ফাইনাল ডেষ্টিনেশন

ফাইনাল ডেষ্টিনেশন
হাসান মাহমুদ
 
FINAL_DESTINATION.jpg
নিউইয়র্কে বেড়াতে গিয়ে খালাতো ভাইয়ের বাসায় কথা বলছিলাম আমরা। আসলে বলছিল ওর বউ, আমরা শুনছিলাম। সে নার্স, অনেক হাসপাতালে কাজ করার পর এখন সিনিয়র কর্ত্রী হয়েছে বিখ্যাত এক বৃদ্ধ-নিবাসে। তার ভাষাতেই বলি।
 
আমাদের ব্যতিব্যস্ত ওল্ড-হোম। দোতালা দালানে হোটেলের মত মাঝখানে করিডোরের দুপাশে সারি সারি রোগীর কামরা। একদিন করিডোর দিয়ে যাচ্ছি, এক কামরার ভেতর থেকে ভেসে এল শব্দ “চটাস”! ভিতরে ঢুকে দেখি হুইল চেয়ারে বসে আছে রোগিণী। বুড়ি নড়তে পারে না, কথা বলতে পারে না, সবই করে দিতে হয়। তার চোখ দেখি অশ্রুতে ছলছল, কান্নাভরা চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নার্স। প্রশ্ন করলাম,
 
“তুমি ওকে চড় মেরেছ ?”
নার্স মেয়েটা এমনিতে ভারী লক্ষ্মী, কিন্তু সে আজ হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বলল, "হ্যাঁ, মেরেছি, মেরেছি!  কি করব ? কথা শোনে না, গোসল করতে চায় না, কাপড় পরতে চায় না, সবকিছু ধস্তাধস্তি করে করে দিতে হয়। কত পারব? কতদিন পারব ?”
“কি হয়েছে ?”
“গোসল করিয়েছি জোরজবরদস্তি করে, এখন জামা পরতে চায় না”।
“গোসল করিয়েছ কতটা গরম পানিতে ?”
“সবাইকে যে টেম্পারেচারে করাই !”
“কোন্ জামা পরাতে চেয়েছ ?”
“এই যে, এটা।“
“তোমাকে বলেছিলাম, তুমি ভুলে গেছ। বুড়ি সবসময় খুব গরম বোধ করে, ও একটু ঠাণ্ডা পানি চায় গোসলের জন্য। ওকে অন্যদের চেয়ে একটু হালকা কাপড়ও পরাতে হয়। বুড়ি কথা বলতে পারে না কিন্তু যা কিছুতে আপত্তি করে তার কোন-না-কোন কারণ আছে। আমি দুঃখিত, তোমাকে অফিসিয়ালি নোটিস দেব এ দুর্ব্যবহারের কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য”।
 
লক্ষ্মী নার্স কেঁদে ফেলল- "তা দাও, অসুবিধে নেই। আমি নার্স আর এটা আমেরিকা, একশ’ একটা চাকরি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কিন্তু এইসব রোগীদের আমরা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত কিভাবে যত্ন নেব ? আমার বাড়িতে কেউ উঁচু গলায় কথাটা পর্যন্ত বলে না ধস্তাধস্তি তো দূরের কথা। আমরাও তো মানুষ, আমাদেরও তো সহ্যের সীমা আছে!"
"না, নার্সদের সহ্যের সীমা থাকতে নেই। তুমি এখন যাও পরের রোগীর কাছে, আমি একে দেখছি”।
 
যত্নে হালকা জামা পরালাম বুড়িকে। যত্নে চুল আঁচড়ে দিলাম, হাতেমুখে ক্রীম মাখিয়ে দিলাম। তারপর হুইল চেয়ারটা টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে হাতে রিমোট-কণ্ট্রোলটা ধরিয়ে দিলাম, ওটা সে টিপতে পারে। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলাম অনেক আদরে। বুড়ি হাসিমুখে তৃপ্তিভরা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অফিসে ফিরে এসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ব্যস্ত রাস্তার দিকে। দুপুরের শহরে অসংখ্য মানুষ, অসংখ্য গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। কি এত জরুরী কাজ মানুষের? সন্ধ্যা নামবে ক’ঘণ্টা পরেই, কেউ খেয়াল করছে না। প্রত্যেক মানুষের জীবনের সূর্যও ধীরে ঢলছে পশ্চিমে, কেউ খেয়াল করছে না।
 
ষাট বছর আগে দুটি কপর্দকহীন তরুণ-তরুণী পরস্পরের হাত ধরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবন যুদ্ধে। কিছুই ছিল না তাদের, কিন্তু ছিল “ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা যেন না যাচি, কিছু নাই ভয় জানি নিশ্চয়, তুমি আছ আমি আছি”! প্রথমে ছোট্ট একটা দোকান করেছে, দিনরাত পরিশ্রমে সে দোকান ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে, তারপর করেছে অন্য ব্যবসা। সেটাও বেড়েছে, তারপর পয়সাকড়ি জমিয়ে এক ভাঙা বাড়ি কিনে মেরামত চুনকাম করিয়ে লাইসেন্স বানিয়ে খুলেছে বৃদ্ধ-নিবাস। দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে সেটাও।
 
“পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি ছিন্ন পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি.........”
 
তারপর ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে শুরু করেছে আধুনিক বৃদ্ধ-নিবাস। দিনরাত পরিশ্রমের মূল্যে রোগী বেড়েছে, কর্মচারী বেড়েছে, বেড়েছে খ্যাতি। সময়ের সাথে সাথে কর্মচঞ্চল তরুণ-তরুণী হয়েছে যবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া এবং শেষে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।
 
বুড়ো প্রায়ই হেসে বলত. –“জীবনে যা জ্বালিয়েছ তুমি আমাকে, এর প্রতিশোধ নেব। এখানে পঙ্গু হয়ে তোমার হাতের সেবা নেব আমি”।
 
শুনে বুড়ি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বুড়োকে তেড়ে মারতে আসত। বুড়ো তার কথা রেখেছে, ক’বছর আগে হার্টের ব্যামোতে নিজের হাতে বানানো বৃদ্ধ-নিবাসে পঙ্গু হয়ে বেঁচে ছিল ক’মাস। বুড়ি তরুণীর প্রেমে ও শক্তিতে জীবনের শেষ সেবা করেছে স্বামীকে রাতদিন। বুড়ো পৃথিবী ছেড়েছে তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে নিয়ে, এখন বুড়িও প্রহর গুনছে। চিরসঙ্গী কর্মদানব জীবনসাথী আজ তার পাশে নেই। স্বামীর হাত ধরে যে তরুণী বহু পরিশ্রমে একদিন প্রতিষ্ঠা করেছিল এই বৃদ্ধ-নিবাস, আজ এখানেই তার হুইল চেয়ারে পঙ্গু জীবন। আজ সে কথা বলতে পারে না, কিছুই করতে পারে না, আজ সে নিজেরই বৃদ্ধনিবাসে নার্সের চড় খায়। এ দালানের, এ অফিসের প্রতিটি কন্দরে জমে আছে তার কত বছরের কত স্মৃতি। এই করিডোরের, এই ঘরগুলোর কত শত ছবি তার চোখে ভাসে, কত কথা তার মনে পড়ে !
 
যে চেয়ারে আজ আমি বসি সেটাতে সে একদিন বসত। এই বুড়ি এই বিখ্যাত বৃদ্ধ-নিবাসের একচ্ছত্র মালিক-ই শুধু নয়, এর প্রতিষ্ঠাত্রীও ॥
 
জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমাদের কার কি অবস্থা হবে কে জানে !

Print