টরন্টোতে রণি-মুর্ছনা

একুশ বছর আগে ১৯৯০ সালে সেটাও ছিল এক বর্ষণমূখর সন্ধ্যা যখন তাঁর গান প্রথম শুনি। রনি প্রেন্টিস রয়, প্রধানতঃ রাগভিত্তিক শুদ্ধসঙ্গীত-গায়ক। এখন যখন প্রায় কোথাও আর যাওয়া হয়ে ওঠে না তখনও সুদীর্ঘ বিশ বছরের অজস্র ঘটনা-দুর্ঘটনা পার হয়ে সেই আকর্ষণ টেনে নিয়ে গেল বর্ষণমূখর টরন্টো'র শনিবার ০৪ মার্চ সন্ধ্যায়, তাঁর একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে। সঙ্গে তবলায় ছিলেন সবার পরিচিত মুখ দোলন সিনহা, শব্দযন্ত্রে আমাদের রাজু ভাই।

শুরুটা ধরিয়ে দিলেন হাসিনা কাদের তাঁর সাবলীল উপস্থাপনায়; তার পর বর্ষিয়ান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী বিমলকান্তি ঘোষ রোডম্যাপ তুলে ধরলেন - একাত্তরে সিলেটের শস্ত্রপাণি সৈনিক বাবা পর্সিভ্যাল প্রেÏিটস ও মা দীপ্তিকণা দত্তের কোলে জন্ম নেয়া বালক রনি প্রেন্টিস রয় তিল তিল করে কিভাবে গীটারবাদক থেকে শুধু কণ্ঠশিল্পীই হয়ে উঠলেন না, সংগীতের ওপরে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাও করলেন। মণিকাঞ্চনের মত তাঁর জীবনসঙ্গিনী ব্যারিষ্টার চয়নিকা দত্তও একাত্তরের সেক্টর কম্যা¨ার চিত্তরঞ্জন দত্ত ও মা শ্রীমতি মণীষা (রায়) দত্ত-এর কণ্যা।

মাঝখানে ছোট্ট বিরতিসহ প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে তিনি বিভিন্ন রসের বাইশটা গান উপহার দিলেন। শুরুতেই রাগ রাগেশ্রী ও নটভায়রো ভিত্তিক স্রষ্টাবন্দনায় আবেশ তৈরী হয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতায় শুরু হল তাঁর হাত ধরে শ্রোতাদের সঙ্গীতভ্রমণ। ঢিমা দাদরায় বর্ষার গানের পর ‘‘হরি না রে তব’’- এর ২য় লাইনটা ‘‘স্বপনে চোখে ভাসে তব মুখখানি’’ - রনি’র পরিশীলিত কন্ঠের টপ্পা - যা কিনা শ্রোতাদের মানসকে স্বভাবতঃই মানবেন্দ্র-এর জন্য তৈরী করে ফেলল। রনি নিখুঁত গাইলেন তাঁর প্রিয় গান ‘‘বনে নয় মনে মোর’’। এর পর তিন প্রজন্ম আগের সেই বিখ্যাত ‘‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’’ পার হয়ে আবার ঠুংরী-স্পর্শের নজরুল - ‘‘আর অনুনয় করিবে না কেহ’’ - মিশ্র মধুবন্তী রাগে। এর পরেই কলাবতী রাগে ‘‘ছলনা জানি তবু পারিনে ফিরে যেতে’’- তিনি তান-বিস্তার দিয়ে বিপুল সাজিয়েছেন বলেই বোধহয় আলাপের অভাবটা মনে লাগল। এরপর ‘‘যদিও এখনো গান’’ হবার পর বাগেশ্রীভিত্তিক নজরুল - ‘‘চাঁদের পেয়ালাতে’’। এটা সত্যি খুবই সুন্দর গেয়েছেন শিল্পী। এর পরের মাইলফলক অমরসঙ্গীত - ‘‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’’ - শিল্পী তাঁর গায়কিতে মানবেন্দ্রকে কপি না করে নিজস্ব ছোঁয়া লাগিয়ে আরো অপুর্ব করে তুলেছেন।

