সাম্প্রদায়িকতা : ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র

                                  সাম্প্রদায়িকতা  :   ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র

                                  হাসান মাহমুদ  - email:- This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. 

                                  উৎসর্গ: - নুসরাত জাহান রাফি’কে

                

দগ্ধমৃত মেয়েটা সারা জাতির আদরের পুতুল হয়ে উঠেছিল। এক মধ্যবিত্ত কিশোরী থানার পুলিশ কর্মকর্তার অপমান অসহযোগিতা অতিক্রম করে নারীখেকো দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাদ্রাসা-অধ্যক্ষের মুখে মামলা ছুঁড়ে মেরেছে, চিন্তা করা যায় !   

২০১৯ সালের ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা নুসরাত জাহান রাফি'র শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। প্রচণ্ড তেজী মেয়ে রাফি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা করলে অধ্যক্ষ তার অনুযারীদেরকে রাফিকে হত্যার নির্দেশ দেয় যারা ৬ এপ্রিল ২০১৯ আগুন দিয়ে রাফি'র ৮০% শরীর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। চারদিন অসহ্য যন্ত্রনার পরে রাফি ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়।   

এই মেয়েকে আমাদের দরকার ছিল। ৮০% অঙ্গার দেহে অসহ যন্ত্রনার মধ্যে যে মেয়ে মরতে মরতেও ক্রমাগত চিৎকারে ঘোষণা করেছিল “আমি সারা দেশের কাছে বলবো, সারা পৃথিবীর কাছে বলবো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য” – সেই পরাক্রান্ত বিদ্রোহীনিকে আমাদের বড়ো বেশী দরকার ছিল। এদেশের ঘরে ঘরে এমন বিদ্রোহীনির জন্ম হোক। 

৪ অক্টোবর ২০১৯ আদালত সিরাজউদ্দৌলা সহ ১৬ জন আসামীর প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।  কিন্তু সেটা কার্য্যকর করা হয়নি আজও - ১৮ই জুলাই ২০২২। 

সফেদ ডানার পরী !
সামিনা আমিন

সফেদ ডানার পরী, অগ্নিস্নানের শেষে
চলেই গেলে একেবারে না ফেরার দেশে?
বৈশাখী উৎসবে মুখরিত আজ
হাসি মুখে কান্না বুকে রব রব সাজ,
কি দিয়ে পূর্ণ করি তোমার প্রত্যয়?
ধরায় যে আজ শ্বাপদসংকুল সময় !

নীরব প্রতিবাদ ওই কণ্ঠে পেলো ভাষা
কি করে বলি, এখনো মেটেনি আশা,
এখনো লাল সবুজে মাটি কাঁপে বারবার,
এখনো মানুষ পথে নামে, মুখোশধারীদের করতে বিচার !
সফেদ ডানার পরী, তোমার ছোট্ট একটি প্রাণ,
তাই দিয়ে অন্ধকারে তুমি করেছো প্রমান
এখুনি না জ্বাললে আলো,
হবে না দুঃস্বপ্নের ইতি, ঘুচবে না কালো !

রয়েছি অপেক্ষায় আমি, গুনে যাই দিন,
আসবে কবে নতুন বর্ষ ফেরাবো তোমার ঋণ?
সেই দিন আর নয় পরী অনলে অনলে,
শুদ্ধ হবে এই মাটি নবধারা জলে !!

বৈশাখ ১৪২৬
ঢাকা

***************************************

মুখবন্ধ  

ইসলামে মানবাধিকার, শারিয়া আইন, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা সংশ্লিষ্ট সমকালীন বিষয়াদি নিয়ে এটা আমার ৪র্থ ও সম্ভবত: শেষ বই। জীবনে আমার সমস্ত কর্মকাণ্ড প্রধানত: ইতিহাসের এক মহাসত্য ঘিরে আবর্তিত। সে সত্য হল, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু থেকে পুরুষতন্ত্র চিরকাল অত্যন্ত ধূর্ততা, দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে কাজে লাগিয়েছে প্রথা, সাহিত্য, সংগীত, পোশাক, খাদ্য, আইন, ধর্ম ইত্যাদি যা কিছু পেয়েছে। ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে লক্ষ কোটি মা-বোনের অশ্রুস্রোতে, অপমানে, ক্ষোভে আর ক্ষতবিক্ষত লাশে। তাই আমাদেরকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারণ প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ ও প্রাণহরণকারী বিষের মধ্যে, সুর ও অসুরের মধ্যে ও ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে পার্থক্য মাত্র এক চুলের। এখানেই ধর্মগুরুদের ওপর কঠিন দ্বায়িত্ব বর্তায়। কারণ কম্পিউটারে ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টি ভাইরাস প্রোগ্রাম থাকে কিন্তু কোনো ধর্মগ্রন্থেই সেই ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে শব্দ বাক্যের উপদেশ ও পরকালে শাস্তির বিধান ছাড়া কোনো প্রতিরোধক নেই। কাজেই ধর্ম মানুষের মঙ্গল নাকি অমঙ্গল করবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কিভাবে ধর্মগুরুরা ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা করে তা সমাজে প্রয়োগ করছেন তার ওপরে।   

তাত্বিক আলোচনা অন্তহীন। কিন্তু গাছের পরিচয় তো তার ফলেই। এটা অনস্বীকার্য যে ইসলামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে, সেই সাথে "তোমারটা ভুল আমারটাই ঠিক, তুমি দোজখে যাবে" এসব বলারও প্রবণতা আছে। কিন্তু যেহেতু যার যেটা বিশ্বাস তার কাছে সেটাই পরম সত্য তাই ও দাবী অর্থহীন। বরং ইসলামের যে ব্যাখ্যায় শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত হয় সেটাই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, এই বিশ্বাসই আমার গবেষণা ও বইগুলোর মূল চালিকাশক্তি এবং এটা এসেছে কোরান থেকেই: -   

তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি- হজ্ব ৭৮, 

আল্লাহ তোমাদের সহজ করতে চান, তিনি তোমাদের কষ্ট চান না - বাকারা ১৮৫,

আল্লাহ তোমাদেরকে কোন প্রকার কষ্ট দিতে চান না - মায়িদা ৬।

অর্থাৎ রসূলের নামে যদি নিরপরাধের কষ্ট বা অপমান হয় তবে সেটা অবশ্যই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ওগুলোকে আমাদের অবশ্যই সাহসের সাথে বর্জন ও উচ্ছেদ করতে হবে। সেই সাথে আছে রসূল (স)-এর ব্যাপারে মুসলিমদের প্রতি উদ্যত তর্জনী আল কোরান - "সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত, তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার জীবন-ধমনী" - সূরা হাক্কাহ ৪৪- ৪৬। অর্থাৎ রসূলের নামে যদি কোরান-বিরোধী কিছু প্রতিষ্ঠিত করা হয় তবে সেটা অবশ্যই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ওগুলোকে আমাদের অবশ্যই সাহসের সাথে বর্জন ও উচ্ছেদ করতে হবে।  

চোদ্দশ' বছর ধরে ইসলামে মানবাধিকারের ব্যাপারে আমরা অনেক দাবীই করেছি কিন্তু তার অনেকটাই প্রমাণ তো করতে পারিই নি বরং বাস্তবে তা উল্টো প্রমাণিত হয়েছে। এখানে এসেই আত্মসমালোচনা অর্থাৎ নিজেদের পারফরম্যান্স রিভিউ জরুরী হয়ে পড়ে। সমস্যাটা হল, ইসলাম-বিরোধীদের চুন খেয়ে আমাদের মুখ এতটাই পুড়েছে যে এখন আত্মসমালোচনার দই দেখলেও আমরা আঁৎকে উঠি আর নিজেদের ব্যর্থতাগুলোকে অস্বীকার করার চেষ্টা করি। ফলাফল পরস্পরের বিরুদ্ধে অবধারিত গালাগালি ও হুংকার। কিন্তু, অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ হয়না, তাই আত্মসমালোচনার বিকল্প নেই।

ইসলামে মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কিছু ইসলামী ও মানবাধিকার সংগঠনের সাথে দীর্ঘকাল কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে, তাই কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এখানে আমরা ভদ্রভাবে বিতর্ক-আলোচনায় অভ্যস্ত। অনেকবার অনেক দেশে এবং ক্যানাডিয়ান টিভিতে মওলানা মুফতির সাথে আমার শারিয়া নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছিল শালীন, বিতর্কের আগে পরে আমরা একসাথে ভদ্রভাবে অনেক আলোচনাও করেছি। বাংলাদেশে সে আবহ নেই।

আমাদের গণমানসে ধর্মীয় সামাজিক রাজনৈতিক অঙ্গনে গত কয়েক দশকে প্রবল বিবর্তন ও মেরুকরণ হয়েছে। বলতে গেলে জাতির মনমানসটাই সম্পূর্ণ বদলে গেছে অনেক দিক দিয়ে।

অর্থনীতিতে কালো টাকা যেমন ভালো টাকাকে তাড়িয়ে দেয় তেমনি সম্প্রতি দেশে উগ্র নেতৃত্বের চাপে শান্তিকামী নেতৃত্ব কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। উগ্রতা ও হিংস্রতা নেতা থেকে সমর্থকদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। কিছু উগ্র আলেম ও উগ্র রাজনীতিক এক মারাত্মক হিংস্র জনতা সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের পক্ষেও এখন আর এই হিংস্র জনতাকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়। এর সাথে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধর্মীয় ব্যক্তি সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা। মানবজাতির কাছে, বিবেকের কাছে এমনকি ধর্মের কাছেও তাঁদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। মানবের পৃথিবী ক্রমশ: দানবের হয়ে উঠেছে, জানিনা এ অন্ধকার দূর হতে কত শতাব্দী লাগবে।   

বইয়ের নিবন্ধগুলোর বেশীরভাগই বিডিনিউজ২৪কম এর মতামত বিভাগে প্রকাশিত, তাঁদেরকে ধন্যবাদ। সবচেয়ে বেশী ধন্যবাদ প্রকাশককে, তাঁর চাপ না থাকলে এ বইয়ের জন্ম হতোনা। 

************************************

সূচিপত্র: -

১। আল্লামা'র বহুবিবাহ, "কাব্যের উপেক্ষিতা" ও ডিমের দোকান 

২। ইসলামে পুনর্বিবাহ - জানা অজানা   

৩। বাবরি-ষড়যন্ত্র: নেপথ্যের ত্রিমূর্তি  

৪। মোদী’র হিন্দুরাষ্ট্র বনাম বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র    

৫। করোনা-বিদ্ধ জাকাত    

৬। তুরস্কের হায়া সোফিয়া – ‘ইসলামের বিজয়’?  

৭। হায়রে ভজনালয়!         

৮। মহামারী ফতোয়ার এপিঠ ওপিঠ: করোনা   

৯। বিশ্বসেরা আলেমদের মতে ইসলামে সংগীত হারাম নয়    

১০। ধর্ষণ উচ্ছেদ - কবি নির্মলেন্দু গুণ ও শারিয়া আইন

১১। তুমুল বিতর্ক - আল্লাহ'র কোরান কোথায়?      

১২। অদ্যপি ধাবমান!    

১৩। নিউইয়র্ক - গ্রাউণ্ড জিরো মস্ক ও শান্তির মূল্য   

১৪। একাত্তর- গোপন রণাঙ্গনের নিঃসঙ্গ সেনাপতি   

১৫। প্রতিমা বনাম ভাস্কর্য: হাদিস ও কোরানের রেফারেন্স   

১৬। ভাস্কর্য ভাঙচুর-উসকানি: রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এবং মদিনা সনদ   

১৭। প্রতিমা বনাম ভাস্কর্য: খেলাফত কালে মুদ্রায় মসুলিম গভর্নরের মুখচ্ছবি                   

১৮। ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (১): প্রেক্ষাপট ক্যাসিনো ক্রাইম   

১৯। ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (২): কে মুসলিম, কে নেতা?  

২০। ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (৩): আবারও জঙ্গি?     

২১। হাদিসের হদিস – “ফেস দি পিপল” টিভিতে "মহা-বিতর্ক" 

২২। নিহত “বিশ্ব-খলিফা”: আমেরিকা! আমেরিকা?

২৩। ইসরায়েল-ফিলিস্তীন : শত্রুমিত্র চিনলিনা রে মন !! 

***********************************

আল্লামা'র বহুবিবাহ, "কাব্যের উপেক্ষিতা" ও ডিমের দোকান 

১৯ এপ্রিল ২০২১

ছোটবেলায় খেলতে বাইরে যাবার সময় মা কখনো টাকা দিয়ে বলতেন - "যদি দোকান খোলা পাও তবে ডিম কিনে এনো"। দোকান খোলা পেলে আমি ডিম কিনতাম, বন্ধ থাকলে কেনা সম্ভব হতোনা।  

"যদি" ও "তবে"-র এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটা মাথায় রেখে চলুন সামনে এগোই।   -

হুলুস্থুল হয়ে যাচ্ছে আল্লামা মামুনুল হককে নিয়ে। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব সহ অনেকগুলো প্রকাণ্ড কুরসী অলংকৃত করেন। ০৩ এপ্রিল ২০২১ দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রয়্যাল রিসোর্টে গেলে তাঁকে অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করা হয়। সেই থেকে তাঁকে নিয়ে নিত্যনতুন খবরে পত্রিকা, ফেসবুক, বাংলাদেশী ইউটিউব চ্যানেলগুলো ভাতের হাঁড়ির মতো টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু ঘটনার ঝড়ে অন্তরালে রয়ে গেছে তাঁর অভিজাত বংশের প্রথমা স্ত্রী ব্যক্তিত্ব-সম্পন্না আমিনা তৈয়েবা’র অশ্রু, দুঃখ এবং ক্ষোভ। তিনি প্রথমে আল্লামা'র দ্বিতীয় (এবং তৃতীয়??) বিয়ের কথা জানতেনই না কারণ শারিয়া মোতাবেক সেটা তাঁর জানবার অধিকারই নেই, অনুমতি বা বাধা দেয়া তো দূরের কথা। তাই তাঁকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেন নি আল্লামা। তাঁর স্তম্ভিত ক্ষুব্ধ সন্তানেরা দেখল, যে মায়ের পায়ের নীচে তাদের বেহেশত সেই মায়ের ঘরে সতীন/রা এসেছে কিন্তু তিনি তা জানারও অধিকার রাখেন না। কবিগুরুর বিখ্যাত নিবন্ধে ঊর্মিলার মতো, প্রিয়ংবদা আর অনসূয়ার মতো, পত্রলেখার মতো তিনি লক্ষ কোটি নিভৃত ক্রন্দসী "কাব্যের উপেক্ষিতা"-দের একজন।       

"যদি" এটা হয় "তবে" ওটা করবে, এটা একটা অবিচ্ছেদ্য শর্তসাপেক্ষ ক্রিয়া যার একটাকে অন্যটা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না। কোরান এই অবিচ্ছেদ্য শর্তসাপেক্ষে বহুবিবাহকে বৈধ করেছে সূরা নিসা আয়াত ৩-এ:- "যদি তোমরা ভয় কর যে এতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করিতে পারিবে না তবে সেইসব মেয়েদের মধ্য হইতে যাহাদিগকে ভাল লাগে তাহাদিগকে বিবাহ করিয়া নাও দুই, তিন বা চারিটি পর্যন্ত।"। স্পষ্টত:ই বহুবিবাহের অনুমতিতে এতিমদের জড়িত থাকার এই অবিচ্ছেদ্য কোরানিক শর্তটা মানুষ সৃষ্ট হরেকরকম দলিল ও ব্যাখ্যা দ্বারা বেমালুম গায়েব করা হয়েছে। কথাটা আমার নয়, কথাটা আমীর আলী, মওলানা ওমর আহমদ ওসমানী, এ.ভি.মীর আহমেদ, জাস্টিস আফতাব হোসেন ইত্যাদি অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞের। সতীনের সংসার মানেই নরক। কোরান সেই নরক বৈধ করেছে একটা তাৎক্ষণিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে, চিরকালীন নয়। একবার আপনার হাতের আঙ্গুল কেটেছিল। আপনি ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছিলেন, ক্ষতটা সেরে গিয়েছিল।  আপনি কি আজীবন ব্যাণ্ডেজ বেঁধে রাখবেন? নিশ্চয়ই না! এটাও সেই রকমই তাৎক্ষণিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান, চিরকালীন নয়। নিসা ৩-এর আগেপরের আয়াতগুলোতে এতিমের স্বার্থরক্ষায় কোরানের ব্যাকুলতা সুস্পষ্ট। ওহুদ যুদ্ধে অনেক সাহাবী নিহত হলে অনেক এতিম হয়েছিল যাদের স্বার্থরক্ষার দরকার ছিল। দলিল জানাচ্ছে –

“আয়েশা (রাঃ)-কে আয়াতটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন − অনেক সময় এতিম মেয়ে ধনশালী ও সুন্দরী হইলে অভিভাবক নিজেই উপযুক্ত মোহর না দিয়া তাহাকে আপনার হওয়ার সুবাদে বিবাহ করে কিন্তু এতিম বালিকা ধনবান না হইলে বা সুন্দরী না হইলে সেইরূপ করে না। এই অন্যায় রহিত করণার্থেই এই আয়াত নাজিল হইয়াছে” - বাংলাদেশ লাইব্রেরী প্রকাশিত আবদুল করিম খানের সঙ্কলিত সহি বোখারি হাদিস ২৪২৮।

কাজেই, যেখানে এতিমদের ওপরে “এই অন্যায়”নেই সেখানে কোরানের বহুবিবাহের নির্দেশ খাটেনা, এই সিম্পল সত্যটা বুঝতে আইনষ্টাইন হতে হয়না। একই হাদিস আছে ডঃ মুহসিন খানের বোখারি-অনুবাদ ৭ম খণ্ড, হাদিস ৩৫, ৫৯ ও ৬২। একারণেই স্বয়ং রসূল (স) হযরত আলীকে (র) দ্বিতীয় বিয়ে করতে দেননি, একবার নয় দু'দুবার – একবার আবু জেহেলের কন্যাকে আরেকবার হিশাম ইবনে মুগীরার কন্যাকে। কারণ দু’কন্যার কেউই এতিম ছিলনা। দেখুন একই বাংলা-সহি বোখারি:-

হাদিস ২৪৭২ − “আলী (রাঃ) আবু জেহেলের কন্যাকে বিবাহ করার পয়গাম পাঠাইয়াছে জানিতে পারিয়া ফাতেমা (রাঃ) রসুলুলাহ (দঃ)-এর নিকট গিয়া বলিলেন − আপনার আত্মীয়স্বজনগণ বলিয়া থাকে যে আপনি আপনার মেয়েদের পক্ষ হইয়া একটু রাগও দেখান না। ঐ দেখুন আলী (রাঃ) আবু জহলের কন্যাকে বিবাহ করিতে চাহিতেছে। রসুলুলাহ (দঃ) বলিলেন - ‘নিশ্চয় ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা। তাহার ব্যথায় আমি ব্যথিত হই। নিশ্চয়ই আমি হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করিতে চাহি না। অবশ্য এই কথা বলিতেছি যে, আল্লাহ’র কসম! আল্লাহ’র রসুলের কন্যা এবং আল্লাহ’র শত্রুর কন্যা একই ব্যক্তির বিবাহে একত্রিত হইতে পারিবে না’। এই ভাষণের পর আলী (রাঃ)বিবাহের প্রস্তাব পরিত্যাগ করিলেন।” এটা আছে মুহসিন খানের অনুদিত বোখারী ৪র্থ খণ্ড হাদিস ৩৪২ ও ৫ম খণ্ড হাদিস ৭৬ ও ৭ম খণ্ড ১৫৭।

হাদিস ২৪৭৩ - হজরত মেসওয়ার ইবনে মাখরামা (রাঃ) জানাচ্ছেন “আমি রসুলুলাহ ((স)-কে মিম্বরে বসিয়া বলিতে শুনিয়াছি − হিশাম ইবনে মুগীরা আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ)-এর নিকট তাঁহার মেয়ে বিবাহ দেওয়ার জন্য আমার নিকট প্রস্তাব করিয়াছে। কিন্তু আমি অনুমতি দিই নাই এবং আলী (রাঃ) আমার কন্যা ফাতেমা (রাঃ)কে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত আমি অনুমতি দিব না। কেননা ফাতেমা হইতেছে আমার শরীরের অংশ। আমি ঐ জিনিস ঘৃণা করি যাহা সে ঘৃণা করে এবং তাহাকে যাহা আঘাত করে তাহা আমাকেও আঘাত করে।”হাদিসটা পাবেন, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মহসিন খানের অনুদিত সহি বুখারি, ৭ম খণ্ড, ১৫৭।  

ইচ্ছে হলেই বহুবিবাহ করা যাবে এটা কোরানের নির্দেশ হলে রসূল (স) ও বিবি ফাতেমা (র) হযরত আলীর বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতেন কি? না, পারতেন না। দুনিয়ার প্রতিটি মুসলিম নারী বিশ্বনবীর (স) কলিজার টুকরা। তিনি তাঁর অনাগত অগণিত সমস্ত কলিজার টুকরাকে সতীনের সম্ভাবনায় ঠেলে দেবেন এবং নিজের মেয়েকে রক্ষা করবেন এমন ব্যাখ্যা তাঁকে অপমান করা ছাড়া কিছু নয়। অথচ আমরা সেটাই করছি যা উনি করেননি, ইচ্ছে হলেই বহুবিবাহ - তাঁর ভাষায় “হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল”।

নিসা ১২৯ ও ১২৭-তেও আছে একাধিক স্ত্রীদের মধ্যে কেউই সমতাপূর্ণ আচরণ করতে পারবে না এবং বহুবিবাহের বিধানটা অবশ্যই এতিম সংশ্লিষ্ট। কোরান হল "কেতাবুম্মুবিন" অর্থাৎ ‘সুস্পষ্ট কেতাব’ (আনআম-৫৯, ইউনুস-৬১, নাহল-৮৯, কাহ্ফ-১, যুমার-২৭,২৮, কামার-১৭, ২২, ৩২, ৪০, বাকারা-২২১, ইমরান-১১৮ ইত্যাদি)। ইসলাম হল “সিরাতুল মুস্তাকিম” অর্থাৎ সহজ সরল পথ। এই সহজ সরল পথ-এর সুস্পষ্ট কেতাবের সুস্পষ্ট নির্দেশটা উল্টে দেবার জন্য আমরা কত পরিশ্রমই না করেছি, কত যুক্তি কত দলিলই না দেখাচ্ছি! নারীর সংখ্যা নাকি পুরুষের বেশী। কত বেশী? চারগুন? তিনগুন? দ্বিগুন? আসলে এর ধারেকাছেও তো নয়! ইন্টারনেটে “Human sex ratio” দেখলেই পাওয়া যাবে প্রকৃতি তার ভারসাম্য ঠিকই বজায় রেখেছে, পুরুষের শিশুমৃত্যু, যুদ্ধ বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু সবকিছু ধরার পরেও দুনিয়ায় অন্যান্য প্রাণীর মতোই পুরুষ-নারী মোটামুটি সমানে সমান।   

"Like most sexual species, the sex ratio in humans is close to 1:1. In humans, the natural ratio between males and females at birth is slightly biased towards the male sex, being estimated to be about 1.05 or 1.06 or within a narrow range from 1.03 to 1.06 males/per female born".    

বিখ্যাত আলেম আল্লামা মুতাহহেরি বহুবিবাহের সমর্থক, কিন্তু তাঁর “উয়োম্যান অ্যাণ্ড হার রাইট্স্” বইয়ের পৃঃ ২৪৬-তে আছে - "জাতিসঙ্ঘের ১৯৬৪ সালের তালিকায় আছে কোরিয়া, রাশিয়া, বিলাত, ফ্রান্স, জার্মানী, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যাণ্ড, রুমানিয়া, হাঙ্গেরী, এবং আমেরিকায় নারীরা গড়পড়তায় ৫২%, পুরুষ ৪৮%"।  অর্থাৎ চার পর্যন্ত যাবার দরকারই নেই, ৫২কে ৪৮ দিয়ে ভাগ করলে যা হয় সেই ভগ্নাংশই যথেষ্ট।  এর পরে আছে যেসব দেশে পুরুষ বেশী, যেমন - “ইরাণ ব্যতিক্রম। সেখানে গত জরীপে পুরুষের সংখ্যা নারীর চেয়ে বেশি দেখা গেছে” (ঐ, পৃঃ ২৪৭)।  কিন্তু ইরানে বহুবিবাহ তো নিষিদ্ধ নয়ই বরং গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত মু’তা বিয়েও সরগরম চালু আছে।  তাই, "সংখ্যাতত্ব" মানলে খুব বেশী হলে দুটি স্ত্রীই তো যথেষ্ট।

কিন্তু তাহলে কোরান চার স্ত্রী পর্যন্ত বৈধ করল কেন? রহস্যটা কি?

কোনো রহস্য নেই। কোরান একটা তাৎক্ষণিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়েছে মাত্র, চিরকালের জন্য নয়। মনে আছে ছোটবেলায় একবার আপনার আঙ্গুলের চামড়া কেটে গিয়েছিল বলে আপনি ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছিলেন? তারপর ক্ষতটা সেরে গেছে সেই কবে আর আপনি সারা জীবন ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

এর পরেও "যুক্তি" দেখানো হয় নারীরা বাঁজা হতে পারে, এমন অসুখ হতে পারে কিংবা মাসে এক সপ্তাহ এবং বাচ্চা জন্ম দেবার ব্যাপারে লম্বা সময় ধরে সংসর্গ সম্ভব নয়, পুরুষের “চাহিদা” নাকি নারীর চেয়ে ৯৯গুণ বেশী, বহুবিবাহ পাশ্চাত্যে যৌনতার প্লাবনের চেয়ে ভালো ইত্যাদি। আমার মনে হয়না এগুলো নিয়ে আলোচনার দরকার আছে, দুটো ছাড়া। (১) নারীরা বাঁজা হতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলামের বৈধ পদ্ধতি ইজতিহাদ তো আছেই, এক্ষেত্রে স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি তো দেয়া যেতেই পারে। কিছু মুসলিম দেশে এ আইন আছেও, আমাদের সরকারেরও এ আইন করা উচিত। প্রতিটি বিবাহিতা মুসলিম নারীর জীবন ও সম্মান আজীবন তার স্বামীর মর্জির ওপরে ঝুলে থাকবে এটা কোনো কাজের কথা নয়। (২) পাশ্চাত্যে যৌনতার প্লাবন। পরাক্রমশালী প্রযুক্তির ফলে যৌনতার প্লাবন এখন বিশ্বগ্রাসী, বহুবিবাহ দিয়ে সেটা ঠেকানোর প্রশ্নই ওঠেনা। দীর্ঘকাল মধ্যপ্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে বাস করার অভিজ্ঞতায় আমি জানি ওদের অবস্থা পাশ্চাত্যের চেয়ে মোটেই ভালো নয়। অজস্র উদাহরণ দিতে পারি কিন্তু তাতে ওদেশের সাথে আমাদের কূটনৈতিক ঝামেলা হতে পারে।  

নারীবান্ধব বহুবিবাহের আইন দেখাচ্ছি প্রাচীন সভ্যতা আসিরিয়ান এবং ব্যাবিলনিয়ান হাম্মুরাবী আইন থেকে:-

(ক) স্ত্রী যদি সন্তানধারণ করিতে পারে তবে স্বামী তাহাকে তালাক দিতে পারিবে না।

(খ) স্ত্রী যদি সন্তানধারণ না করে তবে স্বামী তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারিবে কিন্তু স্বামী তাহাকে ঐ সকল কিছুই ফিরাইয়া দিবে যাহা কিছু সেই স্ত্রী বিবাহকালে আনিয়াছিল, এবং সারাজীবন স্ত্রীর খরচ বহন করিবে।

(গ) স্ত্রী যদি সন্তানধারণ না করে তবে সে স্বামী বিবাহ করিতে পারে কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী কোন ব্যাপারেই মর্যাদায় প্রথম স্ত্রীর সমান হইবে না।

ইত্যাদি। সূত্র: - "ড্রাইভার অ্যাণ্ড মাইলস"-এর “ল’জ ফ্রম মেসোপটমিয়া অ্যাণ্ড এশিয়া মাইনর” এবং ওমস্টেড-এর “হিস্ট্রি অব্ আসিরিয়া”- আইনের অধ্যাপক ডঃ আনোয়ার হেকমত-এর “উইমেন অ্যাণ্ড দ্য কোরাণ”পৃঃ ১৫৩ ও ২৪১-২৪৩।

নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে ইতিহাসের শুরু থেকে পুরুষতন্ত্র অত্যন্ত ধূর্ততা, দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে কাজে লাগিয়েছে প্রথা, সাহিত্য, সংগীত, পোশাক, খাদ্য, আইন, ধর্ম ইত্যাদি যা কিছু পেয়েছে। তাই আমাদেরকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। যে মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত তিনি কেন শাফি’ শরিয়া আইনে সন্তানের বিয়েতে অভিভাবক তো দূরের কথা পুরুষের সমান সাক্ষী পর্যন্ত হতে পারবেন না সে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতে হবে। বিয়েতে নারীসাক্ষী অবৈধ, ১ জন পুরুষ ও ২জন নারী হলেও অবৈধ – আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সত্যায়িত শাফি’ আইনের কেতাব “উমদাত আল সালিক” আইন নং m3.3, আইনে আইনে বিরোধ - বিয়েতে ২জন পুরুষ বা ১জন পুরুষ ও ২জন নারী সাক্ষী বৈধ – বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন (প্রধানত: হানাফি আইনভিত্তিক) ১ম খণ্ড পৃঃ ১৩৬, ধারা ২৬৬ গ ও ২৭২।

১৪০০ বছর ধরে আমরা বন্ধ দোকান থেকে ডিম কিনেছি। কোন প্রাণীর ডিম কিনেছি তার প্রমাণ আছে লক্ষ কোটি "কাব্যের উপেক্ষিতা" আমিনা তৈয়েবা-দের নিভৃত অশ্রুস্রোতে, অপমানে আর ক্ষোভে। এর অবসান হওয়া দরকার, অন্যান্য কিছু মুসলিম দেশের মতো আইন করে বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রিত করা দরকার।               

***************************

ইসলামে পুনর্বিবাহ - জানা অজানা

০৩ এপ্রিল ২০২১

শৈশবে আপনার বাবা-মা'র সংসার ভেঙে গেলে আপনার কেমন লাগত? কিভাবে বড়ো হতেন? আতংকে শরীর শিউরে উঠছে, তাই না?

ধরুন বৌয়ের সাথে আবদুল্লা'র বিধি মোতাবেক পুরো তালাক হয়ে গেছে, এখন ওরা আবার সংসার করতে চায়। ওদের চার বছরের একটা ছেলে আর দু'বছরের একটা মেয়ে আছে। ওই অসহায় নিষ্পাপ শিশুদুটোর চোখের দিকে তাকান।

কি মনে হয়?

চলুন, সামনে এগুনো যাক।     

জানা পর্ব

ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদের কয়েকটি পদ্ধতি আছে যেমন বিভিন্ন পদ্ধতিতে স্ত্রীকে স্বামীর তালাক দেয়া বা স্ত্রী আদালতে আবেদন করে শারিয়ার "খুলা" আইনের মাধ্যমে সম্ভব হলে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করা। পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলেমদের কিছুটা মতভেদ আছে, কিন্তু এ নিবন্ধের বিষয় হল চূড়ান্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর একই স্বামী স্ত্রীর পরস্পরের সাথে পুনর্বিবাহ। এরকমটা ঘটে বাস্তবে। অনেক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রী মনে করেন তালাকের সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল, সংসারটা চালিয়ে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তো তাদের জন্য এর বিকল্প নেই, বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বাবা মা দুজনই দরকার। তখন তাদের পুনর্বিবাহের জন্য বিশ্ব-মুসলিম অতীত বর্তমানে মেনে চলেছে সংশ্লিষ্ট শারিয়া আইন যা বানানো হয়েছে সূরা বাকারা আয়াত ২২৯ ও ২৩০-এর ভিত্তিতে। সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে দিচ্ছি :-

“তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে ……..যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে এরপর সেই পুরুষের পক্ষে সেই স্ত্রী হালাল হবেনা যে পর্যন্ত না সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে উভয়ের পুনরায় মিলিত হওয়াতে গুনাহ নেই"।

অর্থাৎ তালাক পুরো হয়ে গেলে তারা সরাসরি পরস্পরকে আবার বিয়ে করতে পারবে না, স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে করতে হবে। এটাই আমরা জানি, এটাই প্রচলিত। কিন্তু ঠিক কি চরিত্রের স্বামীর কোন সে ঘটনায় বাকারা আয়াত ২২৯ নাজিল হয়েছিল? ইরানের নিশাপুরে ১০০০ সালের দিকে জন্মেছিলেন বিখ্যাত ইমাম আল ওয়াহিদি, তাঁর সুবিখ্যাত কেতাব "আসবাব আল নুজুল" (“আয়াত নাজিলের শ্রেষ্ঠ বিবরণ”) ইসলামে দলিলের এক অনন্য নির্ভরযোগ্য কেতাব যাতে কোরানের অনেক আয়াতের পটভূমি ধরা আছে। সংক্ষেপে কেতাবের ২৩ পৃষ্ঠা থেকে সূরা বাকারা আয়াত ২২৯-এর পটভূমি তুলে দিচ্ছি। ইসলামে "ইদ্দত" হল অন্যত্র বিয়ের আগে স্ত্রীর অপেক্ষা-কাল, সাধারণত: তিন মাসিক। 

"(বর্ণনাকারী অনেক সাহাবীদের সনদ) বলিয়াছেন, 'ইহাই প্রচলিত ছিল যে, স্ত্রীকে তালাক দিবার পর ইদ্দত শেষ হইবার পূর্বে স্বামী তাহাকে ফিরাইয়া লইতে পারিত, হাজার বার তালাক দিলেও (অর্থাৎ যতবার ইচ্ছা - লেখক)। এক বিশেষ সাহাবী (কেতাবে সাহাবীর নাম নেই - লেখক) তাহার স্ত্রীকে তালাক দিল এবং ইদ্দত শেষ হইবার ঠিক আগে তাহাকে ফিরাইয়া লইল। ইহার পরপরই সে আবার স্ত্রীকে তালাক দিল এবং বলিল - 'আল্লাহ'র কসম! আমি তোমাকে ফিরাইয়াও লইব না এবং কখনোই অন্য কাহাকে বিবাহ করিতেও দিবনা'। তখন মহান আল্লাহ নাজিল করিলেন - 'তালাক উচ্চারণ অবশ্যই দুইবার; ইহার পর তাহাকে সম্মানের সহিত রাখিবে কিংবা সদয়ভাবে মুক্ত করিতে হইবে' (মাস্ট বি রিটেইন্ড ইন অনার অর রিলিজড ইন কাইন্ডনেস)”। 

সেই সাথে আছে রসূল (স)-এর ব্যাপারে মুসলিমদের প্রতি উদ্যত তর্জনী আল কোরান - "সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত, তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার জীবন-ধমনী" - সূরা হাক্কাহ ৪৪- ৪৬। অর্থাৎ রসূলের নামে যদি কোরান-বিরোধী কিছু প্রতিষ্ঠিত করা হয় তবে সেটা অবশ্যই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ওগুলোকে আমাদের অবশ্যই সাহসের সাথে বর্জন ও উচ্ছেদ করতে হবে।  

তালাক-বিয়ের এই নারীবিরোধী বিষচক্র চক্র দুবারের বেশী করা যাবেনা, এই হুকুম প্রসারিত হয়েছে পরের আয়াতেই - অত্যাচারী স্বামীর সেই স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করে সেখান থেকে বিধিমতো তালাক বা সেই স্বামীর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই তাকে ফিরিয়ে নেবার- আয়াত ২৩০।      

অর্থাৎ স্ত্রীদের সম্মান, অধিকার ও জীবন নিয়ে অত্যাচারী স্বামীদের শতাব্দী প্রাচীন ইঁদুর-বেড়াল খেলার কুপ্রথাকে কোরান বজ্রাঘাতে উচ্ছেদ করেছে। আমি বুঝতে অক্ষম যাঁরা কোরানকে নারী-বিরোধী বলেন তাঁরা কেন এই দলিলগুলো উল্লেখ করেন না। অন্যদিকে, আয়াতটা অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে নারীর রক্ষাকবচ কিন্তু ওটা প্রয়োগ হয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে, এমনকি প্রেমময় স্বামীর ক্ষেত্রেও।

আয়াত ২২৯ ও ২৩০ এই যে - "যে পর্যন্ত না সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে"- নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল অন্য কাউকে বিয়ে করার বা না করার। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এর বর্বর প্রয়োগ আমরা দেখেছি তালাকের পর হিল্লা বিয়ের নামে নারীকে জোর করে অন্যের সাথে বিয়ে দিয়ে তার বিছানায় পাঠানো হত। এটা ইসলামের নামে ধর্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুখের বিষয় অনেক আলেম এ বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে শক্তিশালীভাবে দাঁড়ানোর ফলে ধীরে ধীরে এটা মোটামুটি উচ্ছেদ হয়েছে। আগের প্রজন্মরা যেটা ইসলামী মনে করে প্রয়োগ করতো, বর্তমান প্রজন্ম বুঝে গেছে আসলে ওটা ইসলামী নয়। সমাজ এভাবেই এগোয়।     

অজানা পর্ব

অতীত বর্তমানের বেশ কিছু স্কলার ও আলেমদের এখানে ওখানে প্রকাশিত কিছু বিচ্ছিন্ন নিবন্ধে এটা আমি পড়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়নি, গণমানসে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটাই তুলে ধরছি মাত্র, এর বেশী কিছু বলার অধিকার আমার নেই। সূরা বাকারা আয়াত ২৩২:-

"যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও, তারপর তাদের ইদ্দৎ পূর্ণ হয়ে যায়, সে অবস্থায় তারা স্বামীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে তাদেরকে বাধা দিও না যখন তারা বৈধভাবে উভয়ে আপোষে সম্মত হয়"- তাইসিরুল কুরআন। 

  • Yusuf Ali: When ye divorce women, AND THEY FULFILL the term of their ('Iddat), do not prevent them from marrying their (former) husbands, if they mutually agree on equitable terms.
  • Sahih International: “And when you divorce women AND THEY HAVE FULFILLED their term, do not prevent them from remarrying their [former] husbands if they agree among themselves on an acceptable basis”.
  • Mustafa Khattab, the Clear Quran – “When you have divorced women AND THEY HAVE REACHED THE END of their waiting period, do not prevent them from re-marrying their ex-husbands if they come to an honourable agreement”.
  • Pickthall: “And when ye have divorced women AND THEY REACH their term, place not difficulties in the way of their marrying their husbands if it is agreed between them in kindness”.
  • Shakir: “And when you have divorced women AND THEY HAVE ENDED their term (of waiting), then do not prevent them from marrying their husbands when they agree among themselves in a lawful manner”.
  • Mohsin Khan: “And when you have divorced women AND THEY HAVE FULFILLED THE TERM OF THEIR PRESCRIBED PERIOD, do not prevent them from marrying their (former) husbands, if they mutually agree on reasonable basis”.
  • Arberry: “When you divorce women, AND THEY HAVE REACHED THEIR TERM, do not debar them from marrying their husbands, when they have agreed together honourably”.

(Emphasis mine).

 

কি দাঁড়ালো তাহলে?

 

কোন ঘটনায় নাজিল হয়েছিল সূরা বাকারা আয়াত ২৩২? সংক্ষেপে তুলে ধরছি "আসবাব আল নুজুল" কেতাব থেকে, পৃষ্ঠা ২৪: -

 

সাহাবী মাকাল বিন ইয়াসার তার বোনকে তার কাজিনের সাথে বিয়ে দিল, যে স্বামী পরে সেই স্ত্রীকে তালাক দিল। তারপরে তারা আবার বিয়ে করতে চাইলে ক্রূদ্ধ মাকাল তাতে প্রচণ্ড বাধা দিল। তখন এই আয়াত নাজিল হয় - "যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করে, তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না"। আয়াত নাজিলের পরে মাকাল সম্মত হয় ও আবার তাদের বিয়ে হয়।         

তাহলে?

"দুইটি প্রেমময় হৃদয়ের মধ্যে বিবাহ হইতে উত্তম আমি আর কিছু দেখি না" - সহি ইবনে মাজাহ, ৩য় খণ্ড হাদিস ১৮৪৭। রহমাতুল্লিল আল আমিন যদি হতে হয় তবে সেটা এই, সেটা এইখানে। ভ্রান্তিময় মানুষ ভুল করতেই পারে কিন্তু অনুতাপের পরে স্বামী স্ত্রী, বাচ্চাদের জীবন ধ্বংস হবে কেন?

“…তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ্ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না ………দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি” - সূরা বাকারা ১৮৫ ও হজ্ব ৭৮।

মুদ্রার দুই পিঠই দেখানো হল। এখন যে যার সিদ্ধান্ত নিক।

সবাইকে সালাম। 

****************************************

বাবরি-ষড়যন্ত্র: নেপথ্যের ত্রিমূর্তি 

৩০ মে, ২০২০

(ধর্ম নিয়ে ষড়যন্ত্র চিরকালই হয়েছে কিন্তু এমন পাশবিক ষড়যন্ত্র বিরল)

“জয় শ্রীরাম! জয় রামজি কি”!  

ছড়িয়ে পড়ছে দুর্দান্ত খবরটা, হুলুস্থূল পড়ে গেছে সুবিশাল ভারতের সাড়ে তিরিশ কোটি হিন্দু সমাজে। রাম দেবতা ফিরে এসেছেন! তিনি ফিরে আসবেন এই অটল বিশ্বাস হিন্দুদের প্রাচীন কাল থেকেই। মহামহিম সেই ক্রান্তি মুহূর্ত এখন সমুপস্থিত, রাম লালা (বালক রাম) এসে দাঁড়িয়েছেন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ভেতরে মিম্বরের ওপরে কারণ ওটাই তার জন্মস্থান। অবিশ্বাসের প্রশ্ন কোথায়- কারণ ছুটে গেছে সাংবাদিকেরা, বহু পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে সেই রাম লালার ছবি, ছাপা হচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারও। 

দুই বছর আগে স্বাধীনতা ও এখন রাম দেবতার আবির্ভাব, এই দুই শক্তিশালী আবেগের প্রচণ্ড মিথস্ক্রিয়ায় রামরাজ্যের স্বপ্নে টালমাটাল হিন্দু জনতার মানস। নড়েচড়ে বসল রাজনীতির নেতা ও দলগুলো, পদধ্বনি শোনা গেল ভবিষ্যতের আরএসএস, বিজেপি, বজরং, জনসঙ্ঘ …. রাজনীতির তাসের টেবিলে স্পেডের টেক্কা পাওয়া গেছে!   

