো সম্ভব - যেমন ফতোয়াবাজীর বিরুদ্ধে যে আইন আছে তার শক্ত প্রয়োগ ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ইসলামের অরাজনৈতিক ব্যাখ্যার বইগুলোকে প্রচার করা, রাজনৈতিক ইসলাম কেন ইসলাম বিরোধী তার ওপরে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের (যেমন ডক্টর বাসাম তিবি, ডক্টর সুভি মনসুর, ডক্টর খালেদ আবু আল ফাদেল, ডক্টর আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার, ডক্টর এডিপ ইউকসেল প্রমুখ) বইগুলো প্রচার করা ইত্যাদি. কিন্তু সেই সাথে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যাকে আর ফেরানো সম্ভব নয়, জাতিকে বহুকাল সেই বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে. সেটা কি বলছি.

আগেই বলেছি ধর্ম-দস্যুরা জনতার সমর্থন পায় না কিন্তু অন্যের, বিশেষ করে সামরিক স্বৈরশাসকদের মাধ্যমে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করায় ওরা খুব দক্ষ. যেমন আমাদের সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, পাকিস্তান শারিয়া রাষ্ট্র ইত্যাদি. এগুলো মোটা দাগের ঘটনা কিন্তু এগুলোর চেয়ে অনেক বেশী বিপজ্জনক ব্যাপারগুলো চোখে পড়ে না. সেটা হল ইসলামী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে এসে সুপরিকল্পিতভাবে জাতিকে রাজনৈতিক ইসলামের দিকে ঠেলে দেয়া. যেমন, জিন্নাহ'র পাকিস্তান কিংবা মুজিবের বাংলাদেশ ছিল সম্পূর্ণ সেকুলার - ধর্মনিরপেক্ষ. সেখানে বায়তুল মুকাররম ও ইসলামী ফাউন্ডেসন ধরনের রাষ্ট্রীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান বানানোর বিপদ হল এই যে ওগুলো ক্রমে রাজনীতিকের হাত থেকে ফসকে গিয়ে ধর্মদস্যুদের খপ্পরে পরার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়. পাকিস্তানে এমন সবগুলো প্রতিষ্ঠান ভয়াবহভাবে জামাতিদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে. আমাদের অবস্থা কিছুটা ভালো - কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে আমাদেরও প্রায় সব ইসলামী নেতা বিশ্বাস করেন পুরুষের ইচ্ছেমত বহুবিবাহে, স্ত্রী-প্রহারে, বিয়ে-তালাক-নেতৃত্ত্ব-সাক্ষ্য-সম্পত্তিতে নারীকে বঞ্চিত করে ইত্যাদি. কিন্তু ওসবের প্রত্যেকটাই কি কি ইসলামী দলিলের ভিত্তিতে ইসলাম-বিরোধী সেই শিক্ষা থেকে জাতি প্রথম থেকেই বঞ্চিত হয়ে আছে.

এবারে দেখা যাক আজ এই ৫ই সেপ্টেম্বর ৪২ মুক্তিসনে (২০১২ সাল) জাতিকে অ-লীগ কোথায় টেনে এনেছে. আগেই বলেছি ধর্ম-দস্যুরা জনতার সমর্থন পায় না কিন্তু অন্যের, বিশেষ করে সামরিক স্বৈরশাসকদের মাধ্যমে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করায় ওরা খুব দক্ষ. যেমন আমাদের সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, পাকিস্তান শারিয়া রাষ্ট্র ইত্যাদি. এগুলো মোটা দাগের ঘটনা. চোখে পড়েনা এমন অনুসঙ্গই বেশী বিপজ্জনক; সেটা হল ইসলামী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে এসে সুপরিকল্পিতভাবে জাতিকে রাজনৈতিক ইসলামের দিকে ঠেলে দেয়া. যেমন, জিন্নাহ'র পাকিস্তান কিংবা মুজিবের বাংলাদেশ ছিল সম্পূর্ণ সেকুলার -ধর্মনিরপেক্ষ. সেখানে বায়তুল মুকাররম ও ইসলামী ফাউন্ডেসন ধরনের রাষ্ট্রীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান বানানোর বিপদ হল এই যে ওগুলো ক্রমে রাজনীতিকের হাত থেকে ফসকে গিয়ে ধর্মদস্যুদের খপ্পরে পরার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়. পাকিস্তানে এমন সবগুলো প্রতিষ্ঠান ভয়াবহভাবে জামাতিদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে. আমাদের অবস্থা কিছুটা ভালো - কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে আমাদেরও প্রায় সব ইসলামী নেতা বিশ্বাস করেন পুরুষের ইচ্ছেমত বহুবিবাহে, স্ত্রী-প্রহারে, বিয়ে-তালাক-নেতৃত্ত্ব-সাক্ষ্য-সম্পত্তিতে নারীকে বঞ্চিত করে ইত্যাদি. কিন্তু ওসবের প্রত্যেকটাই কি কি ইসলামী দলিলের ভিত্তিতে ইসলাম-বিরোধী সেই শিক্ষা থেকে জাতি প্রথম থেকেই বঞ্চিত হয়ে আছে.

