অগাধ সলিল
[(ক’বছর আগে অফিসের ব্যস্ততার মধ্যে জরুরী ফোন এল বাংলা পত্রিকার সম্পাদকের। সলিল চৌধুরী মারা গেছেন, এদিকে পত্রিকা প্রেসে চলে গেছে, রাতের মধ্যেই ছাপা হবে। নিবন্ধের জন্য জায়গা রাখা হয়েছে, সেটা চাই এক্ষুনি। হাজার জোনাকি হয়ে সমস্ত শৈশব-কৈশোর উড়তে লাগল মাথার ভেতরে, কাজে আর মন বসল না। মাথায় উঠল অফিস, দরজাটা বন্ধ করে বসে গেলাম কাগজ কলম নিয়ে। লেখা শেষ হলে ফ্যাক্স করে বাড়ি ফেরার পথে মাঝরাতে আকাশ-পাতাল মন্থন করে বাজতে থাকল, “ধিতাং ধিতাং বোলে, কে মাদলে তান তোলে ..." অদৃশ্য মাদলের ছন্দে-লয়ে দুলতে থাকল রাতের আকাশ গ্রহ-নক্ষত্র আর অন্ধকার পৃথিবী। সে লেখাটাই তুলে দিচ্ছি এখানে)]
‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ’ অর্জুন যখন জানলেন জঙ্গলে বালক একলেব্য তাঁর চেয়েও ভালো তীর চালাচ্ছে তখন তিনি তাঁর গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে অভিযোগ করলেন -"আপনি তো বলেছিলেন আমাকে ছাড়া আর কাউকে শেখাবেন না। কিন্তু ওই ছেলে আমার চেয়েও ভালো তীর চালাচ্ছে, ওকে কেন শেখালেন"। দ্রোণাচার্য অবাক হয়ে বললেন -"আমি তো আর কাউকে শিখাইনি”! দুজনে জঙ্গলে এসে দেখলেন একলব্য তীর চালানো প্র্যাকটিস করছে তার না-পাওয়া গুরু দ্রোণাচার্যের একটা মূর্তি সামনে রেখে।
আমিও আমার না দেখা গুরুর ছবি সামনে রেখে সংগীতের বিভিন্ন আঙ্গিক ও সমীকরণ বুঝবার চেষ্টা করেছি আজীবন।
পঞ্চাশ বছর আগের প্রতিবাদী দলপতি চলে গেলেন নিরাল সফরে। অর্ধশতাব্দীর কথা-সুরের অনর্গল ঝর্ণা বন্দী হয়ে রইল এ্যালবামে। যা ছিল জীবনের উন্মত্ত প্রবাহ, তা হয়ে গেল গল্প, হয়ে গেল ইতিহাস। যার প্রথম জীবনের স্বপ্ন ছিল, “আজকে যে খুব নিঃশব্দ, সশব্দে ফেটে যাবে কাল সে”। হ্যাঁ, শতাব্দীর জড়-নৈঃশব্দ সশব্দেই ফেটে পড়েছিল একাত্তরে। নিশ্চয়ই খুব তৃপ্তিভরে তা দেখেছিলেন প্রতিবাদী সংস্কৃতির মহাগুরু। প্রথম যৌবনে তিনি নিজেই যে ফেটে পড়েছিলেন সশব্দে .... ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন, দ্বিগুন জ্বলে যেন!!
সেই প্রবল প্রতিবাদ যখন সমাজ-রাজনীতির গণ্ডী পার হয়ে আছড়ে পড়ল সংস্কৃতির কূপমণ্ডুকতার ওপর, স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল সারা বাংলা। শতাব্দীর বদ্ধ জলাভূমিতে এ কি দুর্বার বন্যা! গড্ডালিকা প্রবাহের চির-অন্ধকারে এ কি বিজলীর চমক! নতুন নতুন শব্দ চয়নে, বাক্যবিন্যাসে, সপ্তসুরের অচিন্ত্যনীয় নোটেশনে, কো-রিলেশনে, হার্মোনাইজেশনে, সুরের মানোহর চলনভঙ্গীতে এ কোন দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় নতুন নতুন খেলা খেলে চলেছে .... খেলে চলেছে.....চলেছেই........ একের পর এক আতসবাজির ঝলকানিতে রাঙিয়ে দিচ্ছে বাংলার আকাশ বাতাস.......