ধর্মের নামে কিছু মানুষ যত নির্বোধ আর হিংস্র হতে পারে ততটা আর কোনও কারণেই নয়। 

অযোধ্যা। ২২শে ডিসেম্বর ১৯৪৯ বৃহস্পতিবার, রাত ১১টা।          

নিঃশব্দ নিথর রাত, নিস্পন্দ নীরব। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে গ্রহ নক্ষত্রেরা, আতংকিত সরযূর লক্ষ তরঙ্গ। নিকষ অন্ধকারে ইতিউতি তাকিয়ে সন্তর্পনে হেঁটে যাচ্ছে তিন রাম-ভক্ত। দলনেতা সাধু অভিরাম দাসের চাদরের ভেতরে অষ্টধাতুর তৈরি রাম লালা-র ৭ ইঞ্চির মূর্তি। মসজিদের ভেতরে মিম্বরের ওপরে রেখে আসা হবে সেটা। এর সূত্র ধরে ৪৩ বছর পর ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর দেড় লাখ ধর্মোন্মাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে ৪৬৪ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ। পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়বে নেতা-জনতা। মাঝের বছরগুলোতে ইতিহাসের পাতা ক্রমাগত ভিজে যাবে রক্তে। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকবে শত শত রক্তাক্ত লাশ, শত শত বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে ধরিয়ে দেয়া হবে আগুন, ভেতরে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে হাজারো নরনারী শিশু। বাংলাদেশের গ্রামে হৈরা মুচিকে হিংস্র প্রশ্ন করা হবে- “তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙলি কেন”? দুই ধর্মের কিছু উগ্র নেতার উস্কানিতে ঝলসে উঠবে ঘাতকের অস্ত্র, ‘প্রতিপক্ষের’ ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে স্রষ্টার সৈন্যরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।

মত্ত দরিয়া, নাও ডুবুডুবু, মৃত্যু জীবন-নদীর দুধারে,

এধারে রক্তচক্ষু পুরাণ, রক্তচক্ষু কোরান ওধারে।  

“সেই তখন উত্তর ভারতের একটি শহরের মসজিদে গভীর রাত্রিতে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা একটি নূতন জাতিকে সংজ্ঞায়িত করিয়াছিল এবং এখনও তাহা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির চরিত্র নির্ধারণ করিতেছে”- ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।  

সেই কালরাত্রির ঘটনা সবিস্তারে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে গুরু দত্ত সিং-এর ছেলে গুরু বসন্ত সিং-এর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে ছয়দিন ধরে (০৩-০৮ ডিসেম্বর ২০১২। এটা প্রকাশিত হয়েছে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডসহ অজস্র দেশি-বিদেশি সংবাদ-মাধ্যমে এমনকি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও- “অযোধ্যা: দি ডার্ক নাইট- দি সিক্রেট হিস্ট্রি অব রাম’স অ্যাপিয়ারেন্স ইন বাবরি মসজিদ” বইয়ের (প্রকাশক হার্পার কলিন্স, ইণ্ডিয়া) লেখকদ্বয় কৃষ্ণ ঝা ও ধীরেন্দ্র ঝা-এর অনুমতি নিয়ে। বইটা আমাজনে কিনতে পাওয়া যায়। নিচের উদ্ধৃতিগুলো প্রধানত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।

উত্তর-প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরে বাবরি মসজিদ, ১৫২৮ সালে বানিয়েছিলেন সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি। মসজিদের সামনে দেয়াল-ঘেরা মাঠটা মাঝখানে রেলিং দিয়ে দ্বিখণ্ডিত। ভেতরের অংশ মসজিদ সংলগ্ন, বাইরের অংশে হিন্দুরা কাঠের মঞ্চে রামমূর্তির পুজো করেন। “সেখানে সাধু ও রামভক্তরা প্রদীপ জ্বালাইতেন; রামায়ণ হইতে পড়া হইত রাম কিভাবে তাঁহার জন্মস্থানে ফিরিয়া আসিবেন”। 

বিহার থেকে ১৯৩৫ সালের দিকে সেখানে এসে আস্তানা গাড়ে ‘দৃপ্তকণ্ঠ ও খিটখিটে স্বভাবের’ রামভক্ত সাধু অভিরাম দাস। তার দৃঢ় বিশ্বাস মসজিদের ভেতর মিনারের ঠিক নিচেই রামের জন্মস্থান। সে বারবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখে “মর্যাদা পুরুষোত্তম” দেবতা রাম এসে ওখানে দেখা দিয়েছেন। তাই ঠিক সেই জায়গাতেই রামকে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করাটা তার জীবনের একমাত্র ব্রত। “আমরা দেশকে মুক্ত করেছি, আমাদেরকে লর্ড রামের জন্মভূমিও মুক্ত করতে হবে”- এই ছিল তার একমাত্র ধ্যানধারণা যা সহজেই জনসমর্থন পেয়েছিল।  

জুন-জুলাই, ১৯৪৯। অভিরাম দাস আরেক রামভক্ত ম্যাজিস্ট্রেট গুরু দত্ত সিং-এর কাছে স্বপ্নটা খুলে বলতেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি– “এ তো আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ভাইয়া! এ স্বপ্ন তুমি এখন দেখছো, আমি তো এটা বহুদিন থেকেই দেখছি”!  

অলক্ষ্যে ধ্বনিত হল ইঙ্গিত! “কিভাবে মুসলিমদের ইবাদতের স্থানে রামের মূর্তি গোপনে রাখা যায় তাহা লইয়া এই দুইজন আলোচনা করিতে লাগিলেন”। 

কৌশলে অজস্র সাধু সন্ন্যাসী ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হল- রাম দেবতা ফিরে এসেছেন। স্বভাবতই বিশাল ভারতবর্ষের হিন্দুদের মনে মাথায় প্রবল ধর্মীয় আবেগের সাইক্লোন শুরু হল। এক অচিন্তনীয় চাপের মধ্যে পড়ে গেল ভারতের মুসলিম, চারদিক থেকে অদৃশ্য এক ধুম্রজাল ধীরে ধীরে ঘিরতে থাকল তাদেরকে। রাজনীতি ও ধর্মের অঙ্গনে একের পর এক ঘটতে থাকল অঘটন, ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দূরদর্শনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার না করার লিখিত নীতি ভঙ্গ করে শুরু হল প্রবল ধর্মীয় অনুভূতির “রামায়ণ সিরিয়াল”। রাম মন্দিরের পক্ষে বাবরী মসজিদের বিপক্ষে পুরো ভারতের হিন্দু-মানসকে একসূত্রে গেঁথে ফেলল সেটা।    

এবারে ত্রিমূর্তির তৃতীয় মূর্তি। গুরু দত্তের পুরোন বন্ধু ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের নির্বাহী কর্মকর্তা কে কে নায়ার। দুজনই প্রচণ্ড রামভক্ত, দুজনই ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ‘হিন্দু মহাসভা’ দলের সমর্থক যদিও চাকরির কারণে সেটা প্রকাশ করেন না। পরিকল্পনা মাফিক নায়ার কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে ফৈজাবাদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পেলেন যার শহর অযোধ্যার সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরু দত্ত সিং। এদিকে সাধু অভিরাম দাস তো অযোধ্যাতে আছেই। এই সেই ত্রিমূর্তি, ইতিহাসের মারাত্মক খলনায়ক। 

“রামের মূর্তি কিভাবে বাবরি মজিদের ভিতরে স্থাপন করা যায় তাহা পরিকল্পনা করিতে তাহারা একত্রিত হইত… সূর্যাস্তের পর গোপনে সভা হইত, দরজায় এক হিন্দু চাকর রাখা হইত। তাহাকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল কোনো দর্শনার্থী আসিলে তাহাকে যেন বলা হয় যে তিনি (গুরু দত্ত) বিশ্রাম করিতেছেন”… “কে কে নায়ার, গুরু দত্ত ও উচ্চ জেলা প্রশাসকেরা অভিরাম দাসের সহিত পরিকল্পনা করিত কিভাবে বাবরি মসজিদের ভিতরে মূর্তিটি স্থাপন করা যায়, যেই মসজিদ তালাবন্ধ থাকিত ও সেখানে প্রহরী থাকিত”।    

হিন্দু প্রহরী দুপুর থেকে মাঝরাত ও মুসলিম প্রহরী মাঝরাত থেকে সকাল পর্যন্ত পাহারা দিত। “আমি তাহাকে (হিন্দু প্রহরীকে) বুঝাইয়াছিলাম যে ইহা একটি এক্সট্রিম হলি ওয়ার্ক”- অভিরাম দাস। বিশ্বাসীদের মনে ‘হলি ওয়ার্ক’ স্বর্গের হাতছানিতে ঐশী কম্পন তোলে, হিন্দু প্রহরী রাজি হল তাদেরকে রাত্রে মসজিদে ঢুকতে দিতে। মুসলিম প্রহরীকে গুরু দত্ত ও নায়ার হুমকি দিয়েছিল সহযোগিতা না করলে তাকে খুন করা হবে। তাকেও রাজি হতে হল। সাধু অভিরাম দাস তাঁর দুই ভক্তকে নিয়ে রাত এগারোটায় মসজিদের কাছে পৌঁছতেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আবির্ভুত হল সাধু বৃন্দাবন দাস, হাতের রাম লালা’র মূর্তি তুলে দিল অভিরাম দাসের হাতে। 

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার প্রবল প্রভাব আজও আছে থাকবে চিরকাল। প্রহরী তালা খুলে দিলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অভিরাম দাস মসজিদে ঢুকে মিম্বরের ওপরে মূর্তিটি স্থাপন করে, তারপর ব্রহ্ম মুহূর্তের (কোন কোন মতে রাত ৩টা থেকে ৫টা) অপেক্ষা করতে থাকে। ঠিক রাত তিনটায় সে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজোর ঘণ্টা বাজিয়ে স্তোত্র পাঠ শুরু করে। মুসলিম প্রহরী ও বহির্প্রাঙ্গনের (যেখানে রামের পুজো হত) সাধুরা বাইরে থেকে সেটা দেখেছে বলে পরে জানিয়েছে। মুসলিম প্রহরী জানায়, প্রদীপের আলোতে রামের মূর্তি দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল রাম নিজে আবির্ভুত হয়েছেন। সাধু বিন্দেশ্বরী প্রসাদ জানান- “আমরা রাত তিনটায় দেবতার কাছে গেলাম ও স্তোত্র পাঠ করিয়া তাঁহার পূজা করিলাম”। দুই সাইকেল আরোহী ঘটনার ক্রমাগত বিবরণ ফৈজাবাদে অবস্থানরত উৎকণ্ঠিত গুরু দত্ত ও নায়ারের কাছে পৌঁছাতে থাকে। 

এর পরের ঘটনাগুলো সবার জানা।  

পুনরাবৃত্তি করছি- “সেই তখন উত্তর ভারতের একটি শহরের মসজিদে গভীর রাত্রিতে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা একটি নুতন জাতিকে সংজ্ঞায়িত করিয়াছিল এবং এখনও তাহা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির চরিত্র নির্ধারণ করিতেছে”। এ ঘটনা কখনো অতীত হবেনা, এটা বারবার ফিরে এসে ভারতের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কালনাগিনীর ছোবল দিতে থাকবে যার প্রভাব বাংলাদেশ পাকিস্তানেও পড়তে বাধ্য। এছাড়া আরো প্রশ্ন থেকে যায়। কোটি মানুষের বিশ্বাস ও জীবন নিয়ে এই মারাত্মক অপরাধের এতো চাক্ষুস, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দলিল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আদালতে সেগুলো মুসলিম পক্ষের আইনজীবী পেশ করেছেন বলে জানা যায়না। যদি তাঁরা তা পেশ করে থাকেন তাহলে আদালত সেগুলো আমলে নিলনা কেন সেটাও বৈধ প্রশ্ন। আইনজীবীরা বলতে পারবেন।

কালতামামী 

অসাম্প্রদায়িক সম্রাট বাবরের এমন কি জমির অভাব পড়েছিল যে তাঁকে মন্দির ভেঙে মসজিদ বানাতে হবে? আসলে নীতি তো নয় ভোটই হল রাজনীতির ঈশ্বর। সেজন্যই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মসজিদটা ভেঙে সেখানে নির্মিত হবে মন্দির। সেজন্যই সেই মন্দির নির্মাণে টাকা দিলে আয়করে ছাড় দেয়া হবে (আনন্দবাজার, ০৯ মে ২০২০)। কয়েকটা বুলডজার এসে হিংস্র পশুর মতো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় স্থাপত্যটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, সেই ছবি রয়ে যাবে। সে ছবির পাঁচ আঙুলের দাগ রক্তাক্ত হয়ে চিরকাল ফুটে থাকবে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গালে। 

নিজেদেরই সরকারের হাতে এই দুঃসহ অন্যায় অপমান ভারতের মুসলিমেরা ভুলবেনা কোনোদিন।

*****************************************

মোদী’র হিন্দুরাষ্ট্র বনাম বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র 

৩ মার্চ, ২০২০

অগ্নিগর্ভ ভারত।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জ্বলছে দিল্লী, নিহত ৪৬ জন। উত্তাল দেশ, প্রচণ্ড হট্টগোলে মুলতুবি সংসদ অধিবেশন। দীর্ঘ পরিকল্পনায় মোদী-অমিত চক্র সুদৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়েছে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠায়, কাশ্মীর গ্রাস, বাবরী মসজিদ ভেঙে মন্দির স্থাপন ও এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬। বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে সব ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তি। এ বিলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু ও কেরালার সরকার প্রধানেরাও। সব মিলিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ভাষায়- ‘সেকুলার ইন্ডিয়া ফাইটস্ ব্যাক’।

রাজনীতিতে যাই ঘটুক বাস্তবে হিন্দুরাষ্ট্র সম্ভব নয়। যে ধর্ম কয়েক হাজার বছর ধরে প্রচুর বিবর্তিত হয়েছে, যে ধর্মের কোনও প্রেরিত পুরুষ বা একক ধর্মগ্রন্থ নেই, যে ধর্মের এক জায়গা বা এক যুগের কিছু দেবতাকে অন্য জায়গা বা অন্য যুগে খুঁজে পাওয়া যায়না, সেই ধোঁয়াশার ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র হতে পারেনা। জোর করে ও রাষ্ট্র বানালে তার কাজই হবে সতীদাহ ফিরিয়ে আনা। জোর করে ও রাষ্ট্র বানালে তার কাজই হবে মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বীর ওপরে জুলুম করা। সমস্যা আরও আছে, তা হল ইসলামী খেলাফতের যেমন একটা মডেল ছিল হিন্দু রাষ্ট্রের তেমন কোন মডেল সামনে নেই। তাছাড়া হিন্দু আইনগুলোও কোডিফায়েড অর্থাৎ বিধিবদ্ধ নয়। কাজেই হিন্দু রাষ্ট্রের আইন বানাতে হলে মনু সহ বিভিন্ন সংহিতার ভিত্তিতেই বানাতে হবে। কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি ‘অন্যতম অগ্রগণ্য ইন্ডোলজিস্ট’, টাইমস অব ইন্ডিয়া’র ভাষায় ‘বিরল স্তরের বিশেষজ্ঞ’ ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য্যের বই প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য থেকে:-

* সতীদাহ বৈধ – সূত্র – “জীবিত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধূ হতে…এই নারী পতিলোকে যাচ্ছে, এ-প্রাচীন রীতি অনুসরণ করছে” – অথর্ববেদ ১৮/৩/১, ১৮/৩/৩)। “সহমৃতা না হলে পরজন্মে ওই পতি পাওয়া যাবেনা” – বাৎস্যায়ন ৯/১৩।

* নারীকে গৃহবন্দী রাখতে হবে নাহলে তার “শক্তিক্ষয় হবে” – শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪/১/১/৩১।

* সন্তান না জন্মালে ১০ বছর ও পুত্র না জন্মালে ১২ বছর পর স্ত্রীকে তালাক দেয়া বৈধ – আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ১/১০-৫১-৫৩।

* লাঠি দিয়ে স্ত্রীকে মেরে দুর্বল করতে হবে যাতে দেহ ও সম্পত্তির ওপরে তার কোন অধিকার না থাকে – শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/২/১৩।

* রাষ্ট্রের খরচে গণিকাদের উচ্চশিক্ষা দিতে হবে যাতে “মার্জিত রুচী এবং শিক্ষার অধিকারী মানুষ গণিকার কাছেই মানসিক সাহচর্য পায়, বধূর কাছে নয়” – পৃষ্ঠা ৬২।

* স্বামীর জন্য বাড়ীতে উপপত্নী আনা বা বেশ্যাগমন করা বৈধ – মৈত্রায়নী-র বিভিন্ন আইন ও  তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে যে লক্ষাধিক আলেম অজস্র ওয়াজে গণতন্ত্রকে ‘কুফরী আকিদা’ ঘোষণা করে জনগণের একাংশকে ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থনে টেনে আনছেন তাদের সমস্যাও কিন্তু কম গভীর নয়। ওয়াজে তাদের নিজেদের মধ্যে যে ভয়াবহ কুরুক্ষেত্র চলছে, পরস্পরের প্রতি নোংরা কুৎসিত ভাষায় (কখনো ক্যামেরার সামনে জুতো দেখিয়ে) গালাগালি চলছে- তাতে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে গৃহযুদ্ধ অবধারিত। তারপরে আছে শারিয়া আইনের সংকট, যা জাতিকে জানানো জরুরি। উদাহরণ দিচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু শারিয়া কেতাব থেকে, কেউ চাইলে পৃষ্ঠার ফটোকপি পাঠিয়ে দেব। এ কেতাবগুলো যদি কারো পছন্দ না হয় তবে কোন কেতাবের আইন প্রয়োগ করবেন তার নাম বলুন, আমরা খতিয়ে দেখি। পশ্চিমা দেশে ইসলাম-বিদ্বেষীরা যখন এসব আইন উদ্ধৃত করে আমাদেরকে আঘাত করে তখন তার জবাব দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

১. বি-ই-আ বা বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশন প্রকাশিত ৩ খণ্ডের ‘বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন’।

২. বাংলা কোরান (অনুবাদ, মওলানা মুহিউদ্দিন খান)

৩. হানাফী আইন- ‘হেদায়া’, অনুবাদ চার্লস হ্যামিল্টন। মুখবন্ধে আছে, এ বইটি কাউন্সিল অব লিগ্যাল এডুকেশন দ্বারা ইংল্যাণ্ডের ব্যারিস্টারি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত।

৪. শাফি-ই আইন, (শাফি আইন ‘উমদাত আল সালিক, অনুবাদ নু. হা. মিম. কেলার, মিসরের আল আজহার বিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প ও সই দ্বারা সত্যায়িত।)

৫. শারিয়া দি ইসলামিক ল’, বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী বিশেষজ্ঞ ড. আবদুর রহমান ডোই।

৬. ‘ক্রিমিন্যাল ল’ ইন্ ইসলাম অ্যান্ড দি মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ (বর্ষীয়ান শারিয়া-বিশেষজ্ঞ ডক্টর তাহির মাহমুদ লিখেছেন)। জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানকে সাংবিধানিকভাবে “শারিয়া রাষ্ট্র” ঘোষণা করার আগে তাকে উপদেষ্টা হিসেবে আনিয়েছিলেন।

৭. ইসলামিক ল-জ – (“জাফরী” শারিয়া) – শিয়াদের বর্তমান সর্বোচ্চ শারিয়া-ইমাম গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ সিস্তানী।

৮. দি পেনাল ল অব ইসলাম – মো. ইকবাল সিদ্দিকী।

ইত্যাদি। সূত্র বিশেষে কিছু আইনের পার্থক্য দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, এমন দাবীও করে রেখেছেন কিছু বিখ্যাত আলেম, যদিও তাঁরাই পরে বলেছেন ইজতিহাদ করে সবাই আইনের পরিবর্তন করা যেতে পারে – “দুনিয়ার সকল মুসলিম একমত হলেও আল্লাহর আইনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করার অধিকার রাখেনা” – (মৌদুদী - ‘ইসলামী ল’ অ্যাণ্ড কনস্টিটিউশন’, পৃষ্ঠা ১৪০)। শারিয়া আইনের বিভাগগুলো হল:-

হুদুদ :- খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, জ্বেনা, মানহানী ও ইসলাম ত্যাগ, কিছু কেতাবে ধর্ষণ যোগ হয়েছে (দেখুন "ধর্ষণ উচ্ছেদ - কবি নির্মলেন্দু গুণ ও শারিয়া আইন " অধ্যায়)। এক্ষেত্রে শাস্তি কোরান-রসূল (স) দ্বারা নির্ধারিত, সরকারের কিছু করার নেই।

দিয়াত :- খুনীকে নিহতের পরিবার ক্ষমা বা রক্তপণ নিয়ে মুক্তি দিতে পারে, সরকারের কিছু করার নেই। যেসব কোটিপতি খুনীদের “ওপরের সাথে কানেকশন” ও গুণ্ডাবাহিনী আছে, এ আইনে তাদের হাতে গরীব দুর্বলেরা অসহায় অরক্ষিত।

কিসাস:- হত্যার বদলে হত্যা, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক ইত্যাদি।

বাকি সব মামলা “তাযীর” যেক্ষেত্রে বিচারক নিজের বিচারবুদ্ধি বা অতীত উদাহরণ প্রয়োগ করতে পারবেন।

এবারে আইনের উদাহরণ। টেক এ ডিপ ব্রেথ অ্যান্ড ফ্যাসেন ইয়োর সিট বেল্ট!

১. কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না – পেনাল ল অব ইসলাম পৃ. ১৪৯, শাফিই আইন o.1.2.2।

২. ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হুদুদ অপরাধ করলে (খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, জ্বেনা …) তাঁর শাস্তি তো দূরের কথা তাঁর বিরুদ্ধে মামলাই করা যাবে না – বি-ই-আ ৩য় খণ্ড ৯১৪গ এবং হানাফি আইন পৃঃ ১৮৮।

৩. হুদুদ ও কিসাস মামলায় নারী-সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় – বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড ধারা ৫৭৬, হানাফি আইন পৃ. ৩৫৩, শারিয়া দি ইসলামিক ল পৃ. ২৩৫, ক্রিমিন্যাল ল’ইন্ ইসলাম অ্যাণ্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড পৃ. ২৫১, বাংলা কোরান পৃ. ২৩৯, ৯২৮, পেনাল ল অব্ ইসলাম পৃ. ৪৪, শাফিই আইন o.24.9।

৪. হুদুদ মামলায় নারী-বিচারক অবৈধ – বি-ই-আ ২য় খণ্ড ধারা ৫৫৪।

৫. মুসলিম-সংশ্লিষ্ট মামলায় অমুসলিমের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় – বি-ই-আ ২য় খণ্ড ধারা ৫৭২।

৬. হুদুদ মামলায় সাক্ষ্য গোপন করা অপরাধ নয় – বি-ই-আ ২য় খণ্ড ধারা ৫৭৫খ। এ আইন ইসলাম-বিরোধী কারণ “তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না”- বাকারা ২৮৩ ইত্যাদি।

৭. কেউ তার বাবা-মা, দাদা-দাদি, বা নানা-নানিকে (ঊর্ধ প্রজন্ম) ইচ্ছাকৃত খুন করলে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু বাবা মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে (অধ: প্রজন্ম) ইচ্ছাকৃত খুন করলে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না – বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ৬৫ ক ও খ, শাফি’ই আইন o.1.2.4।

৮. (একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মতো) দলবদ্ধ হয়ে গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের অপরাধীরা তওবা করলে

“শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে” – বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৩।

৯. “কোন ব্যক্তির অপরাধ প্রকাশ্য আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে গ্রেপ্তার বা আটকের মাধ্যমে তাহার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাইবে না” – বি-ই-আ ৩য় খণ্ড ধারা ১২৮২। অর্থাৎ খুন ডাকাতি জঙ্গী হামলা সহ যে কোনো অপরাধের প্ল্যানিংয়ের সময় ক্রিমিন্যালদেরকে গ্রেপ্তার করা যাবেনা।

১০. দাস-দাসী, পেশাদার গায়িকা এবং সমাজের নীচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী, ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় – বি-ই-আ ২য় খণ্ড পৃঃ ২৬৩, হানাফি আইন পৃঃ ৩৬১, শাফি’ই আইন o.24.3.3, পেনাল ল’অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৬।

১১. জেনার ক্ষেত্রে বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়- বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৩১১।

১২. স্বামী তার স্ত্রীকে ইচ্ছে হলেই তাৎক্ষণিক তালাক দিতে পারবে। কোনো কোনো কেতাবে আছে অত্যাচারের চাপে, নেশার ঘোরে বা হাসি-ঠাট্টাতে ‘তালাক’উচ্চারণ করলেও পুরো তালাক হয়ে যাবে – হানাফি আইন পৃঃ ৮১ ও ৫২৩, শাফিই আইন n.3.5, বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৭, ৩৪৯, ৩৫১, ‘দ্বীন কি বাঁতে’- মওলানা আশরাফ আলী থানভি, পৃঃ ২৫৪ আইন নং ১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫। এই আইন পৃথিবীর প্রত্যেকটি মুসলিম স্ত্রীকে কার্যত: স্বামীর ক্রীতদাসী বা জুতো-কাপড়ের মতো করে রাখে যা ইচ্ছে হলেই ছুঁড়ে ফেলা যায়। এই শারিয়া আইন কেন কোরান-রসূল (স) বিরোধী (নারী-বিরোধী তো বটেই) তা বিস্তারিত আছে ২ আগস্ট, ২০১৯ তারিখে বিডিনিউজ ২৪ কম - এ প্রকাশিত "তিন তালাকের ‘তালাকপ্রাপ্তি’, উত্তাল ভারত" নিবন্ধে। বলা দরকার, শিয়া শারিয়ায় তাৎক্ষণিক তালাক অবৈধ।

১৩. স্ত্রী সাধারণ তালাকে তিনমাসের খোরপোষ পাবে কিন্তু তাৎক্ষণিক তালাকে কিছুই পাবে না – হানাফি আইন পৃঃ ১৪৫, শাফি’ই আইন m.11.10-1 এবং 3।

১৪. “(স্বামীর জন্য) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে”- বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৩৪৪। কিন্তু ইসলামে দুজন সাক্ষী ছাড়া তালাক অবৈধ – সুরা ত্বালাক আয়াত ২। সহি ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড হাদিস ২০২৫ অনুযায়ীও সাক্ষী ছাড়া তালাক অবৈধ ।

১৫. স্বামী খাবার, বাসস্থান ও পোশাক দিতে বাধ্য থাকবে শুধুমাত্র বাধ্য স্ত্রীকে, অবাধ্য স্ত্রীকে নয়। এর বাইরের সব খরচ এমনকি ডাক্তারের, ওষুধের বা সৌন্দর্য্য-চর্চার খরচ ইত্যাদি হবে স্বামীর করুণা ও দয়া – হানাফি আইন পৃঃ ১৪০, শাফি’ই আইন m.11.4।

১৬. উদ্ধৃতি: “স্ত্রীর যে প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর জিম্মায় ওয়াজিব তা চারটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ – আহার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থান। স্বামী এর বেশি কিছু স্ত্রীকে দিলে অথবা ব্যয় করলে তা হবে অনুগ্রহ, অপরিহার্য নয়।”- বাংলা কোরান পৃঃ ৮৬৭। বলাই বাহুল্য, স্ত্রী অবাধ্য কি না সেটা ঠিক করবে ওই স্বামীই।

১৭. খুনিকে মাফ করতে পারে শুধু নিহতের পুত্ররাই, কন্যারা নয় – শারিয়া দি ইসলামিক ল’পৃঃ ২৩৫। তাহলে নিশ্চয় খুনির কাছ থেকে নিহতের রক্তমূল্যও (দিয়াত) দাবী করতে পারে শুধু নিহতের পুত্ররাই, কন্যারা নয়।

১৮. বিবাহিতা যুদ্ধবন্দিনীদের বিয়ে তৎক্ষণাৎ বাতিল হয়ে যাবে- শাফি’ই আইন o.9.13। এ আইন কি প্রয়োগ করা সম্ভব?

১৯. মদ্যপানের প্রমাণ দু’জন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য। নারী বা নারী-পুরুষের মিলিত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়– বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৭৪।

২০. “কোনো কারণে ধর্ষকের শাস্তি মওকুফ হইলে ধর্ষণকারী কর্তৃক ধর্ষিতাকে মোহরানা প্রদান বাধ্যতামূলক হইবে”- বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ৩০১, শাফি’ই আইন m.8.10। কি এমন “কারণ” যাতে ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধের শাস্তি মওকুফ হতে পারে? তাছাড়া, ধর্ষক কপর্দকহীন হলে কি হবে তা বলা নেই।

২১. মুসলিম পুরুষের (দিয়াত) রক্তমূল্য অপেক্ষা (ক) মুসলিম নারীর রক্তমূল্য অর্ধেক, (খ) ইহুদী-খ্রিস্টানের রক্তমূল্য তিনভাগের একভাগ ও (গ) অগ্নি-উপাসকের রক্তমূল্য পনেরো ভাগের একভাগ – বাংলা কোরাণ পৃঃ ২৭৫, শাফি’ই আইন o.4.9।

২২. “রাষ্ট্রপ্রধানের পুরুষ হওয়াও অপরিহার্য শর্ত।”- বি-ই-আ ৩য় খণ্ড ধারা ৯০০। কিন্তু তারপরেই শর্তটা আর ততটা ‘অপরিহার্য’ থাকেনি, বলা হয়েছে যদি “ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ ফকিহ্গণ কোন বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাতির সার্বিক কল্যাণ বিবেচনা করিয়া উক্ত সর্বোচ্চ পদ নারীর জন্য অনুমোদন করিতে পারেন”- (পৃষ্ঠা ১৯৯)। যে আলেমদের মধ্যে এতো মারমূখী কুরুক্ষেত্র তাঁরা হানাহানি না করে “জাতির সার্বিক কল্যাণ” কত প্রকার ও কি কি এবং কোন নারী “উপযুক্ত নেত্রী” তাতে একমত হবেন তা কি আশা করা যায়?

শারিয়া কেতাবে এমন আইন অজস্র আছে। কাউকে দোষারোপ করছিনা, সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি শুধু সমস্যাটা দেখাচ্ছি। দেশের অনেক কিছু নিয়ে আমরাও অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, পরিবর্তন আমরাও চাই। কিন্তু ওসব আইন দিয়ে তা সম্ভব নয় কারণ:

“আমি সবাইকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি, এযুগে শারিয়াকে চালাইতে হইলে অবশ্যই প্রচণ্ড ঘষামাজা করিতে হইবে…সেই যুগে যে উদ্দেশ্যে শরিয়ার উসুল বানানো হইয়াছিল অনেক কারণেই এখন উহা সেই উদ্দেশ্য অর্জন করিতে সক্ষম নহে।” – ‘প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’, পৃষ্ঠা ১৩, ৫০০ – বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শারিয়া-বিশেষজ্ঞ ড. হাশিম কামালী।

কালতামামি

(ক) দুনিয়ায় ধর্মের সংখ্যা অজস্র। ধর্মরাষ্ট্র বৈধ করলে দুনিয়াটা অজস্র ধর্মরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে মানবজাতির ওপর কি গজব নেমে আসবে তা ভাবলেও আতংকিত হতে হয়।

(খ) আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে। আমরা ভারতে হিন্দুরাষ্ট্রের বিরোধিতা করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছি (১) ১৯৪৭ সালে ইসলাম/মুসলিমের নামে পাকিস্তান বানিয়ে, (২) ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানকে “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” ঘোষণা করে, (৩) ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানকে সাংবিধানিকভাবে “শারিয়া রাষ্ট্র” ঘোষণা করে, (৪) পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস করে, যেমন ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খানের হিন্দু বিরোধী বর্বর “এনিমি প্রপার্টি আইন” (শত্রু সম্পত্তি আইন) ইত্যাদি। এসবের সুযোগ নিয়ে ভারতে মোদী-অমিত চক্র হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার চেষ্টা অবশ্যই করবে ও করছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র “কুফরী আকিদা” আর ভারতে আমরা হিন্দুরাষ্ট্রের বদলে গণতন্ত্র চাইব এ দাবী নির্লজ্জ ও অসৎ।

(গ) হাদিস ও তফসীরগুলোতে ন্যায়বিচারের অনেক উপদেশ আছে। কিন্তু রাষ্ট্র উপদেশ দিয়ে চলেনা, চলে আইন দিয়ে। তাই, আগে শারিয়া আইনের সেই “প্রচণ্ড ঘষামাজা”টা হোক, শালীন আলোচনা হোক। সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন মুসলিম-বিশ্বের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ (প্রয়াত ১৯০৫) বহু আগে:

“আমি পশ্চিমা দেশে গিয়া মুসলিম দেখিলাম না কিন্তু ইসলাম দেখিলাম। ফিরিয়া আসিয়া আমি মুসলিম দেখিলাম কিন্তু ইসলাম দেখিলাম না” আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত গ্র্যান্ড মুফতি মোহাম্মদ আবদুহ।

এই সত্য উঠে এসেছে ১৫৩টি দেশের মধ্যে ওয়াশিংটনের ‘ইসলামসিটি ফাউন্ডেশন’-এর জরিপে, গণতন্ত্রের কাঠামোতেই ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব‘ইসলামী মূল্যবোধ’ প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চে নিউজিল্যাণ্ড, তারপরে সুইডেন, হল্যাণ্ড, আইসল্যাণ্ড ও সুইজারল্যাণ্ড। এই পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্ব, ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের উপলব্ধি। অনেক দেশে এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত নারী। সৌদি আরবে এখন নারীরা গাড়ী চালানো থেকে শুরু করে অনেক অধিকার পাচ্ছেন। ৯৭% মুসলমানের দেশ সুদান ১৯৮৯ সাল থেকে দীর্ঘ ৩০ বছর সাংবিধানিকভাবে "ইসলামিক রাষ্ট্র" থাকার পর সংবিধান সংশোধন করে "ধর্মনিরপেক্ষ সুদান" ঘোষণা করেছে। বলা হয়েছে- "ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করে এক ধর্মনিরপেক্ষ সুদান গড়ে তোলাই প্রধান লক্ষ্য। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।"

"ধর্ম নিরপেক্ষতা"-র কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিন্তু আপাতত: রাষ্ট্র চালানোর জন্য বিশ্বমানবের হাতে র বিকল্প নেই।  

**********************

করোনা-বিদ্ধ জাকাত!

১৩ এপ্রিল, ২০২০

মার্চের শেষ সপ্তাহান্ত ২০২০, করাচি। 

ভয়াবহ দুর্বিপাকে পড়েছে বিশ্ববাসী। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখের দিকে ধাবমান, মৃতের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে একলাখ ছাপিয়ে দেড়লাখের দিকে দৌড়াচ্ছে, আতংকে গৃহবন্দি বিশ্ববাসী। ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম – “A virus can hang for decades like inert chemical without losing any of its virulence. But whenever subjected to a living cell it jumps to life with all its cruel efficiency”. সবচেয়ে বেশী আতংকিত কোটি কোটি গৃহবন্দি গরীব মুটে মজুর। ক্ষুধার তীব্র দহনে জ্বলে যাচ্ছে শরীর, চোখের সামনে ক্ষুধায় তড়পাচ্ছে বাচ্চাগুলো। কিন্তু অসহায় চেয়ে দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই।  

কিন্তু এখন সেখানে উৎসবের চিৎকার। বৌ বাচ্চার হাত ধরে করাচির রেহরি গোঠের দিকে ছুটছে হাজারো ক্ষুধার্ত মানুষ, চোখে মুখে তাদের খুশির আভা। ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে চাল ডাল ত্রাণসামগ্রী বিলানো হবে। লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে হাজারো পরিবার, আইডেন্টিটি কার্ড দেখে দেখে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে তাদের। এক জায়গায় এসে থমকে গেলেন ত্রাণদাতা।

“আপনি তো হিন্দু।”

“জ্বী হ্যাঁ” ।

“সরে দাঁড়ান লাইন থেকে। এই ত্রাণসামগ্রী শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য।”

“কি-ই”??

ক্ষোভে অপমানে স্তম্ভিত চেয়ে রইল নিরন্ন ক্ষুধার্ত মানুষগুলো, বাচ্চাগুলো। কার্ড দেখে দেখে সরিয়ে দেয়া হল সব অমুসলিম পরিবারকে। তারা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল কি আনন্দে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম পরিবারগুলো। দিন না যেতেই ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির মতো টগবগ করে উঠল ইন্টারনেট। সেই অজস্র সংবাদ লিংক পড়ে বিশ্ববাসী ইসলাম/মুসলিম সম্পর্কে কী ধারণা করল তা সহজেই অনুমেয়। কিছু লিংকের হেডলাইন:

১. পাকিস্তানের বর্বর চেহারা ফের প্রকাশ্যে এল। করাচিতে লকডাউন চলাকালীন হিন্দুদের রেশন দেওয়া হবে না বলে সাফ জানাল পাক প্রশাসন।

২. করোনার জেরে লক ডাউন: হিন্দুদের রেশন আটকে অভুক্ত মারার চক্রান্ত পাকিস্তানে।

৩.  করোনা লকডাউনে ইমরান প্রশাসনের অমানবিক চেহারা! ত্রাণ থেকে ব্রাত্য হিন্দুরা।

কিন্তু হিসেবটা তো মিলছেনা। একটা দেশের সরকার তা সে যতই সাম্প্রদায়িক হোক, প্রকাশ্যে এমন করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুখে চুনকালি পড়ে হুঁকো নাপিতে টান পড়বে, চিরকাল তিরষ্কার শুনতে হবে। এমন তো হবার কথা নয়! ইন্টারনেটের লিঙ্কগুলো খুঁটিয়ে দেখতেই ফাঁকি ধরা পড়ল। লিঙ্কগুলো সবই ভারতের। এই দু’দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো পরষ্পরের ব্যাপারে নির্লজ্জ্ মিথ্যাবাদী। তাই খুঁজে খুঁজে ইতালির ‘এশিয়া নিউজ’-এ পেলাম আসল ঘটনাটা। গরীবদেরকে ত্রাণসামগ্রী দিয়েছে সরকার নয়, দিয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এনজিও ‘সায়লানী ওয়েলফেয়ার ট্ৰাস্ট’ এবং সেটা দিয়েছে জাকাতের টাকা থেকে। এখানে এসেই স্পর্শকাতর প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে গেল – অমুসলিমদেরকে জাকাত দেয়া যাবে কি?

কোরানে সুরা তওবার আয়াত ৬০ সহ কয়েকটি আয়াতে ‘সাদাকাতুন’ বলে জাকাত বোঝানো হয়েছে; যে ৮ ধরনের লোককে জাকাত দিতে হবে তাতে ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে বাদ দেয়ার হুকুম নেই- “নিশ্চয়ই সদকাহ্ (জাকাত) হলো আসলে ফকির মিসকিনদের জন্য। আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের জন্য মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য। তাছাড়া দাস মুক্ত করার, ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য”।  

কিন্তু জাকাতের অর্থ অমুসলিমদেরকে দেয়ার বিপক্ষে শারিয়া আইন বানানো হয়েছে (আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা স্বাক্ষর ও স্ট্যাম্প দ্বারা সত্যায়িত শাফি আইন কেতাব “উমদাত আল সালিক” আইন নং h8.24 এবং হানাফী আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৯ ও ২০)। একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে ইমামেরা মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে তৎকালীন বিদ্যমান জীবন-মরণ যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ইজতিহাদ করে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন কারণ যুদ্ধের সময় শত্রুকে সাহায্য করার অর্থ আত্মহত্যা করা। তাহলে ‘সায়লানী ওয়েলফেয়ার ট্ৰাস্ট’ কাজটা কিভাবে ইসলাম মেনেই করতে পারত? দেখা যাক ইসলামী দলিল, মুসলিম ইতিহাস ও বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কী বলেন। 

     

ক. শারিয়া আইন লেখা হয়েছে নবীজীর (স) বহু বছর পরে। তার এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে (এবং পরবর্তী কালেও) জাকাত জমা হত বায়তুল মাল-এ যেটার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল গরীবদের সাহায্য করা। সেখানে কোন গরীবকে ধর্মের ভিত্তিতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এমন কোন দলিল আমরা পাইনি।

খ.কোরান রসূলের (স) বিভিন্ন হুকুমগুলোর তালিকা করলে দেখা যাবে সেগুলোর কিছু- ১. পুরো মানবজাতির জন্য, ২. শুধু মুসলিমদের জন্য, ৩. শুধু মুসলিম পুরুষদের জন্য, ৪. শুধু মুসলিম নারীদের জন্য, ৫. শুধু সেই সমাজের জন্য, ৬. কিছু হুকুম চিরকালের জন্য, ইত্যাদি। 

স্বভাবতই, একের ওপরে বা এক পরিস্থিতির বিধান অন্যের ওপরে বা অন্য পরিস্থতিতে প্রয়োগ করলে বিপর্যয় ঘটবে। সেজন্যই বাইরের কোনও চাপ ছাড়াই মুসলিমেরা নিজেরাই চিরকাল সমাজ বদলের সাথে সাথে বিধানের ক্রমাগত পরিবর্তন করেছেন এবং এখনও করছেন।

মনে আছে ছোটবেলায় মা আপনাকে বলেছিলেন “যাও গোসল কর”; আরেকদিন বলেছিলেন “গোসল করো না”? তাহলে আমরা কি বলতে পারি আপনার মা থুক্কু করে আগের ভুলটা শুধরেছেন? মোটেই তা নয়। “যাও গোসল কর” তিনি বলেছিলেন যেদিন আপনি খেলা শেষে ধূলোমাখা দেহে ঘরে ফিরেছিলেন, এবং “গোসল করো না” বলেছিলেন যেদিন আপনার জ্বর হয়েছিল। আপনার কল্যাণ হল তাঁর মূল্যবোধ, ওটা ঠিক রাখার জন্যই নির্দেশ বদল। চিন্তা করুন, যদি তিনি জ্বরের দিনেও বলতেন “যাও গোসল কর” তবে আপনার কি অবস্থা দাঁড়াত?

