অজানা একাত্তর - রক্তাক্ত পদ্মা - মুক্তিযুদ্ধের ওপরে উর্দু বই "পদমা সুর্খ হ্যায়"-(পদ্মা রক্তলাল)-এর অনুবাদ
মূল লেখক - আনোয়ার শাহিদ খান, বাংলা অনুবাদ - হাসান মাহমুদ. Email:- This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
বইয়ের প্রচ্ছদ:-
অনুবাদকের কথা:-
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপরে বই লেখা হয়েছে অসংখ্য. সেই তালিকায় এ বই কয়েকটি ভিন্নমাত্রায় এক অমূল্য ও মৌলিক সংযোজন. পাঞ্জাবের লাহোর শহরের ছেলে আনোয়ার শাহিদ খান ১৯৬৭ সালে ইন্টারউইং স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে. থাকত ফজলুল হক হল-এ. আমিও তখন সেই হলেই থাকি. সুদর্শন তো সে ছিলই, তার ওপরে তার কাব্যিক শের-শায়েরীর মন তাকে সবার প্রিয় করে তুলেছিল, আমার সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল নিবিড়. একাত্তরের পঁচিশে মার্চের আগে সে অন্য এক বন্ধুর সাথে প্রথমে রাজশাহী ও পরে ভারতে চলে যায়. জুন মাসে সে পাকিস্তানে ফিরে যায়. মার্চের প্রথম থেকেই সে প্রায় প্রতিদিন ডায়েরীতে তার অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছিল উর্দুতে. পাকিস্তানে ফিরে যাবার সময় বিমানবন্দরে সেই ডায়েরী নিয়ে যাওয়াও অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল. পাকিস্তানে ওই ডায়েরী থেকে সে এক সাহসী সম্পাদকের সাহায্যে খবরের কাগজে নিবন্ধ লিখতে থাকে যা পাকিস্তানে তোলকালাম সাড়া ফেলে দেয়. অনতিবিলম্বে সামরিক সরকার এবং ইসলামী মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়ে সে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে লুকিয়ে দু:সহ জীবন কাটায় কিন্তু তার লেখা বন্ধ করেনি. আমাদের স্বাধীনতার পরে সেই নিবন্ধগুলো নিয়ে "পদমা সুর্খ হ্যায়" নামে বই বের হয়, এই বই তারই বাংলা অনুবাদ, - "রক্তাক্ত পদ্মা". উর্দুতে "সুর্খ" মানে রক্তলাল।
আমাদের ওপরে পাকিস্তানী সরকারের লেলিয়ে দেয়া সৈন্যদের সেই গণহত্যা গণধর্ষণের দুর্দিনে এক পাকিস্তানী তরুণ পাকিস্তানেরই মাটিতে আন্ডারগ্রাউণ্ডে লুকিয়ে মৃত্যু-হুংকারের সামনে আমাদের পক্ষে এবং তার নিজের সরকার ও সৈন্যের বিরুদ্ধে কলম-যুদ্ধ করে যাচ্ছে এটা অবিশ্বাস্য. এ বইতে স্বচ্ছ সাবলীল ভাষায় উদ্বাস্তুদের প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তের অবর্ণনীয় কষ্ট এত জীবন্তভাবে উঠে এসেছে যেন পাঠকের মনে হবে চোখের সামনে এখনই ঘটছে একাত্তর. আনোয়ার সৎভাবে শুধু তা-ই লিখেছে যা সে দেখেছে.
এটা খুবই স্বাভাবিক যে তার অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা ছিল. দেশের অন্যান্য জায়গায় যেসব গণহত্যা গণধর্ষণ ঘটছিল তা আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধবদের মাধ্যমে ক্রমাগত জানতে পারছিলাম. সে সুযোগ তার ছিলনা. তাছাড়া জুন মাসে পাকিস্তানে ফিরে যাবার ফলে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের পরের অংশটুকু তার অজানা. তার পরেও, এ বইতে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অজানা কিছু দিক জানতে পারি. সেই সাথে দেখতে পারি এক দেশপ্রেমী কিন্তু নান্দনিক মনের পাকিস্তানীকে. তার চোখের সামনে জ্বলে উঠেছে মানচিত্র ভাঙ্গার দাবানল, একটু একটু করে পুড়ে যাচ্ছে তার গর্বের পতাকা, তার প্রিয় দেশ অবিশ্বাস্যভাবে ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, তার এত গর্বের পাকিস্তানী সৈন্যেরা অমানুষিক বর্বরতায় গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে এগুলো তার কাব্যিক মনকে ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল. সেই সাথে উদ্বাস্তু হবার কষ্ট আর চারদিকের আর্তের আর্তনাদ তাকে মর্মান্তিক বাস্তবতার সম্মুখীন করেছিল. সেই ভগ্নহৃদয়ের আর্তনাদ এই বই.
ইতিহাসে অনেক জাতিই মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সফল হয়েছে খুব কম. আমরা হয়েছি, আমাদের গর্বের তাজ তাজ উদ্দিনের সুদক্ষ পরিচালনায়. কিন্তু মানুষের রক্ত আর মা-বোনের সম্ভ্রমের যে অজস্র মূল্যে আমাদের সেটা অর্জন করতে হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশের অতীত. একাত্তরটা কোনো ক্রিকেট ম্যাচ ছিল না - ওটা ছিল প্রবল ও হিংস্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটা শোষিত নিপীড়িত জাতির জীবনমরণ যুদ্ধের বিস্ফোরণ যুদ্ধ যেখানে প্রতিপক্ষের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ ও ঘৃণার উন্মত্ততা কাজ করে. যত নির্মমভাবে সম্ভব প্রতিপক্ষকে হত্যা করাটাই প্রথম ও প্রধান হয়ে দাঁড়ায়. সেই সময় আমাদের হাতে যদি থাকত পরমাণবিক বোমা আর বোমারু বিমান আমরা অবশ্যই পাকিস্তানের গ্রাম-গঞ্জে কেয়ামত ঘটিয়ে দিতাম. আজ বুঝতে পারি নিরপরাধ মানুষের ওপরে সেই মারণাঘাত কিছুতেই উচিত হতনা কিন্তু তখন আমরা সশব্দ ক্রোধে বিস্ফোরিত হয়েছি – তখন কোনো নীতিবাক্য শোনার সময় নয়. সেই ক্রান্তিকালে দেশের খেয়ে পরে এদেশের বিহারীরা যেভাবে পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষ নিয়েছিল, যেভাবে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল ও আমাদের হত্যা করেছিল তার বহু উদাহরণ আছে কিন্তু তা দেখার সুযোগ আনোয়ারের হয়নি. তাই যেখানেই পাকিস্তানী আর্মী পরাজিত হয়েছে বা পিছু হটে গেছে সেখানেই বিহারীরা হয়ে পড়েছে অরক্ষিত আর আমরা প্রতিশোধের হুঙ্কারে ঝাঁপিয়ে পড়েছি তাদের ওপরে. আনোয়ার সেটা দেখে কষ্ট পেয়েছে কিন্তু আমাদের ওপরে ওদের হিংস্রতা দেখেনি. ওদের ওই পরিণাম ডেকে এনেছিল ওদেরই হঠকারী নেতাদের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত.
এ বই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপরে ভবিষ্যতের গবেষকদের কাজে লাগবে. এটা ভাবানুবাদ করে জাতিকে দিতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি.
হাসান মাহমুদ
১১ই জুন ৪২ মুক্তিসন (২০১২ সাল)
********************************************************
"পদমা সুর্খ হ্যায়"
আনোয়ার শাহিদ খান
মুখবন্ধ (০৮ মার্চ ১৯৭২)
বছর খানেক আগে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের সুশীল সমাজ বোধহয় ভুলেই গেছে। হত্যাকে সমর্থন করা খুব বড় গুনাহ এবং আমরা আমাদের গুনাহ তড়িৎগতিতে ভুলে যেতে বিলক্ষণ পছন্দ করি। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে গুনাহ করাটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো না কোনো বাহানায় গুনাহ করাকে বৈধ করা বা তার সাফাই গাওয়া যেন আমাদের কর্তব্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ হেন কর্তব্য পালনে পশ্চিম পাকিস্তানের, বিশেষ করে পাঞ্জাবের দক্ষতা তুলনাহীন।
২৬শে মার্চ (১৯৭১) সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতায় জানা গেল বাঙ্গালীদের ওপরে পাকিস্তানী আর্মি আগুনের কেয়ামত নামিয়ে দিয়েছে। সেই সন্ধ্যাতে আমি রেডিও পাকিস্তানে (ঢাকা) একটা ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলাম - শুনলাম আমাদের সুশীল সমাজের কিছু লোক আর্মির খুব প্রশংসা করছে।
১৯৭১ - ১৬ই ডিসেম্বরের পরে সবাই আবার সেটাও সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।
ওটা ছিল গণহত্যার মত মারাত্মক গুনাহ'র প্রতি পরিষ্কার সমর্থন. এই গণহত্যা শুধুমাত্র একটা বিশেষ জনগোষ্ঠী বাঙালীর ওপরেই ছিলনা, বরং এটা ছিল নিজের দেশ - পাকিস্তানী জনগনের ওপরেও. বাঙালীর ওপরে গণহত্যা হয়েছে, সেই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের, বিশেষ করে পাঞ্জাবের জাতীয় চরিত্রের আত্মহত্যা হয়েছে. কে কখন কোথায় এই মারাত্মক গণহত্যা সমর্থন করেছে সেকথা আজ বারবার বলে লাভ নেই. এখন আমাদের সামনে পড়ে আছে শুধু বাংলাদেশের ধ্বংসযজ্ঞ, লক্ষ লক্ষ ধর্ষিতা মা-বোন, চুরানব্বই হাজার যুদ্ধবন্দী, “পাকিস্তান” নামের ওপরে বর্বরতার ছাপ আর ধুলায় গড়াগড়ি আমাদের সম্মান.
২৬শে মার্চ রাতে শুরু হওয়া এবং ১৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শেষ হওয়া জিহাদের এই ছিল করুণ পরিণতি. বড় বড়াই করা এই জিহাদ একটা দেশকে ভেঙ্গে ফেলেছে দুই খণ্ডে. দেশটা কোটি কোটি মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন এক বেসামরিক নেতা, জিন্নাহ.
অবশ্য এটাও ঠিক নয় যে ২১শে মার্চে সবারই বিবেক নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল. যাদের দেখার চোখ ছিল তারা ঠিকই দেখতে পাচ্ছিল সামনে কি অসম্ভব ভয়ংকর দিন আসছে, সেই দিনগুলো ১৯৪৭ সালের ভয়াবহ রক্তাক্ত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার চেয়েও শতগুণে নৃশংস হবে.
আর্মি'র হিংস্রতার বিরুদ্ধে এই পাকিস্তানেই, এই পাঞ্জাবেই উঠেছিল প্রতিবাদের কন্ঠ. কিন্তু নিপীড়নের দেয়াল ছিল খুব উঁচু আর নিপীড়কের হাত ছিল লম্বা ও শক্তিশালী. সেই হাতে ছিল বিদেশী অস্ত্র, বিদেশী মতবাদ ও বিদেশী স্বার্থ. তাই পূর্ব পাকিস্তানের ওপর অত্যাচারের সব প্রমাণ ও চিহ্ন নষ্ট করা হলো. "অত্যাচারিতের কান্না ছিল গগনবিদারী আর ঘাতকের চাকু ছিল সন্তর্পণ".
পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাঁরা আসছিলেন তাঁরা ছিলেন নির্বাক. সাংবাদিক সংগঠনের প্রধান কে জি মুস্তফা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন. চিরপরিচিত তাঁকে লাগছিল অপরিচিত - তাঁর এত বছরের পরিচিত বন্ধুদের তিনি হতবাক স্তম্ভিত করে ফিরে গেলেন. যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আর্মি'র গণসংযোগ অফিসারও - তিনি ওখানকার সব খবর বলেছিলেন.
কিছু সাংবাদিক ওখানে যেতে খুব ইচ্ছুক ছিলেন - কিন্তু তাঁদের বলা হলো - "কোথায় যাবে? তুমি ঢাকার বাইরে যেতে পারবে না - ঢাকাতেও তুমি একা কোথাও যেতে পারবে না. সরকারও তোমাকে যেতে দেবে না". তারপর সরকার কিছু বাছাই করা সাংবাদিকদের ওখানে যাবার ব্যবস্থা করল. তাদের মাধ্যমে বাঙালীর "বিশ্বাসঘাতকতা"র খবর আমরা পেলাম. কিন্তু আর্মি'র বিশ্বাসঘাতকতা, বর্বরতা ও বাঙালীর ওপরে গণহত্যার কোনো খবর আমাদের কাছে পৌঁছোতে দেয়া হলো না.
এ হেন অবস্থায় কোত্থেকে উঠে এলো এই তরুণ, যে ১৯৬৭ থেকে জুলাই ১৯৭১ পর্য্যন্ত সুদীর্ঘকাল বাঙালীর সাথে বাঙালীর মতই খেয়েছে থেকেছে আর যুদ্ধের সময় বাঙালীর মতই রিফিউজি হিসেবে ভারতে পালিয়েছে. লাহোর সরকারী কলেজের ছাত্র সে ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকালে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র. জানিনা কিভাবে সে আমার নাম শুনল আমার কাছে এল. পূর্ব পাকিস্তানে এতবড় একটা গণহত্যার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাকে অস্থির করে রেখেছিল কিন্তু বিষয়্টার প্রতি সে ছিল অত্যন্ত সিরিয়াস, নৈর্ব্যক্তিক ও আবেগবর্জিত. কথার মধ্যে মাঝে মাঝেই সে কথা হারিয়ে ফেলছিল - হয়ত ভাবছিল কি জানি সে কথা এমনি এক তিক্ত ও বিষাক্ত সত্য তুলে ধরবে যা পাকিস্তানের সহ্য হবে কি না ! তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল তার মনে নিরন্তর প্রচণ্ড ঝড়.
আনোয়ার শাহিদ বলছিল কিভাবে সে একাত্তরের মার্চ থেকে জুলাই পর্য্যন্ত কাটিয়েছে, কি সে দেখেছে, কিভাবে দেখেছে, ভারতে উদ্বাস্তু শিবিরে কি কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছে. তার বাঙালী বন্ধুও সেই কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছে. যেন পশ্চিম পাকিস্তানের তৈরী দোজখ থেকে ওরা অন্য আরেক দোজখে পড়ে গেছে. জীবনে কখনো এ রকম হয়.
পূর্ব পাকিস্তানে যা হয়েছে তা ইতিহাসের দাবীর প্রতি আমাদেরই নির্বুদ্ধিতা, অক্ষমতা ও অজ্ঞতার স্বাভাবিক পরিণতি. এর জন্য ভারত বা রাশিয়া বা অন্য কোনো দেশকে দায়ী করলেও শেষে দেখা যাবে এর জন্য দোষী আমরাই, আর কেউ নয়. আনোয়ার শাহিদের কাহিনী একাত্তরের সেপ্টেম্বর-এও শোনা যেতে পারত যখন গণহত্যা চলছিল কিন্তু ছাপানো অসম্ভব ছিল. তারপরেও আমি তাকে বললাম সে যা দেখেছে শুনেছে সব লিখে রাখতে. আমি তাকে সরকারের মার্শাল ল' রেগুলেশন পড়তে বললাম - হয়ত তা ওর লেখাতে সহায়ক হবে - হয়ত,... হয়ত বা........
এই "হয়ত"র ওপরে নির্ভর করেই আনোয়ার লিখল মার্চ থেকে জুলাই এই ক'মাসে পূর্ব পাকিস্তানে যা সে দেখেছে শুনেছে. অসংখ্য নারীর ওপরে গণধর্ষণের কথা সে বলেছিল কিন্তু সেটা পাকিস্তানে তখনও লেখা যায় নি, এখনো যাবে না. অসহায় নিরীহ মা-বোনের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই বীরত্বের অনেক সংবাদ ওঠে ওখানকার কাগজগুলোতে. কবি নাসির কাজমী'র ভাষায়:-
Cities upon cities were set afire;
this was how festivities were made.
How shall I say with what ignominy?
the lamps of chastity were blown out.
জ্বললো আগুন শহরের পর শহরে,
এভাবেই হলো উrসব দানবের,
কি লজ্জায় সেই অসহ্য কথা বলি?
নারী-সম্ভ্রম কিভাবে হরণ করা হলো?
আনোয়ার শাহিদের ধারাবাহিক নিবন্ধ "পদ্মা সুরখ হ্যায়" (রক্তাক্ত পদ্মা) নামে বেরোতে থাকল লাহোরের দৈনিক মুসাওয়াত-এ. সবকিছু লেখা গেল না কারণ আমাদের সীমাবদ্ধতাও ছিল, ততটা সাহসও ছিল না. চারদিক থেকে প্রবল প্রতিবাদ আসতে থাকল, হুমকিও এলো কিছু. কিন্তু এসবের মধ্যেই সম্পাদক হানিফ রামাই-এর সাহসিকতার জন্য এটা কোন রকমে প্রকাশিত হতে থাকল. অনতিবিলম্বে এটা এত বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে পাঠক একদিনের জন্যও এটা মিস করতে চাইত না. সেই সাথে দৈনিক ডন প্রত্রিকার গুজরাটি সংস্করণের এক সাংবাদিক এটাকে গুজরাটি ভাষায় অনুবাদ করে সেখানে ছাপাতে থাকলেন. এর সর্বশেষ অধ্যায় ছাপা হল যেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু হল. মাত্র বারো দিনের মাথায় যুদ্ধ শেষ হল, এই নিবন্ধ হয়ে রইল সেই পরাজয়ের প্রতীক.
১৯৪৭ সালের ঘটনার ওপরে অনেক রকম লেখা হয়েছে. আনোয়ার শাহিদের লেখার সাথে আমি সেগুলোর তুলনা করব না. তাঁরা প্রতিষ্ঠিত লেখক, লেখাই তাঁদের পেশা এবং তাঁদের ভাষার দক্ষতা ও ভারসাম্য আছে. কিন্তু সাহিত্যের ব্যাপারে আনোয়ার শাহিদের না আছে তেমন কোনো দাবী না আছে নিজের লেখাকে সাহিত্যের সেই স্তরে বলে দাবী করা. তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র, দেশের এই সর্বনাশ দেখার ও লেখার “দুর্ভাগ্য” তাঁর হয়েছিল. কিন্তু এই "দুর্ভাগ্যের" জন্য হাজারও ভাল কাজকে বলি দেয়া যায়. হায়, দেশের এই সর্বনাশ দেখার “দুর্ভাগ্য” যদি পাকিস্তানে আরো অনেকের হত তাহলে কতই না ভাল হত.
শাফকাত তানভীর মির্জা
০৮ মার্চ ১৯৭২
************************************************
ভুমিকা
এ বই লেখার সময় আমার কি অসহ যন্ত্রণা হয়েছিল তা পাঠকের বুঝবার কথা নয়। যে ঘটনাগুলো, বা দুর্ঘটনাই বলতে পারেন, আমাকে এটা লেখার জন্য প্ররোচিত করেছে সেগুলো একজন দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি হিসেবে, একজন মানুষ হসেবে এবং একজন মুসলমান হিসেবে আমার জন্য ছিল অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক। আমার প্রাণপ্রিয় দেশটা দ্বিখণ্ডিত হতে যাচ্ছিল। ইসলাম আমাকে যে মূল্যবোধ শিখিয়েছিল তা পায়ের নীচে পিষে যাচ্ছিল। আশরাফুল মাখলুকাতের ওপরে নেমে এসেছিল সীমাহীন নিষ্ঠুরতা যা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। আর, আমাকে অসহায়ের মত নিজের চোখে সেসব দেখতে হচ্ছিল।
আমি সেসব দলিলবদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করলাম কারণ আমি জানতাম এই মর্মান্িতক দোজখের চারপাশে মিথ্যের দেয়াল এতই উঁচু করে বানানো হয়েছে যে নির্যাতিত ভুক্তভোগীদের বুকফাটা আর্তনাদ বাইরে থেকে একটুও শোনা যাবে না। এই সেই মুহুর্ত যখন ভাষা নির্বাক হয়ে যায়, কলমের কালি শুকিয়ে যায়। কলম আমারও শুকিয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমার বিবেক আমাকে ভেতর থেকে তাড়া করে ফিরছিল ওই মিথ্যের দেয়াল চুর্ণ বিচুর্ণ করার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে। এই দায়িত্ববোধ থেকেই আমি আমার শুকিয়ে যাওয়া কলম আবার ভিজিয়ে নিয়েছি ক্ষতবিক্ষত হূদয়ের রক্ত দিয়ে।
এই বইয়ের অনেকটাই আমাকে লিখতে হয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখী হবার আতংকের মধ্যে। যা লিখেছি তা রক্ষা করতে আমাকে প্রাণ পর্য্যন্ত বাজী রাখতে হয়েছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে সিকিওরিটি এত নিশ্ছিদ্র ছিল যে একটা সুঁচও গলে বেরনোর উপায় ছিল না (এ বইয়ের কিছু অংশ লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ফিরে যাবার আগে বাংলাদেশে গোপনে লিখেছিলেন যা তিনি সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন - অনুবাদক)। এই অবস্থায় ঘটনার বিবরণ লেখা দু দূটো বিরাট ডায়েরী ধরা পড়া মানে সোজা ফাঁসীর দড়ি। ভেবেছিলাম যে অসামান্য দলিল আমি আনলাম ওখান থেকে তা পাকিস্তানের জন্য একটা বিরল রকমের অমুল্যরতন হবে। কিন্তু আমি আকাশ থেকে পড়লাম যখন দেখলাম কেউ এটাকে পাত্তা দিচ্ছে না - কেউ এটা এমনকি বিনামূল্যেও নিতে চাচ্ছে না।
এই হতাশ অবস্থায় একেবারেই হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে আমার পরিচয় হল দৈনিক মুসাওয়াত-এর সহকারী সম্পাদক শাফকাত তানভীর মির্জা সাহেবের সাথে। তিনি বললেন কিন্তু আমার বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না তিনি এটা প্রকাশ করতে রাজী। আসলেই তিনি এটা দৈনিক মুসাওয়াত-এ ছাপতে শুরু করলেন - লেখক হিসেবে আমার নাম শাহিদ খান-এর প্রথম দু’টো অক্ষর থেকে ছদ্মনাম নিলাম ‘‘শাখ’’। ‘শাহিদ খান’’-এর মানে হল গাছের শাখা। যা হবার তাই হল, কিছু হিংস্র উগ্রপন্থী কিভাবে যেন জেনে ফেলল ‘‘পদমা সুরখ হ্যায়’’ সিরিজটা আমারই লেখা। ওরা আমার প্রাণান্ত করে ছাড়ল। ওরা ছড়িয়ে দিল আমি নাকি বাংলাদেশের আর ভারতের স্পাই। বেশ কিছু থানায় আমার বিরুদ্ধে এসব নিয়ে অভিযোগ রেকর্ড করা হল।
বন্ধুরা গোপনে জানাল আমার বাড়ী আক্রমণ ও আমাকে খুন করার প্ল্যান করা হয়েছে। আমি বাড়ী থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। জনসমক্ষে আমাকে অপমান করে কথাবার্তা চলতে থাকল। এমনকি আমার কিছু বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনও আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। স্বাভাবিকভাবেই আমার বাবা-মা ও ভাই-বোন আমার মতই পুরোটা সময় ধরে অত্যন্ত মানসিক উদ্বেগ ও যন্ত্রণায় কাটিয়েছেন। এমনকি এখনও রাস্তাঘাটে আমাকে ঘৃণা ও জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে পড়তে হয়। তাতে অবশ্য আমি কিছু মনে করি না। আমি ভালো করেই জানি এই সমাজে সত্য বলাটা এক অমার্জনীয় অপরাধ। এখানে কোন মাতাল, লম্পট, ঘুষখোর, মিথ্যেবাদী ও ঠকবাজ ‘‘গাজী’’ বা ‘‘মুজাহিদ’’ উপাধি পাবে কিন্তু সত্যবাদীর জন্য এখানে তৈরী করা আছে ফাঁসীর দড়ি।
এই ভেবে আমার খুব খারাপ লাগে যে পুরো সত্য আমি তুলে ধরতে পারিনি। বাক্স্বাধীনতার বিপুল গলাবাজী সত্বেও সত্য আজও রয়ে গেছে অসম্পুর্ণ। এখনও বোধহয় আমাদের মন-মানস কোনো এক অন্ধকুপে বন্দী। কেউ কেউ বলেন আমার নিবন্ধ আমাদের আর্মীর প্রতি অপমানকর। আমি বলতে চাই আমাদের আর্মীর প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা। তাঁদের দেখলে গর্বে আমার বুক ভরে যায়। একজন সৈন্যের সাজপোষাক বা সে দেখতে কেমন তার চেয়ে তার চরিত্র আমার আদর্শ মনে হয়। তাদের নিষ্ঠা, সততা ও কর্তব্যপরায়ণতা সবাইকে তাদের সম্মান করতে উদ্বুদ্ধ করে। এই কারণেই জাতি দুদু’বার সামরিক শাসনকে খুশীমনে গ্রহণ করেছে। একজন পাকিস্তানী সৈন্যের মধ্যে আমি ইসলামি মুল্যবোধ দেখতে পাই যা প্রতিটি সৈন্য মেনে চলতে বাধ্য। এই মুল্যবোধ কোন কোন নিরস্ত্রের ওপরে অস্ত্র চালানো নয় বরং তাদের এবং শিশু ও নারীদের রক্ষা করা। যারা আত্মসমর্পণ করে তাদেরকে খুন করা নয় বরং যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ভাল ব্যবহার করা। কিন্তু যখন আমি চোখের সামনে আমার এসব আদর্শকে পদদলিত হয়ে কাঁচের পুতুলের মত চুর্ণ-বিচুর্ণ হতে দেখি তখন তা আমার বুক ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। ভুল তো মানুষের হতেই পারে, কিন্তু সেই ভুল মেনে নিয়ে তাকে শুদ্ধ করাই তো মহত্ব। কেউ ‘‘আমার’’ বা ‘‘আমাদের’’ বলেই তাকে ছাড় দেবার অধিকার আমাদের নেই। আমরা কি সেই রসুলের উম্মত নই যিনি বলেছিলেন এমনকি তাঁর কন্যা ফাতমাও যদি চুরি করে তবে তারও একই শাস্তি হবে?
বাংলাদেশের প্রতি আমার সমর্থনের জন্য বেশ কিছু শুভ্যানুধায়ী আমার ওপরে রাগ করেছেন। আমি জানিনা কিভাবে তাঁদের বোঝাব। আমি তো পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বেলুচ ও পাঠান জনগণেরও সমর্থক। দেশে ও দুনিয়ায় প্রতিটি অত্যাচারিতকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু সেটা আমাকে একা করতে হবে কেন? আমি জানি প্রতিটি হূদয়বান সংবেদনশীল মানুষ আমার কষ্ট বুঝবেন ও ভাগ করে নেবেন। আমার সেই মর্মান্িতক দিনগুলোতে মুষ্টিমেয় যাঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন তাঁদের প্রতি অমি অনেক কৃতজ্ঞ। বিশেষ ধন্যবাদ জানাই আফাক, জাফরুল্লাহ, তাজাম্মুল ও আমার ছোট দুই ভাই মাজাহির ইকবাল খান ও মাসুদ আখতার খান যাঁরা এই বইয়ের ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।
আনোয়ার শাহিদ খান
৩৫-ই পাকিস্তান মিন্ট, লাহোর
মার্চ ১৯৭২
******************************************************************
মুখবন্ধ
(০৫ নভেম্বর থেকে ০৪ ডিসেম্বর পর্য্যন্ত দৈনিক মুসাওয়াত-এ প্রকাশিত সিরিজের মুখবন্ধ)
পুর্ব পাকিস্তান একটা অসম্ভব সুন্দর ও রোম্যান্টিক দেশ। এ দেশে বিস্তীর্ণ গ্রাম-গঞ্জে বাঁশঝাড়ে ঘেরা কুটিরগুলোতে ভোরবেলায় ল¥নের মৃদু আলোয় শিশুদের ঘুম ভাঙ্গে। আজানের শব্দের পর হরেক রকমের নানান রঙ্গের পাখীরা মিষ্টি কুহুতানে বাঁশঝাড়ে বাতসের ফিসফিসকে আমন্ত্রণ জানায়, আবাহন করে। এই সেই স্বপ্নের দেশ যেখানে দুর থেকে ভেসে আসে মাঝির বাঁশিতে প্রেমাপ্লুত সুর। এখানে দিকনির্দেশহীন ধীরে ভেসে যাওয়া নৌকোর সাথে ভেসে চলে হূদয়ও। দিগন্তবিস্তৃত গ্রামগঞ্জ, মাঠঘাট নদীনালা মনে বয়ে আনে নিবিড় প্রশান্িত। দুর নদীর তীরে ধীরে উঠে আসা প্রভাত-সুর্য্য এখানে স্বর্ণপ্রভায় ছড়িয়ে দেয় শুভেচ্ছা ও আশার বাণী। সন্ধ্যায় সেই সুর্য্য লজ্জাবতী নতমুখী কনে’র মত দিগন্েতর কোলে মুখ লুকোয়, শান্ত হয়ে আসে নৌকোগুলো ও তাদের পাল, স্তিমিত হয়ে আসে নদী, মাঝি তার বাঁশী রেখে দিগন্তে তাকায় মনভোলানো সুর্যাস্তের পানে। ঝোপ ঝাড় জঙ্গলের অজস্র গাছ মধুর ঘ্রানে আচ্ছন্ন করে আত্মা। উন্মুক্ত নীলাভ নীলাম্বর কুমারীর মনে আনে শিহরণ। কখনো মেঘঢাকা রোম্যান্টিক আকাশ পাখীদের ডাকে ক্রৌঞ্চমিথুনের আহ্বানে। এখানে কুমারীরা কাঁখের কলসীতে টানে পানি, শক্ত হাতে মাঝি টানে বৈঠা ও দাঁড়।
এই মায়াময় দেশটা মুহুর্তে আমার হূদয়হরণ করেছিল যখন ১৯৬৭ সালে প্রথম এখানে এসেছিলাম। এত সুন্দর একটা দেশ - অলেখক আমি ঠিক করেছিলাম এর ওপরে বই লিখব। নিয়তির পরিহাস - সেই বই আমাকে লিখতে হল ঠিকই কিন্তু তার সৌন্দর্য্যের ওপরে নয়, তার রক্তের ওপরে। মনে আছে লম্বা প্রাণবন্ত সুপারী গাছগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে বইয়ের নামও ঠিক করেছিলাম - ‘‘দি গোল্ডেন ল্যান্ড’’। তাই এদেশের গ্রামগঞ্জে যাবার সুযোগ আমি কখনোই ছাড়িনি। আমি নিয়মিত ডায়েরী লিখিনা কিন্তু যা কিছু আমাকে টনেছে সব একটা নোটবইতে লিখে রাখতাম। রাজনীতিতে কোন আগ্রহ ছিল না আমার কিন্তু সে সময়টাই ছিল রাজনীতি-উত্তাল। প্রায় প্রতিদিনই লেগে থাকত মিটিং মিছিল আর হরতাল। দেশের সংহতির জন্য যা কিছু গুরুত্বপুর্ণ মনে হত টুকে রাখতাম। আজ এত বছর পর যখন সেই নোটবই খুলি সেখানে দেখি অজস্র প্রেমময় ফুল আর ঘাতক পাথর পরষ্পরের সাথে লেগে আছে। তখন কি আমি জানতাম একদিন এমন সময় আসবে যখন এই ফুলগুলো মানুষের পবিত্র রক্তে ভিজে যাবে আর আমার এই নোটবই শিশিরের মত স্নিগ্ধ না হয়ে আগুনের হলকায় জ্বলবে !!
ভাঙ্গা বুক ও গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে রক্ত ও আগুনের এই আখ্যান আমাকে লিখতে হয়েছে। মার্চের ০১ তারিখে এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল যা আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল - ঢাকায় পাকিস্তানী পতাকা পোড়ানো হল। আমার নিষ্প্রাণ কলমও যেন সেদিন কেঁদে উঠেছিল। সেদিন থেকেই আমি প্রায় নিয়মিত লেখা শুরু করি। রাজনীতির প্রতি আমার আকর্ষণ নয় বরং গভীর বেদনা থেকে এটা উঠে এল - চোখের সামনে যেন অদুর ভবিষ্যতে আমার প্রিয় দেশের একটা একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ধ্বসে পড়া আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কলমই ছিল আমার একমাত্র গোপন সাথী যার সাথে আমি সঙ্গোপনে প্রায় প্রতিদিনই এই কষ্টের কথা বলছিলাম।
তারপর আমি (২৫শে মার্চের কিছুদিন আগে - এক বন্ধুর সাথে - অনুবাদক) নিরাপত্তার জন্য রাজশাহীতে চলে যাই। সেখানে কিছুটা শান্িত ছিল- আমার কষ্ট কিছুটা কমে এল। এ ছাড়া তখন লেখার মত তেমন কিছু ঘটেনি। তারপরে নেমে এল ২৬শে মার্চের কেয়ামত। আমার কলমও হয়ে উঠল দুর্বার, প্রতিদিন লিখে চললাম। ০২ এপ্রিলে বন্ধুদের সাথে অন্য জায়গায় যেতে হল। তখন উর্দুতে লেখা ডায়েরী কাছে থাকা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাই ওটাকে একটা ছোট্ট পলিথিন ব্যাগে ভরে এক চিহি¡ত জায়গায় মাটিচাপা দিয়ে রাখলাম যাতে পরে সুযোগমত ওটা আবার পেতে পারি। মাটিচাপা দেবার আগে ওটাতে আমি আমার শেষ চিঠি লিখলাম, যাতে ঠিকানা দিয়ে অনুরোধ করে লিখলাম কেউ যদি এটা হাতে পায় তাহলে আমার বাবা-মায়ের কাছে যেন পৌঁছাতে পারে।
০২রা এপ্রিলের পর আমাকে লিখতে হল বাচ্চাদের খাতায় কিংবা কোন ছোট্ট কাগজে - ওগুলো একসাথে গাঁথা ছিলনা। কিন্তু সেগুলোও আমাকে রেখে যেতে হল কারণ পরিস্থিতি এমন হল যে আমাকে ভারতে চলে যেতে হল। ভারতের রিফিউজি ক্যাম্পে কিছুই লেখা সম্ভব ছিলনা, কাজেই যতদুর সম্ভব মনে রাখার চেষ্টা করলাম। অবশ্য ঘটনাগুলো এমনই ভয়ানক ছিল যে সেগুলো ভুলবার উপায় ছিলনা। ভাগ্য ভালো ভারত থেকে ফিরে আমার ডায়েরী দুটো আর অন্যান্য কাগজ যাতে আমি নোট লিখেছিলাম সবই অক্ষত পেলাম. বৃষ্টিতে একটু ক্ষতি হলেও ওগুলো বেশ পড়া যাচ্ছিল. ভারত থেকে ফিরে আমার প্রথম কাজই হলো ভুলে যাবার আগে সেখানে যা ঘটেছে তা যতটুকু মনে আছে লিখে ফেলা. ভারতের আর চলমান ঘটনাগুলো একসাথে লিখতে শুরু করলাম.
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বোঝাতে শিক্ষিত সমাজ "আর্মী" আর অশিক্ষিত সমাজ "মিলিটারী" শব্দ ব্যবহার করত. "বিহারী" শব্দটা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুব গুরুত্বের সাথে বহুল প্রচলিত ছিল. সাধারণভাবে ১৯৪৭ সালে আগত উর্দুভাষী রিফিউজি, পাকিস্তানী পাঞ্জাবী, যে কোন অবাঙ্গালী ও ওপার বাংলা থেকে আসা বাঙ্গালী যারা উর্দু বলত সবাইকেই বিহারী বলা হত.
নিরাপত্তার জন্য আমার বন্ধু ইমদাদ-এর বাবা মাকে আমি "আঙ্কেল" ও "আন্টি" হিসেবে লিখেছি. আমার প্রতি তাঁদের স্নেহ ভালবাসা আমার রক্তের সম্পর্র্কীর চাচা-চাচীর চেয়েও বেশী ছিল. বরং বলা যায় আল্লাহ তাঁদের মনে আমার প্রতি এত ভালবাসা দিয়েছিলেন বলেই আমি বেঁচে আছি ও এ বই লিখতে পারা গেছে. বইয়ের অন্যসব নামও নিরাপত্তার কারণে বদলে দিয়েছি.
আনোয়ার শাহিদ খান
***********************************************************************
১লা মার্চ.
যন্ত্রনায় আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল, চোখে অশ্রু ঝরছিল আর সেই সাথে আমার আত্মা পর্য্যন্ত মোচড় দিয়ে উঠছিল. এতবড় একটা কষ্টের মুহূর্ত জীবনে আসবে ভাবতেও পারিনি. ঘটনার সেই উত্তাল আবর্তে আমার জীবনের লক্ষ্য, আবেগ, আকাংখা ও সম্মান এভাবে পুড়ে যাওয়া দেখার আগে আমি কেন অন্ধ হয়ে গেলাম না ! কয়েক ফুট লম্বা কয়েক ফুট চওড়া সবুজ-সাদা কাপড়ের সাথে আমার সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল. আমিও কেন সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ছাই হলাম না ! আমার সেই স্বপ্ন যার জন্য কত কিছু বিসর্জন দিয়েছি, সেই মরিচীকা যার জন্য কত মরুদ্যান ত্যাগ করেছি, অজানা অচেনা দেশ যার জন্য জন্মভুমি ছেড়েছি, সেই অপরিচিতেরা যাদের জন্য স্বজন ছেড়েছি তারা শুধু তাদের আনন্দের জন্য ক্রান্তিলগ্নে ঝুলে থাকা একটা জাতির দেহে শেষ পেরেক ঠুকে দিল. আজ, বেলা তিনটে ছয় মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের আঙ্গিনায় পোড়ানো হল পাকিস্তানের পতাকা.
ইতিহাস তার নুতন মোড় নিচ্ছিল. নিয়তি তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল- দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল সেটা. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন মুলতবী ঘোষণা করার সাথে সাথে হাজার হাজার প্রতিবাদী রাস্তায় নেমে এল. তারা চিত্কার করে শ্লোগান দিচ্ছিল, "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর'' -"ইয়াহিয়া ইয়াহিয়া, সাবধান সাবধান".
স্টেডিয়ামে পাকিস্তান আর এম-সি-সি'র মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ করা হল, পুলিশ ভ্যানে করে ক্রিকেটারদের হোটেলে দিয়ে আসা হল. চারিদিকে শুধু আগুন আর ধোয়া. গুলিস্তানে নাজ সিনেমা হল আর বেবী আইসক্রীম-এর এত সুন্দর দালান তখন জ্বলছে. বহু দোকান ভাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে - গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছে. পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারীরা আতংকিত হয়ে আছে. আমার মত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে ছাত্রেরা পড়তে এসেছে তারা নিরাপত্তার কথা ভেবে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে আছে. আমিও ঢাকার বাইরে চলে যাবার কথা ভাবছি.
২রা মার্চ
সারাটা দিন উত্তাল গেল. বন্ধুরা ঢাকা ছেড়ে যাবার পরামর্শ দিল কিন্তু আমি মনস্থির করতে পারছি না - ওদিকে ট্রেনও সম্পূর্ণ বন্ধ. সকালে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই জাভেদ আর ফারুকী এসে হাজির. আমরা একসাথে নাস্তা করে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন-এ গেলাম যাতে দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে কোনো অফিসারের সাথে কথা বলতে পারি. কিন্তু সে অফিসের লোকেরা ভেতর থেকে অফিস বন্ধ করে রেখেছিল. সারা শহরে শক্ত হরতাল সেদিন, লাঠি হাতে জনতা ঘোরাঘুরি করছে. হল থেকে বেরোতেই স্টেডিয়াম এর দিক থেকে মিছিল আসতে দেখলাম - সবাই শ্লোগান দিচ্ছিল - "জিন্নার পাকিস্তান, আজিমপুর গোরস্থান", "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর''. মিছিল মোড় নিয়ে রমনা পার্কের দিকে চলে গেল.
DPI অফিসের ওপরে পাকিস্তানী পতাকা দেখে জনতা চিত্কার করে উঠল - "নীচে নামাও, নীচে নামাও" ! উত্তেজিত জনতাকে দেখে অফিসের লোকেরা তাড়াতাড়ি পতাকা নামিয়ে গুটিয়ে ফেলল. হাইকোর্টের ওপরের পতাকাও নামিয়ে গুটিয়ে ফেলা হল. অফিস বন্ধ দেখে আমরা হলে ফিরে এলাম - ফারুকী আর জাভেদ চলে গেল. অবস্থা দেখে ওরা খুবই ভয় পেয়েছিল. কি করা যায় তা নিয়ে আমি স্থানীয় বন্ধু ইমদাদের সাথে পরামর্শে বসলাম. ঠিক হল দু'একদিনের জন্য আমরা বন্ধু তালাতের বাসায় থাকব. ওরা গুলশানে থাকে, ওর বাবা আর্মীর অফিসার. যদি অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে তবে আমরা রাজশাহীতে ইমদাদের
বাসায় চলে যাব. আমি তালাতকে ফোন করলাম, ওর মা ফোন ধরলেন. আমার জন্য তিনি খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, আমাকে তখনই তাঁদের বাসায় যেতে বললেন.
তালাত-ও আমাকে একই কথা বলল. হলের কাছের টেলিফোন অফিস থেকে তালাতকে ফোন করে ফেরার পথে দেখি জনতা একটা মদের দোকান ভেঙ্গে বোতল ভাঙ্গছে. তারপর বামদিকে দেখি আকাশে ধোঁয়া উঠছে, - একটা গাড়ী পুড়ছে.
সেখান থেকে আমরা বটতলায় গেলাম. জায়গাটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা জনপ্রিয় আন্দোলনকেন্দ্র যেখানে ছাত্রেরা মিটিং করে. এটা স্টেডিয়ামও নয়, মিলনায়তনও নয়, এটা একটা বিশাল ছড়ানো বটগাছ যার নীচে ছাত্র-আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র. শত শত ছাত্রেরা সেখানে জড়ো হয়েছিল. সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করা হল এবং বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হল পতাকাটা সবুজ, মধ্যেখানে একটা লাল সূর্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র. আমরা ওখানে যাবার সাথে সাথেই একটা ভক্সওয়াগন গাড়ী এসে থামল, তা থেকে কয়েকজন ছাত্র বেরিয়ে এল - একজনের কাপড় রক্তাক্ত. শোনা গেল ফার্মগেটে গুলী চলেছে এবং তিন জন মারা গেছে. তার রক্তাক্ত কাপড় দেখে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে উঠল, এর মধ্যেই সেখানে লোকের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে. অনেক অছাত্রও লাঠি হাতে সভায় যোগ দিয়েছে. সবাই তখন মিছিল করে ফার্মগেটের দিকে চলে গেল.
আমরা তখনই হলের দিকে রওনা হলাম যাবার পথে ভাবলাম শিক্ষা সচিবের বাসায় ফোন করি. হলের কাছেই বন্ধু লোকমানের বাসা - সেখানে গেলাম ফোন করতে. দুপুরে খাবার সময়ে কোথাও গিয়ে পড়াটা যেন কেমন - কিন্তু সে কিছু তো মনে করলই না বরং খুব যত্ন আত্তি করল. ফোনে শিক্ষা সচিব খুব ভালো ব্যবহার করলেন কিন্তু মাপ চেয়ে বললেন অফিস বন্ধ, তাই তাঁর কোনো সাহায্য করার উপায় নেই. তালাতকে আবার ফোন করলাম - সে খুব করে বলল এখনই তাদের বাসায় চলে যেতে. ভাবলাম তা তো যাব কিন্তু যাব-টা কিভাবে? ওদের বাসা বহু দুরে - এদিকে বাস রিকসা কিছুই চলছে না. ঠিক করা হল সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করতে, তখন হয়ত রিকসা পাওয়া যেতে পারে. এ ছাড়া আর কি-ই বা করার ছিল. কিন্তু সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিতভাবে ইমদাদের বাবা'র পিওন আজিজ এসে হাজির. সে জানাল, ইমদাদের বাবা এসেছেন কমলাপুরে তাঁর বোনের বাসায়, আমরা যেন এক্ষুনি সেখানে যাই. কমলাপুর কাছেই, বেশী দুরে নয়. পায়ে হেঁটে ওখানে পৌঁছাবার সাথে সাথেই ঘোষণা শুনলাম অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারী করা হয়েছে. ভাগ্য ভালো কারফিউ-এর আগেই পৌঁছেছিলাম আমরা, নাহলে পথেই গ্রেপ্তার হতে হত. আমি আগেও ইমদাদের ফুফু'র বাসায় এসেছি, উনারা আমাকে খুবই ভালবাসতেন. টেলিফোনে খবর পাওয়া গেল নবাবপুরে গুলী চলেছে এবং বহু লোক মারা গেছে. আরো জানা গেল বায়তুল মুকাররমের বন্দুক আর ঘড়ির অনেক দোকান লুট হয়েছে. ইমদাদের বাবা ঢাকায় এসেছিলেন অফিসের মিটিং-এ. ঠিক করা হলো ট্রেন চলা মাত্রই আমরা রাজশাহী চলে যাব আর সেখানে থাকব যতদিন না পরিস্থিতি শান্ত হচ্ছে. কারফিউ-এর জন্য হলে ফিরে যাওয়া গেল না, আমরা রাতে সেখানেই থেকে গেলাম.
০৩ মার্চ
অনেক আলোচনার পরে ঠিক হলো কারফিউ শেষ হলেই আমি হল-এ গিয়ে জিনিসপত্তর নিয়ে এ বাসায় আবার ফিরে আসব. এটাও ঠিক হলো সুযোগ পেলেই আমরা রাশাহী চলে যাব. আমি আর ইমদাদ হল-এ যাবার চেষ্টা করলাম. হরতাল চলছিল তাই কোন বাস-রিকসা পাওয়া গেল না. পথে কিছু ছেলে বলল ওদিকে গেলে বিপদ হতে পারে. কিন্তু আমরা থামলাম না, পথে দেখলাম জনতা লাঠি নিয়ে হাঁটছে. নবাবপুরের দিকে আবারো দেখলাম ঘন কালো ধোয়া. ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর জোয়ানরা সর্বত্র দৃপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে. আমাদের পথটা টেলিফোন অফিসের পাশ দিয়ে ছিল - আমরা ওখানে গিয়ে তালাত-কে ফোন করে ঘটনা জানালাম. তারপর আমরা সোজা হল-এ চলে গেছি. মাত্র গোসল করতে যাব কানে এল হৈ চৈ. হল-এর ভেতরের মাঠে এক ছাত্র চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে. সে বলছে পাশের রেলওয়ে কলোনিতে গুন্ডারা এক গরীব বিহারীর বাড়ী আক্রমণ করেছে, ওকে বাঁচাতে হবে. মুহুর্তের মধ্যে কয়েক ডজন ছাত্র লাঠি ও বর্শা হাতে সেদিকে ছুটে গিয়ে গুন্ডাদের তাড়িয়ে দিল. হরতাল প্রায় ২'টোর দিকে শেষ হল - আমরা লাগেজপত্র নিয়ে একটা রিকসা ভাড়া করে কমলাপুর পৌঁছলাম.
শেখ মুজিব সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন.
দুনিয়াটা এক আশ্চর্য্য জায়গা. জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত চমকপ্রদ, প্রতিটি সেকেন্ড আশ্চর্য্যে ভরা. আমার মনে হয় সংকীর্ণ মানসিকতাই সবচেয়ে বড় অপশক্তি. বিজ্ঞানের এত আবিস্কারের পরেও সংকীর্ণ মানসিকতাকে কেন যে আমরা অতিক্রম করতে পারল না !
