হারানো খেলাঘরে - (বাল্যপ্রেমের সত্য ঘটনা - ১)

হারানো খেলাঘরে

হাসান মাহমুদ

জীবনের টানে টানে কত মুখ, কেউ কারো চেয়ে কম?

মরণের টানে টেনেছিল সেই একমেবাদ্বিতীয়ম !!

কেউ জীবনের হারানো খেলাঘরে আজীবন খেলা করে, কেউ তা হেলাভরে পায়ে ভেঙে এগিয়ে যায়। 

বহু, বহু বছর আগের কথা। গহন গ্রামবাংলার ছেলে আমি ম্যাট্রিক পাশ করে সবেমাত্র ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে হোষ্টেলে থাকি। পাশের রুমে থাকে মশা (মোশাররফ, এখন আমেরিকায় থাকে)। সন্ধ্যায় ওর রুমে গেছি, আমাকে দেখেই তড়িঘড়ি বালিশের নীচে কি একটা লুকিয়ে ফেলল। ভঙ্গীটাই বলে দিল ওটা প্রেমপত্র। ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর ওপর। আমি তখন তালপাতার সেপাই। মশা আমার চেয়েও তালপাতার সেপাই, ওকে ধরাশায়ী করতে সময় লাগল না। ধস্তাধস্তিতে কাগজ ছিঁড়ে যাবার জোগাড় হতেই মশা চেঁচিয়ে উঠল – “দিচ্ছি দিচ্ছি, ছিঁড়িস না”।  

হাতে পেলাম, পড়লাম। হ্যাঁ প্রেমপত্রই, ছোট্ট একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে আঠারোটা প্রেমপত্র। কোন এক শিখা তার প্রদীপকে লিখেছে। দু’টোই ছদ্মনাম। আমাদের বই পড়া পরিবার, বাংলা সাহিত্যের হেন বিখ্যাত বই নেই যা আমার মা বুকশেলফ্‌ ও স্মৃতিতে রাখেন নি। আবাল্য গ্রন্থকীট আমি চিঠিগুলো পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আশ্চর্য্য গভীর প্রেমরসে আপ্লুত আঠারোটা চিঠি। সেগুলোর অপরূপ অভিব্যক্তি, ভালোবাসার গভীরতা, কাব্যিক শব্দচয়ন আর বাক্যবিন্যাসের বর্ণাঢ্য প্রকাশ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বন্যার মত। 

একটা চিঠির একটা লাইন রক্ত দিয়ে লেখা, ব্র্যাকেটে লেখা আছে আঙ্গুল কেটে সেই রক্ত দিয়ে লেখা।

বললামঃ-

“মারাত্মক লিখেছে তো ! এমন একটা মুক্তোর মালা তোর মত বাঁদরের গলায় পড়ল !!’’

“ওগুলো আমার নয়, এক বন্ধুর।‘’

“বন্ধুর? ওদের চিঠি তোর কাছে কেন ? কি নাম ওদের? কোথায় থাকে?’’

“সে সব বলা যাবে না”।

কষে চেপে ধরলাম কিন্তু মশা অনড়। কিছুতেই বলল না। শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম –

“কাল এই সময় এখানে থাকিস, আমিই তোকে বলব ওরা কারা”।

“তুই গই গেরামের খ্যাত পোলা ঢাকা শহর চিনিসই না, কিভাবে বলবি ?’’

“কাল এই সময় এখানে থাকিস”।

সকালে ভরপেট নাস্তা করে বেরিয়ে গেলাম। চিঠিগুলোতে ওদের বাসা, স্কুল, জায়গার ইংগিত ছিল, ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আবিষ্কারের গর্ব নিয়ে ফিরলাম সন্ধ্যায়। মশাকে বললামঃ-

“মেয়ের ভালো নাম এই, ডাক নাম এই। বাবার নাম এই, মায়ের নাম এই। মেয়ে দেখতে খুব সুন্দর, হিন্দু এক ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল যার নাম এই। ছেলেটা সম্প্রতি কোলকাতা চলে গেছে”।

মশা নিঃশ্বাস ফেলে বলল - ‘‘হ্যাঁ। আমার ছোটবেলার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গত সপ্তাহে আমাকে চিঠিগুলো দিয়ে গেছে। খুব গভীর প্রেম ছিল ওদের”।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু জীবন বড় রহস্যময়। ততক্ষণে অলক্ষ্যে ধ্বনিত হয়েছে ইঙ্গিত। ভবিতব্যের রেখা ধরে ধরে এ গল্পকে সুদীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে পাড়ি দিতে হবে দু’টো মহাদেশ, যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবী আর ক্যানাডার টরন্টো, ছুঁয়ে যেতে হবে পাকড়াশী’র ভাঙ্গা হার্মোনিয়ম।

দু’বছর পর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আমরা থাকি। মশার সাথে একদিন কি কথায় সেই চিঠির কথা উঠল। কতো ভালো লেগেছিল বললাম, কিছু উদ্ধৃতিও দিলাম। মশা অবাক হলঃ-

“দু’বছর আগে মাত্র একবার পড়েছিস, লাইনগুলো পর্য্যন্ত মনে আছে তোর ?’’