একা একটা মানুষ, কিন্তু একটা বন্যা আনবার জন্য যথেষ্ট। মানুষ তো নয় যেন অসম্ভব জটিল একটা সঙ্গীত-মেশিন ! কথায় কি তা প্রকাশ করা যাবে? লিখে কি শিল্প বোঝানো যায়? একাত্তরের “ও আলোর পথযাত্রী“-র কথাই ধরা যাক। একসাথে কয়েকটা সুরের জটিল ব্যাপার। প্রধান দুটো সুর যখন হার্মোনাইজেশনে একসাথে “সা-রে-গা” এবং “গা-মা-পা” করার পরে “মা-পা-গা” এবং “ধা-র্সা-পা” করল অর্থাৎ প্রথমে এগিয়ে পরে পিছিয়ে এল, তৃতীয় আবছা সুরটা তখন “সা-ধা-সা” করে প্রথমে পিছিয়ে পরে এগিয়ে গেল। অর্থাৎ ঠিক উলটো গতি অথচ কি মিষ্টিই যে লাগল!
“তব জীর্ণপালে”-র শেষ দিকে প্রধান সুরগুলো “পা” থেকে বিভক্ত হয়ে চমৎকার মীড় দিয়ে একদল ওপরে উঠে গেল “ধা”-তে, অন্যদল নীচে নেমে এল “মা”-তে। ওদিকে “সা”- তে একটা সুর তো ষ্ট্যান্ডিং আছেই। সব মিলিয়ে মিষ্টি-মধুর “সা-মা-ধা” কর্ডটা ফুটে উঠল। আসল মুন্সীয়ানা আছে এর পরেই। “জয় পতাকা তুলে সূর্য্য তোরণ” লাইনে প্রধান সুগুলো যখন “পা-ধা-নি-র্সা” অঞ্চলে ঘুরে ফিরে এসে “মা”-তে দাঁড়াচ্ছে, পেছনের সুরটা পুরো সময়টা ধরেই “রে” তে স্থির হয়ে আছে। অর্থাৎ সবগুলো সুর যে হার্মোনাইজেশনে একসাথে না নড়লেও চলে, কোন একটা সুর স্থির থেকে অন্যগুলো চলাফেরা করতে পারে এবং তাতে সেটা আরও যে কত মিষ্টি হয়ে উঠতে পারে, তা এই প্রথম দেখা গেল। এবং তার পরক্ষণেই “দাও হানা”-তে সবাই একসাথে “সা” তে ফিরে এসে সোমের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে “সা-গা-পা”-তে দাঁড়িয়ে গেল, সংগীতের মৌলিক কর্ডটা ফুটে উঠল। এ যেন সপ্তসুরের চডুইপাখীদের ব্যাকরণবদ্ধ সুসংহত বৃন্দ-নৃত্য। চমৎকার নয়? সংগীতকে কতখানি আত্মস্থ করলে একটামাত্র সুরে এতগুলো বর্ণাঢ্য বৈচিত্র্য আনা সম্ভব তা কল্পনারও বাইরে।
সংগীত আত্মিক উপভোগের জিনিস, কিন্তু উপভোগের সময় দেখা না গেলেও এই প্রযুক্তিটাই সংগীতের পায়ের নীচের মাটি। এরই ওপর দাঁড়িয়ে আছে “ধিতাং ধিতাং বোলে”, “সুরের এই ঝর ঝর ঝর্ণা, ইত্যাদি। তাজমহল যেমন সবাই উপভোগ করে কিন্তু তার ভেতরের আর্কিটেকচারের অসম্ভব জটিলতাটা খেয়াল করে না, তেমনি আমাদের কাছে পৌঁছবার আগে শিল্প শিল্পীর, কবিতা কবির এবং সুর সুরকারের মাথায় তৈরী হয় মননে, বোধে এবং উপলব্ধিতে। সেই মননের কলেবর এবং মান তাই খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