দেখুন মওলানা মুহিউদ্দিনের কোরানের অনুবাদ পৃষ্ঠা ৩৩৪ ও ৫৩:- ‘‘নাসিখ ও মনসুখের অবস্থা একজন বিজ্ঞ হাকিম ও ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের মতো। ডাক্তার যখন পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপত্র রহিত করে নূতন ব্যবস্থাপত্র দেন তখন এরূপ বলা ঠিক নয় যে পূর্বের ব্যবস্থাপত্রটি ভুল ছিল। বরং আসল সত্য হচ্ছে এই যে, বিগত দিনগুলোতে সে ব্যবস্থাপত্রই নির্ভুল ও জরুরি ছিল এবং পরবর্তী পরিবর্তিত অবস্থায় পরবর্তী পরিবর্তিত এ ব্যবস্থাপত্রই নির্ভুল ও জরুরি’’। এটা সুন্নাহের ক্ষেত্রেও সত্য, উদ্ধৃতি: “নবী (দঃ)-এর সময়েই কোরান ও সুন্নাহ-তে কিছু সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পরিবর্তন করা হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনই ইহার মূল কারণ” – বিশ্ববরেণ্য ইসলামী বিশেষজ্ঞ ড. হাশিম কামালি- ‘প্রিন্সিপলস অব্ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’। বিধান বদলের এমন অজস্র উদাহরণের অগ্রপথিক হযরত ওমর (রা.)। এ বিষয়ে আগ্রহীরা অনেক উদাহরণ পাবেন বিডিনিউজ২৪.কম-এর “মতামত” বিভাগে আমার লেখা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও হজরত ওমরের (রা:) শাসন: সমান উত্তরাধিকার নিবন্ধে।

তাহলে “কোরান ও সুন্নাহ-তে কিছু সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পরিবর্তন” করে অতীতের আলেমরা কি ইসলাম লঙ্গন করলেন? না, করেন নি। জীবনের প্রয়োজনে মূল্যবোধ বজায় রেখে কোরান-সুন্নাহের কোন বিধানকে সাময়িকভাবে স্থগিত করার বিধান ওই কোরানই দিয়ে রেখেছে। ইজতিহাদ করে অতীতের আলেমরা সেই পদ্ধতিটাই মেনেছেন ও তাতে সমাজের প্রভূত কল্যাণ হয়েছে। এখনো এই করোনাভাইরাসের সংকটেও আলেমরা ইজতিহাদ করে জীবনের নিরাপত্তার কারণে সাময়িকভাবে হজ, ওমরা ও মসজিদে জুমার নামাজ স্থগিত বা সীমাবদ্ধ করেছেন। কোরানের দেয়া সেই পদ্ধতিটা কী তাহলে? এ পদ্ধতির সমর্থন হাদিসেও আছে কিন্তু নিবন্ধ লম্বা হবে বলে সেদিকে যাচ্ছিনা।

কোরান শুকরের মাংস খাওয়া হারাম করেছে চারটি আয়াতে – বাকারা ১৭৩, মায়েদা ৩, আনাম ১৪৫ ও নাহল ১১৫। এখন, যে মুসলিমের সামনে শুকরের মাংস ছাড়া আর কিছু নেই সে কী করবে? না খেয়ে মরবে? না, সেটা জীবনবিরোধী, তাই পথ দেখিয়েছে ওই কোরানই। শূকরের মাংস অবৈধ করার পরপরই ওই প্রত্যেকটি আয়াতে অবধারিত দেয়া আছে বেহেশতী বরাভয় – “অতঃপর কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”

সায়লানী ট্রাস্ট তাহলে কি করতে পারত? (১) কোরান জাকাতের সাহায্য অমুসলিমদেরকে দেয়াটা বৈধ রাখলেও অতীতের আলেমরা সম্ভবত: মুসলিম-অমুসলিমদের সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে তা স্থগিত করেছিলেন। এখন যেহেতু অমন ধর্মযুদ্ধ নেই তাই সায়লানী ট্রাস্ট কোরান মোতাবেক অমুসলিমদেরকে ত্রাণসামগ্রী দিতে পারত। (২) সেটা করতে না পারলে সায়লানী ট্রাস্ট অমুসলিমদের জন্য আলাদা টাকা তুলে তাদের ত্রাণসামগ্রী দিতে পারত। এই ঘটনার পরে কিছু মুসলিম ও ইসলামী সংগঠন সেটা করেছে ও সারা দেশ তাদের প্রশংসা করেছে।

করুণাময়ের বিশ্ব এখন বিকট করোনাময়,

পৃথিবী ঘিরেছে মহা আশংকা, আতংক আর ভয়।

বিপরীত স্রোতে সময়ের ঝড় মাঠঘাট প্রান্তরে,

পশুপাখী ঘোরে মহা আনন্দে, মানুষ বন্দী ঘরে।

প্রকৃতির প্রতিশোধের হাতুড়ী পড়েছে বজ্রাঘাতে,

পরাক্রান্ত “শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি” আজ ভূমিশয্যাতে…  

প্রতিটি বিষয়ে বিশ্বমানসে “রিসেট বাটন”-এ চাপ পড়েছে, দুনিয়া বদলে গেছে চিরকালের জন্য। এই দুঃসময়ে সমূহ দরকার ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়ে পরষ্পরকে কাছে টেনে নেবার, দূরে ঠেলে দেবার নয়। সবাই ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।

************************************************

তুরস্কের হায়া সোফিয়া – ‘ইসলামের বিজয়’?

১৮ জুলাই, ২০২০

প্রশ্নটা উঠেছে এবং সময়ই এর জবাব দেবে। বস্তুত; বহুদিন ধরে বিশ্ব-মানব তাদের সীমিত সম্পদের (সময়, জ্ঞান, অর্থ, চিন্তা, প্রচেষ্টা ইত্যাদি) বেশিরভাগই ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক সমস্যা সমাধানে নয় (দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা ইত্যাদি) বরং নিজেদেরই সৃষ্ট সমস্যার পেছনে (যুদ্ধ, সুইসাইড বম্বিং, পুঁজিবাদের শোষণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি)। এ কেমন সেরা সৃষ্টি?

সংক্ষেপে পটভূমি:

৫৩৭ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান কনস্টান্টিনোপলে তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইমারত এই ‘হায়া সোফিয়া’ গির্জা তৈরি করেন। দীর্ঘ ৯১৬ বছর ওখানে (বিভিন্ন সময়ে অর্থোডক্স ও ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের) উপাসনার পর ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান মুহাম্মদ ফতেহ কনস্টান্টিনোপল দখল করে খ্রিস্টান প্রতিকৃতিগুলো কোরানের আয়াত দিয়ে ঢেকে ওটাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গির্জাটা ব্যক্তিগত টাকায় কিনেছিলেন। বেচাকেনার সেই দলিল তুর্কি সরকারের কাছে আছে, ওটার কপি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক খেলাফত উচ্ছেদ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ৪৮১ বছর ওখানে মুসলিমদের ইবাদতের পর ১৯৩৪ সালে তিনি ওটাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। তারপর ১০ জুলাই ২০২০, ‘এই গির্জাকে জাদুঘর বানানো ভুল ছিল’ সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এটিকে মসজিদ বানানোর আদেশে সই করেছেন। স্বভাবতই এ নিয়ে তুমুল আন্তর্জাতিক, ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া হয়েছে, পক্ষ-বিপক্ষের দলিলপত্র, যুক্তি ও স্কলারদের বক্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও ইন্টারনেটে ব্যাপক কুরুক্ষেত্র চলছে।

বিরোধী পক্ষের বক্তব্য:

“অটোমান সম্রাট যা করেছিল সেটা ছিল লজ্জাজনক, অপমানজনক এবং সুস্পষ্ট গুনাহ….. এখন তুরস্ক আবার সেটাই করল, লজ্জাজনক, অপমানজনক এবং সুস্পষ্ট গুনাহ” -প্রাক্তন কূটনীতিক বর্ষীয়ান ইমাম শেখ ইমরান হোসেন, যার কয়েক মিলিয়ন অনুসারী আছে।

যেহেতু বিষয়টা জরুরি ছিল না তাই বিশ্ব-মহামারীর দুঃসহ দুর্যোগের মধ্যে হঠাৎ এই নতুন বিতর্ক অনেককেই বিরক্ত করেছে। সব সমাজেই সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত আছে, তুরস্কের খ্যাতনামা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক ইয়ালদিরাই ওগুর বলেছেন “তুরস্কের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে পাশ্চাত্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে”। আমিরাতের যুব ও সংস্কৃতি মন্ত্রী এবং ন্যাশন্যাল কমিটি ফর এডুকেশন অ্যান্ড সায়েন্স-এর চেয়ারপার্সন বিদুষী নারী নুরা বিনত মুহাম্মদ আল কাবি বলেছেন বিশ্বের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো বিশ্বমানবের সম্পদ, এগুলোকে সংরক্ষণ করা উচিত।

তুরস্কের বিপক্ষে সোচ্চার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি গেজেট, আল আরাবিয়া, আরব নিউজ ইত্যাদি সংবাদপত্রের কিছু কলামে এরদোয়ানকে ‘মুনাফেক’, ‘উগ্রপন্থী’ বলা হয়েছে। তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকসহ অনেক মুসলিমের মতে বিশ্বময় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের উত্থানের এই বৈরীকালে তুরস্কের উচিত ছিল হযরত ওমরের (র) আদর্শ অনুসরণ করা। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা জেরুজালেম জয় করলে তিনি সেখানে যান। শহরের পাদ্রী সোফ্রোনিয়াস তাকে গির্জার ভেতর নামাজ পড়ার করার আমন্ত্রণ জানালে তিনি বলেন সেখানে নামাজ পড়লে ভবিষ্যতে মুসলিমরা এই অজুহাতে গির্জাকে মসজিদ বানিয়ে ফেলতে পারে। তিনি গির্জার বাইরে নামাজ আদায় করেন যেখানে পরে ‘মসজিদে ওমর’ নির্মিত হয়।

তুরস্কের বিপক্ষে রুশ অর্থোডক্স চার্চ-প্রধান ক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন, ভ্যাটিকানের পোপ ‘ব্যথিত’ হয়েছেন, ইউনেস্কো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রীসসহ বিভিন্ন দেশ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে৷ ইউনেস্কো জানিয়েছে কোনো আলোচনা না করে তুরস্কের এই একতরফা সিদ্ধান্তে ইউনেস্কো গভীরভাবে মর্মাহত, তুরস্ক যেন “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্ট”-এর আইনগুলো মেনে চলে (‘হায়া সোফিয়া’ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টের অন্তর্ভুক্ত)। জবাবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, “আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ আমরা ইউনেস্কোকে জানাব। তুরস্কের সিদ্ধান্ত দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। যেভাবেই হোক আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে অবশ্যই রক্ষা করব, তুরস্কের সার্বভৌমত্বকে লংঘন করে এমন মতামতকে আমরা জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করব”।

সমর্থক পক্ষের বক্তব্য:

তুরস্ককে সমর্থন জানিয়েছেন ড. জাকির নায়েক, ড. ইয়াসির ক্বাধী’র মতো বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী স্কলারেরা যাদের অসংখ্য অনুসারী আছে। সমর্থন করেছে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক, ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী সংগঠন ‘মুহম্মদীয়াহ’ ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন ‘নাহদাতুল উলামা’ সহ আরো অনেকে। ইন্দোনেশিয়ার সাংসদ সুরাহমান হেদায়েত সহ সাইপ্রাস, ইরান ও রাশিয়া বলেছে এটি তুরস্কের ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’, বহু মুসলিম এটাকে ‘ইসলামের বিজয়’ হিসেবে উল্লাস করছেন, কেউ কেউ এটাকে বাবরি মসজিদের ব্যাপারে ‘ভারতের ওপর সফল প্রতিশোধ’ হিসেবেও দেখছেন, এরদোয়ানকে অনেকে মনে করছেন ‘মুসলিম বিশ্বের নতুন সুলতান’। বিশ্ব-মুসলিমের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের আকাঙ্খায় এটা স্বাভাবিক।

তুরস্ক-সমর্থকদের যুক্তি হল,

  • বহু বছর ধরে তুরস্ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেবার চেষ্টা করছে। এই ঘটনায় সেটা বিঘ্নিত হল কিন্তু ইসলামের সেবার চেয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়া বেশি জরুরি নয়।
  • ড. ইয়াসির ক্বাধী দাবি করেছেন বিজয়ী সুলতানের অধিকার ছিল গির্জা নিয়ে যা খুশি করার। তার পরেও তিনি ওটা কিনে নিয়েছিলেন।
  • ড. জাকির নায়েকও একই দাবি করে বলছেন জেরুজালেমের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি ছিল যা কনস্টান্টিনোপলের ক্ষেত্রে ছিল না। কাজেই দুটোর তুলনা করা ঠিক নয়।
  • সম্প্রতি পশ্চিমা দেশে বহু গির্জা মসজিদ কমিটির কাছে বিক্রি করা হয়েছে,
  • জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া পুরনো মসজিদকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনা কেন অন্যায় হবে?
  • স্পেনসহ বহু দেশে অমুসলিমরা মুসলিমদেরকে পরাজিত করে বহু মসজিদকে গির্জা বানিয়েছে,
  • ইসরাইল ৭০০ বছরের পুরোন আল আহমার মসজিদকে নাইট ক্লাব বানাল তখন বিশ্ব-বিবেক কোথায় ছিল?
  • বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় ইউনেস্কো কী করছিল?

যুক্তিগুলো শক্তিশালী। তবে কিনা, শেষের উদাহরণগুলোও অপরাধ এবং এক অপরাধ দিয়ে অন্য অপরাধের বিচার করা যায় না। তাছাড়া, ইসরায়েল আল আহমার মসজিদকে নাইট ক্লাবে রূপান্তরিত করল, এই ন্যাক্কারজনক কাজের বিরুদ্ধে মুসলিম নেতারা কিছু করেননি কেন? ৫৬টা মুসলিম দেশের শক্তিশালী সংগঠন ও আই সি কিছু করেনি কেন? তাদের তো দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়ার কথা !

কালতামামি

১. কনস্টান্টিনোপলে বিজয়ী পক্ষ নিজেরই সম্পত্তি ‘কিনে নিলেন’, এটা ইতিহাসের এক মহা ব্যতিক্রম। কারণ আদিকাল থেকেই বিজয়ী রাজা পরাজিত অঞ্চলের জমি, বাড়িঘরসহ প্রতিটি জিনিস এমনকি পরাজিত জনগণেরও একচ্ছত্র মালিক হতো। নারী-সম্ভোগ ছিল রুটিন ব্যাপার এবং মুসলিম সৈন্যরাও এর ব্যতিক্রম নয়। (কেউ যদি একাত্তর ভুলে গিয়ে থাকেন গুগল-এ ‘ব্যাটল অফ হাররা’ দেখে নিতে পারেন)

২. গির্জা বিক্রিটা কে কী অধিকারে করল এটা যৌক্তিক প্রশ্ন, যদিও ভক্তিমার্গের যুক্তিগুলো বড়ই রহস্যময়। ওটা পাড়ার গির্জা ছিল না, ওটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় উপাসনালয়। যেমন আমাদের কাবা, পোপের ভ্যাটিক্যান, অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দির, তেমনি। এগুলো কি বিক্রি করা যায়? এগুলো কি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে? তাছাড়া, পরাজয়ে লাঞ্ছিত অপমানিত ধর্মগুরু অপমানকারীর কাছে নিজেদের উপাসনালয় বিক্রি করে দেবেন, এ কেমন অঙ্ক?

৩. এখন পশ্চিমা দেশগুলোতে যে গির্জাগুলো কিনে মসজিদ হয়েছে সেগুলো প্রধানত ট্রাস্টের সম্পত্তি, অতীতের বিজয়ী রাজাদের সম্পত্তির মতো ব্যক্তিগত বা মুসলিমদের ক্ষেত্রে খেলাফতের সম্পত্তি নয়। এই কেনাবেচা রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, বিজয়ী রাজাদের মতো ইচ্ছাধীন নয়। আসলে উপাসনালয়ের ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবিশ্বাস্য উদাহরণ রেখে গেছেন শিখ গুরু অর্জুন দেব। ১৫৮৫ সালে অমৃতসরে শিখদের সর্বোচ্চ উপাসনালয় স্বর্ণমন্দির নির্মাণে তিনি সেটার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়েছিলেন লাহোর থেকে মুসলিম দরবেশ শেখ মিয়া মীরকে ডেকে এনে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন চমৎকার উদাহরণটা কোথায় হারাল?

৪. তুর্কী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মুখে ‘সার্বভৌম’ ও ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ শুনে মনে পড়ে কিছু? গণতন্ত্রের স্বঘোষিত বিশ্ব-মোড়লেরা সার্বভৌম মিসরের গণতান্ত্রিক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেনি বরং বিচারের নামে খুন করেছে। আমেরিকার সৈন্যেরা ‘সার্বভৌম’ পাকিস্তানকে কিচ্ছু না জানিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকে বিন লাদেনকে খুন করে লাশ এনে সাগরে ফেলেছে। কাশ্মীর গিলে খাবার পর জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ভারতীয় প্রতিনিধি এরকম ঘোষণা করেছিলেন, “আমরা সার্বভৌম দেশ, কাশ্মীর আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়”। উগ্র নেতারা এরকম ঘোষণা দিয়েছিল, “লর্ড রামের জন্মস্থান সার্বভৌম ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্য, ওটা আমরা অবশ্যই উদ্ধার করব”। একাত্তরে পাকিস্তানও বলেছিল আমাদের ওপরে গণহত্যা গণধর্ষণ তার ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উঠলে এই একই আপ্তবাক্য বলেছিল গোলাম আজমও, তথ্যসূত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দলিল।

না, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, মিসর, নাইজেরিয়া, সিরিয়ায় খ্রিস্টানরা, চীনে উইঘুর মুসলিম, পাকিস্তানে বেলুচদের ওপরে অত্যাচার, ইসরায়েলের ঐতিহ্যবাহী আল আহমার মসজিদকে নাইট ক্লাবে রূপান্তরিত করা, বাংলাদেশে এবং আরব স্প্রিং-এর সময় মিসরে অজস্র মন্দির ও গির্জা ধ্বংস, আফগানিস্তানে দুনিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস, একাত্তরে আমাদের ওপরে গণহত্যা গণধর্ষণ এগুলো কারো ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ নয়। সারা দুনিয়ার অধিকার ও দায়িত্ব আছে এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। কারণ “Injustice anywhere is threat to justice everywhere” -মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

৫. মুসলিম শুধু তুরস্কে বাস করে না। তুরস্কের পক্ষে যতই দলিল-যুক্তি, যত ইসলামী স্কলারেরাই থাকুন না কেন এটাতে বিশ্বমানবের অকল্পনীয় ক্ষতি হতে পারে। ইসরাইলের হাতে আছে আল আকসা মসজিদ। ছলের তো বাহানার অভাব হয় না, ইসলামের আগে ওটা তো ওদেরই উপাসনালয় ছিল! সেটা তারা সিনাগগ বানালে তা হবে তার ‘আভ্যন্তরীণ” বিষয়’, বিশ্ব মুসলিম চীৎকার করে হাত-পা ছুঁড়লে সে তুরস্কের এই উদাহরণ তাদের কপালে ছুঁড়ে সেখানে আলু তুলে দেবে। ভারতের বিজেপি-আর এস এস-এর লক্ষ লক্ষ উগ্র ধর্মান্ধের হাতে আছে মোগল আমলের তাজমহলসহ কয়েকশ’ ‘মন্দির ভেঙে মসজিদ’-এর তালিকা। সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরসহ অতিকায় দিগগজ পণ্ডিতদের সুগভীর গবেষণায় ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত’। সেগুলোর ভিত্তিতে মোদী সরকার যদি বাবরি মসজিদের মতো ওই মসজিদগুলো মন্দির বানায়, বিশ্ব মুসলিম চীৎকার করে হাত-পা ছুঁড়লেই সে তাদের নাকের ডগায় তুরস্কের এই উদাহরণ তুলে ধরে মুখে স্কচ টেপ লাগিয়ে দেবে।

সভ্যতা এগিয়েছে সখ্যের শক্তিতে, সংঘাতের নয়। ইসলামের বিজয় জীবনে ও সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায়, সৈন্যবাহিনী দিয়ে দেশ দখলেও নয় কোর্ট-কাচারী করে ইমারত বিজয়েও নয়। অতীতে বিজয়ী রাজারা পরাজিতদের অজস্র উপাসনালয় ধ্বংস করেছে বা বদল করে নিজেদের করেছে। সেই প্রেতাত্মার বোঝা আমরা কেন বয়ে বেড়াব?

*********************************************

হায়রে ভজনালয় !  

৩ আগস্ট, ২০২০

“হায়রে ভজনালয়,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়” - নজরুল। 

ভণ্ড ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে ক্রোধে ক্ষোভে এতো বিস্ফোরিত হননি আর কোনও কবি লেখক। তবে সে ছিল ব্যক্তির ভণ্ডামী। এখন নজরুল ফিরে এলে মসজিদ-মন্দির-গির্জা-সিনাগগ নিয়ে রাষ্ট্রের কাণ্ডকারখানা দেখে হয়ত বিস্ময়ে পাথর হয়ে যেতেন, হয়ত সময়ের আগেই তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যেত।     

ক. ক’দিন আগে লাহোরে শিখ উপাসনালয় ঐতিহাসিক গুরুদুয়ারা “নানক শাহি”-কে মসজিদে রূপান্তর করছে পাকিস্তান সরকার। 

খ. ঘটনাটিকে ভারত “গুরুতর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে” এবং খুবই গুসসা করে নয়াদিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে “কড়া প্রতিবাদ” জানিয়েছে। ভারত সরকার তীব্র স্মৃতিভ্ৰংশ রোগে ভুগছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। মাত্র কমাস আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সে ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই ভাঙ্গাগড়ার ছবি ও খবর প্রকাশিত হবে সর্বত্র, চিরকাল থেকে যাবে ইন্টারনেটে। বিজয়ের  উল্লাসে ফেটে পড়েছেন অনেকেই। তাদেরকে কে বোঝাবে ওটা কোনো বিজয় নয়, ওটা ইলোরা-অজন্তা-হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো-ময়নামতি-পাহাড়পুর-মহাস্থানগড়ের প্রাচীন সভ্যতার পরাজয়।

গ. ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্ম হবার আগে থেকেই সেখানে অনেক মসজিদ ছিল। ইসরায়েলের নিষিদ্ধ সংগঠন “ইসলামিক মুভমেন্ট”-এর ডেপুটি নেতা শেখ কামাল খতিবের গবেষণা থেকে “মুসলিম মিরর” মিডিয়া জানাচ্ছে ইসরায়েল:

** প্রায় ৪০টি মসজিদ ধ্বংস, বন্ধ বা নিষিদ্ধ করেছে, 

** কমপক্ষে ১৫টি মসজিদকে সিনাগগ (ইহুদী উপাসনালয়) বানিয়েছে,

** ১৭টি মসজিদকে রেস্টুরেন্ট, মদ্যপানের বার ও মিউজিয়াম বানিয়েছে।  এর মধ্যে আছে আল-জাদিদ, আইন হাদ ও আল-সিকসিক মসজিদকে মদ্যপানের বার এবং  আল-আহমার মসজিদকে কনসার্ট হলে পরিণত করা হয়েছে।

** ওই অঞ্চলে ক্রমাগত যুদ্ধে যেসব মুসলিম পরিবার অন্য দেশে চলে গিয়েছিল, ইসরায়েল আইন বানিয়ে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে যার মধ্যে অনেক মসজিদ ছিল। 

লক্ষ্যণীয়, জাতিসংঘে ৫৭টি মুসলিম দেশের শক্তিশালী সংগঠন ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন)-এর শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। ইসরায়েলের এই ইসলাম-বিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধ বা জাতিসংঘে কোনো উদ্যোগের খবর আমরা পাইনি। এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের অগণিত আলেম-মওলানারাও তাদের ওপর কেন চাপ সৃষ্টি করেননি সেটাও স্পষ্ট নয়। মুসলিম বিশ্বের জন্য এটা অত্যন্ত হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক।

ঘ. এবারে তুরস্ক। ১৪৫৩ সালে তুরস্ক-বিজয়ী সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপলে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু খ্রীস্টানদের সর্বোচ্চ ভজনালয় হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। ওটা নাকি তিনি কিনেছিলেন। কার কাছ থেকে কিনেছিলেন? হায়া সোফিয়া কোনো পাড়ার গীর্জা ছিলনা, ওটা ছিল দুনিয়ার এক বৃহৎ ধর্মগোষ্ঠীর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ও সর্বপ্রধান উপাসনালয়।  ঠিক যেমন আমাদের কাবা, পোপের ভ্যাটিক্যান বা শিখদের স্বর্ণমন্দির। এগুলো কি বিক্রি করা যায়? কেনা যায়? এগুলো বিক্রি করার ক্ষমতা কারো নেই, বিক্রি করারও নেই। দুনিয়ার কেন্দ্রীয় উপাসনালয়গুলোর পরিচালনা কমিটি উপাসনালয়গুলোর খাদেম মাত্র, মালিক নন। সৌদি বাদশা যেমন কাবা শরীফের “খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন”, ঠিক তেমনি। তিনি কি কাবা শরীফ বিক্রি করার ক্ষমতা রাখেন ? মোটেই নয়, সেটা কল্পনাও করা যায়না।   

১৯৩৫ সালে কামাল আতাতুর্ক সেটাকে জাদুঘর করেছিলেন, এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সরকার সেটা মসজিদ করেছে। বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়েছেন মুসলিম-বিশ্বের অনেকেই। তাঁরা খেয়াল করছেন না তুরস্কের এ সিদ্ধান্ত ভারতের বাবরি-গ্রাস ও ইসরায়েলের মসজিদ-গ্রাসকে বৈধ করে দিল, সেইসাথে বর্তমান মসজিদগুলোকেও বিপদের মধ্যে ফেলে দিল। নিজে কাঁচের ঘরে বাস করে অন্যের ঘরে ঢিল ছোঁড়া ঠিক নয়। ইসলামের বিজয় ন্যায়বিচার ও শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই, কোর্ট-কাচারি করে ইমারত দখলের মধ্যে নয় এটা তারা মোটেই খেয়াল করছেন না। ইস্তানবুল শহরে অসংখ্য মসজিদ আছে, হায়া সোফিয়ার কাছেই ১৬১০ সালের দিকে বানানো সুলতান আহমেদ মসজিদ (The Blue mosque) একাই ১০ হাজার মুসল্লি ধারণ করতে পারে। তার পরেও হায়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে মসজিদ বানানোটা কোনো ইসলামী বা মুসলিম প্রয়োজন ছিলনা, রাজনৈতিক প্রয়োজন থাকতে পারে।  

ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানোর সিদ্ধান্তের পর আমরা কি হাজার কণ্ঠের উল্লসিত হুংকার শুনিনি: “ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায় – কাশী মথুরা বাকি হ্যায়”? ভারতে ইতোমধ্যে সরকারি দলিলে ঐতিহাসিক ‘এলাহাবাদ’ (আল্লাহ আবাদ)- এর নাম হয়ে গেছে ‘প্রয়াগরাজ’, ঐতিহ্যবাহী ‘আহমেদাবাদ’-এর নাম হয়ে গেছে ‘কর্ণাবতী, বাংলা সাহিত্যে বহুল উল্লেখিত বিখ্যাত ‘মুঘলসরাই স্টেশন’- এর নাম হয়ে গেছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে ‘দীনদয়াল স্টেশন’, পুরো ফৈজাবাদ জেলার নাম হয়ে গেছে অযোধ্যা জেলা (আগে অযোধ্যা ছিল ফৈজাবাদ জেলার একটি শহরের নাম যেখানে বাবরি মসজিদ আছে) ৷  চেষ্টা চলছে ‘তাজমহল’-কে ‘তেজোমহালয়া’, ‘হায়দ্রাবাদ-কে ‘ভাগ্যনগর’, ‘আগ্রা’-কে ‘অগ্রভান’ বা ‘অগ্রয়াল’, ‘মুজফফর নগর’-কে ‘লক্ষ্মীনগর’ ও ‘আমদাবাদ’কে ‘অমরাবতী’ করার।

গল্প নয়, নয় কল্পনা।

ভারতের অজস্র মসজিদের নিয়তি ঝুলছে এই গুরুতর মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রশক্তির হাতে যাকে আরো শক্তিশালী ও বৈধ করেছে তুরস্ক। ভারতের হিন্দুরাষ্ট্রপন্থীদের হুংকার দেখুন -      “সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ৯টি মন্দির ভেঙে মসজিদ”:-  

১। রাম জন্মভূমি মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ,  

২। বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে জ্ঞানভাপি মসজিদ,

৩। মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির ভেঙে শাহী ইদ্গাহ মসজিদ,

৪। গুজরাটের রুদ্র মহালয়া মন্দির ভেঙে জামী মসজিদ,

৫। মধ্যপ্রদেশে ভোজশালা মন্দির ভেঙে কামাল মৌলানা মসজিদ, 

৬। পানডুয়াতে আদিনাথ মন্দির ভেঙে আদিনা মসজিদ,

৭। আহমেদাবাদে ভদ্রকালী মন্দির ভেঙে জামা মসজিদ,

৮। মধ্যপ্রদেশে বিজয় মন্দির ভেঙে বিজামণ্ডল মসজিদ,

৯। দিল্লীর ধ্রুব স্তম্ভ ভেঙে কুতুব মিনার। 

কী মনে হয়?  

উপাসনালয় হোক বা সীমানা হোক, “ওটা আগে আমাদেরই ছিল” এই ভয়ংকর অন্তহীন চক্রটা মানবতার অবর্ণনীয় ক্ষতি করেছে। ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরে জার্মান বাহিনীর পোলিশ করিডোর আক্রমণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুটাই হয়েছিল হিটলারের ওই দাবির ভিত্তিতে – “ওটা আগে আমাদেরই ছিল”। দাবিটা মিথ্যে নয়। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে গেলে ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ফ্রান্সের ভার্সাই শহরের রাজপ্রাসাদে বসে বিজয়ী আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া জার্মানির ওপরে অত্যন্ত বর্বর “ভার্সাই চুক্তি” চাপিয়ে দেয়। ওটা ছিল জার্মানির অর্থনৈতিক মৃত্যুসনদ।  ভার্সাই চুক্তির একটা ধারায় বাল্টিক সাগরের ধারে জার্মানির অঞ্চলটা “পোলিশ করিডোর” নাম দিয়ে পোল্যান্ডকে দেওয়া হয় যাতে পোল্যান্ড বাল্টিক সাগরের সুবিধে পেতে পারে। অথচ ওখানকার প্রায় সবাই নৃতাত্বিক দিক থেকে জার্মান এবং তারা জার্মান ভাষাতেই কথা বলেন।  ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানীর খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো কেড়ে নেয়া হয়, যেমন রূঢ়, সুদেতানল্যাণ্ড ইত্যাদি।  ফলে জার্মানিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, ১৯৩০ সালের পর সেই ক্রোধে ক্ষোভে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানী বিদ্রোহে ঘুরে দাঁড়ায় এবং ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বনাশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধে প্রায় আট কোটি লোক খুন হয়, ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগষ্ট হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে লক্ষ নিরপরাধের ওপরে আণবিক বোমার হত্যাযজ্ঞ হয়, অগণিত সম্পত্তি ধ্বংস হয়।

কাজেই, “ওটা আগে আমাদেরই ছিল” এক ভয়ানক দাবী। কবে না জানি হিজ এক্সেলেন্সি নরেন্দ্র মোদী বলে বসেন- ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আগে আমাদেরই ছিল, ওগুলো ফেরৎ চাই’! সেক্ষেত্রে কী বলব আমরা?

ভজনালয় নিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কালখেলা বন্ধ হোক। সারা দুনিয়ায় ওগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক, দরকার হলে নুতন বানানো হোক। 

ভজনালয় “লইয়া খেলা? 

বড় কাল খেলা!

এই বেলা ভেঙে দাও খেলা, নহে তুমি সে খেলার হইবে খেলনা” - বিসর্জন- কবিগুরু।

*******************************************************

মহামারী ফতোয়ার এপিঠ ওপিঠ : করোনা 

১২ মে, ২০২০

বর্তমান গবেষকেরা যেমন অতীতের দলিলগুলো হন্যে হয়ে খোঁজেন, তেমনি ভবিষ্যতের গবেষকেরা তন্নতন্ন করে খুঁজবেন এই করোনা ভাইরাস মহামারী ক্রান্তিকালে আমরা সাধারণ মানুষেরা কিভাবে এই ভয়াবহ দিনগুলো পার করেছিলাম, বিশ্বে কী কী ঘটেছিল ও কেন ঘটেছিল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতারা কী কী নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই বিভিন্ন বিষয়ের অন্যতম হল ধর্ম বিশ্বাস। এজন্যই ধর্মনেতাদের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ অগণিত ভক্ত তাদের সিদ্ধান্ত ও ফতোয়াগুলো বিশ্বাস করে ও জীবনে প্রয়োগ করে। 

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নির্দেশ দিয়েছেন সবাই যেন গণজমায়েত পরিহার করে, অন্যদের থেকে অন্তত ২ মিটার দূরত্বে থাকে। কারণ গণজমায়েত মানেই হল গণমৃত্যুর ঝুঁকি। এই মুহূর্তেও এমন গণমৃত্যু অসহায়ভাবে মানুষ দেখছে বিশ্বময়। আমাদের মতো দেশে অনেক ক্ষেত্রেই  সঙ্গ-নিরোধ কঠিন বা অসম্ভব কিন্তু কিছু গণজমায়েত এড়ানো যেত যেমন বিয়ে, রাজনৈতিক জমায়েত, নির্বাচন ইত্যাদি। এই দুঃসময়ে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া গুষ্টিসুদ্ধ লোক নিয়ে নাতির বিয়ে দিয়েছেন বেঙ্গালোরে, চিন্তা করা যায়? যাহোক, এ নিবন্ধ ধর্মবিশ্বাসের গণ্ডিতে থাকবে। আমরা আলেমদের সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ফতোয়াগুলোকে (ধর্মীয় মতামত) ঘষে নেব দুটো ইসলামী কষ্টিপাথরে – 

(১) আল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে আমাদের ওপরে কঠোরতা আরোপ করেননি, তিনি আমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না – সূরা বাকারা ১৮৫, মায়িদা ৬, হজ্ব ৭৮। 

(২) আমাদের নবী (স) “রহমতুল্লিল আল আমিন”, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য কল্যাণকর। সেই কল্যাণটাই যদি বাস্তবে প্রমাণিত না হয় তবে সব কথাই বাগাড়ম্বর আত্মপ্রতারণা মাত্র।

অতএব, যে ফতোয়া সমাজে বা ব্যক্তিজীবনে অকল্যাণ বয়ে আনে বা আনতে পারে সেটা অবশ্যই ইসলাম-বিরোধী হিসেবে বর্জনীয়। এই গণমৃত্যুর ক্রান্তিকালে ফতোয়াগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে।  

১. ব্যক্তি বা গণজীবনের ওপর যেগুলোর কোনো বাস্তব প্রভাব নেই।

২. যেগুলোতে সমাজের কল্যাণ হয়েছে।

৩. যেগুলোতে সমাজের অকল্যাণ হয়েছে বা হবার সম্ভাবনা হয়েছে। এবারে উদাহরণসহ সেগুলো দেখা যাক।

১. যেগুলোর কোনো প্রভাব সমাজে নেই 

(ক) কিছু আলেম খেজুর বিক্রি ও ব্যাধি সম্পর্কিত দুটি হাদিসের ভিত্তিতে দাবী করেছেন ১২ মে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী শেষ হবে, কারণ সেদিন আকাশে সুরাইয়া তারাটা উঠবে। বিরোধী মওলানারা দাবী করেছেন সেটা ঘটবেনা। সেটা মোটেই হয়নি, ধর্মে এভাবেই রূপকথা ঢুকে পড়ে। 

(খ) খতমে জালালি- চট্টগ্রামের মাদ্রাসার ছাত্ররা সোয়া লাখ কাগজে আল্লাহর নাম লিখে কাগজগুলি সোয়া লাখ ময়দার আটার গুলির মধ্যে ভরে সেগুলোকে সাগরে ফেলেছে কারণ “এই আমল দ্বারা বিপদ হইতে উদ্ধার হইবে”। 

(গ) কোরান মোতাবেক “যারা আল্লাহ্‌র পথে জীবন দিয়েছে….আল্লাহ্‌র পথে হিজরত করে” এঁরা শহীদ। হাদিস ও অন্যান্য কেতাবে ৪০ রকমের মৃত্যুতে “শহীদ” হবার কথা আছে যার মধ্যে আছে মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী, “যে স্ত্রী তার সতীনের প্রতি তার স্বামীর (অন্যায়) ভালোবাসার দুঃখ সয়ে সয়ে মৃত্যুবরণ করে, প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী” ইত্যাদি – (মুফতি মনসূরুল হক, পরিচালক, জামেয়া রাহমানিয়া মনসুরিয়া, ঢাকা – bd24report.com, মে ১২, ২০২০)। 

তাহলে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলা কিংবা ভাঙা যুবলীগের প্রাক্তন সভাপতি আসলাম ফকিরের মতো অপরাধীরা কোভিড-১৯ মহামারীতে মারা গেলে তারা শহীদ হিসেবে জান্নাতবাসী হবে কি? সিরাজুদ্দৌলা তার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি-কে যৌন নির্যাতন ও পুড়িয়ে মারার নির্দেশের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত। আসলামের ২০০৩ সালে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড, ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে প্রাণভিক্ষা পেয়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, ২০১৭ সালে ২৬ মার্চে সাধারণ ক্ষমায় কারামুক্তি এবং ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল আবারো মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত।  

২. কল্যাণ-ফতোয়া 

শীর্ষ সৌদি ইসলামী প্রতিষ্ঠান দ্য কাউন্সিল অব ইসলামিক স্কলার্স তাদের ফতোয়ায় বিশ্ব-মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মুসলিমেরা যেন জামাতে নামাজ না পড়েন। মক্কা-মদিনার মসজিদেও নামাজ স্থগিত। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বোর্ড সহ মধ্যপ্রাচ্যের আলেমরা এবং ভারতের অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোন্যাল ল বোর্ড একই ফতোয়া দিয়েছেন। সরকারগুলো এসব ফতোয়া প্রয়োগ করেছেন, কিছু মুসলিম-প্রধান দেশে কারফিউ পর্যন্ত জারি হয়েছে। এ নাহলে আরো কত শত হাজার লোকের প্রাণহানি হতো কে জানে! এগুলো ইহুদী খ্রিস্টানের ষড়যন্ত্র নয় বরং বিশ্বের সর্বোচ্চ ইসলামী বিশেষজ্ঞদের ইজতিহাদ। সমাজ বদলের সাথে সমাজকল্যাণের জন্য কোরান-রসূলের (স) কিছু হুকুম সাময়িক স্থগিত বা আপডেট করতেই হবে আমরা চাই বা না চাই। মুসলিম ইতিহাসে এর অজস্র উদাহরণ আছে, এর অগ্রপথিক হযরত ওমর (র)। এরই ধারাবাহিকতায় মসজিদের মাইকে “হাইয়া আলাস  সালাহ’ (নামাজের জন্য এসো) এর জায়গায় ঘোষণা করা হয়েছে ‘আল সালাতু ফি বুয়ুতিকুম’ (ঘরে নামাজ আদায় কর – মুসলিম ইতিহাসে এর উদাহরণ আছে)। এমনকি ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম যে হজ সেটাও যুদ্ধের কারণে কার্যত বন্ধ ছিল ১৮০৩ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত টানা ৬ বছর। ( ‘দি ইনডিয়ান মুসলমানস’ –  স্যার উইলিয়াম হান্টার, পৃষ্ঠা ৪৭।)     

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের দোদুল্যমান “সতর্ক” অবস্থান লক্ষ্যণীয়। এই ক্রান্তিকালে যে কোনো গণজমায়েতে গণ-সংক্রমণে গণমৃত্যুর সম্ভাবনা। অথচ সরকার লম্বা সময় ধরে চেষ্টা করেছে জুমার নামাজ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করার বিষয়ে মওলানাদের “ঐক্যমত” পাবার। সে চেষ্টা ব্যর্থ হবারই ছিল এবং হয়েছেও। সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের এই সময়ক্ষেপণটা বিপজ্জনক ছিল। ৬ এপ্রিল সরকারী সর্বশেষ নির্দেশটাও প্রশ্নাতীত নয়।  

৩. বিপজ্জনক ফতোয়া ও সিদ্ধান্ত   

এই ভয়াবহ সময়ে যখন বিশ্ববাসী শ্বাসরুদ্ধ গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছে, সরকারগুলো সর্বশক্তিতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত তখন কিছু ধর্মগুরু গণজমায়েতের ধর্মাচার পালন করেছেন, ফলে জনজীবনে ঘোরতর দুর্দিন নেমে এসেছে। 

·         দক্ষিণ কোরিয়াতে এই মহামারী ছড়িয়েছে এক চার্চ থেকে, চার্চ প্রধান লি মান-হি হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নত করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
·         ব্রিটেনে হিন্দু গোষ্ঠী ইসকন স্বীকার করছে লন্ডনে তাদের এক গুরুর শেষকৃত্যে অংশ নেওয়া হাজার খানেক সদস্যের কমপক্ষে ২১ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, মারা গেছে ৫ জন।
·         পাঞ্জাবের ইতালি ফেরৎ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত শিখ ধর্মগুরু ৪০ হাজার লোকের সংস্পর্শে আসার পর মারা গেছেন, সবাইকে লকডাউন করেছে কর্তৃপক্ষ।
 ভারতীয় টিভিতে গণজমায়েতের খবর– 

(১) গোমূত্র এই মহামারীর মহৌষধ, এই ঘোষণায় বিখ্যাত যোগগুরু বাবা রামদেব সহ বেশ কিছু গো-ভক্ত গোমূত্র খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন, এতে হাসপাতাল ও ডাক্তার নার্সদের ওপর অনাবশ্যক চাপ বেড়েছে। 

(২) বিজেপি বিশাল গণজমায়েত করে গরুর মাথায় ফুল-সিঁদুর লাগিয়ে মহা ধুমধামে গো-পূজা ও গোমূত্র পানের অনুষ্ঠান করেছে। 

(৩) টিভি ক্যামেরার সামনে পুলিশ ও জনতা গোমূত্র খেয়েছে ও মাথায় মেখেছে। 

(৪) করোনার কুশপুতুল তৈরি করে আগুনে পোড়ালে এ ভাইরাস পুড়ে মরবে, এক পুরুত ঠাকুরের এই ঘোষণায় গণজমায়েতে করোনা-যজ্ঞ হচ্ছিল, পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

(৫) করোনা-মৃত্যুপুরী নিউইয়র্কে সর্বোচ্চ করোনা-আক্রান্ত সমাজের অন্যতম রক্ষণশীল ইহুদী “হাসিডিক” দলের ধর্মগুরুর নির্দেশে ব্রুকলিনে আড়াই হাজার ভক্তের জমায়েতে এক মৃত ধর্মগুরুর শেষকৃত্যের আয়োজন হয়েছে।

এসব গণজমায়েত সমাজকে মারাত্মক গণমৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলেছে। এবারে আমাদের কিছু আলেমের এমনই কিছু আত্মঘাতী ফতোয়া দেখা যাক। 

ক. “দুনিয়ায় ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নেই, আল্লাহ কোনোই “ছোঁয়াচে রোগ”সৃষ্টি করেন নি” – ওয়াজ মাহফিলে উট সংশ্লিষ্ট কিছু হাদিসের ভিত্তিতে (সহি মুসলিম হাদিস ৫৫০৮, ৫৫০৯ ও ৫৫১০ ইত্যাদি) এ দাবি করেছেন কিছু আলেম। এইসব উদ্ভট ও বিজ্ঞান-বিরোধী দাবি ইসলামকে হাস্যকর করে তোলে। সেই দাবি অবশ্য অনেকেই অন্যান্য সূত্র-ব্যাখ্যা দিয়ে নাকচও করেছেন। কিন্তু প্রথম ওয়াজে উপস্থিত আমাদের অর্ধ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীদের কাছে নাকচ করা ব্যাখ্যাটা পৌঁছেছে কি? তাছাড়া রসূল (স) তো বলেছেন, কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো যেভাবে তুমি বাঘ (অন্য রেওয়ায়েতে সিংহ) থেকে দূরে থাকো! “স্পর্শ” বা “ছোঁয়া” শব্দ দিয়ে ছোঁয়াচে রোগের উল্লেখ তো কোরানেই আছে, রোগীর নামও আছে, সামেরী। (সূরা তোয়াহা আয়াত ৮৫, ৮৭ ও ৯৭।) 

তাহলে? 