“মনের যা ভালো লাগে, মন নিজেই সেটা মনে রাখে দোস্ত !"

“আমার সাথে আয়’’।

“কোথায়’’?

“আয়’’।

ওর রুমে গিয়ে সেই ছোট্ট প্লাষ্টিকের ব্যাগটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললঃ-

‘’এগুলোর ভার আমি আর বইতে পারছি না। না পারি রাখতে, না পারি ফেলে দিতে। যাবার পর থেকে ও কারো সাথে যোগাযোগ করেনি, ওর সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না। তোর যখন এতোই ভালো লেগেছে তোর কাছেই থাকুক্‌’’।

হাতে চাঁদ পাওয়া একেই বলে। আবার ডুবে গেলাম সেই গভীর প্রেমে আপ্লুত কাব্যময় চিঠিগুলোতে। রক্তে লেখাগুলো একটু কালচে হয়ে এসেছে। 

অপরিচিতার রক্ত।

ক’বছর পর। ঘটনা তখন ছুট্‌ছে উন্মত্তবেগে। সময়ের জঠরে জন্মযন্ত্রনায় নড়ে উঠ্‌ছে বাংলাদেশের রক্তাক্ত ভ্রূণ, মানচিত্র ভাঙ্গার জন্য তৈরী হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। ছাত্রলীগের চিরদুর্ভেদ্য দুর্গ ফজলুল হক হলের আমি ব্যতিব্যস্ত লীগ-ভিপি আর হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। একাত্তরের পঁচিশে মার্চে নেমে এল নাপাক বাহিনীর গণহত্যার কেয়ামত,

ছিট্‌কে গেলাম কে কোথায়। সপ্তাহ পরে হলে এসে দেখি আর্মি এসে হল ছাত্রলীগ কমিটির সদস্যদের বিছানা-বালিশ মশারী বইপত্র অ্যালবাম ডায়েরী সবকিছু হলের ভেতরের ছোট্ট মাঠের মধ্যে পুড়িয়ে দিয়েছে। ছুঁড়ে ফেলার সময় ওজন কম বলেই হয়ত প্লাষ্টিকের ছোট্ট ব্যাগটা বাতাসের ধাক্কায় অন্যদিকে পড়েছিল, আগুনে পড়েনি। 

যক্ষের মতন আবার বুকে তুলে নিলাম অপরিচিতার হৃৎস্পন্দন। 

       

আরো ক’বছর পর। ততদিনে বাংলাদেশ হয়েছে। সে মেয়ের খুব সুনাম হয়েছে, দেশজুড়ে সবাই তার নাম জানে।  আমার এক দুরাত্মীয়া তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। বলল তার বিয়ে হবে, সামনে গায়ে হলুদ। ছোট্ট এক কাঠের বাক্সে সেই প্লাষ্টিকের ব্যাগ রেখে ছোট্ট তালাবন্ধ করে তাকে দিয়ে বললামঃ-

‘’এটা ওকে দেবেন। চাবি আমার কাছে থাকল, তালা ভাঙ্গতে বলবেন’’।

‘’কি আছে এতে ?’’

‘’জানতে হবে না। জীবনের সবকিছু জানতে হয় না। ওকে বিশেষ করে বলবেন কারো সামনে যেন না খোলে’’।

গল্পটা এখানেও শেষ হতে পারত কিন্তু জীবন বড় রহস্যময়। এরপর ১৯৭৫ সালে আমি আবুধাবী চলে গেছি, দুরাত্মীয়াও হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। 

১৯৭৯ সাল। দেশে গেছি, এয়ারপোর্টে রাজশাহী’র প্লেনের জন্য ডোমেষ্টিক লাউঞ্জে বসে আছি। কানে এল সেই নাম। দেখি একটু দুরে জটলা, চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে যাচ্ছে উদ্যোক্তারা। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৯, দীর্ঘ পনেরো বছর যার প্রথম কদম ফুল বয়ে বেড়িয়েছি এই প্রথম তাকে দেখলাম। হ্যাঁ, মেয়ে সুন্দর। নাক-চোখের নকশা সুন্দর, গায়ের রং দুধে-আলতায় একটু চুন মেশানো। ও জানতেও পারছে না কাছে দাঁড়িয়ে আছে যে তার রক্তলেখা যক্ষের মত আগলিয়ে রেখেছে বহু বছর। 

