কানাডার টরন্টোয় দেড় লক্ষ ডলার মূল্যের ভাষাসৌধ

Courtesy: মোহাম্মদ আলী বোখারী

কানাডার টরন্টোয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে স্থানীয় বাংলাদেশীদের উদ্যোগে গৃহীত প্রায় এক দশকের একটি অনুপম ভাষাসৌধ নির্মাণ প্রয়াস এখন চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারী স্কারবরো সিভিক সেন্টারের কাউন্সিল চেম্বারে অনুষ্ঠিত স্কারবরো কমিউনিটি কাউন্সিলের ১৩তম সভায় উপস্থিত সকল সিটি কাউন্সিলররা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কানাডার ঐতিহাসিক দ্বিতীয় কনফেডারেশন পার্কে দেড় লক্ষ ডলার মূল্যের এই ভাষাসৌধ নির্মাণের প্রয়াসটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এতে অন্টারিও মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধিত অলাভজনক বাংলাদেশীয়দের প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে মনুমেন্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি ইনক্’ সহসাই তাদের প্রাক্কলিত তহবিল উত্তোলন সম্পন্ন শেষে এই ভাষাসৌধ নির্মাণে সক্ষম হবে।


স্কারবরো কমিউনিটি কাউন্সিলের ওই সভায় ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে (আইএমএলডি) মনুমেন্ট ইন কনফেডারেশন পার্ক’ শিরোণামের এসসি ১৩.৩০ নম্বরযুক্ত প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন সিটি অব টরন্টোর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গ্ল্যান ডি বেয়ারমেকার। কমিউনিটি কাউন্সিলের বিলিকৃত আলোচ্যসূচীতে সংযুক্ত পাঁচ পৃষ্ঠার সেই প্রস্তাবনায় কাউন্সিলর বলেছেন, কানাডার বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষার স্মারক হিসেবে কনফেডারেশন পার্কের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে অবস্থিত বর্তমান গার্ডেনের পাশে উদ্যোক্তাদের দানকৃত এই ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে (আইএমএলডি) মনুমেন্ট’টি অনুমোদনের অনুরোধ জানাচ্ছি। সেটির সারসংক্ষেপ বিষয়বস্তুতে বলেছেন, চূড়ান্তভাবে এই অনুমোদন নির্দিষ্ট স্থানে ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে (আইএমএলডি) মনুমেন্ট কমিটি’কে তহবিল উত্তোলন শেষে সৌধ নির্মাণ শুরুর অনুমতি দেবে। একইসাথে আমি বলবো, এই প্রকল্পটি সম্পন্নে পার্কের কর্মকর্তারা আইএমএলডি কমিটির সঙ্গে একত্রে কাজ করবেন। তাতে কাউন্সিলর বেয়ারমেকার আরো বলেছেন, আইএমএলডি কমিটি দানের নিমিত্তে সিটির ‘অফিসিয়াল গিফটস, পাবলিক আর্ট’ অথবা ‘কমেমোরেশন’-এর সকল নির্দেশাবলী অনুসরণসহ ‘আর্ট কমিটি ফর পাবলিক প্লেসেস’-এর অনুমোদন লাভ করেছে। এ বিষয়ে আমি প্রয়োজনীয় দৃষ্টি আকর্ষণমূলক বিজ্ঞপ্তি কনফেডারেশন পার্কের আশেপাশের কমিউনিটিতে পাঠিয়েছি এবং তাতে পার্কের বিকাশে একমাত্র সম্মতিসূচক মতামতই জেনেছি। তদুপরি আইএমএলডি কমিটি সংস্কৃতি বিভাগসহ প্রটোকল বিভাগের দায়িত্বাবলী অনুসরণ করেছে। এছাড়া ওই প্রস্তাবনায় সিটির ওয়েবসাইটে বিদ্যমান ২০০৬ সালে মনুমেন্ট কমিটির কাছে প্রেরিত চিফ অব প্রটোকলের চিঠি, ২০১০ সালে কাউন্সিলরের কমিউনিটি নোটিশ এবং ২০১২ সালে এই প্রস্তাবনার স্বপক্ষে কাউন্সিলরের চিঠির ওয়েবলিংকত্রয় উল্লেখ করা হয়।