খ. দিল্লিতে বহু হাজার মুসল্লীর জামাতে মওলানা সা’দ (তবলীগ জামাত-প্রধান) ঘোষণা দিয়েছেন: “হ্যাঁ, ভাইরাস আছে কিন্তু আমাকে রক্ষা করার জন্য আমার সঙ্গে ৭০ হাজার ফেরেশতাও আছে। করোনাভাইরাস সতর্কতা (২ মিটারের সঙ্গ-নিরোধ) মুসলিম থেকে মুসলিমদের দূরে রাখার ষড়যন্ত্র”। বিশ্বজুড়ে যার লাখ লাখ ভক্ত আছে তার মুখে এমন ভয়াবহ ফতোয়ার ফলাফল ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তিনি কোনো গোপন জায়গায় আছেন।

গ. ফয়সালাবাদের মাওলানা সুহাইব ঘোষণা করেছিলেন এ ভাইরাস মুসলিমদেরকে ছুঁতেও পারবেনা, তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। অন্যান্য জায়গাতেও এমন দাবিদার কিছু আলেম আক্রান্ত হয়েছেন, অথচ আমাদের কিছু আলেম জোরগলায় এই একই ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাদের অনেক ভক্ত আছে। এটা সরকারের সঙ্গ-নিরোধ নির্দেশের লঙ্ঘন কিন্তু সরকার নিশ্চুপ। 

ঘ. মালয়েশিয়ায় তাবলীগ জামাত থেকেই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বলে সেখানকার সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে জানা গেছে।

এছাড়া আছে ফতোয়া ছাড়াই গণজমায়েত – 

(ক) করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ‘আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে’ লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে লক্ষাধিক মুসল্লির উপস্থিতিতে খতমে শেফা এবং 

(খ) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় “প্রায় লাখো” লোক। সংবাদ শিরোনাম ছিল – “এক জানাজা আজ হাজার লক্ষ জানাজার কারণ হয়ে দাড়াঁচ্ছে না তো”? কপাল ভালো যে তারপর ১৪ দিনের বেশী কেটে গেছে কোনো সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর ফলে গণমৃত্যুর ভয়ংকর বিস্ফোরণ হতে পারত। স্মর্তব্য, গণ-জানাজা কোনো আবশ্যিক ফরজ নয়, একজন বা কয়েকজন জানাজা পড়লেও এই ফরজে কেফায়া (সমাজের সামষ্টিক কর্তব্য) আদায় হয়ে যায়। আলেমরা এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টি করলে ভালো হয়, নতুবা গণমৃত্যুর এমন ঝুঁকি আবারও ঘটতে পারে। 

ধর্মবিশ্বাস সংশ্লিষ্ট এই বিপজ্জনক ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা নয়, এগুলো পরিকল্পনা করেই করা। কোনো ধর্মের কেতাবই সেই ধর্মের অপব্যবহার রোধ করতে পারেনা। ধর্মের মানবাধিকার-বান্ধব ও বাস্তব-বান্ধব ব্যাখ্যা দিয়ে ওটা পারেন শুধু ধর্মনেতারা। আলেমদের কাছ থেকে আমরা সেটাই আশা করি। অতীত আলেমরা কি বলেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বর্তমান আলেমরা ইসলামের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তাতে আমাদের কি উপকার বা অপকার হল। একটা ওষুধ আবিষ্কারের পেছনে হাজারো বিজ্ঞানীর শত বছরের পরিশ্রম ও মেধা থাকতে পারে কিন্তু সেটা খেয়ে যদি অসুখটাই না সারে কিংবা আরো বেড়ে যায় তাহলে আর লাভ কী হল? এখানেই ইজতিহাদের গুরুত্ব – এখানেই গাছের পরিচয় তার ফলে। সেখানে আমাদের আর যেন হতাশ হতে না হয়।

শুরুতে কোরান-রসূলের (স) যে দুটো কষ্টিপাথরের উল্লেখ করেছি, এই ঝঞ্ঝাসংকুল ভয়ংকর সময়ে এবং সর্বদা সেটাই হোক আমাদের পথ দেখানো বাতিঘর।

*************************************************

বিশ্বসেরা আলেমদের মতে ইসলামে সংগীত হারাম নয় –

১৯ জানুয়ারি, ২০২০

জবাবটা সিম্পল। ইমামরাই দাবি করেন, “মোহাম্মদী ইসলাম একটি ফিৎরাতি (অর্থাৎ প্রাকৃতিক) ধর্ম”। সংগীত মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। সেজন্যই প্রতিটি দেশ জাতি সভ্যতার ব্যতিক্রমহীন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সংগীত। যখন মানুষের ভাষা ছিল না, কাপড় ছিল না, তখনও মানুষ বিভিন্ন উচ্চারণে গান গেয়েছে, অতীত সভ্যতার গুহার দেয়ালে সেসব চিত্র আজও উৎকীর্ণ। এবং সেজন্যই সৌদি, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আমিরাত, জর্দান, সিরিয়া, মিসর, ইরাক, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেনসহ প্রতিটি মুসলিম দেশ ও প্রতিটি দেশের জাতীয় সংগীত আছে।

অসুখ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে মতভেদ হলে রোগীর যে করুণ দশা সংগীত নিয়ে আমাদেরও তাই। বিভিন্ন আলেম বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন, জনগণের কে কার মতামত মানবেন সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা মানছি ‘দুনিয়ার সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ইসলামী বিশেষজ্ঞ’দের মতামত, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাণ্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক এবং ডক্টর ইউসুফ কারযাভীর মত।

ইউসুফ কারযাভী তার প্রজ্ঞার জন্য সুপ্রসিদ্ধ। তার পরিচয় দেখুন-

১. বিশ্বের সর্ববৃহৎ অন লাইন ফতোয়া-সংগঠন “ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চ”-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট,

২. আন্তর্জাতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড-এর উপদেষ্টা ছিলেন,

৩. আন্তর্জাতিক আলেম-সংগঠন “ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স”-এর চেয়ারম্যান ছিলেন,

৪. বিশ্বময় “ইসলামী ব্যাঙ্কিং” এর প্রভাবশালী আলেম,

৫. কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান,

৬. “মুসলিম-বিশ্বের নোবেল” নামে বিখ্যাত “বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার” পদক পান,

৭. “ব্যাংক ফয়সল” পুরস্কার লাভ করেন।

৮. ব্রুনাই সরকার তাকে “হাসান বাকলি” পুরস্কার প্রদান করে।

মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রয়াত) গ্র্যান্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক (বিস্তারিতের জন্য সার্চ করুন “Al Azhar university – music in Islam, দি ইসলামিক টেক্সট ইনস্টিটিউট) এর মতে- “অনৈতিক ও গুনাহ-এর কর্মকাণ্ডের সহিত যুক্ত না হইলে, কিংবা সেই বাহানায় মানুষকে হারামের দিকে না টানিলে, কিংবা মানুষকে ফরজ ইবাদত (আল ওয়াজিবাত) হইতে সরাইয়া (বা ভুলাইয়া) না দিলে সংগীত শোনা, সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, এবং বাদ্যযন্ত্র বৈধ”।

ডক্টর কারযাভীও একই কথা বলেছেন- “কাজী আবুবকর ইবনুল আরাবী বলিয়াছেন ‘গান হারাম হওয়া পর্যায়ে একটি হাদিসও সহীহ নহে’। ইবনে হাজম বলিয়াছেন – ‘এ পর্যায়ের সকল বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত’… এ পর্যায়ে বর্ণিত নিষেধমূলক হাদিসগুলি সমালোচনার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ….বহুসংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীন গান শুনিয়াছেন,… যে গানের সাথে মদ্যপান, ফষ্টিনষ্টি ও চরিত্রহীনতার মতো কোনো হারাম জিনিসের সংমিশ্রণ হয় সেই গান হারাম… রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন- ‘কার্যাবলীর ভালোমন্দ নির্ভর করে তাহার নিয়তের ওপর।’ কাজেই যেই লোক এই নিয়তে গান শুনিল যে তাহার দ্বারা গুনাহের কাজে উৎসাহ পাওয়া যাইবে তাহা হইলে সে ফাসিক। পক্ষান্তরে যেই লোক স্বভাব মেজাজের সুস্থতা লাভের উদ্দেশ্যে শুনিল, আল্লাহর আনুগত্য কাজে শক্তি সাহস পাওয়ার এবং ভালো ও সৎকাজে আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে শুনিল, তাহার এই কাজ নিশ্চয়ই অন্যায় বা বাতিল নহে। আর যেই ব্যক্তি না আল্লাহনুগত্যের নিয়তে শুনিল না নাফরমানি নিয়তে, তার এই কাজ নিষ্ফল কাজের পর্যায়ে গণ্য।” - ইসলামে হালাল হারামের বিধান- পৃষ্ঠা ৪০৬ – ৪১১

এবারে কোরান।

সংগীতের আরবী হচ্ছে “মুসিকি”, সারা কোরানে ওই “মুসিকি” শব্দটাই নেই। কোরান কোথাও সংগীতকে নিষিদ্ধ করেনি অথচ “সঙ্গীত হারাম” দাবি করা হয় কোরানের দুটো আয়াত দিয়ে-

(১) সুরা লোকমান ৬ নম্বর আয়াত “একশ্রেণির লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ হইতে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে,

এবং

(২) বনি ইসরাইল ৬৪ নম্বর আয়াত (আল্লাহ শয়তানকে বলছেন) − “তুই তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে সত্যচ্যুত করে তাদেরকে আক্রমণ কর।”

সঙ্গীত-বিরোধীরা বলেন সুরা লোকমান ৬-এর ‘অবান্তর কথাবার্তা-ই নাকি ‘সঙ্গীত’ (মওলানা মুহিউদ্দিনের কোরানের অনুবাদ, পৃঃ ৭৮৩ ও ১০৫৩-৫৪)। কি হাস্যকর! আম জিনিসটা আম-ই। জামও নয়, কাঁঠালও নয়। ‘অবান্তর কথাবার্তা’ অবান্তর কথাবার্তাই, অন্যকিছু নয়। একই খেলা করা হয়েছে বনি ইসরাইলের ৬৪ নম্বর আয়াত নিয়েও। আয়াতটা হলো, মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ব্যাপারে আল্লাহ শয়তানকে অনুমতি দিচ্ছেন: “তুই সত্যচ্যুত করে তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, স্বীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ কর”। অথচ এর অনুবাদ করা হয়েছে: “তুই তোর…রাগ-রাগিনী গান-বাজনা ও বাদ্যবাজনা দ্বারা …।”

সংগীত-বিরোধী হাদিসগুলো ভিত্তিহীন তা আমরা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলারদের কাছ থেকে শুনলাম। সংগীতের পক্ষে অজস্র হাদিস আছে, লম্বা হয়ে যাবে বলে উদ্ধৃতি দিচ্ছিনা। এবারে চলুন আরো কিছু দলিল দেখা যাক।

১. অখণ্ড ভারতের সর্বোচ্চ ইসলামি নেতাদের অন্যতম, ভারতীয় কংগ্রেসের দুইবারের সভাপতি, কলকাতার ঈদের নামাজ পড়ানোর পেশ ইমাম মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন: “পয়গম্বর দাউদ (আঃ)-এর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মিষ্টি ছিল। তিনি সর্বপ্রথম হিব্রু সংগীতের সংকলন করেন ও মিশরের ও ব্যাবিলনের গাছ হইতে উচ্চমানের বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনা করেন”। (তর্জুমান আল্ কুরান, ২য় খণ্ড পৃঃ ৪৮০।)

২. “হজরত ওমর(রঃ)-এর আবাদকৃত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় হইল বসরা। আরবি ব্যাকরণ, আরূয শাস্ত্র এবং সংগীতশাস্ত্র এই শহরেরই অবদান” (বিখ্যাত কেতাব ‘আশারা মোবাশশারা’, মওলানা গরীবুল্লাহ ইসলামাবাদী,  ফাজেল-এ দেওবন্দ, পৃষ্ঠা ১০৬।)

৩. ইমাম গাজ্জালী: “নবী করিম (সাঃ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) সম্পর্কে বলিয়াছেন − তাঁহাকে হযরত দাউদ (আঃ) এর সংগীতের অংশ প্রদান করা হইয়াছে।” (মুরশিদে আমিন, পৃষ্ঠা ১৭০ − এমদাদিয়া লাইব্রেরি)

এরকম অজস্র দলিল আছে। ‘অশ্লীল আদেশ শয়তান দেয়’ (সুরা নূর ২১)। কাজেই সংগীতসহ শ্লীল কোনোকিছু হারাম হবার প্রশ্নই ওঠেনা। গানের কুৎসিৎ কথা, কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি বা গানের অতিরিক্ত নেশায় জীবনের ক্ষতি ইত্যাদির সীমা টানেননি ধর্মান্ধরা, পুরো সংগীতকেই ঢালাওভাবে বাতিল করেছেন। করে লাভ কিছুই হয়নি বরং সংগীত আজ সুবিশাল বিশ্ব-ইন্ডাস্ট্রি। দুনিয়ায় কোটি কোটি সংগীতপ্রেমী পরিবার পালছেন, বাচ্চাদের বড় করছেন, প্রতিভার বিকাশ ঘটাচ্ছেন। সংগীত হলো আমাদের সসীম জীবনে এক টুকরো অসীমের ছোঁয়া। চারদিকের আকাশবাতাস সাগর-পর্বত গ্রহ-নক্ষত্র, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিপুল সুরস্রষ্টার মহাসংগীত। তাই, গান শুনুন এবং বাচ্চাদের গান শোনান। গান করুন এবং বাচ্চাদের গান শেখান। গান যে ভালবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ হারাম নয়। ‘আমি বাংলার গান গাই’, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, ‘কান্দে হাছন রাজার মন ময়না’, মায়েদের মধুকণ্ঠে ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ হারাম হবার প্রশ্নই ওঠেনা। শ্লীল সংগীত ইসলামে হারাম নয়।

‘কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ইসলামে নিষিদ্ধ’ (মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও বিদায় হজ্বের ভাষণ)। সঙ্গীত হারাম মনে করলে শুনবেন না, অসুবিধে কী। কিন্তু যারা সংগীত ভালোবাসেন, সংগীতের পক্ষের বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলারদের কথা বিশ্বাস করেন, তাদেরকে আঘাত করাই সেই ইসলাম-বিরোধী বাড়াবাড়ি।

****************************************************

ধর্ষণ উচ্ছেদ - কবি নির্মলেন্দু গুণ ও শারিয়া আইন 

০৮ অক্টোবর ২০২০

"যদি ধর্ষণের চারজন মুসলিম পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষী না থাকে তবে ধর্ষিতার উচিত অভিযোগ না করে চুপ করে থাকা" - পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর তৎকালীন আমির সৈয়দ মুনাওয়ার হাসান একথা বলেছেন সাক্ষাৎকারের ২ মিনিট ৪৫ সেকেণ্ডে: -

https://www.youtube.com/watch?v=-Xul14hvBBg&feature=youtu.be&fbclid=IwAR1jbddf4BBYlIxK0kMmvnZetm0SsSo__8so3ppN27g8EBuKYPju-MYoAEM

   
  • বাংলাদেশে অব্যাহত ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে নারীর প্রতি সহিসংতার মামলাগুলোর দ্রুত বিচারে আইন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ – বিডিনিউজ ২৪ - ০৭ অক্টোবর ২০২০।
  • এপ্রিল থেকে আগষ্ট ২০২০ - দেশে ১৫৩ দিনে ৬৩২ নারী ধর্ষিতা হয়েছেন, ১৪২টি ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে, ৫ ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছেন - আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সূত্রে বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন জাতির ও সংসদের গালে চারবার পড়ছে ধর্ষকের চপেটাঘাত, দিনের পর দিন।

রাতে ঘুম হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর? প্রধানমন্ত্রীর? মুখে ভাত রোচে? ভিত্তি কেঁপে ওঠেনা সংসদভবনের?

  • বিশ্ব-কাঁপানো কোভিড মহামারীর চেয়ে লক্ষগুণ ভয়াবহ ধর্ষণ-মহামারীতে মারাত্মক অরক্ষিত হয়ে পড়েছেন আমাদের মা-বোনেরা। পুলিশ ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করছে কিন্তু তারপরেই সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, - ২০১১- জুন ২০১৮ - ছয়টি জেলায় ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ৫ জনের - আকবর হোসেন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা ২২ এপ্রিল ২০১৯। বিচার না পেয়ে ধর্ষিতার বাবা মেয়েসহ ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করেছেন।

এই দানব-বধের অনেক প্রস্তাবের দুটো হল:- (ক) ধর্ষকের ক্রসফায়ার এবং (২) শারিয়া আইনের প্রয়োগ।      

(ক) কবি নির্মলেন্দু গুণ ধর্ষণের মহামারীতে অতিষ্ট হয়ে তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন - “ধর্ষণের বিরুদ্ধে এইবার মানুষ যেভাবে সোচ্চার হয়েছে, তেমনটি পূর্বে কখনও হয়নি। জাতি এখন ক্রস-ফায়ারের অপেক্ষায় আছে। মনে হচ্ছে, ধর্ষণকে ‘না’ ও ক্রস-ফায়ারকে ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মাদকবিরোধী অভিযানে যদি শত শত ক্রস-ফায়ার চলতে পারে, ধর্ষণবিরোধী অভিযানে কেন নয়? আমরা ধর্ষণের শেষ দেখতে চাই। অনেক সয়েছি, আর নয়”।  তাঁর বক্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় অনেক ক্রসফায়ার-বিরোধীও সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে এর পক্ষেই বলেছেন। সাঈদ জাদীদ-এর লেখায় কোটি মানুষের ইচ্ছে প্রতিফলিত হয়েছে - "ক্রসফায়ারের উপযোগীতা আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি ……..এই মূহুর্তে ধর্ষণটা বন্ধ করে তারপর যা করার করুন…… আগুনটা আগে নিবিয়ে তারপর উৎস সন্ধান করুন। যম্মিন দেশে যদাচার…..তদন্ত অনেক হয়েছে……গুণের চাওয়া এখন কোটি মানুষের চাওয়া, আমারও"। 

যাহোক, পরদিন কবি নির্মলেন্দু গুণ নুতন পোষ্টে লিখেছেন আগেরটা তিনি "লজ্জায়, রাগে-দুঃখে এবং অসহায় ক্ষোভে" লিখেছিলেন। এটাতে তিনি সুন্দর একটা প্রস্তাব করেছেন। কবিরাই ভবিষ্যতের আইন প্রণেতা, জীবদ্দশায় যেসব অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা স্বাপ্নিক কলম ধরেন সেগুলোই শতবর্ষ পরে রাষ্ট্রের আইন হয়। উনি বলেছেন, সংক্ষেপে, ধর্ষণের মামলার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের আদলে "দ্রুততম বিচার ট্রাইবুনাল" গঠন করতে হবে, ঘটনার এলাকার পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও র‌্যাবের যৌথটিম তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দেবে, মন্ত্রণালয়ের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টিম রিপোর্টগুলি পর্যালোচনা করে অভিযুক্তদের রায় ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে শাস্তি কার্যকর করবেন। দ্রুততম সময়ে ধর্ষকদের বিচার নিশ্চিত করতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অর্ডিনেন্স জারী করতে পারেন যা পরে সংসদে পাশ করিয়ে নেয়া যেতে পারে।

প্রস্তাবটাকে কিছুটা আপডেট করছি: - 

১। অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তি দেয়াটা আদালতের কাজ।  

২। অনতিবিলম্বে "ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড" এই আইন পাশ ও প্রয়োগ করতে হবে। এই নরপিশাচেরা কারাদণ্ডে জনগণের টাকায় খাবে পরবে চিকিৎসা পাবে সেটা অন্যায়।

৩। এলাকার সংসদেরও জবাবদিহিতা থাকতে হবে।

৪। ধর্ষণের অভিযোগ জানানোর জন্য অবিলম্বে একটা সরকারী ওয়েবসাইট খুলতে হবে। এটা সহজ। 

৫। মাদ্রাসায় ধর্ষণ কোনো লুকোনো বিষয় নয়। আমাদের বিব্রত আলেমদের অনেকেই এর বিরুদ্ধে ওয়াজ করেন। কিন্তু যেহেতু ওয়াজে ফল হচ্ছেনা তাই ভালো হয় তাঁরা যদি সরকারের অপেক্ষায় না থেকে সবাই মিলে একটা শক্তিশালী কমিটি করেন যার অধিকার থাকবে দেশের যে কোন মাদ্রাসায় ঝটিকা সফর করার, ছাত্রছাত্রীদের সাথে একান্তে কথা বলার। এর সাথে তাঁরা অভিযোগের ওয়েবসাইটও খুলতে পারেন। আরো কার্য্যকর হবে যদি তাঁরা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতো কোনো প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যৌথভাবে এ কাজ করেন।

(খ) এবারে শারীয়াপন্থীদের দাবী - “আল্লাহর আইন প্রয়োগ করে দেখুন, দেশ থেকে ধর্ষণ উঠে যাবে।” তাঁদের উদ্বেগ প্রশংসনীয়। আমরাও চাই শারিয়া বা যা কিছু দিয়েই হোক এ দানব উচ্ছেদ হোক। কিন্তু আমরা শারিয়া-কোর্টে বহু ধর্ষিতার চাবুক-দণ্ড, কারাদণ্ড এমনকি মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা দেখেছি। অবিশ্বাস্য মনে হবে কিন্তু এমন উদাহরণ অজস্র, যেমন:- 

(১) সোমালিয়ার শারিয়া কোর্ট ২০০৮ সালে গণধর্ষিতা আয়েশা দুহুলো'কে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কার্যকর করেছে, জাতিসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল বান কি মুন তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন,

(২) নাইজিরিয়ায় শারিয়া কোর্ট ২০০১ সালে ধর্ষিতা বালিকা বারিয়া মাগাজু'কে ১৮০ বেত্রাঘাতের শাস্তি দিয়েছে,

(৩) পাকিস্তানে তিন হাজারের ওপর ধর্ষিতারা শারিয়া কোর্টের রায়ে দশ বারো বছর জেল খেটেছেন। 

হ্যাঁ অবিশ্বাস্য - কিন্তু নির্মম সত্য।   

একই মামলায় বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে একই রায় দেয়া হলে তার পেছনে অবশ্যই একটা গূঢ় কারণ থাকে। এক্ষেত্রে কারণটা আছে ওই আইনগুলোর মধ্যেই যা অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়াটা মুসলিম হিসেবে আমাদের আত্মঘাতী হবে। সংক্ষেপে দেখাচ্ছি বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত ৩ খণ্ডের ‘বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন’ (বিইআ) ও অন্যান্য কেতাব থেকে। ক্ল্যাসিক শারিয়া আইনে হুদুদ ক্রাইম হল খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, জ্বেনা, মানহানী, মদ্যপান ও ইসলাম ত্যাগ। সেই সাথে শারিয়া দেশগুলোতে ধর্ষণকেও হুদুদে যোগ করা হয়েছে যেমন পাকিস্তান হুদুদ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯ আইন নং ৭ ও ১৯৮০ আইন নং ৮খ। এখন, আমরা ধাপে ধাপে এগোব যাতে শারিয়া-ম্যাথটা স্পষ্ট হয়। প্রথমেই, শারিয়ায় ধর্ষণ কাকে বলে?

  • “কোনো পুরুষ বা নারী বলপ্রয়োগ করিয়া পর্যায়ক্রমে কোনো নারী বা পুরুষের সহিত সঙ্গম করিলে তাহা জেনা হিসেবে গণ্য হইবে। বলপ্রয়োগকারী জেনার শাস্তি ভোগ করিবে যদি বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়” - বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৪ ও ১৩৪খ।

আচ্ছা, তাহলে কি দিয়ে "বলপ্রয়োগ" প্রমাণ হবে? 

  • হুদুদ অপরাধ প্রমাণিত হবে অপরাধীর স্বীকারোক্তি বা চারজন সাবালক মুসলিম পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষ্য দিয়ে। এ মামলাগুলোতে নারীসাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় - বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩; শাফি আইন 0.13.1, 0.24.9; মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরান পৃষ্ঠা ২৩৯, ৯২৮; ‘দ্য পেনাল ল অব ইসলাম’ পৃষ্ঠা ৪৪; হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৫৩; ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড’ পৃষ্ঠা ২৫১। এবং :-
  • “হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলিবে না” - বিইআ ২য় খণ্ড ধারা ৬০০। অর্থাৎ আঙুলের ছাপ, ডিএনএ ইত্যাদি চলবেনা। কেতাবের তত্ব নয়, লাহোর শারিয়া কোর্ট ডিএনএ-টেস্ট নাকচ করেছিল যেজন্য অপরাধীর শাস্তি হয়নি।

আর “ন্যায়পরায়ণ মহিলা” কাহাকে বলে কত প্রকার ও কি কি তা নিয়ে উকিলদের তর্কাতর্কি শেষ হবে না। এ আইন ইসলাম-বিরোধী এটা শরিয়াবিদরাও বোঝেন। তাই আইনটাকে মেরামত করার চেষ্টা করেছেন ১১ শতাব্দীতে স্পেনের ইমাম ইবনে হাজম, জ্বেনা প্রমাণে প্রতি পুরুষের পরিবর্তে দুজন মুসলিম “ন্যায়পরায়ণ মহিলা” হলেও চলবে - বিইআ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৮৮। কিন্তু ওটা শারিয়া কেতাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বলা হয় এই "চার পুরুষের সাক্ষ্য" আইনটা বানানো হয়েছে কোরানের নিসা ১৫ ও নূর ১৩ আয়াতের ভিত্তিতে। কিন্তু ওই আয়াতদুটো এসেছিল নারীদেরকে জ্বেনার মিথ্যা অপবাদ থেকে বাঁচাতে, ধর্ষণের সাথে যার কোনো সম্পর্কই নেই। আসলে পুরো কোরানে কোথাও ধর্ষণের উল্লেখই নেই। সেই নারীবান্ধব আয়াতদুটোকে পেঁচিয়ে এই উদ্ভট ও তীব্র নারী-বিরোধী আইন বানানো হয়েছে। এটা কিভাবে হল তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে “শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি” বই তে, বইটা ইন্টারনেটে ফ্রি পাওয়া যায়।    

  • “জেনা ও ধর্ষণ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ না হইলে জেনাকারীর শাস্তি হইবেনা যদি সে অস্বীকার করে” - বিইআ প্রথম খণ্ড ৩০১ পৃষ্ঠা।

সুস্পষ্ট আইন।

কি হবে যদি ধর্ষণের "চারজন সাবালক মুসলিম পুরুষ চাক্ষুষ সাক্ষী" বোবা বা সমাজের "নীচু ব্যক্তি" হয়?

  • “বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়”, “দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নীচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।” - বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৪৯, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৬৩; হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৩৬১; শাফি আইন o.24.3; ‘পেনাল ল অব ইসলাম’, পৃষ্ঠা ৪৬।

এর সাথে মিলিয়ে নিন - 

  • “হুদুদ মামলায় নারী বিচারক হতে পারবে না” - বিইআ ২য় খণ্ড ধারা ৫৫৪। এজন্যই ইরাণের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ও বিচারক ডক্টর শিরীন এবাদী-কে তাঁরই আদালতে কেরানি বানানো হয়েছিল। কি বীভৎস! তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।

তাহলে ধর্ষিতার শাস্তি কেন ও কোন আইনে হয়? ধর্ষিতার শাস্তি হয় কারণ তার "অপরাধ" একটা নয় বরং দুটো। (১) সে চারজন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষী দিয়ে ধর্ষণ প্রমান করতে পারেনি। তাই সে ধর্ষকের সম্মান হানী করেছে, এজন্য হুদুদ আইনে তাকে মানহানীর শাস্তি পেতে হয়। (২) থানায় বা আদালতে ধর্ষণের অভিযোগ করতে গিয়ে সে তার বিবাহ-বহির্ভুত সংসর্গ স্বীকার করেছে, হোক তা জোর করেও। সেজন্য সে জ্বেনার অপরাধেও অপরাধী। এই হল ধর্ষণের শারিয়া-ম্যাথ।

বাংলাদেশেও অবৈধ ফতোয়ার আদালতে ধর্ষিতাকে চাবুকের ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তান সংসদ ১৯৭৯ সালে এ আইন বানানোর পর থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেও এ আইন বাতিল করতে পারেনি শারীয়াপন্থীদের প্রবল প্রতিরোধের জন্য। পরের দিকে ধর্ষিতারা অভিযোগ করতে যেতেন না কারণ থানায় পুলিশেরা তাদের আবার গণধর্ষণ করত। ১০/১২ বছর কারাভোগের পর ২০০৬ সালে প্রেসিডেণ্ট মুশাররফ ৩০০০+ ধর্ষিতাকে মুক্তি দিয়েছেন (ভোরের কাগজ  ৯ জুলাই ২০০৬)। অথচ রাসুল (সা.) শুধুমাত্র নারীর একক সাক্ষ্যে ডাকাতের (জেনার মতো ডাকাতিও হুদুদ মামলার অন্তর্ভুক্ত) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন - সহি বুখারি ৩য় খণ্ড ৫৯৬ ও ৭ম খণ্ড ২১৬; সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড ২৬৬৬।

এজন্যই কোটি কোটি মুসলিম এবং বহু ইসলামি বিশেষজ্ঞ ও সংগঠন শারিয়া আইনের তীব্র বিরোধী। এজন্যই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শরিয়া সমর্থক ও বিশেষজ্ঞ ড. হাশিম কামালি ব্যাকুল হয়ে বলেছেন: “আমি সবাইকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি শারিয়াকে এ যুগে চালাইতে হইলে অবশ্যই প্রচণ্ড ঘষামাজা করিতে হইবে..…সেই যুগে যে উদ্দেশ্যে শরিয়ার উসুল বানানো হইয়াছিল উহা এখন অনেক কারণেই তাহা অর্জন করিতে অক্ষম।” - ‘প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’ পৃষ্ঠা ১৩, ৫০০, ৫০৪। ইসলামে অপরাধ ও শাস্তির ব্যাপারে তারতম্য থাকার কথা নয়।  কিন্তু কি হবে যদি ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ধর্ষণ করেন?  

  • "হদ্দ-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ করিলে তাহার বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যাইবেনা" - হানাফী মযহাব মোতাবেক বি-ই-আ ৩য় খণ্ড ৯১৪গ ও হানাফি আইন হেদায়া পৃঃ ১৮৮।

ব্যাস, ন্যায়বিচারের চ্যাপ্টার ক্লোজড।

খুঁজে দেখুন শারিয়া রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ষণের মামলায় কি কি রায় হয়েছে। খুঁজে দেখুন সৌদি আরবে নিজের ৫ বছরের কন্যাকে ধর্ষণের ফলে হত্যার জন্য খ্যাতনামা ইসলাম প্রচারক ফারহান আল ঘামদি'র কি সাজা হয়েছিল - সূত্র ইন্ডিপেনডেন্ট ইউকে ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। যে আইনে ধর্ষিতার শাস্তি হয় সে আইন সংস্কার করে কোরানের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করুন - আল্লাহ নিরপরাধের কষ্ট চান না - সূরা বাকারা ১৮৫, মায়েদা ৬, হজ্ব ৭৮, তারপরে ভেবে দেখা যাবে।

****************************************

তুমুল বিতর্ক - আল্লাহ'র কোরান কোথায় ? 

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ 

** "আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক"- সূরা হিজর আয়াত ৯।

** "আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে কিতাব প্রত্যাদিষ্ট করা হয়েছে তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই" - সূরা আল কাহফ ২৭।

অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। “মানুষের ভুল হতে পারে”এ প্রবাদ অর্ধসত্য, মহাসত্য হল প্রতিটি মানুষের কখনো না কখনো ভুল হবেই। আমাদের কোরানটা তো বেহেশত থেকে ছাপা হয়ে আসেনি, মানুষই সেটা লিখেছে বা টাইপ করেছে। সেখানে কোনো ভুল হতেই পারে। মওলানা মুহিউদ্দীন খান-এর অনুদিত কোরানে অজস্র ভুলগুলো যে “মানুষের ভুল” তা বোঝা যায় ও তাতে অর্থ বদলায়না:- (১) পৃষ্ঠা ১২২৩, ১২২৫, ১২২৭, ১২২৯, ১২৩১ ও ১২৩৩- সুরা "যুখরুফ"-এর জায়গায় "যুখরুক", (২) পৃষ্ঠা ১২৯২- “জবরদস্তিকারী”-এর জায়গায় "জবরকারী", (৩) পৃষ্ঠা ১২৫৩- "অপারগ"-এর জায়গায় "অপারক", (৪) পৃষ্ঠা ১২৪২- "খোঁজ"-এর জায়গায় "খুঁজ", (৫) পৃষ্ঠা ১১৮৬- "অর্থ"-এর জায়গায় "অর্ত", (৬) পৃষ্ঠা ১০০৮-"জ্ঞানান্বেষী"-এর জায়গায় "জ্ঞানন্বেষী", (৭) পৃষ্ঠা ৯৫৪- "বান্দা"-এর জায়গায় "বন্দা, (৮) পৃষ্ঠা ৯৩৬- "ব্যতীত"-এর জায়গায় "বতীত", (৯) পৃষ্ঠা ৮৯০- "বিশ্বাসী"-এর জায়গায় "বিস্বাসী", (১০) পৃষ্ঠা ৭৮০-"রেখেছিল"-এর জায়গায় "রেখেছিলে", (১১) পৃষ্ঠা ৭৩৪- "বুঝতে"-এর জায়গায় "বোঝতে", (১২) পৃষ্ঠা ৭১০- "বোঝাতে"- এর জায়গায় "বোজাতে", (১৩, ১৪) পৃষ্ঠা ৭০৮- "সাধ্য"-এর জায়গায় "সাদ্য" এবং "আনছি"-এর জায়গায় "আসছি", (১৫) পৃষ্ঠা ৫৫৩- "খোযা'র" এর জায়গায় "খোযা আর", (১৬ পৃষ্ঠা ৫৪৬- "দেশত্যাগ"-এর জায়গায় "দিশত্যাগ"……… থামি।

অতীত বর্তমানে অসংখ্য আলেম কোরান লিখে বা টাইপ করে কপি করেছেন, তাঁদের কারো এমন হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। যেমন, সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড ২৬৬৬-এ আরবীর পাশে ইংরেজী অনুবাদে আছে এক লোক এক বালিকার গয়না ডাকাতি করতে গিয়ে তাকে খুন করে। মারা যাবার আগে রসূল (স) বালিকাকে দুবার জিজ্ঞেস করলেন লোকটা অমুক অমুক কিনা, সে মাথা নাড়িয়ে "না" জানাল। তৃতীয় নাম বললে সে "হ্যাঁ" জানালে তিনি পাথর দিয়ে বালিকার মাথা চূর্ন করলেন, (“crushed HER head”)। অথচ মূল আরবী হাদিসটায় আছে 'ক্বতলহু' যা পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য, নারীর বেলায় হবে 'ক্বতলহা'। অর্থাৎ তিনি অপরাধী পুরুষেরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন, বালিকার নয়।  প্রমাণ, সহি বুখারীর দুটি হাদিসে এই ঘটনায় ডাকাতেরই মৃত্যুদণ্ড আছে, বালিকার নয় - ৩য় খণ্ড ৫৯৬ ও ৭ম খণ্ড ২১৬। এছাড়া আছে অঞ্চলভেদে বানানের ভিন্নতা। যেমন, ইউরোপে ইংরেজী ভাষায় 'কালার' (“Colour”) কিংবা 'ফেভার' (“Favour”) শব্দের মাঝখানে একটা "ইউ" অক্ষর আছে যা আমেরিকা বা ক্যানাডার ইংরেজীতে নেই।  সেখানে আছে “Color” আর “Favor”।  এক হিসেবে এগুলো ভিন্ন অন্য হিসেবে অভিন্ন কিন্তু অঞ্চলভেদে দুটোই সঠিক। তবে কোরান যেহেতু বিশ্বজনীন, তাই সেখানে অঞ্চলভেদে ভিন্ন কোরানের সুযোগ নেই।

আমাদের বিশ্বাস দুনিয়ার প্রতিটি কোরান হুবহু এক। ওটা আসলে বিশ্বাসের ব্যাপার; কারণ দুনিয়ার সব কোরান কোনোদিন কেউ পরীক্ষা করে দেখেনি সেগুলো হুবহু এক কিনা। কোরান সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষজ্ঞের ভাষায় "স্ট্যান্ডার্ড ন্যারেটিভ" অর্থাৎ "সাধারণত: যা বলা হয়" তা হল:- রসূলকে (স) জিব্রাইল (আ)-এর কোরান শেখানো, ৭টি আঞ্চলিক ভাষায় তেলাওয়াতে বৈধতা, সাহাবীদের কোরান মুখস্থ করা, প্রথম তিন খলীফার প্রয়াস, ইয়ামামা যুদ্ধের প্রভাব, হযরত হাফসার (র) কাছে রাখা কোরান, আজারবাইজান যুদ্ধে কোরান তেলাওয়াতে ভিন্নতা, হযরত ওসমানের (র) সময় জায়েদ বিন সাবিতের (রা) নেতৃত্বে কোরানের সংকলন যা থেকে আমরা বর্তমান কোরান পেয়েছি। বিস্তারিত আছে সহি বুখারী ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫১০ ও ৯ম খণ্ড ৩০১-তে।

কোরান সংকলনের ইতিহাসের ব্যাপারে এই দীর্ঘ হাদিস দুটোর গুরুত্ব অপরিসীম, সংক্ষেপে বলছি। হযরত আবুবকরের (র) খেলাফতকালে ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক কোরানে হাফেজ নিহত হলে হযরত ওমর (র) তাঁকে চাপ দেন কোরান সংকলন করে রাখতে। প্রথমে খলীফা রাজী হননি কারণ যা নবীজী (স) নিজে করেননি তা তিনি কিভাবে করবেন। পরে তিনি রাজী হলে তাঁর আদেশে ওহী লেখক জায়েদ বিন সাবিত চামড়া, পাথর, গাছের ছাল ইত্যাদির ওপরে লেখা ও অন্যান্য হাফেজদের স্মৃতি থেকে আয়াতগুলো একত্রিত করে প্রথম কোরান সংকলন করেন। সেটা হযরত আবুবকর (র) ও হযরত ওমর (র)-এর পরে নবীপত্নী হযরত হাফসার (র) কাছে রাখা ছিল।           

পরে হযরত ওসমানের খেলাফতের সময় সিরিয়া ও ইরাকের মুসলিমেরা একত্রে আর্মেনিয়া ও আজারবাইন জয় করার যুদ্ধের সময় ওই দুই অঞ্চলের মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে কোরান তেলাওয়াতে উচ্চারণের ভিন্নতা ধরা পড়ে। এ থেকে আবার মুসলিমদের মধ্যে অতীতে ইহুদী খ্রীষ্টানদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় কিনা সেই আশংকায় হুদায়ফা বিন আল ইয়ামান ঘটনাটা খলীফাকে জানান। খলীফা তখন জায়েদের নেতৃত্বে চার সাহাবীর "কোরান সংকলন কমিটি" বানিয়ে তাঁদেরকে বিবি হাফসার (র) কাছে রাখা কোরানের সংকলনটা দেন। সংকলনের পরে খলীফা আদি কপিটা আবার বিবি হাফসাকে ফেরৎ দেন। সেই সাথে তিনি কোরানের অন্য যত কিছু লেখা আছে সব ধ্বংস করার আদেশ দেন যাতে দুনিয়ায় কোরানের একটাই কপি থাকে, কোরানের ভিন্নতা নিয়ে সন্দেহ না থাকে।  

কিন্তু এখন ইসলাম-বিরোধীরা ইউটিউবে ক্যামেরার সামনে এতই জোরালো ভাবে বিভিন্ন কোরান খুলে সেগুলোর ভিন্নতা দেখাচ্ছে যে কিছু আলেম এ নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। “Muslim Scholars Shatter the Myth of Quran Preservation!” - এই নামে গুগল সার্চ করলেই ভিডিওটা দেখা যাবে। ২০১১ সালে প্রকাশিত ইবনে ওয়ারাক-এর “WHICH KORAN?” বইতেও বিভিন্ন কোরানের একই আয়াতের পৃষ্ঠার ফটোকপি দিয়ে ভিন্নতা দেখানো হয়েছে। এখন আলেমদের কথা শোনা যাক। বলাই বাহুল্য এখানে ভিডিওর সবকিছু উল্লেখ করা অসম্ভব, যতটুকু সম্ভব তুলে ধরছি। লিঙ্কটা নীচে দিলাম, আপনারা দেখে নেবেন। এর ওপরে আরো ভিডিও এসেছে, সেগুলোও দেখা জরুরী। ড. জাকির নায়েক, স্কলার আহমেদ দীদাত, ইংল্যাণ্ডের ইসলামী অর্গানাইজেশন ইউকে-র উপদেষ্টা আলেম হাইতাম হাদ্দাদ, ইমাম আব্দুল রহমান হাসান ও ইমাম হামজা ইউসুফ সহ অসংখ্য স্কলার দাবী করেছেন দুনিয়ার প্রতিটি কোরান হুবহু এক। পক্ষান্তরে: -

১। আমেরিকায় বিখ্যাত ইসলামী স্কলার আন্তর্জাতিক ‘আল মাগরিব ইনস্টিটিউটের হাউস্টন শাখার একাডেমিক এফেয়ার্স-এর প্রাক্তন ডীন এবং টেনেসি'র রোডস কলেজের রিলিজিয়াস স্টাডি  ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন প্রফেসর ড. ইয়াসির কাধী বলেছেন: - " এটা (কোরানের ভিন্নতা - লেখক) এখন আর কোনো লুকোনো বিষয় নয়….. (কোরান সংরক্ষণের) "স্ট্যান্ডার্ড ন্যারেটিভ" অর্থাৎ "সাধারণত: যা বলা হয়" তাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়না…… তাতে  ফাঁক আছে (The standard narrative has holes in it)। তিনি এমনও বলেছেন, এ নিয়ে তাঁরা ইসলামী বিশেষজ্ঞেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, এখনই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা করা ঠিক হবেনা। সম্ভবত: তিনি  এ নিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলার আশংকায় একথা বলেছেন কারণ তিনি ভালোই জানেন ইসলামী আলোচনায় আমরা কি ভয়ংকর উগ্র। এ কারণেই শারিয়া আইনও বলছে মুসলিম জনগণ বা যাঁরা ইসলামের ধর্মতত্ব শিখছেন তাঁদের পক্ষে এই বিষয়ের সূক্ষ্মতা নিয়ে আলোচনা না করাটাই উপযুক্ত – শাফি’ আইন উমদাত আল সালিক, আইন নং a4.2.  

