• Home
  • Articles
  • Literature :: Bangla
  • নাটের গুরু!! (ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়)

নাটের গুরু!! (ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়)

নাটের গুরু!!

(ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়, আমার বই "বাংলার কথা কই"-এর একটি অধ্যায়) –

হাসান মাহমুদ

অ-তে অজগর, আ-তে আম, ই-তে ইঁদুর, ঈ-তে ঈগল...।

ধুমসে চলছে বাংলা ক্লাস। বৃটিশ রাজত্বের রাজধানী কলকাতায়। ১৯১১ সালে দিল্লীতে স্থানান্তরের আগে পর্যন্ত কলকাতাই ছিল রাজধানী। প্রচুর পরিশ্রম করছেন বৃটিশÑভারতের মিলিটারি সেক্রেটারি অর্থাৎ সমর সচিব। খোদ বড়লাটের পরেই পদটার দায়িত্ব ও মর্যাদা। জনমানস চিনতে ভাষা জানা দরকার। তা ছাড়া বেঙ্গল প্রদেশটা তাঁর মাথাব্যথার কারণও বটে। সুজলা সুফলা হলেও এরকম অগ্নিগর্ভ প্রদেশ ভারতে আর নেই। ভবিষ্যতের সূর্য সেন, আলীমুদ্দীন, ক্ষুদিরামের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন তিনি। তাই এ চেষ্টা। কপালগুণে মাস্টারও পেয়েছেন চমৎকারবাঙালি এবং প্রতিভাবান, আর প্রচণ্ড বিপ্লবী-বিদ্বেষী। সব উচ্চপদের সাহেবরা তাই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিপ্লবী-দমনের গোপন শলা-পরামর্শ তাঁর সাথেই করেন সমর সচিব। ধীরে ধীরে তেতে উঠছে বাংলা। অঘটন-ঘটনপটিয়সী জাত, কবে আবার কি করে ফেলে !

করে ফেললও। পৃথিবী কাঁপানো, লণ্ডনের স্বর্ণ-সিংহাসন কাঁপানো সংবাদ সৃষ্টি হল ২৩শে জুন ১৯১২ সালে। বোমার আঘাত আর কারো ওপর নয়, স্বয়ং বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর ওপরে ! রাগে দুঃখে উন্মাদের মতো ইণ্টেলিজেন্স বিভাগের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমর সচিব। বোমা মেরেছে কোনো পালোয়ান নয়, মাত্র একটা কিশোরী মেয়ে ! ফুটফুটে মেয়েটা, লীলাবতী, কিভাবে পালালো ? কে সে ? কোথাকার মেয়ে ? এত বড় একটা ঘটনা, কেন কেউ আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না ? ইণ্টেলিজেন্স কি ঘোড়ার ঘাস কাটছে বসে বসে ?

প্রাণপাত করল ইণ্টেলিজেন্স। দীর্ঘ দু’বছর পর তদন্ত রিপোর্ট হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বড়লাটের কাছে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলেন স্বরাষ্ট্র সচিব। রিপোর্ট পড়ে চোখ কপালে উঠে গেল হার্ডিঞ্জ সাহেবের। লীলাবতী আদপে মেয়েই নয় ! শাড়ি প’রে এসেছিল বসন্ত বিশ্বাস। বাংলারই দামাল কিশোর। আর এ নাটকের নাট্যকার ? নেপথ্যের সর্বাধিকারী নির্দেশক ? আর কেউ নয়, প্রবল বিপ্লবী-বিদ্বেষী ইংরেজের সুহৃদ সেই বাংলার মাস্টার যে কিনা বোমা বর্ষণের পর দেরাদুনের প্রকাশ্য জনসভায় অনলবর্ষী বক্তৃতায় বিপ্লবীর ফাঁসি দাবি ক’রে কেঁদে রুমাল ভিজিয়ে ফেলেছিল ! “বোমা নিক্ষেপের ব্যাপারে ওই লোকটাই ছিল নাটের গুরু” (মাই ইণ্ডিয়ান ইয়ার্স, ১৯১০-১৯১৬লর্ড হার্ডিঞ্জ)। ধর, ধর ব্যাটাকে। পুলিশ, মিলিটারি সব একসাথে ছুটল তাঁর আস্তানায়।

গুরু হাওয়া হয়ে গেলেন চোখের পলকে। যেন মন্ত্রবলেই। লাটে উঠে গেল বাংলার ক্লাস আর লোক-দেখানো বিপ্লবী-দমন পরামর্শ। শুরু হলো লুকোচুরির বিশ্বরেকর্ড। বিশাল ভারতবর্ষ। আজ বাংলা তো কাল পাঞ্জাব, আজ মাদ্রাজ তো কাল আসাম। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ভানুমতির খেল খেলে চলেছেন গুরু ! আর পেছনে ছুটছে ঘর্মাক্ত সেপাই-শান্ত্রীদল। নাম বদলের, বেশ বদলের, রূপ বদলের, ঠিকানা বদলের ইয়ত্তা নেই। অস্থির হয়ে উঠল বৃটিশ শাসন ব্যবস্থা। কখনো টিকি বাঁধা উড়ে বাবুর্চি, কখনো বিষ্ঠার টিন মাথায় ব্যস্ত মেথর, কখনো বিয়ে পড়ানো পণ্ডিতজী, কখনো শব-মিছিলে আরামে শায়িত মৃতদেহ, কখনো রাগ-রাগিণীর আত্মহারা বেহালা বাদক সেই মাস্টার-অব-অল-ট্রেড্স, জ্যাক অব্ নান। বছরের পর বছর কেটে গেল, কানামাছি ভোঁ ভোঁ চলছেই।