এটা ঠিক যে মৌলবাদের দিক দিয়ে দুনিয়ার মুসলিম মেজরিটি দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য ভালো করছে. আমাদের সংবিধানে লেখা নেই দেশের সংবিধান বা বিচারপদ্ধতির উত্স হবে শারিয়া আইন. অন্যান্য কিছু দেশে গ্রাম-গঞ্জের অনানুষ্ঠানিক বেসরকারী শারিয়া কোর্টগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী কিন্তু বাংলাদেশে তা দুর্বল ও মৃতপ্রায়. ওসব দেশে এসব কোর্টের প্রতি জনগনের মনোভাব নতজানু কিন্তু বাংলাদেশে তা জনগনের ঘৃণার ও দ্রোহের পাত্র. ফতোয়ার আদালতে অত্যাচার হলে ছুটে যাচ্ছে পুলিশ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীরা, সংবাদমাধ্যমে উঠছে ধিক্কারের ঢেউ, হাতকড়ি দিয়ে মোল্লাকে হাজতে পুরছে পুলিশ এটা অন্য মুসলিম মেজরিটি দেশে কল্পনাও করা যায় না. রাস্তায় রাস্তায় ডাণ্ডা হাতে ঘুরছে "ইসলামী" পুলিশ (হিসবাহ), খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কোন মেয়ের একটা চুল বেরিয়ে আছে হেড-স্কার্ফ থেকে, কোন মেয়ে কোন ছেলের সাথে বাজারে গেল, - পার্কে বসে থাকা স্বামী-স্ত্রীর কাছে তাদের নিকাহনামা আছে কিনা - ইচ্ছেমত ধরে পেটাচ্ছে বা টেনে হিচড়ে বন্দী করছে থানায়, এই ভয়াবহ দৃশ্য অনেক মুসলিম দেশেই আছে, বাংলাদেশে এটা কল্পনাও করা যায় না.

আজ করা যায়না, কিন্তু কাল? পরশু? কিংবা তার পরদিন?

দু'ধরনের পাঠক বলতে পারেন আমি অবাস্তব আতংকের বায়বীয় ঢক্কানিনাদ বাজাচ্ছি. এক, যাঁরা চান দেশটা ওরকম হয়ে যাক কিন্তু হয়ে যাক চুপিসারে, না ঘটা পর্য্যন্ত জনগণ যাতে ঘুমিয়ে থাকে. তারপর ইরাণের মত ঘুম ভেঙ্গে দেখবে অনেক দেরী হয়ে গেছে. আর বলতে পারেন যাঁরা জানেন না পঞ্চাশ বছর আগেও কোনো পাকিস্তানী, ইরাণী, মালয় বা ইন্দনেশিয়ানকে যদি জিজ্ঞাসা করা হত - "তোমাদের দেশ কি শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে যাবে?" তারা ঘাড় ঝাঁকিয়ে অট্টহাসী হেসে বলত - "তোমার কি মাথা খারাপ? আমাদের দেশ হবে মোল্লারাষ্ট্র ?? হাহ!!”. আজ তারা অবিশ্বাসের চোখে অসহায় তাকিয়ে দেখেছে তাদের দেশ শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে গেছে. তাই, ইতিহাসের এসব বাস্তব প্রমাণ দেখে সাবধান হওয়া ভাল. কারণ দড়িকে সাপ মনে করলে সুবিধে নেই কিন্তু সাপকে দড়ি মনে করলে সে ভুলের মাশুল প্রাণ দিয়ে শোধ করতে হয়. আজ সেটাই করছে ওসব দেশের নারীরা, ভিন্নমতের মুসলিমরা আর সুশীল সমাজ. এ মহা সর্বনাশ ওদের যদি হতে পারে, হতে পারে আমাদেরও.
 

হাসান মাহমুদ

Print