২। ড: সেহজাদ সালীম ক্যামেরায় ইবনে মাসুদ (র) এবং আব্দুল্লা ইবনে উবাই (র)-এর সংকলনের পৃষ্ঠা দেখিয়ে বলেছেন এদুটো এবং বর্তমান কোরানের মধ্যে সূরা-বিন্যাসে পার্থক্য আছে। তিনি এও বলেছেন দুনিয়ায় পাঁচ রকম কোরান আছে যাদের মধ্যে শব্দ, ক্রিয়াপদ, নাম, ‘এক বনাম বহু’ ইত্যাদির ভিন্নতা আছে। ভালো হতো যদি তিনি বলতেন ওই কোরানগুলো কারা লিখেছে/অনুবাদ ও প্রকাশ করেছে। তিনি আরো দেখিয়েছেন সাহাবী আবদুল্লা ইবনে মাসুদ (র) বলেছেন রসূল (স) কখনোই সূরা ত্বালাক ও সূরা নাস-কে কোরানের অংশ ধরেন নি, ওদুটো দোয়া কুনুতের মতো শুধু দোয়া। অথচ আমাদের কোরানে ওগুলো আছে, ওদুটো বাদ দিলে কোরানে ১১৪টা না হয়ে ১১২টা সুরা হত।

৩। লণ্ডনের ইসলামী প্রতিষ্ঠান দি হিট্টিন ইনস্টিটিউট-এর প্রখ্যাত ইমাম আদনান রাশিদ বলেছেন "বিভিন্ন গোত্রের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে শব্দের পার্থক্য আদি কোরানে ধরা ছিল। এটা কোনো ব্যাপার না, আসল বিষয় হল (আয়াতের) মূল বক্তব্য"। অর্থাৎ আমরা যেমন বলি "খেয়েছিস" ঢাকাইয়ারা বলে "খাইছস", উচ্চারণের কারণে বানান ভিন্ন কিন্তু বক্তব্য একই।

৪। ক্যানাডার প্রখ্যাত বর্ষীয়ান ইমাম শাবির আলী বলেছেন কোরান লেখকেরা মানুষই ছিলেন, “অনেক ধরণের” ভুল তাঁদের হয়েছেও কিন্তু মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মপালনের ওপর এগুলোর কোন প্রভাব নেই। ভালো হতো যদি ইমাম শাবির বলতেন সেই ভুলগুলো কি কি।

৫। ইমাম আদনান রশীদ বলেছেন "ইসলামিক এওয়ার্নেস ডট অর্গ" ওয়েবসাইটে সব কোরানের তালিকা আছে। কায়রোর হোসেনী মসজিদে ১ম হিজরার কোরান ৯৯% কমপ্লিট - শুধু সূরা ফাতিহা পুরোটা ও সূরা বাকারার প্রথম কয়েকটি আয়াত নেই।   https://www.youtube.com/watch?v=q-EseJ3BYbM

৬।পরিচিত ইসলামী সাইট সাবমিশন.অর্গ-এ হাফস ও ওয়ারস কোরানের কিছু পার্থক্যের স্ন্যাপশট ও বিস্তারিত আলোচনা আছে:- https://submission.org/verify_are_all_Arabic_versions_of_Quran_the_same.html

যাহোক, স্কলারদের মধ্যে এই মতবিরোধ তাঁরাই মেটান, ওটা আমাদের সাধারণ মুসলিমের কাজ নয়। এবারে সেই বিখ্যাত "আলীর কোরান"। হাদিস আল্ কাফি, ১ম খণ্ড, আল্ উসুল ২য় পর্ব, অধ্যায় ৪-এর ২, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৭ থেকে উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠার স্ক্যান প্রথম কমেন্টে দেয়া হল :-

“পয়গম্বর (সাঃ)-এর মৃত্যুর পরে হজরত আলী (র) প্রতিজ্ঞা করিলেন কোরাণের সঙ্কলন না করা পর্যন্ত তিনি ঘরের বাহিরে যাইবেন না। তাঁহার সঙ্কলিত কোরাণে বিভিন্ন আয়াত সম্বন্ধে স্বয়ং রসুলের (স) মতামত ছিল। ইহাতে কোন্ আয়াতের পর কোন্ আয়াত আসিয়াছে, কোন্ ঘটনায় কখন কাহার উপর আসিয়াছে ইত্যাদির বিবরণ ছিল। এইগুলি ব্যতীত তাঁহার সঙ্কলনটি আয়াতের দিক দিয়া মুসলিম বিশ্বে প্রচারিত কোরাণের মতই। সঙ্কলনের পরে তিনি তাহা শাসকদের সামনে (কোরান সংকলন কমিটির কাছে - লেখক) পেশ করেন। কিন্তু শাসকেরা তাহা গ্রহণ করেন নাই”।

                                           

ইসলাম-বিরোধীরা সেই বিখ্যাত "ছাগলে খাওয়া কোরানের আয়াত" হাদিসটা দিয়েও আঘাত করেছে। “রজম” হল বিবাহিত/বিবাহিতা ব্যভিচারী/ণীর প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড, ওই হাদিসটার ভিত্তিতে শারিয়া আইনে “রজম” যোগ এবং প্রয়োগ হয়েছে। কোরানে ব্যভিচারী/ণীর চাবুক সহ অন্যান্য শাস্তির আয়াত আছে কিন্তু রজমের আয়াত নেই কারণ ওটা নাকি ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। আমার "শারিয়া কি বলে আমরা কি করি" বইতে এই হাদিসের বিস্তারিত ইসলামী তত্ব-তথ্য ও হাদিসটার পৃষ্ঠার স্ক্যান দেয়া আছে, বইটা ইন্টারনেটে ফ্রি পাওয়া যায়:-   

“বর্ণিত আছে যে বিবি আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন, ‘রজমের ও যুবকের দশ ঢোক দুধপান সম্পর্কিত আয়াত নাজিল হইয়াছিল। অবশ্যই ইহা একটি কাগজের উপরে লিখা হইয়াছিল যাহা আমার কুশনের নীচে রাখা ছিল। যখন রসুল (দঃ) ইন্তেকাল করিলেন আমরা তাঁহার মৃত্যু লইয়া ব্যস্ত ছিলাম, তখন একটি গৃহপালিত ছাগল ঘরে ঢুকিয়া উহা খাইয়া ফেলে’" - সহি ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড ১৯৪৪। (বিবি আয়েশা (রাঃ) বাড়ীতে ছাগল পালতেন এমন দলিল কেউ দেখাতে পারবেন?)

অতীতের কিছু ইমাম এ হাদীসকে জাল বলেছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের মানতে হবে রজমের আয়াত নাজিলই হয়নি। কিন্তু সেটাও পারা যাচ্ছেনা কারণ হযরত ওমর (র) দাবী করেছেন কোরানে নেই বটে কিন্তু রজমের আয়াত নাজিল হয়েছিল - সহি বুখারী ৮ম খণ্ড ৮১৭: ডঃ মুহসিন খান, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাফেজ আবদুল জলিল অনূদিত সহি বুখারী হাদিস ১২৪৩ ও ১২৪৯, "সীরাত": ইবনে হিশাম/ইশাক, পৃষ্ঠা ৬৮৪, মুহিউদ্দীন খানের অনূদিত বাংলা-কোরাণ পৃষ্ঠা ৯২৬, সহি মুসলিমেও এটা আছে ২য় খণ্ডে।

দশ ও পাঁচ ঢোক দুধপানের আয়াত দুটোই বা কি তা এখানে আছে :-  

** সহি ইবনে মাজাহ খণ্ড ৩ হাদিস ১৯৪৩ - (সংক্ষেপে) রসূলকে (স) সালহা বলল সেলিম নামের যুবক তাদের বাসায় এলে তার স্বামী হুজাইফা রাগ করে। তিনি বললেন "তাকে দুধপান করাও"। সালহা বলল সেলিম তো সাবালক, তাকে সে কিভাবে দুধপান করাবে। তিনি হেসে বললেন, তিনি জানেন সে সাবালক। তখন সালহা সেলিমকে দুধপান করাল এবং পরে রসূলকে (স) বলল এখন আর সেলিম এলে হুজাইফা রাগ করেনা।

** সহি মুসলিম হাদিস খণ্ড ৮ # ৩৪২১ - "আয়েশা (র) বলিয়াছেন, সুস্পষ্ট দশ ঢোক দুধপান বিবাহকে অবৈধ করে, এই আয়াত নাজিল হইয়াছিল, পরে ইহা বাতিল হইয়া পাঁচ ঢোক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়"।

** সহি মুসলিম খণ্ড ৮ হাদিস # ৩৪২২- "আমরা বলিয়াছেন তিনি আয়েশার (র) সহিত অবৈধ বিবাহের আলোচনা করিতেছিলেন, এবং (আয়েশা (র) বলিলেন: - "সুস্পষ্টভাবে দশ ঢোক দুধপানের আয়াত নাজিল হইয়াছিল, পরে পাঁচ ঢোক"।

বিশ্বময় নারী-পুরুষ একই কর্মস্থলে চাকরী করেন। এই "ফ্রি মিক্সিং" শারিয়া আইনে হারাম, কিন্তু ওই হাদিসের ভিত্তিতে এর সমাধান প্রস্তাব করেছেন মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ মিসরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটির হেড অফ হাদিস ডিপার্টমেন্ট ড. ইজ্জত আতিয়া। নারীরা তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদেরকে "কমপক্ষে পাঁচঢোক স্তন্যপান” করালেই তাদের মধ্যে "পারিবারিক বন্ধন" স্থাপিত হয়ে ওই হারামটা হালাল হয়ে যাবে। বিশ্ব-তোলপাড়ের এ খবর দিয়েছে বিবিসি-ও, ২২ মে ২০০৭। কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ব-মুসলিমের গুঁতো খেয়ে তিনি মন্তব্যটা প্রত্যাহার করেন।

যাহোক, ওই আয়াতগুলো ছাড়াও (ক) বির-মাউনা সম্পর্কিত আয়াত (বুখারী ৪র্থ খণ্ড ৬৯) এবং (খ) নবীজীর (স) সাথে একান্তে কথা বলতে হলে সদকা দেবার আয়াত (মুহিউদ্দিন খানের অনুদিত কোরাণ পৃষ্ঠা ১৩৪৭) - এই আয়াত দুটোও কোরানে নেই। সব মিলিয়ে, আল্লাহর এতগুলো কালাম কে কবে কোথায় কেন কি অধিকারে বাতিল করল তা জানা যাচ্ছেনা। রসূল (স) যদি করে থাকেন তবে তার প্রেক্ষাপটগুলোও জানা দরকার, কেউ জানালে বাধিত হব। এখন এই ক্রান্তিকালে ইউটিউবে ক্যামেরার সামনে: -

(ক) আমাদের আলেমরা হাজার বছর আগের ইমামদের বক্তব্য শোনাচ্ছেন,

(খ) সারা দুনিয়া চোখের সামনে কোরানে ভিন্নতা দেখছে।

কোনটা বেশী শক্তিশালী?

আলেমদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়………

ভিডিওর লিংক:- https://www.youtube.com/watch?v=ANo6dXc2i-0

***********************************

অদ্যপি ধাবমান ! 

২০০৫ সালে বাংলাদেশ থিয়েটার টরন্টো জাতিকে একটি নবজাত শিশু উপহার দিয়েছিল।  মানবাধিকারের পতাকা হাতে  প্রচণ্ড তারুণ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই শিশু অদ্যপি ধাবমান।       

 

জুলাই ২০০৫।  টরন্টোতে 'শৃঙ্গার' আয়োজিত তিন দিনের নাট্য প্রতিযোগিতায় ২২টি নাটক প্রতিযোগিতা করছে, বিচারক হিসেবে আনা হয়েছে ঢাকা থেকে বিখ্যাত অভিনেতা  হুমায়ুন ফরিদী, কোলকাতা থেকে বর্ষীয়ান নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও ড: দেবজিৎ ব্যানার্জীকে।  তিন বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে, যা প্রায়ই হয়না, বাংলাদেশ থিয়েটার টরন্টো'র হিল্লা বিয়ের ওপরে "নি:শব্দ গণহত্যা" নাটককে দিলেন “বেষ্ট প্রোডাকশন” পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের পুরস্কার পান নাটকের নায়িকা নূর আফরোজ মুন্নী ও পরিচালক/অভিনেতা মোহাম্মদ জামান (কামাল)। এ  রোম্যান্টিক নাটকে ইসলামী সুত্রসহ দেখানো

হয়েছে কেন তাৎক্ষণিক তিন-তালাক ইসলাম-বিরোধী।   যেমন - “নবীজীর সময় থেকে শুরু করে হজরত আবুবকর ও হজরত ওমরের সময় পর্যন্ত একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণকে এক-তালাক ধরা হত”-সহি 

মুসলিম ৩৪৯১, ৩৪৯২ ৩৪৯৩, সুনান আবু দাউদ ২১৯৪, বিশ্ব-বিখ্যাত শারিয়াবিদ ডঃ আবদুর রহমান ডোই-এর “শারিয়া দি ইসলামিক ল” পৃঃ ১৭৯ ও মওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের “Women in Islam” পৃঃ ১১০ ইত্যাদি।

   

পরের ঘটনাবলী:-   

১. এ পুরস্কারের খবর দেশে ছাপা হলে পরিচালক রাকিবুল হাসান এটাকে সিনেমায় রূপ দেন "হিল্লা" নামে, অভিনয়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও ইলোরা গহর। 

২.  অনেক চেষ্টাতেও দেশের কোনো টিভি চ্যানেল এটা দেখাতে রাজী হয়নি।

৩.  ইংরেজী সাবটাইটেল সহ ইউটিউবে দেয়া হলে "হিল্লা" দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়ে।

৪.  ইউরোপ-আমেরিকা-ক্যানাডা ও ভারতে বিভিন্ন ইসলামী কনফারেন্সে দেখানো হয়, বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সমর্থন-পত্র পাঠান।   

৫.  ভারতে ইসলামিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট মুভি'র ৩০০ ডিভিডি কপি করে প্রত্যন্ত মুসলিম নারী-সংগঠনের কাছে পৌঁছে দেন। 

৬. আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয় আমেরিকার লস অ্যানজেলেস শহরে ।

৭.  তুর্কীস্থানের ও মালয়েশিয়ার দুই মুসলিম তাঁদের ভাষায় সাব টাইটেল করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন যাতে তাঁদের জাতিও দলিলগুলো জানতে পারে।

৮. ইংল্যান্ড ও ক্যানাডায় দুজন শিক্ষক তাঁদের ক্লাসে শিক্ষা-বিষয় হিসেবে প্রদর্শন করেন। 

“হিল্লা”র সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ইসলামী দলিলবদ্ধ আরো তিনটি রোম্যান্টিক মুভি বানিয়ে দেখানো হয়েছে কিভাবে কোরান-রসুল (স) দিয়েই সমাজকে ইসলামের নামে বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করা সম্ভব।  ওটা  আর  অন্যান্য  শারিয়া  মুভি  রাখা  আছে hasanmahmud.com ওয়েবসাইটে।  ঢাকার মিডিয়া, রাজনীতি ও সুশীল সমাজের ঢক্কানিনাদ থেকে বহুদূরে নেতা-কর্মীরা গত পাঁচ ছয় বছর ধরে বিভিন্ন গ্রামে মুভিগুলো দেখাচ্ছেন।  জনগনের ওপরে এর প্রভাব সুগভীর, ওইসব গ্রামে আর কোনদিন ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ ঢুকতে পারবে না দেশের অনেক সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার নেতা-কর্মী, সাংবাদিক-শিক্ষক, নারী-সংগঠন ও আলেমদের মধ্যে মুভিগুলোর ডিভিডি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে ও হচ্ছে।  ক্যানাডা'র “মুসলিমস ফেসিং টুমরো” সংগঠনের এই আন্দোলন ছবিসহ রিপোর্ট করেছে ইংল্যান্ড-এর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস, ইউ. কে।  পদ্ধতিটা শান্তিপূর্ণ, এতে নেই টাকা বা নেতৃত্বের কোন্দল।  

       গ্রামে গ্রামে মুভি শো ……

 

মুভি - নারী     

    মুভি - শারিয়া প্রহেলিকা

        Sharia Conundrum

জাতি আজ ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের দুর্যোগে পড়তনা যদি এ আন্দোলন পঞ্চাশ বছর আগে শুরু হত।  আজ এই মুভিগুলো আর "শারিয়া কি বলে আমরা কি করি" বই দিয়ে গ্রাম থেকে  গ্রামান্তরে যে নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে তার সুফল টের পাওয়া যাবে পাঁচ-দশ বছর পর।  একের পর এক মুভির শো হচ্ছে স্কুলের মাঠে, বাড়ীর ড্রইংরুমে, মিলনায়তনে।  গ্রামে ৫টি হিল্লা বিয়ে প্রায় হতে  যাচ্ছিল, কর্মীরা “হিল্লা” মুভিটি ইমামদের দেখালে তাঁরা মুভিতে দেখানো রেফারেন্সগুলো চেক করে হিল্লার ফতোয়া ফিরিয়ে নেন।  আরেক গ্রামে এক নারী কেঁদে বলেছিল এ মুভি আগে দেখলে তাকে ইসলামের নামে “হিল্লা”র মাধ্যমে ধর্ষিতা হতে হত না।  এক খতিব বইটা মসজিদে রেখেছেন সবাইকে পড়তে বলছেন, বইটার দলিল  দিয়ে দেখাচ্ছেন কিভাবে ইসলামের নারী-বান্ধব ব্যাখ্যা দিয়ে নারী-বিরোধী ব্যাখ্যাকে পরাস্ত করা যায়।  এক বিয়েতে  পাত্রীপক্ষ  মেহমানদেরকে  দেখিয়েছে, বিমুগ্ধ পাত্রপক্ষ ডিভিডি  নিয়ে  গেছে  তাদের  গ্রামে  দেখাবে  বলে।  একের পর এক শহরে কলেজের হোস্টেল নিবাসী ছাত্রীরা গ্রামে এসে এটা দেখে ডিভিডি নিয়ে যাচ্ছে বন্ধুদের দেখাবে বলে।   এভাবেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বই ও মুভিগুলোতে দেখানো কোরান-রসুলের (স) দলিল দেখে জনগন আলোকিত হচ্ছে।

    

এ শুধু শুরু। বিলাসিতা নয় বরং জাতির প্রয়োজন ও অস্তিত্বের এই আন্দোলন আরো অনেকদুর যাবে। বাংলাদেশ থিয়েটার টরন্টো’র ২০০৫ সালের সেই ছোট্ট শিশু দুর্দান্ত তারুণ্যে দেশ-দেশান্তরে গ্রাম-গ্রামান্তরে অদ্যপি ধাবমান !!    

  

****************************************************

নিউইয়র্ক - গ্রাউণ্ড জিরো মসজিদ ও শান্তির মূল্য

০৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১০

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে শিউরে উঠেছিল বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ, শান্তিকামী মুসলমান। জায়গাটাকে ‘‘গ্রাউ ণ্ড জিরো’’ বলা হয়। ওটার কাছে শরীফ জামাল-এর ব্যক্তিগত জায়গায় বিশাল মসজিদ ও কম্যুনিটি সেন্টার বানানোর চেষ্টা করছেন শারিয়া-আইনের সমর্থক ইমাম রউফ ও তাঁর স্ত্রী। সে আইনী-অধিকার তাঁদের আছে কিন্তু তার পরেও এর পক্ষে-বিপক্ষে সারা অ্যামেরিকায় হুলুস্থুল পড়ে গেছে। যদিও এর সাথে বহুকিছু জড়িয়ে গেছে, কিন্তু আমি অন্য কথা বলব। তার আগে বলে নেই ‘‘গ্রাউ ণ্ড জিরো মস্ক’’ শব্দটাই ভুল। দু’ব্লক দূরে বলা হলেও জায়গাটা গ্রাউ ণ্ড জিরো’র কেন্দ্র থেকে অনেকটাই দূরে। ওখান থেকে গ্রাউ ণ্ড জিরো দেখাও যাবে না, কারণ মাঝখানে বড়ো একটা দালান আছে। বরং সেন্ট পল চ্যাপেল এবং চার্চ অফ সেন্ট পিটার তার অনেক কাছাকাছি কিন্তু ওগুলোকে ‘‘গ্রাউণ্ড জিরো চ্যাপেল’’ বা ‘‘গ্রাউণ্ড জিরো চার্চ’’ বলছে না কেউ।

যাই হোক, অসংখ্য ধর্মবিশ্বাসী-অধ্যুষিত দুনিয়ায় ব্যক্তিগত শান্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শান্তির প্রয়োজন অসামান্য তা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু সেটা মুফতে আসেনা, তার মূল্য দিতে হয়। ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে দেখা যাক আমাদের নবীজী সহ সে-মূল্য কারা কিভাবে দিয়েছেন এবং তাতে মানুষের কি লাভ হয়েছে।

ঘটনা: এক

৬২৮ সাল। হজ্ব করার জন্য এক হাজার (দলিলভেদে ৭০০ থেকে ১৪০০) মুসলিম সাথে নিয়ে মক্কা’র উপকণ্ঠে এসে তাঁবু গেড়েছেন বিশ্বনবী। মক্কাবাসীরা তাঁকে ঢুকতে দেবেনা, যুদ্ধ হয় হয় ভাব। তখন মক্কাবাসী ও তাঁর মধ্যে এক শান্তিচুক্তি হয় যা ‘হোদায়বিয়া চুক্তি’ নামে বিখ্যাত। সেটা লিখছিলেন হজরত আলী, শুরু করেছিলেন ‘‘বিসমিল্লাহের রহমানের রাহীম’’ দিয়ে। কোরেশ-প্রতিনিধি সোহেল তাতে আপত্তি করলে নবীজী সেটা বদলে শুধু ‘‘আল্লাহ’র নামে’’ লিখতে বলেন। এটা লেখার পরে লেখা হল- ‘‘এই চুক্তি করা হল মুহাম্মদ-উর রসুলুল্লাহ এবং কোরেশদের মধ্যে’’। সোহেল ‘‘আল্লাহ’র রসুল’’ কথাটায় আপত্তি করলে নবীজী তা কেটে ‘‘আবদুল্লা’র পুত্র মুহাম্মদ’’ লিখতে বলেন। কিন্তু হজরত আলী তাতে রাজী হলেন না। তখন নবীজী নিজের হাতে সেটা কেটে দিলেন এবং ‘‘আবদুল্লা’র পুত্র মুহাম্মদ’’ লিখতে বললেন। এভাবে সেই শান্তিচুক্তি কার্য্যকর হল। এর মধ্যে কিছু ধারা মুসলমানদের জন্য অসম্মানজনক ছিল যার জন্য প্রতিটি সাহাবী ইতিহাসে ঐ একবারই নবীজির সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিলেন। তার পরেও তিনি চুক্তি মোতাবেক হজ্ব না করেই ফিরে গেলেন ৫০০ কিলোমিটার দূরের মদীনায় যেখান থেকে এত কষ্ট করে এসেছিলেন। মরুভুমিতে এক হাজার কিলোমিটার চলা কম কথা নয়! এত যুদ্ধের পরেও নবীজী শুধু মুখের কথায় নয় দলিলের প্রমাণে ইসলামের দু দু’টো মূল বাক্যের মূল্য দিলেন এবং কোরেশদের অন্যায় দাবী মেনে নিলেন। ফলে কি হল? পরের বছর তিনি তিন হাজার মুসলিম নিয়ে বিনা যুদ্ধে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করলেন (সেদিন বিশেষ অপরাধের জন্য যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তাদের চারজন ক্ষমাও পেয়েছিল)। এরই নাম নেতৃত্বের প্রজ্ঞা। কাবা’য় আরাধনা-ইবাদতের অধিকার আরবের প্রতিটি সম্প্রদায়ের ছিল, মুসলমানদেরও ছিল। কিন্তু অধিকার কখন কোথায় খাটাতে হয় এবং কখন কোথায় খাটাতে হয়না তা তিনি জানতেন।

ঘটনা: দুই

১৫৮৮ সাল। ভারতের অমৃতসরে শিখদের ধর্মগুরু অর্জুনদেব। আমাদের যেমন কাবা শরীফ, ক্যাথলিকদের যেমন ভ্যাটিক্যান শিখদের তেমনি স্বর্ণমন্দির। সেটা বড়ো করে বানানো হচ্ছে। গুরু’র আদেশ এলো- ‘‘লাহোর থেকে মুসলিম সুফি শেখ মিয়া মীরকে নিয়ে এসো, তাঁর হাতে এই স্বর্ণমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে’’। সবাই অবাক। কেন তা হবে? আমাদের সর্বোচ্চ গুরু বেঁচে থাকতে আমাদের সর্বোচ্চ উপাসনালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর অন্য ধর্মের লোকের হাতে হবে কেন ? গুরু’র আদেশ এলো, ‘‘যা বলছি করো। ভবিষ্যতের মানুষকে ধর্মীয় ভক্তির শক্তিতে ধর্মীয় বিভক্তিকে অতিক্রম করে যাবার পথ দেখিয়ে যাব আমরা’’। এক ধর্মের কেন্দ্রীয় উপাসনালয় আজো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে অন্য ধর্মবিশ্বাসীর হাতে স্থাপিত ভিত্তিপ্রস্তরের ওপরে, এ নিয়ে বিশ্বাসীরা তর্ক করতে পারেন কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে এই হলো নেতৃত্বের অতুলনীয় প্রজ্ঞা।

ঘটনা : তিন

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২, অযোধ্যা। কিছু ধর্মোন্মাদ নেতার নেতৃত্বে ধর্মোন্মাদ হিন্দুর দল ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল ৪৭৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাবরী মসজিদ। ওটা নাকি মন্দির ভেঙ্গে বানানো হয়েছিল, ওখানে তারা আবার মন্দির বানাতে চায়। পরের বছরগুলোতে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় খুন হলো হাজারো নিরপরাধ মানুষ, প্রধানতঃ মুসলিম। উজাড় গ্রাম, জ্বলন্ত ঘরবাড়ী, অসংখ্য বিধবা আর এতিমের আর্তনাদে কেঁপে উঠলো ভারতবর্ষ। ২০০২ সালের ৩রা মার্চে হিন্দুস্তান টাইমস্‌ জনমত জরীপ করে জানতে চাইলো ওখানে জনতা মন্দির চায় নাকি মসজিদ? শতকরা ৬৯.১৩ জন জানিয়ে দিলেন মসজিদটা যদি মন্দির ভেঙ্গে বানানো হয়েও থাকে, তবু এত রক্তারক্তি করে মানুষ খুন করে মন্দির বানাবার কোনো দরকার নেই, মসজিদের জায়গায় মসজিদই থাকুক। এরই নাম ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, এরই নাম আলোকিত মানস যা আজকের ধর্মীয় হিংস্রতার প্রেক্ষাপটে অবিশ্বাস্য মনে হবে।

আইনি অধিকারের চেয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক বড়ো ব্যাপার এবং প্রজ্ঞার সাথে সেই অধিকার প্রয়োগ করাটাই সঠিক নেতৃত্ব। গ্রাউ ণ্ড জিরো’ মস্ক-এর জনমত জরীপে আমরা কি দেখি ? নয়-এগারোর মুসলিম ভুক্তভোগীসহ অন্যান্য মুসলিম, মুসলিম সংগঠন (যেমন সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাসি অ্যা¨ হিউম্যান রাইট্‌স্‌ ইন সৌদি অ্যারাবিয়া সংগঠনের ডঃ আলী আলিয়ামি) সহ শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ অ্যামেরিকান এবং শতকরা ৬১ ভাগ নিউ ইয়র্কবাসী এর বিরোধিতা করেছেন (সি এন এন ১৭ই আগষ্ট ২০১০)। আমরা জানি লিখিত সাংবিধানিক আইনের চেয়ে অলিখিত প্রাকৃতিক আইন অনেক বেশী শক্তিশালী। মুসলিম-অমুসলিমের এই বিপুল জনমত উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আইনী শক্তিতে এগোলে সমাজ অবধারিতভাবে ঘৃণাভিত্তিক সামাজিক বিভক্তির মধ্যে পড়বে। এটা বুঝেই মরিয়া হয়ে ওই জায়গার বদলে সরকারী অন্য জায়গা দেবার প্রস্তাব করেছেন নিউ ইয়র্কের গভর্নর ডেভিড পিটারসন। কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যান করে ইমাম রউফ জাতিকে ঠেলে দিয়েছেন সংঘর্ষের পথে।

গ্রাউ ণ্ড জিরো’ হলো গণহত্যার জায়গা, বিশ্বের শুভবুদ্ধির অশ্রুর জায়গাগুলোর অন্যতম। নিউইয়র্কে ৩০টি মসজিদ তো আছেই, ঠিক ওই স্পর্শকাতর জায়গায় আরেকটা মসজিদ বানিয়ে অধিক কি লাভ হবে যা অন্য মসজিদে হবে না? পশ্চিমা দেশ জনমতের দেশ। এভাবে জাতিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করালে চাকরী-ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের মুসলিম-বিরোধী সন্ত্রাস হবে, তার দায় নেবেন এইসব গোঁয়ার মুসলিম নেতারা? নেবেন না। তাঁরা বুঝতে চান না এই সংঘাত ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হতে পারে, এর মধ্যেই নিউইয়র্কে এক বাংলাদেশী ট্যাক্সী ড্রাইভার মারাত্মকভাবে ছুরিকাহত হয়েছেন শুধুমাত্র মুসলমান হবার কারণে (ক্যানাডাবিডি নিউজ ২৮ আগষ্ট)। শারিয়া আইনের মতো ইসলাম-বিরোধী, নারী-বিরোধী আইনের যাঁরা ঘোর সমর্থক সেই ইমাম রউফ এবং তাঁর স্ত্রী’র কাছ থেকে অধিকার বনাম প্রজ্ঞা’র ভারসাম্য আশা করা বৃথা। শরীফ জামালকে পুলিশ ১৯৯৪ সালে গ্রেপ্তার করেছিল বেশ্যা-সংশ্লিষ্ট ঘটনায়, এঁর ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা আছে, হিংস্র স্বভাবের বলে ইনি অন্যকে মারপিট করে মামলায় পড়েছিলেন। ক’বছর আগের রেষ্টুরেন্ট ওয়েটার বর্তমানে বিলিয়ন ডলারের মালিক সেই শরীফ জামাল হঠাৎ জেগে উঠে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে সালাহউদ্দীনের মতো প্রবলবেগে ইসলাম উদ্ধারে অবতীর্ণ হবেন, তাঁর জমিতে মসজিদ উঠে সাম্প্রদায়িক শান্তি আনবে এসব আষাঢ়ে গালগল্পের ঠগবাজীতে ভোলার জাতি অ্যামেরিকা নয়।

মুখমিষ্টি কথায় ইন্টারফেইথ ডায়ালগের জন্য আমাদের কিছু ইসলামি নেতাদের তৎপরতার অভাব নেই অথচ তাঁদের হঠকারী ইন্টারফেইথ অ্যাকশন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে চরমভাবে নষ্ট করে। এর সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক নাচুনে বুড়িদের সামনে ঢোলের বাড়ি দেবার লোকেরও অভাব নেই। এর মধ্যেই কথা উঠে গেছে মক্কা মদীনাতে মন্দির-গীর্জা বানাতে দিলে তবেই এখানে মসজিদ বানাতে দেয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দাবীটা যদিও বৈধ তবু এই পরিস্থিতিকে সেটা অরো জটিল করে তুলবে।

আমাদের মুসলিম পরিচিতি, ভাবমূর্তি ও অধিকার কোনো গোঁয়াড় নেতৃত্বের খেলার পুতুল নয় ! দালানের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিক্রী করার মূর্খতা আমরা কেন করব? যে-দালান রাজনৈতিক দাবাখেলার বোড়ে, যাকে একটা জাতির ৭০% নাগরিক অভিশাপ দেবে তা ইসলামী হতে পারে না। কোরাণ-রসুলেও আমরা দেখি সব মসজিদ ইসলামি মসজিদ নয়। সেজন্যই আল্লাহ তাঁর রসুলকে অনৈসলামিক মসজিদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন (সুরা তওবা আয়াত ১০৭) এবং নবীজী সেই মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন (মওলানা মুহিউদ্দনের অনুদিত কোরাণ পৃষ্ঠা ৫৯২)।

এই মসজিদ বানানোর বিরোধীতা করার জন্য রক্ষ্মণশীল মুসলিমেরা প্রগতিশীল মুসলিমদেরকে ইসলাম-বিরোধী বলেন, অন্যান্য বাহাতেও সর্বদাই বলেন। কিন্তু প্রগতিশীলদের প্রাণান্ত চেষ্টাতেই মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে এবং রক্ষ্মণশীলেরাও ধীরে ধীরে চোখ খুলছেন। বাংলাদেশের শাহ আবদুল হান্নানের মতো জামাতী ও শারিয়া-তত্ত্বগুরুও এখন মুরতাদ হত্যা বা স্ত্রী প্রহারের শারিয়া আইনের বিরোধী। গ্রাউণ্ড জিরো মস্ক-এর ব্যাপারে খোদ জামাতের মতামত দেখুন তার দলীয় পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামের (২০১০ সালের?) ২৬ আগষ্টের সম্পাদকীয়তে (সারাংশ)-

‘‘গ্রাউণ্ড জিরোতে ইসলামিক সেন্টার ও মসজিদ নির্মাণের সপক্ষে বক্তব্যদাতাদের উচিত বিষয়টির ব্যাপারে প্রতিপক্ষের যেই ভুল ধারণা রয়েছে সেই ভুলের অপনোদন করা। কেননা তাদের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে যেই মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে, সেটা দূরীকরণ না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশকে স্বাভাবিক বলা যাবে না। আর ঐ পরিস্থিতিতে সেখানে কিছু করা হলেও ইসলামের কল্যাণ কতদূর হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ ........মুসলমানদের এমন কোনো জেদের আশ্রয় নেয়া সঙ্গত নয়, যা ইসলামের লক্ষ্যের জন্য অশোভনীয় হবার সম্ভাবনা থাকে’’।

আমিও হুবহু ঠিক ঐ কথাই বলছি। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিশাল ব্যাপার কিন্তু ইন্টারফেইথ অ্যাকশন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয় যা নবীজী ও অন্যান্য নেতারা দিয়েছিলেন। জনগণ তো বোকা নয়, সে মূল্য না দিলে জাতির চোখে ইন্টারফেইথ ডায়ালগ শুধুমাত্র মুখমিষ্টি কথার ঠকবাজী হয়েই চিহ্নিত হবে। চালাকি ধূর্তামী দিয়ে কোনদিনই সমাজের মঙ্গল করা যায় নি, যাবেও না।

************************************

একাত্তর- গোপন রণাঙ্গনের নিঃসঙ্গ সেনাপতি

১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

মনোরম সুইজারল্যান্ড, ছবির চেয়েও সুন্দর। মাঝরাতে নির্জন নিশ্চুপ চারধার। রাজধানী বার্ন শহরের এক বিশাল ভিলার সামনে খুব সন্তর্পনে এসে দাঁড়াল একটা গাড়ি, সন্তর্পনে নামলেন তিনি। গোপনে তাকে জানিয়েছেন বাড়ির বাসিন্দা – “আজই এসে দেখা করো। সন্ধ্যায় আমি ব্যস্ত আছি, মাঝরাতে এসো।”

অভিজ্ঞ ডিপ্লোম্যাট তিনি, ‘মাঝরাত’- শব্দটার ইঙ্গিত বুঝেছেন নিমেষেই, তাই এত সতর্কতা। দ্রুত কিছু কথা হল, বিদায় নিলেন তিনি আগের মতোই সন্তর্পনে।

বাড়িটা সুইজারল্যান্ড এর ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের, আর যিনি তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি রক্তেমাংসে সম্পূর্ণ বাঙালি, একাত্তরে সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ছাব্বিশে মার্চে বাঙালির ওপরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার খবর সারা বিশ্বে বোমার মত ফেটেছে, অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি।

বয়সে প্রবীণ এক পাঞ্জাবি পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত, কবি মানুষ, উর্দু কবিতা লেখেন আর তাকে ছেলের মত স্নেহ করেন।, তার কবি মনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের ষোলই ডিসেম্বর নির্ভুল ধরা পড়েছে। ডেকে বললেন – “পাকিস্তান ইজ ডেড। কোনো দুশ্চিন্তা করোনা, যা ভালো বোঝো করো।”

তারপর একদিন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের ওই আহ্বান। ততদিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে, ভেতরে-বাইরে যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে জাতির তাজ তাজউদ্দিনের সতর্ক হাতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্নের ভাঙ্গা নাওখানা। মাঝরাতে আবার তিনি একটা খাম গোপনে পৌঁছে দিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায়- পদত্যাগ করে প্রবাসী সরকারে যোগ দেবেন ভেবেছেন। ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে সেই খাম পৌঁছে গেল দিল্লীতে, সেখান থেকে সোজা তাজউদ্দিনের হাতে। আবার কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে সুইজারল্যাল্যান্ডের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে তাজউদ্দিনের নির্দেশ পৌঁছালো তার হাতে- “পদত্যাগ করোনা। পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করো”।

এইবার তিনি হাত দিলেন রত্নখনিতে। যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত ইয়াহিয়া বিভিন্ন ফন্দি করছে, প্ল্যান করছে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে পাঠাচ্ছে সেই দেশের সরকারের সাথে দেন-দরবার করতে। সেই সাথে আছে জাতিসংঘের কর্তাদের সাথে গোপন দেন-দরবার। অত্যন্ত গোপন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই দলিলগুলো ফটোকপি করে তিনি মাঝরাতে পৌঁছে দিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদুতের বাসায়- ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে সেই খাম পৌঁছে গেল দিল্লীতে, সেখান থেকে তাজউদ্দিন। আবার কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে সুইজারল্যাল্যান্ডের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে তাজউদ্দিনের নির্দেশ পৌঁছালো তার হাতে- “সাব্বাস! পাঠাতে থাকো, পদত্যাগ করোনা।”

চলতে থাকলো মাঝরাতে খাম চালাচালি।

যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্ল্যান জানাটা অসম্ভব জরুরি, এর ওপরেই জয়পরাজয় নির্ভর করে প্রায় সময়। খুনি ইয়াহিয়ার সমস্ত গোপন প্ল্যান পৌঁছে যাচ্ছে তাজউদ্দিনের কাছে, পৌঁছে যাচ্ছে ক্রমাগত ও অনতিবিলম্বে মাসের পর মাস, কল্পনা করা যায়! তাজউদ্দিনের অনেক সফল সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল সঙ্গোপন এই ফ্রন্টের এই নি:সঙ্গ সেনাপতির ওই অনন্য অবদান যা আর কারো কাছ থেকে পাওয়া যেতনা। সম্মুখ-সমরের চেয়ে এই সংবাদ-ফ্রন্ট মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

তারপরে এক সেই সুখের নভেম্বর। তাজউদ্দিনের নির্দেশ এল- “এবার মনের সুখে নিশ্চিন্তে পদত্যাগ করতে পার, পাকিস্তানের পরাজয় ও আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছে।”

স্বাধীনতার পর তিনি সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, বর্ণাঢ্য তার জীবন বলে শেষ করা যাবে না। 

একাত্তরের রণাঙ্গনের গোপন ও নি:সঙ্গ কিন্তু সফল সেনাপতির নাম ওয়ালিউর রহমান। ঝিনাইদহ জেলা, কাঁচেরকোল গ্রামের সন্তান তিনি । ১৯৭১ সালে সুইজারল্যান্ড এর পাকিস্তান দুতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি, একজন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা। এখনো বেঁচে আছেন। টরন্টোতে বাংলা টিভি কানাডা-তে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, বাংলা টিভিকে ধন্যবাদ। 

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১টি সেক্টর ছিল। আসলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র এবং বিশ্ব-কূটনৈতিক অঙ্গন- এই দুটো মিলে আমরা ১৩টি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলাম।

******************************************

প্রতিমা বনাম ভাস্কর্য: হাদিস ও কোরানের রেফারেন্স

৪ ডিসেম্বর, ২০২০

সরকার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর বিরুদ্ধে প্রায় সব আলেম দাঁড়িয়ে গেছেন এবং তাদের অসংখ্য অনুসারী আছেন। তারা দাবি করছেন, ইসলামে সব মূর্তি অবৈধ; সরকার বলছে- শুধু উপাসনার প্রতিমা অবৈধ, সম্মানের ভাস্কর্য বৈধ। নানা পক্ষের হুংকারে প্রায় যুদ্ধাবস্থা! বর্তমান বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে আমরা দেখবো কোরান ও হাদিসে ভাস্কর্য এবং এর বিরোধিতা নিয়ে ঠিক কী বলা আছে। পাঠকের সুবিধায় লেখাটি চার অংশে ভাগ করে নিয়েছি- (ক) কারণ, (খ) বাস্তবতা, (গ) কোরান এবং (ঘ) হাদিস।

ক. ভাস্কর্য বিরোধিতার কারণ  

বিশেষজ্ঞের মতে অতিরিক্ত কেতাব-প্রবণতা ধর্মগুরুদেরকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অক্ষরের এই কারাগারকে বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ শারিয়াবিদ ড. হাশিম কামালী বলেছেন আক্ষরিকতা “LITERALISM- প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স। তখন শুরু হয় কে কার চেয়ে কত বেশি অক্ষর-শব্দ-দাঁড়ি-কমা জানেন বা “ব্যাখ্যা” করতে পারেন সেই বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা। হ্যাঁ, অতীতে মানুষ ভাস্কর্যের পূজোআর্চা করতো যা তৌহিদের বিপক্ষে। তাই যদি সেই সময়ে ভাস্কর্য নিষিদ্ধ হয়েও থাকে, তবুও সেটা তখনকার প্রজ্ঞা, এখনকার নয়। ঠিক যেমন জিজিয়া কর বা দাসপ্রথার ওপরে কোরান রসুলের (স.) হুকুমগুলো তখনকার প্রজ্ঞা, এখনকার নয়। বর্তমানে ভাস্কর্য-বিরোধিতার কারণ কী? ভাস্কর্য দেখে কি কোনও মুসলিমের ঈমান আকিদার ক্ষতি হয়েছে? হয়নি। কোনও মুসলিম কি ধুপধুনো জ্বেলে তার ইবাদত শুরু করেছে? করেনি। কেউ ভাস্কর্যের ইবাদত শুরু করবে সে সম্ভাবনা কি আছে? নেই, একেবারেই নেই। অর্থাৎ বর্তমানে ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে “কেতাবে আছে” ছাড়া আর কোনো কারণ বা প্রজ্ঞা নেই। তাহলে দেখা যাক কেতাবে কী আছে এবং সেটা বর্তমানের বাস্তব-বান্ধব কিনা। 

খ. বাস্তবতা

বিভিন্ন কারণে বহু দেশসহ মুসলিম দেশগুলোতেও ভাস্কর্য আছে শত শত। এমনকি পাকিস্তানেও জিন্নাহর বিশাল ভাস্কর্য আছে। সেসব দেশের আলেমরা কোনোদিন মিছিল হুংকার তো দূরের কথা, কোনোই আপত্তি করেননি। অর্থাৎ তাদের মতে ইসলামে ভাস্কর্য বৈধ। পুরো মুসলিম দেশগুলোর আলেমরা ভাস্কর্যের বিপক্ষে নন কিন্তু আমাদের আলেমরা ভাস্কর্যের বিপক্ষে কেন- এ প্রশ্নের জবাব আমাদের পেতেই হবে। কেন আমাদের আলেমরা তাদের সাথে কথা বলে উনাদের যুক্তিগুলো জানতে চান না? আশ্চর্য এই যে সৌদি আলেমদের সাথে মতে মিললে আমাদের আলেমরা বলেন, “ওখানেই তো ইসলাম এসেছিল উনারাই তো সবচেয়ে বেশি ইসলাম বোঝেন।” আর মতে না মিললেই বলেন, “সৌদি কী করে না করে তাতে কিছুই এসে যায়না, আমাদের ব্যাখ্যাই ঠিক।” কিন্তু বিষয়টা তো বিশেষ কোনো দেশ বা সরকারের নয়, বিষয়টা হল ভাস্কর্যের প্রতি এতো দেশের এতো এতো আলেমদের সম্মতি। সরকারের উচিত ওই আলেমদেরকে এনে দেশের আলেমদের সাথে বসিয়ে দেয়া যাতে উনারা সমস্যাটার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেন। 

কোরানে ‘বিসমিল্লাহ’ সহ ৬৩৪৯ আয়াত এবং সহি সিত্তার মোটামুটি ২৮,০০০ হাদিস মিলে মোটামুটি ৩৪,৩৫০টি ইসলামী সূত্রের বহু জায়গায় অবৈধ করা হয়েছে “উপাসনার প্রতিমা” অর্থাৎ IDOL. কিন্তু STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য্যকে অবৈধ করা হয়েছে মাত্র একটাতে – সহি মুসলিম বুক ২৪-৫২৫০। সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। বলা বাহুল্য সহি মুসলিমে আছে রসুল (স) সবাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সব সমাধি-সৌধ ভেঙে ফেলতে। আদেশটায় প্রজ্ঞা আছে, কারণ লোকে ওগুলোতে চাদর জড়িয়ে ইবাদত শুরু করে। কিন্তু সমাধি সৌধ আর ভাস্কর্য এক নয়।

 গ. কোরান

কোরানে প্রতিমা, প্রতিমা-পূজারী এবং ধর্মগুরুকে উপাস্যের স্থানে বসানোর নিন্দা আছে ও পরিহার করতে বলা হয়েছে সুরা হজ ৩০, ইব্রাহিম ৩৬, আনকাবুত ১৭, নুহ ২৩-২৪, মায়েদা ৯০, আম্বিয়া ৫২ ইত্যাদিতে। কিন্তু ভাস্কর্য্য বৈধ করা আছে এখানে:-

সূরা সাবা আয়াত ১৩:  They made for him what he willed: synagogues and statues, basins like wells and boilers built into the ground. 