আমার মনে হয় এর একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে ভ্রমণ, ভ্রমণ আর ভ্রমণ. মানুষ পরস্পরের কাছে আসতে পারবেনা ও একে অপরকে সম্মান করতে পারবে না যতক্ষণ পর্য্যন্ত না তারা একে অপরের সংস্পর্শে আসছে, একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গী বুঝতে পারছে ও আথিতেয়তা উপভোগ করছে. ভ্রমণ শুধু মানুষের দৃষ্টিই প্রসারিত করে না, বরং জীবনের অনেক নিগুঢ় সত্যকে বুঝিয়ে দেয়. যারা নিজের গন্ডী ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে ভ্রমণ করার সুযোগ পায় না তারা কুয়োর ব্যাং-এর মত বাঁচে. সময় আমাকে আরো একটা সত্য শিখিয়েছে; চরম সত্য ও চরম মিথ্যা বলে কিছু নেই. আজকে যা ঠিক বা ভুল তা আগামীকাল ভুল বা ঠিক প্রমাণিত হতে পারে. সময়ই নির্ধারিত করে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল.
ইমদাদের চাচাতো-খালাতো-ফুফাতো-মামাতো ছোট ছোট ভাই বোনেরা যখন স্কুলের বইতে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ-এর গুণকীর্তন পড়ছে বাইরে রাস্তায় তখন জিন্নাহ'র কুশপুত্তলিকা ও পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হচ্ছে, শ্লোগান উঠছে "জিন্নাহ'র পাকিস্তান - আজিমপুর গোরস্থান''. গত তেইশ বছরের প্রতিষ্ঠিত সত্য আজ মিথ্যে হয়ে গেল - কে জানে আজ যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল তার আয়ু কতটুকু.
০৪ মার্চ
সকালে খুব করে লুচি-মামলেট দিয়ে নাস্তা করলাম. দুপুর ২'টো পর্য্যন্ত হরতাল, কাজেই কোথাও যাবার প্রশ্নই ওঠে না. তিন মাস হয়ে গেল বৃত্তির টাকা পাইনি, গতকাল যে সুযোগটা এসেছিল সেটাও হরতালের জন্য মাঠে মারা গেল. পকেটে একটা পয়সা নেই, ব্যাংকও বন্ধ. গতকাল পল্টন ময়দানে শেখ মুজিব এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন. তিনি উপস্থিত প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন যে, শহরে কোনো চুরি-ডাকাতি বা লুটতরাজ হবে না. তিনি ঘোষণা করেছিলেন - "যারা এদেশে বাস করে তারা যে কোনো ভাষাতেই কথা বলুক তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব". এর পরে আর কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি. কিন্তু এর আগে বহু দোকান লুট হয়েছে যার বেশীরভাগ ছিল বিহারীদের. নাস্তার পরে বাচ্চাদের সাথে খেলতে বসে গেলাম. দুপুরে খাবার পর রেলওয়ে স্টেশনে গেলাম ট্রেন চলছে কি না দেখতে. না, ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ.
জনগনের চাপে রেলওয়ে-র এক কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে ফোন করে ট্রেন চলাচলের অনুমতি চাইলে তিনি তা দেন. কিন্তু কোনো রেল-কর্মচারী পাওয়া গেল না. এক পদস্থ কর্মকর্তা জনতাকে আশ্বাস দিলেন যে সন্ধ্যার মধ্যে ট্রেন চলবে কিন্তু কোথাও কোনো নাশকতামূলক কাজের দায়িত্ব তিনি নেবেন না. আমি আর ইমদাদ টেলিফোন অফিসে গেলাম বন্ধুদের ফোন করতে কিন্তু সেখানে না ছিল কোনো মানুষ না ছিল কোনো ফোন. আমরা ফিরে এলাম. পথে দেখলাম অনেক মিছিলে স্বাধীনতার উত্তপ্ত শ্লোগান উঠছে. পথে পড়ল টিভি ষ্টেশন, আর্মী দিয়ে সুরক্ষিত. ইমদাদের বাবা মিন্টু রোড থেকে ফিরে এসে খবর দিলেন - ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এক গোপন সফরে আসবে. এর ঠিক আগে আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল ঢাকায় কারফিউ তুলে নেয়া হয়েছে.
গত দুই দিনে ১২৩ জন আহত বা নিহত হয়েছে. সেই মৃতদেহ নিয়ে মিছিল হচ্ছিল, হাতের আঙ্গুলে মৃতের রক্ত মাখিয়ে তার প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করা হচ্ছিল. দূরদৃষ্টিহীন আয়ুব খান বেকুবের মত শেখ মুজিবকে জেলখানায় পুরে তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল. জনগনের দেশপ্রেমকে পুঁজি করে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের ব্যর্থ চেষ্টা হচ্ছিল. ঠিক যেমন সুবিধাবাদী শ্রেণীকে রক্ষা করার লক্ষ্যে ইসলামের অপব্যবহারের জন্য জনগণ ধর্ম-ব্যবসায়ীদের ওপর খাপ্পা, তেমনি স্বার্থের জন্য দেশপ্রেমকে অপব্যবহার করার কারণে জনগণ দেশপ্রেমই ধরে রাখতে পারছিল না. আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ ঠিক তখনই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে উঠল. বিস্ফোরণের ধাক্কায় জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল.
৫ই মার্চ
আজ দৈনিকগুলোর হেডলাইন ছিল - "বেতন পরিশোধ করুন". সাংবাদিকতার ইতিহাসে এরকম হেডলাইন বোধহয় আর কখনো হয়নি. শেখ মুজিব নির্দেশ দিয়েছেন - সব সরকারী ও বেসরকারী অফিস বেলা দু'টো থেকে সাড়ে চারটা পর্য্যন্ত খোলা থাকবে বেতন দেবার জন্য. সত্যি বলতে কি পূর্ব পাকিস্তানের সরকার সম্পূর্ণ শেখ মুজিবের হাতে. জনগণ তাঁর অনুমতি ছাড়া এক পা'ও চলতে রাজী নয়. আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম কথাও থেকে কিছু টাকা পাওয়া যায় কিনা সেই চেষ্টায়. সেখানে সব অফিস বন্ধ ছিল. DPI অফিসে গেলাম কিন্তু কোন লাভ হল না. তালাতকে ফোন করে জানলাম টঙ্গীতে আর্মি তিনশ' জনকে গুলী করে হত্যা করেছে. সে আরো বলল ইয়াহিয়া ঢাকায় আসবে বলে গুজব রটেছে. আমি ইমদাদকে ফোনে সব জানালাম. সে বলল এক হেলিকপ্টারকে গভর্নর হাউসে নামতে দেখা গেছে.
DPI অফিস থেকে আমি ফজলুল হক হল-এ গেলাম ক্যান্টিনে এক কাপ চা খেতে. যাদের সাথে দেখা হল তাদের অনেকে রাগ করে বলল আমি কেন হল ছেড়ে গেছি (তারা বোঝাতে চাইল আমি তাদের বিশ্বাস করিনি). ঢাকা রেডিও আর টিভি "পাকিস্তান" শব্দ ব্যবহার বন্ধ করে দিল, তারা বলতে থাকল "ঢাকা রেডিও" আর "ঢাকা টিভি". অনুষ্ঠান ঘোষক ও সংবাদ পাঠকদের চেহারা ছিল বিষন্ন ও কন্ঠ ছিল রুক্ষ্ম. সরকারকে ঠাট্টা-পরিহাস করা একটা নাটক দেখলাম টিভিতে. ঢাকা টিভি বাঙালী জাতীয়তাবাদী গান আর অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচার করতে লাগল. অবস্থা এতই গুরুতর, যে কোনো সময় সেটা এমনকি শেখ মুজিবেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে.
খবরে বলল ইয়াহিয়া খান আগামীকাল জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেবেন. কয়েক জায়গায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস আর পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহ করেছে বলেও জানা গেল. বাড়ীতে পৌঁছতে দেরী হলো -তাতে আঙ্কেল খুব রাগ করলেন - এরকম আর না করতে বললেন আর সাবধানে থাকতে বললেন.
প্রায় সবাই ভাবছে ০৭ই মার্চের আগে জাতীয় সংসদের অধিবেশনের ঘোষণা নাদিলে শেখ মুজিব বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হবেন. প্রতিদিনই বহু লোক আর্মীর হাতে খুন হচ্ছে, জনগণও ক্রমাগত আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে. ইয়াহিয়া খানের চেষ্টায় বিশ্বাসের যে বন্ধন গড়ে উঠেছিল তা তার নিজেরই সিদ্ধান্ত, জাতীয় সংসদের অধিবেশন মুলতবী, দ্বারা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে. সবার মনে সন্দেহ ও শংকা খেলা করছে, সবার মনেই আশাহত হবার ক্ষোভ বেড়ে উঠছে. সবাই শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে নিয়েছে. রাজনৈতিক ছলচাতুরীতে ছাত্রেরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে এবং এর মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম বদলে সূর্য্য সেন হল রাখা হয়েছে, ইকবাল হলের নাম হয়েছে জহুরুল হক হল. এ হেন পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খানের আজকের বক্তৃতা গুরুত্ব অসীম - এর ওপরে নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ.
০৬ মার্চ
সিদ্ধান্ত হয়ে গেল. কোটি লোক স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল, অনেকে আশাহত হল. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চে জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকলেন. কিন্তু তাঁর বক্তৃতায় পরিস্থিতির অবনতির জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করার জন্য জনগণ ইয়াহিয়ার ওপরে ক্রুদ্ধ হয়ে রইল. আজ রাজশাহী যাবার সুযোগ এসেছিল কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার দিকে যাচ্ছিল বলে মনস্থির করতে পারছিলাম না. যাইহোক, হল-এ গিয়ে বন্ধুদের সাথে পরামর্শ না করা পর্য্যন্ত এটা আমি স্থগিত রাখলাম. এজন্য আমি হল-এ ফিরে এলাম. এসে দেখি পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম. মাখন ভাইয়ের চিন্তিত চেহারা, খালিদ, আলী আর রউফের আশংকা দেখে খুব একটা ভরসা পেলাম না. ওরা সবাই আমাকে ঢাকা থেকে দুরে কথাও থাকতে বলল. মাখন ভাইয়ের (পুরো নাম আব্দুল কুদ্দুস মাখন) মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন. তিনি ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন যা ছাত্রসমাজে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করত. রউফ, আলী আর খালিদ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র. তাদের ধারণা ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তার আয়ু সীমিত, দুই প্রতিপক্ষ কোনভাবেই একমতে পৌঁছতে পারবে না. সুতরাং সে হিসেবেই পরিস্থিতি মোড় নেবে.
সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের একজন বিখ্যাত কবি জনাব জসিমুদ্দীন ইমদাদের ফুফু'র বাসায় এলেন. তিনিও উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন.
হল থেকে রিক্সায় ফেরার পথে রিক্সা-চালকের সাথে কথা বলে বুঝলাম অবাঙ্গালীদের (চলতি কথায় সবাই ওদের "মাউরা" বলত) প্রতি তাদের ঘৃণা এতই বেশী যে তা দূর করা অসম্ভব. আইউব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় একবার এক পিকনিক পার্টি থেকে ফেরার পথে দুটো অল্পবয়সী ছেলের কথাবার্তা আমার কানে এসেছিল. একজন অন্যজনকে বলেছিল - "কাল স্কুলে স্ট্রাইক, যারা উর্দু বলে তাদের বাড়ীঘর আমরা পুড়িয়ে দেব....". নিস্পাপ অল্পবয়সী বাচ্চাদের মুখে এ হেন কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম. কারা এদের মাথায় এই বিষ ঢুকিয়েছে, একটা পুরো প্রজন্মকে বিষাক্ত করে দিয়েছে?
এ ব্যাপারে ইডেন গার্লস কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়া এক মিছিলের কথা মনে পড়ে. একটা ইলেকট্রিক খাম্বার পাশে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়েছিল. কথায় কথায় "মাউরা" শব্দটা এসে পড়ল. তারপর দুজন চলে গেল আর তৃতীয় লোকটা আমাকে বাঙালী মনে করে আমার দিকে তাকিয়ে হৈ হৈ করে বলল আর খুব দেরী নেই -শেখ মুজিব খুব তাড়াতাড়িই মাউরাদের শায়েস্তা করে দেবেন. তারপর সে তার ব্যাখ্যানা শুরু করল কিভাবে এক "মাউরা" যার কাছ থেকে সে টাকা ধার করেছিল, নিষ্ঠুরভাবে শুধু তার রিকশাই ছিনিয়ে নেয়নি বরং তাকে মারধরও করেছিল. পুলিশের কথা থেকে কথাটা উঠল. সে ভয় পাচ্ছিল যে পুলিশ আন্দোলন বন্ধ করে দেবে. তার মনের কথা বের করতে আমি এক বৈপ্লবিক ছাত্র হবার ভান করে বাংলায় বললাম (ততদিনে আমি ভালো বাংলা বলতে শিখে গেছি) পুলিশ আর আগের পুলিশ নেই, তারা বদলে গেছে. আর কোনো পুলিশী অত্যাচার হবে না. শুনে সে তার মনের কথা উজাড় করে বলল- "তা ঠিক আছে স্যার, কিন্তু এই মাউরারা বাঙ্গালীকে খুন করছে. কি আর বলব স্যার, আমার চোখের সামনে পাঁচজন খুন হয়ে গেল". তারপর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলে গেল কিভাবে কিছু লুটেরা এক মাউরার ট্রাক লুট করছিল - হঠাত আর্মী এসে গুলী করলে সেখানেই পাঁচজন মারা যায়.
বাসায় এসে টিভি'র খবর ধরলাম. আঙ্কেল বললেন টিক্কা খান নাকি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হচ্ছে. কিন্তু টিভি'র খবরে সেটা ছিল না. আঙ্কেলের এক বন্ধু আমাদেরকে আরিচা পর্য্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেন - ওটা রাজশাহীর অর্ধেক রাস্তা. ভোর সাড়ে পাঁচটায় গাড়ী রওনা হবে. রাজশাহী পন্ছার জন্য সময়টা ঠিক ছিল কারণ কারফিউ শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটায়. আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল, ঢাকা কারাগার থেকে ৩২৫ জন কয়েদী পালিয়ে গেছে যার মধ্যে ৩৮ জন ছিল রাজনৈতিক কয়েদী. তারা বের হয়ে রাস্তায় মিছিল করেছে. গুজব শুনলাম ক্যান্টনমেন্টে সব বাঙালী সৈন্যের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছে.
৭ই মার্চ
দিনাজপুরের মি: আলী'র জীপে করে সকালে আমরা রাজশাহীর পথে রওনা হলাম. আজকের কাগজে টিক্কা খানের গভর্নর হবার খবর ছাপা হয়েছে. আজ শেখ মুজিব এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন. সবাই খুবই উদ্বিগ্ন. অনেকে ভয় পাচ্ছে জনগনের চাপে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হতে পারেন. ঢাকা ছাড়ার এটাই ভালো সময় কারণ কোনো স্ট্রাইক ছিল না, আর শেখ মুজিবের বক্তৃতার পর কি হবে তা অনিশ্চিত ছিল. টিক্কা খানকে গভর্নর করা থেকে সরকারের উদ্দেশ্য পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল.
আমরা আরিচা ঘাটে পৌঁছলাম সকাল দশটায়. এবারে ফেরীতে নদী পার হতে হবে. ফেরীতে সবাই একই আলোচনা করছিল. একজন বললেন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য মুজিবের ওপরে খুবই চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে কিন্তু তিনি রাজী হন নি. নদী পার হবার পরে আমাদেরকে বসে করে রাজশাহী যেতে হলো কারণ যে জীপ আমাদেরকে রাজশাহী নিয়ে যাবার কথা তার ড্রাইভার বাসে করে এসে আমাদেরকে খবর দিল সেই জীপ ভেঙ্গে গেছে. নাটোরে পৌঁছে সেখান থেকে আমরা ট্যাক্সী নিলাম, আঙ্কেল অন্য একটা গাড়ীতে লিফট পেলেন. নাটোরে এক দোকানদার বলল বেলা দুটোর সময় হঠাৎ রেডিও পাকিস্তান বন্ধ হয়ে গেছে.
সন্ধ্যা সাতটায় কারফিউ শুরু হবার আগেই আমরা রাজশাহী পৌঁছলাম. জানা গেল শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি. তিনি বরং জাতীয় সংসদ বসার এইসব শর্ত দিয়েছেন - সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে, আর্মীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে, জনগনকে হত্যার তদন্ত করতে হবে এবং গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে. তিনি সমস্ত ফ্যাক্টরী আর আদালত বন্ধ ঘোষণা করলেন. রিকসা ও ট্রেন চলার অনুমতি দেয়া হল. বিবিসি তার রিপোর্টে বলল জনগনের চাপ সত্বেও যেহেতু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি তাই সংহতি ও একাত্মতার দরজা এখনো বন্ধ হয়ে যায় নি.
৮ই মার্চ
লেখার মত তেমন কিছু নেই. গতকাল কেন রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়েছিল তা জানা গেল - রেডিও'র কর্মচারীরা সব হরতাল করেছিল কারণ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা প্রচার করার অনুমতি দেয় নি. যাই হোক, সে বক্তৃতা আজ সকালে সম্প্রচার করা হয়েছে. আমি নিজে সেটা শুনেছি. তিনি যা কিছু বলেছেন তা খবরে বলা হয়েছে. বক্তৃতার শেষদিকে শেখ মুজিব জনগনকে বলেছেন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, এবং খুন-খারাপী, লুট বা অগ্নিসংযোগ না করতে.
০৯ই থেকে ২৫ মার্চ
এ সময়টায় রাজশাহীতে উল্লেখ করার মত কিছু ঘটে নি. সবাই ভাবছে ইয়াহিয়া, ভুট্টো আর মুজিবের সংলাপ সফল হবে এবং কোনো একটা পথ বেরিয়ে আসবে. সব অফিস বন্ধ আছে. নিয়মিত মিছিল চলছে, দু'একদিন পরে পরেই হরতাল হচ্ছে. কিন্তু লেখার মত অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি.
২৬ মার্চ
আঙ্কেল আমাকে আতঙ্কিতভাবে ভোর ৬ টায় ডেকে তুললেন. ইমদাদ কাছের একটা বিছানায় ঘুমাচ্ছিল, তিনি তাকেও ডেকে তুললেন. তিনি গুলির শব্দ শুনেছেন বললেন. গতরাতে সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব উঠেছিল কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি. যা পরিস্থিতি তাতে নির্বোধ ছাড়া আর কেউ সামরিক অভ্যুত্থানের চিন্তা করবে না. ঘটনা কি দেখার জন্য আমরা বেরিয়ে এলাম. চারিদিকে তুমুল হৈ চৈ. সবাই এলোপাথাড়ি ছুটছে. একজন বলল ট্রেন স্টেশনের কাছে আর্মী আকাশের দিকে গুলী ছুঁড়ছে. জায়গাটা আমাদের বাসা থেকে প্রায় তিন ফার্লং দুরে. বাসার সামনে দিয়ে একটা রিকসা তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছিল. আমরা তাকে থামতে হাত তুললাম কিন্তু সে থামতে চাইল না. আমরা পিড়াপিড়ি করাতে সে গতি কমালো আর কান্নাভরা আতঙ্কিত কন্ঠে বলল আর্মী সামনে যাকেই পাচ্ছে তাকেই ধরে পেটাচ্ছে - সে প্রাণ বাঁচাতে বাড়ীতে যাচ্ছে. তাকে বললাম আর্মী এমন কেন করবে? সে জবাব দিতে পারল না. তখন দুজন লোক এলো চিকিৎসার খোঁজে. তাদের পিঠের ক্ষত থেকে রক্ত বইছিল, সৈন্যের তাকে চাবুক মেরেছে. কেন মেরেছে তা তারাও বলতে পারল না. বাসায় আঙ্কেলের কাছে কিছু মলম ছিল সেগুলো লাগানো হল. একটা বালক এল যে ট্রেন স্টেশনে গিয়েছিল তার দুলাভাইকে নিতে. সে ও তার দুলাভাই দুজনকেই সৈন্যেরা ধরে পিটিয়েছে. পাকিস্তানী আর্মীর এই অত্যাচারে সবাই ক্ষেপে গেছে কারণ কেউ এর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না. প্রায় আড়াইটার দিকে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রচার করা হল পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও আর্মীর মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছে. সবাই যেখানে অধীরভাবে প্রেসিডেন্টের বক্তৃতার জন্য অপেক্ষা করছিল সেখানে এই খবরে জনগনের উত্তেজনা চরমে পৌঁছল. কিন্তু সেই বক্তৃতা শুনে শেষ আশাটুকুও উবে গেল. বক্তৃতার শেষে বিবিসি প্রচার করল যে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করেছেন. অল ইন্ডিয়া রেডিও জানাল সারা পূর্ব পাকিস্তানে কারফিউ জারী করা হয়েছে আর আর্মীর সাথে সংঘর্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বহু লোক খুন হয়েছে.
এখন মাঝরাত, আমার দুচোখ নির্ঘুম. আমি উদ্বিগ্নভাবে বিভিন্ন রেডিও স্টেশন ধরে সর্বশেষ খবর জানার চেষ্টা করছি.
২৭শে মার্চ.
অগ্নিগিরি বিস্ফোরিত হয়েছে. সেটা সম্পূর্ণ তুলে ধরা অসম্ভব তা যাঁর এতটুকু সাধারণ জ্ঞান আছে তিনি বুঝবেন. বিবিসি, অস্ট্রেলিয়া রেডিও আর অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে জানা গেল এ পর্য্যন্ত দশ হাজার লোককে খুন করা হয়েছে. রেডিও পাকিস্তান দাবী করেছে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে. অল ইন্ডিয়া রেডিও তার বিরোধীতা করে বলেছে গোপন এক রেডিও স্টেশন থেকে শেখ মুজিবের বাণী এখনো শোনা যাচ্ছে. গুজব রটেছে শেখ মুজব চট্টগ্রামে তাঁর হেড কোয়ার্টার বসিয়েছেন. আমেরিকান কনসাল জেনারেলের বরাতে বলা হয়েছে যে tank দিয়ে ঢাকার পরিস্থিতি সামাল দেয়া হচ্ছে.
রাজশাহীতে আজ অনেকে অফিস করেছে. মার্শাল ল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সব বাড়ীর ওপর থেকে কালো পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানো হচ্ছে. আঙ্কেল পাকিস্তান-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন - তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন. অন্য সবাইও খুব চিন্তিত. সন্ধ্যা ৫টা থেকে সকাল পর্য্যন্ত কারফিউ জারী করা হয়েছে. কাজেই গর্তে পড়া ইন্দুরের মত আমরা বাসায় আটকে আছি. যে কোনো সময় বাড়ী বাড়ী সার্চ হতে পারে, সৈন্যেরা অপমান করতে পারে এ ভেবে সবাই ভয় পাচ্ছে . শোনা যাচ্ছে শত শত লোক খুন হয়েছে. Bank দোকানপাট সবই বন্ধ. বাজার থেকে খাবার উধাও হতে পারে এ আশংকাও করা হচ্ছে.
আঙ্কেলের বয়েসী একজন লোকের এর চেয়ে বেশী উদ্বেগ আর কি হতে পারে? বিভিন্নভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানকে তিনি কত ভালবাসেন. চারিদিকে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর ওই ভালোবাসাই একটুখানি আশা.
২৮ মার্চ
বাইরে লাউড স্পিকারে তীক্ষ্ণ এক কন্ঠে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল. ঘোষণা করা হচ্ছে যে কারফিউ অনির্দিষ্ট কালের জন্য চালু থাকবে. ঘোষণার পরে পরেই গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল. আমরা বাড়ীর বাইরে এলাম কিন্তু কে গুলী ছুড়ল কেন ছুড়ল কিছু বোঝা গেল না. সবাই আতংকে চুপসে আছে. বাচ্চাদের চেহারা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে আছে. আবার গুলি ও পাল্টা গুলীর শব্দ শোনা গেল. তারপর এক প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল মাটি. মনে হচ্ছিল আর্মী পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে. এরপর একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দ - প্রতিটি বিস্ফোরণের সাথে সাথে বুকের মধ্যে আতংক আর ত্রাস. অটোমেটিক ব্রাস ফায়ারের সাথে একক গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছে - তার মানে যুদ্ধ হচ্ছে. মনে হাজারো প্রশ্ন. বিকেলে বাগানের মালী তাহির খবর নিয়ে এলো - পুলিশ লাইন থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে. কিছুক্ষণ পরে সে আবার খবর নিয়ে এলো - ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আর্মিকে আক্রমণ করে তাদের প্রায় সব গাড়ী ধ্বংস করে দিয়েছে. এটা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করল না.
২৯ মার্চ
ক্রমাগত মানসিক চাপে আমি বিপর্যস্ত. কিছু লিখতেও ইচ্ছে করে না. চারদিকে এত গুজব - শোনা যাচ্ছে শহরে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর নিয়ন্ত্রণে তারা ও পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানী আর্মিকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে. আমি বিদেশী রেডিও ধরে আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করছিলাম, তখন এক ভদ্রলোক এসে জানালেন পুলিশ জনগণের মধ্যে রাইফেল বিতরণ করছে আর স্বেচ্ছাসেবক হবার আহ্বান করছে. তার মানে হল যে কেউই রাইফেল চালাতে জানে এসে একটা নিয়ে যাক. তিনি মাত্র প্রস্থান করেছেন তখনই মালী এসে জানাল পুলিশ লাইনের সব পুলিশকে মেরে ফেলা হয়েছে, তাদের মৃতদেহ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আর লোকে তাদের রাইফেল চুরি করছে. আরেকটা গুজব শোনা গেল জেল ভেঙ্গে সব কয়েদী বেরিয়ে এসে ছুটে পালাচ্ছে. মালীর কথা কেউ বিশ্বাস করল না কিন্তু অন্য সুত্রে নিশ্চিত হওয়া গেল ভারী অস্ত্র দ্বারা পুলিশ লাইন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং বহু পুলিশ খুন হয়েছে. পাছে আমরা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ি এই ভয়ে খন্দক খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হল, আমার ১৯৬৫-এর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কাজে লাগল. লাহোরে আমাদের বাড়ী ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছে ছিল আর যুদ্ধ চলছিল পাকিস্তান মিন্ট কলোনীতে আমাদের বাড়ী থেকে মাত্র ৬ মাইল দুরে জাল্লো এলাকার বি-আর-বি খালের কাছেই.
কারফিউ-এর ব্যাপারে আর কোনো ঘোষণা না আসে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল. তখন নিজাম খবর নিয়ে এলো যে আর্মী তাদের এলাকায় খন্দক খুঁড়েছে আর আশেপাশের সব বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিয়েছে. সে আরো বলল আর্মী বেশ শক্তিশালী, তাদের সংখ্যা নিশ্চয়ই হাজারের কম হবে না. তারা রেডিও-ও নিয়ন্ত্রণ করছে. ওদিকে ঢাকা রেডিও ষ্টেশন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল. অল ইন্ডিয়া রেডিও জানাল জনগণ ঢাকা রেডিও ষ্টেশন অক্রমণ করেছে এবং তুমুল যুদ্ধ চলছে. বিবিসি'র প্রতিনিধি জানালেন শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার হবার খবরটা সম্ভবত: সত্যি. কিন্তু রাজশাহীতে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহের খবরটা সত্যি নয়, তারা তখনও আর্মীর সাথেই আছে.
লাহোরের জন্য মনটা পুড়ছে কিন্তু ফিরে যাবার কোন উপায় দেখছি না. ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার লাগছে.
৩০ মার্চ
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ. চারদিকে সর্বগ্রাসী অনিশ্চয়তা. কখনো মৃত্যু এত কাছে যে আমি যেন তার এগিয়ে আসার পদধ্বনি শুনতে পাই.
আজ জেল ভেঙ্গে চোর-ডাকাত আর বিদ্রোহীরা বেরিয়ে এসেছে. তার ওপরে নিজের ছায়ার চেয়েও কাছে আছে সবচেয়ে বড় শত্রু যার নাম ক্ষুধা. আজ যে পরিস্থিতি তা যদি এরকমই থাকে তাহলে মানুষ না খেয়ে মরতে শুরু করবে অচিরেই. সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই অনেক যন্ত্রণার কষ্টের আর আতংকের নানান কথা মনে এল. আজকাল ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখছি, যদিও ওগুলো স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয় বলে এখনো মনকে প্রবোধ দিতে পারছি. খুব সকালে কালাম সাহেব এলেন. তিনি এক ইনসিওরেন্স অফিসে কাজ করেন. তিনি আসতেই রাজনীতির কথা উঠল. তিনি আশাবাদী মানুষ, যদিও মাঝে মাঝে আশাবাদী হবার ভান করতে হয় তাঁকে. মতামতের ব্যাপারে তিনি ভয়ংকর একরোখা. তিনি মনে করেন পাকিস্তানী সৈন্যেরা বেশীদিন লড়াই করতে পারবে না, শেষ পর্য্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে.
অল ইন্ডিয়া রেডিও বলছে স্বাধীনতাপন্থী যোদ্ধারা চিটাগং, যশোহর, কুমিল্লা, রাজশাহী আর দিনাজপুর নিয়ন্ত্রণ করছে. এমনিতেই অল ইন্ডিয়া রেডিও'র বিশ্বাসযোগ্যতা কম, এখন তা আরো কমে গেছে. রাজশাহী পাকিস্তানী আর্মী'র নিয়ন্ত্রণে না হলেও সেটা স্বাধীনতা-যোদ্ধাদেরও নিয়ন্ত্রণে নয়. তবে এটাও সত্যি যে, রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে আর্মীর অবস্থা বলতে গেলে বেশ খারাপই, তারা দরকারমত গোলাগুলিও ছুঁড়ছে.
সকালে রাজশাহীর ওপর দিয়ে ফাইটার প্লেন উড়ে গেল. কারফিউ-এর পরে যে দু'একটা দোকান বা অফিস খুলেছিল, প্লেন যাবার পরে সেগুলোও ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে গেল. শহর থেকে দলে দলে লোক রিকশা-টাঙ্গায় বা স্রেফ পায়ে হেঁটে গ্রামের দিকে ছুটছে. বিকেলে খবর এল রাজশাহীর একটা অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নিয়েছে, তারা এখন পুলিশ বাহিনী আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সাথে নিয়ে রাজশাহীর দিকে ছুটে আসছে. পাকিস্তানী আর্মী প্রধানত: রেডিও স্টেশন, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন অফিস আর পাওয়ার হাউস পাহারা দিয়ে চলেছে. তাদের মনোবল মনে হচ্ছে দৃঢ়. প্রচুর খাবার দাবার মজুত করে তারা নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে. শোনা গেল পাবনায় আর্মীর অবস্থা শোচনীয়, পাবনা শিগগিরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে যাবে. সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া রেডিও খবরে বলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলী চলেছে এবং প্রায় পঞ্চাশ জন শিক্ষককে মেরে ফেলা হয়েছে. রেডিও অস্ট্রেলিয়া জানাল টিক্কা খান গুরুতর জখম হয়ে মারা গেছে. অল ইন্ডিয়া রেডিও আরো জানাল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আর বিমান বন্দরে তুমুল লড়াই চলছে, এবং কাল রেডক্রস-এর প্লেন ঢাকায় পৌঁছাবে.
পুলিশ স্টেশন থেকে আঙ্কেল তাঁর দুটো রাইফেলই নিয়ে এসেছেন. কেউ একজন বলল তাঁকে সেগুলো আবার পুলিশের কাছে ফেরত দিতে হবে কারণ এরকম একটা ঘোষণা করা হয়েছে. আজ মেথর তার কাজ শুরু করেছে. সে বলল কাল-পরশু সে আসতে পারেনি কারণ তার সহকর্মীরা নিহত হয়েছে. অবস্থা এতই অনিশ্চিত যে কখন কি হবে কিছুই বলা যাচ্ছে না. বোঝা-ই যাচ্ছে দুই পক্ষই যে কোন মূল্যে জিতবার আপ্রাণ চেষ্টা করবে.
জীবন যখন এত সস্তা হয়ে পড়ে তখন আর কোনই মূল্য থাকে না. সারাদিন ধরে এসব গুজব শুনে শুনে মন এতই উচাটন হয় যে চরম সীমায় পৌঁছে যায়, - সন্ধ্যার দিকে মাথায় একেবারে ব্যথা শুরু হয়.
৩১ মার্চ
রাত গিয়ে ভোর হলো - ইমদাদ দেখি বিবিসি শুনছে. সময়টা খবর প্রচারের নয় - একটা পল্লীগীতি বাজছে. এত উত্তেজনার পর ওই পল্লীগীতি কি যে শান্তি এনে দিল ! হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নিলাম. তখনও চা তৈরী হয় নি, আমি টেবিল ছেড়ে উঠে সবার সাথে অল ইন্ডিয়া রেডিও'র খবর শুনতে গেলাম.
একটু পড়ে দেখি ইমদাদের মা নিজের হাতে আমার জন্য চা আনছেন. দেখে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম. বেশ কিছুদিন পড়ে ঢাকা রেডিও শুরু হল. অল ইন্ডিয়া রেডিও বলেছিল মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা রেডিও দখল করে নিয়েছে. কিন্তু রেডিও পাকিস্তান বলেছিল বিদ্যুত-বিভ্রাটের জন্য ঢাকা রেডিও বন্ধ ছিল. অল ইন্ডিয়া রেডিও বলেছিল ঢাকা বিমান বন্দরে তুমুল যুদ্ধ চলছে, কিন্তু ঢাকা থেকে আসা রাজশাহীর আকাশে পাক খাওয়া ফাইটার বিমান দেখে তা মনে হলনা. অল ইন্ডিয়া রেডিও আরো বলেছিল মুজিবের সমর্থকেরা ঢাকা দখল করে নিয়েছে. কিন্তু কেউই তা বিশ্বাস করেনি. যাহোক, যুগোস্লাভিয়ার সাংবাদিক আর লন্ডন টেলিগ্রাফের খবরে মনে হল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গুলীর খবরটা সত্যি. শহর থেকে হাজার হাজার লোক গ্রামে চলে যাচ্ছিল. খবর পেলাম কুষ্টিয়া, কুমিল্লা আর চিটাগাং-এ যুদ্ধ চলছে, প্লেন থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে. কেউ কেউ এটাকে বিদ্রোহ বলছেন. আমি বুঝতে পারছিনা এটাকে বিদ্রোহ বলব নাকি গত চব্বিশ বছরের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া বলব. ইতিহাসে দেখি এখানকার মানুষই পাকিস্তানের জন্মের মূল ভুমিকা পালন করেছেন. পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পানিপথের উর্দুভাষী লিয়াকত আলী খান মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদে ঢাকা থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন. লাহোরে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উপস্থাপনার গৌরব যাঁর, সেই শের-এ বাংলা ফজলুল হকের অর্জনের কথা কে ভুলতে পারে? কাশ্মীরের সৈয়দ আহমেদ শহীদের আন্দোলনে যেসব স্বেচ্ছাসেবকেরা স্রেফ পায়ে হেঁটে পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও পরে কাশ্মীর পর্য্যন্ত গিয়েছিলেন তাঁদের কথা আমি ভুলিনি. মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৬৫ সালে ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট কি সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছে ও বেশীর ভাগ মেডেল জিতেছে তাও আমার মনে আছে. পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মনোবল ও উৎসাহ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের চেয়ে একটুও কম নয়. আমি কেবল ভাবছি আর ভাবছি ইতিহাসের কি ক্রান্তিকালেই না আমরা এসে পড়েছি !
এইমাত্র অস্ট্রেলিয়া রেডিও জানাল পাকিস্তানী আর্মী প্রাথমিক বিদ্রোহ দমন করে ঢাকা সহ সব শহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে. খবর শেষ হতে না হতেই হেলিকপ্টারের তীক্ষ্ণ শব্দ বাতাস কেটে ছুটে এল. বাইরে এসে দেখি অনেক ওপরে পাকিস্তানী হেলিকপ্টার. ওটা চক্কর দিয়ে ধীরে ধীরে আর্মী ক্যাম্পে নেমে এলো. চারদিকে গুজব রটে গেল হেলিকপ্টারে সৈন্য ও গোলাবারুদ এসেছে. আরো শোনা গেল মুক্তিযোদ্ধারা পাবনা দখল করে ফেলেছে, পাকিস্তানী আর্মী শহর ছেড়ে পালিয়েছে. অন্যান্য বহু গুজবের মতো এটাও বিশ্বাস করতে কষ্ট হল. রাজশাহীতে আর্মী ক্যাম্পের বাইরে আসত না – প্রায় সারাক্ষণই ট্রেঞ্চে থাকত. সন্ধ্যা পর্য্যন্ত কোনো গুজবেরই সত্যতা প্রমাণ হলনা. কিন্তু এটা নিশ্চিত ছিল যে রাজশাহীতে আর্মী ক্যাম্পবন্দী হয়ে পড়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হলে তা সামলানো আর্মীর পক্ষে কঠিনই হবে. মন থেকে দুশ্চিন্তা তাড়ানোর জন্য সন্ধ্যায় লনে কিছু খেলাধুলা করলাম. মগরেবের নামাজ পড়ে লনে চেয়ার পেতে আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম. মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরেই বিরাট কাঠের বাক্সে বারুদের বিশাল স্তুপে যে মৃত্যু ওৎ পেতে আছে তা নিয়ে কেউ কিছু বলল না. এরকম অবস্থায় মনের জোর রাখা খুবই দরকার. ভীতকম্পিত হয়ে বাঁচার চেয়ে মনে জোর রেখে সাহসের সাথে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াই অনেক ভাল.
০২ এপ্রিল
কাল ডায়েরী লেখার সময় পাইনি. গত পরশু গুজব রটেছিল পাকিস্তানী আর্মীর ওপরে ভয়ংকর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে. গতকাল গুজবটা আরো বেড়ে গিয়েছিল. সবাই বলাবলি করছিল আক্রমণটা যে কোনো সময় শুরু হবে, তাই একটা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া দরকার. কিন্তু যাবটা কোথায় ? ঠিক করা হল এখান থেকে তিন মাইল দুরে আঙ্কেলের অফিসের মালী কাইউমের বাড়ীতে গিয়ে উঠব আমরা. নিয়তির
খেলা বলে একটা কথা আছে, - আমরা আজকাল তাই হয়ে গেছি মনে হচ্ছে. তাড়াতাড়ি আমরা নিজেদের বাকস প্যাঁটরা গুছিয়ে নিলাম. ইমদাদ যেতে চাচ্ছিল না, সে বলল সে রয়ে যাবে এখানেই. আন্টির চোখে তখন অশ্রু. তিনি বললেন ইমদাদকে ছেড়ে যাবার কোনো মানে হয়না. এতে ইমদাদ যেতে রাজী হল. কিছুক্ষণ পরে আঙ্কেল বললেন তিনি বাড়ী দেখাশোনার জন্য রয়ে যাবেন. এতে আন্টি আবার কাঁদতে শুরু করলেন. তখন ঠিক হল আমরা যেখানেই যাব সবাই একসাথে যাব. প্রতিবেশী মুশতাক সাহেবেরও আমাদের সাথে যাবার কথা ছিল, তিনি পরিকল্পনা মাফিক এর মধ্যেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে জীপে করে কাইউমের বাসায় চলে গেছেন. আমাদের জীপটা খারাপ হয়ে পরেছিল, তাই কথা ছিল মুশতাক সাহেবের জীপ ফিরে এসে আমাদের নিয়ে যাবে. মুশতাক সাহেবের জীপ যাবার পরে পরেই দেখলাম আর্মীর কয়েকটা জীপ দ্রুতবেগে সেদিকেই চলে গেল. মনে হল এ অবস্থায় মুশতাক সাহেব হয়ত জীপ পাঠাবেন না.
এর মধ্যেই কালাম সাহেব এলেন. তিনি বললেন আর্মীর ওপরে আক্রমণের গুজবটা মিথ্যা হতে পারে, তাই বাড়ীঘর ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না. কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে সবাই তাই মনে করল. তখন কায়ুম এসে বলল মুশতাক সাহেবের জীপ খারাপ হয়ে গেছে. কাইউমকে বলা হল মুশতাক সাহেবকে বলতে যে আমরা যাব না ঠিক করেছি. কিছুক্ষণ পরে মুশতাক সাহেব এসে হাজির. তিনি বললেন আত্মীয় স্বজন এসে কাইউমের বাড়ী আগেই ভরে ফেলেছে- তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাঁকে একটা আমগাছের নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে. এই নিরর্থক কষ্ট থেকে আমরা বেঁচে গেছি বলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম. অত্যন্ত পীড়াদায়ক এই অনিশ্চয়তায় আমি আর বিলাল ঠিক করলাম সারা রাত জেগে পাহারা দেব. তাই সন্ধ্যা না হতেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম যাতে তাড়াতাড়ি উঠে রাত জগতে পারি.
রাত দু'টোয় ঘুম থেকে উঠে বাড়ীর চারপাশে ঘুরে এলাম -চাকর তাহির আলী আর নিজামের পিঠ চাপড়ে দিলাম. ওরা আমাদেরকে এভাবে পেয়ে খুব খুশী হল. তখন হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে ভেসে এল গুলির শব্দ . গুলির শব্দ বাড়তে লাগল, তার সাথে যোগ হল মেশিনগান আর মর্টারের শব্দ. মনে হল তুমুল যুদ্ধ চলছে. আমরা ছাদে উঠে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করলাম. মনে হল ভারতীয় আর্মীর সাথে লড়াই হচ্ছে- সীমান্তটা এখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দুরে. লড়াই চলল সারাটা রাত ধরে. সকালে জানা গেল নবাবগঞ্জ থেকে যে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস আসছিল সেটাকে পাকিস্তানী আর্মী আক্রমণ করেছিল. সন্ধ্যায় জানা গেল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস চারদিক থেকে ঘিরে আনছে পাকিস্তানী আর্মীকে.
০৩ এপ্রিল
রাত প্রায় একটার সময় প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল. মনে হল সেটা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী আর্মীর বড় ধরনের কোনো অস্ত্রের শব্দ. ক্রমাগত একের পর এক গোলাগুলিতে সারাটা আকাশ তখন আলোকিত হয়ে উঠেছে. আর্মী ক্যাম্প খুব দুরে ছিলনা বলে প্রতিটি বিস্ফোরণের আওয়াজে আমাদের বাড়ীটা তখন কেঁপে কেঁপে উঠছে, জানালাগুলো ঝনঝন করে উঠছে. লড়াই চল সারাটা রাত, সকাল পর্য্যন্ত. সকালে জানা গেল নবাবগঞ্জ থেকে নওহাটা রোড ধরে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এগিয়ে আসছিল, - তারা নওহাটা রোডের চারধারের সব বাড়ী খালি করতে নির্দেশ দিয়েছিল. আমাদের বাড়ীও নওহাটা রোডেই, তাই আমরা তখনি বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়া ঠিক করলাম. কিন্তু কোথায় যাব? এর জবাব কারো জানা নেই. প্রথমে ঠিক হল কালাম সাহেবের বন্ধু এক ডাক্তারের বাসায় গিয়ে উঠব আমরা. পরে আঙ্কেল সিদ্ধান্ত বদল করলেন, আমরা গিয়ে উঠলাম উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা মতিন সাহেবের বাসায়. কালাম সাহেব তাঁর ডাক্তার বন্ধুর বাসায় চলে গেলেন.
মতিন সাহেবক আমি আগে দেখেছি. তিনি বুড়ো মানুষ এবং অত্যন্ত অমায়িক. তাঁর বিশাল বাড়ীর উত্তর দিকে তিনি আমাদের জন্য একটা ঘর খালি করে দিলেন. লাগেজগুলো ড্রইংরুমেই থাকল, - আমরা
এবারে সত্যি সত্যিই রিফিউজি হয়ে গেলাম. বাড়ীটা ছিল জেলখানার কাছেই. একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য বাড়ীর বাইরে আসতেই জেলখানার এক হাবিলদারের সাথে দেখা. সে বলল কিছু পুলিশ কয়েকজন জেল-ওয়ার্ডেনের সাথে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছে. তারা জেলখানার উচ্চপদস্থ অফিসারদের কাছে গিয়ে রাইফেল চেয়েছিল কিন্তু টা তাদের দেয়া হয়নি. এতে তারা খুবই ক্ষেপে গিয়েছিল কিন্তু এর মধ্যেই কেউ এ ঘটনা আর্মীকে জানিয়েছিল. আর্মী তক্ষুনি জেলখানা ঘিরে ফেলে ওদেরকে গ্রেপ্তার করে ফেলে. হাবিলদার বলল - "যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম. মনে হচ্ছিল আমাদের ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখে পড়তে হবে. কিন্তু আর্মী মেজর আমাদের ভালো উপদেশ দিয়ে ভালো ব্যবহার করে বিদায় করলেন". হাবিলদার দেখলাম মেজরের এই অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে হতভম্ভ আর খুব খুশী.
বিকেল ৩টার দিকে এক ফাইটার জেটের কর্কশ আওয়াজ শুনলাম. চারদিকে তখন আর্তনাদ, সবাই হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ির নীচে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে. আমিও তাই করলাম. সবাই ভেবেছিল জেট থেকে বোমা ফেলা হবে, কিন্তু সেটা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর অবস্থান জেনে নিয়ে ফিরে গেল. গুজব রটল জেট থেকে নাপাম বোমা ফেলা হয়েছে কিন্তু শিগগরই সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হল.
০৪ এপ্রিল
ভোর তিনটার দিকে ভয়াবহ গোলাগুলির আওয়াজে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল. মনে হলো একটা মেশিনগান বাসার খুব কাছেই. সেই মেঘলা আকাশের নিকষ অন্ধকারে কি সাংঘাতিক আতংকই যে লাগছিল ! হাড্ডাহাড্ডি সেই তুমুল যুদ্ধ সকাল পর্য্যন্ত চলল. সূর্য্য ঝন উঠেছে তখন মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন এক আধটা গুলির শব্দ ছাড়া চারিদিক বাকিসব সৌম্য, শান্ত. রাতে কি হল তা কিছুই জানা গেল না, কেউ কিছু বলতেও পারল না. ফাইটার জেট তিনবার আক্রমণ করল. ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস আমাদের থেকে তিন-চার মাইল দুরে আর্মী ক্যাম্পের কাছেই. তাই ফাইটার জেট-টা আমাদের বাড়ীর ওপর থেকেই ডাইভ দিয়ে নীচে নামছিল. বাচ্চাদের ততদিনে এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে. ওরা ভয় তো পায়-ই নি বরং খুব মজা করে দেখছিল.
০৫ এপ্রিল
সাধারনত: জেট ফাইটারের প্রথম দলটা আসে সকাল দশটার দিকে. তাই আগের যে বাসাটা আমরা ছেড়ে এসেছি সেটা একটু দেখার জন্য আমি আর ইমদাদ নিরাপদ সময় সকাল ৭টার দিকে বেরোলাম. রাস্তায় যাদের যে কয়জনের সাথে দেখা হল সবাইকেই খুব ভয়ার্ত আতংকিত দেখাচ্ছিল. কোনরকমে আগের ছেড়ে আসা বাড়ীতে পৌঁছলাম, রাস্তায় তেমন বিশেষ কিছু ঘটেনি. সেখানে দুজন চাকর শাকিল আর বিল্লু দিনের বেলায় থাকত, রাতে তারা তাদের বাড়ীতেই থাকত. তারা বলল প্রতি রাতেই সারারাত গোলাগুলি চলে. এর মধ্যে আইজাজ এল, সে কালাম সাহেবের বাড়ী দেখাশোনা করে. সে বলল কালাম সাহেবের বাড়ীর পেছনের উঠোনে একটা গুলী ফেটেছে, তাতে করে বাড়ীর একটা দেয়ালে ফাটল ধরেছে. সে আরো বলল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সৈন্যেরা রাতে রাতে বাড়ীর পাশ দিয়েই শহরে গেছে - ওরা ওদিকেই কথাও লুকিয়ে আছে. সে নিশ্চিত ছিল আমাদের বাড়ীর কথাও বুলেটের দাগ থাকবেই. একটু খোঁজাখুঁজির পরেই আঙ্কেলের বেডরুমের জানালার একটু ওপরে দেখা গেল বুলেটের দাগ. ওটার অবস্থান থেকে বোঝা গেল ওটা ছিল আর্মীর দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর ছোঁড়া.