“আজ শুধু এইটুকু থাক” গানে নোটেশন কি তীক্ষ, তার মাঝখানে হঠাৎ কড়ি মধ্যমের আবির্ভাব চমকে দেয় একেবারে। “ঝনন ঝনন বাজে” কলাবতী রাগে শুরু, পরক্ষণেই বাদ্যযন্ত্রগুলো উড়ন্ত কপোতের মত শৈল্পিক ভাঁজ খেয়ে কলাবতী ভেঙ্গে চুরে গিয়ে দাঁড়াল “মা”-তে যা কিনা কলাবতীতে (‘মা’ এবং 'রে') নিষিদ্ধ। এবং আবার আরেকটা ভাঁজ খেয়ে সুর দিব্যি ফিরে এল কলাবতীতে। শিল্পের মাধুর্য্য বজায় রেখে এমন অবলীলায় ব্যাকরন ভাঙ্গার ও গড়ার শক্তি ও অধিকার বুঝি ঐ একজনেরই ছিল। “সুরের এই ঝর ঝর ঝর্ণা” গানের প্রতিটি অংশই আলাদা করে পরীক্ষা করার মত, - সেখান থেকে শেখার মতো। হার্মোনাইজেশনে “র্সা-র্সা-র্সা--র্রে-র্গা-র্রে-এর সাথে “র্সা-র্সা-র্সা-র্সা-র্নি-ণি”, শুদ্ধ “নি” হয়ে কোমল “ণি”-তে দাঁড়ানো, ওদিকে শেষের স্ট্যাণ্ডিং-এর সাথে নীচে “পা” তো আছেই, সব মিলিয়ে “পা-ণি-র্রে”-আবার একটা কর্ড। কি অসম্ভব সৃষ্টিশীলতা, ভাবলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। “শোন, কোন একদিন” তার সুরমাধুর্য্য বজায় রেখে একবার নয, দু-দুবার “সা” বদলেছে, যা আর কোন বাংলা গানে শুনিনি।
ক’টা গানের কথা বলব? তিল তিল উত্তমের সমন্ময় যদি হয় তিলোত্তমা, তবে তাঁর সব গানই তিলোত্তমা। কথা, সুরের প্রযুক্তি, আর যন্ত্রসংগীতে মাধুর্য্য। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। কণা কণা সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রতিটি গানের অঙ্গে অঙ্গে। যন্ত্রসঙ্গীতের অংশটাও কি কম! বাঁশীর এমন অপরূপ ব্যবহার আর কোথায় পাব?
এবারে ‘রানার”। বাংলা গানের জগতে এর তুলনা আছে? শুদ্ধ-কড়ি-কোমলে, লয়-তাল ফেরতা উত্থানে পতনে রানার এক মৌলিক অসাধারণ সৃষ্টি। কবিতাটার মেজাজ সুরোরোপের জন্য কি চ্যালেঞ্জটাই না ছিল! সেই মেজাজ রক্ষা করে সুর দেবার জন্য কথাগুলো বোধ হয় তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিল। সেই তিনি চলে গেলেন। যেন একটা হিমালয় ধ্বসে গেল। যাবার আগে অনেক কিছু দিয়েও গেল। তিনি যেন মৃদুহেসে ভবিষ্যতের জন্য একটা কাজই রেখে গেলেন। সেটা হল নজরুলের “বিদ্রোহী”। একটা সুর আছে কবিতাটার। কে দিয়েছেন জানিনা, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সুরটা কবিতার তুলনায় খুবই দুর্বল। বিদ্রোহী কবিতার মত এমন একটা গুরুভার ধারণ করতে পারেনি সেটা। আসলে অগাধ সলিল ছাড়া বোধহয় হিমালয়ের সাংস্কৃতিক উচ্চতার সাথে বিসুভিয়াসের সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ ধারণ করাই সম্ভব নয়।
সম্পাদক বলেছিলেন, সলিল চৌধুরি মারা গেছেন। কথাটা ঠিক নয়।
মানুষের মরণশীল।
কিন্তু কিছু অনন্য মানুষের জন্য অভিধানে “অমর” এবং ‘মৃত্যুঞ্জয়” শব্দ খুব দুটো যত্ন করে লিখে রাখা আছে।