কিন্তু এই বিপজ্জনক লুকোচুরির মধ্যেই পালটা আঘাত হানলেন সেই আশ্চর্য্য কর্ম-দানব। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শত্র“কে আঘাত হানার এই তো সময় ! কাবুলে গড়ে উঠেছে মহেন্দ্র প্রতাপ, অজিত সিং অম্বাপ্রসাদ আর বরকত উল্লার নেতৃত্বে প্রবাসী স্বাধীন ভারত সরকার (জার্মানি, তুরস্ক তাকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল)। কাবুল থেকে থাইল্যাণ্ড পর্যন্ত লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে আবার সিপাহী বিপ্লবের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। পুরো ভারতবর্ষের আয়োজনে আছে পাঞ্জাবি কর্তার সিং, মারাঠি পিংলে, আর বাংলার এই মাস্টার-অব্-অল্-ট্রেড্স। ব্যস্ত, ব্যস্ত, ব্যস্ত।

হলো না। কতিপয় মীর জাফর এখানো আছে, তখনো ছিল। মীরজাফরদের গোপন খবরে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক দানব, একাত্তরের বাংলাদেশের মতো। ব্যর্থ হয়ে গেল লক্ষ লক্ষ মুক্তিসেনার বুকের রক্ত। ধরা পড়ল, মারা পড়ল প্রায় সবাই। আর সেই বাঙালি অধিনায়ক একেবারে রাজবেশ পরে সোজা গিয়ে হাজির পাসপোর্ট অফিসে। “আমি রাজা পি. এন. ঠাকুর। নোবেল-লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়। জাপান সম্রাটের আমন্ত্রণে কবি জাপান যাচ্ছেন তো, আমাকে তাঁর আগে যেতে হচ্ছে ওখানকার আয়োজন তদারক করতে, এমিসারী হিসেবে।”

ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার ট্যাগোর-এর জাপান যাবার কথা জানি আমরা। আপনি প্লিজ একটু বসুন, এই পাঁচ মিনিট।”

পনেরো মিনিটের মাথায় পাসপোর্ট। ২২শে জুন হারুকিমারু জাহাজের বারান্দা থেকে শেষবারের মতো দেখে নিলেন স্বদেশের মাটি। অস্ফুটস্ব^রে বললেন, ‘ওয়ান ফাইট মোর, দ্য লাস্ট অ্যাণ্ড দ্য বেস্ট।’

জাপানে পৌঁছানোর খবরটা যেন চড় হয়ে চটাশ করে পড়ল বৃটিশের গালে। সাথে সাথে শুরু হলো অপমানিত সিংহের গর্জন। সাঁড়াশীর মতো চেপে ধরল জাপান সরকারকে  আমাদের বিদ্রোহী ফিরিয়ে দাও, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে। ওদিকে জাপানের সরকার-বিরোধী পার্টি জনগণকে বোঝাচ্ছে, দেশপ্রেমিক লোকটাকে খুন হবার জন্য বৃটিশের হাতে তুলে দেবে ভাই !

না ! প্রতিবাদের ঝড় তুলে ফেলল জনতা আর সংবাদপত্রগুলো, ও আমাদের অতিথি। জাপানি আতিথেয়তার শতাব্দী-প্রাচীন ঐতিহ্যে কলঙ্ক লাগতে দেব না। ততদিন আন্তর্জাতিক অদৃশ্য রাজনীতিতে আর জাপানের ভেতরে এই নিয়ে মহা হুলুস্থুল বেধে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সদ্য বিজয়ী ইংল্যাণ্ড চাপ দিয়ে চলেছে লীগ অব্ নেশন্স (জাতিসঙ্ঘের পূর্বসুরী)-এর মাধ্যমে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা জাপান সরকারের নেই। দিনে দিনে ভেঙে পড়ল তার মেরুদণ্ড। বিদ্রোহীকে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল সংসদে। দিনক্ষণও ধার্য্য হয়ে গেল। পাশবিক উল্লাসে ফাঁসির দড়ি পাকাতে শুরু করল বৃটিশ। পলকের জন্য থমকে গেল বহমান ইতিহাসবিশ্ব রহিল নিঃশ্বাস রুধি, নিভায়ে সূর্যতারা।

হল না। দীর্ঘশ্বাসে বন্ধু সোমার দিকে তাকালেন বিরোধী দলের নেতা তোয়ামা। “লোকটাকে বুঝি আর বাঁচানো গেল না হায়েনার হাত থেকে।”

একটা উপায় আছে। মাত্র একটা।” বাসায় ফিরে সোমা তাঁর স্ত্রীকে বললেন, “মাত্র একটা উপায় আছে।” স্ত্রী তাকালেন কন্যার দিকে, “মাত্র একটা উপায় আছে মা।”

নতস্বরে বললেন কন্যা তোশিকো, “আমি জানি। আমি, আমি রাজি আছি।”

ব্যস্। দূর-দ্বীপবাসিনীর এক মধুর সম্মতিতে বাংলার তথা ভারতবর্ষের ভবিষ্যত ছুটল তার অনির্ধারিত পথে, নির্ধারিত হয়ে গেল নিয়তি। বিশাল একটা জাতির নিয়তির ওপর যে কে কোথায় কিভাবে অবদান রেখে যায়, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ধন্য। ধন্য তোশিকো। ভবিষ্যতের আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য তৈরি হয়ে গেল ইষ্ফল-বার্মা, মণিপুর, কোহিমা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যাণ্ড। কলকাতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল নেতাজীর গ্রহ-নক্ষত্ররা। মহাকালের ডাক এসেছে ঐ, মাভৈঃ! মাভৈঃ! এদিকে বিয়ের উৎসব উল্লাসে ফেটে পড়ল সমস্ত জাপান। এ এখন আমাদের জামাই ! দেখি, কোন্ শালা গায়ে হাত দেয় !

লেজ গুটিয়ে নিল জাপান সরকার। উদ্যত কালফণা গুটিয়ে নিল বৃটিশ। ক্রোধে ক্ষোভে হাত কামড়াতে লাগল। বড়লাটের গায়ে হাত তোলা লোক, এভাবে পার পেয়ে যাবে !