এরপর অনুষ্ঠানে নেমে এল বিষাদ, এলেন পিন্টু ভট্টাচার্য্য। হেমন্ত, মানবেন্দ্র, শ্যামল, তরুণ, দ্বীজেন, সতীনাথ, পান্নালাল, ধনঞ্জয়ের প্রজন্মের পর বাংলা গানে যে খরা তাকে অতিক্রম করে উচ্ছ্বল জলতরঙ্গে আবির্ভুত হয়েছিলেন পিন্টু। তিনিও সম্প্রতি প্রয়াত। পর পর তাঁর অমর গান গাইলেন শিল্পী, ‘‘এক তাজমহল গড়ো’’, ‘‘চলো না দীঘা’র সৈকত ছেড়ে’’, ‘‘তুমি নির্জন উপকুলে নায়িকার মত’’। এরপর পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী’র ‘‘যদি আবার জন্ম নেই’’ পার হয়ে অনল চট্টোপাধ্যায়ের ‘‘বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায়’’ যখন বাইরেও বৃষ্টিমুখর। এরপর রনি গাইলেন শ্রোতাদের অনুরোধে তিনটে গানের অংশবিশেষ, দু’টো মান্না দে আর একটা নজরুল। কিন্তু তিনি অনুরোধেও গাইলেন না রবীন্দ্রসঙ্গীত। ব্যাখ্যাকরলেন তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান - সবার সব গান গাওয়া উচিত নয় কারণ প্রতিটি গানের একটা দাবী আছে এবং কোন এক গায়কের পক্ষে সব দাবী মেটানো সম্ভব নয়।

এরপর জটিলেশ্বর-এর ‘‘আমার স্বপন কিনতে পারে’’ পার হয়ে আবার মানবেন্দ্র - ‘‘ওই চন্দ্রকলা’’ আর ‘‘বারে বারে কে যেন’’। তারপর দ্বিজেনদ্রলাল রায়ের অবিস্মরণীয় মাইলফলক - ‘‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’’। এরপর শেষ গান - ‘‘একই বাংলা দু’টি নয়নে’’। সমাপ্তিতেটবের ভেতর ফুটন্ত ফুল সহ সুন্দর একটা ফুলগাছ উপহার দিলেন উদ্যোক্তা সংগঠন বাংলাদেশ সেণ্টার অ্যাণ্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস। সব মিলিয়ে মন-ভরানো অনুষ্ঠান হল।

এবারে দোলন সিনহা। বাদ্যযন্ত্রীদের নিয়ে না লেখার প্রথা নেই কিন্তু প্রথাটা ভাঙ্গা দরকার। অতিরিক্তবিনয়ী এই ছেলেটা যে পশ্চিমবঙ্গের গত প্রজন্মের সঙ্গীত-দিকপাল অজয় সিনহা’র ভ্রাতুষ্পুত্র তা কেউই বোধহয় জানেন না। গত পনেরো বছর ধরে তার তবলা বাজানোর ক্রমাগত উন্নতি দেখছি খেয়াল করে করে, প্রবাসী শিল্পীর মধ্যে এটা বিরল। গত কয়েক বছরে তার বাঁয়া’র কাজ চমৎকার পর্যায়ে পৌঁছেছে, বিভিন্ন তালে ছন্দের বৈচিত্র্য ধীরে ধীরে আরো পরিপৃক্ত হচ্ছে এবং তার পরিমিতিবোধ লক্ষ্যণীয়। ঠুংরী-অঙ্গের ‘‘হরি না রে তব’’ গানে আড়ি ও ছন্দফেরতা, ‘‘যদিও এখনো গান’’-এ কাহার্বা দুনি’র ঢং, ‘‘আর অনুনয়’’-এর আড়ী, ‘‘আমি যামিনী’’-তে বাঁয়ার বোল ইত্যাদি মিলে দোলন বাজিয়েছে চমৎকার - এগুলো রনি’র গানকে আরো উপভোগ্য করে তুলেছিল। ‘‘বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায়’’ গানটা কাহার্বা তালে, দোলন বাজিয়েছেও কাহার্বা। অথচ রনি গায়কের মুড মাফিক তাৎক্ষণিকভাবে ওটা যেভাবে একটু অন্য ঝোঁকে গেয়েছেন তাতে আদ্ধা হলে আরো মিলে যেত মনে হল - আমার ভুলও হতে পারে। তবে গায়কের গায়কি, ঝোঁক আর ছন্দমাফিক বোল-এর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা বাদ্যযন্ত্রীর থেকেই যায়।

উদ্যোক্তাদের, শিল্পীকে, দোলনকে আর শব্দযন্ত্রে রাজু ভাইকে অজস্র ধন্যবাদ। সবার মতই ঘনঘোর বৃষ্টিতে বহুদুর থেকে আসা সার্থক হয়েছে আমারও।


হাসান মাহমুদ ০৮ মার্চ ৪১ মুক্তিসন (২০১১)

Print