নূরুল আলম লাল- গায়ক ও গায়কী

নিথুঁত বাংলা ও উর্দু উচ্চারণ, সাবলীল গায়কী, সুরেলা কন্ঠ, কন্ঠে সুরের সুক্ষ্ম কারুকাজ, চওড়া স্প্যান, মসৃণ নাদ ও সংযত গমক সব মিলিয়ে নূরুল আলম লাল নি:সন্দেহে শ্রুতিমার্গের গায়ক. সেই সাথে আছে আমার খুব পছন্দের একটা অনুসঙ্গ, জোয়ারী ভিত্তিক সুরেলা স্ট্যান্ডিং. শৈশবে কৈশোরে তারুণ্যে সঙ্গীতের যে বৈশিষ্ট্য শুনতে শুনতে আমরা বড় হই তা আমাদের কমফর্ট জোন তৈরী করে. সেই বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক নিয়মেই বিবর্তিত হয়েছে কিন্তু আবাল্যের সেই কমফর্ট জোনে এখন মাত্র যে ক'জন গায়ককে পাই তিনি তাঁদের মধ্যে একজন.

তাঁর গানের সিডি "কত স্বপ্ন ছিল"-তে গান আছে বারোটা, সবগুলোই প্রেমের গান. কথাগুলো কোনো গানের সাধারণ কোনটার খুব সুন্দর, সুরেরও তাই. তবে সব গানেই স্বরের ও সুরের সুক্ষ্ম কারুকাজ সহ তাঁর গায়কী অত্যন্ত শক্তিশালী. একদিক দিয়ে গানগুলোর মিউজিক ডেভেলপমেন্ট একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারত. সেটা হল, তাঁর গায়কী কয়েক দশক আগে আমার কৈশোর-তারুণ্যের সময়কার –কিন্তু এ গানগুলোর মিউজিক ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্রের সহযোগিতা যাঁরা করেছেন তাঁরা একেবারেই আধুনিক কালের. তার মানে হলো গায়কী আর বাদ্যযন্ত্রের বাজানোর মধ্যে এক প্রজন্মের ফারাক. কিন্তু আশ্চর্য্যজনকভাবে তাদের মধ্যে সংঘাত না হয়ে সখ্যতা হয়েছে.

"মিষ্টি হাসি হেসে" ও "যে কলম দিয়ে তুমি" - সুন্দর মিষ্টি সুর - নিখুঁত গেয়েছেন সুন্দর গায়কীতে. কিন্তু গান দুটোয় নারীকন্ঠের হাসি ও আবৃত্তির কথাগুলো গায়কীর মত স্বাভাবিক লাগল না. "যেতেই হবে এই যদি শেষ কথা" গানটার সুন্দর সুর - বাদ্যযন্ত্রে তারুণ্যের ঝড় স্পষ্ট. "আমার সমুখে যমুনা পেছনে তাজমহল"- অপূর্ব লিরিকের ভারী সুন্দর গান. বাদ্যযন্ত্র সুন্দর. কড়ি-কোমল মিলিয়ে "তোমারই যাবার পরে", "পৃথিবী আমার বিদায় ঘনিয়ে এলে" এবং বসন্ত রাগের ছোঁয়া নিয়ে "এতোদিন পর তোমার" গানগুলো যে কোনো গায়কের পক্ষে চ্যালেঞ্জ. নূরুল আলম লাল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গানগুলোর দাবী পূরণ করেছেন.
"কত স্বপ্ন ছিল"- এ গানটা সিডি'র নাম-গান. ওটার রেকর্ডিং লেভেল অন্য গানের চেয়ে বেশী হয়েছে. তাতে অসুবিধে হয়েছে এই যে, অন্য গানগুলো শেষ হবার পরে এটা শুরু হয় খুব জোরে. তাতে গানটা কানে কর্কশ লাগে. কন্ঠও একটু কর্কশ লাগছিল. আরো একটা ব্যাপার আছে. গানটা বিষন্ন-রসের. ওটার সুরে, মিউজিক ডেভেলপমেন্ট-এ, বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে ও রেকর্ডিং লেভেল-এ সেই বিষন্নতা প্রতিফলিত হলে আরো ভালো লাগত. বারোটা গান, এতে অন্য ধরনের দুএকটা গান থাকলে কিংবা দাদরা কাহারবা'র সাথে দুএকটা ত্যাওড়া আদ্ধা থাকলে কেমন হত?

গান-কবিতার সিডি'র প্রচ্ছদে বানান ভুল থেকে কি বাংলাদেশ বেরুতে পারবে না? এগুলো সংস্কৃতির ব্যাপার -সেখানে বানান ভুল থাকা মোটেই ঠিক নয়. যাহোক, "কত স্বপ্ন ছিল" এ গানের সিডি দাঁড়িয়ে আছে আরেক বিরল সঙ্গীতের ওপরে তা হলো, শ্রোতাদের এটা নিবেদন করেছেন গায়কের স্ত্রী তামান্না আলম ও দুই ছেলে সজীব ও রাজীব. সজীব বাদ্যযন্ত্রে ও রাজীব তবলায় পারঙ্গম, পিতার গানে তারা অংশ নিয়েছে ওগুলোতে. একটা পরিবার থেকে এরকম নিবেদন বিরল, অত্যন্ত বিরল. কামনা করি এই শিল্পী পরিবার ক্রমাগত অতিক্রম করতে থাকুন তাঁদের নিজেদের সাফল্যকেই.


হাসান মাহমুদ
২২শে মে ৪২ মুক্তিসন (২০১২) 

Print