ধনী দেশ, বড়লোক শ্বশুর, পারিবারিক মাধুর্য্যরে হাতছানি। তবু, মনের মধ্যে কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে ! মনের সৈকতে বার বার এসে আছড়ে পড়ে বহু পুরোনো একটা ঢেউ। সারি সারি মুখ, বেশির ভাগই খুন হয়ে গেছে বৃটিশের হাতে। অগণিত সেই মৃতদেহ কি শুধু ইতিহাসের ডেস্ক্রিপ্শন হয়েই থাকবে ? মহামুক্তির প্রেস্ক্রিপ্শন হবে না কখনো ! কত লক্ষ মুক্তি-পাগল মানুষ দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গেছে শুধু দেশটিকে স্বাধীন করবার চেষ্টায়। সে চেষ্টা আর কি হবে এই এতদূরে, এই বয়সে ! শুরু করেছিলেন কত বছর আগে বাংলার সেই দামাল কিশোর। আজ পেরিয়ে গেছে মাঝ বয়স। তবু উঠে দাঁড়ালেন। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিলেন আহ্বান  এসো ভাই, আর একবার চেষ্টা করে দেখি।

ফিরে তাকাল ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরের লক্ষ লক্ষ ভারতীয়। কে ! কে কথা বলছে ! আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে কার উদাত্ত আহ্বান, এসো ভাই, আর একবার চেষ্টা করে দেখি ! প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে দু’দুটো সিপাহী বিপ্লবও। কিন্তু সাফল্যের ভিত্তি গড়ে গেছে তারা নিজেদেরই হাড়ে গড়া ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে। এসো ভাই, একবার চেষ্টা করি।

এক থেকে দুই, দুই থেকে চার। অবাক বিস্ময়ে সারা পৃথিবী দেখল, ধীরে ধীরে প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো লক্ষ লক্ষ বুকে জেগে উঠছে শতাব্দীর ক্ষুধিত দেশপ্রেম। বন্যার মতো এগিয়ে এল মানুষ, জাপান থেকে বার্মা পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ। ত্যাগের পর ত্যাগ, সারা দূরপ্রাচ্য জুড়ে গঠিত হয়ে গেল সেনাবাহিনী ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ। কেন্দ্র তার টোকিও, গুরু তার কর্ণধার। বিরাট সেনাবাহিনীকে গুছিয়ে তুলছেন মোহন সিং, সাথে আছেন মেজর শাহ্নেওয়াজ, মেজর ধীলন। ওদিকে সুদূর বার্লিন থেকে ভেসে আসছে মহাকালের বরাভয়“আমি সুভাষ বলছি। মনে রেখো, পরাধীনতার চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই...।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল তরঙ্গের দুই প্রান্তে দুই বাঙালি কর্ণধার নিজেদের ছোট্ট মনপবনের নাওটাকে কিনারায় ভেড়াবার জন্য ব্যাকুল। ইউরোপে গঠিত হয়ে গেছে আজাদ হিন্দ ফৌজ। এদিকে ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ। পৃথিবীর দু’ধারে দুটো মত্ত আবেগ পরস্পরকে আলিঙ্গন করার তাগিদে ফুলে ফুলে উঠছে। গল্প নয়। তোমার আমার ইতিহাস, বিদেশের মাটিতে।

সুদূর ইউরোপের চেয়ে দূরপ্রাচ্য থেকে আক্রমণটাই বেশি সুবিধেজনক। তাছাড়া সমগ্র এশিয়ার একমাত্র স্বাধীন দেশ জাপান। জেনারেল তোজো সরকার গঠন করে প্রথম থেকেই বলছেন, “এশিয়া র্ফ এশিয়ান্স, গো হোম হোয়াইট্স্।” তাঁর কাছে দাবি গেল- “আমার বয়স হয়েছে। সুভাষকে এনে দাও। তাঁর অধীনে শেষ কটা দিন কাজ করতে চাই।” ওদিকে বার্লিনেও তাই। “আমাকে জাপান পাঠাও। তার অধীনে সেপাই হলে গর্ববোধ করব আমি সুভাষচন্দ্র বোস।” (হায়! আমাদের আজকের নেতারা!) কিন্তু ততদিনে হিটলারের পরাজয়ের ঘণ্টা বেজে উঠেছে। রাশিয়া আক্রমণ করে নিজের পায়ে কুড়ল মেরেছে প্রায় বিশ্বজয়ী জাতটা। তবু, হিজ এক্সেলেন্সি চন্দ্র বোসের অনুরোধের একটা দাম আছে। জোগাড় হলো সাবমেরিন। মেজর আবিদ হাসানকে নিয়ে তিনমাসের সাবমেরিনে জাপান।

শতাব্দীর সাথে শতাব্দীর দেখা হলো। মানবাধিকারের দুই অতন্দ্র প্রহরী, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একজন নবীন, একজন প্রবীণ। নবীনর সুভাষের হাতে সমস্ত রাজনৈতিক-সামরিক দায়িত্ব তুলে দিয়ে তৃপ্তির ছুটি নিলেন অর্ধশতাব্দীর কর্মচঞ্চল মহাবিদ্রোহী নাটের গুরু। তারপর নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজলেন। শ্রদ্ধাবনত মহামান্য জাপান সম্রাট পাঠিয়ে দিলেন রাজশকট সে মরদেহ বইবার জন্য। জাপানের ইতিহাসে রাজপরিবারের বাইরে ওই একবারই ব্যবহার হলো সেটা। ইউরোপে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজ সুভাষ ডিজল্ভ্ করেছেন আগেই। সেই একই আজাদ হিন্দ ফৌজ নাম নিয়ে স্বাধীনতার দিকে পা বাড়াল ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ।

তাঁর নাম স্বাধীনতা।  তাঁর নাম দেশপ্রেম।

 জাতি-ধর্মের বিভেদের বহু ঊর্দ্ধে মহামুক্ত মহানন্দ বিশাল মহাপুরুষ তাঁর নাম রাসবিহারী বসু ॥