অনুবাদ: তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, কুয়ার মতো বৃহদাকার পানির পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। 

সূরা সাবা-র আয়াত ১৩-র ব্যাপারে কিছু ভাস্কর্য-বিরোধী দাবী করেন ওটা ছিল নিষ্প্রাণ কিছুর মূর্তি, প্রাণীর নয়। কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে তারা এটা পেলেন? আমরা তো দেখছি আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে প্রাণীর ভাস্কর্যকেও বৈধতা দিয়েছেন: “যখন তুমি আমার আদেশে কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত” – মায়েদা ১১০। প্রাণীর ভাস্কর্য্যের বৈধতা আছে সূরা ইমরান ৪৯ আয়াতেও। হযরত ইব্রাহীম (আ) বললেন - "আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখির আকৃতি তৈরি করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখিতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে"।

তাহলে?

কোরান মেনে চললে এখানেই সিদ্ধান্ত হয়ে চ্যাপ্টার ক্লোজ হবার কথা, কিন্তু তা হয়নি। শব্দ বাক্য দাঁড়ি কমা নিয়ে অন্তহীন চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, যা করে অতীতের অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। যাহোক,  কোরানের ‘রিজস’, তামাসিল ও সংশ্লিষ্ট শব্দের বাংলা তর্জমাতে শব্দ “মূর্তি” ব্যবহার করা হয়েছে।  কিন্তু "মূর্তি" শব্দে  উপাসনার প্রতিমা যেমন দুর্গামূর্তি, এর সাথে গান্ধীমূর্তি, হনুমান-সাপ-মাছসম্মানের ভাস্কর্য, অতীত সভ্যতায় গুহার দেয়ালে মানুষ ও প্রাণীদের খোদাই করা প্রতিকৃতি  সবই অন্তর্ভুক্ত।  যেমন ইংরেজীতে "দি লেগ ইজ ব্রোকেন" বললে সেটা মানুষের বা প্রাণীর পা নাকি চেয়ার টেবিলের পা তা বোঝা যায়না। ইংরেজীটার বাংলা অনুবাদে সেটা বোঝা যায় কারণ বাংলায় চেয়ার টেবিলের পা হল "পায়া"।  ঠিক তেমনি ইংরেজিতে উপাসনার মূর্তি (প্রতিমা- IDOL) ও সম্মানের ভাস্কর্যের মূর্তি (STATUE) আলাদা দুটো শব্দ। আলেমরা কোরানের ‘রিজস’, তামাসিল ও সংশ্লিষ্ট শব্দের কি ইংরেজি অনুবাদ করেছেন? কোরানে যেখানে নবী সুলায়মানের (আ) রাজপ্রাসাদে ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা দিয়ে সেটা বৈধ করা আছে, সেই সূরা সাবা আয়াত ১৩ ছাড়া কোরানের ইংরেজী অনুবাদে কোথাও STATUE অর্থাৎ “ভাস্কর্য” শব্দটিই নেই। আমি বহুল প্রচারিত ইউসুফ আলী ও পিকথল-এর অনুবাদ থেকে একথা বলছি। এমনকি মৌদুদীর ‘তাফহীমুল কুরআন’ এর অনুবাদেও STATUE শব্দটি আমি পাইনি। 

ঘ. হাদিস

এবারে সহি সিত্তা অর্থাৎ আমাদের ছয়টি সহি হাদিস গ্রন্থ- সহি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী। হাদিসের অনুবাদক আলেমরা কী প্রমাণ করেছেন? 

সহি বুখারি

পুরো সহি বুখারিতে STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য শব্দটিই নেই, IDOL অর্থাৎ উপাসনার প্রতিমার উল্লেখ আছে এই হাদিসগুলোতে – ১ম খণ্ড ৬, ২য় খণ্ড ৩০৩, ৬৭১, ৭০৬, ৩য় খণ্ড ১৮, ৪৩৮, ৬৫৮, ৪র্থ খণ্ড ২৬২, ২৭৬, ৪৬১, ৫৫৮, ৫৭৮, ৭২৩, ৫ম খণ্ড ১৬৯, ২০৬, ৩৭৫, ৬ষ্ঠ খণ্ড ২২, ৮৯, ১০৪, ১৪৭, ২৪৪, ৩৮৪, ৪৪২, ৪৪৭, ৪৪৮, ৪৭৮, ৪৮৩, ৭ম খণ্ড ৩৮২, ৩৮৩, ৮ম খণ্ড ২২৬, ২৭১, ৩১৪, ৩৪৫, ৯ম খণ্ড ২৩২, ৫২৭ ও ৫৩২। যা নেই তা অবৈধ হবার প্রশ্নই ওঠেনা।

সহি নাসাঈ  

১ম খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ১৩টি জায়গায়,  

২য় খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ১৬টি জায়গায়,

৩য় খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ২৭টি জায়গায়, 

৪র্থ খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ এবং IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ শব্দ দুইটির কোনোটিই নেই,

৫ম খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ২০টি জায়গায়,

৬ষ্ঠ খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ২৫টি জায়গায়। 

যা নেই তা অবৈধ হবার প্রশ্নই ওঠেনা।

সহি ইবনে মাজাহ 

১ম খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ১৯টি জায়গায়,

২য় খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ৮টি জায়গায়, 

৩য় খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ৩টি জায়গায়,

৪র্থ খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ৭টি জায়গায়,  

৫ম খণ্ড – STATUE অর্থাৎ ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ২৮টি জায়গায়।

যা নেই তা অবৈধ হবার প্রশ্নই ওঠেনা।

সহি আবু দাউদ 

STATUE অর্থাৎ “ভাস্কর্য” শব্দটি নেই, IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ১১টি জায়গায়। যা নেই তা অবৈধ হবার প্রশ্নই ওঠেনা।

  

সহি তিরিমিযী

IDOL অর্থাৎ ‘প্রতিমা’ আছে ৮ জায়গায়। আর STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য আছে হাদিস ২৭৬৪-এ যেটার বিষয় এ নিবন্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।

সহি মুসলিম

IDOL অর্থাৎ উপাসনার প্রতিমার উল্লেখ আছে এই হাদিসগুলোতে – বুক ১ – ৩০৪, ৩০৫, ৩৫২, ৩৬৭, বুক ৪ -: ১৮১২, বুক ৫ – ২৩১৮, বুক ৭ – ২৯২৩, বুক ১০ – ৩৮৪০, বুক ১৫ – ৪০৪৩, বুক ১৯ – ৪৩৯৫, ৪৩৯৭, ৪৩৯৮, ৪৪৩১, বুক ৩১ – ৬০৪৬, ৬০৫৩, বুক ৪০ – ৬৮৩৯ ও বুক ৪১ – ৬৯৪৪, ৭০২৩। আর STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্যকে অবৈধ করা আছে মাত্র একটি হাদিসে- বুক ২৪-৫২৫০। 

অর্থাৎ আমরা দেখলাম, কোরান-হাদিসের মোটামুটি ৩৪,৩৫০টি ইসলামী সূত্রের মাত্র একটাতে STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্যকে অবৈধ করা আছে, সহি মুসলিম বুক ২৪- ৫২৫০। এ হাদিস কতটা নির্ভরযোগ্য? সহি হাদিস নিয়ে আমাদের আলেমদের আলোচনার সুযোগ আছে। যেমন, আলেমরা আমাদেরকে শিখিয়েছেন রসূল (স) মক্কায় ছিলেন ১৩ বছর, মদিনায় ১০ বছর। কিন্তু ওই সহি মুসলিমেই আমরা পাই তিনি মক্কায় ছিলেন ১৫ বছর- বুক ০৩০, হাদিস ৫৮০৫। সহি বুখারিতে ৩টি হাদিসে আছে তিনি মক্কায় ছিলেন ১৩ বছর (৫ম খণ্ড ১৯০, ২৪২ ও ২৪৩), আবার ওই সহি বুখারিতেই ৪টি হাদিসে আছে তিনি মক্কায় ছিলেন ১০ বছর (৪র্থ খণ্ড ৭৪৭, ৭৪৮, ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫০২ ও ৭ম খণ্ড ৭৮৭।

আবার, রসূল (স) হজ্ব করেছেন মাত্র একবার যাকে ‘বিদায় হজ্ব’ বলে। আলেমরা আমাদেরকে শিখিয়েছেন বক্তৃতায় তিনি নাকি বলেছেন আমাদের জন্য তিনি রেখে যাচ্ছেন কোরান ও তার সুন্নাহ, এ দুটো ধরে রাখলে আমরা “কোনদিন পথভ্রষ্ট হবনা”। কিন্তু ওটা সহি সিত্তার প্রায় ২৮০০০ হাদিসের কোত্থাও নেই, বরং সহি সিত্তাতেই এক রসূলের (স) এক বিদায় হজ্বের এক ভাষণের দুটি পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন আমরা পাই:-  

১। উনি রেখে গেলেন শুধুই কোরান “যা ধরে রাখলে আমরা কোনদিন পথভ্রষ্ট হবনা”- (ক) সহি মুসলিম ২৮০৩, (খ) সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড ৩০৭৪। এর সমর্থনে হজরত ওমরের ভাষ্যে আছে “শুধু কোরানই আমাদের জন্য যথেষ্ট”- সহি বুখারী ১ম খণ্ড-১১৪, ৯ম খণ্ড ৩৭৪ ও ৪৬৮। 

২। উনি রেখে গেলেন কোরান ও তার প্রজন্ম (আহলে বায়েত) “যা ধরে রাখলে আমরা কোনদিন পথভ্রষ্ট হবনা”- সহি মুসলিম হাদিস ৫৯২০।      

অর্থাৎ সহি হাদিস নিয়ে আমাদের আলেমদের আলোচনার সুযোগ আছে, দরকারও আছে।

সংক্ষেপে আরো কিছু দলিল 

(ক) স্বয়ং রসূলের (স) বাড়িতে বিবি আয়েশা (র) প্রাণীর পুতুল নিয়ে খেলেছেন – বুখারি ৮ম খণ্ড ১৫১, আবু দাউদ ৪৯১৪, মুসলিম ৩৩১১, ৫৯৮১। বালিকা পুতুল নিয়ে খেলবে, এটাই স্বাভাবিক নাকি ইসলাম বিরোধী?   

(খ) কাবার দেয়ালে ছিল ৩৬০টি মূর্তি ও হযরত ঈসা (আ) ও (তার) মাতা মেরির ছবি – বুখারি ৩য় খণ্ড ৬৫৮। “রাসুল (সা) হযরত ঈসা (আ.) ও (তার) মাতা মেরির ছবি বাদে বাকি সব ছবি মুছিয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন।”- সিরাত – ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক-এর পৃষ্ঠা ৫৫২।   

(গ) প্রাচীন সভ্যতা আছে এমন দেশ সহ বহু দেশ জয় করেছিলেন মুসলিমরা, সেখানেও নিশ্চয়ই অনেক প্রতিমা-ভাস্কর্য ছিল। কিন্তু সাহাবীরা কিংবা ৭১০ সালে মুহম্মদ বিন কাশেম হিন্দু রাজা দাহিরের সিন্ধুদেশ জয় করার পর কোনো ভাস্কর্য ভেঙেছিলেন তেমন দলিল আমরা পাই না।

সবকিছু মিলিয়ে যা সুস্পষ্ট তা হল ইসলামে তৌহিদ বিরোধী আরাধনার প্রতিমা হারাম, কিন্তু সম্মান সৌন্দর্যের ভাস্কর্য হারাম হবে? প্রশ্নই ওঠেনা।   

**************************************************

ভাস্কর্য ভাঙচুর-উসকানি: রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এবং মদিনা সনদ

৯ ডিসেম্বর, ২০২০

ভাস্কর্য-বিরোধিতার মাধ্যমে উস্কানি দেওয়ায় দেশের তিন বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা নিয়েছে আদালত। এর প্রতিক্রিয়ায় আল সাফা ইসলামিক মিডিয়াতে দেওয়া বিবাদী নেতার বিবৃতির মদিনা সনদ সংশ্লিষ্ট অংশ: “মামলার আইনজীবী তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন সেটি হল যে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী তিনি মদিনা সনদে বাংলাদেশকে চালানোর জন্য দাবি করেছেন বা মদিনা সনদে বাংলাদেশ চলবে বলে মন্তব্য করেছেন। তো বাংলাদেশের কনস্টিটিউশন এবং সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ আখ্যায়িত করে উনাকেও এই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বিবাদী করা হয়েছে।”

যেহেতু মদিনা সনদের মত গুরুত্বপূর্ণ দলিলের কথা আগেও উঠেছে তাই শুধু এর ধর্মতাত্বিক দিক নিয়ে শালীন আলোচনা দরকার।

প্রেক্ষাপট

গঠনতন্ত্র হল কোনও সংগঠনের মূল দলিল যার ভিত্তিতে তার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সব সংগঠনেরই গঠনতন্ত্র থাকে এবং রাষ্ট্রও একটা রাজনৈতিক সংগঠন। নবীজী (স) ৬২২ সালে মদিনায় হিজরত করার পরের বছরই এই “সহীফা” তৈরি করে মদিনার অমুসলিমদের কাছে প্রস্তাব করেন, বিস্তারিত আছে “সিরাত”-এ (ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক) পৃষ্ঠা ২৩১-২৩৪। দলিলের নাম ‘The Covenant Between The Muslims and The Medinans And With The Jews – অর্থাৎ “মুসলিম ও মদিনাবাসী এবং ইহুদিদের মধ্যে কভেন্যাণ্ট” অর্থাৎ চুক্তি, কথা দেওয়া, প্রতিজ্ঞা, ইত্যাদি। ‘সিরাত’ থেকে ভাবানুবাদ দিচ্ছি-

মুজাহির ও আনসারদের বিষয়ে রসুল (সা.) একটি চুক্তিপত্র লেখেন যাহাতে তিনি ইহুদিদের সাথে ‘বন্ধুত্বসুলভ চুক্তি’ (Friendly Agreement) করেন এইভাবে- ‘ইহা রসুল মুহম্মদের পক্ষ হইতে মুমিনগণ, কুরাইশ মুসলিমগণ এবং মদিনার যাহারা তাহাদের পরে আসিয়া যোগ দিয়াছে ও পরিশ্রম করিয়াছে তাহাদের ভিতরে সম্পর্ক স্থির করিতে। তাহারা সকলে এক উম্মা’।

১৪০০ বছর আগের দলিল দিয়ে আজকের রাষ্ট্র “মদীনা সনদে দেশ চলবে” এই দাবিটা যেহেতু উঠেছে তাই দলিলটা খুঁটিয়ে দেখার দরকার আছে। দলিলটা এখন ইন্টারনেটে ফ্রি পাওয়া যায়, ড. হামিদুল্লাহ’র বিখ্যাত বই ‘দ্য ফার্স্ট রিটেন কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্ল্ড’অর্থাৎ ‘বিশ্বের প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র’দেখা যেতে পারে। সনদের পরবর্তীতে মদীনার অমুসলিম গোত্রদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধগুলোকে এ দলিলের আলোচনার বাইরে রাখতে হবে কারণ সেগুলো পরের দিকের হিস্টোরিক্যাল ডেভেলপমেন্ট, ঘটনার বিবর্তন। সনদের ধারাগুলো পড়ে নিলে এ নিবন্ধ বুঝতে সুবিধে হবে, মোট ৪৭টি, কখনো ৫২ বলা হয়েছে। এ দলিলের গুরুত্ব ও অবদান নবীজীর (স) মদিনা জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের, কারণ পরবর্তীতে এটা বাতিল করা হয়। নিচে দেখুন-    

১. এ দলিল আরবের শতাব্দীপ্রাচীন গোত্রভিত্তিক সংঘাতময় সমাজ উৎখাত করে সব গোত্র ও ধর্মের অভিবাসীকে নিয়ে নির্ধারিত ভৌগোলিক সীমাবেষ্টিত “এক জাতি” (দলিলের ভাষায় ‘উম্মা’) প্রতিষ্ঠা করেছিল। যে নবীজী (স) জীবনে গোত্রগুলোর পারষ্পরিক যুদ্ধের অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কোনই সমাজ-ব্যবস্থা দেখেননি, “সবাই মিলে এক উম্মা” এই প্রগতিশীল কনসেপ্ট তার অসাধারণ মেধার প্রমাণ। এ ছিল মানবসভ্যতার অগ্রগতির দিকে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।  

২. জনগণের নিরাপত্তার আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মদিনা সনদের ধারাগুলো পড়লে দেখা যাবে এর ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের মনে নিরাপত্তার আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যে কোনো শাসনকর্তার জন্য এ এক বিপুল অর্জন যা অতীত বর্তমানের অনেক দেশেই ছিলনা বা নেই। 

ইসলামী রাষ্ট্রপন্থিরা মদিনা সনদকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন?

ক. “রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা পৌঁছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সর্বপ্রথম মদীনায় ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত ইহুদী গোত্রসমূহের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না এবং কোন আক্রমণকারীকে সাহায্য করবে না। তারা আক্রান্ত হলে মুসলমানগণ তাদেরকে সাহায্য করবে। শান্তিচুক্তিতে আরও অনেক ধারা ছিল”- মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরান, পৃষ্ঠা ১৩৪৯, ৩৩৫ ও ৪৮।

খ. ওই দলিলটি ছিল ‘মদিনা চুক্তি’এবং ‘মদিনা সনদ’– ৩য় খণ্ড, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন পৃষ্ঠা ৩৬০, প্রকাশক বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন।

গ. “মদিনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জুলুম ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদীনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মালবম্বী বিশেষত ইয়াহুদীদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে খ্যাত”। (সূত্র: ইসলামী জীবন- সন্ত্রাস নির্মূলে মহানবী (সা.)-এর শ্বাশ্বত কর্মসূচি-মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ ভুঞা, দৈনিক ইনকিলাব ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮।) 

এমন অজস্র উদাহরণ আছে। অর্থাৎ আমরা দেখছি ইসলামী রাষ্ট্রপন্থিরাও দলিলটাকে ‘গঠনতন্ত্র’ বলেননি, বলেছেন শান্তিচুক্তি, মদিনা চুক্তি এবং মদিনা সনদ। তার কারণও আছে। সনদের ধারাগুলো পড়লেই স্পষ্ট হবে ওটার বিষয় প্রধানত যুদ্ধ ও যুদ্ধসংক্তান্ত বিষয়াদি, শান্তিচুক্তি, রক্তমূল্য, গোত্রগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি। ‘রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র’ একটা বিশাল, জটিল ও ব্যাপক বিষয়, এতে শত বিষয়ের হাজারো ধারা থাকে। তাছাড়া:- 

(ক) গঠনতন্ত্র তৈরিই হয় দুই বা বেশি পক্ষের আলোচনা-বিতর্ক করে। কিন্তু নবীজী (স) নিজে থেকে এককভাবে ওটা তৈরি করেছিলেন।

(খ) গঠনতন্ত্রে আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের মাধ্যমে পরিবর্তনের সুযোগ থাকতেই হয়। মদিনা সনদের ওপরে আলোচনা বা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না এবং কোন পরিবর্তন হয়ওনি।

(গ) গঠনতন্ত্রকে ক্রমাগত পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে প্রয়োগ করতে হয় যা এ দলিলের ক্ষেত্রে হয়নি।

(ঘ) একতরফা ঘোষণায় চুক্তি বাতিল করা যায় কিন্তু আলোচনা ছাড়া গঠনতন্ত্র বাতিল করা যায় না। অমুসলিমরা এ-চুক্তি ভঙ্গ করলে “ওবাদা ইবনে সামেত (রা.) প্রমুখ সাহাবী প্রকাশ্যভাবে তাদের সাথে চুক্তি বিলোপ ও অসহযোগের কথা ঘোষণা করেন”। (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনূদিত বাংলা-কোরান পৃ: ৩৩৬)। 

এবারে আত্মসমালোচনা, যাকে খুব বুদ্ধিমানের মতো প্রচণ্ডভাবে এড়িয়ে চলি আমরা। কিন্তু তাতে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। মদিনা সনদের ধারায় আছে-

“কেহ যদি কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করে ও তাহা প্রমাণিত হয়, তবে নিশ্চয়ই খুনির মৃত্যুদণ্ড হইবে”। – ধারা ২১।

আবার নিচের ধারাটিও আছে-“কোন অবিশ্বাসীকে খুন করার বদলে কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে খুন (ইয়াক্তালু) করিবে না” - ধারা ১৪ - দ্য ফার্স্ট রিট্ন্ কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্ল্ড, পৃষ্ঠা ৪৫ ও ৪৭- ড. মুহম্মদ হামিদুল্লাহ।

এ দিয়ে দেশ চলতে পারে?

মদীনায় তখন মোটামুটি দশ হাজার লোকের বাস (ড. মুহম্মদ হামিদুল্লাহ পৃ. ১৩), আর মুজাহির-আনসার মিলিয়ে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র দু’শো।” (দ্য প্রসেস অব্ ইসলামিক রেভল্যুশন” – মওলানা মওদুদি, পৃ. ৪২।)

অর্থাৎ অমুসলিমরা ৯৮ শতাংশ, ওটা ওদেরই ভিটেমাটি পৈতৃক জায়গা। সেই দশ হাজার লোক ও তাদের শক্তিশালী নেতারা নিজেদেরই দেশে বসে নিজেদেরই বিরুদ্ধে এই অন্যায় অপমানকর চুক্তিতে কেন রাজি হবে মাত্র দু’শো জনের নেতার সাথে? আপনি হবেন? প্রশ্নই ওঠে না। ওরা নবীজীকে (স) আল্লাহর রসুল বলেই মানেনি, তার নেতৃত্ব মানবে কেন? নেতা কখনো নেতাগিরি ছাড়তে চায়? এ সামাজিক শাসন নবীজী অবশ্যই করেছিলেন, তবে শুরুতেই নয় বরং কয়েক বছর সংগ্রামের পরে মদিনার এবং অন্যান্য অমুসলিম গোত্রগুলোকে তার আওতায় এনে।

কাজেই ১৪০০ বছর আগেকার যে শান্তিচুক্তির বিষয় প্রধানত গোত্রীয় শান্তিচুক্তি ও সাহাবীরা যা বিলোপ করেছিলেন, সেটাকে ‘গঠনতন্ত্র’ নাম দিয়ে বর্তমানে গোত্রীয় সংস্কৃতিমুক্ত কোনও ‘দেশ চলবে’, এ বাক্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। হ্যাঁ, মদিনা সনদের যে স্পিরিট, যে মর্মবাণী (সব ধর্মের নাগরিক মিলে এক উম্মা) তা শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য চিরকালের উদাহরণস্বরূপ।

*********************************************

প্রতিমা বনাম ভাস্কর্য: খেলাফত মুদ্রায় মসুলিম গভর্নরের মুখচ্ছবি

২২ ডিসেম্বর ২০২০

দেশে এমনিতেই অজস্র সমস্যা, সাথে যোগ হয়েছে ভাস্কর্যের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক, হুংকার, তকমা, গালিগালাজ ইত্যাদি। শালীন আলোচনার মাধ্যমে এর সুরাহা হওয়া দরকার। যেকোনো আন্দোলনের অন্যতম শক্তি (১) হিকমা অর্থাৎ প্রজ্ঞা, (২) কল্যাণমুখী সুস্পষ্ট একটা তত্ত্ব, (৩) ইচ্ছেতরুর অবাস্তব কল্পধেনু নয় বরং বাস্তব বান্ধবতা, ও (৪) ব্যক্তিগত আবেগ। সেগুলোই দেখা যাক এবারে।

১. হিকমা অর্থাৎ প্রজ্ঞা

কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশের পেছনে হিকমা অর্থাৎ প্রজ্ঞা থাকতে হয়। বর্তমানে ভাস্কর্য দেখে কোনো মুসলিমের ঈমান আকিদার ক্ষতি হয়নি, ধুপধুনো জ্বেলে তার আরাধনা শুরু করেনি কেউ। অর্থাৎ ভাস্কর্য মুসলিমের কোনোই ক্ষতি করছে না। তাই বিশ্বের অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞ বলেছেন পূজার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু না থাকলে ভাস্কর্য হারাম নয়। আমাদের ভাস্কর্য-বিরোধীরা তাঁদের সাথে কথা বললে ও তাঁদের যুক্তিগুলোকে দেখলে ভালো হয়।

২. তত্ত্ব

ভাস্কর্য-বিরোধী তত্ত্বটা এসেছে কোরান ও সহি হাদিস থেকে (সহি সিত্তা অর্থাৎ ছয়টি সহি হাদিস গ্রন্থ- সহি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী)। জীবনের দীর্ঘকাল আমি মধ্যপ্রাচ্যে কাটিয়েছি, আরবি ভাষার শব্দ-জটিলতা আমার কিছুটা জানা আছে। উপাসনার প্রতিমা অবৈধ করে কোরান-হাদিসে যে ‘রিজস’ ও সংশ্লিষ্ট শব্দাবলি আছে তার বাংলা তর্জমাতে “মূর্তি”শব্দটা ব্যবহার করার ফলে দুর্গামূর্তি গান্ধীমূর্তি, হনুমান-সাপ-ব্যাঙ-মানুষের ভাস্কর্য সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এই জগাখিচুড়ীর সমাধান পাওয়া যাবে কোরান ও সহি হাদিসের ইংরেজি অনুবাদে কারণ ইংরেজিতে উপাসনার প্রতিমা (IDOL) ও সম্মানের/সৌন্দর্য্যের ভাস্কর্য (STATUE) আলাদা দুটো শব্দ। কোরান ও সহি হাদিসের মোটামুটি ৩৪,৩৫০টি ইসলামি সূত্রে অবৈধ করা আছে IDOL অর্থাৎ আরাধনার প্রতিমা, আর ভাস্কর্য অর্থাৎ STATUE নিষিদ্ধ তো দূরের কথা শব্দটার উল্লেখই নেই মাত্র একটি হাদিস ছাড়া এবং সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।

ভাস্কর্য-বিরোধীরা সূরা সাবা’র আয়াত ১৩-এ: “তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, কুয়ার মতো বৃহদাকার পানির পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত” – অনুসারে ভাস্কর্যের বৈধতা নাকচ করেন এই বলে যে ওটা অতীতের ব্যাপার, নবীজী (স.) আসার পরে ওটা নাকি বাতিল হয়ে গেছে। আল্লাহর বিধান কে, কেন, কবে, কোথায়, কী প্রেক্ষাপটে ও কোন অধিকারে বাতিল করল এবং বিশ্ব-মুসলিম সেটা মানতে বাধ্যই বা হবে কেন? ওদিকে তো উদ্যত-তর্জনী দাঁড়িয়ে আছে আল কোরান - “তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না”- সূরা আল-ফাতিহা আয়াত ২৩।

আল্লাহ’র বিধানের প্রজ্ঞা বাতিল করার অধিকার কারো নেই।

সূরা সাবা-র আয়াত ১৩-র ব্যাপারে কিছু ভাস্কর্য-বিরোধী বলেন ওটা ছিল নিষ্প্রাণ কিছুর মূর্তি, প্রাণীর নয়। তারা কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে এটা পেলেন? আমরা তো দেখছি আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে প্রাণীর ভাস্কর্যকেও বৈধতা দিয়েছেন: “যখন তুমি আমার আদেশে কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত” – মায়েদা ১১০। প্রাণীর মূর্তির বৈধতা আছে সূরা ইমরান ৪৯ আয়াতেও - হযরত ইব্রাহীম (আ) বললেন - "আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখির আকৃতি তৈরি করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখিতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে"।

তাহলে?

অতএব কোরান মোতাবেক প্রাণীর ভাস্কর্যও বৈধ যা মুসলিম খলিফারাও মেনেছেন, মুদ্রায় সাসানিদ খলিফার মুখচ্ছবি দেখুন।

৩. বাস্তব

(ক) বাংলাদেশে বহুকাল থেকেই প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ অজস্র মানুষের ভাস্কর্য আছে তার প্রতিবাদ ভাস্কর্য-বিরোধীরা কখনো করেননি অথচ হঠাৎ কেন জাতির পিতার ভাস্কর্যের বিরোধিতা তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আমরা এখনো পাইনি। বরং মুসলিম ইতিহাসের বাস্তবে ভাস্কর্যের প্রমাণ আছে। (এক) কয়েনউইক ডটকম-এ “কয়েনেজ অব দ্য ফার্স্ট ক্যালিফেট”-এ খেলাফত আমলের মুদ্রাতে কোরানের কলমার সাথে খলিফার ভাস্কর্য খোদাই করা আছে।

(দুই) ইরানের সাসানীদ বংশের সম্রাটকে পরাজিত করে মুসলিম সৈন্যেরা ইরান জয় করে। সেই সম্রাটদের মুদ্রায় তাঁদের মুখচ্ছবি খোদাই করা থাকত। ইরান জয় করার পর সাসানীদ সম্রাটদের অনুকরণে মুসলিম গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ মুদ্রায় নিজের মুখচ্ছবি খোদাই করেন, কেউ তাতে কোনো আপত্তি করেন নি। ডেভিড উড, জে. স্মিথদের মতো কট্টর ইসলাম-বিরোধীদের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি সংগ্রামরত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি স্কলার আমেরিকার ড. ইয়াসির কাধি একথা বলেছেন এবং ক্যামেরায় মুদ্রা দেখিয়েছেন। তাঁর ভিডিও “লাইব্রেরি চ্যাট”সিরিজের ১১ নম্বর ভিডিওতে ৫০ মিনিটের পর ক্যামেরায় সে মুদ্রা দেখা যাবে :-  https://www.youtube.com/watch?v=nJCbonlLQcI

(খ) এই কারণেই বাংলাদেশের বাইরের বিশ্ব-আলেমরা কোনোদিন ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কোনো মিটিং মিছিল করেননি। অর্থাৎ দুনিয়ায় প্রায় ১৬০ কোটি আলেমদের আট ভাগের সাত ভাগই ভাস্কর্য্য বিরোধী নন। কারণ তারা উপাসনা প্রতিমা ও সম্মানের ভাস্কর্যের পার্থক্য জানেন। আমাদের ভাস্কর্য-বিরোধীরা বলেন- “কোন দেশ কি করছে সেটা ধর্তব্য নয়।” কিন্তু ভাস্কর্য-সমর্থকরা তো বিশেষ কোনো দেশের কথা বলছেন না, তারা বলছেন, ওসব দেশের আলেমদের কথা। আশাকরি আমাদের আলেমরা ডক্টর ইয়াসির কাধি-র সাথে আলোচনা করে আমাদেরকে একটা মীমাংসা উপহার দেবেন, উনাকে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব এক নামে চেনে।

(গ) গত কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহে সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়েছে যে মুসলিম-বিশ্ব মানবাধিকারের পক্ষেই বিবর্তিত হচ্ছে। উদাহরণ অজস্র। (এক) আদি ইমামেরা যে কোনো কিছুর ওপরে যে কোনো ছবি আঁকার এতই বিরুদ্ধে ছিলেন যে শারিয়া আইনে কাপড়, চামড়া, দেয়াল বা যে কোনো কিছুর ওপরে প্রাণী অপ্রাণী সবকিছুরই ছবি আঁকা অবৈধ করা হয়েছিল – আল আজহার বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প স্বাক্ষরে সত্যায়িত শারিয়া কেতাব “উমদাত আল সালিক”, আইন নং w.50 সিরিজ। ধীরে ধীরে বিশ্ব মুসলিম তা থেকে বেরিয়ে এসেছে। (দুই) কয়েক দশক আগেও অনেক আলেম ক্যামেরার ছবি, টিভিতে ছবি, ছবি আঁকা ইত্যাদির দারুণ বিপক্ষে ছিলেন, তারাও কোরান হাদিসেরই সূত্র দিতেন। বিশ্ব মুসলিম তা থেকেও অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। (তিন) বাংলার মুসলিম মানসে কয়েক দশক ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছে ‘মকসুদুল মুমেনীন’ কেতাব, আজ ইমামেরাই বলেন এ বই না পড়তে। অর্থাৎ মুসলিম সমাজ প্রকৃতির অমোঘ বিধানেই বিবর্তিত হচ্ছে। আশা করা যায় কয়েক দশক পরে ভাস্কর্যের বৈধতা নিয়েও কোনো বিতর্ক থাকবে না।

(ঘ) এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম মালিককে (র.) খলিফা হারুনর রশীদ প্রস্তাব করেছিলেন রাষ্ট্রীয়ভাবে খেলাফত জুড়ে ইমামের শারিয়া আইন প্রয়োগ করবেন এবং সেটা কাবার গায়ে ঝুলিয়ে দেবেন। কোনো মুসলমানের পক্ষে এর চেয়ে সম্মানের আর কি হতে পারে! কিন্তু প্রাজ্ঞ ইমাম সম্মতি দেননি বরং বলেছিলেন তিনি মদীনার ইমাম, অন্যান্য জায়গায় মুসলিমদের জন্য তাদের নিজস্ব ইমাম আছে – (মুহাম্মদ আবু জাহরা’র বিখ্যাত কেতাব “দি ফোর ইমামস” পৃষ্ঠা ৭২-৭৩)। ইমামের এই কথার মধ্যে গভীর প্রজ্ঞা আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গার পরিস্থিতি ভিন্ন, সেই সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সেখানকার ইমামেরা মুসলিমদেরকে কোরান ও রাসূল (স.) মোতাবেক এমনভাবে হেদায়েত করবেন যাতে সমাজের কল্যাণ হয়। এটাই ইজতিহাদ, ইসলামের এক অনন্য পদ্ধতি অথচ যার প্রয়োগ বেশি দেখা যায় না। এই পদ্ধতি আলেমদেরকে যেমন অধিকার দেয় তেমনি দায়িত্বও দেয়। কিন্তু আজ আমাদের আলেমদের মধ্যে ইজতিহাদ-এর দাযিত্ব পালন আমরা খুব একটা দেখিনা, তাঁরা শুধু অতিত আলেমদের সিদ্ধান্তই আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেন। সে দায়িত্বটা ওই হেদায়েত পর্যন্তই, জোর করে চাপিয়ে দেয়া নয়। বলাই বাহুল্য, হেদায়েতের মধ্যে হুংকারের জায়গা নেই।

সম্প্রতি রাজনীতি ও ধর্মনীতির অঙ্গনে ভাষা প্রয়োগে তুমুল অবক্ষয় ঘটেছে, হুংকার ছাড়া কথাই নেই। সহি ইবনে মাজাহ ৫ম খণ্ড হাদিস ২৯৭২- তে নবীজীর (স) বলা দুই বাক্যের অপূর্ব উপদেশটা সবাইকে মেনে চলার অনুরোধ করছি। তাঁর শানে রচিত এই কবিতাটা এখন বাংলা ভাষায় “স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির”-তে ২২ লক্ষ ভিউ ও চৌষট্টি হাজার শেয়ার নিয়ে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়। ইন্টারনেটে “জিহ্বা কবিতা”সার্চ করলেই পাওয়া যাবে।

**********************************************

ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (১): প্রেক্ষাপট ক্যাসিনো ক্রাইম

৩ অক্টোবর, ২০১৯

উন্নয়ন-অন্যায়নের উথাল পাথাল ঘটনা-দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত জাতির মন মগজ। ক্যাসিনো-ক্রাইমে চলছে হরেক রকম “লীগ”-এর রাঘব বোয়ালদের ধরপাকড়। এই প্রেক্ষাপটে ওয়াজ মাহফিলে আবারো উঠে এসেছে সেই পুরোনো দাবি, দেশ ক্রাইমে ছেয়ে গেছে কিন্তু কোনো ক্রাইমই উচ্ছেদ হবেনা কারণ বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যা ধর্মহীন ও ধর্মবিরোধী ‘কুফরি আকিদা’। সব ক্রাইম উচ্ছেদ হবে ইসলামী রাষ্ট্রে। তিতিবিরক্ত ক্রুদ্ধ ও বিকল্প-সন্ধানী গ্রামবাসীরা সেটা বিশ্বাস করছে। অসংখ্য আলেমদের সবাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরোধী এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক। শত শত ওয়াজে কোটি গ্রামবাসীর ওপর তাদের ব্যাপক প্রভাব আজ এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে যাবেনা। তাদের ওপর মওলানাদের সম্মান ও প্রভাব শক্তিশালী, মানুষের জন্মের আজান থেকে বিয়ের দোয়া হয়ে মৃত্যুর জানাজা পৰ্যন্ত তাদের কাছে বাঁধা। আমি গ্রামে জন্মেছি বড় হয়েছি, এখনো ফোনে কৃষক বাল্যবন্ধু ও আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখি। আগে তারা নববর্ষ, বসন্তবরণ, ২১ শে, ২৬শে আর ১৬ই উদযাপন করত, কিন্তু এখন করেনা কারণ “হুজুরে কইছে ওইডা শির্ক”।

অলক্ষ্যে বদলে যাচ্ছে সমাজ।

এ নিবন্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামী রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে। লক্ষ্যণীয়, পশ্চিমা দেশে আমরা ইসলাম নিয়ে ভদ্রভাবে বিতর্ক-আলোচনায় অভ্যস্ত। ক্যানাডিয়ান টিভিতে আজহারী মওলানার সাথে কয়েকবার শারিয়া নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্কের পরে আমরা একসাথে অনেক হাসিঠাট্টা করেছি। বাংলাদেশে সে আবহ নেই। বিভিন্ন মতামতের শালীন সংঘাতই অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি এবং মুসলিমদের গঠনমূলক সমালোচনা ইসলামের সমালোচনা নয়, এটা কেউ না বুঝলে কিছু করার নেই।

(১) বর্তমান বাস্তবতা

ধর্মনিরপেক্ষতা আস্তিকতা বা নাস্তিকতা নয়। ডিকশনারি মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতা হল এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা যা রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মবিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। ধর্মীয় রাষ্ট্রের শতাব্দী ধরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ জনগণ সেটাকে উৎখাত করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মের স্থান নেই। সময়ের সাথে শব্দটার অর্থ উল্টো হয়ে গেছে। ঠিক যেমন ‘মীর জাফর’ নামটার অর্থ চমৎকার কিন্তু এখন এতই ঘৃণিত যে কেউ ওই নাম রাখেনা। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো ধর্মের বিরোধী তো নয়ই বরং সব ধর্মকে সহায়তা করে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার (ক) বানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশন, (খ) বায়তুল মুকাররমের সমস্ত খরচ দেয়, (গ) তবলিগ জামাতের জমি দিয়েছে, (ঘ) অজস্র অনুদান দিয়েছে এবং দিচ্ছে মসজিদ মাদ্রাসায়, (ঙ) সরকারি খরচে হজ করছেন হাজারো মানুষ, (চ) দেশে  ৫৬০টি মডেল মসজিদ বানানো হচ্ছে ইত্যাদির লম্বা তালিকা। পশ্চিমা সরকারগুলো বাধা দেয়নি হাজার হাজার মসজিদ ও ইসলামি সংগঠন বানাতে, বরং তাদের অজস্র টাকা ও আইনি সহায়তায় মুসলিম ইমিগ্র্যান্ট, ইসলামি সংগঠন, মসজিদ-মাদ্রাসা, ওয়াজ-মহফিল, রেডিও-টিভি চ্যানেল, এমনকি শারিয়া ব্যাঙ্ক, শারিয়া মিউচুয়্যাল ফাণ্ড, শারিয়া-ইকুয়িটি ইত্যাদি গত কয় দশকে বেড়েছে কয়েক গুণ। ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক দৈনিক নয়া দিগন্ত বলছে-

“জার্মানিতেই বর্তমানে আড়াই হাজারের ওপর মসজিদ রয়েছে। সে-দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন তার সরকার জার্মানিতে আরো মসজিদ তৈরি করবে। একই ঘোষণায় তিনি এ’ও জানান, জার্মানীর সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় জার্মান ভাষায় ইসলাম শিক্ষা দেয়া হবে … এ বোধোদয় ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারাকোজির মধ্যেও এসেছে … উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে তিনি ফ্রান্সে ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অর্থ সহায়তা দিতে পারেন। ব্রিটেন ইতোমধ্যে মুসলমানদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য প্রদান করেছে … ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ইতালিয় ইসলামি সংহতকরণ’ নামে ইতালিতে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান চালু করেছেন। এভাবে ইউরোপের প্রায় সব দেশই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে”। ২৩শে জুলাই ২০০৮, ‘ইউরোপ ও ইসলাম’ ।

অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আসলে ধর্মের সহায়তাকারী। ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র চালানোর একটা পদ্ধতি মাত্র। ওগুলো সংসদে বসে বানিয়েছেন এবং সমাজ-বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করছেন জনগণের নির্বাচিত উচ্চশিক্ষিত সমাজবিজ্ঞানী ও আইনবিদ সাংসদেরাই, পাদ্রী-রাবাই ধর্মগুরুরা নন। ঠিক যেমন বিজ্ঞানীরা বহু গবেষণায় বানিয়েছেন বহু ওষুধ যা প্রাণ রক্ষা করে ও শিল্পায়নের প্রযুক্তি দেয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যদি ‘ধর্মহীনতা’ হয়, তবে ‘প্রাণহীন দেহ’ হবে ‘প্রাণ নিরপেক্ষ’ এবং ‘বৃষ্টিহীন মরু’ হবে ‘বৃষ্টিনিরপেক্ষ মরু’। কি দাঁড়াল তাহলে?