আরো এগারো বছর পর। ক্যানাডার ইমিগ্রেশনের অ্যাপ্লাই করেছি, ল'ইয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে হয়ে যাবে। হঠাৎ মনে হল জীবনভর পরের হার্মোনিয়ম বাজালাম পাড়ার শিল্পীর সাথে থেকে শুরু করে থেকে ওস্তাদদের রাগ-রাগিনীর কনসার্ট পর্য্যন্ত, আমার নিজের একটা হার্মোনিয়ম থাকা উচিত। কোলকাতা’র পাকড়াশীর হার্মোনিয়ম সুবিখ্যাত। অর্ডার দিলাম অনেক শর্ত দিয়ে, কাঠ বহু পুরোন হতে হবে, রীডের ডেপথ কম হতে হবে, রীডের স্প্রিং লুজ ও পাশগুলো ঘষে দিতে হবে যাতে ত্রিতালের কালবৈশাখীতে পরষ্পরের সাথে ধাক্কা না খায় – নানান বায়নাক্কা। পাকড়াশী বানাল ভাল। ইমিগ্রেশন নিয়ে টরন্টোতে এসে একটু জড়িয়ে গেলাম সংস্কৃতি-জগতে, সবাই জানল আমার খুব ভালো একটা হার্মোনিয়ম আছে। ১৯৮৯ সালের দিকে বাংলাদেশ সমিতির প্রেসিডেন্ট ফোন করলেনঃ-  

‘’উপকারটা করতেই হবে হাসান ভাই !! না করবেন না যেন’’।

‘’কি ব্যাপার ?’’

‘’দেশে থেকে খুব নামকরা এক শিল্পীকে আনছি, আপনার হার্মোনিয়মটা একটু লাগবে।‘’

‘’কোন শিল্পী?’’

নাম শুনে অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে। পেছনের কত কথা মনে পড়ল। '৬৪ সালে সেই ঢাকা কলেজের হোষ্টেল .....মশার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি….সেই প্ল্যাষ্টিকের ব্যাগ..... এফ এইচ হলে মশার সাথে সন্ধ্যা.....পুড়ে যাওয়া সবকিছুর মধ্যে অক্ষত চিঠি.........সেই ডোমেষ্টিক লাউঞ্জ! এত বছর পর গল্পটা শেষ হবে। বললাম আনব হার্মোনিয়ম।   

গাড়ীর ট্রাংকে হার্মোনিয়ম নিয়ে যাচ্ছি অনুষ্ঠানে, ভাবছি ওকে কি কিছু বলব?  চিঠিগুলোর কথা বলব?  জিজ্ঞেস করব প্রদীপের কথা?  প্রদীপ এখন কোথায় আছে, কেমন আছে? ওর সাথে আর কখনো দেখা হয়েছে?  যোগাযোগ আছে? বললে মেয়েটা কিভাবে সেটা নেবে?

নাকি কিছুই বলব না? এই বয়সে এসে কি ওই বয়সের কথা বলা যায়? দু’টি কচি মন কচি বয়সে কাছাকাছি এসেছিল, একসাথে জীবন কাটাতে চেয়েছিল কিন্তু পারল না। কেন ওরা দুরে সরে গেল? জীবনের ঐশী স্পন্দন একেবারেই কি হারিয়ে গেল জীবন থেকে? নাকি রাতের প্রবল ধ্রুবতারাটা প্রবলতর হয়ে আছে দিনের আলোর গভীরে ?

তখন আমাদের সব অনুষ্ঠান কৃষ্টি আর ব্লোর -এর কাছে এক স্কুলে হতো। সেখানে যাচ্ছি, ড্যাভেনপোর্ট আর কি এক রাস্তার ঘিঞ্জি ক্রসিংয়ে বিশাল এক গাড়ী এসে দানবের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ট্রাংকের ওপরে। ছত্রছান হয়ে গেল সবকিছু - আমার এতো আদরের এতো ভালো পাকড়াশীর হার্মোনিয়ম তখন ভেঙ্গেচুরে লাশ হয়ে পড়ে আছে। প্রেসিডেন্টকে ফোন করে দিলাম - অনুষ্ঠানে যাওয়া হলনা, গল্পটা অসমাপ্ত থেকে গেল। 

অসমাপ্ত গল্প জীবনের ভারী অপছন্দ, ভালমন্দ যেভাবেই হোক জীবন সেটা শেষ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে। তাই মনে হয় এ গল্পটাও হয়তো শেষ হবে কোনদিন....কোথাও....কোনভাবে ....কখনো..... কে জানে !

*********************************************

এটা ২০০০ সালে লেখা। জীবন আসলেই ক’বছর পরে গল্পটা শেষ করেছিল। সে গল্প হয়তো পরে কখনো হবে।

কিংবা হয়তো হবেনা ……….

Print