&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&

https://www.facebook.com/photo/?fbid=3447932832190263&set=gm.1229606490986285&idorvanity=821701721776766

Pijush Mondal

‘দেশত্যাগীর শেষ আশ্রয়’

রাসবিহারীর বয়স যখন ঊনত্রিশ বছর তখন তিনি ভারত ত্যাগ করেছিলেন। ভারতত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই এই বিপ্লবী বীরের জীবনের একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছিল। তাঁর জীবনের পরবর্তী ত্রিশ বছর জাপানে অতিবাহিত হয়েছিল, এবং জাপানকেই তিনি তাঁর দ্বিতীয় জন্মভূমি বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তবে তিনি দেশত্যাগ করলেও ওই ত্রিশ বছর কিন্তু বৃথা কালক্ষেপ করে নিজের জীবন অতিবাহিত করেন নি। দেশের মুক্তির চিন্তায় তাঁর মস্তিষ্ক তখনও সর্বক্ষণ আলোড়িত হতো, এবং অতঃপর জাপানকে কেন্দ্র করেই রাসবিহারী তাঁর সংকল্পকে সিদ্ধ করেছিলেন। বিভিন্ন প্রাচীন নথি থেকে জানা যায় যে, জাপানে বসেই তিনি ভারতের পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বেশ গভীরভাবেই নিরীক্ষণ করতেন, এবং বিশেষ করে যখন থেকে ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীর অভ্যুদয় ঘটেছিল, তখন থেকেই তিনি গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ধারাও পর্যবেক্ষণ করতেন। এমন কি, আন্দামান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ‘বীর সাভারকারের’ সঙ্গেও তিনি পত্রের বিনিময় করেছিলেন। বর্তমানে অনেকেই মনে করেন যে, ১৯১৫ সালে রাসবিহারী বসুর জাপানে চলে যাওয়াটা বোধহয় ইতিহাস-বিধাতারই অভিপ্রেত ছিল। কেননা, তিনি জাপানে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য ‘ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ’ গঠন করেছিলেন বলেই, পরবর্তীকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে ‘নেতাজী’রূপে ‘সুভাষচন্দ্র বসু’র অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছিল। বস্তুতঃ তাঁর জীবনের ওই ত্রিশ বছরের কাহিনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেরই একটা স্বতন্ত্র অধ্যায় বলে গণ্য হওয়া উচিত। এই প্রসঙ্গে ‘হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ’ লিখেছিলেন, “The life history of Rash-Behari Bose is a thrilling chapter in the history of India’s struggle for independence so many pages of which are blotted with tears and blood and deathless deeds.” না জানি কত বীরের রক্তধারা, কত মায়ের অশ্রুজলে সেই ইতিহাস রচিত হয়েছে। আসলে ভারত ত্যাগ করে জাপান চলে গিয়েও রাসবিহারী কখনও নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি, তাঁর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের রোষবহ্নি সেই সূর্যোদয়ের দেশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এখন তাঁর জীবনের সেইসব অধ্যায় পাঠ করলে বুঝতে পারা যায় যে, নিজের সমস্ত জীবন ধরে এই বিপ্লবী শুধু একটিমাত্র মন্ত্রই সাধন করে গিয়েছিলেন - সে মন্ত্র ছিল ‘ভারত-মন্ত্র’। ভারতের স্বাধীনতা ছিল তাঁর শৈশবের চিন্তা, কৈশোরের আকুতি, যৌবনের সাধনা আর যৌবনোত্তর কালের একাগ্র স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন, সেই সাধনাকে তিনি কিভাবে সফল করেছিলেন, সার্থক করেছিলেন, সেটা তাঁর জীবনের পরবর্তী ত্রিশ বছরের প্রচেষ্টার ইতিহাস থেকে জানতে পারা যায়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে সেই ইতিহাসকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়।


কলকাতা ত্যাগ করে ১৯১৫ সালের ২২শে মে তারিখে রাসবিহারী প্রথমে সিঙ্গাপুরে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি টোকিওতে উপনীত হয়েছিলেন। টোকিওতে তিনি কোথায় থাকবেন, কার কাছে যাবেন - সেসব কিছুই তখন তাঁর জানা ছিল না। তাঁর কাছে অর্থের সম্বলও তেমন ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বিচলিত হননি, নিরুদ্যম হননি। তিনি ভালো করেই জানতেন যে, তিনি স্বেচ্ছায় বিপদ-সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছেন, এবং সাথে এটাও জানতেন যে - “এ তুফান ভারি দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।” ভারতে যে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, সেটা যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল, যখন বোধন হতে না হতেই পূজার মঙ্গলঘট ভেঙে গিয়েছিল, তখন তাঁর জায়গায় অন্য যে কেউ হলে হয় তিনি নৈরাশ্যে ভেঙে পড়তেন, কিংবা বৈরাগ্যের পথে চলে যেতেন, অথবা সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে নিজের জীবনের উপরে যবনিকা টেনে দিতেন। কিন্তু বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত রাসবিহারীর প্রতিজ্ঞা ছিল স্বতন্ত্র, চরিত্র ছিল অসাধারণ। তাই ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় যে, তাঁর পরিকল্পিত সশস্ত্র অভ্যুত্থান যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল, ভারতের নানা প্রদেশে বিপ্লবীরা একে-একে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখনও রাসবিহারী কিন্তু ‘বারীন্দ্রকুমার ঘোষের’ মতো নৈরাশ্যে বলে ওঠেন নি - “My mission is over.”; বরং তিনি সবাইকে এটাই বলেছিলেন যে, তিনি বিদেশে অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন। সেই যে তিনি স্বদেশ পরিত্যাগের সময় - বিদেশে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যাচ্ছি - বলেছিলেন, তখন সেটা যে শুধু তাঁর কথার কথা ছিল না, তাঁর জীবনের পরবর্তী ইতিহাসই আজও সেটার অভ্রান্ত সাক্ষ্য বহন করে চলছে।