এর মধ্যেই তাহির আর মালী এসে হাজির. তারা বলল ওভারসিয়ারের বাড়ীটা বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে. আমরা নিকুকে বললাম কিছু মুরগী জবাই করে দিতে আর গাইটার দুধ দুয়ে দিতে. এর মধ্যে আমরা ওভারসিয়ারের বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম তাহির ঠিকই বলেছে, বুলেটে বুলেটে দেয়ালগুলো একেবারেই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে. মনে হলো ওখানে একটা শেল-ও বিস্ফোরিত হয়েছে. ফিরে এসে দেখি দরজার সামনে এক সাপ কুন্ডুলী পাকিয়ে বসে আছে. আমরা ওটাকে মারার চেষ্টা করতেই সেটা সুরুৎ করে একটা গর্তে ঢুকে গেল. আমরা দুধ আর মুরগী নিয়ে ফিরে এলাম. ওখানে ইমদাদের সুটকেসের সাথে আমারও একটা সুটকেস রেখে এসেছিলাম, তা থেকে আমি একজোড়া কাপড়ও নিয়েছিলাম.
কাছেই এক বসত থেকে ধোঁয়া উঠছিল. জানা গেল চারিদিকে যাতে দেখা যায় সেজন্য পাকিস্তানী আর্মী তাদের ক্যাম্পের চারদিকের সব বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে.
মতিন সাহেবের বাসায় ফিরে এলাম নিরাপদেই. বাসায় আসতেই হেলিকপ্টারের শব্দ - বাচ্চারা চেঁচিয়ে উঠল - "ওই যে জেট, ওই যে জেট !!". বেরিয়ে এসে দেখি কপ্টারটা আর্মী ক্যাম্পে নামল. জেট-এর আক্রমণ শুরু হল স্বাভাবিকভাবেই, - হেলিকপ্টারের সাথে জেট ফাইটার গুলোও ফিরে গেল. ওরা আবার ফিরে এলো - মোট দুবার, দু'বারই গুলিবর্ষণ করে ফিরে গেল. মতিন সাহেবের বাসা শহরের এক ধারে যেখানে বাড়ীঘর বেশী নেই. খবর শোনার জন্য ধরলাম অল ইন্ডিয়া রেডিও. শুনলাম রাজশাহী জেলখানার দেয়াল গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে. জানালা খুলে দেখলাম জেলখানার দেয়ালগুলো দিব্যি বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে!!
০৬ এপ্রিল
ছেড়ে আসা বাড়ী নিয়ে আঙ্কেলের মন উচাটন হয়ে আছে. তাঁর মতে এখানে মহিলারা থাকুক, আর পুরুষেরা ওই ছেড়ে আসা বাড়ীতে গিয়ে থাকুক. কিন্তু এতে কেউ রাজী হল না. তিনি নিজে গিয়ে বাড়ীটা দেখে আসতে চাচ্ছিলেন. কিন্তু এই পরিস্থিতিতে শহরে একলা বেরোনো কিংবা বিশেষকরে ঐদিকে যাওয়া মানেই হল মরণফাঁদে পড়া. তাই আমিও তাঁর সাথে চললাম. মাত্র আমরা রওনা হয়েছি তখনি শাকিল এসে উপস্থিত. সে বলল যা পরিস্থিতি তাতে বাইরে বেরোনো নিরাপদ নয়, সে নিজেই অনেক বিপদ ঘাড়ে নিয়ে এখানে এসেছে. শুনে আমরা বাইরে যাওয়া বাদ দিলাম. শাকিল বলল সারা রাত অনেক গোলাগুলি চলেছে, আমরা যে ট্রেঞ্চ খুঁড়েছিলাম তার মধ্যেই সে সারারাত বসে ছিল. সে আরো বলল জেট ফাইটারের আক্রমণের মুখে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস পিছু হটে এসেছে.
শাকিলকে নিয়ে আমি দু'টো কাগজে লিখেছিলাম - একটা ইংরেজীতে অন্যটা উর্দুতে. তাতে লিখেছিলাম সে কোনো ব্যাপারে জড়িত নয়, সে এ বাড়ীতে আছে শুধু দেখাশোনা করার জন্য, তার সাথে ভদ্র ব্যবহার করা হোক. কাগজ দুটো ওকে দিলাম যাতে পাকিস্তানী আর্মীর কেউ ওকে জেরা করলে এগুলো হয়ত কাজে দেবে. সন্ধ্যায় শোনা গেল নুরুল আমিন আর মৌলবী ফরিদ আহমেদ রেডিওতে ভাষণ দেবেন. চারদিকে যা পরিস্থিতি তাতে খবরটা একটু অস্বাভাবিক লাগল. সবাই যা ভেবেছিল তাই হল, দু’জনেই একই কথা বললেন - এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ভারতের উচিত নয় এর ভেতরে নাক গলানো. নুরুল আমিনের বক্তৃতা নিয়ে মানুষের সন্দেহ ছিল ওটা তাঁর নিজের কন্ঠ কি না. অনেক ধৈর্য্য আর উদ্বেগ নিয়ে বৃটেনের পররাষ্ট্র সচিবের বক্তৃতাও শুনলাম - কিন্তু সেটা ছিল হতাশাব্যঞ্জক.
০৭ এপ্রিল
আঙ্কেল আর আমি কালাম সাহেবের বাসায় গেলাম দেখা করতে আর আলোচনা করতে ছেড়ে আসা বাড়ীটা দেখতে যাব কি না. তিনি বললেন ওদিকে যাওয়াটা ঠিক হবে না কারণ আর্মী ইপিআর অর্থাত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর লোকদের খুঁজছে, যে কাউকে তারা সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করতে পারে. তিনি আরো একটা ঘটনা বললেন - দুইজন বিহারীর সাথে কিছু পাকিস্তানী সৈন্য ওয়াপদা'র এসডিও'র বাসায় গিয়ে তাঁর বুকে বেয়নেট ধরে ইপিআর-এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল. তাঁর ছেলেমেয়েরা চিত্কার করে কাঁদছিল - আর কোরান হাতে তাদের পায়ে পড়ে বাবাকে ছেড়ে দিতে বলছিল, কেননা তিনি ইপিআর-এর ব্যাপারে কিছুই জানতেন না. সৈন্যেরা তখন তাদেরকে কোরান পড়তে বলেছিল - তারা কোরান পড়লে তারা উনাকে ছেড়ে দিয়েছিল.
পরিস্থিতি খুবই নাজুক. ছেড়ে আসা বাড়ীটা দেখতে যাবার কথাটা আমরা মাথা থেকে বের করে দিলাম. মতিন সাহেবের বাসায় এলে শাকিলের সাথে আবার দেখা হল. অর সাহস দেখে অবাকও হলাম ওকে বকাও দিলাম. ও বলল আমাদের ছেড়ে আসা বাড়ীতে রাতে চার পাঁচজন সৈন্য এসেছিল কিন্তু তারা ওকে কিছু বলে নি. শাকিল আমাদের জন্য গাই দুইয়ে দুধ এনেছিল. গরুর কিছু খাবার নিয়ে সে চলে গেল.
মতিন সাহেবের বাড়ীর খুব কাছে সুন্দর একটা পুকুর ছিল. আমি একটা বই হাতে তার পাড়ে গিয়ে বসলাম. কিছুক্ষণ পরেই কাছেই হুলুস্থুল গোলাগুলির শব্দ শুরু হল. মনে হল কোনো দল অন্য দলের ওপরে হঠাত হামলা করেছে. ভাবলাম কয়েদীরা পালাবার চেষ্টা করেছে আর গার্ডরা তাদের দিকে গুলী ছুঁড়ছে. ক'দিন আগে এভাবে পালাবার চেষ্টা করে দুতিনজন কয়েদী মারা পড়েছে. কিন্তু এবারে গোলাগুলি চলতেই থাকল আর তার তীব্রতাও বেড়ে গেল. আমি এক ছুটে বাসায় ফিরে এলাম. বাসার সবাই তখন ভয়ে চুপসে গেছে. বাড়ীর সমস্ত জানালা-দরজা বন্ধ করে দেয়া হল. চারিদিকেই গুলির শব্দ - এর সাথে যোগ হল মর্টারের বিকট আওয়াজ. সবাই ভয়ে কাঁপছে. এর মধ্যে জেলখানার এক সিপাই এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই - শহরে ইপিআর এসে পৌঁছেছে, তারা ফাঁকা ফায়ার করছে. আরেকটা খবর এলো, - যেসব আর্মী রেডিও স্টেশন পাহারা দিচ্ছিল তারা মারা পড়েছে. কেউ বলল ইপিআরের সংখ্যা কয়েক শ' কেউ বা বলল কয়েক হাজার.
এই রকম বিভিন্ন খবর আমরা চুপ করে শুনছিলাম. আমরা আর আগের মত ভয় পাচ্ছি না. জানতে পারলাম বাড়ীর ঠিক পিছনে আর ডানদিকে বাংকারের ভেতরে মর্টার বসানো আছে. তার মানে আমরা ক্রসফায়ারের ঠিক মাঝখানে আছি. তখন দুজন ভদ্রলোক বৌবাচ্চা সহ মতিন সাহেবের বাড়ীতে ছুটে এলেন. তাঁদের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে, আতংকে ত্রাসে তাঁদের মুখ ফ্যাকাশে আর তাঁরা খুব হাঁপাচ্ছিলেন. তাঁদের একজন কোনো এক বিভাগের এস ডি ও, অন্যজন এক ব্যাংকের ম্যানেজার. তাঁদের পা খালি, পরণে শুধুমাত্র লুঙ্গী আর গেঞ্জি. তাঁরা এতই ভয় পেয়েছিলেন যে হাঁটতে গিয়ে টলছিলেন. তাঁরা বললেন তাঁদের বাড়ীর ঠিক পেছনেই মর্টার বসানো হয়েছে আর তা থেকে অনবরত গুলী ছোঁড়া হচ্ছে. তাঁদের বাড়ীর ভেতরে বহু জায়গায় গুলী এসে লেগেছে, এমনকি একটা গুলী এসে পেরেকের সাথে ঝোলানো এক কাপড় ভেদ করে চলে গেছে. তাঁরা সারাক্ষণই মেঝেতে শুয়ে ছিলেন, সুযোগ পেতেই বেরিয়ে এসেছেন. কাছেই যে নদী তার চরে তাঁরা রাত কাটাবেন ঠিক করেছেন.
তাঁদের আমরা সান্ত্বনা আর সাহস দিলাম - বোঝালাম যে নদীর খোলা চরে না খেয়ে মরার চেয়ে গুলী খেয়ে মরা অনেক ভাল. অনেক চেষ্টার পর তাঁরা তাঁদের বাড়ী থেকে কিছু কাপড় আনতে রাজী হলেন. গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের সাহসও ফিরে আসছিল.
অনেক চিন্তা করার পর তাঁরা সার্কিট হাউসে যাওয়া ঠিক করলেন. সেখানে ডিআইজি আর কমিশনারের পরিবার ছিলেন - তাঁদের মধ্যে চেনা পরিচয় ছিল. তাঁরা মাত্র গেছেন ঠিক তখনই কেউ একজন দৌড়ে এল. সে নাকি লাউড স্পিকারে ঘোষণা শুনেছে বমন হামলা আসন্ন, তাই সবাইকে শহর ছেড়ে যেতে বলা হচ্ছে. খবরটা এতই অসম্ভব যে কেউ সেটা বিশ্বাস করলো না. কিছুক্ষণ পর আবার গোলাগুলি শুরু হল. আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম.
পড়ে জানা গেল ইপিআর-কে আর্মী শহর ছেড়ে চলে যেতে বলছে নতুবা শহরে বোমা ফেলা হবে. একেই ভদ্রলোক আসন্ন বিমান হামলা মনে করেছেন. যাহোক, ইপিআর কিন্তু কিছুতেই শহর ছেড়ে যেতে রাজী নয়. বিমান হামলা হলে কি করতে হবে আমরা সেই প্রস্তুতি নিতে লাগলাম. বাড়ীতে অনেকগুলো শক্ত সিঁড়ি ছিল, বিমান হামলায় সেগুলো খুবই উপযুক্ত আশ্রয়. বাচ্চারা যাতে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য প্রতিটি বাচ্চাকে একজন বড়'র কাছে দেয়া হল. রাত হয়ে আসছিল তাই সমস্ত আলো নিভিয়ে দেয়া হল. ঠিক হল সারা রাত কেউ না কেউ পালাক্রমে জেগে পাহারা দেবে. আমি খবর শোনা শুরু করলাম. চট্টগ্রাম থেকে আসা এক লোক জানাচ্ছেন, যতখানি বর্বরতায় পাকিস্তানী সৈন্যেরা বাঙালী-হত্যা করছে, ততখানি বর্বরতায় বাঙ্গালীরা বিহারী-হত্যা করছে. এদিকে এখানে আর্মীর নির্দেশের জবাবে ইপিআর আর্মীকে আত্মসমর্পণ করতে বলছে. আর্মী ক্যাম্পের দিক থেকে মাঝে মাঝে মেশিনগানের কর্কশ আওয়াজ ছাড়া বাকি সবকিছু নিস্তব্ধ নিথর, নিস্পন্দ নীরব. হঠাৎ করে জোর হওয়া বইতে লাগল. মেঘাচ্ছন্ন আকাশে শুরু হল বিদ্যুতের ঝলকানি আর ঘোর বজ্রের ধ্বনি.
মেশিনগানের আওয়াজ এখন বন্ধ হয়ে গেছে.
এখন রাত ১০ টা.
০৮ এপ্রিল
কি সাংঘাতিক এক রোমাঞ্চকর সকাল দিয়ে শুরু হল দিনটা. ভোরে আমি আর বাদল নিরাপত্তাকে শিকেয় তুলে হওয়া খেতে বেরোলাম. বাড়ীর কাছেই পদ্মা নদী, তার তীরে যেতেই কয়েদীর পোশাক পরা একসারি কয়েদী নদীর শুকনো তটে ছুটে নেমে যাচ্ছে দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! নদীর ওপারেই ভারত - তারা মহানন্দে সেদিকে ছুটেছে. তাদের কারো কারো পায়ে শেকল বাঁধা, তারা তেমন ছুটতে পারছে না - কিন্তু অন্যেরা বেদম দৌড়চ্ছে. কেউ কেউ কয়েদীর পোশাক খুলে বালুর ভেতরে লুকোচ্ছে. এমনই সম্বিতহারা হয়ে দেখছিলাম যে খেয়ালই করিনি কয়েকজন ইপিআর এদিকেই আসছে. একটা ক্লিক শব্দে মাথা ঘুরিয়ে ওদের দেখেই ভয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল. বাদলও খুব ভয় পেয়েছে. কাঁধে রাইফেল হাতে ওরা চারজন, পেছনে মাথার ওপরে বাকসে অস্ত্র বইছে আরেকজন. আমরা বাড়ীর দিকে রওনা হতেই ওদের একজন আমাদের বলল থামতে. আমাদের পা যেন থমকে গেল. কিন্তু তাও আমি আস্তে করে পা বাড়ালাম - বাদলের সাথে ঠিক করলাম কথা বলতে হলে বাদলই বলবে.
সৈন্যটা প্রশ্ন করল - "তোমরা কি বিহারী"?
বাদল জবাব দিল - "না".
সৈন্যটা আবার বলল- "তাহলে আমাদের দেখে পালাচ্ছিলে কেন"? স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে লোকটা আমাদের সন্দেহ করেছে.
বাদল বাড়ীটা দেখিয়ে জবাব দিল - "আমরা আমাদের বাড়ীর দিকে যাচ্ছিলাম".
সৈন্যটা বাড়ীর কাছেই একটা জায়গা দেখিয়ে বলল - "ঠিক আছে, বাসায় গিয়ে আমাদের জন্য কিছু পানির ব্যবস্থা কর. আমরা ওই বাংকারে আছি".
আমি এদিকে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছি, বাদল কাছে আসতেই বাড়ীর দিকে রওনা হলাম. বাড়ীতে এসে দুজন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম. ঠিক করলাম কাউকে কিছু বলব না - খামাখা অন্যদেরকে উদ্বিগ্ন না করাই ভাল. এর মধ্যেই খবর রটে গেছে যে, জেলখানার পেছনের দেয়াল ভেঙ্গে কয়েদীরা পালিয়েছে. মতিন সাহেব মাঝে মাঝে উপদেশ দেবার জন্য জেলখানার কয়েদীদের সাথে দেখা করতেন. আমরা সবে নাস্তা শেষ করেছি, দুজন কয়েদী এসে হাজির. ওদের পরনে তখনও কয়েদীর পোশাক. ওরা মতিন সাহেবকে স্যাল্যুট করে বলল, ওরা ঠিক করেছে অন্য কয়েদীদের সাথে না পালিয়ে মতিন সাহেবের দেখভাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উনার সাথেই থাকবে, কেননা দিনকাল খুব খারাপ. ওরা বলল জেলখানায় উনার উপদেশ শুনে ওরা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে. মতিন সাহেব চুপ করে থাকলেন - বোঝা গেল তিনি রাজী হয়েছেন.
কয়েদী দুজন বস্তাভর্তি বালু এনে সিঁড়ির নীচে এমন করে রাখল যে সেটা বিমান হামলার জন্য আরো নিরাপদ হল. বিমান হামলার সম্ভাবনা সব সময়ই ছিল. সবাই সকালে খুব উদ্বিগ্ন থাকত - কোথাও সেরকম একটু শব্দ হলেই আঁতকে উঠত, যদিও এরোপ্লেন আর আসে নি. বেলা প্রায় দুটোর দিকে আমার একটু ঘুম ঘুম লাগছিল. ভাবলাম রাতে তো জেগে জেগে পাহারা দিতে হবে, একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক. ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়ে ওঠার পর কেবল হাত-মুখ ধুয়েছি - কানে এলো গগনবিদারী "জয় বাংলা" শ্লোগান. শহর এখন ইপিআরের দখলে, জনগণ মিছিল বের করছে. এর মধ্যে সবচেয়ে দু:খজনক হল অবাঙ্গালী বিশেষ করে উর্দুভাষী মুহাজিরদের হত্যা. মুহাজিরেরা পাকিস্তান আর্মীর সমর্থক ছিল. আর্মীর পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আছে. তাই, যেখান থেকেই আর্মী পশ্চাদপসরণ করছিল, মুহাজিরেরা মারা পড়ছিল. ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম রায়টের চেয়েও খারাপ অবস্থায় ছিল তারা.
০৯ এপ্রিল
গত পরশু থেকে যে এরোপ্লেনের অপেক্ষা ছিল তা অবশেষে এল. মনে হচ্ছিল এবারে বোমা পড়বে, তাই সবাই হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ির নীচে লুকোল. কিন্তু একটু উঁকি দিয়ে দেখি ওগুলো আসলে ফাইটার জেট, বোমারু বিমান নয়. যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম. ফাইটারগুলো একটা চক্কর খেয়ে উত্তর দিকে চলে গেল. তারপর বিরাট দুটো বিস্ফোরণের বিকট শব্দ, তার পরেই বিমানগুলো সোজা আকাশে উঠে গেল. আবার তারা সোজা নীচে নেমে এল, চক্কর খেয়ে আবার ওপরে উঠে গেল. এবারে ওগুলো আমাদের দিকে ছুটে এল কারণ প্রথম চক্কর খাবার সময় ওদের দিকে আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি কোথাও থেকে গুলীবর্ষণ করা হয়েছিল. ওরা সোজা নীচে এসে প্রায় নারকেল গাছগুলোর কাছাকাছি চলে এল, তারপর আক্রমণ করল ফায়ার ব্রিগেডে. তারপর তারা আবার ওপরে উঠে গিয়ে পাক খেয়ে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল. ওগুলো এতই কাছে এসেছিল যে পাইলট সহ ককপিটের অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছিল. এবারে ওরা আক্রমণ করল গ্রেটার রোডে যেখানে ইপিআর-এর আস্তানা ছিল. এবারে তারা ডাইভ করে নীচে নেমে এল এমনভাবে যে একটা প্লেন নারকেল গাছের আড়ালে প্রায় হারিয়েই গেল. মনে হচ্ছিল ওটা ক্রাশ করবে. কিন্তু পরক্ষণেই ওটা প্রচণ্ড মেশিন গানের শব্দের সাথে আকাশে উঠে এল.
প্লেনগুলো দু'তিনবার আক্রমণ করে পশ্চিম দিকে গেল, সেখানে তারা তিন চারবার আক্রমণ করে তারপর ফিরে গেল. এরপরে মনে হল ওরা আর খামাখা শহর আক্রমণ করবে না. সবাই নিজের জীবনে ফিরে গেল. আমি বইটা নিয়ে আবার পড়তে বসলাম. মতিন সাহেবের সংগ্রহে অনেক বই ছিল, তিনি আমাকে পড়তে দিলেন ভগবান দাসের লেখা "দি এসেনসিয়াল ইউনিটি অফ অল রিলিজিয়নস". মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছি এর মধ্যেই মতিন সাহেবের সবচেয়ে ছোট ছেলে শামিম চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এলো - "দরজা লাগাও, দরজা লাগাও. মিলিটারী আসছে " !! ও ঠাট্টা করছে মনে করে সবাই হাসতে লাগল. কিন্তু মতিন সাহেব আর আঙ্কেল কথাটাকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে বাইরে দেখতে গেলেন. তাঁরা দেখলেন কয়েকজন ইপিআর বিহারী খুঁজে বেড়াচ্ছে. জানিনা তাঁদের মধ্যে কি কথা হল কিন্তু তারা চলে যাবার পর আঙ্কেলকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখলাম. তিনি আমাকে বললেন দরকার হলে আমি তাঁর ভাতিজা এই ভান করতে. বললেন আমি লন্ডনে আমার বাবার সাথে থাকি. তাঁর একটা রেস্টুরেন্ট আছে, আমি আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে এসেছি. ইমদাদ বলল - ওরা যদি বিশ্বাস না করে তাহলে কি হবে? আঙ্কেল বললেন - ""তাহলে আমি ওদের সত্যি কথা বলে দেব, কিন্তু ওকে মেরে ফেলার আগে ওদেরকে আমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়ে যেতে হবে. এটা কি রকম ন্যায়, কি রকম মানবতা? কি ধরণের ধর্ম এটা যা নিরপরাধীকে খুন বা অত্যাচার করতে বলে "?
আবেগে উত্তেজিত হয়ে আঙ্কেল প্রায় চীrকার করছিলেন. আমার চোখে তখন অশ্রু - কৃতজ্ঞতার ও দায়বদ্ধতার অশ্রু. আঙ্কেলের স্নেহ আমাকে যেন কিনে নিল. বাড়ীর বাইরে কেউ আমার আসল পরিচয় জানত না. শুধু একবার মতিন সাহেবের বাড়ীর পাহারাদার আঙ্কেলের কাছে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে আমি পাঞ্জাবী. কিন্তু আঙ্কেল তার সন্দেহ দূর করেছিলেন এই বলে যে আমি পাঞ্জাবী নই, আমি তাঁর ভাতিজা. পাহারাদারের সাথে এসব কথার পরে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পরিবারের সবাইকে বলেছিলেন তারা যেন আমার পরিচয় বাইরের কাউকে না বলে.
কিন্তু মতিন সাহেবের মেয়ের কাছ থেকে জানা গেল সেই পাহারাদার তাকে প্রশ্ন করে এর মধ্যেই আমার পরিচয় জেনে ফেলেছে. এতে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল. মতিন সাহেব তাঁর ছেলে বাদলকে বললেন যেন কিছুই হয়নি এভাবে পাহারাদারের সাথে কথা বলে ওর মনে যদি এখনো কোন সন্দেহ থাকে তা দূর করতে. আমিও খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম, পাহারাদারটা আবার ইপিআরকে গোপনে বলে দিয়েছে কি না. নতুবা ইপিআর-এর তো আর কোনো কারণ ছিলনা বিহারীর বা অবাঙ্গালীর খোঁজে এ বাড়ীতে আসার. মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ভয়ের কিছু নেই, খারাপ কিছু ঘটবে না. যদি ঘটেই যায় তখন দেখা যাবে.
দিনের বাকিটা কিছুটা এই মানসিকতায় কিছুটা চিন্তিতভাবে কাটল. সন্ধ্যায় জীপে করে ইপিআর-এর কয়েকজন যুবক এসে হাজির. তারা তাদের জন্য চাল আর আটা জোগাড় করছে. ওদেরকে এড়াতে গিয়ে মতিন সাহেব বেকায়দায় পড়লেন. ওরা শাসিয়ে গেল কাল আবার আসবে এবং খালি হাতে ফিরবে না. রাত আটটার দিকে বাইরে লাউড স্পীকারে একজন ইপিআর-এর ঘোষণা শোনা গেল পুরো শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, কেউ যেন দুশ্চিন্তা না করে আর সবাই যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়. কিছুক্ষণ পরে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকেও প্রচার করা হল রাজশাহী থেকে পাকিস্তানী আর্মী উচ্ছেদ হয়েছে, শহর এখন ইপিআর-এর নিয়ন্ত্রণে আছে . ঠিক তখনই পাকিস্তানী আর্মী ক্যাম্প থেকে গোলাগুলী শুরু হল. সারাদিন ধরে বিহারীদের ওপরে অত্যাচারের খবর এল, বাসার সময় এটাকে খুবই নিন্দা করতে লাগল. পাকিস্তান হবার সময় এরা বাড়ীঘর আত্মীয় স্বজন ছেড়ে এসেছিল, এখন আবার তাদের কষ্ট পেতে হচ্ছে - কিন্তু কেন, কার জন্য ?
১০ এপ্রিল
সারাটা রাত তুমুল লড়াই হল, বার বার ঘুম ভেঙ্গে গেল. আমি এতদিনে মোটামুটি কামরা-বাসী হয়ে গেছি - আমার কামরার চার দেয়ালের মধ্যেই বেশীর ভাগ সময় কাটাই. তাই মতিন সাহেব চলে যাবার পর জানতে পেলাম তিনি দেখা করতে এসেছিলেন. যাহোক, তাঁদের ড্রইংরুমের কথাবার্তা শুনে মাফি (ইমদাদের ছোট বোন) আমাকে বলল কালাম সাহেব নিজেও শহর ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবছেন অন্যদেরও তাই করতে বলছেন. আমি একটু আশ্চর্য্য হলাম. গতকাল পর্য্যন্তও তিনি সবাইকে সাহস দিয়েছেন, মন শক্ত করতে বলেছেন, - আজ আবার হঠাত কি হল? ভাবলাম উনি হয়ত এমনিই কিছু বলেছেন, মাফি সেটা অন্যভাবে নিয়েছে. কিন্তু পরেরবার তিনি যখন এলেন তাঁর চেহারা দেখি অন্যরকম. তিনি বললেন ইপিআর-এর খাবার দাবার ফুরিয়ে গেছে, আর পাকিস্তানী আর্মীও তাদের ক্যাম্পের চারদিকে মাইন পুঁতে নিজেদের অবস্থান বেশ শক্ত করেছে. তাতে করে আর্মী'র কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ায় ইপিআর-এর বিজয় এখন অনিশ্চিত. কালাম সাহেবের ভাঙ্গা মন দেখে আর এমন সব কথাবার্তায় সবাই আরো ভয় পেয়ে গেল. পাকিস্তানী আর্মীর বিজয় মানেই এদের সবার সাক্ষাত মৃত্যু. আবার সেই পুরনো প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল - শহর ছেড়ে যাব যে, যাবো-টা কোথায় ? মতিন সাহেব আর আঙ্কেল অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের চেহারায় স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে আতংক. আমার মনে হলো পাকিস্তানী আর্মী গণহত্যা করবে এটা একেবারেই অসম্ভব. আমি তর্ক জুড়ে দিলাম - কি কারণে আর্মী গণহত্যা করবে? আমার বিপক্ষেও অবশ্য যুক্তি এল. এ হেন ভয়ানক পরিস্থিতিতে জ্ঞানী মানুষও হাস্যকর কিছু করে বা বলে ফেলে. আতংকে ত্রাসে মতিন সাহেবেরও এখন সেই অবস্থা. আমি আঙ্কেলকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আর্মী যদি এসেই পড়ে আমি তো আছি. আমি ওদেরকে বলব এঁরা সবাই আমাকে প্রথম থেকেই আগাগোড়া রক্ষা করেছেন. নিশ্চয় আর্মী এতে খুশী হবে আর কারো কোনো ক্ষতি করবে না. আঙ্কেল সেটা বুঝলেন মনে হল. যাহোক, এমন পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়া মানেই সাক্ষাত মৃত্যু ডেকে আনা.
কালাম সাহেব চলে যাবার পর যে যার মত চিন্তা করতে লাগল, - শেষে সবাই মনে করল বাড়ী ছেড়ে যাওয়াটা বোকামী হবে, আর পাকিস্তানী আর্মী নাগরিকদের কোনো ক্ষতি করবে না. এর মধ্যেই এক ডাক্তার এলেন. তিনিও বললেন পাকিস্তানী সৈন্যের গণহত্যা করবে এটা অসম্ভব, তাই চিন্তার কিছু নেই. (২৫শে মার্চের গণহত্যার পর এটা কিভাবে ভাবতে পারে মানুষ? - অনুবাদক). যদিও বিবিসি'র খবর অনুযায়ী চট্টগ্রামে গণহত্যার খবরটা খুবই চিন্তার কারণ ছিল তবু আমি আমাকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে ওরকম কিছু এখানে হবে না. ডাক্তার বললেন রাজশাহীর ayasistyant কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে গেছে. তাদেরকে নবাবপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এক বাঙালী মেজর ভুঁইয়া তাদের বন্দী করে রেখেছে. তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয়েছে. বিকেলে ইপিআর-এর একটা জীপ আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল. সৈন্যদের সাথে অতার ভেতরে কিছু বিহারী পুরুষ ও নারী ছিল. জীপটা সোজা জেলখানায় চলে গেল. পড়ে জানলাম তাদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবে জেলখানায় রাখা হয়েছে. ওদের মধ্যে পুরুষদের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বেশী ছিল.
সন্ধ্যায় কালাম সাহেব আবার এলেন. তিনি আগেই বলেছিলেন তিনি শহর ছেড়ে যাবেন. বাড়ীর সবাই তাঁকে দেখে খুব অবাক হল, এমনকি মতিন সাহেবও তাঁকে নিয়ে একটু ঠাট্টা মস্করাও করলেন. কালাম সাহেব বললেন . তাঁর জীপ ইপিআরেরা আটকিয়ে দিয়েছিল, আর এগোতে দেয় নি. এখন যখন তিনি যেতেই পারছেন না - তিনি ইপিআরের শক্তির গুণকীর্তন করছেন সম্ভবত: নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্যই. দুপুরের খাবারের পরে আমরা সবাই একসাথে বসলাম. মতিন সাহেব বললেন আমাদের হাতে যা টাকা আছে তা শিগগিরই ফুরিয়ে যাবে. কাজেই, আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হতে পারে কেননা তা নাহলে আমরা কিভাবে চলব? তিনি বলছিলেন বাড়ীর বড় বড় জিনিসগুলো বিক্রী করে দেয়া হোক. কিন্তু কেউ তাঁর এই প্রস্তাবকে সমর্থন দিল না - কিন্তু যেহেতু এর কোনো পাল্টা প্রস্তাব ছিল না তাই আলোচনা আর এগুলো না.
মতিন সাহেবের হাত দেখা খুব পছন্দ - তিনি ওটার ওপরে পড়াশুনা করছেন বহুদিন থেকে. তিনি হঠাৎ তাঁর ডান হাত চোখে খুব কাছে এনে কিছুক্ষণ খুব করে খুঁটিয়ে দেখলেন. তারপর বেশ জোরের সাথে ঘোষণা করলেন তাঁর হাতে গরিবীর কোন রেখা নেই. আমি ভাবলাম এতবড় একটা কথা বলা তাঁর ঠিক হলনা. বোধহয় নিয়তিরই ইংগিত, আমি তাঁর চোখে চোখ রেখে মনের কথাটা বুঝিয়ে দিলাম. মনে হল তিনি বুঝতে পেরেছেন.
ঘুমোতে যাই. সবাই ঘুমোবার ব্যবস্থা করছে.
১১ এপ্রিল
রাতে খুব একটা গোলাগুলি হয়নি তাই রাতে বেশ ঘুম হয়েছে. বেলা দশটার দিকে কালাম সাহেব এলেন. তিনি বললেন তিনি সরে পড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু ইপিআর এবারেও তাঁকে যেতে দেয় নি. যে ডাক্তারের বাসায় তিনি আছেন সেটা খুব ছোট বলে তিনি মতিন সাহেবের বাসায় আসতে ইচ্ছুক. আসলে তিনি মনস্থির করেই ফেলেছেন - একটু পরেই তাঁর বাকস প্যাঁটরা আসা শুরু করল. তরিতগতিতে ড্রইং রুমটা একটা গুদামঘরে পরিণত হল. বিকেলে ইপিআরের আরেকটা জীপ বাসার পাশ দিয়ে চলে গেল. জানালা দিয়ে দেখলাম জীপে দুজন লোকের চোখ হলুদ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা আছে. পরে জানলন ওরা ছিল বিহারী. ওদের একজন ছিল বৃদ্ধ, তার দাঁড়ি ছিল অশ্রুতে ভেজা.
মতিন সাহেবের চাকর পাঁচু খবর নিয়ে এলো, - পাকিস্তানী আর্মী নগরবাড়ী ঘাট থেকে গানবোটে পাবনার দিকে আসছে. কালাম সাহেব সেটা বিশ্বাস করলেন না.
সন্ধ্যা ৫টায় অল ইন্ডিয়া রেডিও বলল পাকিস্তানী আর্মী পাবনা পৌঁছে গেছে. এদিকে খবর পেলাম পুরো একটা বাস ভর্তি করে ইপিআর বাহিনী এখান থেকে পাবনার দিকে রওনা হয়েছে আর্মিকে বাধা দিতে. সন্ধ্যায় আকাশ অন্ধকার করে খুব ঝড়ো বাতাস উঠল - শুরু হল বৃষ্টি. এর মধ্যে কালাম সাহেবের বন্ধু করিম সাহেব সপরিবারে এসে হাজির. তাঁদের ও জায়গা হল ড্রইংরুমে . জায়গার অভাবে খুব চাপাচাপি লাগতে লাগল, আমরা আমাদের বাকস প্যাঁটরা শোবার ঘরে নিয়ে এলাম. দশ বাই বারো ফুটের এই ছোট্ট ঘরে একটা টেবিলও ছিল যাতে থাকত গ্লাস, টিফিন ক্যারিয়ার, ওষুধের শিশি এসব খুঁটিনাটি. অদ্ভুত ভঙ্গীতে ঘরের বেশ কিছু জায়গা দখল করে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিশাল আলমারী. ওখানে ছিল একটা স্প্রিং-বেড যাতে এক আমি ছাড়া আর কেউ শুতে চাইত না. সেখানে আমি একাই ঘুমোলাম. জায়গার কমতির সাথে সাত জনের পরিবার সমঝোতা করে নিচ্ছিল.
রাত দশটাতেও সমানে গোলাগুলি চলছিল, অন্ধকারের সাথে সাথে মেশিনগানের আর রাইফেলের কর্কশ শব্দ বেড়েও গেল. এর মধ্যে এসব আওয়াজে আমি এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি - মনে হচ্ছে এটা আমার জীবনেরই একটা অংশ. কখনো মনে হয় সারাটা জীবন এমনই চলবে. সকালে আঙ্কেল এসে আমাকে গোপনে জানালেন আমাদের আগের বাসা ছেড়ে আসার আগে তিনি আন্টি'র গয়নাগুলো বাগানে পুঁতে রেখেছেন. এখন তিনি ওগুলো নিয়ে আসার কথা ভাবছেন কারণ এখান থেকে পালাতে হলে ওগুলো দরকার হবে. ব্যাপারটা খুবই স্পর্শকাতর - প্রথমে বললাম ওগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক - কিন্তু পরে চিন্তা-ভাবনা করে তাঁকে বললাম ওগুলো তাঁর কাছেই থাকা দরকার.
১২ এপ্রিল
সারা রাতের প্রচণ্ড যুদ্ধ সকালেও থামছে না. সাধারণত: এরকমটা হয়না. প্রথমে মনে হলো ইপিআর চারদিক থেকে আর্মিকে ঘিরে আনছে. এইসব হুলুস্থুলের মধ্যে আঙ্কেলের বাড়ীর কথা ভুলেই গেলাম. পরে (আগের বাসার পাহারাদার) শাকিল এসে জানাল আর্মী তাদের বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করছে. শাকিল আরো জানাল গতকাল কিছু আর্মী এসে তার বুকে বেয়নেট ধরে নানারকম প্রশ্ন করেছে. শাকিলের জবাব তাদের বিশেষ সন্তুষ্ট করতে পারে নি. তারা তখন গরুটা দিতে বলে. শাকিল তাদের কাকুতিমিনতি করে বলে সে কত বিপদ মাথায় নিয়ে এতদিন গরুটা পেলেছে - ওটা দিলে তার অনেক ক্ষতি হবে. তখন তারা ইপিআরের জিজ্ঞেস করে - শাকিল যখন বল সে তা জানে না তখন তারা তাকে নিয়ে ডাক্তার ইসার-এর খালি বাসায় যায়. তারা তালা ভাঙ্গার একটু চেষ্টা করতেই অন্য একটা দরজা খোলা দেখতে পেল. তারা সারা বাড়ীর ভেতরটা ঘুরে দেখে পাশের দোতলা বাড়ীটার ছাদে উঠল. তারা চারদিক খুঁটিয়ে দেখে তাদের ক্যাম্পে ফিরে গেল, যাবার আগে শাকিলকে শাসিয়ে গেল তখনি সেখান থেকে চলে যেতে, আর কাউকে তাদের কথা না বলতে. দুপুরে কালাম সাহেবের ড্রাইভারও এসে হাজির. সে বলল আর্মী বাড়ীটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, ওরা বোধহয় আজ রাতে ছাদে একটা মেশিনগান বসাবে. বেলা দুটোর দিকেও মাঝে মাঝে গুলির শব্দ হতে থাকল. অল ইন্ডিয়া রেডিও জানাল গোয়ালন্দ ঘাট পেরিয়ে আর্মী উত্তর দিকে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে.
কাল রাতে বৃষ্টির পর চারদিক স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে. মতিন সাহেবের বাংলোটা পুরনো. বাড়ীর চারপাশে বিশাল জায়গা জুড়ে পুকুর আর গাছগাছালি. গাছগুলোতে সারাক্ষণ পাখীদের কিচিরমিচির লেগেই আছে. এখন বসন্তকাল, কিন্তু গোলগুলীর শব্দে কোথায় হারিয়ে গেছে কোকিলের কুহুতান. বাতাসটাও ফুলের সুগন্ধের বদলে বয়ে আনছে বারুদের গন্ধ. সন্ধ্যায় আমি আর ইমদাদ বাড়ীর কাছেই একটা খালি চেকপোস্টে গিয়ে বসলাম. আমরা এটা ওটা নিয়ে কথা বললাম, অতীতের কিছু স্মৃতিচারণ করলাম, কিছুটা হাসিঠাট্টাও করলাম. ওই পরিস্থিতিতে হাসির শব্দও যেন অস্বাভাবিক লাগছিল. মাগরেব নামাজের সময় হলে আমি পুকুরে ওজু করে কেবল বাসায় এসেছি অমনি দেখি মেইন গেট দিয়ে একটা জীপ ঢুকছে. আমি তাড়াতাড়ি আমার কামরায় গিয়ে নামাজ পড়া শুরু করলাম. পরে জানা গেল আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী মতিন সাহেবের ভাগ্নে তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছে. সে নানারকম উদ্ভট কথা বলেছে যেমন শেখ মুজিব ভারতে আছেন আর তাজ উদ্দীন আছেন রাশিয়ায় !
আজ এক কাণ্ড হয়েছে. বিকেলে বিলাল রেডিও খুলে কোনো এক স্টেশন ধরেছে যেখানে খবর হচ্ছিল. খবরের প্রথম দিকটা আগেই হয়ে গিয়েছিল, যেটুকু শোনা গেল তা হচ্ছে এই, আমেরিকা, রাশিয়া আর ভারত মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেমেছে. সে ছুটে এসে কালাম সাহেবকে তা বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন তিনি নাকি বহুদিন থেকেই এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ! এখন নাকি মুরগী (অর্থাৎ পাকিস্তান-অনুবাদক) রোষ্ট হবে! সন্ধ্যায় পুরো খবর আবার প্রচার হলো শুনলাম. সেটা ছিল - চীন অভিযোগ করেছে যে আমেরিকা, রাশিয়া আর ভারত মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেমেছে. কালাম সাহেবের উত্তেজনা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল.
যে কোন কারণেই হোক মানুষ ইপিআর-এর ওপর ভরসা করে উঠতে পারছিল না. কালাম সাহেব ঠিক করলেন আমরা রাত জেগে পাহারা দেব. খবর এসেছে, চাপাই নবাবগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আছে কিন্তু সেখানে লুটতরাজ শুরু হয়েছে. মানুষ ঘরবাড়ী ছেড়ে ভারতে পালাচ্ছে. কালাম সাহেব বললেন যদি ইপিআর পরাজিত হয় তবে আমাদেরকে নদীর চরে গিয়ে থাকতে হবে.
১৩ এপ্রিল
সকালে নাস্তার পরে আমি আর ইমদাদ আবার গতকালের সেই চেকপোষ্টে গেলাম. চমত্কার বাতাস বইছিল, খুব স্নিগ্ধ ছিল চারদিক. ইমদাদের আর আমার হাতে দুটো বই ছিল, আমরা বই পড়তে লাগলাম. প্রায় ১১টার দিকে মতিন সাহেবের ছোট ছেলে এসে বলল সে ওই পুকুরে সাঁতার কাটতে চায় কিন্তু গোলাগুলির শব্দে সে খুব ভয় পেয়েছে. টার খুব কাছে বসলে সে সাঁতার কাটতে পারে. সে সময়টায় অবশ্য খুব একটা গোলাগুলি হচ্ছিল না. আমি তার সাথে রওনা হতেই দেখলাম বিলাল আর তার চাচা আসছে. গতকাল থেকে আমি বিলালের চাচার চোখ এড়িয়ে চলছি. তিনি খুব সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন. ভাবলাম এখন তাঁকে এড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না. বেশ একটু আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম. বিলাল আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আঙ্কেলের ভাতিজা হিসাবে, আর বলল উনি তার চাচা খায়রুল সাহেব. কেন যেন প্রথম থেকেই খায়রুল সাহেব. নামের বড় বড় চোখের এই হালকা পাতলা লোকটাকে আমার পছন্দ হলনা. আমি আত্মবিশ্বাস নিয়েই তাঁর সাথে বাংলায় কথা বলা শুরু করলাম. তিনি আমার চেয়ে দুতিন বছরের বড়. এর মধ্যে আন্কেল বাসার বাইরে এসে আমাকে খায়রুলের সাথে কথা বলতে দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন. তিনি তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে এসে খায়রুলের সাথে কথা শুরু করে দিলেন - আর আমাকে চোখের ইশারায় বাড়ীর ভেতরে যেতে বললেন.
কিছুক্ষণ পরে তিনি আমার কামরায় এসে বললেন খায়রুলের সাথে কথা বলাতে সাংঘাতিক বিপদ হয়েছে. ও যদি আমার পরিচয় জানতে পারে তাহলে আমাকে আর কিছুতেই বাঁচানো যাবে না. আমি যেন এ ব্যাপারে অত্যুংত সতর্ক থাকি - ওর সাথে আর কথা না বলি. আমারও প্রথমে মনে হয়েছিল ওর সাথে কথা বলাটা ভাল হয়নি কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম এতে কিন্তু আমার শাপে বর-ই হয়েছে. কারণ একই বাসায় থেকে ওকে লম্বা সময় ধরে সারাক্ষণ এড়িয়ে চললে আমাকে ও সন্দেহ করবেই. দুপুরে খাবার পর বিলাল এসে বলল খায়রুল আমাকে ওর কাছে যেতে বলেছে.
আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম. ও কেন আমাকে ডাকবে? এ আবার কি খেলা শুরু হল? "হে আল্লাহ, আমাকে সাহায্য কর"- মনে মনে প্রার্থনা করলাম. তারপরে পুরো আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওর কামরায় গেলাম. দেখলাম আমার দুশ্চিন্তা একেবারেই ভিত্তিহীন !! ও আমাকে সন্দেহ তো করেই না বরং আমাকে তাস খেলতে ডেকেছে. খেলার মধ্যে সে আমাকে পুরো বিবরণ দিল নবাবগঞ্জে কি কি ঘটেছে. রাজশাহীতে আর্মী পুলিশ লাইন আক্রমণ করার খবর ওখানে পৌঁছলে ওখানকার ইপিআর বাহিনী তাদের পাঞ্জাবী অফিসারদেরকে খুন করে আর তাদের সুবেদার মেজরের নেতৃত্বে রাজশাহী আসার প্রস্তুতি নেয়. এ খবর পাবার পররাজশাহীর আর্মী তাদের অনুগত এক বাঙালী মেজর ভুঁইয়াকে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য সেখানে পাঠায়. ভুঁইয়া সেখানে পৌঁছলে লোকজন রাজশাহীর আর্মীকে পরাজিত করে সে সেখানে গেছে মনে করে তাকে বিপুল সম্বর্ধনা দেয়. গলায় মালা পরিয়ে তাকে নিয়ে রাস্তায় মিছিল হয় এবং তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের কম্যান্ডার করা হয়. কিন্তু কম্যান্ডার হবার ওপরেই তার নির্দেশগুলো পাকিস্তানী আর্মীর পক্ষে যেতে থাকে. এতে সুবেদার মেজর তাকে সন্দেহ করা শুরু করে এবং তার ওপরে নজর রাখে. একদিন সে দেখে মেজর ভুঁইয়া বেতারে পাকিস্তানী আর্মীর সাথে যোগাযোগ করছে. তাকে তক্ষনি গ্রেপ্তার করা হয়. কেউ বলে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কেউ বলে তাকে জেলখানায় রাখা হয়েছে. এসব খবর চাউরহলে মানুষ আর্মীর আক্রমণের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বাড়ীঘর ছেড়ে দলে দলে ভারতে পালাতে থাকে.
খায়রুল নিজের ভেতরে ডুবে গিয়ে একমনে এসব বলে যাচ্ছিল আর আমি বের করার চেষ্টা করছিলাম সে আমাকে সত্যি সত্যি ইমদাদের চাচাত ভাই মনে করে কি না. শেষে মনে হল আমার পরিচয় নিয়ে তার কোন রকম সন্দেহই নেই. ওদিকে অল ইন্ডিয়া রেডিও ক্রমাগত বলে যাচ্ছে আর্মী পাবনা দখল করে নিয়েছে, কিন্তু ইপিআরের তরফ থেকে বলা হচ্ছে পাবনা তাদের দখলে. সব মিলিয়ে চারদিকে অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তা . তার ওপরে গুলী লেগে ইলেক্ট্রিসিটির তার নষ্ট হয়ে গেল - তাই রাতে লন্ঠন আর মোমবাতি ছাড়া গতি নেই.
০৩ মে –
১৪ এপ্রিল থেকে ০২ মে পর্য্যন্ত ২২ দিন পর -
পরের বাইশটা দিন এতই বিশৃঙ্খলা আর উলটপালটের মধ্যে কাটল যে কিছু লেখাই গেল না. কিন্তু এই বাইশ দিনের প্রতিটি মুহূর্ত মনের মধ্যে গভীরভাবে গেঁথে রইল. ১৪ এপ্রিল সকাল থেকেই বিরাট বিস্ফোরণের গুমগুম আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল, এরকম আওয়াজ আগে কখনো হয়নি. কালাম সাহেব বললেন ইপিআর আর্মীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, শব্দটা গ্রেনেড ফাটানোর. তিনি বললেন শিগগিরই বেয়নেটবিদ্ধ পাকিস্তানী সৈন্যদের মরণ আর্তনাদের মধ্যে দিয়ে ইপিআরের বিজয়বার্তা ঘোষিত হবে. তিনি তাঁর নিজস্ব স্টাইলে পুরো ছবিটা তুলে ধরছিলেন. সবাই তাঁকে অবাক হয়ে দেখছে দেখে তিনি পায়ের ওপরে পা তুলে তৃপ্তিভরে একটা সিগারেট ধরালেন.