ভৌগোলিকভাবে কানাডার রূপায়নে সকল প্রদেশের সংযুক্তিতে কনফেডারেশন বা রাষ্ট্রীয়মৈত্রী গঠিত হয় ১৮৬৭ সালে এবং সেই প্রেক্ষিতে প্রথম কনফেডারেশন পার্কটির আত্মপ্রকাশ ঘটে রাজধানী অটোয়ায়। তারই শতবর্ষ পূর্তিতে টরন্টোর মারখাম ও এলসমেয়ার ইন্টারসেকশন সংলগ্ন ১৯৬৭ এলসমেয়ার রোডে সরকারীভাবে এই দ্বিতীয় কনফেডারেশন পার্কটি নির্মাণ করা হয়। সপরিসর এই পার্কে ইনডোর আইস হকি গ্রাউন্ড ও সুইমিং পোল ছাড়াও রয়েছে বিণোদন অনুষ্ঠানের জন্য একটি চমৎকার অডিটরিয়াম এবং বিশাল কার পার্কিং সুবিধা। অন্যদিকে, ফেব্রুয়ারি মাসে কানাডায় তুষারপাত হয় বিধায় টরন্টোর এই কনফেডারেশন পার্কটিই একুশে ফেব্রুয়ারির বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একমাত্র যথোপযুক্ত স্থান হিসেবে সিটি অব টরন্টোর কাছে অতি বিবেচিত হয়।

প্রসঙ্গত এই প্রতিবেদক ২০০৩ সালের অক্টোবরে সিটি অব টরন্টোর তৎকালীন নির্বাচিত মেয়র ডেভিড মিলারের একটি সাক্ষাতকার নেন, যা স্থানীয় সাপ্তাহিক বাংলা কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়। তাতে সুনির্দিষ্টভাবে মেয়র কর্তৃক একুশের প্রক্লেমেশন ঘোষণা, সিটি পার্কে ভাষাসৌধ নির্মাণ এবং বাংলাদেশী অধ্যুষিত ডেনফোর্থ এলাকার ‘স্ট্রিট সাইনেজে’ বাংলা টাউন দ্বৈতভাষায় নামকরণের সম্মতি লাভ সম্ভব হয়। এ জন্য ২০০৬ সাল পর্যন্ত একক প্রচেষ্টাটি অব্যাহত থাকে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর যথাক্রমে প্রথমবারের মতো মেয়রের প্রক্লেমশন লাভ এবং অন্টারিও প্রাদেশিক পার্লামেন্টে অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারী এমপিপি খলিল রামাল কর্তৃক বিবৃতি প্রদান সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এ উপলক্ষে টরন্টো থেকে প্রকাশিত চারটি সাপ্তাহিক পত্রিকা - দেশে বিদেশে, বাংলা কাগজ, বাংলা রিপোর্টার ও বাংলা নিউজের সহযোগিতায় মেট্রো হলে একুশের একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, যা পনেরটি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির মিলন মেলায় পরিণত হয়। এখান থেকেই সূচিত হয় এই ভাষাসৌধ নির্মাণ প্রয়াস, যা বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সম্প্রচারে গুরুত্ব লাভ করে। জুলাইয়ে গঠন করা হয় ২৫ জন বাংলাদেশীর সমন্বয়ে এই মনুমেন্ট কমিটি, আহবায়ক হন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান মাহমুদ এবং সদস্য সচিব এই প্রতিবেদক, পরে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

তারা সিটির সুনির্দিষ্ট বিধানে চিফ অব প্রটোকলের কাছে জমা দেন এই ভাষাসৌধ নির্মাণের প্রস্তাব। ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিচারকমন্ডলীর রায়ে বাংলাদেশে নব্বইয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা বুয়েটের আর্কিটেক্ট নাজমুল জায়গীরদারের নির্বাচিত ডিজাইনটি সিটির কাছে গ্রহনযোগ্য হয়। এরপর চলতে থাকে দীর্ঘমেয়াদী আমলাতান্ত্রিক নিয়ম রক্ষা। আর সেই অভিযাত্রায় যুক্ত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রয়েল আর্কিটেক্ট ইনস্টিটিউট অব কানাডার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট র্যােন্ডি ধর ও ড. আহসান হাবিব; বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্কিটেক্ট রফিক আজম, ইশতিয়াক জহির তিতাস ও ড. আদনান মোর্শেদ। তিন শতাধিক বহুভাষী মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এই মনুমেন্ট কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হচ্ছেন কানাডার প্রাক্তন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী ও সাংসদ মারিয়া মিন্না এবং অপর দুই কার্যনিবাহী কর্মকর্তা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহমেদ হোসেন ও হিসাবরক্ষক আকতার আহমেদ।


উল্লেখ্য, গত ১৪ ফেব্রুয়ারী স্কারবরো কমিউনিটি কাউন্সিল সভায় টরন্টোর ঐতিহাসিক কনফেডারেশন পার্কে এই ভাষাসৌধের অনুমোদনকালে মনুমেন্ট কমিটি থেকে কাউন্সিল চেম্বারের গ্যালারীতে উপস্থিত ছিলেন সভাপতি হাসান মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বোখারী, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব টরন্টোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহবুব রব চৌধুরী ও টরন্টো থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টু।

Print