রাসবিহারীর জীবনের শেষ ত্রিশ বছরের ইতিহাসে দেখা যায় যে, ১৯১৫ সালের জুন মাস থেকে ১৯১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত তাঁর মাথার উপরে সব সময়েই মৃত্যুর খড়্গ উদ্যত ছিল। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করা পর্যন্ত, ইংরেজদের গুপ্তচরের যন্ত্রণায় তাঁকে একবার নয়, সতেরো বার নিজের আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৪১ সালের ৮ই ডিসেম্বর তারিখে জাপানের যুদ্ধঘোষণা পর্যন্ত রাসবিহারীর রাজনৈতিক প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর জীবনের একেবারে শেষ পর্বে রাসবিহারীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মিলন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সম্ভবতঃ সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অধ্যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, বর্তমান সময়ে নেতাজী অনুরাগী বা অনুগামীরা সেই ঐতিহাসিক অধ্যায়টির আলোচনা করতে গিয়ে নেতাজীর কথা বলতে যতটা উচ্ছ্বসিত হন, রাসবিহারী বসুর কথা ঠিক সেই ভাবে বলতে তাঁরা কুণ্ঠা বোধ করেন। কারণ বোধগম্য নয়। স্বয়ং নেতাজী যাঁর সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে প্রকাশ্য সভায় যাঁকে ‘পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতার জনক’ বলে ঘোষণা করেছিলেন,তাঁর মহত্ত্বকে এইভাবে লাঘব করবার কোনো কারণ কিছুতেই থাকতে পারে না। পৃথিবীতে কে কবে নেতৃত্বের মোহ ত্যাগ করতে পেরেছেন? রাসবিহারী বসুই সম্ভবতঃ এর একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি তাঁর স্বোপার্জিত নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় সেদিন সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই ইতিহাস নিয়ে অল্প-বিস্তর প্রায় সকলেই জ্ঞাত রয়েছেন।


যে ত্রিশ বছর সময় রাসবিহারী বসু জাপানে অতিবাহিত করেছিলেন, ওদেশে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন এমন একাধিক জাপানী ব্যক্তিত্বের স্মৃতিচারণ থেকে তাঁর জাপানবাসের প্রথম দিকের সেই ইতিহাস জানতে পারা যায়। রাসবিহারীকে নিয়ে অতীতের ইংরেজি স্মারক গ্রন্থগুলিতে তাঁদের অনেকের রচনা সন্নিবেশিত হওয়ার জন্য তাঁর জীবনের ওই অধ্যায়টির উপরে একটা সময়ে যথেষ্ট আলোকসম্পাত ঘটেছিল। সেই সব ঐতিহাসিক রচনার মধ্যে তাঁর শ্বাশুড়ি ‘শ্রীমতী কোক্কো সোমা’ লিখিত বিবরণ থেকে রাসবিহারী সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পারা যায়। এছাড়া ‘জে. জি. ওসাওয়া’ প্রণীত ‘The Two Great Indians in Japan’ নামক গ্রন্থে ‘টোকিওতে তরুণ বোস’ শীর্ষক অধ্যায় থেকে জাপানে সদ্য সমাগত রাসবিহারীকে ঠিক কি কি অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সেসবের একটা বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। শ্রীওসাওয়া লিখেছিলেন, “বোস কোবেতে পৌঁছালেন, এবং ১৯১৫ সালের জুন মাসে তিনি টোকিওতে গিয়েছিলেন। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তিনি সাংহাইতে এলেন। কিন্তু সেখানে তাঁকে ব্যর্থ হতে হয়, কারণ চীনদেশে তখন বিপ্লব চলছিল। সেখানে বহু ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশ অবস্থান করছিল। বোস আবার টোকিওতে প্রত্যাবর্তন করলেন, এবং এইখানে তিনি চীনের বিখ্যাত বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী দলের নেতা সূন ইয়াৎ-সেনের সঙ্গে পরিচিত হন। (১৯১৩ সালের নানকিন বিদ্রোহে পরাজয়ের পরে তিনি তখন জাপানে গিয়ে নিজের পলাতক জীবন যাপন করছিলেন।)

দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় একই সময়ে ভারতের বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু ও চীনের বিপ্লবী নেতা সূন ইয়াৎ-সেন জাপানে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিলেন। পলাতক এই দুই সমমর্মী ও সমপন্থী বিপ্লবীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। সূনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বোসের জীবনে শুভ হয়েছিল, কারণ তিনি বহুবার এই ভারতীয় বিপ্লবীর জীবনরক্ষা করেছিলেন। … টোকিওতে পৌঁছাবার পাঁচ মাস পরে ২৭শে নভেম্বর, ১৯১৬, বোস ভারতের স্বাধীনতার জন্য একটি বিরাট সভা সংগঠিত করেছিলেন। এই সভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন লালা লাজপৎ রাই ও হেরম্বলাল গুপ্ত। (তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রস্থ ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতিনিধিস্থানীয় ছিলেন।) আমার বন্ধু ডাঃ শেমাই ওকাওয়া এই সভার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। ইউনো পার্কের নিকটস্থ সেইকেন রেস্তোরাঁতে এই সভা হয়েছিল। লাজপৎ রাইয়ের বক্তৃতায় জাপানী শ্রোতাদের সকলেই মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ হন। সকলেই প্রবলভাবে ভারতে ইংরেজ শাসনের নিষ্ঠুরতার কথা বলেন। এই সংবাদে বিচলিত ও ভীত হয়ে টোকিওস্থ ব্রিটিশ দূতাবাস জাপানের বৈদেশিক মন্ত্রীকে অবিলম্বে ভারতীয় বিপ্লবীদের বহিষ্কৃত করে দেওয়ার জন্য চাপ দিলেন। সেই চাপের সামনে জাপ-সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রী নতি স্বীকার করলেন। পশ্চিমের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির কাছে জাপ-বৈদেশিক দপ্তরের দাসত্ব ও জাপানী জাতির উপরে ঐ শক্তিবর্গের নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা তখন একটা ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছিল। জাপানের অধিবাসীবৃন্দ তাই জাপ-সরকারের বৈদেশিক নীতির উপরে বীতশ্রদ্ধ ছিল।