কিন্তু আমার মন বলছিল অন্য কথা. শব্দটা ট্যাংকের কামানের. তার মানে ঢাকা থেকে যে আর্মী আসার কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল তারা এসে পড়েছে. সন্ধ্যা নাগাদ সব জানা গেল - আমি যা ভেবেছি তাই. যারা কালাম সাহেবের রূপকথায় ভুলেছিল তারা চুপ করে বসে পড়ল. সারা বাড়ীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল আতংক আর ত্রাস. কালাম সাহেবকে মনে হলো তাঁর ইচ্ছে-বিশ্লেষণে কিছুটা বিব্রত. বাড়ীর বাইরেও তখন চলছে চরম বিশৃঙ্খলা, মানুষ পাগলের মত ছুটছে ভারতের সীমান্তের দিকে. বাড়ীর সামনের রাস্তাটা ভরে গেছে নারী-পুরুষ আর বাচ্চাদের দিয়ে - সবাই ঘটিবাটি রসদপত্র যা কিছু পেরেছে বহন করে চলেছে পদ্মা পেরিয়ে ভারতে যাবার জন্য.
কালাম সাহেব তাঁর লাগেজগুলো নিয়ে যাবার জন্য তৈরী হলেন, শরীফ সাহেবও তাঁর সঙ্গে যাবার জন্য তৈরী হলেন. মতিন সাহেব ভুগছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে আর আঙ্কেল কোনোমতেই যেতে রাজী ছিলেন না. সবার চেহারায় খেলা করছিল ভয়ানক আতংক আর ত্রাস. কালাম সাহেব সবাইকে যাবার জন্য তাগাদা দিতে লাগলেন - তাঁর মতে এখানে থাকা মানে ইচ্ছে করে মরণফাঁদে পড়া কারণ আর্মী প্রতিটি যুবককে হত্যা করবে, সব ঘরবাড়ী ধ্বংস করে দেবে - ইত্যাদি. অবশেষে সবাই যেন তাঁর কথায় সম্মোহিত হয়ে পড়ল, এমনকি আঙ্কেল পর্য্যন্ত দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন. আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম - আমি থাকে তাঁর কোনো ভয় নেই. বললাম - "আপনারা আমাকে এতদিন রক্ষা করেছেন, আমি আর্মীর সাথে কথা বলব, ইনশা আল্লাহ আপনাদের কিছু হবে না". তিনি রাজী হলেন কিন্তু আতংকে ত্রাসে আন্টি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন. যখন অন্যেরা চলে যাচ্ছিল তিনি কান্না শুরু করলেন. তিনি বললেন এতদিন একসাথে থেকেছি এর পরেও থাকব. বাঁচলে একসাথে বাঁচব, মরলে একসাথেই মরব.
বৌয়ের চাপে মতিন সাহেব ঠিক করেছেন চলে যাবেন. যদিও মহিলারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁরা আমাকে রক্ষা করেছেন একথা আমি আর্মিকে বললে তাঁদের কিছু হবে না, কিন্তু এটা অনিশ্চিত ছিল যে আদপেই আমি সে সুযোগ পাব কি না. আর্মীর সাথে আমার কথা বলার সুযোগের আগেই যদি সবাই মারা পড়ে ? এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই, আমার কাছেও না. আমি খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলাম. এতদিন একসাথে ছিলাম - তাঁরা নিজেদের জীবন বাজী রেখে আমাকে রক্ষা করেছেন. কিভাবে আমি তাঁদের এখন ছেড়ে যাই? আল্লাহ'র নাম নিয়ে আমিও তৈরী হলাম তাঁদের সাথে যাবার জন্য.
ঘনঘোর অন্ধকার চারদিকে. শহরে কি ঘটছে তা জানার জন্য একজনকে পাঠানো হয়েছে. সে এসে বলল শহরে জনপ্রাণী বলতে কেউই নেই - আর পাকিস্তানী আর্মী কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শহর দখল করবে. সবাই উন্মুখ হয়ে তার কথা শুনছিল আর আমি লন্ঠনের ম্লান আলোছায়ায় সবার মুখে দেখছিলাম ভয়ানক আতংকের ছাপ. শরীফ সাহেবের স্ত্রী দরজার কাছে বাচ্চা কোলে স্বামীর দিকে প্রশ্নের চোখে তাকিয়ে আছেন. ছোট্ট রাশী বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে উদ্ভ্রান্তের মত সবার দিকে তাকাচ্ছে. ওর কচি মনটা বোধহয় পরিস্থিতিটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না. তিম্মি'র স্বাভাবিক বড় দুটি আঁখি ভয়ে আরো বড় হয়ে বিস্ফারিত আছে. জেল-পালানো কয়েদীটা যে কিনা বাড়ীতে না গিয়ে মতিন সাহেবের সেবা করার জন্য এসে এখানেই থেকে গিয়েছিল সে এখান থেকে চলে যাবার ঘোর বিরোধী. তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল সবার জীবন বাঁচানোর ভার যেন তারই ওপর. সে বলছিল এই অন্ধকার রাতে নদীর চরে গিয়ে রাত কাটানোটা মোটেই নিরাপদ নয়. সে সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল - "জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ভর্তি - ওখানে সাপখোপ আর স্কর্পীয়নে ভরা. কাদা আর পানি চারদিকে, ওখানে প্রচুর মশা ভনভন করছে. এই বাচ্চাগুলো আদর সোহাগ আর প্রাচুর্য্যের মধ্যে বড় হয়েছে, জীবনে এক মাইলও হাঁটেনি. কিভাবে ওরা মাইলের পর মাইল হাঁটবে?" কিন্তু ওর সব যুক্তি আতংকের বন্যায় ভেসে গেল - চলে যাওয়াই স্থির হল.
শিগগিরই দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে ত্রিশ পয়ত্রিশ জনের দোল আমরা নদীর চরে নেমে গেলাম. ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ, চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে এক ফুট দুরেও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না. নদীর চরে নামতে নামতে আমরা বুঝে গেলাম কি ভয়ানক অবস্থায় আমাদেরকে পড়তে হবে. মাটি কোথাও নরম কোথাও বেশ শক্ত. আমার চলছিলাম দিকনির্দেশহীন এক অজানা গন্তব্যে. বর্ষাকাল অনেক আগেই গত হয়েছে, তাই বেশীরভাগ জায়গায় চরটা ছিল শুকনো. সামনে পড়ল প্রায় একশ মিটার চওড়া পানির স্রোত. নদীর মূল স্রোত এখনো কয়েকশ মিটার দুরে. মাঝে কয়েক গজ চওড়া আরো স্রোত আছে কিন্তু সেগুলো খব গভীর নয়.
কোন দিকে যাব কোথায় যাব এ নিয়ে অনেকের সাথে অনেকের মতে মিলছে না. আঙ্কেল চাচ্ছিলেন আমরা পশ্চিম দিকে গিয়ে নদীর ওপারে কোনো একটা গ্রামে যাই. মতিন সাহেবের চাকর সাবরাতি চাচ্ছিল আমরা নদী পার না হয়ে যদি পূব দিকে চলতে থাকি তাহলে প্রেমতলী পৌঁছাব. ওটাই ওর গ্রাম, ওখানে সে আমাদের নিরাপদ ও আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে. আমরা পানির ধার ধরে ধরে পূব দিকে এগিয়ে চললাম. পথে বহু লোক দেখলাম পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে. এমন কিছু লোক ছিল যারা শুধু আজকের রাতটা নদীর চরে কাটাবার জন্য এসেছিল কিন্তু এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না. মতিন সাহেব বুড়ো মানুষ, তার ওপরে দুর্বল. তিনি একটু হাঁটার পরে সুলেমান তাঁকে পিঠে নিয়ে হাঁটছে. এক জায়গায় তাঁকে মাটিতে নামিয়ে দিতেই দেখা গেল এর মধ্যে তাঁর একটা জুতো কোথায় খুলে পড়ে গেছে. এর পর থেকে বেচারাকে খালি পায়ে হাঁটতে হল. এক জায়গায় দেখি অনেকগুলো লোক বালির একটা ঢিপির আড়ালে বসে আছে. আর্মী আসবে মনে করে তারা একে অপরকে বলছিল ঢিপির আড়ালে শুয়ে থাকতে. ভাবলাম আমাদের দলের কেউ যদি ওকথা শুনে ফেলে তাহলে খুব ভয় পেয়ে যাবে. তাই আমি খুব শক্তভাবে ওদেরকে বললাম চুপ করে থাকতে - আর্মী কক্ষনো এদিকে আসবে না. কিন্তু আমি মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছিলাম যদি ইপিআর হেরে যায় তাহলে তাদেরকে তাড়া করে আর্মী এদিক আসতেও পারে. আমি নিশ্চিত ছিলাম আর্মী সাধারণ মানুষের কোন ক্ষতি করবে না - কিন্তু এই অন্ধকারে কে জানে কে সাধারণ মানুষ আর কে নয়.
ক্রমাগত হেঁটে চলতে চলতে আমরা নদীটা পার হতে চাচ্ছিলাম যাতে ওপারে কোন একটা নিরাপদ আশ্রয় পাই. কিন্তু কোনো নৌকো দেখা যাচ্ছে না. কিছুদুর যাবার পর এক জায়গায় দেখা গেল পানিটা গভীর নয়. সবাই আমরা পায়ে হেঁটে পানি পার হলাম. এবারে আমরা চলছি নদীর মূল স্রোতের দিকে কিন্তু তার আগেই আরেকটা এমন স্রোত পড়ল যা নৌকো ছাড়া পার হওয়া অসম্ভব. জায়গাটা খেয়া পারাপারের নৌকোর ঘাট, ওখানে এর মধ্যেই বহু লোক জড়ো হয়েছে কিন্তু কোনো নৌকো নেই.
রাত প্রায় বারোটা বাজে. আকাশে মেঘ সরে গেছে, চাঁদের ম্লান আলোয় সুন্দর চারদিক. পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে এল ঠাণ্ডা বাতাস, আমি চাদর দিয়ে বাতাস ঠেকানোর চেষ্টা করছি. আন্টি দেখি ঠাণ্ডায় কাঁপছেন - আমি চাদরটা তাঁকে দিলাম. আঙ্কেল বাকস থেকে আরেকটা কাপড় বের করে আমাকে দিলেন. কাপড়টা একটু মোটা ছিল, তাই বাইরের ঠাণ্ডায় এর ভেতরে খুব আরাম লাগল. শরীর গরম রাখার জন্য আমি পানির ধার ধরে হেঁটে চলেছি আর ভাবছি নিয়তি মানুষকে নিয়ে কতই না খেলা করে. এর মধ্যে মতিন সাহেবের স্ত্রী আমাকে ডেকে বললেন বাদলকে ডেকে জেনে নিতে যে স্যুটকেসটায় দামী জিনিসগুলো ছিল সেটা তার বাবার কাছে আছে কি না. তখন হঠাত দেখি মতিন সাহেবের স্ত্রীর পাশেই বসে আছেন শরীফ সাহেবের স্ত্রী, তাঁর শাড়ীটা খুব পাতলা বলে তিনি ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছেন. আমার খুবই অস্বস্তি লাগল, আমার চাদরটা খুলে তাঁকে দিলাম. কিন্তু তার পরেই খুব ঠাণ্ডা একটা হওয়া এসে আমাকে একেবারে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল. বাদলকে পাওয়া গেলনা তাই আমি সোজা মতিন সাহেবের কাছে গেলাম. বাকসটা তো তাঁর কাছে ছিলই, বরং তিনি ওটার ওপরেই বসে ছিলেন. আমি তাঁকে বললাম তাঁর স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে যে বাকসটা খোয়া যায় নি, তাঁর কাছেই আছে. এর পর আমি পানির ধার ধরে দৌড়ানো শুরু করলাম যাতে শরীরটা একটু গরম হয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে পারি. ইমদাদও তাই করল, আমার সাথে দৌড়াতে লাগল. তখন কেউ জানে না নৌকো কিভাবে পাওয়া যাবে. নদীর ওপারে একটা নৌকো দেখা গেল কিন্তু সকালের আগে ওটা এপারে আসার কোনই সম্ভাবনা নেই. এদিকে এখানে সকাল পর্য্যন্ত থাকাও বিপজ্জনক কারণ পাকিস্তানী আর্মী আমাদেরকে দেখে ইপিআর পালাচ্ছে মনে করে গুলী করতে পারে. কিন্তু আমরা আর কি-ই বা করতে পারতাম ! আমাদের তো ফিরে যাবারও উপায় ছিলনা. অর্থাৎ আমরা একটা সাংঘাতিক মরণফাঁদে পড়ে গেছি.
তখন কে যেন বলল আমাদের মধ্যে ভালো কোনো সাঁতারু থাকলে সে সাঁতার দিয়ে ওপারে গিয়ে নৌকোটা এপারে আনতে পারে. কিন্তু সেটাও খুবই বিপজ্জনক হবে কারণ পানি মারাত্মক ঠাণ্ডা আর স্রোতটাও তো প্রবল. তাছাড়া নৌকোটা বিরাট, ওটা বাইতে অন্তত: তিনজন লোক দরকার. সাবরাতি খুব ভালো সাঁতারু কিন্তু স্রোতের প্রচন্ড গতি দেখে সে ইতস্তত: করতে লাগল. ইমদাদ আর করিম সাহেব সবাইকে বোঝাতে লাগলেন সকালের আগেই নদী পার না হলে সকালে আর্মী আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে. অনেক বলা কওয়ার পর আমাদের মধ্যে দু'জন সাঁতার দিয়ে ওপারে যেতে রাজী হল কিন্তু তিনজন না হলে যাবার কোনো মানে হয় না. তখন সাবরাতি ওই দুজনের সাথে যেতে রাজী হল. এদিকে বাতাস আরো বেড়ে গেল. ওখানে মাঝিদের বিশ্রামের জন্য চাটাই দিয়ে বানানো একটা কুটির মত ছিল, ঠাণ্ডা বাতাসের বিরুদ্ধে ওটা কিছুটা হলেও আমাদেরকে রক্ষা করল. সবাই ওটার মধ্যে গাদাগাদি করে বসে রইল. আমি ওটার মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না. গুঁতোগুঁতি করে অন্যদের পা মাড়িয়ে হয়তোবা নিজেকে ওই ভীড়ের মধ্যে গুঁজে দিতে পারতাম কিন্তু তাতে মন সায় দিল না.
বেশ কিছু লোক ঠাণ্ডা বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে ঘরটার একদিকে বসে ছিল. শেষমেষ আমি ওখানে যেতে পারলাম কিন্তু ভাল লাগল না. ফিরে এসে এদিক ওদিক করতে লাগলাম. বাচ্চাদের পাচ্ছিল ঘুম. সাথে হোল্ডল ছিল, ওতে বাচ্চাদের শোবার ব্যবস্থা হল. যাদের জায়গা হলনা তাড়া ঠাণ্ডা বালুর ওপরে শুয়ে পড়ল. এর মধ্যে বাতাসে উড়ে আসা বালুর জন্য করিম সাহেবের ছোট্ট বাচ্চাটা চীত্কার করে কাঁদতে শুরু করেছে, চেষ্টা করেও তাকে থামানো যাচ্ছে না. তার বাবা-মা অসহায়ের মত তাকিয়ে আছেন. চাদর গায়ে আঙ্কেল তাঁর চাকর মুখলিসের সাথে একটা বিছানায় বসে আছেন, ঠাণ্ডায় কাঁপছেন তিনি. আমাকে ডেকে তিনি তাঁর পাশে বসলেন, তাঁর ডানদিকে বিলাল বসে ছিল. আমরা তিনজন তখন ওই একই চাদরের নীচে.
এমন সময় চিৎকার উঠল - "নৌকো এসেছে, নৌকো এসেছে !!" লোকজন তখন চিৎকার করতে করতে নৌকোর দিকে ছুটতে শুরু করেছে. আমরাও তড়িঘড়ি ছুটলাম কিন্তু আমরা যাবার আগেই নৌকো ভরে গেছে. নৌকোটা বড়, প্রায় ষাট সত্তর জন ওতে উঠে গেছে. নৌকোটা ওপারে রওনা দিল, আমরা ওটার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকলাম. হঠাত চিৎকার উঠল, "গুলী! গুলী!!". তাকিয়ে দেখি রাজশাহী থেকে আগুনের ধোঁয়া উঠছে. সারাটা আকাশ লাল করে আগুনের শিখা লকলক করে বেড়ে উঠল. নৌকোটা ফিরে এল প্রায় এক ঘন্টা পরে.
কিন্তু নৌকোতে এবারেও সবার জায়গা হল না. সেই সাথে লোকজনের চীত্কার, হুড়োহুড়ি, বাকস প্যাঁটরা টানার আওয়াজ, বাচ্চাদের কান্না সব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হল. ওপারে পৌঁছানোর বেশ কিছু আগেই নৌকোটা হঠাত বেমাক্কাভাবে কাদায় আটকে গেল. বাধ্য হয়ে বাকস প্যাঁটরা হাতে নিয়ে বাচ্চা কোলে করে আমরা হাঁটু পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে পারে পৌঁছলাম. এ যাত্রায় ইমদাদ আমাদের সাথে আসতে পারেনি, তাই আমি ফিরতি নৌকোতে ফিরে গেলাম যাতে ওর আসাটা নিশ্চিত করতে পারি. বিলালও আমার সাথে চলল. এইবার নৌকোতে সবাই আসতে পারল. আমরা এপারে আবার হাঁটতে লাগলাম.
ততক্ষণে আবার মেঘ এসে আকাশ ছেয়ে চাঁদ ঢেকে দিয়েছে. আমরা উদ্দেশ্যহীন হাঁটছি, কেউ জানি না কোথায় যাচ্ছি. সেই সঘন অন্ধকারে তখন সবাই নিজের মধ্যে ডুবে আছে. মেয়েরা আর বাচ্চারা কয়েকবারই পেছনে পড়ে গেল, তাই আমাদেরকে ওদের অপেক্ষায় থেমে থেমে এগোতে হল. মতিন সাহেবের স্ত্রী কিছুটা হালকা পাতলা, তিনি খুবই ধীরে হাঁটছিলেন বলে বার বার পেছনে পড়ে যাচ্ছিলেন. আমি উনার সাথে হাঁটছিলাম যাতে একা না লাগে. খুব বিষন্ন গলায় তিনি বললেন - "জীবন কত বদলে গেছে দেখেছেন? জীবনে কোনদিন এক মাইলও হাঁটিনি, কিন্তু এখন ? এই খালি পায়ে বোধহয় আরো মাইলের পর মাইল হাঁটতে হবে, কোথায় যাচ্ছি জানি না". আমি চুপ করে রইলাম.
আমাদের ক্লান্ত কফেলাটা বলতে গেলে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে. চোখে নাকে ঢুকছে বাতাসে ছুটে আসা বালুর কণা. ভোর ৩টা এখন, শহর থেকে আমরা এখনো দীর্ঘ পাঁচ মাইল দুরে কিন্তু পথ ভুল করার জন্য আমাদেরকে প্রায় দশ মাইল বেশী হাঁটতে হল. সাবরাতি বলল মূল নদীর যেখানে সবচেয়ে চওড়া সেটা খুব কাছে, ওখানে নৌকো পাবার সম্ভাবনা. তখন হঠাত আমার ডানদিকে কয়েকটা ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখলাম. বিপদের গন্ধ পেয়ে আমি থেমে গেলাম.
মতিন সাহেবও থেমে গেলেন আমার সাথে. লোকগুলো আমাদের সাথে কর্কশভাবে কথা বলা শুরু করল. তাদের গলা শুনে বাকিরাও থেমে গেল. কাছে এলে দেখলাম ওরা চারজন, হাতে চকচকে ধারালো ছোরা আর sickles. দেখে মতিন সাহেবের স্ত্রী ভয় পেয়ে গেলেন. আমি শক্ত হবার চেষ্টা করছি, লোকগুলো কাছে এসে সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল. শরীফ সাহেব আর সুলেমান তাদের সামনে এগিয়ে এলেন - সুলেমানের শরীর ছিল প্রকাণ্ড আর মজবুত - সেই সাথে শরিফ সাহেবের হাতের পিস্তলটা দেখে ওরা নরম হয়ে গেল. তারা নরম সুরে বলল আমরা ভুল দিকে যাচ্ছি - ওরা শুধু আমাদেরকে ঠিক পথটা দেখিয়ে দিতে এসেছে. সুলেমান এগিয়ে এল আরো কয়েক কদম.
সে এক হ্যাঁচকা টানে একজনের হাত থেকে ছোরাটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল- "এখন বল ঠিক পথ কোনটা?" তারা আমাদেরকে ডানদিকে যেতে বলল. আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম একটু বিশ্রাম করে আমরা আবার রওনা হব. এরপর তারা চলে গেল. আসলে আমরা তাদেরকে বিশ্বাসই করিনি. আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল ওরা যে পথে যেতে বলেছে সেদিকে ওদের একটা পুরো দল অপেক্ষা করছে কি না. কিন্তু কোনদিকে যাব ঠিক করতে পারছিলাম না বলে ওখানেই বাকি রাত টুকু কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল. মাটিতে চাদর বিছিয়ে সবাই বসে পড়লাম. এত এত হেঁটে হেঁটে সবাই কত যে ক্লান্ত ! বসার সাথে সাথেই দুচোখে জড়িয়ে এল নিবিড় ঘুম - কিন্তু ঘুমোবার কি যো আছে? ঠাণ্ডার চোটে শরীরের লোম খাড়া হয়ে আছে. বিলাল হোল্ডলটা টানাটানি করে ওটাকে ঘুমোবার ব্যাগ বানানোর চেষ্টা করছে. হোল্ডলটা বিরাট, তাই ভাবলাম ওতে বিলালের পাশে আমারও জায়গা হবে. কোনমতে ওটার ভেতরে পা থেকে কোমর পর্য্যন্ত ঢোকাতে পারলাম - এদিকে ঠাণ্ডা বাতাসে আমার মাথা আর বুক হিম হয়ে যাচ্ছে. পা কিছুটা গরম আর মাথা ঠাণ্ডা !! ফিজিক্স-এর সুত্র অনুযায়ী আমার মাথা থেকে একটা ইলেকট্রিক তরঙ্গ বোধহয় দাঁত পর্য্যন্ত যাচ্ছে! ঘুমের দেখা নেই - এইসব ফালতু চিন্তা মাথায় এসে ভর করেছে. ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে মাথাটা হোল্ডলের অন্যদিকে ঢোকানোর চেষ্টা করতেই ওখানে জমে থাকা বালুতে এমনই দম বন্ধ হবার জোগাড় যে তাড়াতাড়ি মাথা বের করে ফেলতে হল. সব মিলিয়ে খুবই অস্থির লাগছিল. সারাটা রাত কাঁপতে কাঁপতেই কেটে গেল. সকালে সবাই আবার রওনা হলাম, দেখা গেল আমরা আগে সঠিক পথেই ছিলাম - ওই লোকগুলো আমাদেরকে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে.
নদীপার CROSSING THE MAINSTREAM
কাছেই খেয়াঘাট - শিগগিরই সেখানে পৌঁছে গেলাম আমরা. যতদুর দৃষ্টি যায় কোনো নৌকো নেই. সাবরাতি আর সুলেমান অন্যদিকে গেল, কোনো নৌকো দেখলে সেটা এখানে বেয়ে আনবে. ওরা ফিরে এসে বলল দুরে নৌকো আছে কিন্তু কোনো মাঝিই নৌকো এখানে আনতে চাচ্ছে না. হঠাত নজরে পড়ল নদীর ওই পারে একটা নৌকো আমাদের দিকেই আসছে. কিন্তু ওটা আমাদের কাছে না এসে নদীর মাঝখানে একটা চরে থামল. কে যেন বলল নৌকোটা এখানে আসবে না কারণ পানির গভীরতা এখানে একেবারেই কম. নিরুপায় মানুষ বুক-ডোবা পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে নৌকোটার দিকে যাচ্ছে. বাচ্চারা আর মেয়েদের নিয়ে আমরা কি করে তা করি. কেউ একজন বলল মাঝিকে বেশী টাকার লোভ দেখালে সে হয়ত নৌকোটাকে এখানে আনবে. সাবরাতি বলল মাঝি তার নৌকোর ব্যাপারে কোনোই ঝুঁকি নেবে না. এই নিরুপায় অবস্থায় বুক-ডোবা পানির ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে নৌকোয় যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না.
সূর্য্য উঠতে শুরু করেছে. কাল বাড়ী ছাড়ার সময় যে যা পারে কিছু খেয়ে নিয়েছে. আমার কিছু খাবার রুচি ছিল না. সেই থেকে এখন পর্য্যন্ত আমি কিচ্ছু খাইনি. কি যে খিদে লাগছিল আমার ! সাথে কিছু মুড়ি ছিল, তাই খেলাম আমরা সবাই. তারপর ধীরে ধীরে পানির দিকে এগিয়ে গেলাম, আমি আর ইমদাদ সবার পেছনে. মতিন সাহেবের ছত ছেলেটাকে আমি ঘাড়ের ওপর বসিয়ে পানিতে নেমে গেলাম - মতিন সাহেবকে সুলেমান ঘাড়ে তুলে নিল. এক বুড়ি নোংরা একটা কাপড়ে তার জিনিসপত্র পেঁচিয়ে নিয়েছিল, সেটা পিঠে নিয়েছিল বলে তার ওজনে বুড়ি কুঁজো হয়ে গিয়েছিল. ভয় পাওয়া শিশুর মত সে ধীরে ধীরে হেঁটে ওখানে পৌঁছল. ওর পিঠের পোটলাটা তখন ভিজে জুবুথুবু - ওটা থেকে ঝরছে পানি. সবাই নিজের নিজের জিনিসপত্র মাথায় নিয়ে পানির মধ্যে দিয়ে নৌকোর দিকে হেঁটে চলেছে. মনে হলো যেন আখেরাতের মাঠে সবাই নিজের নিজের পাপের বোঝা নিয়ে চেলছে - আমারটাই বোধহয় সবচেয়ে ভারী. ওখানে যখন পৌঁছলাম নৌকো ভর্তি লোক নিয়ে সেটা ওপারে চলে গেছে. বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ওটা কখন ফিরে আসে. এর মধ্যে বহু লোক সেখানে জড়ো হয়েছিল. কেবল একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছি মাত্র, সৈন্যের পোশাক পরা কয়েকজন এদিকেই আসছে দেখা গেল. কেউ একজন বলল ওরা পাকিস্তানী আর্মী.
ভয়ে সবার মুখ তখন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে. কেউ কেউ উচ্চস্বরে কোরানের আয়াত পরা শুরু করেছে. সৈন্যের যখন কাছে এল দেখলাম ওরা খাকি পোশাক পরা চারজন ইপিআর. একজনের রক্ত ঝরছিল - ওর পিঠে গুলী লেগেছে. ওরা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এখানে এসেছে. ওরা কাছে আসতেই আঙ্কেল আমাকে মেয়েদের মধ্যে লুকোতে বললেন. আমি তা না করে সৈন্যদের থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইলাম আর আঙ্গুল দিয়ে ব্যস্তভাবে বালুতে আজেবাজে লাইন আঁকা শুরু করলাম. সবাই ওদেরকে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগল. রাজশাহীর দিকে তাকিয়ে দেখি সাদা কালো ধুম্রজালে আকাশ ভরে গেছে. আঙ্কেল আমার কাছে এসে বসলেন - জিজ্ঞেস করলেন কি ভাবছি. বললাম আমার মাথা খালি লাগছে - মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি. এর মধ্যে নৌকোটা ফিরে আসছে দেখা গেল. পুরুষ নারী, বাচ্চা যুবক বুড়ো সব ধরণের মানুষ এমনকি কিছু ছাগলও ঝাঁপিয়ে পড়ে বুক-ডোবা পানিতে ছুটল নৌকোয় আগে উঠবার জন্য. ধাক্কাধাক্কি করে সবাই নৌকোয় উঠে পড়ল. চলে গেল নৌকো, ফিরল এক ঘন্টা পর.
এই এক ঘন্টা আমি চুপ করে বসে ওই উত্তাল ঘটনাগুলো নিয়ে শুধু ভাবলাম আর ভাবলাম. এর মধ্যে আমিও অন্যদের মত হয়ে গেছি - ধাক্কাধাক্কি করে নৌকোয় না উঠলে হয়ত কোনদিনই যেতে পারব না. তাই নৌকোটাকে ফিরতে দেখামাত্রই মতিন সাহেবের ছোট ছেলে শামীমের হাতে আমার জুতো জোড়া ধরিয়ে দিয়ে ওকে ঘাড়ে তুলে পানিতে নেমে পড়লাম. কখনো কোমর কখনো বুক সমান পানিতে হেঁটে হেঁটে আমরা কোনরকমে নৌকোতে উঠে পড়লাম.
ভীড়ের জন্য মনে হচ্ছিল আমরা যেন ছাগলের পাল. সবাই সবদিক দিয়ে একেবারেই সমান, উঁচুনীচু ধনী গরীব কোনই তফাত নেই. বোরখা পরা যে নারীরা জীবনে কাউকে মুখ দেখায় নি তাদের আজ মুখ ঢাকবার উপায় নেই. কিছু তরুণী ছিল খুব কাছের আত্মীয় ছাড়া যাদের মুখ কেউ কখনো দেখেনি তারাও আজ গাদাগাদি অপরিচিত পুরুষের চাপে পিষে যাচ্ছে. কোনরকমে আমি দাঁড়াবার জায়গা করেছিলাম কিন্তু সেটা এতই বিপজ্জনক ছিল যে নৌকো একটু কাত হলেই আমি পানিতে পড়ে যাব. সবাই সেটা বুঝতে পেরে আরো একটু চাপাচাপি করে আমাকে বসতে দিল. ওদের প্রতি আমি কি যে কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম ! নৌকো ওপারে পৌঁছল, লোকজন চটপট নেমে গেল. আমরা লাগেজপত্র তীরে রেখে ফিরে এলাম নৌকোয়, - নৌকো আবার ফিরে যাচ্ছিল ফেলে আসা লোকজনকে আনতে যার মধ্যে আঙ্কেলও ছিলেন.
তিনি প্রায় অর্ধেক শরীর পানিতে ডুবিয়ে নৌকোর অপেক্ষা করছিলেন. আমি তাঁকে তাড়াতাড়ি নৌকোয় উঠিয়ে নিলাম - নৌকটাও আবার যেন ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হল. আমাদের দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও পাওয়া কঠিন. তখন দেখি নৌকোর ঠিক মাঝখানে দু'টো ছাগলের ঠিক মাঝখানে এক চিলতে জায়গা আছে. আমি আমার জায়গাটা আঙ্কেলের জন্য ছেড়ে দিয়ে একে কনুইয়ের ধাক্কা ওকে গুঁতো তার পা' মাড়িয়ে ছুটলাম ছাগলের দিকে. ছাগল দুটোর মাঝখানে গিয়ে দেখি ওখানে বসে আছে এক বুড়ী. ছাগলের বিকট দুর্গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে মাথা ফেটে যাবার জোগাড় - কিন্তু ওই বুড়ীকে শান্ত দেখে একটু সান্ত্বনা পেলাম. আস্তে করে যেন আমার ঘ্রাণশক্তিও কমে এল.
জেলখানার পোশাক পরা দুজন কয়েদী বসেছিল আমার কাছ থেকে কিছুটা দুরে. একজনকে তো রীতিমত খুনীর মত লাগছিল. সে আবার নেশাও করত মনে হয় কারণ নেশার ঘোরে তার চিকন চোখ দুটো লাল হয়ে ছিল. ও বোধহয় গাঁজা খেত. দেখলম সে লোভী চোখে আঙ্কেলের হাতে ধরা রেডিওটার দিকে তাকিয়ে আছে. তারপর নৌকো তীরে পৌঁছানো পর্য্যন্ত ওরা নিজেদের মধ্যে কি যেন ফিসফিস করল. মাটিতে নেমে ভাবলাম ওরা বোধহয় আমাদেরকে আক্রমন করবে - কিন্তু সম্ভবত: ওদের সে সাহস হলনা. আশ্চর্জ্য় যে ওরা নীচে না নেমে আবার নৌকোতেই ওপারে ফিরে গেল. ততক্ষণে সূর্য্য উঠেছে. যে বালু গতকাল আমাদেরকে ঠাণ্ডায় জমিয়ে মেরেছে সেই বালু এখন গরম হয়ে উঠেছে. রাতের ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পা সেই উষ্ণ বালুতে খুব আরাম লাগছে. এখানে কিছু কুলীও পেলাম, দুজনকে ভাড়া করে জিনিসপত্র ভাগাভাগি করে কাছের গ্রামের দিকে হাঁটা দিলাম আমরা.
ভারতের দিকে ....
বাকস প্যাঁটরা'র জন্য কুলী ভাড়া করাতে কি যে আরাম হল. কিন্তু তাই বলে আমাদের চলার গতি বাড়লনা - এবারে যে জিনিসটা আমাদেরকে প্রায় মাটিতে পেড়ে ফেলল তার নাম ক্ষুধা. তার ওপর সারা রাত বাকস প্যাঁটরা নিয়ে হাঁটার জন্য শরীরে বেশ ব্যথা. আঙ্কেল বাচ্চাদের জন্য অনেকগুলো ক্যান্ডি কিনেছিলেন, বাড়ী ছেড়ে আসার সময় তিনি সেগুলো সাথে নিয়েছিলান. ওগুলোই তিনি আমাদের দিলেন খাবারের বিকল্প হিসেবে. কিন্তু নদীতে হাঁটবার সময় সেগুলো ভিজে গিয়ে একটার সাথে আরেকটা লেগে গিয়েছিল. তাছাড়া ওগুলোতে ধুলোবালিও লেগেছিল. সাধারণ অবস্থায় আমরা ওগুলো ফেলেই দিতাম কিন্তু এখন এই মারাত্মক ক্ষুধায় ওগুলো মনে হলো যেন অমৃত. আরো বেশ কিছু হাঁটবার পরে কয়েকটা কুটির নজরে পড়তেই সবাই সেদিকে দিলাম ছুট. আমাদের এত পিপাসা পেয়েছিল যে বলার নয়. কুটিরগুলোর কাছে যেতেই সারা গ্রাম ভেঙ্গে পুরুষ নারী বাচ্চারা এসে হাজির. সবাই আমাদেরকে উৎসুক চোখে দেখছে. তারা তক্ষুনি আমাদেরকে পানি খেতে দিল. তারা বলল আমরা যে গ্রামে যেতে চাই তার নাম খাদির. ওখানে মতিন সাহেবের পরিচিত একজন কনট্রাকটার থাকেন, গ্রামটা এখান থেকে আরো ছয় সাত মাইল দুরে.
ক্ষুধা পিপাসা নিয়ে আমরা সারা রাত সকাল দুপুর পর্য্যন্ত হেঁটে হেঁটে তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত. তার পরে আবার আরো ছয় সাত মাইল হাঁটতে হবে শুনে আমরা একেবারেই ভেঙ্গে পড়লাম. তখন একজন বলল ভারতের সীমান্ত মাত্র দেড় মাইল দুরে - সেখানে রিফিউজি ক্যাম্প-এর ব্যবস্থা করা আছে. আমাদের সবার বিধ্বস্ত অবস্থা বিবেচনা করে খাদির গ্রামে যাওয়া বাদ দিয়ে ভারতে যাওয়াই স্থির হল. গ্রামবাসীদের অনুরোধ করলাম গরুর গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিতে, আমরা ভাড়া দেব. কিন্তু কেন যেন কেউই রাজী হল না. আমাদের অনেক অনুনয়ের পর একজনের মন গলল, সে দুটো গরুর গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিল. গরুর গাড়ীতে মেয়েরা, বাচ্চারা বুড়োরা আর লাগেজ পত্র তুলে দিয়ে বাকি আমরা পায়ে হেঁটে রওনা হলাম.
সবেমাত্র রওনা হয়েছি এমন সময় নদীর দিক থেকে খাকি পোশাক পরা তিন চারজন লোক এল. তাদের ঘাড়ে রাইফেল আর হাতে বুলেটের ব্যাগ. তারা ঘুরে অন্য পথে চলে গেল, মনে হল তারাও ভারতে যাচ্ছে, গরুর গাড়ী আসতে ধীরে চলছে, পেছনে আমরা. এখন সবাই আনন্দিত আর হালকা. সবাই মৃত্যুফাঁদ পেরিয়ে এসেছি, এখন সবাই নিরাপদ. যদিও নিজেদের বাড়ীঘর ছেড়ে আসতে হয়েছে, যদিও ভবিষ্যত অনিশ্চিত তবুও আসন্ন বিপদ ঠেলে তো বাঁচা গেছে !!
পায়ে খুব ব্যথা করছে. হাঁটার শক্তি সাহস কোনটাই আর নেই আমার. লাগেজপত্রের বোঝা অনেক টেনেছি, মানসিক উদ্বেগও ছিল প্রচণ্ড. অন্যদের জন্য ভারত নিরাপদ হলেও আমার জন্য বিপজ্জনক. এই সেই দেশ যাকে আমি অপছন্দ করি, সাতচল্লিশে এ দেশ থেকেই আমার বাবা-মা, দাদা-দাদীরা পাকিস্তানে এসেছিলেন চিরদিনের জন্য. এখন প্রতিটি পদক্ষেপে আমি সেই দেশের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি. একটা গরুর গাড়ীতে ওঠার চেষ্টা করলাম কিন্তু ওটা আগে থেকেই ভর্তি, কোনই জায়গা ছিল না. কাজেই টলতে টলতে হেঁটে চলা ছাড়া আমার উপায় ছিল না.
চরম ক্লান্তির জন্য কখনো আমি পেছনে পড়ে যাচ্ছিলাম, আবার রাস্তায় কাদার কারণে গরুগাড়ীর গতি কমে এলে পাশে চলে আসছিলাম. রাস্তার পাশে একটা তরমুজের ক্ষেত পড়ল. যারা হাঁটছিল তাদের সবাই একটা বা দুটো তরমুজ নিয়ে নিল - আমি নিলাম একটাই. আমাদের প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত পেটের জন্য তরমুজগুলো যেন এক মহাভোজের উৎসব এনে দিল. এদিকে অন্যদেরকে খেতে দেখে আমার খিদেটাই বেড়ে গেল –শরীফ সাহেব বড় রহম করে আমাকে তাঁর তরমুজের অর্ধেকটা দিলেন. শুধু তাই নয় তিনি চেপেচুপে তাঁর গরুর গাড়ীতে আমার জন্য একটু জায়গাও করে দিলেন. কি বড় মনের মানুষই না ছিলেন তিনি!
আমি গোগ্রাসে তরমুজ খেলাম আর তার ছোঁচাগুলো গাড়ীটানা বলদগুলোকে খাওয়ালাম.
ভারতে প্রবেশ !
একটানা চলতে চলতে বুঝতেই পারিনি কখন ভারতে ঢুকে পড়েছি! রাস্তা আর আগের মত উঁচুনীচু নয়, চারপাশও অন্যরকম, এইমাত্র যে খালটা পেরিয়ে এলাম তাতে এক নৌকো ভর্তি লোক হিন্দুদের পরিচয়জ্ঞাপক সাদা ধুতি আর সাদা সার্ট পরা. গরুর গাড়ী গুলোকে ছেড়ে দিতে হল কারণ ওরা আর এর পরে যেতে পারবে না. বেলা ৪টা বাজে প্রায়, গরমে সবার অবস্থা কাহিল. বাদল আর খায়রুল তো লুঙ্গীতে কাছা মেরে লাফ দিয়ে পড়ল খালের মধ্যে. বাকিরা হাতমুখ ধুয়ে নিল. খেয়াপারের নৌকোটা ছিল ছোট, তাই একবারে সবার জায়গা হলনা - দুবার লাগল.
হিন্দুরা আমাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে, - বোঝা গেলনা সেটা বিতৃষ্ণা নাকি পরিহাসের দৃষ্টি. মাঝিকে ভাড়া দিয়ে আমরা প্রায় মাইল খানেক দুরে রিফিউজি ক্যাম্পের দিকে হাঁটা ধরলাম. পথে কিছু ভারতীয় সৈন্য পড়ল কিন্তু তারা আমাদেরকে দেখেও দেখল না.
কাতলামারী-তে
মেয়েরা বাচ্চারা নিয়ে এই বিধ্বস্ত অবস্থায় ভারতের সীমান্ত-শহর মুর্শিদাবাদের কাতলামারী-তে পৌঁছলাম প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর. এইবার সবাই আমাকে নিয় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল কারণ আমি পাকিস্তানী. আমার এক জল নাম নেয়া হল, শাহাদত হোসেন - আমি ইমদাদের চাচাত ভাই, আমার বাবা বহু আগে গত হয়েছেন এবং আমি লন্ডনে আমার রেষ্টুরেন্ট চালাই. আমি চাচার সাথে দেখা করতে এসে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডেন্টিটি কার্ডে আমার আসল পরিচয় লেখা ছিল, সেটা ছিঁড়ে ফেললাম. কাতলামারীতে কোনো রিফিউজি ক্যাম্প ছিল না, তাই আমরা ভারতীয় আর্মীর চেক পোষ্ট-এর কাছে এক গাছের নীচে বসে পড়লাম. ঠিক তখনি এক ভদ্রলোক এসে আমাদের পুরুষদের জেরা করতে লাগলেন. আমি বাচ্চাদের ভীড়ে লুকিয়ে কোনরকমে রক্ষা পেলাম. আমাদের সবাইকে দুটো করে কলা আর কিছু মুড়ি দেয়া হলো - মুহুর্তের মধ্যে সেগুলো সাবাড় হয়ে গেল. এর মধ্যে এক মুসলমান হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আমাদের মেয়ে আর বাচ্চাদের তাঁর বাসায় আশ্রয় দেবার প্রস্তাব করলে মেয়েরা আর বাচ্চারা সেখানে গেল. আমরা পুরুষরা বসলাম তাঁর বাসার সামনে বেঞ্চের ওপরে.
কিছুক্ষণ পরে বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স বিএসএফ-এর পোশাকে এক ক্যাপ্টেন এসে হাজির. দাঁড়ি-পাগড়ী না থাকলেও বোঝা-ই যাচ্ছিল সে একজন শিখ. সুঠাম স্বাস্থ্যবান দেহ, কথা বলার ধরণ আর কব্জিতে রুপার ব্রেসলেট-ই বলে দিচ্ছিল সে শিখ. সে নিজের পরিচয় দিল, পূর্ব পাঞ্জাবের জাগীর সিং. লোকটা দেখলাম খুবই কর্কশ আর উদ্ধত. কথা বার্তার মধ্যে হঠাৎ সে পাকিস্তানী আর্মীর বদনাম শুরু করে দিল. ১৯৬৫ সালে লাহোরের জাল্লো সেক্টরে যুদ্ধে ভারতীয় বাহীনির বীরত্বের কথা সে অনেক বাড়িয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলতে লাগল. লোকটা জানত না জাল্লো'র বিআরবি খালের মাত্র ৬ মাইল দুরেই আমাদের বাড়ী. ওই যুদ্ধ আমি স্বচক্ষে দেখেছি - আমি জোর গলায় বলতে পারি পাকিস্তানী আর্মী সংখ্যায় অনেক বেশী ভারতীয় সৈন্যদেরকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ঠেকিয়ে দিয়েছিল. সেই সময় পাকিস্তানী আর্মী পূর্ব পাকিস্তান সহ সারা জাতির পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল. লোকটা যেভাবে পুরো ঘটনাকে উল্টিয়ে দিল তাতে রাগে আমার রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল কিন্তু কি করব. নিজেকে অতিকষ্টে সামলিয়ে রেখে চুপ করে থাকা ছাড়া আমার আর কিই বা করার ছিল !
এর মধ্যে বিএসএফ-এর এক সৈন্য এসে তাকে স্যালিউট দিয়ে বলল ইপিআরের কয়েকজন সৈন্য ক্যাম্পে এসেছে - তাদের কোনো অস্ত্র নেই এবং তারা জখম হয়েছে. ক্যাপ্টেন তাকে নির্দেশ দিল ইপিআরদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে - সে শিগগিরই আসবে. কিন্তু সৈন্যটা চলে যাবার পরপরই সে আবারো আমাদেরকে তার সাংঘাতিক বীরত্বের গপ্পো শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল. কথায় কথায় মুক্তিবাহীনির কথা উঠলে সে তাদের খুব প্রশংসা করল. বলল, অস্ত্রের কমতি সত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে সুসংগঠিত পাকিস্তানী আর্মীর সাথে লড়েছে তা প্রচন্ড সাহসের ব্যাপার. সে নিজে নাকি দিনাজপুরে গিয়ে দেখেছে মুক্তিযোদ্ধারা কি দক্ষতার সাথে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে -যদিও সে নিয়ন্ত্রণ বেশীদিন রাখা সম্ভব ছিলনা.
এরপর আমাদের থাকা খাওয়ার কথা উঠলে সে বলল আওয়ামী লীগের এক এমপি কাছাকাছি কোথাও আছে, তাকে গিয়ে ধরতে. তখন আবদুল আজিজ নামে কুর্তা-পাজামা পরা এক ভদ্রলোক এলেন, তিনিই সেই এমপি. তাঁকে বেশ বুদ্ধিমান মনে হল. তিনি পাবনার লোক, তাঁকে "হিন্দুস্তান" নামে একটা গাড়ী দেয়া হয়েছিল. তাঁর মুখে শুধু একটাই কথা - পাকিস্তানী আর্মীর ভয়াবহ অত্যাচারের কথা. তিনি নাকি এই ভয়ানক অবস্থা অনেক আগেই আঁচ করেছিলেন এবং শেখ মুজিবকে বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নেতারা প্রেসিডেন্টের সাথে মিটিং-এর পর মিটিং নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে সে সুযোগই তিনি পান নি. তিনি বললেন নেতারা নাকি খুব বোকামী করেছেন. যাহোক, কাছেই বহরমপুর শহরে তিনি আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবেন. তিনি এটাও সতর্ক করে দিলেন, বহরমপুরের কোনো হোটেলে রুম খালি নেই, আর ভাড়া করার মত বাড়ীও পাওয়া কঠিন হবে কারণ এর মধ্যেই সব ভরে গেছে. কথাগুলো এত ফালতু মনে হলো যে আমি ওখান থেকে চলে এসে বাড়ীর ভেতরে গেলাম.
ডাক্তার সাহেবের বাড়ীটা অন্যান্য বাড়ীর মত মাটির তৈরী হলেও বেশ বড়সর. বাড়ীর চারদিকে বিভিন্ন রকম খাম্বার ওপরে ঢেউটিনের ছাদ দিয়ে তৈরী করা বারান্দা . বাথরুমটা সিমেন্টের. চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন. বারান্দায় আমাদের মেয়েরা আর বাচ্চারা ঠাসাঠাসি করে বসে আছে. আমাকে দেখেই মেয়েরা বাজার থেকে সাবান ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিস কিনে আনতে বলল - আমি সেগুলো কিনেও আনলাম. বাজারে ওদের মুদ্রার সাথে পাকিস্তানী মুদ্রাও চালু ছিল.
এক সময় পাকিস্তানী একটাকা ভারতীয় দেড় রুপী ছিল. দেখে খুব খারাপ লাগল এখন আমাদের এক টাকা এখানকার বারো আনা হয়ে গেছে. হাতমুখ ধবার জন্য আমি টিউবওয়েল খালি হবার অপেক্ষায় রইলাম. লাইন এতই লম্বা ছিল যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আমার বাড়ি না আসায় আমি খুব হতাশ হয়ে বাইরে চলে এলাম. ততক্ষণে বাচাল ক্যাপ্টেনটা চলে গেছে. ওদিকে চুলায় ডেকচি বসানো হয়েছে, খিচুড়ী রান্না হবে. এর মধ্যে কে যেন আমাদের হাতমুখ ধবার জন্য এক বালতি পানি এনে দিল. কি যে কৃতজ্ঞ লাগলো আমার ! হাতমুখ তো ধুলামই, মাথাতেও কিছু পানি ঢাললাম.
