আপনাকে ধন্যবাদ

আপনাকে ধন্যবাদ

৩১শে আগস্ট ৩০ মুক্তিসন (২০০০ সাল)


আবার এগিয়ে আসছে ভয়াল সেই ৩১শে আগষ্ট। আজ আবার আপনাকে হৃদয়ের গভীরতম স্পন্দন থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যেমন জানিয়েছি গত ২৫টি বছরের প্রতিটি ৩১শে আগষ্টে। জানাতে থাকব যতদিন বেঁচে আছি.
আপনাকে দেখেছি মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। আপনিও আমাদের দেখছেন মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তাই নিশ্চয় আমাদের কথা আপনার মনে নেই। কিন্তু আপনি যদি ১৯৭৫ সালে ৩১শে আগষ্টে সন্ধ্যায় তেজগাঁ এয়ারপোর্টে (তখনও নুতন এয়ারপোর্ট হয়নি)কর্মরত ইমিগ্রেশন-বস্‌ হয়ে থাকেন, আপনাকে জানাতে চাই আপনাকে আমরা দু’জন কখনো ভুলিনি। পৃথিবীর যেখানেই থাকি এই দিনে আমরা ফোনে সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতিচারণ করি আর আপনার উদ্দেশ্যে বলি - ‘‘আপনাকে অনেক, - অনেক ধন্যবাদ’’।

প্রতিটি বিপ্লবের সরব ধ্বংসের পর আসে প্রতিবিপ্লবের নীরব ধ্বংস। এসেছিল বাংলাদেশেও, একাত্তরের পর। সবার হাতে অস্ত্র - ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তারুণ্য-শক্তি। মতের ভিন্নতা, জেদ, অনভিজ্ঞতা, লোভ আর প্রতিহিংসা-পরায়ণতায় আরো অনেক জীবন ধ্বংস হয়েছিল যা ইতিহাসে জায়গা পায়নি। আমার সদ্য পাওয়া চাকরীটা যায় যায় কারণ অফিসে যাওয়া-আসাও তখন কঠিন। মরিয়া হয়ে আমি আর মঞ্জু দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছি। আর্থিক গরীব দু’টি তরুণ – টাকা, যোগাযোগ, গন্তব্য কিছু ঠিক করা নেই - শুধু চেষ্টা চলে যাবার - অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। বিস্তর মহাভারত পার হয়ে ফ্লাইট পাওয়া গেল ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫। গন্তব্য দুবাই। জায়গাটা মধ্যপ্রাচ্যে এইটুকু শুধু জানি - ওখানে আমাদের কেউ নেই।

হিমালয় টলে গেল ভোর রাতে, সপরিবারে খুন হয়ে গেলেন জাতির পিতা। ফ্লাইট বাতিল।

আবার অসহ্য অপেক্ষা। ৩১ আগষ্ট বিকেলে মঞ্জু ছুটে এল - দু ঘন্টা পরে ফ্লাইটের সিট পাওয়া গেছে, এখনি পৌঁছতে হবে এয়ারপোর্ট। বাবা-মা ভাইবোন কেউ জানল না, তড়িঘড়ি সামনে কাপড় যা ছিল আর এমএসসি'র সার্টিফিকেট স্যুটকেসে ভরে ছুট। ততক্ষণে সবাই ভেতরে ঢুকে গেছে - প্লেন ছাড়ে ছাড়ে। ইমিগ্রেশন-ক্লার্কের হাতে পাশপোর্ট টিকিট তুলে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছি। উত্তেজনায় কিছু হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে, চোখেমুখে খুব গরম লাগছে - পা দু’টো পাথরের মত ভারী।

কারণ, - আমাদের পাশপোর্ট ‘‘খারাপ’’, আমাদের টিকিটও ‘‘খারাপ’’।

লোকটা পাশপোর্ট-টিকিট দুটো লম্বা সময় হাতে ধরে থাকল। তারপর খুব ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর মরা মাছের চোখের মত ভাবলেশহীন চোখে আমাদের দিকে অপলক তাকাল, - চুপ করে তাকিয়েই থাকল। তার মানে তার অভিজ্ঞ চোখে আমরা ধরা পড়ে গেছি। আমরা জন্ম-ক্রিমিন্যাল নই, পারফেক্ট ক্রাইম করতে পারিনি। ভয় পাবার শক্তিও তখন আমাদের নেই। প্রচণ্ড মানসিক চাপে উত্তেজনায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ভয়ে আতংকে মঞ্জু শক্ত করে চেপে ধরেছে আমার হাত।