আমেরিকার ডলারে লেখা নেই ‘ইন্ গড উই ট্রাস্ট’? হ্যাঁ, আছে। সাংসদ ও রাষ্ট্রপ্রধানকে ধর্মীয় শপথ নিতে হয় না? হয়। কোরান হাতে শপথ নেয়া বৈধ করেনি সরকার? করেছে। আদালতগুলোতে বাদী-বিবাদীকে ধর্মীয় শপথ নিতে হয় না ? হয়। ক্যানাডায় ক্যাথলিক স্কুলে প্রচুর সরকারি টাকা যায় না? যায়। বিলেতের সরকার রাষ্ট্রীয় ট্রেজারি থেকে শারিয়া-বণ্ড বাজারে ছাড়েনি? ছেড়েছে। আমেরিকার ট্রেজারি ইসলামি ব্যাঙ্কিং-এর অনুমোদন দেয়নি ? দিয়েছে। আমেরিকার সরকারি প্রতিষ্ঠান এআইজি শারিয়া-ব্যাঙ্কিং অনুমোদন দেয়নি ? দিয়েছে। লণ্ডনের বিশাল মসজিদের জন্য দশ কোটি পাউণ্ড সরকারি অনুদানের প্রস্তাব ছিল না? ছিল, সে ইমেইল আমরা পেয়েছি। জার্মানির কোলন-এ সুবিশাল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে না? হচ্ছে। বিলেত ও জার্মানি তাদের আইনে মুসলিম নাগরিকদের জন্য বহুবিবাহের কিছু উপাদান গ্রহণ করেনি? করেছে। সরকারগুলো পুলিশ দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধান করে না? করে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে সরকার শারিয়ার বিরুদ্ধে মিছিল নিষিদ্ধ করেনি? করেছে। টরন্টো শহরে রেজিস্টার্ড ইসলামি সংগঠন নেই অনেক? আছে। ইংল্যাণ্ডে জার্মানিতে ফ্রান্সে প্রায় সাত হাজার বৈধ ইসলামি সংগঠন নেই ? আছে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো বিশাল জমির ওপরে বিরাট দালান, অনেক দেশে সেগুলোর বিভিন্ন ট্যাক্স মওকুফ করা হয় না? হয়। সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ অত্যাচারিত মুসলিমকে আশ্রয় নাগরিকত্ব দিয়েছে কোন মুসলিম রাষ্ট্র নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোই।

এরপরেও ওয়াজ মহফিলে শুনতে হয় পুরো পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে ও যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

এক ধর্মের ধর্মরাষ্ট্র অন্য ধর্মের রাষ্ট্রকে বৈধ ও উৎসাহিত করে। পাকিস্তানের ইসলামি রাষ্ট্র ভারতে হিন্দু রাষ্ট্রকে বৈধ ও উৎসাহিত করে। ইউরোপ অ্যামেরিকা ক্যানাডা অস্ট্রেলিয়ায় ওরা ইহুদী-খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানিয়ে আমাদের ঘাড়ে ওদের শারিয়া চাপিয়ে দিলে কোটি কোটি মুসলমানের কী দুর্দশা হবে আর তার জন্য কে দায়ী হবে? ধর্মরাষ্ট্র ইসরায়েল কি দানবীয় তা তো আমরা দেখছি। ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান অমুসলিমদের প্রতি কি দানবীয় তা তো আমরা দেখছি। খ্রিস্টান, হিন্দু (সনাতন) রাষ্ট্র (সতীদাহ স্মর্তব্য) ও মুসলিম খেলাফত হাজার হাজার বছর সময় পেয়েছিল নিজেদের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার, এখনো পাচ্ছে কিছু দেশে। কিন্তু কিছু হাতেগোণা শাসকের সময় ছাড়া এর ইতিহাস ভারাক্রান্ত হয়ে আছে জনগণের দুর্ভোগে, নারীর অশ্রু আর রক্তে। এর কিছুটা পাবেন মতামত বিভাগে ২৮ অগাস্ট, ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত “মুসলিম উম্মাহ ও অপ্রতিহত মোদী” নিবন্ধে। এছাড়াও পাওয়া যাবে ইমাম গাজ্জালীর চিঠিতে :-

“বাদশাহদের প্রায় সব জমিজমা ও প্রাসাদ (রিয়েল এস্টেট) অবৈধভাবে অর্জিত। কাহারো উচিত নহে এসব সুলতানকে মুখ দেখানো বা তাহাদের মুখ দেখা। তাহাদের অত্যাচারের জন্য তাহাদিগকে ঘৃণা করা উচিত, তাহাদের অস্তিত্বকেই নিন্দা করা উচিত, তাহাদের প্রশংসা করা উচিত নহে…তাহাদের রাজপ্রাসাদ ও সাজ-পোশাককে নোংরা ও অনৈসলামিক ঘোষণা করা উচিত”… তিনি সকল মন্ত্রীদিগকে চিঠিতে লেখেন যে, − “স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করিয়াছে। আমি এইস্থান ত্যাগ করিয়া যাইতেছি যাহাতে স্বৈরতন্ত্রের এই নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড আমাকে দেখিতে না হয়” − এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেন্ট ইন ইসলাম − মওলানা মওদুদি- পৃষ্ঠা ৬২-৬৩।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা কি ত্রুটিমুক্ত? অবশ্যই নয়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল হিটলারের মতো দানব, এসেছিল বুশ ব্লেয়ার যারা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম তৈল-কুতুবদের সাহায্যে মুসলিমদের ওপর গণহত্যার দাবানল জ্বালিয়েছে। অর্থাৎ লোহার কুড়ুলটা অন্য কাঠকে ছিন্নভিন্ন করতে পেরেছে কাঠের হাতলটার সাহায্য পেয়েছে বলেই। আমাদের শারীয়াপন্থীরা সরকারের ব্যর্থতাকে জনগণের কাছে গণতন্ত্রীর ব্যর্থতা হিসেবে দেখান। এটা অসৎ প্রবৃত্তি। তৃতীয় বিশ্বে সত্যিকারের গণতন্ত্র নেই, আছে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরাচার বা অন্যকিছু। গণতন্ত্র দেখতে হলে আসতে হবে পশ্চিমা বিশ্বে। ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল ব্র্যান্ট এক মামলায় তিন দিনের জেল খেটে এসেছেন। বাংলাদেশে এটা চিন্তা করা যায়? এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। মুসলিম ইতিহাসে এটা আমরা আদিতে কিছু দেখি যেমন হযরত ওমরের (রা) ছেলে আদালতে শাস্তি পেয়েছিল। কিন্তু খেলাফত রাজতন্ত্র হয়ে যাবার পর এমন আর বেশি দেখা যায়না। এখনকার শারিয়া-রাষ্ট্রে তো এটা কল্পনাই করা যায়না।

ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান চুরি-ডাকাতি, খুন-জখম, মদ্যপান, ব্যাভিচার ইত্যাদি অপরাধ করলে শাস্তি তো দূরের কথা তার বিরুদ্ধে মামলাই করা যাবেনা− বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ৩য় খণ্ড আইন নং ৯১৪ গ এবং হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৮৮। তওবা করলেই গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারীর শাস্তি মাফ (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ১৩)। কিংবা পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম মহিলা গভর্নর ড. শামশাদ আখতার যেহেতু নারী তাই তিনি ব্যাংকের কিছু বিশেষ দলিলে সই করতে পারবেন না (দৈনিক ডন ২৯-০৯-২০০৮) এমন উদ্ভট দাবিও ঘটে ইসলামী রাষ্ট্রেই। ইসলামী রাষ্ট্রে আইন হয় – “কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাক্ষ্য গোপন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হইয়াছে” (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩১)। 

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আইন হয় আইনের চোখে সবাই সমান, তওবা করলেও অপরাধের শাস্তি হবে, আইন হয় “সাক্ষ্য গোপন করিও না”− বাকারা ২৮৩, মায়েদা ১০৬, ইমরাণ ১৬১ ইত্যাদি।

ইসলামী রাষ্ট্রে আইন হয় −“যদি উদ্দেশ্যটি বাধ্যতামূলক হয় তবে মিথ্যা বলা বাধ্যতামুলক” (শাফি আইন নং আর.৮.২) ইত্যাদি।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আইন হয় – “মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকো … সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না”− সুরা হজ ৩০ এবং বাকারা ৪২। 

অনেকে বলেন পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্য মিসর ইত্যাদি যেগুলো সাংবিধানিকভাবেই শারিয়া রাষ্ট্র সেগুলো পারফেক্ট ইসলামিক রাষ্ট্র নয়। সেক্ষেত্রে আমরা বর্তমান বিশ্বে পারফেক্ট ইসলামী রাষ্ট্র কোনটা তা জানতে চাই। ভালো হয় যদি আমাদের শারীয়াপন্থীরা জানতে চেষ্টা করেন কেন অনেক ইসলামী সংগঠন ও বিশেষজ্ঞ ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরোধী। ভালো হয় যদি তারা আলেম-উলামা প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ার বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন নাহদালাতুল উলামা’র ‘দি ইলিউশন অব অ্যান ইসলামিক স্টেট্’ (ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম) বইটার যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করেন কারণ ভিন্নমত নিয়ে চিন্তা করাটাই জ্ঞানার্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।

***************************************

ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (২): কে মুসলিম, কে নেতা?

১৯ অক্টোবর, ২০১৯

“ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি খুঁড়ে জঙ্গীদের বের করা হবে” – র‌্যাব-প্রধান বেনজীর আহমেদ, প্রথম আলো ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।

হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে এবং সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন। এদিকে তনু, মিতু, সাগর-রুনি, নুসরাত, পলি, আবরার, শিশুহত্যা, ছাত্র রাজনীতি ইত্যাদি অসহ্য ঘটনাবলীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জাতির মন-মানস। অনেকে তো খবর পড়াই ছেড়ে দিয়েছেন। বসে নেই জঙ্গীরাও, গোপনে অস্ত্র ও হত্যা পরিকল্পনা চালিয়েই যাচ্ছে তারা। এই সেদিনও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকহ  ধরা পড়েছে তারা (বিডিনিউজ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৫ ও ১৭ অক্টোবর ২০১৯ – গাবতলী, সাভার, ফতুল্লা)। তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট – ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। নররক্তের জ্বালানি-চালিত গগনপোতের স্বর্গভিযানে তারা বদ্ধপরিকর।

এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি তিনটে, (১) মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহদের মতো নিজেদের রাজ্যে, (২) গণতান্ত্রিক পন্থায়, যেমন  বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো করছে, ও (৩) বাংলাদেশের জঙ্গীরা এই পথের অনুসারী- সশস্ত্র সংগ্রাম যা তালেবানেরা করেছিল আফগানিস্তানে। প্রশাসন খেয়াল করলে ভালো হয়, গ্রেপ্তার, বিচার, শাস্তি- এসব দিয়ে সম্পূর্ণ জঙ্গী উচ্ছেদ কখনোই হবেনা। ইসলামের জঙ্গী ব্যাখ্যা যতদিন থাকবে ততদিনই জঙ্গী জন্মাতে থাকবে। উচ্ছেদ করতে হবে ইসলামের জঙ্গী ব্যাখ্যা এবং অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন কিভাবে সেটা সম্ভব। তাদের গবেষণা সংকলন করা আছে শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি বইতে, ওটা ইন্টারনেটে ফ্রি দেয়া আছে।

ইসলামী রাষ্ট্রপন্থীরা দাবি করেন তারা ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ অর্থাৎ প্রথম চার খলিফার আদর্শে রাষ্ট্র চালাবেন। আচ্ছা ধরুন, আমরা জনগণ তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ম্যাণ্ডেট দিলাম। তখন তারা কী করবেন? আমরা জানি প্রথম চার খলিফা আমৃত্যু ক্ষমতায় ছিলেন এবং চার রকম ভিন্ন পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাই জানতে হবে প্রস্তাবিত ইসলামী রাষ্ট্রে (ক) রাষ্ট্রপ্রধান আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকবেন কিনা, এবং (খ) সেই চার পদ্ধতির কোনটা অনুসরণ করে কেউ রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এবং অন্য পদ্ধতিগুলো বাতিল হবে কিনা। পদ্ধতিগুলো হল:-

(১) সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মত অনুযায়ী রসূল (স) জনগণের ওপর নেতা নির্বাচনের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন,

(২) হযরত আবুবকর (রা) ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হযরত ওমরকে (রা) পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন,

(৩) হযরত ওমর (রা) ছয় সাহাবীর কমিটি করে তাদের মধ্যে থেকে খলিফা নির্বাচনের ভার দিয়েছিলেন, সে কমিটি হযরত ওসমানকে (রা) খলিফা নিযুক্ত করেছিল,

(৪) হযরত ওসমান (রা) হঠাৎ নিহত হলে হযরত আলীর (রা) বিকল্প ছিলনা, তিনি খলিফা হয়েছিলেন। স্মর্তব্য, সিরিয়ার গভর্নর মাবিয়া’র নেতৃত্বে (তাঁকে “রা.” বলা যাবে কিনা তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে) মুসলিম বিশ্বের একটা অংশ হযরত আলীকে (রা) খলিফা বলে স্বীকার করেনি।

এর কোন পদ্ধতিটা আমরা নেব আর কোনটা বাতিল করব? নাকি সবগুলোই নেব? এছাড়াও আছে নেতা নির্বাচনের সংকট। নিচে দেখুন ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোর সমর্থক এই আলেমদের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক কী। আমি আলেমদের চরিত্রহনন করতে চাইনা তাই তাদের নাম উল্লেখ করছিনা। আমি শুধু নেতৃত্বের সমস্যাটা চিহ্নিত করছি। ইউটিউবের শত শত উদাহরণ থেকে দশটা দেখাচ্ছি:-

১. অমুক মওলানা বলেছেন তমুক বিখ্যাত বর্ষীয়ান আল্লামা “এই এই পশুর বাচ্চা”। বর্ষীয়ান আল্লামা ও পশুদুটোর নাম উল্লেখ করছিনা, আপনারা বুঝে নেবেন।

২. অমুক হাফেজ বলেছেন তমুক মওলানা “হারামজাদা”,

৩. অমুক আল্লামা বলেছেন তমুক মওলানা “বুড়া শয়তান”,

৪. অমুক মওলানা তমুক আলেমকে “উচিত শিক্ষা” দিলেন,

৫. অমুক মুফতি তমুক মওলানাকে “আইক্কা ওয়ালা বাঁশ” দিলেন,

৬. অমুক মওলানা তমুক আলেমকে “জুতা পেটা” করলেন,

৭. অমুক মওলানার “ফাঁসি চাই”দাবী করলেন তমুক আলেম,

৮. অমুক মুফতি তমুক মওলানাকে “বাংলাওয়াশ” করলেন,

৯. অমুক মওলানার প্রতি তমুক আলেম – “তুই ব্যাটা কে”??

১০. বিশালকায় আলেম তো ওয়াজে একের পর এক অন্যান্য মওলানা/আলেম/মুফতিদেরকে হুংকারে হুংকারে “কাফের” ফতোয়া দিয়েই যাচ্ছেন। তাকে আবার আরেক মওলানা গালি দিয়ে বলছেন – “কুত্তায় কামড়াইলে ইনজেকশন ল’!! হগগলরে দোজখে পাঠাইয়া হে অ্যাকলা মুমিন ব্যাহেস্তে যাইব”!

এই হল অবস্থা। মুসলিম নেতৃত্বের ভয়ংকর অন্তর্দ্বন্দ্বে আজ ক্ষতবিক্ষত বিশ্ব মুসলিম। খেলাফতের ইতিহাস জ্ঞান বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির পাশাপাশি কিছু ব্যতিক্রম বাদে "খলীফা"র নামে গোটা বিশেক রাজবংশের পরস্পরের সাথে ক্রমাগত রক্তাক্ত যুদ্ধ বিদ্রোহ পাল্টা বিদ্রোহ খলীফার গুপ্তহত্যা দুর্নীতি ইত্যাদির ইতিহাস। বস্তুত: প্রায় প্রতিটি ইমামই এই কষ্ট নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন যে, ইসলামের নামে যা চলেছে তা ইসলাম নয়। ইমাম গাজ্জালীর চিঠি থেকে সেটা দেখিয়েছেন মওলানা মওদুদি:- “বাদশাহদের প্রায় সব জমিজমা ও প্রাসাদ (রিয়েল এস্টেট) অবৈধভাবে অর্জিত। কাহারো উচিত নহে এসব সুলতানকে মুখ দেখানো বা তাহাদের মুখ দেখা। তাহাদের অত্যাচারের জন্য তাহাদিগকে ঘৃণা করা উচিত, তাহাদের অস্তিত্বকেই নিন্দা করা উচিত, তাহাদের প্রশংসা করা উচিত নহে...তাহাদের রাজপ্রাসাদ ও সাজ-পোশাককে নোংরা ও অনৈসলামিক ঘোষণা করা উচিত”... তিনি সকল মন্ত্রীদিগকে চিঠিতে লেখেন যে,- “স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করিয়াছে। আমি এইস্থান ত্যাগ করিয়া যাইতেছি যাহাতে স্বৈরতন্ত্রের এই নিষ্ঠূর ও নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড আমাকে দেখিতে না হয়” - এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেণ্ট ইন্ ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬২-৬৩)।

আচ্ছা, ধরে নিলাম আমরা জনগণ আলেমদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতা দিলাম, তারপর? রাষ্ট্রনেতা নির্বাচনে তাঁরা তো দেশকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে ফেলে দেবেন !  কারণ ওই পরষ্পরবিরোধী আলেমদের প্রত্যেকের অসংখ্য সমর্থক আছে। আমি জুজুর ভয় দেখাচ্ছি না মুসলিম ইতিহাসে এর অজস্র উদাহরণ আছে।  কাবা শরীফ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ইমাম, এমনকি বড়পীর জিলানী (র) পর্যন্ত এই ফিতনার হাত থেকে রেহাই পাননি। এই যুগশ্রেষ্ঠ দরবেশের বিরুদ্ধে ইমাম হৌজের নেতৃত্বে এক হাজার ইমাম “কাফের” ফতোয়ায় সাক্ষর করেছিল। টঙ্গীতে তবলিগী দুই দলের ভয়ানক সংঘর্ষ এই বিপর্যয়ের ইঙ্গিত মাত্র (হাজার হাজার তবলীগির মারামারির ময়দানে একই দাঁড়ি টুপি একই পোশাকে উনারা শত্রু-মিত্র চিনলেন কী করে সেটা একটা রহস্য বটে!)। আলেমদের কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে বাকি আলেমদের কী অবস্থা করবেন তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয়না। কারণ তাদের একের মতে অন্য আলেম ও তাদের অনুসারীরা হয় পথভ্রষ্ট অথবা ইসলাম ত্যাগকারী মুরতাদ।

‘খাঁটি মুসলিম’ কে তাহলে? আপনি, নাকি আমি ? ওরা, নাকি তারা? এ প্রশ্নের জবাব আছে দেশের সর্বোচ্চ ১০ জন আলেমদের ভাষ্যে। ১৯৫৩ সালে মওলানা মউদুদীর লেখা ‘দি কাদিয়ানী প্রবলেম’ পুস্তিকাটি মুসলিমদেরকে আহমদী মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দিলে লাহোরে তিনদিনে প্রায় পনেরো হাজার নিরীহ আহমদী খুন ও বহু হাজার আহত হন। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়, হাজারো বিধবা ও এতিমের আর্তনাদ হাহাকারে কেঁপে ওঠে দেশ। এতে মউদুদীর ফাঁসির সাজা হয়, পরে সৌদির হস্তক্ষেপে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সবশেষে তিনি ছাড়া পান।

মউদুদীর দাবি ছিল আহমদী মুসলিমদেরকে সাংবিধানিকভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করা হোক। সরকার দেখল, ‘কে মুসলিম’ সেটা সংজ্ঞায়িত না করলে তো আর ‘কে অমুসলিম’ তা নির্ধারণ করা যাচ্ছেনা। তখন সরকার “কে মুসলিম” সেটা ঠিক করার জন্য প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুনির আহমেদের নেতৃত্বে “মুনির কমিশন” গঠন করে। তাঁরা মওলানা মওদুদি সহ দেশের সর্বোচ্চ ১০ জন মওলানার সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে ১০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে প্রকাশ করেছিলেন ‘মুনির কমিশন রিপোর্ট’। বাংলাদেশে যে যা-ই বলুক এই সর্বোচ্চ মওলানারাই জাতির ইসলামী মানস গড়েছিলেন, তাদের মতামতকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। এই মওলানা/আলেমরা হলেন:-

১. মওলানা আবুল আ’লা মউদুদী, আমির, জামায়াতে ইসলামী,

২. মওলানা আহমদ আলী, প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ ইসলাম, মাগরিবী পাকিস্তান,

৩. মওলানা আবুল হাসনাৎ মুহাম্মদ আহমদ কাদরী – প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান

৪. মওলানা গাজী সিরাজুদ্দীন মুনীর

৫. মুফতি মুহাম্মদ ইদ্রিস, জামিয়া আশরাফিয়া, নীলা গামবাদ, লাহোর

৬. হাফিজ কিফায়াত হোসেন, ইদারা-ই হাকুক-ই তাহাফফুজ-ই শিয়া

৭. মওলানা আবদুল হামিদ বাদায়ুনী, কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট, জমিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান

৮. মওলানা মুহম্মদ আলী কান্দালভি, দারুস সাহাবীয়া, শিয়ালকোট

৯. মওলানা আমিন আহসান ইসলাহী

১০. সদর আঞ্জুমান আহমদিয়া’র রাবওয়াহ মওলানার লিখিত বক্তব্য।

অনেকে জেনে অবাক হবেন, মুনির কমিশন তাদের সিদ্ধান্তে লিখেছেন যে এই আলেমরা “কে মুসলিম” এটাকে এতই ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যে কারো সাথে কারো ১০০ শতাংশ মেলেনা।

মুনির কমিশন রিপোর্ট থেকে আলেমদের জবাবগুলো নীচে দেয়া হল, গবেষণায় আগ্রহীদের কাজে লাগতে পারে। আমি আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরছি মাত্র, এর কিছুই আমার নিজস্ব বক্তব্য নয়।

মওলানা আবুল আ’লা মউদুদী, আমির, জামায়াতে ইসলামী:

 ১. (ক) প্রশ্ন: কে মুসলিম ?

জবাব: সে মুসলিম যদি সে বিশ্বাস করে তৌহিদে, সকল নবীকে, আল্লাহ’র নাজিলকৃত সকল কেতাবে, ফেরেশতাকে ও কেয়ামতে।

(খ) প্রশ্ন: উপরোক্ত বিষয়গুলিতে বিশ্বাস প্রকাশ করাই কি মুসলিম হিসাবে দাবি করিবার এবং ইসলামে রাষ্ট্রে মুসলিম হিসাবে গণ্য করিবার জন্য যথেষ্ট?

জবাব: হ্যাঁ।

(গ) প্রশ্ন:- কেহ উপরোক্ত বিষয়গুলিতে বিশ্বাসের দাবি করিলে অন্য কাহারো কী তাহার বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার আছে?

জবাব: উপরে আমি যে পাঁচটি শর্ত উল্লেখ করিয়াছি তাহাই হইল ভিত্তি। ঐগুলির মধ্যে কেহ কোন পরিবর্তন করিলে সে ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যায়।

মওলানা আহমদ আলী, প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ ইসলাম, মাগরিবী পাকিস্তান

প্রশ্ন: কে মুসলিম ?

জবাব: সে মুসলিম যদি সে কোরান ও রসূল যাহা বলিয়াছেন তাহা বিশ্বাস করে। যে উপরোক্ত দুইটি বিষয় বিশ্বাস করে সে মুসলিম হইবার অধিকার রাখে। ইহার অধিক কিছু তাহার বিশ্বাস অথবা করিবার প্রয়োজন নাই।

মওলানা আবুল হাসনাৎ মুহাম্মদ আহমদ কাদরী – প্রেসিডেন্ট, জামিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান (১৯৪৮):

প্রশ্ন: কে মুসলিম ?

জবাব:

(ক) তাহাকে অবশ্যই আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাস করিতে হইবে।

(খ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স) ও তাঁহার পূর্ববর্তী সকল নবীদিগকে বিশ্বাস করিতে হইবে।

(গ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স)-কে শেষ নবী হিসাবে বিশ্বাস করিতে হইবে।

(ঘ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স)-এর উপর নাজিলকৃত কোরানে বিশ্বাস করিতে হইবে।

(ঙ) তাহাকে অবশ্যই ইসলামের রসূল (স)-এর বিধি-নিষেধগুলিকে অবশ্য পালনীয় হিসাবে বিশ্বাস করিতে হইবে।

(চ) তাহাকে অবশ্যই কেয়ামতে বিশ্বাস করিতে হইবে।

প্রশ্ন: যে নামাজ পড়েনা সে কি মুসলিম?

জবাব: হ্যাঁ, কিন্তু যে নামাজকে অস্বীকার করে সে মুসলিম নহে।

মওলানা গাজী সিরাজুদ্দীন মুনীর:

আমি তাহাকে মুসলিম মনে করি যে কলেমাতে তাহার বিশ্বাস প্রকাশ করে – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’, এবং রসূলের উদাহরণ অনুযায়ী জীবন যাপন করে।

মুফতি মুহাম্মদ ইদ্রিস, জামিয়া আশরাফিয়া, নীলা গামবাদ, লাহোর:

ফার্সি শব্দ ‘মুসলমান’ দিয়া যে ‘মুসলিম’ বোঝানো হয় তাহা ও ‘মুমিন’-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। ‘মুমিন’ শব্দের পরিপূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে, মুমিন কে তাহা বুঝাইতে আমাকে পাতার পর পাতা লিখিতে হইবে। কেহ আল্লাহ’র আনুগত্য প্রকাশ করিলে সে মুসলিম হয়। তাহার উচিত বিশ্বাস করা তৌহিদে, নবীগণের নবীত্বে ও বিচার দিনে। কেহ আজান বা কুরবানীতে বিশ্বাস না করিলে সে ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যায়। একইভাবে, ‘তাওয়াতির’-এর মাধ্যমে অন্যান্য বহু কিছু আমাদের রসূল হইতে পাওয়া গিয়াছে। মুসলিম হইতে গেলে তাহাকে এগুলিও বিশ্বাস করিতেই হইবে। এগুলির তালিকা দেওয়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

হাফিজ কিফায়াত হোসেন, ইদারা-ই হাকুক-ই তাহাফফুজ-ই শিয়া:

সেই ব্যক্তি মুসলমান বলিবার যোগ্য যে বিশ্বাস করে তৌহিদে, নবুয়তে ও কেয়ামতে। এই তিনটিই মূল ভিত্তি যাহা মুসলমান হইবার জন্য মান্য করিতেই হইবে। এই বিষয়ে শিয়া ও সুন্নির মধ্যে কোনোই তফাৎ নাই। এই তিনটি বিধানে বিশ্বাস করা ব্যতীত মুসলমান বলিয়া গণ্য করিতে হইলে ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ নামে অন্যান্য বিষয় রহিয়াছে যাহা মানিতেই হইবে। এইগুলি সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করিতে হইলে আমার দুই দিন লাগিবে। উদাহরণ হিসাবে বলিতে পারি ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’-এর অন্তর্ভুক্ত পবিত্র গ্রন্থের প্রতি সম্মান, ওয়াজুব-ই নামাজ, ওয়াজুব-ই রোজা, শরীয়ত মোতাবেক ওয়াজুব-ই হজ্ব এবং অন্যান্য অসংখ্য বিষয়।

মওলানা আবদুল হামিদ বাদায়ুনী, কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট, জমিয়াতুল উলামা-এ পাকিস্তান (১৯৭০):

(ক) যে ব্যক্তি ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’-এ বিশ্বাস করে সে-ই মোমিন এবং প্রত্যেক মোমিনের অধিকার আছে মুসলমান হিসাবে গণ্য হইবার।

(খ) প্রশ্ন: ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ কি ?

জবাব: যে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভে এবং আমাদের রসূলের (স) রিসালতে বিশ্বাস করে সে ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ পুরন করে।

(গ) প্রশ্ন: মুসলিম বা অমুসলিম হইবার জন্য আরকান (পাঁচটি স্তম্ভ) ব্যতীত অন্য কিছু আছে কি?

জবাব: অবশ্যই আছে।

(ঘ) প্রশ্ন: তাহা হইলে, কেহ যদি আরকান ও আমাদের রসূলের (স) রিসালতে বিশ্বাস করে কিন্তু অন্যের জিনিস চুরি করে, অন্যের সম্পত্তি খেয়ানত করে, প্রতিবেশির স্ত্রীর দিকে কুদৃষ্টি দেয় এবং উপকারীর প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতার অপরাধ করে তবে তাহাকে কি আপনি মুসলিম বলিবেন না?

জবাব: এইগুলি সত্বেও সে মুসলিম, যদি সে উপরোক্ত বিশ্বাসগুলিতে বিশ্বাসী হয়।

মওলানা মুহম্মদ আলী কান্দালভি, দারুস সাহাবীয়া, শিয়ালকোট।

কেহ রসূল (স)-এর নির্দেশ মানিয়া সবগুলি ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ পালন করে সে-ই মুসলমান।

প্রশ্ন: ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’এর সংজ্ঞা কি ?

জবাব:- ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ সেইসব দরকারী বিষয় যাহা ধর্মীয় জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক সকল মুসলমানের জানা আছে।

প্রশ্ন:- ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ এর সংখ্যা কত?

জবাব: উহা এতো বেশী যে উল্লেখ করা অসম্ভব। আমি নিজেই সেগুলি গণনা করিতে পারিব না। সালাত, সাওম এইগুলিকে ‘জুরুরীয়াত-এ দ্বীন’ হিসাবে উল্লেখ করা যাইতে পারে।

মওলানা আমিন আহসান ইসলাহী:

দুই প্রকার মুসলমান আছে – রাজনৈতিক (সিয়াসি) ও প্রকৃত (রিয়্যাল, হাকিকী)। রাজনৈতিক মুসলমান হইতে হইলে তাহাকে অবশ্যই (ক) বিশ্বাস করিতে হইবে আল্লাহ’র একত্বে, (খ) বিশ্বাস করিতে হইবে রসূল (স) শেষ নবী অর্থাৎ জীবনের সর্ববিষয়ে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক (ফাইনাল অথরিটি), (গ) বিশ্বাস করিতে হইবে সকল মঙ্গল ও অমঙ্গল আল্লাহ হইতে আসে, (ঘ) বিশ্বাস করিতে হইবে কেয়ামতে, (ঙ) বিশ্বাস করিতে হইবে কোরান আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত শেষ কিতাব, (চ) মক্কায় হজ্ব করিতে হইবে, (ছ) জাকাত দিতে হইবে, (জ) মুসলমানের মত নামাজ পড়িতে হইবে, (ঝ) ইসলামী সমাজের সকল বাহ্যিক রীতিনীতি মানিয়া চলিতে হইবে, এবং (ঞ) সাওম রাখিবে। এই সকল শর্ত মানিলে সে ইসলামী রাষ্ট্রের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের অধিকারী হইবে। এই দশটি শর্ত শুধুমাত্র প্রকাশ করাই মুসলমান হইবার জন্য যথেষ্ঠ, কেহ জীবনে তাহা পালন করুক বা না করুক। কেহ প্রকৃত মুসলমান হইতে হইলে তাহাকে আল্লাহ ও তাহার রসূলের (স) সকল হুকুম যেইভাবে দেয়া হইয়াছে সেইভাবে পালন করিতে হইবে।

প্রশ্ন: আপনার মতে শুধুমাত্র ‘মর্দ-ই সালেহ’-ই মুসলমান?

জবাব: হ্যাঁ।

প্রশ্ন: তাহা হইলে আপনার মতে রাজনৈতিক (সিয়াসি) মুসলমানের জন্য বিশ্বাস করাই যথেষ্ঠ, কিন্তু প্রকৃত (রিয়্যাল, হাকিকী) মুসলমানের ক্ষেত্রে শুধু বিশ্বাসই নহে পালন করাও জরুরী?

জবাব: না, আপনি ঠিকমত বুঝেন নাই। সিয়াসি মুসলমানের জন্যও পালন করা জরুরী, আমি বলিতে চাই কেহ যদি মুসলমান হইবার শর্তগুলি বাস্তবে পালন না করে, সে সিয়াসি মুসলমানের বহির্ভূত নহে।

প্রশ্ন: কোনও রাজনৈতিক (সিয়াসি) মুসলমান যদি আপনার বর্ণিত প্রযোজনীয় শর্তগুলিতে বিশ্বাস না করে, তাহাকে কি আপনি বেদ্বীন বলিবেন?

জবাব: না, আমি তাহাকে শুধু বে-আমল বলিব।

সদর আঞ্জুমান আহমদিয়া’র রাবওয়াহ মওলানার লিখিত বক্তব্য- "যে রসূল (স)-এর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত এবং কলেমা তৈয়ব-এর ওপর তাহার বিশ্বাস প্রকাশ করে সে-ই মুসলমান"।

অথচ ইসলাম কি, মুসলিম কে এর জবাব কোরান-রসূলই (স) দিয়ে গেছেন। কোরাণ সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে – “হে ঈমানদারগন!.......যে তোমাদেরকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলমান নও” - সূরা নিসা ৯৪। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কি সুন্দর কি কার্যকর নির্দেশ, যেটা আমাদের হজরত শাহ্ জালাল শাহ্ মখদুমের (র) দল পদে পদে মেনে চলেছেন। বাংলার হাজার বছরে কোথাও একটা উদাহরণ নেই তাঁরা কাউকে কাফের বলেছেন।

"ইসলাম কি" এই সোজা সাপ্টা স্পষ্ট প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব বলে গেছেন স্বয়ং পয়গম্বর (সাঃ) নিজে, বিখ্যাত জিব্রাইলের হাদিসে - "(উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত) - “একদিন হজরত জিব্রাইল মানুষের বেশে নবীজীর কাছে আসিলেন এবং বলিলেন, হে নবী। ইসলাম কাহাকে বলে ?” তিনি বলিলেন, “ইসলাম হইল, তুমি আল্লাহ্’র ইবাদত করিবে এবং কাহাকেও শরিক করিবে না, নামাজ প্রতিষ্ঠা করিবে, জাকাতকে ফরজ হিসাবে পালন করিবে”- মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মুহসিন খানের অনুদিত সহি বুখারি ও মুসলিম, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৭৩৩, নোট ১, এবং মিশকাতুল মাসাবিহ্ ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩-২৫, নং ২(১)-এর সূত্রে বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৯৮)। একই প্রমাণ দেখুন হাদিস কুদসি থেকে, আন্ নাবাবীর ফর্টি হাদিস নং ২।

কে মুসলিম এ প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে গেছেন তিনি - "যে ব্যক্তি আমাদের নামাজের মতো নামাজ আদায় করিবে, আমাদের কিবলাহকে কিবলাহ মানিবে এবং আমাদের জবাইকৃত পশুর গোশত আহার করিবে সেই মুসলিম" - সহি হাদিস। তিনি এও বলেছেন - “যাহারা নিজদিগকে মুসলমান বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে তাহাদের তালিকা বানাও”- মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মুহসিন খানের অনুদিত সহি বুখারি ৪র্থ খণ্ড, হাদিস ২৯৩ ও ২৯৪। সাহাবীরা তা বানিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই দু’একজন হলেও মুনাফেক ছিল যারা ইসলাম-বিরোধীতা করার জন্যই প্রকাশ্যে মুসলমানিত্ব ঘোষণা করতো। নবীজী (স) সেটা জানতেন না তা হতেই পারে না। কিন্তু তিনি কোনো প্রশ্ন না করে তালিকার প্রত্যেকের মুসলমানিত্ব গ্রহণ করেছিলেন, কাউকেই বলেননি তার দাবী মিথ্যা, সে মুসলমান নয়। মানবচরিত্র তাঁর জানা ছিল, তিনি জানতেন কেউ নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করার পরেও  তিনি যদি কারো মুসলমানিত্ব অস্বীকার করেন তবে তার সুযোগ নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত নষ্ট মুসলিমরা অন্য মুসলমানদের অমুসলিম বলবে, কাফের-মুরতাদ বলবে, খুন জখম করবে। তাঁর সেই দিব্যদৃষ্টি ব্যর্থ করে আমরা পরস্পরকে ‘কাফের’ বলেছি। ইমাম হানিফা, শাফি, মালিক সহ আমাদের অতীত ইমাম, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকে ঐ আঘাতের শিকার হয়েছেন। কাজেই কে মুসলিম কে নয় সেই গুরুভার বিচার করার মালিক আছেন মাথার ওপরে, ভ্রান্তিময় মানুষ সে অধিকার রাখেনা।

বেহেশতে যেতে চান? সেটারও সুস্পষ্ট সহজ পথ বলে গেছেন তিনি। লম্বা হাদিস, মাঝখান থেকে তুলে দিচ্ছি :- "আবদুল্লা কায়েস নামক গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল ... আরজ করিল- 'ইয়া রসুলুল্লাহ্ ! ... আপনি আমাদিগকে কয়েকটি স্পষ্ট উপদেশ ও আদেশ নিষেধ বলিয়া দিন যাহা অনুসরণ করিয়া আমরা সকলে বেহেশত লাভের উপযুক্ত হইতে পারি। ... রসুলুল্লাহ্ (দঃ) প্রথমতঃ তাহাদিগকে চারিটি কর্তব্যের আদেশ করিলেন। (১) ... কায়মনোবাক্যে এই অঙ্গীকার ও স্বীকারোক্তি করা যে একমাত্র আল্লাহ্ই মা’বুদ, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মা’বুদ নাই এবং মোহাম্মদ (দঃ) আল্লাহ্’র রসুল। (২) নামাজ উত্তমরূপে আদায় করা, (৩) জাকাত দান করা, (৪) রমজান মাসে রোজা রাখা এবং গণিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ দেওয়া। রসুলুল্লাহ্ (দঃ) তাহাদিগকে চারিটি বস্তু (পাত্র) ব্যবহার করিতে নিষেধ করিলেন। রসুলুল্লাহ্ (দঃ) তাহাদিগকে ইহাও বলিলেন, এই সব আদেশ নিষেধকে তোমরা ভালরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইবে এবং দেশে গিয়া সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে” - আবদুল করিম খান সম্পাদিত হাফেজ আবদুল জলিলের বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ৩৯ হাদিস নম্বর ১২।

এই হলো ইসলাম, এর মধ্যে না আছে ফতোয়া, না আছে শারিয়া-আইন বা রাষ্ট্র। এরই সমর্থন আমরা দেখতে পাই কোরাণে, নবীজীর জীবনীতে, আমাদের ইমামদের মধ্যে আর ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে। নবীজী কেন বলেছিলেন যারা অনুপস্থিত তাদের “সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে?”  কারণ, ওটাই হল ইসলাম। এ-নির্দেশ চিরকালের মুসলিমের জন্যও, আমাদের জন্যও। সমাজ চালানোর জন্য তাঁকে যে-সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেগুলোকে কিন্তু তিনি কখনোই বলেননি “সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে।” এভাবেই তিনি এ-সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যে, কোন একসময়ের কোন এক সমাজের শাসন-ব্যবস্থার অনেক আইনকানুনই সর্বকালের সমাজে খাটেনা।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করোনা, এই করে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে (মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও বিদায় হজের বাণী)।

************************************************

ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (৩): আবারও জঙ্গি?

১২ নভেম্বর, ২০১৯

বিডিনিউজ, ৬ নভেম্বর ২০১৯- দেশে এখনো আরো ৬টি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। অর্থাৎ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আপনার মন মগজ যতই ভরা থাকুক যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় আপনার ওপর আরেকটা হলি আর্টিজান ঘটে যেতে পারে। যদি ওই জঙ্গিদেরকে দেখানো যেত রসূলের (স) বলে যাওয়া ইসলাম কি, “ইসলামী রাষ্ট্র-এর তত্ব ও বাস্তবে কত ফাঁক রয়েছে তবে হয়ত তাদের অনেকেই ফিরে আসত। সরকারকেও বুঝতে হবে শুধু আইন আর বন্দুক দিয়ে ধর্মীয় হিংস্রতা উচ্ছেদ করা যাবে না, ওই ধর্ম থেকেই শান্তির ব্যাখ্যা তুলে আনতে হবে যা করেছেন অতীত বর্তমানের অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ। এখন দরকার তাদের সেই ইসলামী ব্যাখ্যা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।

জঙ্গীরা কিন্তু বসে নেই। বিভিন্ন ঘটনার ঢক্কানিনাদে অনেকেরই চোখে পড়েনি সংবাদপত্রে, বিশেষ করে বিডিনিউজ২৪কম-এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গত ২ বছরে কয়েক ডজন জঙ্গী গ্রেপ্তার - ২০২১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারী, ২০ জানুয়ারি, ২৫শে জানুয়ারী, ২১ ফেব্রুয়ারী, ০৫ এপ্রিল ও ১৭ ডিসেম্বর। ওরা নাহয় ধরা পড়েছে, যারা ধরা পড়েনি তাদের সংখ্যা কত হতে পারে? ভয়াবহ ব্যাপার, চিন্তা করলে আতংকিত হতে হয়। দেশে সবাই অরক্ষিত, যে কোনো দিন যে কোনো জায়গায় হলি আর্টিসনের মতো, রমনা বটমূলে বর্ষবরণ বা যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হত্যাযজ্ঞের মতো নিরীহের রক্তস্রোত বয়ে যেতে পারে। মানুষ খুন করে জঙ্গিরা যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় সেটার তত্বে কি কি সমস্যা আছে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা আছে?