সন্ধ্যা পেরিয়ে নিশ্চুপে এগিয়ে আসছে রজনী যখন রান্না শেষ হল| আমরা যখন খেতে বসছি তখন রাত হয় হয়| বারান্দায় নীচু টুলের ওপর আমরা গোল হয়ে বসেছি| আমাদের সামনে বড় বড় কলাপাতা যাতে করে আমরা খাব| একজন বিরাট বাসনে খিচুড়ী এনে সবার কলাপাতায় কিছু কিছু করে দিয়ে গেল| আমার খুবই ক্ষিদে পেয়েছিল - কিন্তু বাকি সবাই-ই তো ক্ষুধার্ত - আমি উত্সুকভাবে একজন একজন করে তাদের চোখমুখ নিরীক্ষণ করছি| মতিন সাহেবের মুখে এসে আমার নজর আটকে গেল| তাঁর সাদা প্যান্টে কাদার দাগ| তাঁর সাদা চুল আর সাদা সার্ট ধুলায় ভর্তি| পা' দুটো আড়াআড়ি ভাবে রেখে তিনি নীচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছেন| তাঁকে মনে হল ঘটনাবহুল উথাল পাথাল সময়ের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি|
প্রথম যেদিন তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল আমরা তাঁর ডাইনিং রুমে একসাথে বসে ডিনার খেয়েছি| কোন রকম দাগহীন শ্বেতশুভ্র কাপড়ে তাঁকে কি অপূর্বই যে লাগছিল! বিশাল বাড়ীতে তাঁর চারপাশে একপাল চাকরের দল এক ঐশ্বর্য্যময় অভিজাত আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল| মাথায় সঘন শুভ্র কেশ-সজ্জিত তাঁর সেই তৃপ্তহাস্যময় অভিজাত চেহারা এখনো আমার মনে ভেসে ওঠে| কে ভাবতে পেরেছিল সেটা এত তাড়াতাড়ি স্বপ্নের মত মিলিয়ে যাবে| মোহাচ্ছন্নের মত আমি তাঁর দিকে তাকিয়েই ছিলাম - তিনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসলেন| সেই ডাইনিং টেবিলের হাসি আর এই হাসি - কতই না পার্থক্য এ দুটোতে! এ হাসি একজন অভিজাত অথচ আহত মানুষের কষ্টের হাসি| মনে পড়ল ডাইনিং টেবিলে তাঁর সেই গর্বিত ঘোষণা - তাঁর হাতে দারিদ্র্যের রেখা নেই ! তিনি হস্তরেখার চর্চা করতেন - হাতের তালু চোখের সামনে ধরে তিনি সেই ভবিষ্যতের ঘোষণা করেছিলেন|
কিন্তু এখন মতিন সাহেবের মত তিনিও অত্যন্ত মানসিক উদ্বেগের মধ্যে| এক সেকেন্ডের বেশী তাঁর চোখে তাকিয়েথাকার সাহস আমার হলনা, চোখ নামিয়ে নিলাম আমি| সত্যি বলতে কি আবেগে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল| একটু পরে ক্ষুধাটা আবার চাগিয়ে উঠল, এক লোকমা খিচুড়ী মুখে দিলাম| সেটা গলা দিয়ে নামছে আর আমি আবার অন্যদেরকে নিরীক্ষণ করে চলেছি| সবার চোখেমুখে সেটাই খেলা করছে যা আমার চোখেমুখে করছে| উফ, খিচুড়ীতে নুন এত বেশী- আমার গলাটা যেন জ্বালা করে উঠল| খাবার পেয়েই ক্ষিদেটা যেন আরো কয়েকগুন বেড়ে গেছে কিন্তু আমি বেশী খেতে পারলাম না| আমার পাশেই বসা ছিল ইমদাদ| ও কি করে যেন আমার অবস্থাটা বুঝে ফেলল| ওর কিছু মাখন কেনা ছিল, সেটা আমার প্লেটে খিচুরীর সাথে মিশিয়ে দিল| বিনিময়ে ওকে কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিই বা দিতে পারলাম আমি|
নিশিযাপন
খাবার পর প্রশ্ন দাঁড়াল রাত কাটাব কোথায়. ঠিক তখনি আবার ক্যাপ্টেন জাগীর সিং-এর আবির্ভাব. তিনি তাঁর খাদ্য-ব্যবসায়ী বন্ধুকে বলেছেন আমাদের জন্য দুটো ঘরের ব্যবস্থা করতে. তিনি সে জায়গাটাও দেখিয়ে দিলেন যা মাত্র পঁচিশ গজ দুরে. আমরা লাগেজ্পত্র নিয়ে সবে সেদিকে রওনা হয়েছি এমন সময় মাথায় ভেঙ্গে পড়ল বাংলার প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়. বৃষ্টির ফোঁটা তো নয় যেন তীরবেগে ছুটে এসে আঘাত হানছে বন্দুকের অজস্র গুলী. ওখানে মেয়েদের জন্য একটা কামরা আর আমাদের সবার জন্য ঠিক করা ছিল বারান্দা. যাহোক, রাতে সে আমাদেরকে তার অফিস ঘরে তার কর্মচারীদের সাথে থাকতে দিল. বৃষ্টিতে ভেজা কাপড় বদলিয়ে আমরা পড়লাম শুকনো কাপড়. অফিসটায় এক বিরাট চৌকির ওপরে সাদা চাদরে ঢাকা তোষক পাতা ছিল. দুতিনজন কর্মচারী বসে রেডিও শ্রীলংকা শুনছিল. মানুষ যেহেতু বেশী তাই মেঝেতেও পাতা হয়েছে চাদর-ঢাকা লেপ - সবাই শুয়ে পড়ল সেগুলোতে. আমি শুলাম চৌকিতে কালাম সাহেবের পাশে - তাঁর একটা কম্বল ছিল কিন্তু আমার ছিলনা কিছুই. বৃষ্টির জন্য ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল বলে, বেশ শীত লাগছিল আমার. ভাবলাম কালাম সাহেব কম্বলটা আমার সাথে ভাগ করে নেবেন কিন্তু তিনি এমনভাবে অন্যদিকে মুখ করে রইলেন যেন আমি এখানে নেই. শীত এত তীব্র হয়ে উঠল যে ঘুমানো অসম্ভব. আমি মেঝেতে ওই কর্মচারীদের পাশে একটু জায়গা খুঁজলাম.
যা ভাগ্যে জুটল তা হল মেঝেতে পাতলা একটা লেপ আর শরীরের ওপর একটা সুতি চাদর. কর্মচারীদের সাথে ঐটুকু ভাগ করে নেয়ার সৌভাগ্যে একটু আরাম হল. আমাকে জায়গা দেবার জন্য বেচারা কর্মচারীদেরকে পা দুটিয়ে শুতে হল. কিন্তু অজান্তে হলেও কেউ যখনই পা লম্বা করছে আমি বেচারা তার অবধারিত ভুক্তভোগী হচ্ছি. এইভাবে ক্রমাগত মৃদু লাথি খেতে খেতেই পার করে দিলাম রাতটা.
অগ্নিকুণ্ডের দাবানলে রাজশাহী
সকালে বেজায় খিদে নিয়ে ভাঙ্গল ঘুম. বাদলকে নিয়ে চায়ের দোকানে চললাম নাস্তা খেতে. দোকানে মাত্র পৌঁছেছি লোকজন দেখি কোথায় যেন যাবার জন্য দৌড়চ্ছে. কে যেন বলল রাজশাহী যেন ভয়াবহ দাবানলের মধ্যে পরে গেছে - প্রচণ্ড আগুন লেগেছে সেখানে. আমরাও ছুটলাম. একটা উঁচু জায়গায় সবাই জোর হয়েছে যেখান থেকে রাজশাহী একটু ভাল দেখা যায়. নদীর ওপারে গাছের সারি - তার পেছনে দেখি বহু দালান আগুনে জ্বলছে. শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুন্ডুলী পাকিয়ে বিশাল বিশাল ধোঁয়ার স্তম্ভ আকাশে উঠে যাচ্ছে, সারা রাজশাহীর আকাশ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন. আল্লাহকে ধন্যবাদ, আমরা ঠিক সময়েই রাজশাহী ছেড়েছি !
ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে রাজশাহীকে জ্বলেপুড়ে যেতে দেখলাম - ফিরে এলাম দোকানে. ওখান থেকে হাজারে হাজারে রিফিউজি ছুটে আসছে যেন বন্যার ঢল. সবাই রাজশাহীর ধ্বংসযজ্ঞ-এর যে বর্ণনা দিল তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল. কত রকম কাহিনী - রাজশাহী মাটির সাথে মিশে গেছে, প্রত্যেকটি দালান জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গেছে, এমনকি হাইকোর্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক আর ষ্টেট ব্যাংক পর্য্যন্ত পুড়ে তো গেছেই লুটও হয়ে গেছে. চা খেতে খেতে সেবব নিয়ে ভাবছি. যা শুনছি তার সবকিছু বিশ্বাস হচ্ছে না, কিছু কিছু অসম্ভব মনে হচ্ছে. কিন্তু নিজের সমর্থনে কিই বা আছে আমার ! সবাই মনে হচ্ছে তৈরী হয়েই আছে এই রকম কাহিনী গোগ্রাসে গেলার জন্য.
নাস্তা সেরে দোকান থেকে বের হয়ে দেখি কিছু বিদেশী সাংবাদিক ঘাড়ে ক্যামেরা আর ফ্লাশ ব্যাটারী নিয়ে সীমান্তের দিকে যাচ্ছে. কেউ একজন বল্লল ওদের একজন সম্ভবত: বিবিসি'র সাংবাদিক.
ভারতীয়েরা শুনছে রেডিও পাকিস্তান !
ফিরে এসে দেখি মতিন সাহেব, কালাম সাহেব আর আঙ্কেল অফিসের বাইরে চেয়ারে বসে আছেন আর বরাবরের মতই কালাম সাহেব বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন. তাঁর মোদ্দা কথাটা হল পাকিস্তানী আর্মী সরকারী দালান সহ রাজশাহীর প্রতিটি দালান পুড়িয়ে দিয়েছে. তার মানেই হল আর্মী এখানে থাকবে না - সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে চলে যাবে. তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম কিন্তু বিশ্বাস হলনা. আমি তাঁর সাথে তর্ক শুরু করলাম - তিনি একটু নরম হলেন মনে হল কারণ যে যে ব্যাপারে আমি দ্বিমত পোষণ করি পরে তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে. তিনি নরম হলেন বটে কিন্তু মত পাল্টালেন না. দুপুরে খাবার জন্য রান্নাবান্না শুরু হল. কাছেই একটা গাছের নীচে চুলা বানানো হয়েছে, লাকড়ী আনা হয়েছে. খাদ্য-ব্যবসায়ীর লোকজন হাঁড়ী-পাতিলের ব্যবস্থাও করেছে. সবাই খিচুড়ীর চাউল ইত্যাদি কেনার জন্য টাকা দিয়েছে. যাদের পক্ষে সম্ভব রান্নায় সাহায্য করল. কিছু কর্মচারীর সাথে গল্পগুজব করলাম - ওরা ছিল অবাঙ্গালী - বাংলা বলতে ওদের কিছুটা অসুবিধেই হচ্ছিল. এতে আমার কিছু সুবিধেই হল, ওরা বাঙালী হলে আমার বাংলা উচ্চারণ শুনে সন্দেহ-টন্দেহ করতে পারত. আমাদের দুর্দশা বা রাজনীতিতে ওদের মোটেই কোন আকর্ষণ ছিলনা, তাই কথাবার্তা যা হত প্রায় সবই গান বাজনা নিয়ে. ,
কথাবার্তায় যতটুকু পারি সংযত রইলাম - কিন্তু হঠাৎ কেরানীটা সীলোন রেডিও বদলে পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডি স্টেশন ধরলে আমি একটু অবাকই হলাম. ওটাতে যেসব উর্দু আর পাঞ্জাবী গান হচ্ছিল সবাই খুব আনন্দের সাথে শুনছিল. সবাই খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল যখন সেই পল্লীগীতিটা শুরু হল - "লাল মেরি পাত, রাখিও বালা ঝুলে লালান...:". কিন্তু আমার জন্য এটা যে কি মর্মান্তিক ছিল ! মনে পড়ল বাড়ীর কথা যে বাড়ীতে শিগগিরই তো দুরের কথা বরং আর কোনদিনই হয়ত ফেরা হবে না. এর পরে একে অন্যের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটালাম অথবা বার বার ওই জায়গায় গিয়ে জ্বলন্ত রাজশাহী দেখতে লাগলাম.
গুজব হল সত্যি
খাবার পর চায়ের নেশায় ছুটে গেলাম সেই ঘোষের দোকানে. সেখানে দেখি খুব পাতলা আর দুর্বল একটা লোক ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে বসে আছে. মনে হলো লোকটা রাজশাহীর. জিজ্ঞেস করলাম সে কে, তার বাড়ী কোথায় ? সে বলল সে রাজশাহীর এক ব্যাংকের পিওন - এখনি এসে পৌঁছেছে. স্পষ্ট বোঝা গেল সে রাজশাহীতে আজ আর্মী পৌছানো পর্য্যন্ত ছিল. আজ সেখানে কি হয়েছে তা জানার কৌতুহল আমার অদম্য হয়ে উঠল. একসাথে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলাম অনেকগুলো প্রশ্ন. সে আসতে ধীরে শুরু করল তার কাহিনী. সে তার ব্যাংকের দালানে আটকে পড়েছিল, কিছুতেই বেরুতে পারছিল না. সে বলল:- "একবার আমি বেরুনোর চেষ্টা করতেই তিন চারজন আর্মী এসে হাজির. আমি আবার ভেতরে ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলাম. ভেতরে পিচঢালা অন্ধকার কিন্তু বাইরের দালানগুলোতে আগুন লাগাতে আলো ছিল. তাই আমি আর্মীদেরকে দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তু ওরা আমাকে দেখছিল না. তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে তারা আমাদের দালানের বারাব্দায় আশ্রয় নেয়. ওরা আমার এত কাছে ছিল যে ভয়ে আমি কাঁপতে থাকলাম. আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম. কখনো ওরা উর্দুতে কখনো পাঞ্জাবীতে কথা বলছিল. পাঞ্জাবী ভাষা আমি না বুঝলেও উর্দু থেকে কিছুটা বুঝলাম. একজন বলল যেভাবে তারা ষ্টেট ব্যাংক উড়িয়ে দিয়েছে সেভাবে এটাও উড়িয়ে দেয়া হোক. শুনে ভয়ে আমার পা পাথরের মত হিম হয়ে গেল. অন্যেরা তার কোথায় সায় না দিয়ে বলল আবার ফিরে আসা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করতে. বৃষ্টিটা ধরে এলে তারা চলে গেল. সকালে আমি বেরোলাম, পথে কয়েকজনের সাথে দেখা যারা আমার মতই লুকিয়ে ছিল. আমরা ভারতে পালানোর জন্য পদ্মা নদীর দিকে ছুটলাম. আমার পাশে ছিল দুইজন, সম্ভবত ওরা ভাই. একজনের হাতে ছিল একটা স্যুটকেস. পথে মরে পড়ে আছে অনেক মানুষ, সেগুলোর চারদিকে ঘোরাঘুরি করছে শকুনের পাল. পুরো সাহেব বাজার পুড়ে শেষ হয়ে গেছে. আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকলাম. দুই ভাই থেমে কি যেন করার জন্য তাদের স্যুটকেস খুলল কিন্তু আমি থামলাম না - চলতেই থাকলাম. যখন আমি ওদের থেকে প্রায় বিশ গজ আগে, তীক্ষ্ণ শব্দে বাতাস ভেদ করে দুটো বুলেট ছুটে এসে ওদেরকে বিদ্ধ করল. দুই ভাই মাটিতে পড়ে তখন তখনই ছটফট করতে করতে মরে গেল. আমি প্রাণপনে দৌড়তে লাগলাম - কোনরকমে পৌঁছলাম নদীর ধারে. তারপর সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে এখানে এসেছি. আল্লাহকে ধন্যবাদ - আমার জান বেঁচে গেছে". এই বলে সে শেষ করল তার কাহিনী.
ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী লোকটা, তাকে দেখে মিথ্যাবাদী বা ঠকবাজ মনে হয়নি আমার. তার কথা বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না. আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যখন আমি বুঝে গেলাম যা কিছু শুনেছি তা সবই সত্যি, কালাম সাহেবের কথা আসলে সত্যিই. কিন্তু তারপরেও আমার মন সেটা মানতে চাচ্ছিল না. আমি কালাম সাহেবের কাছে গেলাম - উনি দুজন লোকের সাথে কথা বলছিলেন. আমার তখন মনে হচ্ছিল বুকটা ভেঙ্গে গেছে - তাঁকে বললাম তিনি যা কিছু বলেছিলেন সবই সত্যি. তিনি অত্যন্ত উদ্দীপ্ত হয়ে উচ্চস্বরে প্রায় চীত্কার করে চারপাশের সবাইকে বললেন -:- "শুনলে তোমরা এই ছেলেটা কি বলছে? এ খুব বুদ্ধিমান ছেলে, সবকিছু সে অত্যন্ত সঠিকভাবে বুঝেছে. তরাও বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে আমি যা বলছি".
সবাই আমার দিকে ফিরে তাকাল. তারা আমার চেহারায় একটু আশার আলো খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু চরম হতাশায় আমি নিজেই তখন ডুবন্ত লোকের মত একটু খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি. কথাও কোনো একটা আশার আলোর জন্য আমি পাগলের মত চারদিকে হাতড়ালাম - কিন্তু মনে হল দুনিয়ায় ওই দুরে জ্বলন্ত রাজশাহীর আগুনে আলোকিত আকাশ ছাড়া আর কিছুই নেই. এ আলো আমার জন্য অমাবশ্যার নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়. মনের গহীনে সুগভীর কষ্ট পুষে পুষে কাটল নির্ঘুম রাত.
তবুও আশা আছে !
সকালে উঠেই ছুটলাম সেই জায়গায় যেখান থেকে রাজশাহী স্পষ্ট দেখা যায়. অনেক জায়গা থেকে সাদা-কালো ধোঁয়া এখনো উঠছে. একজন মাঝির সাথে দেখা হল. সবল সুঠাম দেহের অত্যন্ত সুদর্শন যুবক, নাম তার খালেক. ওকে বললাম রাজশাহীতে কি কি ঘটেছে, জানতে চাইলাম এ ব্যাপারে সে কি মনে করে. সে বলল তার কাছে চাক্ষুষ প্রমাণ নেই তবে এটুকু সে বলতে পারে হাইকোর্ট আর ষ্টেট ব্যাংকের দালান বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যান্য সরকারী দালানগুলোরও কোন ক্ষতি হয়নি. যেটা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা হলো শহরের আঁকাবাঁকা রাস্তার ধারে সবচেয়ে বড় বাজার সাহেব বাজার যেখানে সকালে পাইকারী দোকানগুলো ব্যবসা শুরু করে. তার এক বন্ধু এক্ষুনি রাজশাহী থেকে এসেছে, তার সাইকেল সহ বাড়ীটা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে. খালেকের কথা শুনে একটু হলেও আশা পেলাম. খালেক নিশ্চয় মিথ্যা কথা বলছে না - কিন্তু গতকালের লোকটাও তো মিথ্যে বলেনি. দুটো বক্তব্যকে পাশাপাশি রেখে আমার মনে হলো গতকালের লোকটা সত্যতাকে একটুখানি বাড়িয়ে বলেছে যা ওরকম ভীত সন্ত্রস্ত আতংকিত অবস্থায় মানুষ করতেই পারে. পরে জানা গেল - আসলেই ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বোধহয় হাইকোর্টের দালানকে অন্য দালানের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে.
আমাদের ওপরে গোয়েন্দাগিরি!
সেদিন এলেন বহরমপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট, প্রায় পুরো সমত্তায় তিনি ক্যাপ্টেন জাগীর সিং-এর অফিসে কাটালেন. কালাম সাহেব আর মতিন সাহেব তাঁর সাথে দেখা করে এলেন. পরে জানা গেল ইপিআর এর একজন ক্যাপ্টেনও সেখানে ছিল - তারা পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করেছে. এদিকে আমার যেন কেমন সন্দেহ হল জানু নামের কর্মচারীটা আমাদের ওপরে শুরু করেছে গোয়েন্দাগিরি. ও সাবধানে আমাদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে তা আমি দুবার দেখলাম. এটাও টের পেলাম যা কিছু আমরা যখনি আলোচনা করে ঠিক করছি তখনি তা ক্যাপ্টেন জাগীর-এর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে. আমি সতর্ক হয়ে গেলাম কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বললাম না কারণ তাতে জানুর প্রতি সবার আচরণ হঠাৎ করে বদলে যেত. জানু বুঝে যেত যে তার পরিচয় আমরা ধরে ফেলেছি. সেই সাথে আমি আমাদের আলোচনা এমনভাবে করা শুরু করলাম যাতে জানুর সামনে গুরুত্বপুর্ন কোনো আলোচনাই না হয়. একদিন সে জিজ্ঞেস করল কত কত ছেলেরা যুদ্ধের জন্য অস্ত্রের ট্রেনিং নিচ্ছে আমরা কেন ক্যাম্পে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছি না. আমরা আমাদের পরস্পরের দিকে বাঙ্ময় দৃষ্টি বিনিময় করে ওকে বললাম পরিবারের একটা ব্যবস্থা করে আমরাও ট্রেনিং নেব.
আপনি আমার মেহমান, কিন্তু দুদিনের বেশী নয় !
আঙ্কেল ফিরে যেতে চাচ্ছেন কিন্তু কালাম সাহেব আর শরীফ সাহেব তার ঘোর বিরোধী. মতিন সাহেব ভুগছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে. খাদ্য-ব্যবসায়ী তার অফিসে আমাদের জায়গা দিয়েছিল মাত্র একদিনের জন্য, এদিকে পার হয়ে গেছে তিন দিন. পনের বিশ মিনিটের জন্য বন্ধু খাদ্য-ব্যবসায়ীকে নিয়ে ভারতীয় ক্যাপ্টেন আসেন প্রায় প্রতিদিনই. একদিন তাঁরা আরেক ক্যাপ্টেন বন্ধুসহ এসে হাজির.
নুতন ক্যাপ্টেনকে আঙ্কেল আর মতিন সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার পর জাগীর সিং তার বন্ধুর সাথে ইংরেজীতে কথা বলে শুরু করল. তারা খেয়াল করল না আমি কাছেই দাঁড়িয়ে আছি, ইংরেজী আমি বুঝতেও তো পারি ! তারা বলাবলি করছিল রিফিউজীরা তাদেরকে খুব ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিয়েছে. তাদের কথাবার্তার সারমর্ম হল - পাকিস্তান থেকে এসে যুদ্ধ করার জন্য ফিরে যাওয়া শিকেয় তুলে এরা এখানে মজা করছে. জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদ-সদস্যেরা অনেক টাকা নিয়ে এসেছে, - তারা কলকাতার অভিজাত হোটেলে খুব আনন্দেই আছে. স্কুল-কলেজের ছেলেরা এখানে এসেই কলকাতায় ছোটে দিনে তিনটে বম্বে সিনেমা দেখার জন্য. যুদ্ধের যত বোঝা সব তারা ভারতের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছে, এমন জাতিকে সাহায্য করে লাভ কি.
যাহোক, তৃতীয় দিনে খাদ্য-ব্যবসায়ী আমাদেরকে অফিস খালি করতে বলে দিল. ওর নাকি বোন আসছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে, তাকে থাকার জায়গা দিতে হবে. অনেক বলে কয়ে আরেকটা দিন থাকার অনুমতি পেলাম আমরা.
অন্য কোথা, অন্য কোনখানে....
আমরা নুতন আশ্রয় খোঁজা শুরু করলাম. বিকেলের দিকে জীপে করে ব্লক ডিপার্টমেন্ট অফিসার এসে হাজির, ডিস্ট্রিক ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁকে বলেছেন আমাদের আশ্রয় দরকার. তিনি বললেন রিফিউজি ক্যাম্পে কিছু জায়গা এখনো খালি আছে, আমরা যেন দেখে আসি. আঙ্কেল তার সাথে গিয়ে ক্যাম্পটা দেখে যখন ফিরলেন, তাঁকে অস্থির লাগছিল. তিনি বারবার আল্লাহ'র কাছে প্রার্থনা করা শুরু করলেন. তিনি বললেন জায়গাটা এতই জঘন্য - ওখানে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল. সন্ধ্যায় আরেকজন এলেন, তিনি নাকি রাজশাহীর এক ব্যাংকের ম্যানেজার. তাঁর শালী মতিন সাহেবের মেয়ের সহপাঠিনী, তিনি মতিন সাহেবকে খুঁজছেন. তাঁর শালী জানতে পেরেছে তিনি এখানে আছেন - তাঁর কাছে দুটো ঘর খালি আছে থাকার জন্য. আঙ্কেল তাঁর সাথে গিয়ে ঘর দেখে ফিরলেন, বললেন ঘরদুটো ছোট হলেও অন্য কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্য্যন্ত ওখানে থাকাই ভাল. এর মধ্যে কালাম সাহেব বহরমপুর থেকে ঘুরে এলেন - বললেন ওখানে একটা বাড়ী পাওয়া গেছে, আমরা কালই গিয়ে উঠতে পারি. কিন্তু আঙ্কেলের মোটেই বহরমপুরে যাবার ইচ্ছে নেই -ঠিক হল কাল সকালে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে.
সকালে ব্লক ডিপার্টমেন্ট অফিসার এলেন আবার. বললেন আমাদের জন্য একটা স্কুল খালি করা হয়েছে, আমরা যেন দেখে আসি. আমি আর আঙ্কেল গেলাম সেখানে. প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে বিরাট দুই কক্ষের স্কুল, টয়লেট প্রায় পঁচিশ যোগ দুরে. পানির ফ্লাশের ব্যবস্থা নেই বলে কিছু মাছি ভনভন করছে. পানির জন্য দালানের বাইরে আছে হাতে চালানো টিউবওয়েল. ইলেকট্রিসিটি নেই, বাজারটাও বহু দুরে. আঙ্কেল বললেন এখানে থাকা কঠিন - কিন্তু রিফিউজি ক্যাম্পের চেয়ে ঢের ভাল. আমার মনে হল আমরা উপায়হীন, কিন্তু তবুও এখানে থাকতে মন সায় দিচ্ছিল না.
ফিরে এসে দেখি কালাম সাহেব বহরমপুরে চলে যাবার জোগাড়যন্ত্র করছেন. আমরা যে অন্য চেষ্টা করছি তা তিনি জানেনই না. সেটা বলাতে তিনি একটু রেগেই গেলেন, বললেন বহরমপুরে না গিয়ে আমরা মহাভুল করছি. তিনি আরো বললেন আমরা যাই বা না যাই তিনি যাবেনই. এই বলে তিনি ভাড়া করা ঘোড়ার গাড়ীতে লাগেজপত্র তুলে দিয়ে পরিবার সহ বাস স্টেশনের দিকে রওনা হয়ে গেলেন. শরিফ সাহেবও পরিবারসহ তাঁর সাথে চলে গেলেন. এদিকে মতিন সাহেব পরিবার সহ আমাদের সাথেই থাকা ঠিক করেছেন. ভাড়া করা দুটো ঘোড়াগাড়ীতে আমরা লাগেজপত্র তুলে ব্যাংকের ম্যানাজারের বাসার দিকে হাঁটা দিলাম - বাসাটা মাইল খানেক দুরে.
অসাধারণ মেজবান
আসলে ম্যানেজারের বাসাটা আমরা যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক ভাল. সারা গ্রামের মাটির তৈরী বাড়ীগুলোর মধ্যে কংক্রিটের তৈরী এই বাড়ীর কামরাগুলো ছিল ভারী সুন্দর. একটা কামরায় লাগেজপত্র ও মেয়েদের জায়গা হল. অন্য কামরার মেঝেতে তুলোর তোষক পাতা হল আমাদের শোয়া বা বসার জন্য. বাড়ীটা তখনও তৈরী শেষ হয়নি, মাত্র এই দুটো কামরাই বানানো হয়েছে. তাই কোনো আসবাবপত্র ছিল না. এ ঘরগুলো আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়ে ম্যানেজারের পরিবার ও তাঁর বাবা পাশেই মাটির তৈরী ঘরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন. ম্যানেজার তাঁর পরিবার নিয়ে কাছেই শ্বশুরবাড়ীতে গিয়ে উঠেছেন. ম্যানাজারের ছোট ভাই পিন্টু খুব বুদ্ধিমান ও প্রানবন্ত ছেলে. মনে হল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে ভারতের কাছে সাহায্য চাচ্ছে সেটা তার ঠিক পছন্দ নয়. আমাদের কামরার কাছেই টিনশেডের নীচে বানানো হয়েছে চুলো. আমরা সেখানে রান্না শুরু করলাম. ম্যানেজারের বাবা চৌধুরী সাহেব অতীব ভদ্রলোক. আমাদের কিসে একটু আরাম হয় সেই চেষ্টায় তিনি সদাব্যস্ত. সারা গ্রামে ফ্লাশ-এর টয়লেট একটাও নেই - তবে বাড়ীতে একটা সার্ভিস ল্যাট্রিন ছিল. চৌধুরী সাহেব দুজন লোক ভাড়া করে মাটিতে গভীর গর্ত করলেন, সেটা বাঁশ ও কাদা দিয়ে লেপে দেবার ব্যবস্থা করে চারদিক চাটাই ও খেজুর পাতা দিয়ে ঢেকে দিলেন - সব মিলিয়ে আমাদের মেয়েদের জন্য একটা নুতন সার্ভিস ল্যাট্রিন তৈরী হল. আমরা সবাই তার প্রতি কি যে কৃতজ্ঞ হলাম.
বাংলার হাট !
সেদিনও খিচুড়ী রান্না হল. চৌধুরী সাহেব কিছু রান্না করা তরকারী পাঠালেন. সেই বেগুন ভাজির স্বাদ আমি জীবনে ভুলিনি, ভুলবোও না. খেয়েদেয়ে সবাই শুয়ে পড়ল. সন্ধ্যায় ম্যানেজার সাহেব এসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলেন. পরদিন জানা গেল সেদিনই হাটের দিন - বাংলার গ্রামগঞ্জে সপ্তাহে একদিন যে বাজার বসে. কিছু কেনাকাটার দরকার ছিল. গ্রামের একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে আমি আর আঙ্কেল রওনা হলাম হাটের দিকে. পথে পড়ল সেই রিফিউজি ক্যাম্প যাতে ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার আমাদের থাকতে বলেছিলেন. ক্যাম্পের পঞ্চাশ গজ দুরে থাকতেই আমাদের নাকে রুমাল চাপা দিতে হল ক্যাম্পের দুর্গন্ধ সামলাতে. ক্যাম্পটা ছিল একটা স্কুলের দালানে - ঘোড়ার আস্তাবলের চেয়েও তার অবস্থা খারাপ. এর দুর্দশা বর্ণনা করতে নুতন শব্দ লাগবে.
কিছু লোক কামরার ভেতরে থাকত, বাকিদের জায়গা বারান্দায়. ওই অতটুকু জায়গার ভেতরেই তাদের জীবনযাপন. তারা ওখানেই খায়, বসে, শোয়. তাদের কিছু বাচ্চারা ওখানেই পায়খানা করে. সেটা আমাদের চোখে পড়ল যখন আমরা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেগুলোর ওপরে, সবার শরীরের ওপরে এবং খাবারের ওপরে ভনভন করছিল শত শত মাছি. জীবনে আমি মানুষের এত শোচনীয় দুর্দশা দেখিনি. হাটে পৌঁছে আমরা কিনলাম চাল, ডাল, শাকসব্জী আর অন্যান্য দরকারী জিনিসপত্র. গরুর মাংস তো দুরের কথা হাটে কোনো রকমেরই মাংস ছিল না. তাই কিছু ডিম কিনে আমরা ফিরলাম. আজ খিচুড়ীর সাথে কিছু শাকসব্জী যোগ হল. খাবার পর সবাই একটু গা' এলিয়ে দিল - সন্ধ্যায় আমি আর বাদল গেলাম চায়ের দোকানে .
বড্ড বেঁচে গেছি !
ঘোষের চায়ের দোকানে যেতেই কানে এল বেশ কিছু লোকের উচ্চকন্ঠে রাজনীতির তোলকালাম. কিন্তু নজর কাড়ল একটু দুরে শান্তভাবে বসে যে লোকটা চা খাচ্ছে সে. আমি সেখানে যেতেই সে কেন যেন আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল. খুব অস্বস্তি লাগল আমার - কিন্তু তক্ষুনি বুঝে গেলাম সে একটা স্পাই, সম্ভবত: ভারতীয় আর্মীর. আমার প্রতি সন্দেহ তার চাউনিতে স্পষ্ট ঠিকরে বেরোচ্ছে. আমি তখন যেন কিচ্ছু হয়নি এমন একটা ভাব করছি আর আমাকে নিয়ে লোকটা কি ভাবছে তা আঁচ করার চেষ্টা করছি. লোকটা আমাকে নিরীক্ষণ করছে তার মানেই হল আমি ধরা পড়ে গেছি. সেটা বুঝতে পেরে বাদলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল. আতংকের একটা ছোট্ট ঢেউ যেন শিরশির করে আমার মেরুদণ্ড দিয়েও বয়ে গেল. কিন্তু ভারতের মাটিতে পা দেবার পর থেকেই যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমি মানসিকভাবে তৈরীই ছিলাম. এটার জন্যও রেডি হয়ে গেলাম - সেকেণ্ডের মধ্যে প্ল্যান করে ফেললাম. ওকে অগ্রাহ্য করে হৈ হৈ করে লাফ দিয়ে পড়লাম রাজনীতির আলোচনায়. সর্বশক্তি দিয়ে কাজে লাগলাম যা কিছু বাংলা জানতাম - যেন আমি এক অতি উত্সাহী বাংলাদেশ-পন্থী. মুহুর্তের মধ্যেই আসরের একেবারে মধ্যমণি হয়ে গেলাম আমি !! গলাবাজীটা এমনই উচ্চকন্ঠে করতে লাগলাম যে সবাই একেবারে অভিভূত হয়ে গেল. লোকটা একটু দ্বিধাম্বিত হল কিন্তু তবু ত্যারছা চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করতেই লাগল. সেটারই পুরো সুযোগ নিয়ে আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে ক্ষিপ্রগতিতে তার দিকে ঘুরে তাকে টেনে আনলাম আলোচনায়. এতে ওর চোখে সন্দেহের যে লেশটুকু ছিল তাও উবে গেল. আমি যা-ই বললাম সে শুধু হুঁ হাঁ করে গেল - তারপর চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চলে গেল.
চা খেয়ে বাদলের সাথে রওনা হয়ে দেখি লোকটা হেঁটে হেঁটে সোজা আর্মী ক্যাম্পের দিকেই যাচ্ছে. আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম - আমার ট্রিক কাজে লেগেছে নতুবা এই মুহুর্তে আমাকে ওর সাথে হেঁটে হেঁটে ওই ক্যাম্পে যেতে হত. তড়িঘড়ি বাড়ীর দিকে ছুটলাম আমরা, বাদলের চোখমুখ তখনও ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আছে. সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই - আমাকে আস্তে করে বলল - "শাহিদ ভাই, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ আমরা মরণ থেকে বেঁচে গেছি. আমার তো মনে হচ্ছিল আজ আমরা ধরাই পড়ে গেছি". আমি খুব জোরে জোরে অট্টহাসি হাসলাম - আসলে কিন্তু সেটা ছিল শরীর মনের আতংকটা তাড়ানোর জন্য. তাড়াতাড়ি হেঁটে আমরা বাসায় এলাম - বাদলকে মানা করার সত্বেও সে সবাইকে ঘটনাটা বিস্তারিত বলে দিল. বোধহয় এতে ওর শরীর-মনে বসে যাওয়া ভয়টা কেটে গেল. সবাই আমাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল, আমাকে আর কখনো বাইরে যেতে নিষেধ করল. কিন্তু পরিস্থিতিটা এমনই মোড় নিল যে হওয়ায় উড়ে গেল সে নিষেধ . কারণ ঠিক পরের দিনই আমি ল্যাট্রিনে গিয়ে দেখি বৃষ্টি সেটাকে ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেলেছে.
আবার সেই খাদ্য-ব্যবসায়ীর কাছে
ফিরে এসে বাদল, মন্নু আর ইমদাদের সাথে পরামর্শ করে আমরা চারজন সেই খাদ্য-ব্যবসায়ীর দোকানে গেলাম. সেখানে ছিল ফ্লাশ লাগানো টয়লেট. অনুমতি নিয়ে আমরা তা ব্যবহার করলাম আর রেডিও সিলোনে হিন্দী গান শুনলাম ও কিছু গল্পগুজব করলাম. ওখানে জুন্নুও ছিল, তার কাছে জানতে চাইলাম পাকিস্তানী আর্মীর সাথে যুদ্ধের হাল হকিকত. সে বলল একটু আগেই তিন ট্রাক বোঝাই করে বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স রওনা হয়েছে সারদা আক্রমণ করতে. এর পরেই সে হঠাৎ রেগে গিয়ে বলা শুরু করল - "তোমরা কোনোই কাজের না. তোমাদেরকে লোকদেরকে অজস্র হ্যান্ড গ্রেনেড আর টিনভর্তি পেট্রল দেয়া হয়েছিল আর তারা সেগুলো পাকিস্তানী আর্মীর কাছে খুইয়ে এসেছে".
এরপরেই কথা ঘুরে গেল নক্সালপন্থী অর্থাৎ বামপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবীদের দিকে. ওরা আসলে কারা? জুন্নুকে জিগ্গেস করলাম - ওরা সরকারকে এতই সন্ত্রস্ত করে রেখেছে যে পুলিশ পর্য্যন্ত রাইফেল তাদের বেল্টের সাথে বেঁধে রাখে, ওরা কি এতই শক্তিশালী? জুন্নু বলল :- "নক্সালপন্থীরা এমন কেউকেটা কিছু না, ওদের বেশীরভাগই ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্র মাত্র. শক্তিশালী বোমা বানাতে ওরা ওস্তাদ. আসলে যে বোমাগুলো আমরা মুক্তিবাহীনিকে দিয়েছি সেগুলো ওই নক্সালপন্থীদের কাছ থেকেই উদ্ধার করা".
হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে জুন্নু চিৎকার করে উঠল - "মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন!". রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি মুখ্যমন্ত্রী তো দুরের কথা কোনই মন্ত্রীর নাম নিশানা নেই. না কোনো গাড়ীর বহর, না কোনো সাইরেন, হট্টগোল বা লোকজনের ভীড়. শুধু ধুতি আর ভারতীয় পোশাক পরা মোটাসোটা একটা লোক ভারতে তৈরী অতি সাধারণ গাড়ী থেকে নামলেন. তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন সবকিছু, লোকজনের সাথে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন. শুনলাম তিনিই পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিং নেহার. তাঁর এ হেন সাদাসিধে চলন বলন দেখে আমার ঘাড়ত্যাড়া নাক উঁচু পাকিস্তানী মন্ত্রীদের কথা মনে হল. পাকিস্তানে মাঝে মাঝে একটু যখন গণতন্ত্র ফিরে আসে তখন মন্ত্রীটন্ত্রীদের দেখা যায় - নতুবা শুধুই তো সামরিক শাসন. যাহোক, চারদিক দেখেশুনে এক সময় তিনি চলে গেলেন, ততক্ষণে আমাদের বাথরুম ব্যবহারও শেষ হয়েছে.
আবার ঘোষের চায়ের দোকানে
গতকালের অশনি সংকেত উপেক্ষা করে আজ আবার ঘোষের চায়ের দোকানে যাওয়াটা আমাদের চরম বোকামী হতে পারত. দোকানের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ী - পুলিশ টহল দিচ্ছে এদিক ওদিক আর দুজন পুলিশ দোকানে বসে চা খাচ্ছে. নক্সালাইটরা যাতে সুযোগমত হঠাত হামলা করে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য রাইফেলগুলো ওদের কোমরে ইস্পাতের শেকল দিয়ে বাঁধা. আমরা চা খেয়ে ওই ওদিকে গেলাম যেখান থেকে স্পষ্টভাবে রাজশাহী দেখা যায়. শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে এখনো সাদা ধোঁয়ার কুন্ডুলী উঠে পুরো আকাশটা একেবারে ছেয়ে রেখেছে. কেউ একজন বলল একটা কুন্ডুলী জ্বলন্ত চিনির মিল থেকে উঠছে. কিন্তু চিনির মিল কে পোড়াবে কেনই বা পোড়াবে ভেবে পেলাম না. ওটা নিশ্চয় অন্য কিছুর হবে. ফিরে এলাম খুব মন খারাপ নিয়ে. বাদল বহরমপুর চলে গেল কালাম সাহেবের খোঁজখবর নিতে, খায়রুও মালদহ চলে গেছে বন্ধুদের কাছে. যাবার আগে সে বলে গেছে ইপিআর এখনো নবাবগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করছে - কিন্তু সেটা ঠিক বলে মনে হল না. খায়রু নবাবগঞ্জে একটা ব্যাংকে চাকরী করে. কালাম সাহেব একদিন তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন ব্যাংকের টাকাগুলো লুট হয়ে যেতে পারে - খায়রু সেখান থেকে বিশ ত্রিশ হাজার টাকা লুটে কিছুদিন ফুর্তি করলেই তো পারে. পোকাটা সেই থেকে খায়রুর মাথায় নড়াচড়া করছিল. সন্ধ্যায় দেখা হল একজনের সাথে যিনি তখনি রাজশাহী থেকে এসেছেন. তিনি বললেন একশ' বিশটা ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানী আর্মী আজ নবাবগঞ্জের দিকে রওনা হয়েছে. পরদিন শুনলাম তারা নবাবগঞ্জ দখল করেছে.
যাবো কি যাবো না......
রাজশাহী থেকে কিছু লোক এসেছে যারা এতদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল. তারা বলল পাকিস্তানী আর্মী গোলাগুলি বন্ধ করেছে কিন্তু সন্দেহজনক লোকজনদের গ্রেপ্তার করছে যাদের বেশীরভাগই তরুণ. লোকজনও রাজশাহীতে ফেরা শুরু করেছে কিন্তু আর্মিকে এড়িয়ে চলছে. রাজশাহী রেডিওটাও একদিন চালু হল. বলা হল শহরে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, লোকজন যেন ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা শুরু করে. বাংলা, ইংরেজী আর উর্দুতে এ ঘোষণা করা হচ্ছে. বলার ভঙ্গীটা একেবারে সেনাসুলভ, খুবই বাজে. স্বাভাবিক জীবন যাত্রা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, ওটা কি হুকুম দেবার মত কিছু? এ ঘোষণায় লাভের লাভ কিছুই হলনা, শুধু আমাদের মেজবান ম্যানেজার একজনকে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দিলেন খবরটার সত্যতা যাচাই করতে. সারাদিন আমরা চতোকের মত উন্মুখ হয়ে তার অপেক্ষায় থাকলাম - অবশেষে সে ফিরে এল. সে জানাল যুদ্ধের ভয়ে যারা গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিল তারা ফিরে আসছে, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না. রাস্তায় লোকজন বিশেষ নেই, তাও শুধুমাত্র দিনের বেলায় কারণ রাতে থাকে কারফিউ. সে এটাও জানাল তরুণ-যুবকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে. শুনে আঙ্কেল আর মতিন সাহেব মহা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন. মতিন সাহেবের স্ত্রী স্পষ্ট করেই বলে দিলেন তিনি ফিরে যাবেন না কারণ তাঁর ছেলের কিছু হলে সেটা তাঁর জন্য জীবন্ত কবর হবে. এর মধ্যে বাদল বহরমপুর থেকে ফিরেছে. সে, ইমদাদ আর মন্নুও ফিরে যেতে রাজী নয়.
বাদল জানাল কালাম সাহেব আর শরীফ সাহেব বহরমপুরে একটা বাসা ভাড়া করে একসাথে আছেন. তাঁরা চান আমরা সবাই ওখানে গিয়ে থাকি কারণ ফিরে গেলে আবার মুক্তিবাহীনির ক্রোধের শিকার হতে হয় কিনা.
শুনে মতিন সাহেব চুপ করে রইলেন. কালাম সাহেবের এক আত্মীয় কলকাতায় মস্তবড় সরকারী চাকরী করেন, অভিজাত এলাকায় তাঁর বিশাল বাড়ী. বাদল বলেছিল তাঁর পরিবার তো ওখানে গিয়ে থাকতে পারে. মতিন সাহেব এতে রাজী নন. তাঁর মতে এই বয়সে আত্মীয়ের কাছে হাত পাতাটা খুব একটা লজ্জার ব্যাপার. বাদলকে তিনি শান্তভাবে বুঝিয়ে বললেন - "তা ছাড়া কতদিনই বা ওভাবে থাকা যায়? তুমি এখনো ছোট, সম্পর্কের এই সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলো তুমি বুঝবে না".
তাঁর জোয়ান ছেলেদের নিয়ে আঙ্কেল খুব দুশ্চিন্তায় আছেন. সবাই আমার দিকে প্রশ্নের চোখে তাকাচ্ছে. আমি কথা দিলাম যে তাঁদের ছেলেদের রক্ষা করার জন্য আমি সবকিছু করব. কিন্তু তাঁরা আমার চেয়ে বয়সেও বড়, অভিজ্ঞতাতেও. তাই তাঁরা আমার চেয়ে ভালো বুঝবেন এটাই স্বাভাবিক. আমি এটাও বললাম যে আমার জন্য তাঁদের ছেলেদের জীবনকে বিপদে ঠেলে দেয়াটা ঠিক হবেনা মোটেই -কারণ আমি সীমান্ত পার হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারব. সেটা যদি অসম্ভব হয়ও তবু শেষমেষ আমি ভারতে পাকিস্তানী দুতাবাসে তো আশ্রয় নিতে পারব.
এবারে সবাই খুব গভীরভাবে ভাবতে শুরু করল. চারদিক তখন সুমসাম - নিস্তব্ধ নীরব. কিছুক্ষণ পরে আঙ্কেল তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন পাকিস্তানে ফিরে যাবার, তাতে পাকিস্তানী আর্মীর গুলী খেয়ে মরতে হয় তবুও. তাঁকে খুব আবেগাপ্লুত দেখাচ্ছিল. তিনি বললেন ভারতে আসার পর থেকেই একটা কথা তাঁর মনে কাঁটার মত বিঁধে আছে. তিনি বললেন - "তোমাদের এখনো বোঝার বয়স হয়নি. অতীতের কথা কিছুই জান না তোমরা. লজ্জা আর অপমান ছাড়া এখানে আমাদের জন্য আর কিছুই নেই. পানির চেয়ে রক্ত অনেক ভারী. আমি আমার দেশে ফিরে যাব তাতে যা হয় হোক. এটাই আমার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত".
আঙ্কেলের সিদ্ধান্ত ছেলেদের পছন্দ হয়নি তা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল. শুধু মতিন সাহেবের নির্বাক চোখেমুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই. সভা ভঙ্গ হল. বাদল তার মায়ের কানে কানে কি যেন বলল তারপর বহরমপুর যাবার জন্য তৈরী হল. আমি ঠিকই বুঝলাম ওখানে সে কালাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করবে. কিন্তু মুখে সে বলছে তার স্যান্ডেল ক্ষয়ে গেছে, সে যাচ্ছে নূতন একটা কেনার জন্য. ইমদাদও তার সাথে চলে গেল. এর মধ্যে ম্যানেজার এসে হাজির. তিনি পাকিস্তানে ফিরে যাবার খুবই পক্ষে. রাজশাহীতে তাঁর শ্বশুরবাড়ী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিন্তু নিজের বাড়ীটা অক্ষতই আছে. তিনি খুব বড় গলায় বললেন - "রিফিউজি ক্যাম্পের অবস্থা খুবই খারাপ, এমনকি ওখানে খাবারেরও টানাটানি. টয়লেট-বাথরুমের অবস্থা তো আরো জঘন্য - যে কোনো সময় কলেরার মহামারী লেগে যেতে পারে. কয়েকজনের এর মধ্যেই কলেরা হয়েছে. ওদিকে দিনকে দিন খাবারে দামও বেড়ে চলেছে. তাছাড়া একটা সুসংগঠিত শক্তিশালী আর্মীর বিরুদ্ধে ইপিআর লড়াই করেছে উশৃঙ্খল দাঙ্গাবাজদের মত. নিজেদের শক্তিকে ইপিআর খুব বড় করে দেখেছে আর বড্ড হামবড়া গর্ব করেছে যে পৃথিবীর কোন শক্তিই তাদের হারাতে পারবে না. কিন্তু তারা পাকিস্তানী আর্মীর সামনে টিকতেই পারেনি".