ওদিকে প্লেন ছাড়ে ছাড়ে।

তখন আপনি এলেন, ইমিগ্রেশন চীফ। ঠিক এলেন না, গটগট করে ওদিকে কোথা থেকে কোথা যেন যাচ্ছিলেন। ক্লার্কটা কিউবিক্‌ল থেকে বেরিয়ে আপনার কাছে গেল, আপনি থমকে দাঁড়ালেন। সে আপনাকে পাশপোর্ট-টিকিট দেখিয়ে কি যেন ফিসফিস করল। আমরা তখন দু’টো স্থির মৃতদেহ দাঁড়িয়ে আছি। আপনি আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন - আতংকে ত্রাসে পাথর আমরা আরো পাথর হয়ে গেলাম।

এই ৩৭ বছর পরেও হুবহু এখনো কানে বাজে আপনার জলদগম্ভীর কন্ঠস্বরে জীবনের বরাভয় - ‘‘লেট দেম ট্রাই দেয়ার লাক্‌’।

বলেই আপনি গট গট করে চলে গেলেন। লোকটা ফিরে এসে আমাদের পাশপোর্টে ষ্ট্যাম্প মেরে আমাদের বিদায় করল। ছুটে এসে প্লেনে উঠলাম, প্লেন আকাশে উঠল, বুক তখনো ধ্বকধ্বক করছে। আতংকে উত্তেজনায় মঞ্জুর তখন খুব জ্বর উঠে গেছে, আমার হাত ধরে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল - ‘‘এভাবে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের কি হবে? আমাদের টাকা কই’’?? তখন খোলা বাজারে বিদেশী মুদ্রা বেআইনী ছিল, মঞ্জু কোত্থেকে একশ পাউণ্ড জোগাড় করে এক মাস্তান-চীফকে দিয়েছিল। কথা ছিল তার লোক প্লেনের মধ্যে আমাদের ওই টাকা দেবে। সে টাকা এলনা। তার মানে আমরা কপর্দকশুন্য।

পরের মহাভারত বলে আপনার সময় নেবনা কিন্তু দু’টো কথা বলতেই হবে। দুবাই-ইমিগ্রেশন ক্লার্কের চোখও অভিজ্ঞ ছিল, ধরা আমরা সেখানেও পড়েছিলাম। কিন্তু সেখানে সেই মাঝরাতে আপনার মত ইমিগ্রেশন চীফ ছিলনা যিনি দুটি অনভিজ্ঞ তরুণের সামনে জীবনের দরজা খুলে দেবেন। আমাদের পাশপোর্ট আটক হল, আমরাও আটক হলাম। কেউই বোধহয় জানেনা প্রতিটি বিমানবন্দরে ছোট্ট একটা জেলখানা থাকে। সারা রাত বন্দী থেকে পরদিন দুপুরে আমরা দুজন সেখান থেকে কিভাবে পালালাম সেকথা থাক, কি অবস্থায় পালালাম সেকথা বলে শেষ করি।

তখন আমাদের (১) পরণের কাপড় ছাড়া কোন কাপড়, স্যাণ্ডেল-টুথব্রাশ-রেজর-চিরুণী কিচ্ছু নেই কারণ স্যুটকেস চিরতরে কোথায় হারিয়ে গেছে, কোনদিনই আর সেগুলো ফিরে পাইনি. (২) কোন শিক্ষা-সার্টিফিকেট নেই, কারণ ওগুলো স্যুটকেসে ছিল, (৩) পকেটে একটা পয়সা নেই, (৪) কোন বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন নেই, (৫) জায়গা চিনি না, (৬) ভাষা জানি না, (৭) ভিসা নেই, কারণ (৮) পাশপোর্টই নেই, আর, এই সবগুলোর চেয়ে আরো অনেক মারাত্মক - (৯) আগষ্টের মধ্যপ্রাচ্য, দোজখের গরম!!

কিন্তু আপনি জেনে রাখুন আপনার শুভেচ্ছা ব্যর্থ হয়নি। সবদিক দিয়ে ভয়াবহ অবস্থা থেকে শুরু করে সেই দুটি তরুণ দানবের শক্তিতে জীবন-যুদ্ধ করেছে এবং পরিপুর্ণ সফল হয়েছে। এখন তারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দু’টো দেশের বৈধ নাগরিক। সাধারণ মানুষের যা চাইবার তা সবই তারা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয় তারা আপনার ঋণ শোধ করার চেষ্টাও করেছে - বেশ কিছু কিশোর-তরুণদের লাক্‌ ট্রাই করার সুযোগ করে দিয়েছে। যাদেরকে দিয়েছে তাদের অনেকেই আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত - তারাও একদিন পরের প্রজন্মকে সুযোগ করে দেবে। সমাজ এভাবেই এগোয়, মানুষই মানুষের কাজে আসে।

আপনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন এই কামনা করে আবারো বলি - আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।

 

(৪০ মুক্তিসন ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ৩১শে আগষ্টে আমি এটা পোষ্ট করি - হাসান মাহমুদ)
 

Print