পরবর্তীকালে এই দপ্তরটি যেমন যুক্তরাষ্ট্র মার্কিনের বংশানুক্রমিক হয়েছিল, তখন তেমনি এটি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বংশানুক্রমিক ছিল। … পরের দিন সকালেই লাজপৎ রাই আমেরিকায় পলায়ন করলেন। বোস আর গুপ্তকে পুলিশ হেডকোয়াটার্সে তলব করা হয় ও তাঁদের প্রত্যেকের উপরে একটি করে ডিপোর্টেসনের হুকুমপত্র দেওয়া হয়। ঐ আদেশে বলা হয়েছিল যে, পাঁচদিনের মধ্যেই তাঁদের উভয়কেই জাপান ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু সেই ভারতীয় বিপ্লবী দু’জন নতি স্বীকার করবার মতো মানুষ ছিলেন না। তাঁরা পুলিশের সেই হুকুম অগ্রাহ্য করলেন। তাঁরা যেসব সংবাদপত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে আবেদন জানালেন, এবং যেসব জাপানীদের তাঁরা জানতেন তাঁদের কাছেও আবেদন জানালেন। অবশেষে জাপানের বর্ষিয়ান নেতা তোয়ামার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ইনি একজন যথার্থ সামুরাই ছিলেন। ভারতে হিন্দুদের মধ্যে ‘ব্রাহ্মণ’ বলতে যে শ্রেণীকে বোঝানো হয়, জাপানের সামুরাইরাও ঠিক সেই শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। সামুরাইরা চিরকাল অহিংসার পক্ষপাতী। পরের দিন প্রভাতী সংবাদপত্রে দেখা গেল যে, জাপানের প্রায় প্রত্যেকটি কাগজে বৈদেশিক দপ্তরের বিরুদ্ধে কঠোর সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। বহু সুপরিচিত রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবহারজীবী এই দু’জন তরুণ ভারতীয়কে রক্ষা করবার জন্য এগিয়ে এলেন।

কিন্তু সমস্ত চেষ্টাই বৃথা হল। তখন প্রাচ্যের অভিমুখে ফিরে যাওয়ার জন্য কোনো স্টীমার পাওয়া গেল না। ফিরে যেতে হলে ইউরোপগামী জাহাজেই তাঁদের চড়তে হবে আর সেই জাহাজ যেই সাংহাই বন্দরে ভিড়বে অমনি তাঁরা ব্রিটিশ পুলিশ দ্বারা কবলিত হবেন। … পুলিশের প্রধান কর্তা এই মর্মে হুকুমজারি করলেন যে, ২রা ডিসেম্বর, ১৯১৫, ইয়োকোহামা বন্দর থেকে যে জাহাজটি ছাড়বে, বহিষ্করণ আদেশপ্রাপ্ত ভারতীয় দু’জন যেন ঐ জাহাজে চড়ে জাপান ত্যাগ করেন। যদি তাঁরা এই আদেশ অমান্য করেন তাহলে তাঁদের জোর করে ঐ জাহাজে চড়িয়ে দেওয়া হবে। ভাগ্যের কি পরিহাস, ভারতের এই বিপ্লবী দু’জন না পারেন ভারতে অবস্থান করতে, না পারেন জাপানে। যাই হোক, তাঁরা কিন্তু এই হুকুম মানলেন না। উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটতে থাকে। ১লা ডিসেম্বর। বোস আর গুপ্ত সমস্ত আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে, একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে শান্তভাবে বসে আছেন, আর পুলিশের বিষদাঁত ক্রমশই তাঁদের নিকটবর্তী হয়ে আসছিল।

এমন অবস্থায় তাঁরা কি করতে পারেন? বন্ধুহীন এই তরুণ আগন্তুক দু’জন জাপানে উপস্থিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে জাপ-সরকারের কাছ থেকে ডিপোর্টেসনের আদেশ পেলেন এবং সেই আদেশে বলা হল যে, পুলিশ তাঁদের বলপূর্বক এই দেশ পরিত্যাগ করতে বাধ্য করবে। এমন অবস্থায় কোনো বিপদের ঝুঁকি নেওয়া চলে না। তাঁরা অবশ্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন। একতরফা বিচারে তাঁরা দণ্ডিত হয়েছিলেন - দণ্ডিত হয়েছিলেন দেশপ্রেমের জন্য। উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ নেই; ঘাতকের খড়্গের জন্য তাঁদের অপেক্ষা করতেই হবে। এখন শুধু সময়ের প্রশ্ন। খড়্গ প্রায় নেমে আসবার উপক্রম হয়েছে। … দুপুরবেলায় সংবাদপত্রের দু’জন লোক এলো তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ঠিক এই সময়ে তাঁদের ছোট্ট কামরার প্রবেশপথে একটি মোটর গাড়ি এসে থামল, এবং সেই গাড়ি থেকে একজন জাপানী ভদ্রলোক লাফ দিয়ে পড়লেন। তিনি তাঁদের দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন, এবং দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কেউ জানত না তাঁদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হল, এবং পরবর্তী আট বছর কাল ধরে, এক তরুণী জাপানী বালিকা ও তাঁর মা ভিন্ন, তাঁদের সংবাদ কেউ জানতে পারেন নি।”