লোকটার এসব আবোলতাবোল কথাবার্তা শুনে আঙ্কেল বিরক্ত তা তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট. আর মতিন সাহেব সবসময়ের মতই কাঠের মূর্তির মত নির্বিকার, ভাবলেশহীন. বাদল বলল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ভারতের কোনই দরদ নেই, ভারত শুধু নিজের স্বার্থ দেখছে. তার উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা. কিছু কিছু ইপিআর মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে, সবাই তার নিন্দা করল. আরেকটা লোক এসে ম্যানেজারকে ডেকে নিয়ে গেল আর আমিও বাড়ীর বাইরে এলাম.
নক্সালাইট !
কাছেই একটা মাঠে বাচ্চারা আবহমান গ্রাম বাংলার খেলা "পিঠু গরম" খেলছে. আমাকে ওরা খেলতে ডাকল, আমিও ওদের সাথে খেলতে শুরু করলাম. সবসময় ভয় আর উদ্বেগভরা মনকে একটু হালকা করার এ এক মোক্ষম উপায়. বাচ্চারা তো আমাকে পেয়ে মহা খুশী. খেলাশেষে হাতমুখ ধোবার জন্য এক টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে দেখি পাশের নীচু দেয়ালটার ওপরে লাল একটা ডায়েরী রাখা, কে যেন ভুলে ফেলে রেখে গেছে. কেন যেন মনে হল ডায়েরীটা খুব রহস্যময়. মনে অদম্য কৌতুহলের চাপ. ত্যারছা চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই. আলতো করে তুলে নিলাম ওটা. পড়ে দেখি ওটা একটা নক্সালপন্থীর ডায়েরী. ওতে মোটামুটি এরকম লেখা আছে:- ১২ই জানুয়ারী - কমরেড হরি সিং-এর সাথে মিটিং...........১৫ই জানুয়ারী- অন্য কমরেডদের উপস্থিতিতে প্ল্যান চূড়ান্ত করা হল.......... ৩০শে জানুয়ারী - প্ল্যান ব্যর্থ হল.... ইত্যাদি. অনেক কিছু ঠিক বোঝা গেল না, ওগুলো ইচ্ছে করে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে বা সাংকেতিকভাবে লেখা হয়েছে. দুয়েকটা টেলিফোন নম্বরও ছিল. যে ফেলে গেছে তার জন্য ডায়েরীটা নিশ্চয়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ. ওটা পকেটে রেখে সবেমাত্র টিউবওয়েলের হাতলে চাপ দিয়েছি তখনই উনিশ-বিশ বছরের এক সুদর্শন তরুণ এসে হাজির.
সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরা ছেলেটাকে মনে হল ছাত্র. সে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল - জিজ্ঞাসা করল আমি কোন ডায়েরী দেখেছি কি না. তাকে কিছু প্রশ্ন করতে যাব তার আগেই সে আমাকে হতভম্ভ করে দিল. আমার পকেট থেকে ডায়েরীটা উঁকি দিচ্ছিল, সেটা দেখতে পেয়ে সে চোখের পলকে তড়িৎগতিতে সেটা হস্তগত করল. ভেবেছিলাম ডায়েরীটা মাঝবয়েসী, শক্তিশালী ও হিংস্রমুখী কোনো লোকের হবে, এখন দেখি মোটেই তা নয় ! সে নক্সালপন্থী তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু নক্সালদের যে ভয়াবহ বর্ণনা জুন্নু দিয়েছিল তার সাথে এর কোনই মিল নেই. যাহোক, ছেলেটা তীর গতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল - যাবার আগে অবশ্য ভদ্রভাবে আমাকে ধন্যবাদ দিতে ভোলেনি.
খায়রু'র ব্যাংক-যাত্রা !
বাড়ীর দিকে না গিয়ে ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটা দিলাম ক্ষেতের দিকে. দুনিয়ায় যে কোনো দেশে গ্রামের লোকেরা মোটামুটি একই রকম. সরলতা আর বিশুদ্ধ বাতাস তাদের নিত্যসঙ্গী. ক্ষেতে এক চাষী নিবিষ্টমনে লাঙ্গল দেয়া জমি সমান করছে, দুনিয়ায় কোথায় কি ঘটছে সেদিকে তার কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই. দেখে আমার হিংসাই হল. ম্যানাজারের বাসায় গিয়ে দেখি খায়রু সেখানে উপস্থিত. সে পরিচয় করিয়ে দিল রাজশাহীর কি একটা কলেজের ছাত্র সংসদের সদস্যের সাথে. খায়রু জানাল মুক্তিযোদ্ধারা নবাবগঞ্জ থেকে সরে গেছে আর এই ছেলেটা কোনরকমে পালাতে পেরেছে. সে বলল আর্মী যাতে নবাবগঞ্জে না পৌঁছাতে পারে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধার ছোট্ট একটা খালের ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু আর্মীর ট্রাক খালের ভেতর দিয়েই ড্রাইভ করে পার হয়েছে. এ খবরে জনগণ আতংকিত হয়ে পালাতে শুরু করেছে. কালাম সাহেব যে ঠাট্টা করে বলেছিলেন খায়রু ব্যাংক লুটে কিছুদিন ফুর্তিটুর্তি করলেই পারে সে পোকাটা খায়রুর মাথা থেকে তখনও যায়নি. সেই মতলবে সে রওনা দিল ব্যাংকের দিকে. কিন্তু ব্যাংকে যাদের টাকা গচ্ছিত ছিল তারা বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে, কাউকে ব্যাংকের ধরে কাছে আসতে দিচ্ছে না. অন্যান্য কিছু জায়গা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেখানে ব্যাংকের তিরিশ চল্লিশ কোটি টাকা লুট হয়েছে. ভারতের সরকার ব্যাংকগুলোকে পাকিস্তানী টাকা জমা নেবার অনুমতি দিয়েছে, মানুষ বস্তাভর্তি টাকা ভারতে এনে ব্যাংকে জমা দিচ্ছে.
যারা রাজশাহী থেকে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে পালিয়ে নবাবগঞ্জে এসেছিল, আর্মী এখানেও আসার জন্য তারা এখন ওই বাক্স প্যাঁটরা নিয়েই সীমান্ত পার হয়ে মালদহে আসছে. সবচেয়ে বড় খবর হল, যে ADCG-কে মুক্তিবাহীনি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য গ্রেপ্তার করেছিল তাকে গুলী করে মেরে ফেলা হয়েছে. ডেপুটি কমিশনারকে অবশ্য বহরমপুরে আনা হয়েছে. কুষ্টিয়া এখনো মুক্তিবাহীনির দখলে এবং চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছে. কুষ্টিয়া-কলকাতা যোগাযোগের রেলপথ এতদিন চালু ছিলনা, ওটাকে মেরামত করে চালু করা হয়েছে. সিলেটও এখনো মুক্তিবাহীনির দখলে, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী সেখানে ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন. ভারত শিগগিরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে. এ কদিন খায়রু আমাদের সাথে ছিলনা, এর মধ্যে সে এসব খবর জোগাড় করেছে.
পরদিন একটা আম গাছের নীচ তোষক বিছিয়ে আমি বাদল আর খায়রু গল্প করছি. বাদল ফিরে এসেছে বহরমপুর থেকে নুতন স্যান্ডেল কিনে, খায়রুও আছে খুব মুডে. মহা উৎসাহের সাথে সে বলছে কিভাবে সে নবাবগঞ্জ থেকে পালাল. হঠাৎ করে তার মুখ দিয়ে অবাঙ্গালীদের প্রতি খুব ঘৃণাভরা একটা কথা বেরিয়ে এল. সে বলল কোন বিহারী বা পাঞ্জাবীর চেহারা দেখার চেয়ে সে পায়খানা দেখা বেশী পছন্দ করবে. একথায় বাদল খুব অস্বস্তি বোধ করল, সে মাফ চাইবার ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকাল. আমি শুধু খুব স্বাভাবিকভাবে উচ্চকন্ঠে অট্টহাসি হাসতে থাকলাম. এতে খায়রু অবাক হয়ে গেল. কিন্তু সে কিছু বলার
আগেই আমি তার পালানোর গল্পে চলে গেলাম. খায়রুও আবার সে কাহিনী বলা শুরু করল.
খালি হচ্ছে রিফিউজি ক্যাম্প
এদিকে ম্যানাজের সাহেব আরেকজনকে রাজশাহী পাঠালেন খবর আনার জন্য. সে ফিরে এসে যা বলল তা আগের খবরের মতই - নুতন কিছু ঘটেনি. সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি এমন সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা কয়েকজন হিন্দু এল. ওদের একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমার বাড়ী কোথায়. বললাম আমার বাড়ী সিলেটে. সে কয়েক মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে তারপরে বলল তার কষ্টের কাহিনী. তার বাড়ীঘর সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এখন সে সর্বহারা রিফিউজি. তার এখন ফিরে যাবারও উপায় নেই কারণ সেখানে তার আর কিছুই নেই. ওখানে আরেকজন হিন্দু ছিল যে অনেক আগে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় সর্বহারা হয়ে এসেছিল - সে মুসলমানদের খুব দুর্নাম করতে লাগল. আমি তাড়াতাড়ি চা শেষ করে হাঁটা দিলাম বাড়ীর দিকে. বাদল আর খায়রু আমার জন্য অপেক্ষা করছিল - ওরা আমাকে আর ইমদাদকে নিয়ে কলকাতা যেতে চায়. ওদের মতে এটা কলকাতা দেখার একটা মোক্ষম সুযোগ. আমি মনে মনে হাসলাম আর সবিনয়ে সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলাম, ইমদাদও তাই করল. ওরা মনক্ষুন্ন হলেও আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে বহরমপুর যাবার নাম করে চলে গেল কলকাতা.
বহরমপুরে কালাম সাহেবের সাথে কি কথা হয়েছে তা কিন্তু বাদল কাউকেই বলেনি. এরমধ্যে দেখা হয়ে গেল খালেক মাঝির সাথে. সে রাজশাহী ঘুরে এসেছে -পরিস্থিতি ভালোর দিকেই. হাট -বাজার বসা শুরু হয়েছে, রাস্তায় দুচারটা রিকসাও নজরে পড়ে. লোকজন অফিস আদালতে যাওয়া শুরু করেছে - সে নিজেও ফিরে যাবে শিগগিরই.
এ ধরনের খবরের ফল এই হল যে রিফিউজি ক্যাম্প থেকে কেউ কেউ ফিরে যাওয়া শুরু করল. যারা ফিরে গেল তারা ভালো আছে এ খবর রিফিউজি ক্যাম্প পৌঁছলে অন্যেরাও ফিরে যেতে উত্সাহিত হল. এ ধরনের ক্যাম্পে স্বভাবতই মানুষ খুব কষ্টে থাকে - তাই অনেককেই দেখা গেল প্রথম সুযোগেই ফিরে ফিরে যেতে. যারা ভারতের শহরে চলে গিয়েছিল তদের অনেকে সীমান্তের গ্রামে চলে এল ফিরে যাবার জন্য. রিফিউজি ক্যাম্পের ওপরে চাপ কিছুটা হলেও কমে এল.
পিন্টু'র গপ্পো !!
এ হেন পরিস্থিতিতে আঙ্কেলও সবাইকে সবকিছু গুছিয়ে রাজশাহীতে ফিরে যেতে চাপ দিলেন. কিন্তু একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউই এতে রাজী নয়. অজানা এক অশুভ আতংক সবাইকে তাড়া করে ফিরছে. ফিরে যাওয়াটা প্রতিদিনই বাতিল হচ্ছে. এর মধ্যে বাদল আর খায়রুও ফিরেছে কলকাতা থেকে. আমি নিশ্চিত ছিলাম, কলকাতায় শুধু কলকাতা দেখা ছাড়াও কোনো একটা বিশেষ উদ্দেশ্যেই ওরা সেখানে গিয়েছিল. সেটা কি তা অবশ্য আমার জানা ছিল না. ওরা দুজনই ফিরে যাবার প্রচণ্ড বিপক্ষে. ওরা কলকাতা থাকার সময় আমি ম্যানেজারের ছোট ভাই পিন্টুর ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি. পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ভারতের সাহায্য চায় এটাতে তার ঘোর আপত্তি. তার কথায় - "আমরাই এখানে কখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি. আপনারা কি করে ভাবলেন এখানে আপনাদের সাহায্যকারী আছে? প্রত্যেক পদক্ষেপে আমাদের বিরুদ্ধে ওদের মনোভাবের সম্মুখীন হতে হয় আমাদেরকে. আপনি এ থেকেই বুঝবেন আমরা, বিশেষ করে ভ্রমণের সময় আমাদের আসল নামে না ডেকে হিন্দু নামে ডাকি যাতে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়. ভোটের সময় আমরা ভারতের মুসলিম লীগকে ভোট দেই - তাতে আমাদেরকে যে কত রকম ঠাট্টা তামাসা পোহাতে হয় ! ওদের প্রতি আমাদের বিতৃষ্ণা এতই বেশী যে ১৯৬৫ এ ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে যখন আমাদেরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রাইফেলের ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পাকিস্তানী আর্মী যদি এখান পর্য্যন্ত পৌঁছাতে পারে তাহলে আমরা এইসব রাইফেল ওদের দিয়ে দেব যাতে এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়. আমরা পাকিস্তানকে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসি. পাকিস্তান না থাকলে ভারতবর্ষ থেকে মুসলমানেরা উচ্ছেদ হয়ে যেত". পিন্টু আরো বলল পশ্চিম বাংলার একজন মুসলমানও বাংলাদেশ সমর্থন করে না. বলল - "এখানকার হিন্দুরা ভারতের অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশী মুসলিম-বিদ্বেষী. যখন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা এখানে এসে তাদের ওপরে অত্যাচারের কথা বলে তখন এরা আরো ক্ষেপে যায়. এখানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাও ঘটে যেতে পারে. হিন্দু ঘাতকেরা এর মধ্যেই তাদের ছুরি শানিয়ে রেখেছে, যদিও সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে সেরকম কিছু না ঘটে".
ইথার-প্রেম !
কলকাতা রেডিও যেভাবে গত বছরগুলো ধরে পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থনে প্রচার করে চলেছে তাতে মনেই হতে পারে পশ্চিম বাংলার জনগণ পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে. গত তিন মাসে কলকাতা রেডিও এটা যেভাবে করেছে তাতে কলকাতার প্রতিও আকর্ষণ বাড়ার কথা. কাজেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে এখানে এলেই এরা গলায় মালা দিয়ে প্রেম-প্রীতি ভালবাসার বন্যা বইয়ে দেবে. কিন্তু বাস্তবে যা ঘটে তাতে হতাশই হতে হয়. আমি যতদিন ছিলাম কোনো হিন্দুকেই মুসলমানের সাথে খুশীমনে কথা বলতে দেখিনি, বরং মুসলমান দেখলেই ওদের ভুরু কুঁচকে যেতে দেখেছি.
রাজশাহী ফেরার আগের দিন আমি আর ইমদাদ গেলাম বহরমপুরে. আঙ্কেল আমাকে যেতে দিলেন কিন্তু খুব সাবধান থাকতে বললেন. বাস স্ত্যান্দ ব এস দুরে, আমরা ভোরে কিছুটা পায়ে হেঁটে কিছুটা রিকসায় চড়ে সেখানে গেলাম. যে রিকসায় গেলাম তাতে রাজশাহীর লাইসেন্স প্লেট লাগানো দেখে তো আমরা অবাক. রিকসা চালককে জিজ্ঞাসা করতে সে জানাল সে রাজশাহীর লোক, রিকসা নিয়েই এখানে এসেছে আবার সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে এটা ফেরত নিয়ে যাবে. এখানে তার আয় বেশী নয় - দিন গুজরান করতে তার বেশ কষ্টই হচ্ছে. বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে একটা চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসলাম আমরা. সেখানে এক উদ্ধতস্বভাব হিন্দু এক রিফিউজীর সাথে কথা বলছিল. আমরাও রিফিউজি, তাই সেই রিফিউজি লোকটা আমাদেরকে তার কষ্টের কাহিনী বলা শুরু করল.
সেই হিন্দু লোকটা আমাদের দিকে ফিরে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল, তার চোখেমুখে স্পষ্ট সন্দেহ. সে
হঠাত করে আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমার বাড়ী কোথায়. এ হেন আকস্মিক আক্রমণের জন্য আমি তৈরী ছিলাম না, - ইমদাদের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও একটু হতভম্ভ. আমি মনে মনে নিজেকে সংহত করে নিলাম -তারপর তাকে হেসে বললাম আমার বাড়ী সিলেট. তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে সে পরের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল - "তাহলে এখানে কি করছেন"? বললাম আমার চাচার সাথে দেখা করতে রাজশাহী এসেছিলাম. লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করল - "আপনার চাচা কি করেন?" মনে হল সে বড়ই নাছোড়বান্দা কিন্তু ভাগ্যক্রমে ঠিক তখনি বাস এল আর আমরা হুড়োহুড়ি করে তাতে উঠে পড়লাম. লোকটা বড্ড ব্যাজার মুখে তাকিয়েই থাকল.
বহরমপুর
বড্ড পুরোন বাস, - পাকিস্তানের গ্রামগঞ্জে এরকম বাস চলে. বাসভর্তি মানুষ, কোনমতে একটু দাঁড়াবার জায়গা করে নিয়েছি. সারাটা পথ নির্বিঘ্নে কাটল - আমি মাথা নীচু করে জানালা দিয়ে দেখে নিচ্ছি বাইরেটা. মাঝে মাঝেই বসতি, বাসটা সেখানে থেমে লোক তোলানামা করছে. মাইল পাঁচেক যাবার পর দেখি একটা
দালানের চারপাশে আর্মী ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছে. চারপাশে কিছু তাঁবু আর সারিবাঁধা ট্রাক. প্রায় প্রতি পাঁচ মাইল পরে পরেই এরকম, কোথাও আবার ভলিবল খেলার চমত্কার ব্যবস্থা আছে. চলছে বাস - কেউ কেউ আমাদেরকে অনুসন্ধিত্সু চোখে দেখে পরক্ষণেই আবার উদাস হয়ে যাচ্ছে. পথে পড়ল একটা খাল - সেটাতে নৌকোর ওপরে বানানো ভাসমান সেতু - খাল পার হবার জন্য. কিন্তু সেটা এতই সরু যে একবারে মাত্র একটা গাড়ীই যেতে পারে. সেতুটায় বাস ওঠামাত্র সেটা ঝাঁকি খেয়ে হুড়মুড় করে এমনই নড়বড় করে উঠল যে মনে হল হয় ওটা ভেঙ্গে যাবে নয়ত বাসটা পিছলে খালে পড়ে যাবে. যাহোক, তেমন কিছু ঘটল না, ওপারে পৌঁছে সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস নিল. ঘন্টা তিনেক পর এল বহরমপুর শেষ ষ্টেশন, তার এধার থেকে ওধার পর্য্যন্ত সারিবাঁধা ছোট ছোট দোকান. চায়ের দোকানও আছে, আর আছে লম্বা বেঞ্চের সাথে লম্বা টেবিল সহ একটা খাবার রেস্টুরেন্টও যার দেয়ালগুলো রান্নার ধোঁয়ায় একেবারে কালো হয়ে গেছে. সেই কোন ভোরে সামান্য নাস্তা করেছিলাম - ক্ষিদেয় পেট চন চন করছে. কিন্তু অনেক হেঁটেও ভাল কোনো রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল না.
হিন্দু রেস্টুরেন্টে –
হাঁটার জন্য খিদেটা যেন আরো চাগিয়ে উঠল, তখন হঠাৎ একটা রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল. নাম ভুলে গেছি কিন্তু সাইনবোর্ডটাই বলে দিল ওটা হিন্দু রেস্টুরেন্ট, তীরের ছবি দিয়ে দিক নির্দেশ করা আছে. সেই মাফিক হেঁটে আমরা খুবই একটা চিপা গলিতে ঢুকলাম - গলির শেষে কাঠের সিঁড়ি লাগানো আছে দোতলায় যাবার, রেস্টুরেন্টটা ওখানে. সত্যি অবাক রেস্টুরেন্ট ! মস্ত এক প্রায়-অন্ধকার ঘর, তার মধ্যে দুটো লম্বা টেবিল আর টেবিলের সাথে লম্বা বেঞ্চি পাতা, ব্যাস !! ঢুকতেই কাউন্টার, ঘরের শেষ কোনায় রান্নাঘর. সারা ঘরে রান্নার এমনই ধোঁয়া যে দম প্রায় বন্ধ হবার জোগাড় আমাদের. ছাদে নোংরা একটা বাল্ব জ্বলছে. বেঞ্চিতে বসে কয়েকজন হিন্দু ভদলোক খাচ্ছেন, তাঁরা একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার খাবারে মন দিলেন. তাঁদের দেখে বেশ ভালোমানুষ মনে হল. আমরা বেঞ্চিতে বসলে নোংরা পোশাকের ওয়েটার ঘাড়ে একটা নোংরা টেবিল-মোছার কাপড় ঝুলিয়ে কাছে এল. গোস্ত খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু হিন্দু রেস্টুরেন্টে গোস্ত প্রায়ই থাকে না. কি আর করা -আমরা মাছের অর্ডার দিলাম. রেস্টুরেন্টের যা দশা সে হিসেবে দামটা কিন্তু বেশ চড়া. কাউন্টারে বসা যে লোকটাকে ম্যানেজার মনে হচ্ছিল তাকে সেটা বলতেই সে এমনই ক্ষেপে গেল যে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হল. মনে হল এখানে এসে আমরা জায়গাটা ভারী অপবিত্র করে ফেলেছি, আমাদের কাছ থেকে সে যা আয় করবে তার চেয়ে বেশী তাকে খরচ করতে হবে এটাকে ধুয়ে মুছে পবিত্র করতে.
কালাম সাহেব - বহরমপুরে
খাওয়া শেষ করে আমরা সোজা চলে গেলাম কালাম সাহেবের কাছে. কিন্তু তিনি বাসায় ছিলেন না. কষ্ট হল দেখে যে পনেরো জনের দুটি বিরাট পরিবার মাত্র দুটো ঘরে বাস করছে. সবার গায়ে জ্বর - কালাম সাহেবের মেয়ের তো কয়েকবারই বমি হয়েছে. গভীর হতাশায় সবারই চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে. শরীফ সাহেবের বাচ্চাটাও খুব অসুস্থ. বাজারে দুধ পাওয়া যাচ্ছেনা, তাই বাচ্চাটাকে পানির ভেতরে লজেন্স গুলিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে. তার মা'ও খুব অসুস্থ. চারদিন আগে শরীফ সাহেব কলকাতা গেছেন চাকরী খুঁজতে. কালাম সাহেব এলেন কিছুক্ষণ পর. কষ্টের একটা হাসি হাসলেন তিনি. ভয় পাচ্ছিলাম আমাদের পাকিস্তানে ফিরে যাবারসিদ্ধান্তে তিনি আবার বকাবকি শুরু না করেন, আমাদের যেতে নিষেধ না করেন.
যা ভেবেছিলাম তাই হল, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কথাটা তুললেন তিনি. যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন সবাইকে তাঁর কথা মানতে, তাঁর মতে ফিরে যাওয়া মানেই সাক্ষাত মৃত্যু. তিনি বললেন - "পাকিস্তানী আর্মীর হাত থেকে যদি বেঁচেও যাও, মুক্তিবাহীনির হাত থেকে কে তোমাদের বাঁচাবে? আর্মীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু যারা অফিস করা শুরু করবে তাদের খুন করা তো সহজ! এর মধ্যেই এরকম দুয়েকজনকে ওরা টার্গেট করেছে. আমার কথা বিশ্বাস না হলে এস, যারা এটা জানে আমি তাদের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি. রাজশাহীর কমিশনার এখানেই থাকে, তোমরা তার সাথে কথা বলতে পার. বিশ্বাস হচ্ছেনা আমার কথা? এস আমার সাথে". এই বলেই তিনি একটা রিকসা ডেকে মোটামুটি গায়ের জোরেই আমাদেরকে তাতে তুলে দিযে পাশে বসে পড়লেন. বিভিন্ন চোরাগলি পেরিয়ে একটা বড় রাস্তায় এসে দেখি শবমিছিল আসছে উল্টোদিক থেকে. দুই সারি বেঁধে হেঁটে আসছে মানুষ. বিষন্ন কন্ঠে তারা শ্লোগান দিচ্ছে "জয় সিপিএম". কৌতুহল হল, জিজ্ঞাসা করাতে একজন বলল ওদের এক নেতা খুন হয়েছেন - রাজনৈতিক হত্যা. এটা তাঁরই শবমিছিল.
রহস্যময় লোক
এক সময় কালাম সাহেব পুরনো এক অদ্ভুত দালানের সামনে রিকসা থামালেন. সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা দোতলায় পৌঁছলাম. ছোট্ট ছোট্ট অনেকগুলো কামরা সারি করে বানানো. বেশ কিছু কামরা পার হয়ে আমরা একটার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলাম. ভেতর থেকে কেউ একজন বলল ভেতরে যেতে - আমরা ঢুকলাম. পায়রার খোপের মত অসম্ভব ছোট ঘর, ঘুমোবার জন্য ছোট্ট একটা খাট. বহু পুরনো একটা চেয়ারে লম্বা চওড়া বিপুলদেহী এক ভদ্রলোক বসে আছেন. দেখেই মনে হল তিনি ব্যবসা করেন. কালাম সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন. তাঁর নাম ইদু সাহেব, তিনি সুপরিচিত কন্ট্রাকটার, মুক্তিযুদ্ধে তিনি অনেক টাকা দিয়েছেন এবং পরিবার পরিজন সহায় সম্পত্তি সব পেছনে ফেলে এখানে এসেছেন. তিনি ইদু সাহেবকে বললেন আমরা তাঁর বন্ধুর ছেলে আর ভাস্তে. তিনি খুব সতর্ক চোখে আমাদেরকে দেখছিলেন. তিনি বললেন যারা চাকরীতে ফিরে যাচ্ছে তাদের তালিকা বানানো হচ্ছে এবং তাদের জীবন নিরাপস নয়. তিনি এও বললেন যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে রাজশাহী আক্রমণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে. বাংলাদেশ সরকার শিক্ষিতদের চাকরী দিচ্ছে কাজেই আমাদের উচিত এখানে অপাতত কোনো একটা চাকরীর চেষ্টা করা. তিনি খুব নীচুস্বরে রহস্যময় ভঙ্গীতে কথা বলছিলেন.
ওখান থেকে বেরিয়ে কালাম সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনারের কাছে. তিনি বহরমপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাসায় থাকেন, পদটা পাকিস্তানের ডেপুটি কমিশনারের সমান. রিকসা সেখানে পৌঁছলে দেখা গেল তাঁরা দুজনে কোথায় যেন গেছেন. কালাম সাহেব বললেন যদি পাকিস্তানে যেতেই হয় তাহলে ডেপুটি কমিশনারের সাথেই যেতে - তিনি নিশ্চয় যাবার জন্য উদগ্রীব কারণ তাঁর পরিবার আগেই চলে গেছেন.
আবার কাতলামারী
সেখান থেকেই আমরা কালাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাতলামারী যাবার জন্য রিকসা করে বাস স্টেশনে যাবার পথে দেখি একটা জীপে উড়ছে বাংলাদেশের সবুজ পতাকা. ভারতীয় আর্মীর একটা কনভয়কে জায়গা দিতে রিকসাটাকে ফুটপাথে ওঠাতে হল. কনভয়টায় রাশিয়াতে বানানো অনেকগুলো শক্তিশালী ট্রাক ছিল, ওগুলো ছিল খালি আর ফিরছিল সীমান্ত থেকে. পরে আরেকটা কনভয় পার হল, সবগুলোরই ড্রাইভার ছিল শিখ. পথে বেশ কিছু খবরের কাগজ কিনেছিলাম, বাসের অপেক্ষায় সেগুলো পড়া গেল. প্রায় সবগুলোরই প্রথম পাতা পূর্ব পাকিস্তানের খবরে ভর্তি, ভেতরের পাতায় তার ওপরে অজস্র মন্তব্য. সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠিগুলো খুবই আকর্ষণীয়. প্রায় সবগুলোতেই ভারত সরকারের কঠিন সমালোচনা করা হয়েছে. একটা চিঠিতে বলা হয়েছে ভারতের সরকারের ওপরে নির্ভর করা পূর্ব পাকিস্তানীদের উচিত নয় কারণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মুরোদ ভারত সরকারের নেই. এক হিন্দু লেখক এটাও বলেছেন যে বাংলাদেশকে দুনিয়ার কোন সরকারই স্বীকৃতি দেবে না, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরী করা বা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটাও ভারতের নিদারুন বোকামী হবে.
সিদ্ধান্ত নেয়া হল
কাতলামারীর পথে বাসে সারাটা সময় ধরেই মাথায় ঘুরতে থাকল কালাম সাহেবের কথা. সত্যি বলতে কি তাঁর কিছু কথায় আঙ্কেল আর মতিন সাহেবের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমার ভয়ই লাগছিল (কারণ তাঁরা সরকারী চাকরী করেন - অনুবাদক). ডেপুটি কমিশনার রাশিদুল হাসানের কথাই ধরা যাক. তাঁকে গ্রেপ্তার করে এখানে আনা হয়েছে এবং সর্বদা খবরদারীতে রাখা হয়েছে. কাজেই তাঁর নিজের ইচ্ছায় ফিরে যাবার বা কোনো সিদ্ধান্ত নেবার উপায়ই নেই. যেহেতু তিনি স্বইচ্ছায় আসেন নি আর তাঁর পরিবার রয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তানেই, তাই প্রথম সুযোগেই তিনি ফিরে যাবার চেষ্টা করবেন. পরে আমার এ ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল, বহরমপুরের ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটকে ঠকিয়ে তিনি দেশে পালিয়েছিলেন. কিন্তু এখন আমি দ্বিধাগ্রস্ত, এতগুলো জীবনকে আমি বিপদে ফেলতে পারি না.
রাত হবার আগেই পৌঁছলাম কাতলামারী, আঙ্কেলকে খুলে বললাম সবকিছু. তিনি স্পষ্টই বললেন তাঁর ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত অটল, তাতে যে কোন বিপদই হোক না কেন. শুনলাম ক্যাপ্টেন জাগীর সিং নাকি এসেছিল আজ. সে কোত্থেকে শুনেছে আমরা ফিরে যাচ্ছি. কিন্তু কে তাকে বলল কথাটা? যাহোক আমরা তাকে কিছু বললাম না. আমি নিশ্চিত ছিলাম সে যদি জানে আমরা ফিরে যাচ্ছি তাহলে সে যে করেই হোক তাতে বাগড়া দেবে. এর মধ্যে পিন্টু ফিরে এল. সে বলল ঘোষের দোকানে চা খাবার সময় বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্সের কয়েকজনের সাথে তার প্রায় হাতাহাতি হবার জোগাড় হয়েছিল. সে বলল - "ওখানে কিছু রিফিউজি ছিল, রাজশাহীর স্বাভাবিক অবস্থার কথা বলে ওদের আমি ফিরে যেতে উত্সাহিত করছিলাম. এতে বর্ডার সিকিওরিটির একজন ক্ষেপে গিয়ে বলল আমি মানুষকে মরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, আমি নাকি পাকিস্তানের স্পাই. এ নিয়ে মারামারির অবস্থা হলে অন্যেরা তাদেরকে থামায়.
নীড়ে ফেরা
জিনিসপত্র সব বাঁধাছাঁধা হয়ে গেছে, ভোরে রওনা হবার কথা আমাদের. কিন্তু বেরোতে বেরোতে সকাল সাতটা হয়ে গেল. মেজবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে মনের আনন্দে পা বাড়ালাম প্রিয় মাতৃভুমীর দিকে. বাকস-প্যাঁটরা বইবার জন্য চৌধুরী সাহেব দুজন কুলীর ব্যবস্থা করেছিলেন. মনে তখন সে যে কি উত্তাল আনন্দ - কিন্তু তার পরেও একটু ভয় ভয় লাগছিল. পথে অনেক বাধা আসবে, বিশেষ করে সীমান্তে. বাচ্চা আর মায়েদের জন্য আমরা হাঁটছিলাম ধীরে ধীরে. তাছাড়া রাতে বৃষ্টি এসে কাদা করে দিয়েছিল অনেক জায়গায়. বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্সের নজর এড়াতে আমরা চালু রাস্তা না ধরে চলছিলাম মাঠ ঘাট ক্ষেত খামারের মধ্যে দিয়ে. মাইল খানেক যাবার পর দেখি একটা লোক পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে. সে জিজ্ঞাসা করল আমরা পাকিস্তানে যাচ্ছি কি না. আমরা হ্যাঁ বলতেই সে বলল ওখানকার অবস্থা ভাল নয়, আমাদের উচিত ওই মরণ ফাঁদে না গিয়ে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা. শুনে আমাদের গলা শুকিয়ে গেল. সীমান্ত তখনো মাইল পাঁচেক দুরে. আরো কিছুদুর হাঁটার পর আরেকজন লোক আমাদের বলল ওই একই কথা, রাজশাহীর অবস্থা সুবিধের নয়. আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম. যাই হোক আমরা থামলাম না, মন খারাপ হলেও চলতেই থাকলাম. মাইল তিনেক যাবার পর পড়ল একটা খাল. সেটা পার কেবল একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, দুজন গাঁট্টাগোঁট্টা লোক আমাদের দিকে এগিয়ে এল. তাদের ভঙ্গীটাই এমন ভীতকর ছিল যে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম. তারা আল্লাহ'র ওয়াস্তে আমাদের ফিরে যেতে বলল. রাজশাহী একেবারে দোজখ হয়ে গেছে, পাকিস্তানী আর্মী যাকেই সামনে পাচ্ছে গুলী করে মারছে আর বাসা থেকে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে. শুনে আতংকে ত্রাসে আমরা আধমরা হয়ে গেলাম. ফিরে যাবার কথা উঠল. ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল তার কাছে যে খবর এসেছিল তা ভুল হতেই পারে না - বরং এই দুজনকে মনে হচ্ছে ইন্ডিয়ান স্পাই. তাঁর কথাটা মনে ধরল আমার. বাকি সবাইকে মানিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা দিলাম আমরা. দেহেমনে তখন সবাই এতই ক্লান্ত যে প্রত্যেকে যেন নিজের শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে.
ভারত সীমান্তে....
সীমান্ত মাত্র মাইল খানেক দুরে, আমরা হেঁটে চলেছি অবিরাম ক্ষেত খামারের ভেতর দিয়ে. সবার পায়ের গোড়ালীর ওপর পর্য্যন্ত কাদা দিয়ে ঢাকা, কাঁটার আঘাতে পা ক্ষতবিক্ষত. হঠাত নজরে পড়ল বর্ডার সিকিওরিটির চেক পোষ্ট, বাঁদিকে মাত্র শ' খানেক গজ দুরে. মনে হল ওরাও আমাদের দেখতে পেয়েছে.
একজন সৈন্য উঁচু টাওয়ার থেকে নেমে আমাদের কাছে এসে বলল পোষ্টের সুবেদার আমাদেরকে ডেকেছে.
আঙ্কেল, ম্যানেজার, পিন্টু আর আমি তার সাথে গেলাম চেক পোষ্টে. সুবিশাল মোচ আর নিকষ কাল রঙের হিন্দু সুবেদার বেরিয়ে এল - বলল বাকি সবাইকে চেক পোষ্টে নিয়ে আসতে. আমরা হাত তুলে সবাইকে আসতে বললাম, তারা এল. ততক্ষণে বাকি সব সৈন্য আমাদের চারপাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে. কেউ কেউ কিছু বাজে মন্তব্যও করল. ক্রোধে আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল কিন্তু ধৈর্য্য ধরে থাকা ছাড়া কিই বা করতে পারতাম আমরা. বাক্স প্যাঁটরা পরীক্ষা করার নামে সুবেদার আমাদের উত্যক্ত করা শুরু করল. তারপর সে জিজ্ঞাসা করল আমরা ফিরে যাবার অনুমতি নিয়েছি কি না. পিন্টু বুদ্ধি খাটিয়ে বলল ক্যাপ্টেন জাগীর সিং আমাদের ফিরে যাবার অনুমতি দিয়েছে. কথাটা ডাঁহা মিথ্যা, কিন্তু কাজ হল. সুবেদার আমাদের যেতে দিল কিন্তু সেই সাথে হুঁশিয়ারীও দিল আমরা যেন আর কোনদিন ভারতে যাবার কথা চিন্তাও না করি. এইসব অপমানকর কথা ও ব্যবহার হজম করে আমরা আবার রাজশাহীর দিকে হাঁটা দিলাম. পিন্টু আরেকটা বুদ্ধিমানের মত কাজ করল. ভারতীয় হিসেবে সে সুবেদারের অনুমতি নিল যাতে সে সীমান্ত পর্য্যন্ত আমাদের সাথে যেতে পারে. পথে পিন্টু বলল - "আমি ওদেরকে হাড্ডি পর্য্যন্ত চিনি. আপনাদের ভাগ্য ভাল ওরা আপনাদের এমনিই ছেড়ে দিয়েছে. নাহলে আপনাদের প্রতিটি পাই পয়সা ওরা কেড়ে নিত".
পাকিস্তানে !
আল্লাহ'র কাছে হাজার শুকুর, আরো ঘন্টা খানেক হেঁটে পাকিস্তানের মাটিতে পা' রাখলাম আমরা. খায়রু বিদায় নিল এখান থেকে. সে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্র্মী, সে পাকিস্তানে নিরাপদ মনে করে না. সারাটা পথ সে আমার সাথে কথা পর্য্যন্ত বলেনি, বিদায়কালে হাত মিলিয়ে যাবার সময়ও সে ছিল নিরুত্তাপ. ভেবে পেলাম না কি আছে ওর মনে. পথে পড়ল এক গ্রাম - আমরা গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসা করলাম রাজশাহীর কি পরিস্থিতি. তারা বলল পরিস্থিতি মোটামুটি ভাল, আমাদের আগে বহু লোক শহরে গেছে. তারা কিছু ট্রেঞ্চ দেখাল যেগুলো পাকিস্তানের ভেতরে ভারতীয় সৈন্যের খুঁড়েছে. শহর যতদিন ইপিআরের নিয়ন্ত্রণে ছিল তারা দিনে এইসব ট্রেঞ্চে থাকত আর রাতে শহরে যেত. এখন এগুলো আবর্জনায় ভরে গেছে.
ভারতের পথে হিন্দুরা
চলার সময় ম্যানেজার আমার পাশে হাঁটছিলেন, তিনি আমাকে গোপনে কি যেন বলতে চাইলেন. তিনি ফিসফিস করে বললেন তিনি আমার পরিচয় জানতে পেরেছেন. আমার পরিচয় গোপন রাখার ব্যাপারে আমরা এতই সতর্ক ছিলাম যে আমি অবাক হয়ে গেলাম - কি করে তীয়নি সেটা জানলেন? ম্যানেজার আমার মনের কথা বুঝতে পেরে খোলাসা করলেন - আমার আসল পরিচত খায়রু তাঁকে বলেছে. আমি তো অবাক - খায়রু কিভাবে জানল ? ম্যানেজার বললেন - খায়রু'র বোন মতিন সাহেবের স্ত্রী, আমার আসল পরিচয় হঠাত ভুল করে সেই মহিলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে. এতক্ষণে আমার প্রতি খায়রুর অস্বাভাবিক আচরণের কারণ পরিষ্কার হল. ত্রাসে আতংকে আমার গা শিরশির করে উঠল, - খায়রু আমার পরিচয় জেনে ফেলেছে আর আমি এখনো বেঁচে আছি ! নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আমি আবারো আল্লাহ'র কাছে শুকরিয়া জানালাম. একটু হাসিও পেল - আমাকে বাঙালী মনে করে খায়রু অবাঙ্গালী আর পাঞ্জাবীদের ব্যাপারে কি বলেছিল. ম্যানেজার বলল সে আমার মাধ্যমে পাকিস্তানী আর্মিকে জানাতে চায় যে সে যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার চেষ্টা করবে. তার দেশপ্রেম দেখে আমার ভাল লাগল. এইসব কথার মধ্যেই চোখে পড়ল করা যেন আসছে. কাছে এলে দেখলাম তারা শহর থেকে পালাচ্ছে. মানুষ শহর থেকে পালাচ্ছে, এটা অবশ্যই আমাদের জন্য বিপদ সংকেত. ম্যানেজার বললেন ওরা হিন্দু, পরে দেখা গেল ওরা সত্যিই হিন্দু. পরেও দেখলাম দলে দলে মানুষ রাজশাহী থেকে চলে আসছে, প্রায় সবাই হিন্দু. তারা সবাই বলল হিন্দুদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে. এক মুসলমান বলল হিন্দুদেরকে আর্মীরা হত্যা করছে না - বিহারীরাই অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে. শুনে ম্যানেজার ভয় পেয়ে গেলেন, আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম. আরেকজন বলল আর্মী প্রত্যেক যুবককে সন্দেহ করছে. শুনে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কথাটা আঙ্কেলের কানে গেল কি না. এসব শুনে তিনি নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যাবেন. কিন্তু তাঁরা অনেক পেছনে ছিলেন - শুনতে পাননি কথাটা. .
আবার পানিতে হাঁটা.....
পথে পড়ল আরেকটা খাল - এবং চারদিকে কোনো নৌকোর নাম নিশানা নেই. তার মানে ওটা হেঁটে পার হতে হবে. পানি ঘাড় সমান উঁচু এবং স্রোত প্রবল. কুলীরা বাকস প্যাঁটরা নিয়ে আগেই ওখানে পৌঁছেছে - বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে. আমাদের আরো পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন মতিন সাহেব আর তাঁর ছেলেরা - তাঁরাও এসে পৌঁছলেন. মতিন সাহেব বললেন এই স্রোতের ভেতরে হেঁটে পার হওয়া খুব বিপজ্জনক, তাই কেউ একজন গিয়ে কিছু লোকজনকে নিয়ে আসুক সাহায্যের জন্য. প্রশ্ন হলো, যাবে টা কে? এক মধ্যে মালিক সাহেব এলেন. তিনি সরাসরিই বললেন - এগিয়ে চলো. আমিও তাতেই মত দিলাম. তৈরী হয়ে আমরা নেমে গেলাম পানিতে. আমার শুধুমাত্র মাথাটা পানির ওপরে, আমার আগে আগে বাক্স প্যাঁটরা মাথায় চলেছে কুলী. খালের অন্যদিক থেকেও বহু লোক এপারে আসছে পানিতে হেঁটে হেঁটে. স্রোত এত বেশী ছিল যে আমার পায়ের নীচে মাটি পিছলে যেতে লাগল এবং মাঝপথে সত্যি আর মাটি পেলাম না. প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলাম - কোনো রকমে সাঁতার কেটে কুলীর কাছে পৌঁছলাম. মাথায় বাক্স প্যাঁটরার ওজন থাকে তার পা মাটিতে শক্ত হয়ে বসছিল, সে আমাকে বলল তাকে শক্ত করে ধরে থাকতে. কিছুটা এগিয়ে পেলাম মাটি - পৌঁছলাম ওপারে.
বিচ্ছিরি বৈষম্য
মতিন সাহেবের বাসা খাল থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দুরে, আমি আর মালিক ভেজা কাপড়ে সেখানে গেলাম. বাসায় চাকর ও অন্যান্যেরা ছিল. তাদের সব কথা বলতেই তারা তক্ষুনি আমাদের সাথে খালে এল. আসার পথে আমি একজন চাকরকে শহরের অবস্থা জিজ্ঞাসা করলাম. সে বলল বিহারীরা নানা ব্যাপারে খুবই বাড়াবাড়ি করছে. জানতে চাইলাম তার বিহারী সহকর্মী কেমন ব্যবহার করছে. সে বলল খারাপ না. আমি বললাম বিহারীদের সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিয়ে শান্তিতে থাকাই ভাল. সে মোটামুটি সম্মত হল এই বলে যে এখন যা পরিস্থিতি তাতে পারস্পরিক সমঝোতার ভেতরে বাস করাই ভাল. কিন্তু সে এ-ও বলল - "সময় মত ওদের সবাইকে উচ্ছেদ করতে হবে". তার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম. মানুষের প্রতি মানুষের এত বেশী ঘৃণা কেন থাকবে? আমার খুব খারাপ লাগছিল, কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে চললাম. তার মনে এরকম বিচ্ছিরি বৈষম্য দেখে খুবই বিতৃষ্ণা লাগছিল.
যুদ্ধাহত রাজশাহী
মতিন সাহেব ও অন্যান্যের খাল পার হয়ে বাসায় এলেন. খাবার দাবার আর রান্না করার বাসনপত্র ছাড়া বাকি সবকিছু ঠিকই ছিল. আঙ্কেলের বাড়ীটা কেমন আছে সেই ভেবে আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম. তিনিও তাই ছিলেন, সেটা বোঝা-ই যাচ্ছিল. মতিন সাহেবের এক বিহারী চাকরকে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলাম আঙ্কেলের বাসার দিকে. কিছুটা পায়ে হাঁটার পর পাওয়া গেল রিকসা. যখন আমি তাকে বাংলায় বললাম আমরা যেতে চাই, সে সরাসরি তা নাকচ করে দিল, অর্থাৎ সে যাবেনা. কিন্তু আমি যখন উর্দুতে বললাম সে অনতিবিলম্বে রাজী হয়ে গেল. অর্থাত অবস্থা তখন এমন যে উর্দুই যেন শাসক হয়ে উঠেছে. যেতে যেতে আমি চারপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছি তখন. ফায়ার ব্রিগেড থেকে সাহেব বাজার পর্য্যন্ত সবকিছু আগের মতই আছে. কিন্তু সাহেব বাজার নিদারুণ যুদ্ধাহত. কোথাও ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে, কোথাও দেয়ালের ওপরে ছাদই নেই. আগুনে ছাদের গলে যাওয়া অজস্র টিন, পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া অজস্র জানালা-দরজা, অজস্র লুন্ঠিত দোকান, ধ্বংস হয়ে যাওয়া অজস্র বিরাট দালানের বিশাল ইস্পাতের রেলিং আমাকে বলছিল পুরো এলাকাটা ধ্বংসের কাহিনী. এক জায়গায় বেশ কিছু মটর সাইকেলের দগ্ধ কংকাল, দগ্ধ ভগ্ন একটা ফটোগ্রাফির দোকানের ভাঙ্গা জানালা দিয়ে ওই দেখা যায় ভেতরে ঝুলন্ত বাল্ব - শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস. নিউমার্কেটের এলাকাতেও একই ভয়াবহ চিত্র. বেশীর ভাগ দোকান নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বাকিগুলো লুট হয়ে গেছে.
রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই ছিল দোতলা গুলশান হোটেল. ওটা ছিল ইপিআরের দুর্গ. পুরো দালানটাই বুলেটে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত - দেয়ালে দেয়ালে মস্ত বড় অসংখ্য গর্ত. রাজশাহীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা গ্রেটার রোড, তার একধারে ছিল সারি সারি বহু কাঁচা বাড়ী. আজ ওগুলো পড়ে আছে ভস্মীভূত বাঁশের গাদার মত. দৈনিক ব্যবহারের রান্নার ডেকচি, সসপ্যান, কলসী, উনুন, পানি খাবার গ্লাস ইত্যাদি সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধুলায় গড়াচ্ছে. আগুনে পুড়ে ওগুলোর এমন অবস্থা হয়েছে যে আর কোনদিনই ব্যবহার করা যাবে না. রাস্তার অন্যধারে ছিল দালানের সারি. সেগুলোও অজস্র বুলেটে বুলেটে বিদ্ধ হয়ে ধ্বংস প্রায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে. দালানগুলোর মধ্যে একটা মসজিদ ছিল সেটাও রক্ষা পায়নি, সেটাও গুলীবিদ্ধ. পরিবার পরিকল্পনা অফিসের দালানটা তো পুরোটাই বিধ্বস্ত, তার সামনে পুড়ে কয়লা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু গাড়ীর কংকাল. ইলেকট্রিক তারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে ঝুলে আছে এলোপাথাড়ি. ওদিকের ওই তাল গাছগুলোকে হয়ত রক্ষাব্যুহ হিসেবে কেউ কাজে লাগাতে চেয়েছিল. ওগুলোর ছাল খুব শক্ত কিন্তু তাও উড়ে গেছে বুলেটের বৃষ্টিতে. অনেক বাড়ীর বাইরের দেয়ালে কলমা আর কোরানের আয়াত লেখা. অনেক বাড়ী আর দোকানের গায়ে উর্দুতে লেখা ওটার মালিক কোন বিহারী বা মুহাজিরের. প্রায় প্রতিটি বাড়ী ও দোকানে উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা. মার্শাল ল' সরকারের আদেশ, - প্রতিটি সাইন বোর্ড লিখতে হবে উর্দু বা ইংরেজীতে. তাড়াহুড়োতে কিছু ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে হাস্যকর. যেমন "প্রবেশ নিষেধ"-এর ইংরেজী করা হয়েছে-"ষ্টপ ! ডোন্ট গো!" রাস্তাগুলো এতিমের মত ফাঁকা, মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে.
