একুশের রাণী
বাহান্নোর পূর্ব পাকিস্তান মাতৃভাষার আর্ত আহ্বানে টালমাটাল. সেই ছোট্ট শহরটাতেও আছড়ে পড়েছে ঢাকার উত্তাল ঢেউ.. স্কুলের বইখাতা ছুঁড়ে ফেলে জীবনের বৃহত্তর ব্রত শেখাবার জন্য পথে এসে দাঁড়িয়েছেন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়ত্রী, সমস্ত শহর, সুশীল সমাজ তাঁর পেছনে. প্রমাদ গুনল ঢাকার ম্যাজিষ্ট্রেট কোরেশী - সেই রক্ষণশীল সমাজে শিক্ষিকাকে গ্রেপ্তার করা হল. উত্তাল জনতা তখনি তুলে ফেলল দশ হাজার টাকার জামিন- সেটা নাকচ হল.. পুলিশ ভ্যানে তাঁকে ঢাকা পাঠানোর পথে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তাঁর হাজার হাজার উন্মত্ত ভক্তের দল - একশ' ষাটটা গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশের ওপরে.. পুলিশের আর্তনাদে ছুটে এলো ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, সেই ছোট্ট শহরের ইতিহাসে এই প্রথম জারী হলো ১৪৪ ধারা.. গ্রেপ্তার হলো ১১৫ জন, ২ জন ছাত্রী সহ.. সম্মানিত প্রধান শিক্ষয়িত্রীর গ্রেপ্তারের খবরে তখন সারা দেশে ক্ষোভের আগুন.. সরকার গিয়ে পড়ল তাঁর স্বামী খাদ্য পরিদর্শক আব্দুল মান্নাফের কাছে... ছুটে এল স্বামী প্রবর - "যা হয়েছে হয়েছে, এখন ওই মুচলেকায় সই করে ঘরে ফিরে চল"... মুচলেকা হল "যাহা করিয়াছি আর কদাপি করিব না".... অবাক হয়ে তিনি চেয়ে রইলেন স্বামীর দিকে কিন্তু স্বামীর তালাকের ধমকের পরেও কিছুতেই রাজী হলেন না... হয়ে গেল তালাক. তিনি ঘর হারালেন, চাকরী হারালেন কিন্তু যক্ষের মত আগলে রাখলেন মাতৃভাষাকে....
কলকাতা হাইকোর্টের সম্ভ্রান্ত বিচারক রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায় ও শিক্ষিকা মাখনমতি দেবীর কত আদরের একমাত্র মেয়ে কল্যাণী রায়চৌধুরীর সম্ভ্রান্ত জীবনে নেমে এসেছিল কার্তিকের ময়ুর সেই কত আগে, ১৯৪৬ সালে. ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ে সম্ভ্রান্ত এই ব্রাহ্মনকণ্যা পাড়ি দিলেন দুস্তর সাগর-মরু-পর্বত .....কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র গোপালগঞ্জের আব্দুল মান্নাফের হাত ধরে তিনি অতিক্রম করে গেলেন জাত-ধর্মের গণ্ডী, কল্যাণী রায়চৌধুরী থেকে হলেন মমতাজ বেগম..... এরই নাম প্রেম যার মাধুর্য্য, গৌরব যার দযিত্ব মান্নাফ রাখেন নি, তালাক দিয়েছেন এমন প্রেমময়ী স্ত্রীকে.
সম্ভ্রান্ত কল্যাণী রায় চৌধুরী, সম্ভ্রান্ত শিক্ষিকা মমতাজ বেগম দীর্ঘ দেড় বছর কারাগারে কাটিয়ে যখন বেরোলেন তখন তাঁর শরীর ভগ্নপ্রায়. জীবনের শেষ চেষ্টা করলেন ঢাকার আনন্দময়ী গার্লস স্কুল আর বাওয়ানী একাডেমীতে শিক্ষকতার কিন্তু শরীর আর সঙ্গ দিল না.... যিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস তাঁকে ভুলে গেল.. প্রায় কেউই জানলনা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১৯৬৭ সালের ৩০শে মার্চ ধীরে ধীরে নিভে এল তাঁর মৃত্যুহীন প্রাণ.... প্রায় কেউই জানলনা একান্ত অনাড়ম্বরে আজিমপুর গোরস্তানে তিনি চলে গেলেন মহা প্রস্থানের পথে চিরনিদ্রায়. সেই কবর কোথায় তা আজ কেউ জানে না. একমাত্র সন্তান খুকু তখন বিদেশে. আজ তিনি নেই - দেখেও গেলেন না এত বছর পরে তাঁর সেই প্রিয় স্কুলের সামনের রাস্তার নাম হয়েছে "ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক".
সেই ছোট্ট শহরের নাম নারায়ণগঞ্জ. সেই স্কুলের নাম মর্গান গার্লস স্কুল. সে স্কুল সেখানে আজো আছে, নেই শুধু এক অসাধারণ শিক্ষয়িত্রী যিনি মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য ধ্বংসের করাল গর্জন শুনেছিলেন সঙ্গীতের মত.... তথ্যসূত্র:- (1)জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৮ – ১৯৭৫ - অলি আহাদ. (2) ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম : আজীবন বিপ্লবী এক নারীর ভুলে যাওয়া অধ্যায় - আসিফ মহিউদ্দীন
হাসান মাহমুদ
০৮ ফেব্রুয়ারী ৪২ মুক্তিসন (২০১২)