পরবর্তী কাহিনী রাসবিহারীর শ্বাশুড়ির বিবরণ থেকে উদ্ধৃত করা সঙ্গত হবে। তবে তার আগে ঘটনার সূত্র বুঝবার সুবিধার্থে দু’-একটি কথা বলবার দরকার রয়েছে। এখানে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন জাপানের রাজধানী টোকিওর পশ্চিম প্রবেশপথে ‘সিনজিকু’ নামের একটি রেলস্টেশনের কাছে ‘নাকামুরায়া’ নামের একটি বেকারি (পাউরুটি তৈরির দোকান) ছিল। সেই বেকারির মালিক ছিলেন ‘আইজো সোমা’। তিনি সংবাদপত্রে ঐ দু’জন ভারতীয় বিপ্লবীর বিপদের কথা জানতে পেরে খুব উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। ১৯১৫ সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখের সকালে তিনি তাঁর দোকানে সমাগত জনৈক ক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি সংবাদপত্রে বর্ণিত ঐ দু’জন হতভাগ্য ডিপোর্টিদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য অবগত আছেন কিনা। তখন সেই ক্রেতাটি তাঁকে অতি গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁদের রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে কোনো একটি নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখবার জন্য তোয়ামা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তখন তাঁর সেই কথা শুনে সোমা চুপিসারে তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর অব্যবহার্য পুরানো কারখানার মধ্যে ওই ভারতীয় দু’জনকে তিনি অনায়াসে লুকিয়ে রাখতে পারবেন। একই সাথে আরো বলেছিলেন যে, সেখানে পুলিশের দৃষ্টি পড়বার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেই ক্রেতাটি ছিলেন একটি পত্রিকার সম্পাদক; তাঁর নাম ছিল ‘নাকামুরা’। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর একজন সাংবাদিক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ তোয়ামার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনিও তখন ওই হতভাগ্য ভারতীয় দু’জনের বিপদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সব শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ রাসবিহারী, হেরম্ব গুপ্ত ও বেকারীর মালিক সোমাকে তাঁর বাসভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তোয়ামার বাড়ির চারদিকেও সর্বক্ষণ গোয়েন্দা পুলিশ তাঁদের সতর্ক দৃষ্টি রাখত। এবারে পরবর্তী ঘটনাক্রম সম্বন্ধে শ্রীমতী কোক্কো সোমার বিবরণ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক।


তিনি লিখেছিলেন, “২৮শে নভেম্বর, ১৯১৫, আমি সর্বপ্রথম জানতে পারি যে, পুলিশ জাপানে সমাগত হতভাগ্য ভারতীয় বিপ্লবীর উপরে বহিষ্করণের আদেশ জারি করেছে। তাঁকে পাঁচদিনের মধ্যেই জাপান ত্যাগ করে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বহিষ্করণের অর্থ ছিল তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে সঁপে দেওয়া এবং তার অর্থ মৃত্যু। তখনকার দিনে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে সব সময়েই দোকানে থাকতাম ও পাউরুটি মুড়ে দিতাম, দাম নিতাম, আর কখনো কখনো খরিদ্দারদের অভ্যর্থনা করতাম। এই সংবাদে আমার স্বামীকে খুব বিচলিত হতে দেখেছিলাম, এবং এই ভারতীয়টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সকালে তিনি ‘নিরোকু’ পত্রিকার সম্পাদক নাকামুরা (ইনি আমাদের দোকানের একজন নিয়মিত খরিদ্দার ছিলেন) দোকানে আসামাত্র তাঁকে সব কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমার স্বামীকে খুব আগ্রহভরে নাকামুরার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলাম ৷ কিন্তু আমি তখন অন্যান্য খরিদ্দারদের নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, আমি তাই ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। তারপরে দেখলাম যে, একটা কাজে তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদেই নাকামুরা ব্যস্তসমস্ত ভাবে আমার স্বামীর খোঁজে এলেন এবং তখনই আমি সর্বপ্রথম জানতে পারলাম যে, সকালবেলায় তিনি নাকামুরার কাছে কি প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু কেউ তাঁর খোঁজ দিতে পারল না। যে-সব টেলিফোন নম্বর আমাদের জানা ছিল আমরা তার প্রত্যেকটিতে রিং করলাম, কিন্তু কোথাও তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না। … অবশেষে আমাদের দোকানের ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরেই আমার স্বামীর পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তাঁকে তক্ষুণি দোকানে ফিরে আসতে বললাম। সেইদিন রাত্রেই বোস ও তাঁর বন্ধুকে আমরা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিই। পরের দিন সকালবেলার কাগজে তাঁদের দু’জনের অন্তর্ধানের সংবাদ প্রকাশিত হয়। আমাদের বাড়ি নিরাপদ হবে জেনেই তোয়ামা এই ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার স্বামী যখন গভীর রাত্রে তোয়ামার বাড়ি থেকে তাঁদের নিয়ে আসেন তখন তাঁরা দু’জনেই সম্পূর্ণ জাপানী বেশে সজ্জিত ছিলেন। টোকিও শহরের কেন্দ্রস্থলে বিরাট একটি বাগানসমেত তোয়ামার বাড়ি। সেই উদ্যানের পিছনের দরজা দিয়ে বোস ও তাঁর বন্ধুকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। তোয়ামার টুপি ও কিমোনো দিয়ে বোসের ছদ্মবেশটি তৈরী হয়েছিল। বাগানের পেছনেই একটি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। তাঁরা দু’জনে পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এসে ঐ গাড়িতে উঠলেন আর আমার স্বামী সামনের দরজা দিয়ে বহির্গত হয়ে, একটু ঘুরে গিয়ে সেই গাড়িতে তাঁদের সঙ্গে এসে মিলিত হলেন। তোয়ামার বাড়ির ঠিক সামনেই তখন পুলিশের বড়কর্তার গাড়ি অপেক্ষা করছিল ও সেখানে ইউনিফর্ম-পরিহিত কয়েকজন পুলিশ ও গোয়েন্দাও দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু জাপানের সর্বজনমান্য তোয়ামার বাড়িতে ঢুকে যে তল্লাসী করবে এমন সাহস পুলিশের ছিল না। তখন তাঁর বাড়ির সমস্ত জানালা বন্ধ ছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পরে তাঁরা সেই প্রাসাদের দেউড়িতে ঢুকে সেই ভারতীয় দু’জনের কথা জিজ্ঞাসা করে। একটি ভৃত্য উত্তরে তাঁদের জানায় যে, কয়েক ঘণ্টা আগেই তাঁরা সেখান থেকে চলে গেছেন। এই কথা শুনে পুলিশের আতঙ্কের সীমা-পরিসীমা থাকে না। প্রবেশপথে তাঁরা সেই ভারতীয় পলাতক দু’জনের দু’জোড়া জুতা দেখতে পেয়েছিল। … যে গাড়ি করে তোয়ামার বাড়ি থেকে বোস ও তাঁর বন্ধুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখনকার দিনে সেটি ছিল টোকিও শহরের সবচেয়ে শক্তিশালী গাড়ি - ঘণ্টায় আশী মাইল বেগে ছুটতে সক্ষম। সেই গাড়ির পিছু নিয়ে সেটাকে লঙ্ঘন করা অন্য কোনো গাড়ির পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজেই তোয়ামা এই ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, যদিও বা তাঁরা পিছু নেয় তাহলেও পুলিশের গাড়ি কিছুতেই সেই গাড়ির নাগাল পাবে না। সেটি ছিল ডাক্তার সুগিয়ামার গাড়ি। পরের দিন সকালবেলায় আমার স্বামী তাঁর ভৃত্যদের - এঁরা দীর্ঘকাল যাবৎ তাঁর পরিচর্যা করে আসছিল - ডেকে বললেন, বন্ধুগণ, আমি একটা ভীষণ বিপদের ঝুঁকি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিতে চলেছি। বহিষ্করণ দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত দু’জন হতভাগ্য পলাতক ভারতীয় বিপ্লবীকে আমি আমার অব্যবহার্য পুরানো কারখানাঘরে লুকিয়ে রেখেছি। এটা আমার পক্ষে খুবই দুঃসাহসের কাজ। যেহেতু এটা একটা আন্তর্জাতিক সৌজন্যের বিষয়, সেজন্য আমি এই কাজ করতে সাহসী হয়েছি। আমরা জাপানীরা আমাদের চোখের সামনে তাঁদের মরতে দিতে পারি না। … এই কথা শুনে ভৃত্যরা খুবই আনন্দিত হল, তাঁরা কোনো আপত্তিই করল না। তাঁদের গৃহস্বামীর এই সিদ্ধান্ত তাঁরা যে শুধু সানন্দে গ্রহণ করল তা নয়, তাঁরা সকলেই তখন একবাক্যে আমার স্বামীকে এই বলে আশ্বাস দিল যে, তাঁরা তাঁদের প্রাণ দিয়ে আশ্রয়-প্রার্থী ভারতীয় বিপ্লবী দু’জনকে রক্ষা করবে। তাঁদের চোখে-মুখে অকপট প্রভুভক্তি যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আমি আমার দু’জন পরিচারিকার মধ্যে একজনকে বোসের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত করেছিলাম।”