মতিন সাহেবের বিহারী ভৃত্য জানাল শহর যখন ইপিআরের নিয়ন্ত্রণে ছিল তখন তাড়া বিহারীদের বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে আর দোকান লুট করেছে. যখন আর্মী বিজয়ী হল তখন বিহারীদের পালা এল বাঙ্গালীদের বাড়ী পোড়ানোর আর দোকান লুটের. লোকটা মতিন সাহেবের খুবই অনুগত ছিল, তাঁর অনুপস্থিতিতে সে এই বাড়ী রক্ষা করেছে বলেই এটা অক্ষত আছে. পুরো রাজশাহীতে মাত্র কয়েকটা বাড়ী লুট হয়নি, তার মধ্যে এটা একটা. এদিক দিয়ে মতিন সাহেবের ভাগ্যটা খুব ভালো.
বিষাদ গাথা
আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সরকারী সম্পত্তি হিসেবে আঙ্কেলের সরকারী বাড়ীটা সুরক্ষিত ও অক্ষত থাকবে. মনে মনে আমি তাই প্রার্থনা করছিলাম কারণ তা না হলে আমি আঙ্কেলের ও তাঁর পরিবারের সামনে মুখ দেখাতে পারবনা. রিকসা এসে আঙ্কেলের বাংলোর সামনে থামল. বাড়ীর সবগুলো দরজা বন্ধ দেখে আমি কি যে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম এই মনে করে যে ভেতরে সবকিছু ঠিকঠাক আছে. কিন্তু আমার টনক নড়ল যখন দেখলাম বারান্দায় কিছু পুরনো চিঠি আর কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে. আমার বুক ভেঙ্গে গেল যখন দেখলাম দরজার তালা ভাঙ্গা. কিন্তু তাহলে দরজাগুলো ভেতর থেকে কিভাবে বন্ধ করা আছে? সপষ্ট যা বুঝলাম তা শাকিল পরদিন জানাল, - সে দরজা বন্ধ করে গিয়েছিল কিন্তু বাসায় এসে দেখে দরজা খোলা, বাসা খালি. দেখলাম একটা দরজা একটু বেঁকে আছে. সেই ফাঁক দিয়ে একটা লাঠি ঢুকিয়ে ভেতরের ছিটকিনি খুলে দরজাটা খুলতেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল. সারা ঘরে কাগজ আর কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে আছে. দেয়ালের কাছে ইস্পাতের একটা কাবার্ড ছিল, আমি সেদিকে ছুটে গেলাম. দেখলাম অতার ওপরে এমন দাগ যে ওটাকে ভারী কিছু দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়েছ্. কাবার্ডটা একেবারে খালি. ড্রেসিং টেবিলটা আছে কিন্তু তার আয়নাটা উধাও. স্টোরে গিয়ে দেখি খালি বাকসগুলো আমাকে যেন ভেংচি কাটছে. ওগুলোতে রাখা ছিল কাপড়, চাদর, লেপ - তার কিচ্ছু নেই. আমার এত খারাপ লাগতে লাগলো - মনে হল যেন এ অপকর্মটা আমিই করেছি. আঙ্কেল আর তাঁর পরিবারের কাছে আমি কি বলব ? তাঁরা এত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তার বদলে আমি তাঁদের এতবড় একটা খারাপ খবর দেব ? লজ্জায় আমার মনে হল ধরণী দ্বিধা হও, আমি তাতে জীবন্ত ঢুকে পড়ি. মতিন সাহেবের বাসায় এসে দেখি সবাই উন্মুখ হয়ে আমার কাছ থেকে বাড়ীর খবর জানার জন্টি অপেক্ষা করছে. আমার ফ্যাকাসে মুখ দেখে তাদের সেই উন্মুখতা হতাশায় পরিণত হল. এলোমেলোভাবে আমি কোনমতে তাঁদের জানালাম যা আমি দেখেছি. আঙ্কেল শান্তভাবে বললেন - এটাই যদি আল্লাহ'র ইচ্ছা তবে তর্ক বিতর্ক না করে সেটা মেনে নেয়াই ভাল. রাতটা খুবই মনোকষ্টে কাটল. এখন আমাদের শুধু পরণের কাপড় ছাড়া আর কিচ্ছু নেই, বোঝা হয়ে থাকতেও হচ্ছে অন্যের বাসায় সেই কবে থেকে.
মৃত্যুশয্যায় বিলাল
শান্তভাবেই শুরু হল সকালটা. কিন্তু এ শান্তি বেশীক্ষণ থাকল না কারণ বিলাল বলল ওর পায়খানার সাথে রক্ত বেরিয়েছে. আঙ্কেল স্তম্ভিত হয় গেলেন. এ বাড়ী ছেড়ে যাবার সময় থেকেই অর্থাৎ প্রথম থেকেই তিনি বারবার বলছিলেন বিলালের স্টমাক আলসার আছে, কিছুদিন আগেই পরপর চারদিন তার পায়খানায় রক্তক্ষরণ হয়েছে. তাঁর চোখে আমি দেখলাম পানি - তিনি আমার সামনে পড়তেই তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অশ্রু মুছে নিলেন. একটা রিকসা করে তখনি হাসপাতালে নেয়া হল বিলালকে. ডাক্তার বললেন ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে. আঙ্কেল ওর সাথে রয়ে গেলেন, আমি আর ইমদাদ ফিরে এলাম. হাসপাতালের অবস্থাও খুব শোচনীয়. সব মেথর ছিল হিন্দু. তাদের হয় মেরে ফেলা হয়েছে নয় তারা পালিয়েছে. হাসপাতালের ওয়ার্ড আর বাথরুমগুলো এত নোংরা হয়ে আছে বলবার নয়. কোন কোন রোগী তো বিছানাতেই টয়লেট করছে - তাদের ধোয়ানো মোছানোর কেউ নেই. ডাক্তার বলেছেন বিলাল যেন নড়াচড়া না করে, তাই তার সাথে একজনের থাকা দরকার হল. ঠিক হল আমরা পালা করে ওর সাথে থাকব. ইমদাদ থাকবে সকাল সাতটা থেকে বেলা একটা পর্য্যন্ত, তারপরে আমি বিকেল পাঁচটা পর্য্যন্ত, তারপরে আঙ্কেল থাকবেন সারা রাত. বিকেল পাঁচটার সময় কারফিউ শুরু, তাই আমাকে তার কিছুটা আগে রওনা হতেই হবে. যদি দরকার পড়ে তবে আমরা একে অপরেরটা করব. বিলালের রক্তক্ষরণ পরের দিনও হল. ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তা থামাতে পারছিলেন না. বিলাল এত রক্ত হারাল যে শেষ পর্য্যন্ত ডাক্তার রক্তের ব্যবস্থা করতে বললেন. ব্লাড ব্যাংক খালি বললেই চলে, - সেই সাথে রক্ত দেবার মত কাউকেই পাওয়া গেল না. শেষে কোনরকমে এক বোতল রক্ত জোগাড় করা সম্ভব হল.
এদিকে যে কোনো মুহুর্তে গ্রেপ্তার হবার ভয়ে সবাই অস্থির. বদল আর মন্নু'র বাইরে যাওয়া একেবারেই নিষেধ, এমনকি বাড়ীর কয়েক গজ দুরে পুকুরে সাঁতার কাটবার জন্যও নয়. বিলালকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরদিন আমি আর আঙ্কেল তাঁর বাড়ী দেখতে গেলাম. সম্প্রতি তিনি খুবই চাপের মধ্যে পড়ে গেছেন. লুট হয়ে গেছে বাড়ীঘর, বাড়ন্ত ছেলে হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়, পরিবারসহ তিনি অন্যের বাসায় থাকছেন. চোখেমুখে বেদনা আর দু:খ তাঁর চোখেমুখে সারাক্ষণ. তার পরেও তিনি শান্ত আর আল্লাহ'র কাছে শুকরগুজার. তাঁর বাড়ী লুট হবার নিদারুন দু:সংবাদ তো তিনি আমার কাছ থেকে আগে থেকেই পেয়েছেন, তার পরেও ওখানে পৌঁছে বাড়ীর অবস্থা দেখে তিনি একেবারে যেন পাথর হয়ে গেলেন. তাঁর সেই বেদনাঘন শান্ত নীরবতা আমাকে যেন ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল.
কেন যেন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল, যেন আমার কারণেই এই সর্বনাশটা হয়েছে. আহা, যদি আলাদীনের প্রদীপটা পেতাম তাহলে এক মুহুর্তে এই বাড়ীটাকে আমি আগের অবস্থায় নিয়ে যেতাম !! কিছুক্ষণ এখানে থেকে আমরা ফিরে যাবার পথে দেখি একটা লোক ব্যথায় কাতরাচ্ছে. তার কাপড় রক্তে ভেজা, কিছু লোক তাকে হাসপাতালে নেবার চেষ্টা করছে. বিহারীরা তার ওপরে প্রতিশোধ নিয়েছে. আমার বুকভাঙ্গা কান্না পেল. বাড়ী ফিরে সবাইকে ঘটনাটা বললাম - সবাই বেদনায় মূক হয়ে গেল.
রক্তাক্ত সান্তাহার
তৃতীয় দিনেও বিলালের রক্তপাত হল. তার পালস খুব বেশী, সাথে খুব বেশী জ্বরও আছে. তাকে আরেক বোতল রক্ত দেয়া হয়েছে. সেদিনই খবর এল বিহারীদের প্রায় আশীটা মৃতদেহ আনা হয়েছে সান্তাহার থেকে - বেশীরভাগই নারী ও শিশু. আতংকে ত্রাসে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কি জানি শহরে আবার ক্রুদ্ধ বিহারীদের উন্মত্ত প্রতিশোধ শুরু না হয়ে যায়. আমার সুগভীর কষ্টও হচ্ছিল - এই নারী ও শিশুগুলো কি অপরাধ করেছে? কোন সে অপরাধে এদের এভাবে খুন করা হল? এর কোনো জবাব আমার কাছে ছিলনা. এ খবরের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় দোকান-হাটবাজার সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল. সবাই ভয় পাচ্ছে যে বিহারীরা প্রতিশোধ নেবে. সন্ধ্যার আগেই দু'একটা ছুরিকাঘাতের কথা শোনা গেল. পরদিন শোনা গেল ভয়াবহ খুন খারাপী হত যদি না রাজশাহী নিয়ন্ত্রণ করছিলেন যে কর্নেল তিনি বিহারী কলোনিতে কারফিউ দিয়ে ওদের বাধা না দিতেন. যাহোক, সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই দু'একটা করে খুন হতে থাকল. রেডিওতে মার্শাল ল কর্তারা একটা মিটিং-এর ঘোষণা দিয়েছিল, সেটাতে যেতে গিয়ে আঙ্কেলের অফিসের হেড ক্লার্ক বিহারীদের হাতে খুন হলেন.
আমাদের মৃত্যুসংবাদ !!
কালাম সাহেবের চাকর বহরমপুর থেকে এল. সে শুনেছিল পাকিস্তানে পৌঁছবার সাথে সাথে ছিল পাকিস্তানী আর্মী আমাদেরকে পুরুষদের মেরে ফেলেছে আর মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে. শুনে সে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল, কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না. গুজব ছড়ানোই যদি কৌশল হয়ে থাকে তবে আমি অবশ্যই বলব ভারতীয় পঞ্চম বাহিনী এতে খুবই দক্ষ. মনে পড়ল কাতলামারীতে পথে একজনের সাথে দেখা হলে সে প্রথমেই নিশ্চিত হয়েছিল আমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছি.
তারপর সে আমাকে রাজশাহীর পরিস্থিতি জিনিয়ে কথাবার্তা বলে ঘনিষ্ঠ হবার ভান করল. তারপরে সে মুক্তিবাহীনির খুব প্রশংসা করল, বলল পাকিস্তান বিমান বাহীনির বাঙালী পাইলটেরা বিদ্রোহ করে তাদের যেত ফাইটারগুলো উড়িয়ে ভারতে নিয়ে এসেছে আর সেখান থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে. ১৯৬৫-এ পাক-ভারত যুদ্ধের পাইলট হিরো বাঙালী স্কোয়াড্রন লিডার এম এম আলম তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন. ব্যাটা জানতই না যে স্কোয়াড্রন লিডার এম এম আলম ও তাঁর পরিবারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি. নাহলে সে এমনই গোপনীয় ভঙ্গীতে কথা বলছিল যে আমি তার কথা বিশ্বাসই করে ফেলতাম. আমি জানি স্কোয়াড্রন লিডার এম এম আলম বাঙালী নন. তাঁর পিতামাতা বিহারের লোক, ঢাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন. বিমান বাহিনীতে যোগ দেবার পর তিনি প্রধানত: পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এবং সেই সময়টায় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ডেপুটেশনে ছিলেন. যাহোক, লোকটার কথাবার্তায় আমি এমন ভাব করলাম যেন এমন সব গোপন খবর পেয়ে আমি খুবই উৎফুল্ল.
ডাক্তার, মেডিক্যাল ছাত্র ও নার্স
হাসপাতালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রের সাথে দেখা, সে পাঞ্জাবের শিয়ালকোটের ছেলে. এক ডাক্তারের সাথেও পরিচয় হলো যে লাহোরের মানুষ. তার দুজনেই মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলে থাকে. পরে জানলাম আন্দোলনের সময় মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকদের সামনেই তাদের দুজনকে ধরে পেটানো হয়েছে এবং তাদের রুম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে. পরে রাজশাহী আর্মীর নিয়ন্ত্রণে এলে তারা মানুষের শুধু উপকারই করেনি বরং বেশ কিছু লোকের প্রাণও বাঁচিয়েছে. তারা বিলালের ব্যাপারেও আমাদেরকে আপ্রাণ সাহায্য করল. তার পেটের আলসার থেকে চতুর্থ দিনও রক্তপাত হচ্ছিল, তাকে আরেক বোতল রক্তও দিতে হয়েছে. ও বাঁচবে কি না তা নিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম - নামাজে ওর জন্য বিশেষ দোয়া করলাম. সেদিন বিলালোকে দেখার জন্য রিকসা করে হাসপাতালে যাবার পথে আন্টি কাঁদতে শুরু করলেন. আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন - "বিলাল বাঁচবে তো"? সন্তানের জন্য মায়ের এই আর্তনাদ, এর আমি কি জবাব দেব? আমার চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ল অশ্রুধারা. তারপরেও আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিলাম - চিন্তার কিছু নেই, বিলাল শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে. কিন্তু তিনি কাঁদতেই থাকলেন.
গতবার যখন বিলালের আলসার হয়েছিল রক্তপাত হয়েছিল মাত্র চারবার. কিন্তু এবারে যখন কয়েক দিন ধরে সাতবার রক্তপাত হয়েছে, মনে হচ্ছে যেন আর কোনোই আশা নেই. এর মধ্যে পাঁচ বোতল রক্ত দেয়া হয়েছে, পালস কখনো স্বাভাবিক কখনো হঠাত খুব বেড়ে যাচ্ছে. দীর্ঘ সাত সাতটা দিন এই অসহ ইঅবস্থায় কাটানোর পরে সামান্য উন্নতি দেখা গেল. ডাক্তারেরা রক্তপাত বন্ধ করতে সক্ষম হলেন. কিন্তু এর মধ্যেই বিলাল এত রক্ত হারিয়েছে যে ডাক্তারেরা ভয় করছিলেন ওটা আবার শুরু হয় নাকি. তাঁরা বললেন এখনই অপারেশন করতে. এরকম দুর্বল শরীরে অপারেশন খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু উপায়ই বা কি. পুরো সময়টা ধরে আমি নার্সদের ব্যবহার আর কর্মদক্ষতা দেখে অভিভূত. একশ' পঁচিশজন নার্সের মধ্যে একশ' জনই নেই, মাত্র পঁচিশজন রাতদিন পরিশ্রম করছেন পুরো হাসপাতাল সামলাতে. তাঁরা এমনই একাগ্রতার সাথে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন যে কারো খেয়ালই হচ্ছে না – একশ’ জন নার্স অনুপস্থিত ! তাঁদের দেখে আমার মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল.
অপারেশন!
বিলালের অপারেশনের দিনে আমি হাসপাতালে. আঙ্কেলর উদ্বেগ দেখে আমার ভয় যেন আরো বেড়ে গেল. যে দু'ঘন্টা ধরে বিলালের অপারেশন হচ্ছিল সেই সময়টায় আঙ্কেলের উত্কন্ঠা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়. তিনি বাচ্চা ছেলের মত কাঁপতে শুরু করলেন. যখন অপারেশন শেষে বিলালকে সাদা চাদরে ঢেকে স্ট্রেচারে করে বাইরে আনা হল. অপারেশন সফল হয়েছিল যদিও রক্তের অভাবে বিলালের চেহারা সাদা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল. অপারেশনের পরের দুiটি দিনই ছিল সবচেয়ে দুশ্চিন্তার সময়. এই দুদিন ধরে সবাই তার জন্য দুশ্চিন্তায় অস্থির, সবাই আহার নিদ্রা ভুলে দোয়া করছে তার রোগমুক্তির জন্য. সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যখন দুদিন পর থেকে বিলাল একটু একটু করে ভাল হতে থাকল. আল্লাহ আমাদের দোয়া শুনেছেন - বিলাল এখন কোনো রকম বিপদের বাইরে. অপারেশনের সময় তাকে আরো দু'বোতল রক্ত দেয়া হয়েছিল, সব মিলিয়ে সাত বোতল রক্ত.
আবার বিপদ !
বিলালের অসুখটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ কিন্তু সেই বোঝার ওপরে ঝুলছিল আরো অনেক বিপদ. সামরিক সরকার ঘোষণা করেছিল, যেসব সরকারী কর্মচারী ২১শে এপ্রিলে বা তার আগে অফিসে জয়েন করেছন তাঁরা বেতন পাবেন. আঙ্কেল জয়েন করেছেন ২৪ তারিখে. তাঁর হাতে যা কিছু ছিল বিলালের অসুখে নি:শেষ হয়ে গেছে. বেতন পাবেন না শুনে তিনি একেবারেই মুষড়ে পড়লেন. কেউ কেউ বলল তিনিই তো অফিসের বড়কর্তা, তিনি ইচ্ছে করলেই তাঁর জয়েনিং ২১শে থেকে দেখাতে পারেন. একথা শুনে তিনি রেগে আগুন হয়ে গেলেন. তিনি বললেন বেতন পান বা না পান তিনি কিছুতেই অসৎ হতে পারবেন না. কিছুদিন পরেই সরকার ঘোষণা করল ২৪শে এপ্রিলের আগে জয়েন করলেও বেতন পাওয়া যাবে. ঘটনার এইসব ঘনঘটা ছাড়াও শোনা গেল আর্মী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর লোকজনের টাকা পয়সা লুট করছে. আঙ্কেলের অফিসের বড় কেরাণী যাকে বিহারীরা খুন করেছিল, তাঁর বয়স প্রায় একশ'. তিনি দেখা করতে এলেন. তিনি বললেন- তাঁরা একটা কুঁড়েঘরে থাকেন - একদিন তাঁরা খাচ্ছিলেন সে সময় দু'জন আর্মী দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল. তারা হিন্দুদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল. তারা ভেবেছিল তিনি হিন্দু. তিনি নিজেকে মুসলমান দাবী করলে তারা বলল কোরান থেকে কলমা পড়তে. তিনি কলমা পড়লেন - কিন্তু তার পরেও তারা তাঁকে সার্চ করল. এসব বলে বেচারা বুড়ো মানুষ কাঁদতে শুরু করলেন. একদিন শোনা গেল দূর্গাপাড়া থেকে একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে. শুনে আঙ্কেল আরো বিচলিত হয়ে পড়লেন. বিলাল তখনো হাসপাতালে. তিনি আমাকে বললেন রাত্রে বাসায় থাকতে, ইমদাদ আমার জায়গায় রাত্রে হাসপাতালে থাকবে.
আমরা সেভাবেই দিন কাটাতে থাকলাম.
আর্মীর বর্বরতা
আর্মী সরকার ঘোষণা করেছিল, যে কোনো বিল যেমন টেলিফোন বা বিদ্যুত - পরিশোধের চেক তাদের দ্বারা সই করিয়ে নিতে হবে. আঙ্কেল তো হাসপাতালে বিলালকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তাই ও কাজটা করতে হত আমাকেই. বার বার আর্মীর অফিসে যেতে হত. আমি পাঞ্জাবের বলে স্বাভাবিকভাবেই আর্মীর কয়েকজনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল. এভাবেই শিয়ালকোটের এক সিপাই কর্পোরাল অর্থাৎ নায়েকের সাথে আমার দেখা হয়. সে মহা উৎসাহে আমার দোস্ত বনে গেল আর আমাকে আমন্ত্রণ করল কোনো বিশ্রামের সময় গল্পগুজব করার জন্য তার কাছে যেতে. আমি প্রথম সুযোগেই তার কাছে গেলাম জীবন মৃত্যুর এই নাটকীয় ও বেদনাঘন উত্তাল সংঘর্ষের সাক্ষাৎ সত্য জানতে. সে খুব বিষন্ন স্বরে বলল - "ভাগ্যের দয়া যে আমি এখনো বেঁচে আছি আর আপনার সাথে কথা বলছি. নাহলে এই পরিস্থিতিতে আমাদের বাঁচারই কোন আশা ছিল না. রাজশাহীতে সৈন্যের সংখ্যা মোটামুটি খারাপ ছিলনা, কিন্তু পরে নানা কারণে আমাদের শক্তি কমে গেল. আমরা ভাবতেও পারিনি আমাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ হবে. শেখ মুজিবের ঘোষণা করা নন -কোঅপারেশন আন্দোলন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল. তারপরে যে আর্মী মেজর রাজশাহীতে ডেপুটি মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট-কে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন. কিন্তু পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এই বলে পাঠালেন যে তিনি আর্মী মেজরের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন, তিনি ঢাকা পুলিশ অফিস থেকে নির্দেশ পান. এটা মেজরকে ক্রুদ্ধ করেছিল কিন্তু সেই পরিস্থতিতে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট-এর সহযোগিতা অত্যন্ত দরকার ছিল. তাই মেজর সে অপমান হজম করে তাঁকে আবার ডেকে পাঠালেন. এবারে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এলেন, কিন্তু এলেন এক অস্ত্রধারী এক পুলিশ গার্ড সহ. মিটিং-এ তাঁর চলন বলন এবং কথাবার্তাও সন্তোষজনক ছিলনা. তখন কথাবার্তার মধ্যেই উপস্থিত এক আর্মী ক্যাপ্টেন হঠাৎ পিস্তল বের করে তাঁর বুকে চেপে ধরে. তাঁর অস্ত্রধারী পুলিশ গার্ড-কেও দুজন সৈন্য ধরে ফেলে.
তাঁদের দুজনকেই নিরস্ত্র ও বন্দী করা হয়. এই খবর পুলিশ লাইনে পৌঁছলে সমস্ত পুলিশ সশস্ত্র বিদ্রোহ করে. পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আর্মীও সশস্ত্র পদক্ষেপ নেয়. এই ঘটনায় আর্মী প্রায় এক হাজার লোককে খুন করে".
ইপিআর বিদ্রোহ - নায়ের মুখ থেকে
নায়েক বিস্তারিত বলে চলল - "অন্যান্য জায়গায় ইপিআরের বিদ্রোহের খবর আমরা পাচ্ছিলাম কিন্তু রাজশাহীতে ওরা তখনও বেশ অনুগত
ছিল. কিন্তু যখন নওগাঁ আর নবাবগঞ্জে বিদ্রোহ করল তখন নিরাপত্তার জন্য রাজশাহীর ইপিআরদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হল. নবাবগঞ্জের বিদ্রোহের খবর পেয়ে এখান থেকে একজন বাঙালী মেজর ভুঁইয়াকে ওখানে পাঠানো হল. (বাঙালী মেজর ভুঁইয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে, যাকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মুক্তিবাহীনিরা হত্যা করেছিল). কিন্তু ওখানে পৌঁছার পরে সম্ভবত: সে আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল - তাই নবাবগঞ্জের ইপিআর আমাদের আক্রমণ করেছিল. ওরা আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে আনছিল. ওরা আমাদের অবস্থান জানত, ওদের সাথে অনেক অস্ত্র সহ অনেক ভারতীয় সৈন্য ছিল. চতুর্দিক থেকে ওরা আমাদের ওপরে একটানা গোলাবর্ষণ করছিল. ওরা আমাদের অস্ত্রাগারকে টার্গেট করেছিল, কিন্তু আমরা আগেই আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলেছিলাম. ওরা সেটা জানত না, তাই ওদের সমস্ত গোলাগুলি পড়ছিল যেখানে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র আগে রাখা ছিল. আমাদের অনুরোধে ঢাকা থেকে একটা হেলিকপ্টার এসে আমাদের নারী ও বাচ্চাদের সরিয়ে নিয়ে যায়. সেইদিন আমি আমার পরিবারের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম. লেখার সময়টা ছিল অন্ধকার রাত. বাইরে থেকে যাতে দেখা না যায় সেজন্য একটা কম্বলের ভেতরে টর্চ জ্বালিয়ে সেই আলোয় আমি লিখছিলাম চিঠিটা. আমরা কখন কি করি তা আমাদের প্রতিপক্ষ ভাল করেই জানত. তাই ওরা আঘাত হানত বিশেষ করে খাবার সময়টাতেই. এই রকম বাধার ফলে আমাদেরকে প্রায়ই না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে. ওদের আঘাত এতই প্রচন্ড ছিল যে আমাদের এক ইঞ্চিও বাদ যায় নি. একদিন আমরা কিছুটা সময় পেলাম মুরগী রান্না করার. পাকিস্তানে আমার গ্রাম থেকে এক পাউন্ড ঘী উপহার পেয়েছিলাম. জীবনে আর সুযোগ পাব কি না তাই ভেবে সবটুকু ঘী দিয়ে রাঁধলাম মুরগীটা. কয়েকজন মিলে মনের আনন্দে খেতে বসেছি এমন সময় একটা গোলা এসে পাশের কামরায় ফেটে পড়ল. বাকি সবার খাবার আনন্দ মিলিয়ে গেল শুন্যে, তারা জীবন বাঁচানোর জন্য তাড়াতাড়ি ট্রেঞ্চে ঢুকে পড়ল. আমি কিন্তু ছাড়লাম না, - আমি একাই পুরো মুরগীটা সাবাড় করে তবে উঠলাম. কামরা থেকে বেরোতেই এক বন্ধুর সাথে যে কিনা মুরগীটায় অংশ নিতে আসছিল. আমরা মাত্র কথা শুরু করেছি কানে এল ছুটে আসা গোলার শব্দ. বন্ধুটি মজা করে বলল -"চল গোলাটাকে অভ্যর্থনা জানাই". কাছেই ছিল একটা দেয়াল - আমরা ধুপ করে শুয়ে পড়লাম ওটার গোড়ায় . গোলাটা বিস্ফোরিত হল কাছেই, ওটার অসংখ্য স্প্লিন্টার এসে আঘাত করল দেয়ালটাকে, তার প্লাস্টার আমাদের ওপরে ঝরে পড়ল বৃষ্টির মত. যাহোক, স্প্লিন্টার থেকে তো বাঁচলাম ! সবটা মুরগী আমি খেয়ে ফেলেছি শুনে বন্ধুটি মন খারাপ করে ফিরে গেল.
একটু এগিয়ে যেতেই আরেক বন্ধুর সাথে দেখা. আমাকে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি সে সেখানেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে, একটা বুলেট এসে তাকে আঘাত মরণাঘাত করেছে. আমার কাছ থেকে সে ছিল মাত্র কয়েক ফুট দুরে. কয়েক গজ দুরে দুজন সৈন্য একটা গাছের নীচে বসে খাবার খাচ্ছিল, এমন সময় একটা গোলা সে বিস্ফোরিত হল তাদের কাছেই. চোখের পলকে একজন সেখানেই মারা গেল, অন্যজনের উড়ে গেল একটা পা'. গোলাবর্ষণের তীব্রতা বেড়েই চলছিল. তাই আমি হাতে ভর করে ছুটলাম ট্রেঞ্চের দিকে. চতুর্দিকে ছুটে এসে বিস্ফোরিত হচ্ছে গোলার পরে গোলা. আমার খুব কাছে এসে পড়ল একটা - আমার অবধারিত মৃত্যু হত যদি সেটা বিস্ফোরিত হত. ভাগ্যিস সেটা বিস্ফোরিত হয়নি. আল্লাহ'র কাছে শুকরানা জানিয়ে আবার দ্রুত হামাগুড়ি দিলাম ট্রেঞ্চের দিকে. ট্রেঞ্চের কাছে আসতেই আবার একটা গোলা এসে পড়ল খুব কাছে এবং কি সৌভাগ্য আমার! ফাটল না এটাও !! মুহুর্তে আমি ঝাপ দিলাম একটা বাংকারে. কংক্রিটে বানানো ছিল বলে ওটা ছিল নিরাপদ. আমাদের শত্রুরা এটা জানত, তাই অনবরত ছয় ঘন্টা ধরে ওটার ওপর গোলা ছুঁড়েছে. গোলার তীব্রতা একটু কমে একে আমি আমার বাংকারে ফিরে এলাম. শত্রুর তুলনায় আমাদের সৈন্যসংখ্যা এতই কমে গিয়েছিল যে বাইরে থেকে সাহায্য না এলে আমরা হয়ত বাঁচতামই না.
পাবনার হত্যাযজ্ঞ - নায়েক
"আমরা নিজেরা সুসংগঠিত হবার আগেই পাবনা থেকে অনুরোধ এল সাহায্যের. তেই এখান থেকে একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন, একজন লেফটেন্যান্ট ও কয়েকজন সৈন্য পাবনায় রওনা দিল. কিন্তু শত্রুপক্ষ পাবনায় ছিল শক্তিশালী - আমাদের সৈন্যের পাবনায় পৌঁছানোর সাথে সাথে শত্রুরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে প্রবল আক্রমণ শুরু করল. প্রথমেই আহত হল আমাদের ক্যাপ্টেন. তাঁকে আনতে গিয়ে আহত হল আরেক সৈন্য. তৃতীয় আরেক সৈন্য ওই দুজনকে আনতে গেল - এবং ক্যাপ্টেনকে আনতে সমর্থ হল. কিন্তু সে যখন ফিরে গেল আহত সৈন্যকে আনতে, বেচারা বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে ওখানেই মরে গেল. তখন আরেক সৈন্য আহত ও নিহতদের নিয়ে এল. এভাবে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে, যেখানে অস্ত্র প্রায় শেষ এবং অন্য কোথাও থেকে সাহায্য আসার সম্ভাবনা নেই, কম্যান্ডিং অফিসার নির্দেশ দিলেন, - যে যেভাবে পারে নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে. আর্মীর পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পড়ে তারা রাজশাহী ফেরার চেষ্টা করল. কিন্তু হতভাগ্যদের প্রায় সবাই বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়ে জনগণ দ্বারা নিহত হল. মাত্র কয়েকজনের মৃতদেহ পরে পাওয়া গেছে. যখনি আমাদের সৈন্য, অফিসার বা তাদের পরিবার ধরা পড়েছে, তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে - এমনকি বাচ্চাদের পর্য্যন্ত গুলী করে মারা হয়েছে."
বলতে বলতে নায়েকের গলা ধরে এল. এসব স্মৃতি তার জন্য মর্মান্তিক তো বটেই. এই ভয়ংকর মৃত্যুযজ্ঞ কত সুখী হাস্যমুখ অফিসার ও জোয়ানদের ঠেলে দিয়েছে মরণের দিকে. তাঁদের পরিবারের নারীদের ধর্ষণ ও রক্তের ভেতরে পরে থাকা মৃত বাচ্চাদের কথা মনে করে আমি ক্রোধে ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে গেলাম. আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না - বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম.
অন্যরকম - অন্যরকম ....
এরপর তিন চারদিন ব্যস্ত থাকতে হল হাসপাতালে, তাই আর নায়েকের কাছে যেতে পারিনি. একদিন আঙ্কেলের এক চাকর এল, নাম তার নিকু. সে ছিল খ্রিষ্টান. তার পুরো গোত্রটাই খ্রিষ্টান হয়ে গেছে মিশনারীদের চেষ্টায়. এই গোত্রটা সুপরিচিত ছিল দুটি কারণে - তাদের উত্ফুল্ল ও পরিশ্রমী স্বভাবের জন্য. রাজশাহীর বিশেষ অঞ্চলের কৃষিকাজ নির্ভর করে প্রধানত: এদের পরিশ্রমের ওপরেই. সে বলল তাদের গ্রামে বেচ কিছু যুবকদের খুন করা হয়েছে ও নারীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে. পুরো গ্রামটাই এখন শুধু ধুধু উজাড় বসতি. বুকভাঙ্গা খবর, কিন্তু আজকাল প্রায় অর্ধেক খবরই এরকম. পরদিন আবার গেলাম নায়েকের কাছে. অন্য কিছু সৈন্যও ছিল কিন্তু তারা মন মেজাজের দিক দিয়ে নায়েকের চেয়ে অনেক অন্যরকম. তারা নায়েকের মত ম্রিয়মাণ নয় - তারা মনে হলো বেশ আনন্দেই আছে. তারা খুব গর্ব করে আমাকে তাদের বীরত্বের গল্প বলতে লাগল. তাদের কাছে এসব হলো আগুন আর রক্তের হোলিখেলা - বলতে বলতে তাদের চোখ আনন্দে ঝিকমিক করতে লাগল. একজন খুউব বড়াই করে বলল - "ওরা তো কাপুরুষ !! আমরা ওদের গ্রামে গেলেই ওরা লেজ তুলে পালিয়ে যায় শুধুমাত্র কিছু বুড়ো হাবড়া ছাড়া - যারা দৌড়তে পারে না".
তখন এক বুড়ো এল কাশতে কাশতে. সে বিহারী, নাহলে এখানে এত স্বাধীনভাবে আসার সাহস কার আছে? সে এখানে এক সৈন্যের পরিচিত. সে এসেছে সৈন্যটাকে বলতে সে যেন ওয়াপদা'র (তখনকার পানি ও বিদ্যুত বিভাগ) অফিসারকে ফোন করে বলে দেয় তার বাসায় বিদ্যুত দিতে. বুড়োটা কিছুক্ষণ থাকল ও কথাবার্তায় যোগ দিল. হঠাত করে সে বলল - বাঙ্গালীরা ক্রীতদাস হয়ে জন্মেছে, চিরকাল ক্রীতদাসই থাকবে. এদের মধ্যে না ছিল কোন বাদশাহ, না কোন পাহলোয়ান, এমনকি কোন দরবেশ পর্য্যন্ত নয়. এরা একটা পচা জাতি, এদের প্রতি সেই ব্যবহারই করতে হবে. এই বিষাক্ত কথা শুনে রাগে আমার রক্ত গরম হয়ে গেল - তক্ষুনি আমি উঠে চলে এলাম.
গ্রাম পাকিস্তানী নয়, বাংলাদেশী....
সোজা চলে এলাম হাসপাতালে বিলালের কাছে. সে ভাল হয়ে উঠছে - অপারেশনের সেলাই খুলে দিলেই সে ফিরে যাবে বাড়ী. ডাক্তার বলল কয়েকজন ধর্ষিতা নারী ভর্তি হয়েছে, কারো কারো অবস্থা আশংকাজনক. হাসপাতাল থেকে রিকসা করে ফেরার সময় ভাবলাম আজ পদ্মা নদীর ধারে বাঁধের ওপরে যে পথ সেটা দিয়ে যাই. সে পথে ওঠার সাথে সাথে কানে এল কে যেন বলছে থামতে. রিকসা থামল. রাস্তার ধরে দুজন বিহারী তরুণ বাংকার খুঁড়ছিল, ওরাই বলেছে রিকসা থামাতে. ওদের পেছনে ঝোপ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে নজরে পড়ল এক পাঞ্জাবী সৈন্য. বিহারীদের পাত্তা না দিয়ে আমি পাঞ্জাবীর দিকে তাকিয়ে পাঞ্জাবী ভাষায় জিগ্গাসা করলাম ব্যাপার কি. আমাকে পাঞ্জাবী বলতে শুনে বিহারী দুটো মাপ চাওয়ার ভঙ্গীতে ফিরে গেল. কিন্তু ওই সৈন্যটা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করল কে পাঞ্জাবীতে কথা বলছে? আমি আমার পরিচয় দিলাম - সে মহা উৎসাহে আমাকে নিয়ে গেল ঝোপের পেছনে তার বাংকারে. ভাবলেশহীন চেহারায় দুটো ছোট্ট চোখের হাবিলদার সে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে মাত্র গত সপ্তাহে. ঢাকা থেকে গাড়ীতে এসে ফেরীতে নগরবাড়ী পার হয়ে গাড়ীতে করে পৌঁছেছে রাজশাহী. একটু হিংসুক কন্ঠেই সে বলল - "এই বিহারীরা আমাকে বলেছে ওরা বাঙালীর এত লুট করেছে যে তিন বছর আয়েশ করতে পারবে".
আমি জিজ্ঞাসা করলাম নদীর ওপার থেকে লোকজন আসছে কি না সে বলল - "আসতে চাচ্ছে কিন্তু আমরা কাউকে আসতে দিচ্ছি না". আমি জিজ্ঞাসা করলাম - পানির ওপারে সীমান্তের এপারে যে পাকিস্তানী গ্রাম আছে তাদের ব্যাপারে কি? সে আশ্চর্য্য হয়ে বলল - "ওখানে তো কোনো পাকিস্তানী গ্রাম নেই ! ওগুলো তো সব বাঙালীর গ্রাম !!" শুনে বিহারী তরুণদুটো তাকে সমর্থন করে মাথা ঝাঁকাল. এবারে আমার আশ্চর্য্য হবার পালা. আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম পাকিস্তানী সীমানা পানি পার হয়ে সীমান্ত পর্য্যন্ত - পানি ও সীমানার মধ্যে অনেক গ্রাম আছে যেখানে পাকিস্তানীরা বাস করে এবং তারা পাকিস্তানের প্রতি নিবেদিত. শুনে সে আশ্চর্য্য হয়ে বলল - "এই বিহারীরা আমাকে সেকথা বলেনি - অন্য কথা বলেছে". এর দেখলাম মধ্যে চারজন বাঙ্গালীকে ধরে আনা হয়েছে, তাদের হাত পিঠের পেছনে বাঁধা. ওদের মধ্যে একজন কাঁদছিল. তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল সে ওয়াপদা-র কেরাণী, সে রাজনীতি করেনা এবং সে নিরপরাধ. আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম. হাবিলদার তাদেরকে মেজরের কাছে পাঠিয়ে দিল. দেরী হয়ে যাচ্ছিল বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম.
সৈন্যরাও মানুষ !!
পরদিন হাসপাতালে না গিয়ে আমি আবার হাজির নায়েকের কাছে. ও আমাকে দেখে খুশীই হল. চা খেতে খেতে কথা হল অনেক. লোকটা আমার কাছে মন খুলে দিচ্ছিল, তাই আমি খোলাখুলিই ওকে মানুষের ওপরে সৈন্যদের অত্যাচারের যে কথা চারদিকে শোনা যাচ্ছে সেকথা জিজ্ঞাসা করলাম. সে কিছুই অস্বীকার করল না, শুধু বলল - সমাজের প্রতিটি স্তরেই ভাল ও মন্দ মানুষ আছে. এবারে আমি কোন রাখঢাক না করে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম সে নিজে কতজন বাঙালী খুন করেছে. সেও সুস্পষ্ট কন্ঠে বলল - সে কখনো কোন নিরস্ত্র মানুষের দিকে একটা বন্দুকও ছোঁড়েনি. কারণ কোন নিরস্ত্রকে হত্যা করলে নিহতের প্রাণের জবাব তাকে আল্লাহ'র কাছে দিতে হবে. সে দোয়া করেছে যেন আল্লাহ তাকে হেন অপকর্ম থেকে বাঁচিয়ে রাখেন. দেয়ালে ঝোলানো ছিল তিনটে কোরান. সেগুলো ছিল অন্যান্য সৈন্যদের যারা বদলী হয়ে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে এগুলো নেবে আবার. নায়েককে সেদিন খুব আনন্দিত দেখায় নি. কেন তা জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে বলে ফজরের নামাজ কাজা হয়েছে, তাই তার মনটা ভালো নেই. তারপর সে বলল তার গ্রামের কথা, বাল্যবন্ধুদের সাথে ছোটবেলার দুষ্টুমীর কথা, ভাই-বোন আর বাবার কথা, আর স্নেহময়ী মায়ের কথাও যিনি উৎকন্ঠিত ভাবে তার পথ চেয়ে বসে আছেন.
নায়েকের সাথে আমার এমনই ঘনিষ্ঠতা হল জে সে আমাকে এক বাঙালী মেয়ের সাথে তার প্রেমের কথাও না বলে পারেনি. সে তার বালিশের নীচ থেকে এতা ডায়েরী বের করে তা থেকে অত্যন্ত সুন্দরী এক বাঙালী মেয়ের ছবি বের করে আমাকে দেখাল. বলল - "পাবনাতে আমি এই বাঙালী মেয়েটার প্রেমে পড়ি. আমরা দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবাসতাম. আমাদের দেখা মাত্র কিছুদিনের জন্য হয়েছিল. তখনও অবস্থা খারাপ হয়নি. তারপরেই রাজনীতিতে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করল, আমি রাজশাহীতে বদলী হলাম". তারপরে আমাদের আর কোনদিনই দেখা হয়নি, জানি না সে বেঁচে আছে কি না. তাকে আমার সবসময় গভীরভাবে মনে পড়ে".
এসব কথা আমাদের দুজনকেই দুনিয়া ভুলিয়ে দিয়েছিল, - সময়ের খেয়াল ছিলনা আমাদের. হঠাৎ ঘড়িতে দেখি পৌনে পাঁচটা বাজে. তড়িঘড়ি উঠে বাড়ীর দিকে ছুটলাম কারণ পাঁচটা থেকে কারফিউ শুরু হবে.
মাথা নীচু করে আমি দ্রুতবেগে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম পাকিস্তানী আর্মীর কথা. তাদের যে ভাবমূর্তি আমার মনে ছিল তা হলো আল্লাহ'র সৈন্য. কাজেই তাদের সব কাজ আল্লাহ'র নির্দেশ মোতাবেকই হওয়া উচিত ছিল. তারা কি নীতি মেনে চলবে তা বহু আগেই কবি ডক্টর মুহাম্মদ ইকবাল বলে গেছেন:-
" জীবন এমনভাবে বানাও যেন তা হয় পর্বতের প্রবাহমান ঝর্নাধারার মত উচ্ছ্বল.
কিন্তু তা যখন সমতলে আসে তখন যেন হয় সঙ্গীতের মত স্রোতময়".
হঠাৎ এক সৈন্যের হুঙ্কারে আমাকে থামতে হল. সে জিজ্ঞাসা করল আমি কোথায় যাচ্ছি. বললাম বাসায় যাচ্ছি. সে বলল জানো না এখন কারফিউ ? আমি বললাম এখনো দশ মিনিট বাকি আছে. সে আমাকে ছেড়ে দিল কিন্তু আমার চিন্তাধারাকে এমনই নষ্ট করে দিয়ে গেল যে আমি আর ইকবালকে আগের জায়গায় আনতে পারলাম না.
রক্তাক্ত ফুলেরা
পরদিন আমাকে হাসপাতালে যেতে হল খুব ভোরেই. বিলালকে দেখলাম বেড-এ বসে আছে. সে এখন একটু একটু হাঁটতেও পারে. আমি তাকে অপেক্ষা করতে বলে তিন নম্বর ওয়ার্ডে গেলাম আহত বাচ্চাদের দেখতে. আগে কয়েকবারই যেতে চেয়েছি কিন্তু সাহস হচ্ছিল না. বাচ্চারা যন্ত্রনায় কোঁকাচ্ছে দেখলে হয়ত আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারব না. কিন্তু শুনেছি ওরা নাকি এখন বেশ ভাল, শিগগিরই বাসায় চলে যাবে. ওয়ার্ডের দরজায় দাঁড়িয়ে এক পলক দেখে নিলাম ভেতরটা. সব বাচ্চাদের বয়সই দশের নীচে. এই ছোট্ট পুতুলগুলোর মাঠে খেলে বেড়ানোর কথা, তা নয় ওরা ব্যান্ডেজে জড়িয়ে বিছানায় পড়ে আছে. ফ্যাকাশে চোখমুখে হাসির লেশমাত্র নেই - শুধু ত্রাসের রাজত্ব. মনে হচ্ছে ওরা হাসতেই ভুলে গেছে. ওদের সবারই গলায় দাগ - ওদের ধরে জবাই করা হচ্ছিল যখন ওদেরকে উদ্ধার করা হয়েছে. একটা ছোট্ট ছেলের নাম ওয়াসিম. আমি জিজ্ঞাসা করলাম - "কে তোমাকে মেরেছে?" সে বলল - "হিন্দুরা". আমি বললাম - "কি করেছে ওরা তোমাকে?" সে বলল - "ওরা আমাকে মাটিতে ফেলে জবাই করতে চাচ্ছিল". বাচ্চাটা একেবারে ভাবলেশহীন চেহারায় এসব বলছিল যেন কিছুই হয়নি, এটাই একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা. সে আরো বলল তার সবগুলি ভাই-বোনকে খুন করা হয়েছে আর মা'কে ধরে নিয়ে গেছে. তার বাবা তার মা'কে খুঁজতে বগুড়ায় গেছে. জিজ্ঞাসা করলাম - "তোমার আব্বু কি করে"? সে বলল তিনি রেলের গার্ড. তখন বাচ্চাটার ভাবলেশহীন চোখদুটো শুকনো কিন্তু আমার দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেছে.
মায়ের অশ্রু
ছেলেটার কাছেই অন্য একটা বেডে ছিলেন এক মমতা মাখা স্নেহময়ী মা. তিনি খুব কষ্টভরা কন্ঠে বললেন - "আমার দুখের কথা বলার ভাষা নেই. আমার নয়টা সন্তানের মধ্যে মাত্র এই তিনটে বেঁচে আছে". এই বলে তিনি তাঁর পাশে ব্যান্ডেজ বাঁধা তিনটে বাচ্চাকে দেখালেন, যাদের প্রায় কংকাল বলা চলে. তারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন আমি একটা দানব যে তাদের ভাইবোনকে খেয়ে ফেলেছে. ওদের খুব কাছেই একটা ছোট্ট মেয়ে বসেছিল - কি যে মায়াময় আর নিষ্পাপ তার চোখমুখ আর চাউনি. তাকে দেখে আমার ছোটবোনের কথা মনে পড়ে মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল. সেই মা আমাকে তাঁর কাহিনী বললেন, তাঁর চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল অশ্রুধারা. তিনি বললেন - "বাবা, আমরা নিজেদের রক্ষা করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম. জানতাম আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, তাই আমরা শেষ রক্তবন্দু দিয়ে লড়াই করে যাবার জন্য তৈরী ছিলাম. আমি এমনকি বন্দুক চালানোও শিখেছিলাম. কিন্তু তারা আমাদের ঠকিয়েছে. তারা বলেছিল কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না - এই বলে ওরা আমাদের অস্ত্র নিয়ে নিয়েছিল. তারপরে ওরা আমাদের খুন করা শুরু করে. এদের বাবা ছিলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোর কিপার. তিনি ছুটিতে এসেছিলেন আমাদের সাথে থাকার জন্য. ওরা প্রথমে তাঁকে খুন করে. আমার জোয়ান মেয়েকে ম্যাট্রিক পর্য্যন্ত পড়িয়েছিলাম - সে তার বাবার মত বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে তারপর খুন হয়ে গেছে. ওরা আমার বাকি সব ছেলেমেয়েকে জবাই করেছে. ওরা আমার মাথায় এত জোরে মেরেছে যে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম. আমরা সবাই মরে গেছি মনে করে ওরা চলে যায়. পড়ে আর্মী এসে বাকি সব মৃতদেহ থেকে আমাদের উদ্ধার করেছে". এ কাহিনী বলার সময় সেই মা হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন. আমি পাথরের মত নিরুত্তাপ আবেগহীন শুধু শুনে গেছি তাঁর কথা. ওই বাচ্চারা যারা নিজের চোখে নিজের ভাইবোনদের জবাই হতে দেখেছে ওদের বুকও বুঝি একই রকম পাথর হয়ে গেছে. আমি তখন কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছি. ওয়ার্ডের বাকি সব বাচ্চাদের কাহিনীও একই রকম.