বর্তমানে কেউ যদি কল্পনা করেন যে, একদা সুদূর জাপানে একজন পাউরুটি বিক্রেতার অব্যবহার্য একটি পুরানো কারখানা ঘরের মধ্যে রাসবিহারী বসু আত্মগোপন করেছিলেন, তখন সেই ঘটনা তাঁর স্মৃতিপটে ১৯১০ সালে সকলের অলক্ষ্যে কলকাতা ত্যাগ করে চন্দননগরের ‘মতিলাল রায়ের’ বাড়িতে কাঠের আসবাবপত্র ভরা একটি ঘরের মধ্যে ‘অরবিন্দ ঘোষের’ সেই দুঃসাহসিক আত্মগোপনের চিত্রটিও ভেসে উঠবে; আর সেই সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে সুদূর কাবুলের এক দুর্গন্ধপূর্ণ উটের আস্তাবলের মধ্যে ছদ্মবেশী সুভাষচন্দ্র বসুর সেই আত্মগোপনের চিত্রটিও তিনি কল্পনা করতে বাধ্য হবেন। ভারতের এই তিনজন বিপ্লবী সন্তানকে দেশের স্বাধীনতার জন্য যে কতটা মূল্য চোকাতে হয়েছিল, সেটা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করবার জিনিস, বুদ্ধি দিয়ে নয়। বিপ্লবের কণ্টকময় পথে কিভাবে চলতে হয়, সেটা রাসবিহারীর জীবনের ইতিহাস থেকে যেভাবে শিক্ষা পাওয়া যায়, তার অন্য কোনো তুলনা ইতিহাসে আজও নেই।

(ছবি পরিচয়: নিজের পুত্র ও কন্যার সাথে জাপানে তোলা রাসবিহারী বসুর শেষ ছবি।)

(তথ্যসূত্র:
১- The two great Indians in Japan: Sri Rash Behari Bose and Subhas Chandra Bose, Georges Ohsawa.
২- Rash Behari Bose: The Father of the Indian National Army, Lexi Kawabe & Elizabeth Marsh.
৩- Ajia no mezame: Rasu bihari bosu den, Kokko Soma.
৪- Bose of Nakamuraya: An Indian Revolutionary in Japan by Takeshi Nakajima.
৫- রাসবিহারী বসু, জলধর মল্লিক, গ্রন্থতীর্থ (২০০৯)।
৬- কর্মবীর রাসবিহারী, শ্রী বিজনবিহারী বসু, দি ইস্টার্ন টাইপ ফাউন্দ্রী এন্ড ওরিয়েন্টাল প্রিন্টিং ওয়ার্কার্স প্রাইভেট লিমিটেড (১৩৬৩ বঙ্গাব্দ)।)
সংগৃহীত পোষ্ট

 

Print