যুদ্ধের শিকার
বিলালের ওয়ার্ডে যখন এলাম আমার আর কথা বলারও শক্তি নেই. তার ওয়ার্ডে একমাত্র সে ছাড়া বাকে প্রতিটি রোগী যুদ্ধাহত. ওর পাশের বেডের লোকটার ঘাড়ে ঢুকে গেছে মেশিনগানের বুলেট. তার ঘায়ে এখন সেপটিক হয়ে গেছে - খুব দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সেটা থেকে. তার পরের বেডে আমারই বয়সী এক তরুণ - তার হাতে বুলেটের তিন তিনটে ক্ষত. নিজের বাসায় বসে সে বুলেট খেয়েছে. অন্যান্য বেডে ছিল শান্তাহারের রোগীরা. তারা উন্মত্ত জনতার হিংস্রতার শিকার, তাদের মধ্যে যুবক বুড়ো সবাই আছে. তাদের পুরো শরীরই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে. সেপসিস হয়ে সেটা বেড়ে যাবার জন্য তাদের অনেকেরই হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে. একটা তের বছর বয়সের ছেলে যে কিনা এই সেদিনও ছুটে বেড়াত সে আজ একটা পা হারিয়ে ক্লাচএ ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে. সফেদ দাঁড়ি এক বুড়ো রোগীর হাত ঝুলছে ঘাড়ের সাথে বাঁধা কাপড়ে, তার কপালেও ব্যান্ডেজ. বাম চোখের ঠিক ওপরের ক্ষতটা মুখ হা করে আছে. সে বলল আক্রমনকারীরা সরাসরি তার চোখেই আঘাত করতে চেয়েছিল কিন্তু একটু ফসকে গেছে. প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের আরেকজন, তার ঘাড়ে রক্তের ক্ষত. তার মানে তাকে জবাই করার চেষ্টা করা হয়েছিল. সে বলল সে দিনাজপুর থেকে শান্তাহারে এসেছিল আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নিতে. এসেছিল বলেই সে আহত হয়েও বেঁচে গেছে, - ওদিকে দিনাজপুরে খুন হয়ে গেছে তার পরিবারের প্রত্যেকে. তাদের কাছেই ছিল এক শ্বশুর আর তার জামাই. বুড়ো বলল তাদের সারা পরিবারকে একটা কামরায় বন্দী করে সেখানে বোমা ফাটানো হয়েছে. সব বাচ্চাসহ তার মেয়ে ওখানে মরে গেছে. পুরো ওয়ার্ডে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে যে আহত সে মাত্র এগারো বছরের ছেলে. তার সারা শরীর ঝাঁঝরা - সে সারাক্ষণ নার্সকে ডাকছে. তার মাথায় এত জোরে আঘাত করা হয়েছে যে ডাক্তারেরা বলছে তার বাঁচার আশা খুবই কম. ধীরে ধীরে তার জ্ঞান লোপ পেল আর একদিন সে সব কষ্টের ওপারে চলে গেল. সেই ছিল তার সারা পরিবারের একমাত্র জীবিত. আরেকজন স্বাস্থ্যবান শক্ত শরীরের লোক ছিল. সে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেঞ্চ খুঁড়ছিল, এমন সময় একটা বুলেট তার মাথায় ঢুকে গেল. ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টাতেও ফল হল না, একদিন সে মরে গেল.
এই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র একটা শহরের হৃদয়বিদারক ঘটনা. এই একই ঘটনা ঘটেছে সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি রাস্তা ঘটে, প্রতিটি গঞ্জে গ্রামে, প্রতিটি শহরে. এর শিকার ছিল বাঙালী অবাঙ্গালী দুই-ই, যারা একদিন একসাথে সংগ্রাম করে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা করে জন্ম দিয়েছিল একটা স্বাধীন দেশের, - পাকিস্তানের. ভাগ্যের কি পরিহাস !! মাত্র তেইশ বছর পরেই দুনিয়ার সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের আজ এই নিদারুণ অবস্থা. এতে দুনিয়ার সামনে মাথা নীচু হয়ে গেছে শুধু পাকিস্তানীদেরই নয় বরং সারা মুসলিম উম্মার. এত বিশাল আকারের এই সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ, এই মর্মান্তিক গণহত্যা শুধু পাকিস্তানেরই নয়, বরং সমস্ত মুসলিম উম্মা আর বিশ্বের মানবতার ওপরে ঘোর কলংক. প্রশ্ন হল, এতবড় একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটল কেন? আজ পাকিস্তানে কেউ আছে যার সাহস হবে এ প্রশ্নের জবাব দেবার ??
ফুটপাথ বাজার
বাজারে গেলাম একদিন. অবস্থা এমন হয়েছে যে দরকারী জিনিসপত্র বাজারে পাওয়ায়ই যায় না কিংবা পাওয়া গেলেও দাম এত বেশী যে ছুঁলেই হাত পুড়ে যায়. দোকানগুলো লুট হয়েছিল, যোগাযোগের রাস্তাঘাট এতটাই নষ্ট হয়েছে যে গ্রাম থেকে শহরে জিনিসপত্র আনা-নেওয়াও কঠিন. সব মিলিয়ে জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়ে কয়েকগুন চড়ে গেছে. চার আনা দামের এক প্যাকেট সিগারেট বিক্রী হচ্ছে দুই থেকে তিন টাকায়, ঘী আর চা তো পাওয়াই যায় না. একটা ব্যাটারীর দামই হয়ে গেছে চার টাকা. ভালো মানের ব্লেড বাজার থেকে উধাও, নিম্নমানের ব্লেড আগের চেয়ে অনেকগুন বেশী দাম. এমনকি ম্যাচ বাকসের দামও আকাশে পৌঁছে গেছে. আজকাল বাজার বসছে ফুটপাথে. আগের লাখপতিরা এখন ফুটপাথে বসে ডাল বিক্রী করছে. লুট করা মাল বিক্রী হচ্ছে খোলাখুলি. দামী কাপড়চোপড় গড়াগড়ি যাচ্ছে ফুটপাথের ধুলোয়. লুট করা সিল্কের বেনারসী শাড়ী থেকে শুরু করে লিপস্টিক, মুখের পাউডার ও অন্যান্য প্রসাধনী দিব্যি পাওয়া যাচ্ছে দেদার, কিন্তু মুশকিল হল এসব লুটের মালের আসল দাম বিক্রেতা নিজেই জানে না. তারা হয়ত একশ টাকার জিনিস বিক্রী করছে পাঁচ টাকায়, কিংবা এক টাকার দামের জিনিসের দাম হাঁকছে পঞ্চাশ টাকা. সবচেয়ে লক্ষ্মণীয় হল, সারা বাজারে বাঙালী দোকানদার একজনও নেই.
আবার আতংক
এতদিনে বেশীর ভাগ লোক শহরে ফিরে এসেছেন. জীবনযাত্রা স্বাভাবিক বলে মনে হলেও সর্বত্র বিরাজ করছে এক অদৃশ্য আতংক. নিরপরাধেরা ক্রিমিন্যালের আতংকে ভুগছে, আর ক্রিমিন্যালেরা ভুগছে অপরাধবোধে. জীবন বাইরে শান্ত কিন্তু ভেতরে তোলপাড় করছে ঘূর্ণিঝড়. কোর্ট রোডে মার্শাল ল অফিসের দিকে গেলে যে কেউ দেখতে পাবে প্যারেড মাঠে নুতন নুতন সৈন্যদের কুচকাওয়াজ. সৈন্যদের মনোবলও সুদৃঢ়. তাদের যে কারো সাথে কথা বললে বোঝা যায় তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশ রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ. ভারত থেকে সদ্য ফেরা এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা হল. সে বলল স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতারা কলকাতার হোটেল থেকে যুদ্ধ চালাচ্ছেন. বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র কলকাতার রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত হচ্ছে. পশ্চিম বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে কোনো মুহুর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যেতে পারে. আওয়ামী লীগের যেসব কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদ ওখানে গেছেন তাঁরা ফিরে আসতে চান কিন্তু জীবন ও সম্পত্তির ভয়ে পারছেন না ফিরে আসতে. ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির ওপরে ছড়াচ্ছে এমন সব গুজব যে লোকেরা ফিরে আসতে ভয় পাচ্ছে. যারা আসছে তারা সরকারের দেয়া পথে না এসে চুপিচুপি আসছে অন্যান্য গোপন পথ ধরে. ভারতীয় এজেন্টরা তাদের হয়রানি করছে আর আসার পথে বাধার সৃষ্টি করছে. পশ্চিম বঙ্গে অনেক মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে কারণ তাঁরা বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতির বিরোধীতা করেছেন. ইঞ্জিনিয়ারটি পরিবারসহ প্রায় এক মাস ভারতে ছিলেন. তিনি নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতেন.
এসেছে নীড়ের ডাক, বিদায় বিদায়....
বিলাল এখন অনেকটাই ভাল. আমি লাহোরে ফিরে যাবার কথা ভাবছি. বাঙালী-বিহারীর মধ্যে দাঙ্গা যে কোনো মুহুর্তে সম্ভব, আর্মী আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেটা প্রতিরোধ করতে. রেলওয়ে চালু হয়নি এখনো. রাজশাহী থেকে ঢাকায় দিনে যায় মাত্র একটা কৌচ. শোনা যাচ্ছে রেল লাইনগুলো মেরামত হচ্ছে, শিগগিরই চালু হবে ট্রেন. একদিন সত্যি সত্যিই শোনা গেল কয়লার ইঞ্জিনের কুহুধ্বনি. কি মিষ্টিই যে লাগল ! মনে হল যেন সফরের জন্য ডাকছে. ট্রেন বন্ধের কারণে মানুষ ছিল অবরুদ্ধ অবস্থায়. এই হুইসল নিশ্চয় মানুষের মনে জাগিয়েছে আনন্দের উত্তেজনা. চিঠিপত্র, বাস ও ট্রেন মানুষের আবেগের সাথে কতটা জড়িত তা মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সময় মনে থাকেনা. এখনকার পরিস্থিতিতে একটা চিঠি, বাসের হর্ন বা ট্রেনের আওয়াজ জীবনের গতি ফিরিয়ে আনে.
রাজিশাহীর সবাইকে খোদা হাফেজ বলাটা কি যে বেদনাদায়ক ছিল ! আমার চোখে অশ্রুর বন্যা. মিলনের বা বিচ্ছেদের মুহুর্তেই আবেগ তার সমস্ত বাধা অতিক্রম করে যায়. বাড়ীর সবার চোখে অশ্রু. আন্টি বললেন - "বাবা, আমি তো উর্দুতে লিখতে পারিনা. তাই আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পারব না কিন্তু সারা জীবন তোমাকে মনে রাখব. তোমার প্রতিটি মুহূর্ত আমার মনে সারা জীবন জীবন্ত হয়ে থাকবে". আঙ্কেল তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে বললেন -"তুমি আমার অন্যান্য সন্তানের মতই প্রিয়, তোমাকে আমার খুব মনে পড়বে. বাকি সন্তানদের মত আমি তোমাকেও বলি - নিজের স্বস্থি আর শিক্ষার যত্ন নিও. জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সত্য আর ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে". অবাগে তাঁর গলা ধরে আসছিল - তিনি অনেক কষ্টে উচ্চারণ করছিলেন. ইমদাদ, ওর ভাই বোন বিলাল, মুভি আর মাফি চুপ করেই ছিল কিন্তু ওদের ছলছল চোখে জমে থাকা অশ্রু অনেক কথাই বলছিল. আমার জন্য যে কষ্ট তাঁরা করেছেন সেজন্য আন্টি আর আঙ্কেলকে ধন্যবাদ দিলাম. তাঁদের মত প্রিয়জন সারা দুনিয়ায় আমার আর নেই. সেই কঠিন দু:সময়ে তাঁদের সাথে কাটানোর প্রতিটি মুহূর্ত আমার সারা জীবন মনে থাকবে. বাড়ীর বাইরে লনে এলাম - সব কাজের লোক আর আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছেন, সবার চোখমুখ বেদনায় ভারাক্রান্ত. ফরিদের চোখে অশ্রু. সেই খ্রিষ্টান কাজের লোক নিক্কু এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল. বেদনার্ত কন্ঠে বলল -"ভাইয়া, এখানে এত এত খুন আর এত এত রক্ত ! সম্ভব হলে পাকিস্তান থেকে আমাকে ফোন করবেন".
ঢাকায় ফিরলাম জুনের ১৫ তারিখে.
ঢাকায় !!
প্রিয়জনের সাথে বিচ্ছেদের বেদনাভরা মনে ঢাকার পথে ড্রাইভারের পাশের সিটটাই ছিল আমার. মায়াময় বাংলার দিগন্তবিস্তৃত মাঠ ঘাট, ক্ষেত খামারের মধ্যে দিয়ে চলছে বাস. রাস্তার পাশে মানুষের বসতি যে কুটিরগুলো সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে আছে, বুলেটে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত শুধু তাদের বাঁশের কংকাল দেখা যাচ্ছে. ঘন্টা খানেক পরে নাটোর. এখানে দুর্ধর্ষ যুদ্ধের আলামত ছড়িয়ে আছে. দগ্ধ গাড়ীর কংকাল, বুলেটে বুলেটে ছিন্নভিন্ন বাড়ীগুলোর দেয়াল, আর্মীর জীপ আর ট্রাক ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক, সব মিলিয়ে যুদ্ধাহত এক ছোট্ট শহর, - তার ধ্বংসের সাতকাহন. চেক পোষ্টে সবাইকে নামিয়ে বাসের সবকিছু তন্নতন্ন করে খোঁজা হল - তারপরে আবার যাত্রা. এই ছোট্ট নাটোর সারা পূর্ব পাকিস্তানে বিখ্যাত এক নাম. তার প্রধান শহরের পাশেই দুগ্ধধবল স্তম্ভ, তাতে কায়েদে আজমের বাণী উদ্ধৃত - ইমান, একতা, শৃঙ্খলা. নাটোরেই নাকি দেশের সবচেয়ে বড় পুকুর (লেখক সম্ভবত: নাটোরের চলন বিলের নাম শুনেছিলেন - বাংলার সবচেয়ে বড় বিল - অনুবাদক). এর সৌন্দর্য্যের জন্য নাটোর কবিদের আকর্ষণ. এখানে হিন্দুর সংখ্যা খুব বেশী আর নাটোরের মিঠাই কাঁচাগোল্লার খ্যাতি দেশ জুড়ে. মনে পড়ল ক'বছর আগে এই সুন্দর শহরটায় এসেছিলাম আমরা কয়েক বন্ধু. রাজশাহী থেকে নাটোর, নাটোর থেকে পাবনার পথে রাস্তার ধারে একই রকম বাংলার মনোহর দৃশ্য. তার মধ্যেও দেখলাম লোকেরা পুড়ে যাওয়া বাড়ী থেকে যা কিছু পারা যায় উদ্ধার করার চেষ্টা করছে. পাবনা পৌঁছার মাইল খানেক আগে রাস্তার ধারে নজরে পড়ল একটা পোড়া ট্রাকও. দেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতালের জন্য পাবনা বিখ্যাত. কিন্তু এখন প্রতিটি মানুষের উদ্বিগ্ন ও ভয়ার্ত চোখমুখ দেখে মনে হল পুরো শহরটাকেই মানসিক হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে. সেখান থেকে রওনা হবার পরেই আবার একটা চেকপোষ্ট. কিন্তু এবারে চেক করা হল শুধু আইডেনটিটি কার্ড. ভারত থেকে আসার পথে আমার কার্ডটা নষ্ট করে ফেলতে হয়েছিল, আমার পাঞ্জাবী পরিচয় ও ভাষা খুব কাজে লাগল. ঘন্টাখানেক পরে পৌছানো গেল পদ্মা নদীর পাড়ে নগরবাড়ী ঘাট. এখান থেকে ফেরী দিয়ে পদ্মা পার হতে হবে, এখানেও আর্মী চেকপোষ্ট. এই চেকপোষ্টে আর্মী এত ভালো ব্যবহার করল যে সবাই খুশী হল. ফেরী আসার দেরী আছে, তাই সবাই বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল একটু বিশ্রামের জন্য. আমি সোজা ঢুকে গেলাম চেকপোষ্টের ভেতর. আমি লাহোরের, আমি পাঞ্জাবী, তাই খাতির পেলাম খুব. দুজন অফিসার তাদের পরিচিতি দিয়ে বলল যে কোনো সমস্যায় তাদের সাথে যোগাযোগ করতে. ধন্যবাদ দিলাম তাদের. ফেরীতে পদ্মা পার হতেই আবার আরেকটা চেকপোষ্ট. এর আগের চেকপোষ্ট গুলোতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা পুলিশ কাজ করছে, সেখানে কোথাও মেয়েদের চেক করা হয়নি. কিন্তু এখানে আর্মী নয়, কাজ করছে বিহারী যুবকেরা যাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল সিভিল আর্মড ফোর্স. তারা অত্যন্ত অপমান ও অসম্মানজনকভাবে সবাইকে চেক করল, এমনকি মেয়েদেরও. এতে সবাই খুব রেগে গেল কিন্তু বেচারাদের কিছুই করার ছিলনা. সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা পৌঁছে জীবনযাত্রা স্বাভাবিকই মনে হল, এমনকি ফ্যাশনদুরস্ত তরুণ-তরুণীও দেখলাম বেশ স্বচ্ছন্দেই ঘোরাফেরা করছে. জীবনের এতটা সময় এত ভয়ানক উদ্বেগ, আতংক, ত্রাস, দুশ্চিন্তা, শারীরিক পরিশ্রম ইতাদির ভেতর দিয়ে গেছি যে অতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল ঢাকার এই স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক লাগছিল.
রাজশাহী থেকে ঢাকা, এই লম্বা সফরে সারাটাক্ষণ শুধু চুপ করে ছিলাম.
মিনতি থেকে অগ্নিগিরি
ঢাকায় এসে আমার হোষ্টেল ফজলুল হক হলে না গিয়ে আমি সোজা চলে গেলাম মণ্ডল সাহেবের বাসায়. লাহোরে তিনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন. এতদিন পরে দেখা, সবাই ভাল আছে জেনে খুশী হলাম আমরা. এতদিন আমার কোনো খবর না পেয়ে তিনি মনে করেছিলেন আমি মরেই গেছি. বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তারা প্রায় সবাই গ্রামে চলে গেছে. নোমানকে পাওয়া গেল, আমরা দুবন্ধু দেখা করে কথা বললাম নিবিড়. তার মতে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, শত্রু এদেশ ও জাতিকে অনেকটাই ধ্বংস করতে সমর্থ হয়েছে. এখন কথা হল, কিভাবে দুই পক্ষের এই মহাভুল শোধরানো যায়, এবং কোনো পক্ষ কি এই পদক্ষেপ নেবে? না, কোনো জবাব নেই এ প্রশ্নের.
এবারে গেলাম পাকিস্তান টেলিভিশনের সিনিয়র প্রডিউসার মমিনুল হকের সাথে দেখা করতে. সম্মান ও ভালবাসার জন্য তাঁকে ডাকতাম মমিন ভাই বলে. বছর তিনেক আগে টিভিতে একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল - "ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র" - এই বিষয়ে যাতে আমি অংশ নিয়েছিলাম. তখন থেকেই মমিন ভাইয়ের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা. পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা এক পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল টিভি ষ্টেশনের গেট. প্রথমে বাঙালী মনে করে সে আমাকে অত্যন্ত অপমানজনভাবে ধমক দিল - বলল “দূর হয়ে যাও!!”. কথাটা মমিন ভাইকে বলে দেখি তিনি আগে থেকেই ওই অভদ্র পুলিশের ওপরে রেগে আছেন. তিনি বললেন - এই পুলিশগুলো বাঙালীদের মানুষই মনে করে না. লাহোরে এক সরকারী সফরে তিনি কিছুটা পাঞ্জাবী শিখেছিলেন. আমরা একসাথে বাইরে গেট-এ এলে তিনি পুলিশটাকে পাঞ্জাবী ভাষায় সম্ভাষণ করলে পুলিশটা উদ্ধতভাবে বলল - "বিরক্ত করো না - যাও নিজের কাজ কর". একজন সম্মানিত সিনিয়র প্রডিউসারের সাথে তার এই দুর্ব্যবহারে আমি হতবাক হয়ে গেলাম. এভাবে অপমানিত হয়ে মোমিন ভাইয়ের চোখে দেখি রক্ত উঠে এসেছে. রাগে তিনি রীতিমত কাঁপছিলেন. তিনি আমাকে কি যেন বললেন কিন্তু তাঁর কন্ঠ ছিল অস্বাভাবিক. আমরা সবেমাত্র গেটের বাইরে এসেছি হঠাত প্রচন্ড একটা চড়ের শব্দে ঘুরে তাকালাম. দেখলাম আরেকটা পুলিশ একজন ঠেলাগাড়ীওয়ালাকে ধরে পেটাচ্ছে. পুলিশটা তাকে আরেকটা প্রচন্ড চড় মারল. তার দোষ ছিল, পুলিশটা তাকে থামতে বলার সাথে সাথে সে ঠেলাগাড়ী থামাতে পারেনি. বেচারা আমার দিকে মিনতিভরা চোখে তাকিয়ে আছে. আমি পুলিশটার দিকে তাকালাম কিছু বলার জন্য কিন্তু থেমে গেলাম. মনে হল হাজার হাজার ঠেলাগাড়ীওয়ালা আমার দিকে ওইরকম মিনতিমাখা চোখে তাকিয়ে আছে. কি বলব আমি ? এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে কোন সে অমানুষ মানবতার বাণী শুনবে? ঠেলাগাড়ীওয়ালা চলে গেল. কেউ তার মিনতির জবাব দিল না. কেউ তাকে পাকিস্তানী ওই পুলিশের হিংস্রতা থেকে বাঁচাতে পারল না. এখন তার চোখে আর কোন মিনতি নেই. এখন তার চোখে আর কোন দু:খ নেই, এখন তার বুকের মধ্যে যা আছে তা হল পাকিস্তানীদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণার বিদ্রোহী অগ্নিগিরি. এবং সেটা তার একার বুকে ছিল না, ছিল মোমিন ভাইয়ের বুকেও. অসহায় আমি বিদায় জানিয়ে চলে এলাম.
বৃদ্ধার প্রার্থনা
পরদিন আবার দেখা নোমানের সাথে. তাকে খুব ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল. সে বলল পরিস্থিতি এতই খারাপ যে প্রকৃত পাকিস্তানীরাও আশা হারিয়ে ফেলছে. সে বলল - " আমি আর কি বলব, তুমি নিজেই দেখে নাও. জনগণ অল ইন্ডিয়া রেডিও সনে গভীর আগ্রহের সাথে. আর, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে তো কেউ ভোলেই না. তারা সত্য মিথ্যা যা কিছু প্রচার করছে জনগণ বিশ্বাস করছে আর সেই মোতাবেক নিজেদের আশা আকাংখা গড়ে তুলছে. অনেকেই বিশ্বাস করছে শিগগিরই মুক্তিবাহিনী এসে দেশ দখল করবে. ভারত এই অপপ্রচার দিনে দিনে বাড়িয়ে তুলছে. ওদের তুলনায় রেডিও পাকিস্তান একেবারেই তুচ্ছ". কথাটা নোমান ঠিকই বলেছিল. সেদিনই আমি ইমদাদের চাচীর সাথে দেখা করলাম. তিনি শুধু সত্যবাদীই নন, তিনি স্পষ্টবক্তাও বটে. তিনি বললেন - "দোয়া কর যেন পরস্থিতি এমন হয় যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়”.
২৫শে মার্চ ঢাকায় কি হয়েছিল?
আমি খালেদের বাসাতেও গেলাম. অর মা শুকিয়ে কংকাল হয়ে গেছেন. মিরপুরের রাস্তা দিয়ে যাবার পথে বিহারীরা তাঁর ছোট ভাইকে খুন করেছে, - সে আঘাত তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি. খালেদের বাচাল নানীরও কথা হারিয়ে গেছে, - এখন তিনি প্রায়ই চুপ করে থাকেন. তাঁর ভাস্তে ও ভাগ্নীও এই হিংস্রতার দাবানলে পুড়ে মরেছে.
একদিন হঠাৎ রাস্তায় এক ক্লাসফ্রেন্ডের সাথে দেখা. তার কাছেই শুনলাম বিস্তারিত. এর ভেতরে মর্মান্তিকভাবে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল. সে ঢাকার বিখ্যাত এলাকা আজিমপুরে থাকত. ২৫শে মার্চের আগেই নাকি গুজব রটেছিল যে আজিমপুরে মুক্তিবাহীনির ট্রেনিং ক্যাম্প বানানো হবে. গুজব শিগগিরই পরিণত হল বাস্তবে, ক্যাম্পও হল, রাইফেলের গুলির শব্দও শোনা যেতে লাগল. তারা তাড়াতাড়ি আজিমপুর ছেড়ে ঢাকার অদূরে জিঞ্জিরাতে গিয়ে উঠল. কিন্তু সংঘর্ষের সময় মুক্তিবাহীনি ঢাকা ছেড়ে ওই জিঞ্জিরাতেই গিয়ে উঠল. পাকিস্তানী আর্মী তাদের অনুসরণ করে জিঞ্জিরাতে সেই এলাকা ঘিরে ফেলল. শুরু হল যুদ্ধ. একটা গলা এসে ফাটল তাদের বাসার ঠিক সামনে - তাতে আহত হল তার মা আর ছোট ভাই. ভাই পরে বেঁচে উঠল কিন্তু মা মারা গেলেন. সে আরো বলল আইউব খানের পা-চাটা মোনায়েম খান যে কিনা বহুদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিল, তার দুজন গুণ্ডা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিল. বিদ্রোহী ছাত্রদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারাই. সংগী সাথী নিয়ে তারাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল ঢাকায় - ফলে মার্চের ২৫ তারিখে ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে. কিন্তু আর্মী একশন নেবার সাথে সাথে তারা ডিগবাজী মেরেছে. তাদের জন্যই পাকিস্তানী আর্মীর হাতে বহু নিরপরাধ ছাত্র খুন হয়েছে যাদের মধ্যে রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও ছিল.
আমার শিক্ষকদের ভালোমন্দ জানার জন্য আমি গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে. হলগুলো ছিল তালা দেয়া, কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না. কিন্তু আমাকে তো আমার জিনিসপত্র নিতে হবে. তাই প্রভোষ্ট-এর অনুমতি নিয়ে আমি আমার রুমে গেলাম. জিনিসপত্র ঠিকঠাকই ছিল. হলের ভেতরে মাঠে দেখি কিছু গর্ত খোঁড়া. দারোয়ান বলল ওখানে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা আছে সন্দেহে আর্মী ওগুলো খুঁড়েছে. তারা তিনচারটা রুমে তলাশী করেছে ও কয়েক জায়গায় মাটি খুঁড়েছে কিন্তু কিছু পায়নি. বিপদ আঁচ করতে পেরে ছাত্ররা আগেই হল ছেড়ে পালিয়েছিল- তাই এখানে কোনো খারাপ ঘটনা ঘটেনি. দারোয়ানের কাছে জিনিসপত্র রেখে শিক্ষকদের সাথে দেখা করতে গেলাম আমার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে. নোমান আগেই বলেছিল আমাদের এক খ্যাতনামা শিক্ষকের নিহত হবার খবরটা মিথ্যা, তবু সেটা যাচাই করার জন্য প্রথমেই সোজা গেলাম তাঁর কক্ষে. তাঁর নিহত হবার খবর কলকাতার আকাশবাণী থেকে ক্রমাগত প্রচার হয়েছে কিন্তু আকাশবাণীর মিথ্যা-প্রচারের জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে তিনি দিব্যি সেখানে বসে কথা বলছিলেন তাঁর ছাত্রদের সাথে. নবজাত শিশুর মত নিষ্পাপ এক শিক্ষককে খুন করেছিল আর্মী. তিনি গত পঁচিশ বছর ধরে জুনিয়র শিক্ষক ছিলেন, কিছু মানসিক অসুস্থতার জন্য তাঁর প্রমোশন হয়নি. এক ফিজিক্স ছাড়া দুনিয়ার আর কোনোকিছুর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলনা, এবং ফিজিক্সেও একটা সীমার ওপরে তিনি উঠতে পারতেন না. রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিলনা. আরো বেদনাদায়ক হল তাঁর মৃতদেহ তাঁরই কক্ষের সামনে পড়েছিল দীর্ঘ কয়েকটা দিন. আমার দুই শিক্ষক ডক্টর সালাম আর তাঁর স্ত্রী ডক্টর রোকেয়া আপার সাথে দেখা হল. ডক্টর সালাম ছিলেন ধীরস্থির মানুষ. তিনি ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তানের দর্শনের সমর্থক ছিলেন - দেশের মঙ্গলই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান. আমাকে দেখে তিনি খুশী ও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন. তিনি বললেন- “পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দাও - বহু ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমাদের মধ্যে ঘৃণার যে পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে তা দুই পক্ষের প্রচেষ্টা দিয়ে অতিক্রম করতে হবে. পাকিস্তান আমাদের দেশ এবং একতা আমাদের লক্ষ্য. দেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য আমাদের সবার একসাথে কাজ করতে হবে". তাঁর দেশপ্রেম দেখে আমার খুবই ভাল লাগল, আমি কথা দিলাম তাঁর বার্তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের কাছে পৌঁছে দেব. আকাশবাণী থেকে এটাও প্রচার করা হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গোলা ছোঁড়া হয়েছে. বিশ্ববিদ্যালয়ের দালানগুলো ছাড়াও আমি আটটা হলের প্রতিটিতে গিয়ে দেখলাম শুধুমাত্র ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে. বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসগুলো চলছে কিন্তু ক্লাস শুরু হবার ঘোষণা এখনো দেয়া হয়নি.
বিশ্ববিদ্যালয়
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অফিসারের বাসায় গেলাম দেখা করতে. গত চার বছর তিনি খুবই সাহায্য করেছেন আমাকে, এবারেও দুহাত বাড়িয়ে সম্ভাষণ করলেন. তাঁর ছেলে ও ভাস্তে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্লাস শুরু হবে সহসাই. যাতে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে না যায় সেজনয় গুজব রটানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলাটা একটা ট্র্যাপ, যে-ই ক্লাসে যাবে তাকেই আর্মী গ্রেপ্তার করবে. তাঁর ছেলে ও ভাস্তে আমাকে জিজ্ঞাসা করল এ গুজন সম্বন্ধে আমি কি মনে করি. আমি বললাম এটা স্রেফ গুজব, সরকারের পক্ষে ছাত্ররা ক্লাসে গেলে তাদের গ্রেপ্তার করার কোন কারণও নেই, যুক্তিও নেই. তাছাড়া সরকার নিজেই তো চাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসুক. যাহোক এ গুজব তাদেরই উদ্দেশ্য সফল করল যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের দুরে সরিয়ে রাখতে চায়. আমার কথায় ওরা সাহস ফিরে পেয়েছিল, পরে আর্মীর নিরাপত্তায় ক্লাস শুরুও হয়েছিল. ওদের কাছে জানতে পারলাম স্টাটিসটিক্স বিভাগের প্রধান ডক্টর মুনিরুজ্জামান সহ আমাদের আর কোন শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে. এ হত্যাগুলো কি ভুল বোঝাবুঝির কারণে ঘটেছিল? মেডিক্যাল কলেজের পাশ দিয়ে যাবার সময় শহীদ মিনারের দিকে দৃষ্টি গেল. গত বিশ বছর ধরে এই মিনারটা জাতির আবেগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে. পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৯৫২ সালে পুলিশের গুলিতে নিহতদের সম্মানে এটা বানানো হয়েছিল. ওটাতে দেখি বড় করে "মসজিদ" লেখা. শহরের অন্যান্য শহীদ মিনার ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে. পাবলিক লাইব্রেরীর দালান আর টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার অটুটই ছিল. কার্জন হলে যাবার পথে দেখলাম রমনা রেস কোর্সের ভেতরে চিরকালের দাঁড়ানো সেই বিখ্যাত মন্দিরটি নেই. কার্জন হল যেখানে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট, সেটা আর আশেপাশের অন্যান্য দালান ঠিকই আছে. মোটের ওপর সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে কোনো সহিংসতা ঘটেনি. আমি ফজলুল হক হলের দারোয়ানের কাছ থেকে আমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে
গেলাম মন্ডল সাহেবের বাসায়.
বিদায় পরিহাস
ঢাকায় ছিলা মোট পনের দিন, জীবন বাইরে থেকে দেখেছি স্বাভাবিক কিন্তু না ! ভেতরে ভেতরে গভীর ও ভয়ানক একটা আতংক খেলা করছে প্রত্যেকটি মানুষে চোখেমুখে. শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা যেমন কেন্দ্রীয় পোষ্ট অফিস, মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকা, ওয়াপদা ভবন ইত্যাদিতে প্রায়ই বিস্ফোরিত হচ্ছে বোমা, যদিও তাতে কোন প্রাণহানী হয়নি. গোলাগুলির শব্দও যে শোনা যায় না এমন নয়. শহরে নিত্যদিন সিকিওরিটি চেক হচ্ছে প্রচন্ড. রিকসা, বাস আর অন্যান্য গাড়ী তন্নতন্ন করে সার্চ করা হচ্ছে হঠাত থামিয়ে. কল কারখানার সবাই এখনো ফিরে আসেনি কিন্তু উত্পাদন কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে. শহরের তিনটি বানিজ্যিক কেন্দ্র জিন্নাহ এভেনিউ, নিউমার্কেট আর বায়তুল মুকাররমে বয়ে চলেছে জীবনের উত্তাল তরঙ কিন্তু তা শুধুমাত্র দিনের বেলাতেই. যে মুহুর্তে সূর্য্য ডোবা শুরু হল, সবাই ছুটোছুটি করে চলে যায় বাড়ীর নিতাপত্তায়. প্রত্যেকটা দিনই শোনা যাচ্ছে কোনো না কোনো উত্তেজক ঘটনার কথা.
এরমধ্যে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি. পি আই এ-র করাচীর ফ্লাইটে সিট পাওয়া গেল জুলাইয়ের চার তারিখে. বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সুকঠিন, যাত্রী ছাড়া কাউকেই বিমান বন্দর এলাকায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না. কাজেই বাইরে থেকেই বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে হল. তার মধ্যে ছিল আবুল কালাম - যাকে আমি ডাকতাম কে-এল-এম বলে. সে পি-আই-এর এক দুর্ধর্ষ চাকুরে, তার কাছ থেকে আমি বহুবার ঢাকা-লাহোর আসা যাওয়ায় উপকার পেয়েছি. আসলে সে-ই আমাকে ঢাকায় অভ্যর্থনা করেছিল আমি যখন এখানে প্রথম আসি. কিন্তু আমাকে বিদায় জানাতে আজ সে-ও বিমান বন্দরে ঢুকতে পারল না !!
বন্দরে নাবিক
এই ছয় ঘন্টার ফ্লাইট আমাকে ক্লান্ত করে ফেলল. যুদ্ধের জন্য প্লেন ভারতের ওপর দিয়ে যেতে পারছিলনা, তাই লাহোর যেতে গেলে শ্রীলংকা হয়ে প্রথমে আসতে হত করাচী. করাচীর রানওয়েতে প্লেনের চাকা যখন স্পর্শ করল মনে হল যেন সমুদ্রে ভয়ংকর সাইক্লোন পেরিয়ে নাবিক পৌঁছল তার বন্দরে. লাহোরে রওনা হবার আগে
করাচীতে আমার চাচার বাসায় থাকলাম ক'দিন. লাহোরে কেউ আমাকে নিতে আসেনি কেননা আমি কাউকে আমার আসার কথা জানাই নি. লাহোর বিমান বন্দর থেকে পি আই এ-র বাসে করে গেলাম শহরে. পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা দুজন পাকিস্তানী সৈন্যও আমার সাথে করাচী থেকেই ছিল. বাস চলার সাথে সাথে একজন সৈন্য ড্রাইভারকে আদেশ করল বাসটাকে শহরের একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যেতে. এ হেন উদ্ভট আদেশে বাস ড্রাইভারের চক্ষু চড়কগাছ ! সে বলল বাস ক্যান্টনমেন্টে বাস স্টেশন পর্য্যন্ত যাবে, পথে যদি কোথাও সৈন্যেরা নামতে চায় তবে সে সেখানে বাস থামাতে পারে.
ড্রাইভারের একথায় সৈন্যেরা খুব রেগে গেল কারণ তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে, তারা ভাবতেও পারে না সাধারণ মানুষ তাদের আদেশ শুনবে না. তারা খুব উদ্ধতস্বরে বলল যা হুকুম করা হচ্ছে তাই করতে. ড্রাইভার তখনি সুইচ অফ করে বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করে বাস থেকে নেমে গেল. সে পি আই এ-এর অফিসারের সাথে ফোনে কথা বলল কারণ আর্মীর আদেশ পালন তার চাকরীর মধ্যে পড়ে না. অন্যান্য যাত্রীরা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল তারা এবারে সৈন্যদের বুঝিয়ে দিল যে, বাসটা চলে দুই বিশেষ স্টেশনের মধ্যে, অন্য কোথাও যাবার অধিকার ড্রাইভারের নেই. তাই সৈন্যেরা হয় নেমে যাক কিংবা বাস যেখানে যাবে সেখানে চলুক. সৈন্যের আর কি করবে - তারা ব্যাপারটা হজম করে ড্রাইভারকে তার নিয়ম মত চলার ইশারা করে বসে পড়ল. সৈন্যদের এই বেআইনী ও উদ্ধত ব্যবহারে অন্য যাত্রীরা অবাক হলেও আমি হইনি. কারণ বহুদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এটাই ঘটে এসেছে. অন্যদিকে, এতদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানে যা দেখেছি সেটাই আমার মনে স্বাভাবিক হিসেবে বসে গিয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের এই পরিবেশটাই আমার কাছে অস্বাভাবাবিক মনে হচ্ছিল. সৈন্যদেরও নিশ্চয়ই সেরকমই মনে হচ্ছিল. বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এখানে যা ঘটছে সেটাই হওয়া উচিত. চারদিকে সুখী, নিরুদ্বেগ ও হাসিখুশী মানুষেরা চমৎকার জীবন কাটাচ্ছে. জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কারো দুশ্চিন্তা নেই, নেই কোনো রক্তচক্ষু, নেই ঘন ঘন মানুষ খুন বা জ্বলন্ত দালান জ্বলন্ত শহর, নেই গোলাগুলি বা বোমার বুক কাঁপানো বিভৎস আওয়াজ. যে দোজখ থেকে এলাম তা থেকে এটা অনেক অন্যরকম জায়গা, অনেক ভালো জায়গা.
সত্যের ভয় ও সত্য-সন্ধানী
আমাকে পেয়ে আমার বাবা মায়ের কি যে আনন্দ হল সেটা যে কোনো মানুষ বুঝবে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব. আমার মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন - এতগুলো মাস ধরে তিনি আমার নিরাপত্তা ও মঙ্গলের দুশ্চিন্তায় না পেরেছেন ঠিকমত ঘুমোতে না খেতে. ভাইবোন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের তো কথাই নেই, সবাই আমাকে আনন্দে আত্মহারা. আনন্দ আমারও তো কম নয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি সুগভীর বিষন্ন ও নি:সঙ্গ. জীবনের স্বাভাবিকতা আমি হারিয়ে ফেলেছি তা স্পষ্ট. অনেক দিন ধরে আমি শুধু ভীত সন্ত্রস্ত বাচ্চার মত বসে আছি আমার কামরার এক কোণে. আগে টের পাইনি, গত কয়েক মাসের প্রতিটি দিন প্রতিটি কখন যে ভয়ানক ধকল, উদ্বেগ আর ত্রাসের মধ্যে দিয়ে পার করেছি তা বসে গেছে আমার রক্তে, ঢুকে গেছে আমার মনা মানস আর উপলব্ধির রন্ধ্রে রন্ধ্রে. মানুষ যখন জিজ্ঞাসা করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কি আমি শুধু চুপ করে থাকি. ভয় হয় ওদের বললে ওরাও আমার মত মানসিক রোগী হয়ে যাবে. সময় যখন আমার এই ক্ষত একটু একটু করে সরিয়ে তুলছে আমার একটু সাহস হল মুখ খুলতে. কিন্তু আমি অবাক হলাম - কেউই সত্য জানতে চায় না ! লোকে তাই শুনতে চায় যা আগে থেকেই তাদের মনে সত্য হিসেবে বসে আছে. এ হেন অবস্থায় চুপ করে থাকা আর উপায় কি.
জীবন বয়ে চলে স্বাভাবিকভাবেই - সেই চরম দিনরাতগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানে আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছিল তার ওপরে ধীরে ধীরে জমছে ধুলো - বইতে শুরু করেছে বিস্মরণের বাতাস. এমন সময় দেখা হল কিছু সত্য সন্ধানীর সাথে, তারা চাইল আমি যেন সবকিছু লিখে দেই. সেই কলম দিয়ে শুরু করলাম সেই নিদারুণ দিনগুলোর বিবরণ লেখা. তখন তো কলমই আমার সম্বল - পূর্ব পাকিস্তানের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের. বন্ধুদের আবেগপূর্ণ চিঠিগুলো আমার কি যে প্রিয় ছিল কিন্তু সেই সাথে সেগুলোতে ছিল অনেক তিক্ত সত্যও. সময়ের সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত নিযে আশংকাই বেড়ে উঠছিল কিন্তু তবু আমার মনে হচ্ছিল ওখানকার শিক্ষিত সমাজ পাকিস্তানের অখন্ডতাই ধরে রাখতে চাইবে; তারা পূব-পশ্চিমের ঐক্যে রাখতে পারবে অমূল্য অবদান.
চিঠি কথা বলে
পূর্ব পাকিস্তানে তখন কি ঘটছিল তার কিছুটা এই চিঠিগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে -
১. ১৫ই আগস্ট ১৯৭১
প্রিয় শাহিদ,
জীবনযাত্রা এখানে স্বাভাবিক হয়ে আসছে - শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষা কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরণ সত্বেও পরীক্ষা চলছে.
২. ২৫শে আগস্ট 1971
প্রিয় শাহিদ,
সময় হল বেদনা-ধ্বংসী সর্বশ্রেষ্ঠ মলম কথাটা কতটা সত্যি আমি জানিনা - কিন্তু এই ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে অনেক ক্ষতই সেরে উঠছে যদিও যন্ত্রনাটা রয়েই গেছে. বোমা-বিস্ফোরণ থামেনি - গতকাল বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বালিকাদের পরীক্ষাকেন্দ্রে. বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমত ক্লাস চলার ব্যাপারে সরকারের সহায়তা চেয়েছে. ক্লাস এখনো শুরু হয়নি, কিন্তু পরীক্ক্ষা চলছে এবং অনেক ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে. মনে হচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটবে না কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না. আম্মার বিরুদ্ধে জুনিয়র ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ এনেছে আমি নাকি পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া সমর্থন করছি. তাদের যুক্তি হল, যেহেতু সব ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে পারছে না কাজেই পরীক্ষা বন্ধ রাখাই যুক্তিযুক্ত.
৩. ০৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রিয় শাহিদ,
দু-একজন ছাড়া বাকি সব ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দ্দিয়েছে. বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে ক্লাস শুরু হয়েছে - আটটা হলের দুটো ছাত্রছাত্রীতে ভর্তি. বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছে. কিন্তু জনগনের মনে পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা দিন দিন বেড়েই চলেছে কারণ তাদের সাথে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত ব্যবহার করা হচ্ছে. এই পরিস্থিতিতে বোধহয় এরকম ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী. এই জন্যেই যাঁরা অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থনে কাজ করছেন তাঁরা চরম দ্বিধায় আছেন.
৪. ১২ই অক্টোবর ১৯৭১
বোমা বিস্ফোরণের সংখ্যা বেড়ে গেছে. কখনো সেটা এত বেশী যে মানুষ ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছে না. কয়েকদিন আগে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম নিউমার্কেটে. সেখানেও বোমা ফাটল. দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেল, মানুষজন ছুটোছুটি করে পালিয়ে গেল. সেটা বোমার ভয়ে যতটা নয় তার চেয়ে বেশী মুক্তিবাহিনী হিসেবে গ্রেপ্তার হবার ভয়ে. কিন্তু আধঘন্টা পরেই আবার যে কে সেই, দোকানপাট খুলে আগের মতই বেচাকেনা শুরু হয়ে গেল যেন কিছুই হয়নি. মাঝখান থেকে বোমার আঘাতে এক বেচারা রিকসাওয়ালা আহত হয়েছে
ওদিকে ঈদের গার্লস কলেজের সামনে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফেটেছে, কিন্তু ছাত্র সমাগম বন্ধ হয়নি.
৫. ২২শে অক্টোবর ১৯৭১
প্রিয় শাহিদ,
ক্রমাগত অন্তহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে থেকে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি. আশা করি পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে না - আমাদের নেতারা সমস্যার একটা সমাধান বের করবেন. আল্লাহ'র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের করুণা করেন.
স্বগ হইতে বিদায় - নরকের পথে ….
পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের সুখশান্তির আশা পূরণ হয়নি. ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর তাদের নয় মাস ধরে প্রতিটি দিন আরেক ভয়াবহ দু:স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যা সারা দেশের মারাত্মক ক্ষতি করেছে. এতে জাতির আত্মা আহত রক্তাপ্লুত হয়েছে, লজ্জায় শরমে আমাদের মাথা নীচু হয়ে গেছে. সবচেয়ে দু:খের কথা হল সবকিছু হারিয়েও আমরা শিখিনি কিছুই. এই ভয়ানক ট্রাজেডি'র পরেও আমরা তাই করছি যা আগে করেছি. এমনকি এখনও আমরা সত্য বলতে ভয় তো করিই, শুনতেও ভয় করি. এখনও আমাদেরকে ইসলাম ও দেশ্প্রেমের নামে ঠকানো হচ্ছে. এখনও জাতীয় সমস্যা সমাধানে আমরা আগেই মতই আবেগের পথ ধরছি আর আমাদের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যকে দোষারোপ করছি. সংক্ষেপে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে আমরা যে আত্মঘাতী পথে চলেছিলাম, এখনও আমরা সেই একই মারাত্মক পথেই চলছি. চারদিকে আজ নিকষ অন্ধকার; শুধু সুদুর দিগন্তে দেখছি একটা আবছা আলোর অস্পষ্ট রেখা. তা হল জাতির পরের প্রজন্ম. সেই প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কিছুই পায়নি শুধু বঞ্চনা আর অপমান ছাড়া. সেই অমিতবিক্রম প্রজন্ম একদিন শক্ত সবল হাতে জাতির ললাট থেকে এই লজ্জা, এই কলঙ্ক মুছে দেবে, ন্যায়ের পতাকা তুলে ধরবে সুউচ্চ এতে আমার কোন সন্দেহ নেই.
জানুয়ারী, ১৯৭২ সাল.
সমাপ্ত