নেতৃত্ব নিয়ে আলেমদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনার তো আছেই। তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা আছে কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের নেই এবং সংজ্ঞা না থাকলে আলোচনায় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সৌদি আরব পাকিস্তান ইরানসহ যেসব দেশের সংবিধানে আছে রাষ্ট্র চলবে শারিয়া মোতাবেক, সেগুলো কি “ইসলামী রাষ্ট্র”? অনেক আলেম বলেন ‘হ্যাঁ’, অনেকে বলেন ‘না’। সিরিয়া ইরাকের ইসলামিক স্টেট সুবিশাল এলাকা দখল করে “শাসন” করছে, সারা বিশ্ব থেকে সেখানে হাজারো মুসলিম ছুটে গেছে “খলীফা”র হাতে বায়াত করে “জিহাদ” করতে অথচ বহু আলেম দাবি করছেন ওটা ইসলামী রাষ্ট্রই নয়। ড. জাকির নায়েক তো ঘোষণাই করেছেন আসলে ওটা “অ্যান্টি ইসলামিক স্টেট” অর্থাৎ “ইসলাম-বিরোধী রাষ্ট্র”। অর্থাৎ আমাদের অবস্থা হল, বাচ্চাটার কি অসুখ হয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন ডাক্তার বিভিন্ন রোগের কথা বলছেন। আমরা তাহলে করবটা কি ?  রোগীকে কি ওষুধ খাওয়াব ? কবিগুরু বলেছেন - “একভাবে যাহা ‘না’ আরেকভাবে তাহা যদি ‘হাঁ’ হয় তবে সেই ছিদ্র দিয়া সমস্ত জগৎ যে গলিয়া ফুরাইয়া যাইবে”– কবিগুরুর “চতুরঙ্গ”।  ইসলাম নিয়ে এই “হ্যাঁ-না”-এর শুভংকরে আমাদের সমস্ত শক্তি “গলিয়া ফুরাইয়া” গেছে, বাকী আছে প্রধানত: বাগাড়ম্বর আর পরস্পরের বিরুদ্ধে হুংকার গালাগালি। এর অবসান দরকার এবং কাজটা আলেমদেরই।

অতঃপরম? কোরান-রসূল (স) থেকেই ওপরে দেখানো হয়েছে ইসলাম কি, মুসলিম কে এবং কিভাবে বেহেশতে যাওয়া যাবে। এগুলো যদি আমাদের জাতি জানতো ! কতভাবে কত জায়গায় কি মারাত্মকভাবে আমরা কোরান ও রসূলকে (স) লঙ্ঘন করেছি আমরা কি তা জানি? এমন আত্মঘাতী দাবিও করা হয়েছে- “প্রতিটি আয়াত যাহা আমাদের আলেমদের সিদ্ধান্তের (রুলিং) বিরুদ্ধে যায়, বলিতে হইবে ‘পবিত্র কোরানের এই আয়াতটি বাতিল হইয়া গিয়াছে’” – দাবি করেছেন ১০ম শতাব্দী ইরাকের গ্র্যান্ড মুফতি আবুল হাসান আল খারকি- “দি ট্র্যাজেডি অফ ইসলাম”- বিখ্যাত ইমাম মুহাম্মদ তৌহিদী পৃষ্ঠা ৯৪। তিনি ওই দাবীর নিন্দা করেছেন। 

                                 

এই একই দাবির উল্লেখ আছে (১) শারিয়া আইনের ওপরে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট বই ড. হাশিম কামালী’র “ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স” পৃষ্ঠা ২০৩: -  

                                  

এবং (২) বিশাল ভারতবর্ষে ইসলামী কেতাবের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশক দিল্লীর “কিতাব ভবন”-এর বই “দি ডকট্রিন অফ ইজমা” পৃষ্ঠা ১৬-তেও ওই দাবীর নিন্দা করা হয়েছে:-

                                                

কি আশ্চর্য্য! মানুষের সিদ্ধান্ত আল্লাহ’র কালামকে বাতিল করে দেবে? মওলানাদের ঐক্যমত কোরানের আয়াত ও রসূলের (স) সুন্নত বাতিল করার ক্ষমতা রাখে?

এই হল সেই “সীমা লঙ্ঘন” করা যার বিরুদ্ধে কোরান বারবার তর্জনী তুলেছে।

জঙ্গিদের অনেকেই হয়তো জঙ্গি হতো না যদি তারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধী আলেম ও মুসলিম বিশেষজ্ঞদের বইগুলো পড়ত, তাদের যুক্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করত আর “ইসলামী রাষ্ট্র”-গুলোতে মানুষের অশ্রু ও রক্তস্রোত খেয়াল করত। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এ বইগুলোর অনুবাদ ছড়িয়ে দেয়া। কয়েকটা বই:-

  • The Illusion of an Islamic State -আলেম উলামা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন “নাহদালতুল উলামা”- ২০১৩ সালে এর সদস্য ছিল প্রায় ৪ কোটি)।
  • TOWARD our Reformation – From LEGALISM to VALUE ORIENTED ISLAMIC LAW and JURISPRUDENCE – Dr. Mohammad Omar Farooq.
  • The Challenge of Fundamentalism – Bassam Tibi.
  • Toward an Islamic Reformation – Abdullan An-Naim.
  • Believing Women in Islam – Asma Barlas.
  • The Forgotten Queens of Islam – Fatima Mernissi.

এগুলোর সার সংক্ষেপ সংকলন করা আছে “শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি” বইতে। বইটা ইন্টারনেটে ফ্রি পাওয়া যায়। 

ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থনে যুক্তিগুলো আছে মওলানা মওদুদী, সৈয়দ কুতুব, আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও পাকিস্তান/বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বইগুলোতে। আর আছে শারিয়া কিতাবগুলোর মুখবন্ধে। এগুলোর সাথে ওপরের বইগুলো মিলিয়ে পড়লেই ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম স্পষ্ট হবে, এ নিয়ে পরে আলোচনা করব। বই পড়া সম্ভব না হলে জঙ্গিরা শারিয়া কেতাব খুলে আইনগুলো পড়লেই বুঝবেন কি মরিচীকার পেছনে ছুটছেন তারা। বাবা-মা, দাদা-দাদি, বা নানা-নানিকে খুন করলে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে কিন্তু বাবা মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না- বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড ধারা ৬৫ ক ও খ, শাফি’ই আইন Law #o.1.2.4। কিংবা খুন-জখম চুরি-ডাকাতির মামলায় নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়- হানাফি আইন পৃ. ৩৫৩; শাফি’ই আইন পৃ. ৬৩৮ − Law #o.24.৯, ক্রিমিন্যাল ল’ ইন্ ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড পৃ. ২৫১, মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরাণ পৃ. ২৩৯।

এসব আইন দিয়ে ইসলামেরও বদনাম হয়, দেশও চলে না। মানবসভ্যতা আজ কঠিন সমস্যার অতলগহ্বরে পতিত। কাশ্মীরের পর বাবরি মসজিদের জমিও বেদখল হয়ে গেল। “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী”-র সমাধান আমরা জানি না কিন্তু যাদের জানার তারা জানেন।

“আমার বিশ্বাস, যদি তাহার মতো কেহ যদি বর্তমান বিশ্বের স্বৈরশাসক (ডিক্টেটর) হইতেন তাহা হইলে তিনি সমস্যা সমাধানে এমনভাবে সফল হইতেন যাহাতে এতো প্রয়োজনীয় শান্তি ও সুখ আসিত”। “I believe that if a man like him were to assume the dictatorship of the modern world he would succeed in solving its problems in a way that would bring it the much-needed peace and happiness”- বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক জর্জ বার্নার্ড শ’।

কথাটা তিনি রসূলকে (স) পয়গম্বর হিসেবে নয়, একজন সফল শাসক হিসেবে বলেছেন। সামাজিক স্থিতি প্রতিষ্ঠায় সখ্য ও সংঘাত, যুদ্ধ ও শান্তিচুক্তি, কঠিন শাস্তি ও নিঃশর্ত ক্ষমা, এই বিপ্রতীপ শক্তিগুলোকে এতো সূক্ষ্ম ভারসাম্যে এমন প্রাজ্ঞ ও সফল প্রয়োগ আর কোনো নেতা করেছেন কিনা আমি জানি না। সেজন্যই ১৪০০ বছরের দূরত্ব থেকে তিনি আজও উদ্যত তর্জনী হেলনে পুরো বিশ্ব-মানবসমাজকে প্রচণ্ড শক্তিতে সবার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করে চলেছেন। সেজন্যই তিনি মানুষের ইতিহাসে “সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী মানুষ”- “দি হান্ড্রেড”, মাইকেল হার্ট।

জঙ্গিরা কবে তাঁর দেয়া ইসলাম উপলব্ধি করবে?

*******************************************

হাদিসের হদিস – “ফেস দি পিপল” টিভিতে "মহা-বিতর্ক" 

ক্যানাডার মন্ট্রিয়ল শহরের জনপ্রিয় বাংলা টিভি চ্যানেল "ফেস দি পিপল, রোড টু ডেমোক্র্যাসি টিভি"  গত ০৮ই মে ২০২১ তারিখে "কোরআনের সরল পথ ও হাদিস মানার বাধ্যবাধকতা" বিতর্ক অনুষ্ঠান উপহার দেন। এতে মসৃণ সঞ্চালনা করেছেন চ্যানেলের পরিচালক সাইফুর রহমান সাগর, আলোচক ছিলেন দেশের তরুণ আলেম আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক এবং আলোচক ও ইসলামী গবেষক জনাব সজল রোশানI ইসলামের ভিন্ন ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী দুই গবেষক এতদিন নিজস্ব বলয়ে লেখালেখি করে বক্তব্য দিয়ে আমাদেরকে প্রভাবিত করেছেন। এ অনুষ্ঠান তাঁদেরকে একসাথে জনতার সামনে এনে ভিন্নমতের প্রতি উগ্রতা ও গালিগালাজের অসভ্য স্রোতের বিপরীতে বলিষ্ঠভাবে গবেষণা ও মননের শালীন সংঘাতের দ্বার উন্মুক্ত করেছে যা কিনা সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এমন বিতর্ক কিছু আছে কিন্তু বৃহত্তর অঙ্গনে সম্ভবত: এই প্রথম। মোটাদাগে বলা যায় জনাব আব্দুল্লাহ ইসলামের রক্ষণশীল ব্যাখ্যায় এবং জনাব সজল ইসলামের প্রগতিশীল ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী। রক্ষণশীল মুসলিমেরা বিশ্বাস করেন সংগীত, ভাস্কর্য্য, নারী-নেত্রীত্ব ইত্যাদি হারাম, গণতন্ত্র কুফরী আকিদা, দাঁড়ি রাখা ওয়াজিব ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ওসব বিষয়ে প্রগতিশীল মুসলিমদের বিশ্বাস ভিন্ন বা বিপরীত। দুপক্ষেই আছে অজস্র স্কলার ও দলিল।

অনুষ্ঠানে আমরা দেখলাম কোরান নিজেকে “সুস্পষ্ট, বিস্তারিত ও সম্পূর্ণ” (সুরা আল-কাহফ ৫৪, যুখরুফ ২, ইউসুফ ১, শুআরা ২, কাসাস ২, দুখান ২, ৫৮ ইত্যাদি) বলেছে এটা যেমন সত্যি, হাদিস ছাড়া আমরা চলতে পারব না এটাও তেমনি সত্যি। এই আপাত-বিরোধের একটা সমন্বয় নিশ্চয়ই আছে এবং সেটা  আলেমদেরই কাজ। তবে হাদিস বিশ্বমানবের এক অমূল্য সম্পদ, এর মতো মৌলিক গ্রন্থ আর কোনো ধর্মে নেই। এতে মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক, সামরিক, ষড়যন্ত্র এমনকি পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহ (ফিৎনা) ইত্যাদির ইতিহাস ধরা আছে। হাদিস ত্যাগ করলে আমরা অনেক কিছু হারাব এবং এক ভয়াবহ শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সম্ভবত: সেজন্যই জনাব সজল সামগ্রিকভাবে হাদিস অস্বীকার করেন নি, কিছু আপত্তি তুলেছেন যা চিরকাল অগুনতি ইসলামী বিশেষজ্ঞেরা তুলেছেন।

ইমাম শাফি' ইরাক থেকে মিসরে গিয়ে তাঁর ইরাকি ফিকাহ আপডেট করে মিসরি ফিকহ (মাজহাবে জাদীদ) প্রবর্তন করেন। একথা কেন? কারণ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অজান্তে আমাদের ধর্মবিশ্বাসটাই "আমি" হয়ে ওঠে। আমরা শৈশবে, তারুণ্যে, যৌবনে, প্রৌঢ়ত্বে ও বার্ধক্যে ক্রমাগত আমাদের বহু বিশ্বাস আপডেট করি কিন্তু ধর্মবিশ্বাস আপডেট করার ক্ষেত্রে তা "আমি"র ওপরে আক্রমণ মনে হয়, আমরা প্রাণপনে সেটা প্রতিরোধ করি। অথচ সৎ ভিন্নমতের নিরিখে ধর্মবিশ্বাসকে আরো পরিশুদ্ধ করার সুযোগ আছে।    

সহি সিত্তায় (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী) তে অসংখ্য আধ্যাত্মিক, ঈমান-আকিদা বিষয়ক, ইবাদত ও নৈতিকতা আছে। তবে বিশেষ কিছু হাদিসের ব্যাপারে অনেক মুসলিম চিরকাল প্রচণ্ড আপত্তি করেছেন, সেগুলোর ওপরে আলোচনা হলে অনুষ্ঠান পূর্ণতা পেত। হতে পারে তাঁদের সবগুলো আপত্তি সঠিক নয় কিন্তু এটা হতে পারেনা যে তাঁদের সবগুলো আপত্তিই ভুল। অতীতের মুহাদ্দেসরা বিপুল পরিশ্রম ও একাগ্রতায় অসংখ্য হাদিস সংকলন, অসংখ্য রাবী ও সনদ/মতন যাচাই বাছাই করেছেন। এই সুবিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোথাও কি চুল পরমানও মানবিক বিচ্যুতি হয়েছে? না হয়ে থাকলে কিছু বলার নেই। হয়ে থাকলে তা নিয়ে আলেমরা আলোচনা করলে সমাজের উপকার হবে কারণ অনেক বিভ্রান্তি ও বাদ প্রতিবাদের ওটাই মূল। প্রগতিশীলদের আপত্তির উদাহরণ অজস্র, ৬টি দেখাচ্ছি।

১। বুখারী ৫ম খণ্ড হাদিস ১৮৮ - বানরের পরকীয়া: -  

"আমর বিন মায়মুন বলিয়াছেন - "ইসলাম-পূর্ব অজ্ঞতার সময়ে আমি দেখিলাম কিছু বানর একটি বানরীকে ঘিরিয়া আছে। তাহারা উহাকে পাথর মারিতেছিল কারণ সে অবৈধ যৌনসঙ্গম করিয়াছিল। আমিও তাহাদের সহিত যোগ দিয়ে উহাকে পাথর মারিলাম"।

এখানে ইসলাম কোথায়? বানরীকে পাথর মারার কারণ তিনি কিভাবে জানলেন? বানরের “অবৈধ যৌনসঙ্গম” বলতে আমরা কি বুঝব? এমন কথাবার্তা সহি বুখারীতে কেন?      

২। নবী মুসা (আ) সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রাস্তায় অজস্র লোকের সামনে দৌড়োচ্ছেন, কারণ তারা মনে করতো তাঁর যৌনাঙ্গে হার্নিয়া রোগ আছে তাই মানুষের ভুল ভাঙানোর দরকার হয়েছিল - বুখারী ১ম খণ্ড হাদিস ২৭৭। তুর পাহাড়ে স্বয়ং আল্লাহ যাঁর সাথে কথা (কালাম) বলেছেন সেই মহিমামণ্ডিত মুসা কলিমুল্লাহকে (আ) নিয়ে লোকের একটা গুরুত্বহীন সন্দেহ নিরসন কি এতই দরকার যে তাঁকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মানুষের সামনে দৌড়োতে হবে? নগ্নতা হল অশ্লীলতা, শয়তান অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয় - বাকারা ১৬৯। অশ্লীলতা কি করে ইসলামী হয়?

৩। “বর্ণিত আছে যে বিবি আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন, “ব্যভিচারীকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড (রজম) এবং যুবককে দশ ঢোক স্তন্যপানের আয়াত নাজিল হইয়াছিল। অবশ্যই আমার কুশনের নীচে রাখা একটি কাগজের উপরে ইহা লিখা হইয়াছিল। যখন রসুল (দঃ) শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন আমরা তাঁহার মৃত্যু লইয়া ব্যস্ত ছিলাম, একটি গৃহপালিত ছাগল ঘরে ঢুকিয়া উহা খাইয়া ফেলে”- সহি ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড হাদিস নং ১৯৪৪।

                              

তাহলে সুরা হিজর ৯ - “আমি এই উপদেশগ্রন্থ নাজিল করিয়াছি এবং আমিই উহা সংরক্ষণ করিব”-এর কি হবে? আমি মধ্যপ্রাচ্যে থাকার সময় মসজিদের ইমামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সুদীর্ঘ যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হল "ছাগলটি বেহেশত হইতে আসিয়াছিল"। শুনে আমি চুপ, কিন্তু ধাক্কাটা এখনো বুকে লেগে আছে।   

ওপরে দেখানো "যুবককে দশ ঢোক স্তন্যপান" করালে যুবক মাহরাম হয়ে তাদের বিয়ে হারাম হয়ে যাবে। সহি মুসলিম হাদিস ৩৪২১ ও ৩৪২২-তে বিবি আয়েশা (র) বলেছেন ওই ১০ ঢোক-কে পরে ৫ ঢোক করা হয়েছিল। অন্য আয়াত বাতিলের হাদিসও আছে (রোজা রাখা ও দরিদ্রকে খাওয়ানো এবং বির মাউনা সংক্রান্ত - বুখারী ৩য় খণ্ড ১৭০ ও ৪র্থ খণ্ড ৬৯)। কিন্তু কে কবে কোথায় কেন ও কোন্ অধিকারে আল্লাহর কালাম বাতিল করল জানতে পারিনি। নবীজীর (স) সাথে একান্তে কথা বলতে হলে কিছু সদকা দিতে হবে এ-আয়াতও আল্লাহ নাজিল করে পরে রহিত করেন - মুহিউদ্দিন খানের অনুদিত বাংলা-কোরাণ পৃষ্ঠা ১৩৪৭, কিন্তু সেই রহিত করার আদি দলিল পাইনি, এগুলো কেউ জানালে বাধিত হব।

যাহোক, ২০০৭ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস বিভাগের প্রধান ড. ইজ্জত আতিয়া বলেছিলেন দুনিয়াময় মুসলিম নারীরা বেগানা পুরুষের সাথে চাকরীক্ষেত্রে কখনো একা থাকছে যা হারাম। কাজেই, নারীরা তাদের সহকর্মীদেরকে ৫ ঢোক স্তন্যপান করালে তাদের সাথে একা থাকা হালাল হবে। এটা বলাতে তিনি খুব হেনস্থা হন। আসলে তিনি সহি মুসলিম হাদিস ৩৪২৪ ৩৪২৫, ৩৪২৬, ৩৪২৭ ও ৩৪২৮ এবং সুনান ইবনে মাজাহ হাদিস ১৯৪৩-এর কথাই বলেছিলেন। সংক্ষেপে:-   

সালাহ বিনতে সুহায়েল রসূলকে (স) বলল তাদের মুক্তিপ্রাপ্ত দাস সলিম বাসায় এলে তার স্বামী হুদায়ফা অসন্তুষ্ট হয়। রসূল (স) তাকে বললেন সলিমকে স্তন্যপান করাতে। সে বলল তা কি করে হবে, সলিম তো প্রাপ্তবয়স্ক। তিনি হেসে বললেন সেটা তিনি জানেন। সুহায়েল সলিমকে স্তন্যপান করানোর পর সে বাসায় এলে হুদায়ফা আর অসন্তুষ্ট হতনা। সহি ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড ১৯৪৩: -  

(নবীপত্নী উম্মে সালমা (র) বলেছেন রসূল (স) স্তন্যপান বৈধ করেছিলেন শুধুমাত্র ওই বিশেষ ঘটনার জন্য - সহি মুসলিম হাদিস ৩৪২৯) ।

৪। বুখারীতে আছে রসূল (স) মক্কায় ছিলেন ১৩ বছর - ৫ম খণ্ড ১৯০, ২৪২ ও ২৪৩। কিন্তু আবার ওই বুখারীতেই আছে তিনি মক্কায় ছিলেন ১০ বছর - ৪র্থ খণ্ড ৭৪৭, ৭৪৮, ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫০২ ও ৭ম খণ্ড ৭৮৭। আবার সহি মুসলিমে (হাদিস ৫৮০৫) আছে তিনি মক্কায় ছিলেন ১৫ বছর।

৫। সর্বোচ্চ হাদিস দিয়েছেন আবু হুরায়রা (র), ৫০০০ এর ওপর। তিনি বলেছেন:- "রসূল (স) বলিয়াছেন - যে কিছু জানে কিন্তু জিজ্ঞাসিত হইলে গোপন করে, হাশরের দিনে তাহার ঘাড়ে আগুনের জোয়াল থাকিবে" - সহি আবু দাউদ হাদিস ৩৬৫০। কথাটা বাকারা ৪২-তেও আছে :-  "সত্যকে মিথ্যা দিয়া আড়াল করিওনা এবং জানিয়া শুনিয়া সত্য গোপন করিওনা"। অথচ বুখারী ১ম খণ্ড হাদিস ১২১-এ আবু হুরায়রা (র) বলেছেন:- "রসূলের (স) নিকট হইতে আমি দুই ধরণের জ্ঞান মুখস্থ করিয়াছি। উহার একটি অংশ আমি তোমাদিগকে বলিয়াছি, এবং যদি আমি দ্বিতীয়টি বলি তবে আমার গলার রগ (pharynx) কাটিয়া ফেলা হইবে (killed)"।   

অর্থাৎ তিনি নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য বিশ্ব মুসলিমকে চিরকালের জন্য অজস্র হাদিস থেকে চিরবঞ্চিত করেছেন। 

৬। বুখারী ৭ম খণ্ড হাদিস ২৬৮: -

“আবু হুরায়রা (র) বর্ণনা করিয়াছেন - "রসূল (স) বলিয়াছেন (দান-খয়রাতের ওপর লম্বা হাদিস)……...লোকেরা প্রশ্ন করিল- হে আবু হুরায়রা ! তুমি কি রসূল (স)-এর নিকট ইহা শুনিয়াছ? সে বলিল - 'না। ইহা আমি বলিতেছি"

Volume 7, Book 64, Number 268: Narrated Abu Huraira: -"The Prophet said, 'The best alms is that which is given when one is rich, and a giving hand is better than a taking one, and you should start first to support your dependents.' A wife says, 'You should either provide me with food or divorce me.' A slave says, 'Give me food and enjoy my service." A son says, "Give me food; to whom do you leave me?" The people said, "O Abu Huraira! Did you hear that from Allah's Apostle ?" He said, "No, it is from my own self."   

তাহলে?

ওপরের উদাহরণগুলো সুবিশাল অদৃশ্য মগ্নমৈনাকের দৃশ্যমান চুড়োটুকু মাত্র, এরকম উদাহরণ অজস্র। একারণেই "আহলে কোরান" দল কোরান ছাড়া সব কেতাবকে অস্বীকার করে, তারা ছাড়া বহু মুসলিম চিরকাল কিছু বিশেষ হাদিসের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন, সামগ্রিকভাবে হাদিসের বিরুদ্ধে নয়। তাঁরা হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবীরদের নয়, দলিলের শুদ্ধতার কথা বলেছেন। হাদিস নিয়ে আপত্তি আলোচনা দুটোরই সুযোগও আছে দরকারও আছে। আসলে এমন চেষ্টা হয়েছিলও। বিশ পঁচিশ বছর আগে তুর্কী সরকার সহি সিত্তার "পরিচ্ছন্ন" সংস্করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, রাজনৈতিক ঢক্কানিনাদে ওটা হয়নি। কিন্তু আমাদের কেতাবের মুখোমুখি তো আমাদের হতেই হবে, সমাধান তো আলেমদেরই দিতে হবে। সেই সমাধান "ছাগলটি বেহেশত হইতে আসিয়াছিল"-র মত হলে তো হবেনা। কোনো হাদিসে যদি কোনো ঘাটতি থাকে তাহলে ঝগড়াঝাটি না করে সেটাকে ঠিক করে সামনে এগুলেই তো হয়।

হাদিস প্রবলভাবে বিশ্বমানবের এক চতুর্থাংশকে (মুসলিম) প্রভাবিত করে অথচ ১৪০০ বছরে মানবজীবনে হাদিসের ভালোমন্দ কি প্রভাব হল তার ওপরে নেই কোন রিসার্চ বা সমীক্ষা। আলেম সমাজ বা ইসলামী ফাউণ্ডেশন এটা করলে ভাল হয়, তাতে অনেক কিছুই স্পষ্ট হবে।       

"ফেস দি পিপল টিভি"-কে আবারো ধন্যবাদ।

****************************************

নিহত “বিশ্ব-খলিফা” বাগদাদী: আমেরিকা! আমেরিকা?

২৯ অক্টোবর, ২০১৯

“সিরিয়ায় মার্কিন অভিযানে আইএস নেতা বাগদাদি নিহত”- আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ২৭ অক্টোবর ২০১৯।

তা বেশ। প্রায় বিশ বছর ধরে “ইসলামিক স্টেট” যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে, অসংখ্য মানুষের ওপর বর্ণনাতীত অত্যাচার করেছে মানুষ খুন করেছে, অসংখ্য নারীদের বন্দী করে যৌনদাসী বানিয়ে কেনাবেচা করেছে সেই দানবের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। এ দানব হঠাৎ করে কোত্থেকে উঠে এসে বিশাল এলাকা দখল করে কেয়ামত সৃষ্টি করল, একে কে বানালো তা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা। তবে আমরা খেয়াল করেছি সুদূর ইউরোপ এমনকি বাংলাদেশেও তার ঘাতক হাত ছুটে গেছে কিন্তু বাড়ির পাশে প্যালেস্টাইনের ওপর গণহত্যাকারী ইসরাইলের ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। দুনিয়া জুড়ে আলেমরা চিৎকার করেছেন ওরা মুসলিম নয়, ওটা ইসলামী রাষ্ট্র নয়। কিন্তু অমন চিৎকার করলেই ওরা অমুসলিম হয়ে যায় কিনা, ওদের প্রতিটি হিংস্রতার সমর্থন ইসলামী কেতাব থেকে পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে পরে ভদ্রভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।

আমেরিকা! এই সেই দেশ যে চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে মানবজাতিকে দিয়েছে অসামান্য উপহার। কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতির মতো দানব দুনিয়ায় দ্বিতীয় নেই। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সে নিজেকে সারা দুনিয়ার পুলিশ ও বিচারক দুই-ই নিযুক্ত করেছে। একাত্তরে আমাদের জীবনমরণ যুদ্ধে গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারী পাকিস্তানকে সে শুধু রাজনৈতিক সমর্থনই করেনি বরং সামরিক মারণাস্ত্র জুগিয়েছিল। ভিয়েতনামে অসংখ্য নিরপরাধকে বিষাক্ত নাপাম বোমা ফেলে খুন করেছিল এই সরকার। আরো দুটো মর্মান্তিক প্রমাণ দিচ্ছি কিন্তু তার আগে বলে নিই, যে বাহানায় সে সিরিয়া-ইরাক ধ্বংস করেছে সেখানে কোনোই “উইপন অফ মাস ডেকস্ট্রাকশন” ছিল না।

১. পারমাণবিক বোমার প্রেক্ষাপট:

১৯৪৫ সাল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির মুসোলিনিতো আগেই গেছে, জার্মানিও শেষ। এখন ইউরোপ, রাশিয়া, কানাডা ও আমেরিকার সমস্ত সামরিক শক্তি ছুটেছে জাপানের বিরুদ্ধে। আক্রমণের পর আক্রমণে ছোট্ট জাপান দিশেহারা।

(ক) প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজোর সরকার আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠালো টোকিওতে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত জ্যাকব মালিকের কাছে। সেটা পাত্তাই দিল না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আর রাশিয়ার নেতা স্ট্যালিন, চলতেই থাকল নিরপরাধ জনগণের ওপরে হত্যালীলা।

(খ) দিশেহারা জাপান সরকার দ্বিতীয়বার আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠালো টোকিওতে সুইস প্রতিনিধির মাধ্যমে, সেটাও পাত্তা দিল না তারা, চলতেই থাকল নিরপরাধ জনগণের ওপরে হত্যালীলা।

(গ) ২৮ জুলাই-০১ আগস্ট ১৯৪৫, রাশিয়ার পটাসড্যাম-এ ট্রুম্যান, চার্চিল আর স্ট্যালিনের মিটিং। জনগণের ওপরে ক্রমাগত গণহত্যায় আতংকিত জাপানসম্রাট হিরোহিতো তাঁর ব্যক্তিগত সচিব প্রিন্স কনওয়ের মাধ্যমে তিন নেতার কাছে আবার আত্মসমর্পনের প্রস্তাব পাঠালেন। ভাবতে পারেন, কতটা বর্বর হলে তৃতীয়বারের মতো ১ অগাস্টে পাঠানো আত্মসমর্পনের প্রস্তাব গৃহীত হলো ৬ অগাস্ট হিরোশিমা ও ৯ অগাস্ট নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফেলার পরেই, আগে নয়?

উদ্ধৃতি দিচ্ছি ওই আমেরিকারই সমর দপ্তরের রিপোর্ট থেকে-

“হিরোশিমার ২,৫৫,০০০ লোকের মধ্যে ১৩,৫০০ (তাৎক্ষণিকভাবে- আমার কথা) হতাহত হয়। নাগাসাকির ১,৯৫,০০০ লোকের মধ্যে (তাৎক্ষণিকভাবে- আমার কথা) হতাহত হয় ৬৫,০০০। হিরোশিমার ৯০,০০০ পাকা বাড়ির মধ্যে ৬০,০০০ বাড়ি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। নাগাসাকি থেকে ১২ মাইল দূরের ঘরবাড়ির জানালা দরজাও উড়ে গিয়েছিলো”।

বৃটিশ মিশনের অফিসিয়াল রিপোর্ট-

“বোমা পড়বার এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অগ্নিজ্যোতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলে বহুদূর পর্যন্ত সবকিছু ঝলসে যায়। এ অঞ্চলে যেসব নর-নারী ছিল তাদের গায়ের চামড়া পুড়ে অঙ্গারের মতো কালো হয়ে যায়”।

কিভাবে অসংখ্য জীবন্ত মানুষের “গায়ের চামড়া পুড়ে অঙ্গারের মতো কালো হয়ে” গিয়েছিল আর যন্ত্রনায় অধীর হয়ে তারা কিভাবে চিৎকার আর্তনাদ করতে করতে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য উন্মাদের মতো ছুটছিল তা কল্পনা করলে দেখলে মুখের ভাত আর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। ওই পরমাণু-বিষক্রিয়ায় জাপানে বহুকাল পর্যন্ত হাজার হাজার পঙ্গু শিশুর জন্ম হয়েছে।

২. আমাদের স্বাধীনতার “আটলান্টিক চার্টার”:

১৯৪১, ২য় বিশ্বযুদ্ধের ৩য় বছর। হিটলার, হিমলার, গোয়েবলস, রোমেল, রিবেনট্রপ, গুডেরিয়ান, রুনস্ট্যান্ড, গুটেনবার্গের অবিশ্বাস্য সামরিক বিস্ফোরণে থরহরি কম্পিত ইউরোপ। এক রাশিয়া ছাড়া প্রায় সারা ইউরোপ চলে গেছে জার্মানির দখলে, চলে গেছে বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, হল্যান্ড এমনকি ফ্রান্সও। থরথর হাটুকাঁপা ইংল্যান্ডের এই মহা দুর্দিনে একমাত্র ভরসা আমেরিকা, কানাডা আর বিশেষ করে ভারতবর্ষসহ উপনিবেশগুলোর সাহায্য। তড়িঘড়ি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সাথে আটলান্টিক সাগরে প্রিন্স অফ ওয়েলস জাহাজে ১৪ অগাস্ট ১৯৪১ মিটিংয়ে বসলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। উপনিবেশগুলোর নাকের ডগায় স্বাধীনতার একটা আবছা ঘোষণার মুলো ঝুলিয়ে দেয়া দরকার যাতে যুদ্ধে ওদের সাহায্যটা পাওয়া যায়।

জাহাজ থেকে রেডিওতে প্রচারিত হল সেই বিখ্যাত আটলান্টিক চার্টার যার আটটি ধারার তৃতীয়টিতে বলা হল যুদ্ধশেষে প্রতিটি মানুষের অধিকার থাকবে তার জায়গায় স্বাধীনভাবে সরকার গঠনের।

স্বাধীনতা! আনন্দে ফেটে পড়ল ভারতবর্ষ। সহস্র লেখক কবি দার্শনিকের স্বপ্ন, কত সন্তানহারা পিতামাতার, মাতৃহীন এতিমের অশ্রু! কত রশীদ আলী, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, শাহনেওয়াজ, ভগৎ সিং, কত তিতুমীর, মঙ্গল পান্ডে, টিপু সুলতান, মাষ্টারদা, প্রীতিলতা, বীণা দাস, মাতঙ্গিনী হাজরার রক্তস্রোত। কত ফাঁসি, কত আন্দামান… সে অন্ধকারের অবসান ডাকছে ওই, স্বাধীনতার সূর্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওই!

একমাত্র ব্যতিক্রম নেতাজী। চার মাস আগে, ১৯৪১-এর এপ্রিলে তিনি জার্মানি পৌঁছে স্বাধীন ভারত পরিকল্পনায় ব্যস্ত। সেই সুদূর থেকে ইন্ডিয়ান রেডিওতে ভেসে এল তার মহা সতর্কবাণী- “বিশ্বাস কোরো না, বিশ্বাস কোরো না! পাখীর মধ্যে কাক, প্রাণীর মধ্যে শেয়াল ও জাতির মধ্যে ব্রিটিশ সবচেয়ে ধূর্ত, ওদের বিশ্বাস কোরো না”!!

শুনলেন না ভারতের নেতারা, যুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভারতবর্ষ। পরের বছর ১৪ অগাস্ট চার্টারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে রুজভেল্ট আবারো ঘোষণা করলেন এক বছর আগে চার্চিলের সাথে তার বৈঠকে আটলান্টিক চার্টার নিশ্চিত করা হয়েছে।

কিন্তু তিন বছর পর রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানি যখন বিধ্বস্ত, নির্লজ্জ পাল্টি মারলেন নেতাদ্বয়। ঘোষণা করলেন- “এমন কোনো স্বাক্ষরিত দলিল কখনো ছিল না….. আটলান্টিক চার্টারের কপি বলতে কিছু নেই… আমার কাছে নেই। ব্রিটিশের কাছেও নেই। যা আছে তা হল (ওই জাহাজ থেকে পাঠানো) রেডিও অপারেটরের বার্তা মাত্র… এমন কোনো আনুষ্ঠানিক দলিল নেই” - প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট - ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৪। 

“No signed version ever existed… There isn’t any copy of the Atlantic Charter… I haven’t got one. The British haven’t got one. The nearest thing you will get is the [message of the] radio operator on Augusta and Prince of Wales… There was no formal document”– President Roosevelt, 19 December 1944.

ব্যাস, খেল খতম।

আসলে এই দুই জিগরি দোস্ত সেই ১৯৪১ সালেই এটা গোপনে ঠিক করেছিলেন। প্রমাণ- চার্চিলের লেখা “বৃটিশ সাম্রাজ্য দেউলিয়া করার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী হইনি”। “I have not become the King’s First Minister in order to preside over the liquidation of the British Empire”– Sir Winston Churchill – 09 September 1941.

এরই নাম রাজনীতি। মানবতার, নিরপরাধের রক্ত অশ্রু আর্তনাদের কোনো ঠাঁই এখানে কখনো ছিলোনা এখনো নেই।

(সূত্রসমৃদ্ধ বিখ্যাত বই- আমি সুভাষ বলছি, শৈলেশ দে, ৩য় খণ্ড, ৩৫৬, ৩৫৭ ও বিভিন্ন পৃষ্ঠা)।

**************************************

ইসরায়েল-ফিলিস্তীন : শত্রুমিত্র চিনলিনা রে মন !!

০৩ জুন ২০২১.

(২০২১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি আবার ফিলিস্তীন ও ইসরাইলের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়, এতে বহু ফিলিস্তিনী হতাহত হয়)

মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনীতির কথা আমি বলবনা কারণ "যা জানোনা তার পেছনে পড়োনা"- সূরা বনি ইসরাইল ২৬। আমি শুধু বলব বিশ্বের হিংস্রতম দানব রাষ্টের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মীতার কথা, বিশ্বব্যাপী ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বিন্দু বিন্দু ন্যায়শক্তিকে একত্রিত করার কথা।  

১৯৩৪ সালে লণ্ডন থেকে ভারতে ফিরে জিন্নাহ মৃতপ্রায় অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগকে চাঙ্গা করতে ভারত ভ্রমণের অংশ হিসেবে ১৯৩৮ সালে বাংলায় আসেন। বাংলায় তখন ফজলুল হকের বিপুল জনপ্রিয় কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা মৃতপ্রায় বেঙ্গল মুসলিম লীগেরও নেতা। প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে খাজা-গজাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র "ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি" আর কলকাতায় হাসান ইস্পাহানী সাহেবের ছোট্ট দল "নিউ মুসলিম মজলিস"। কৃষক-প্রজা পার্টিকে বাংলা থেকে বের করে সর্বভারতীয় অঙ্গনে আনা দরকার, তাই নেতাদের সাথে জিন্নাহর আলোচনা চলছিল। কিন্তু একদিন  তিনি "ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি"-র খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথেও কথা বলেছিলেন।এতে কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা খাপ্পা হলে জিন্নাহ বলেছিলেন ভারতের বিন্দু বিন্দু মুসলিম শক্তিকে একত্রিত না করলে তিনি জয়ী হবেন না। 

এটাই মূল কথা, বিন্দু বিন্দু শক্তিকে একত্রিত করা। এর সাথে যোগ করুন আড়াই হাজার বছর আগের প্রাজ্ঞ সান জু - “KNOW THY ENEMY”, তোমার শত্রুকে চিনে নাও। মুদ্রার উল্টোপিঠে অব্যক্ত আছে -"তোমার বন্ধুকে চিনে নাও"।

পশ্চিমা দেশে কারা ফিলিস্তীন ও মুসলিমের বন্ধু? উদাহরণ অজস্র। ২০০৫ সালে রসূল (স)-এর কুখ্যাত ড্যানিশ কার্টুনের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠেছিলেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ইহুদী ধর্মনেতা রাবাই জোসেফ সিটরুক:- ‘‘কার্টুন প্রকাশের পরে বিশ্ব-মুসলিমের যে ক্রোধ তাহাকে আমি সম্পুর্ণ সমর্থন করি। কোন ধর্মকে অপমান করিয়া কেহই কিছু লাভ করিতে পারে না, ইহা অত্যন্ত অসৎ কর্ম’’। গর্জে উঠেছিলেন ক্যালগেরী’র সর্বোচ্চ ইহুদী ধর্মনেতা রাবাই নেলসন-ও, মুসলিমদের প্রতিক্রিয়ার অনেক আগেই।

এ তো গেল ধর্মগুরুদের কথা। সাধারণ মানুষদের কি খবর? ০৭ই জানুয়ারী ২০০৯ প্যালেস্টাইনে গণহত্যার বিরুদ্ধে টরন্টোতে ইহুদী মহিলারা ইসরায়েলী দূতাবাসে ঝটিকা প্রবেশ করে চীৎকার করে অবস্থান ধর্মঘট করেছিল, তাদের হাতে পোষ্টার ছিল -‘‘হে ফিলিস্তিনীরা, আমরা তোমাদের সাথে আছি’’। পরে পুলিশ ডেকে তাদের জোর করে বের করে দেয়া হয়। গত সপ্তাহেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে সব ধর্মের লক্ষ মানুষ উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে স্পেনের মাদ্রিদ, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে ইরাকের বাগদাদ, মধ্যপ্রাচ্যের ও জার্মানীর বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, লাইপজিগ, স্টুটগ্রার্ট, মিউনিখ, হামবুর্গ, কোলন, হ্যানোভার ও হিল্ডেসহাইম শহরে, লণ্ডনে, ফ্রান্সের প্যারিসে, লিওঁ, বোর্দো, মার্সেইসহ অন্যান্য শহরে, কোপেনহেগেনে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও মেলবোর্নে, টোকিওতে। সিবিসি নিউজ ২২ মে ২০২১- "প্যালেষ্টাইনের সমর্থনে (টরন্টো শহরের - লেখক) ইয়ং-ডানডাস স্কয়ার লোকে পরিপূর্ন হইয়া গিয়াছিল, জনতা ইসরাইল কনসুলেটের দিকে অগ্রসর হইয়াছিল"।       

                                           

কারা এরা? বিশ্বের হিংস্রতম দানব রাষ্টের বিরুদ্ধে কারা এই লক্ষ লক্ষ শস্ত্রবিবেকের দল? করোনার এই দহণকালে গৃহকোণের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে এরা কারা প্ল্যাকার্ড হাতে প্যালেষ্টাইনের পতাকা হাতে ছুটে গিয়েছে ইসরাইল দূতাবাসগুলোর সামনে, পুলিশের তাড়া খেয়েছে প্রহার খেয়েছে গ্রেপ্তার হয়েছে? শুধুই কি মুসলিম? 

না, তাদের অধিকাংশই অমুসলিম। কি ভাষায় এঁদের ধন্যবাদ জানাব আমরা? অথচ আমাদের অহরহ শুনতে হয় বাঁজখাই গলার হুংকার -"পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যুদ্ধ ঘোষণা করেছে"।   

শত্রুমিত্র চিনলি না রে মন !    

বিশ্বময় ছড়ানো ছিটানো এগুলো কি শক্তিহীন শুভশক্তি? মোটেই নয়। "বীরভোগ্যা বসুন্ধরা" সত্য, কিন্তু দিনশেষে মানবের হাতে দানব পরাস্ত হয়েছে বলেই সভ্যতা এগিয়েছে। হ্যাঁ, ইসরাইল সমর্থক মুসলিম বিদ্বেষী এক শক্তিশালী ইহুদী চক্র প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করে চলেছে আমেরিকার সরকার ও সংবাদমাধ্যম। এর মধ্যে আছে ব্রিজিটি গ্যাব্রিয়েল, পামেলা গ্যালার, রবার্ট স্পেনসার, ডেভিড ইয়েরুসালমী, রেমন্ড ইব্রাহীম -এর দল। বিস্তারিত আমি জানিনা কেননা ওটা আমার সাবজেক্ট নয়। এ মুদ্রার উল্টো পিঠটা দেখা যাক এবারে।         

আমেরিকান মুসলিমেরা (জনগণের মাত্র ১% এর মতো) আতংকে ত্রাসে অস্থির হয়ে পড়েছিল ২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। কারণ ক্রূদ্ধ ৯৯% অমুসলিমের একাংশও যদি অস্ত্রহাতে মুসলিমদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে কেয়ামত হয়ে যাবে। তখন কি করেছিল সাধারণ অমুসলিম জনগণ? শোনা যাক এক বাঙালী আমেরিকানের কাছ থেকে, সংক্ষেপে :-  

“নর্থ ফার্ষ্ট ষ্ট্রীটে ঘুরতেই চোখে পড়ল গাছপালার আড়ালে পুলিশের গাড়ী। পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে পুরো মসজিদ এলাকা। আমরা নামাজ পড়লাম নির্বিঘ্নে। বিস্মিত হয়েছিলাম মসজিদের লবিতে বিশাল ফুলের তোড়া দেখে, সাথে চিরকুটে লেখা ছিল - ‘‘আমরা তোমাদের প্রতিবেশী, তোমাদের শুভাকাংখী, অতিতের মত আগামীতেও আমরা পাশাপাশি থাকব শান্তির সাথে”। ওই তিনদিনে প্রায় পঞ্চাশটা মেসেজ রেকর্ড হয়েছিল মসজিদের টেলিফোনে। তার একটা ছিল চরম বিদ্বেষময় অশ্লীল গালিতে পুর্ণ, করিৎকর্মা পুলিশ দ্রুত ধরে জেলে পুরেছিল মেসেজদাতা যুবককে। বাকি উনপঞ্চাশটা মেসেজগুলোর মূল কথাই ছিল ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব আর সহযোগিতার আগ্রহ। এমনকি কোন কোন ম্যাসেজে এমনও বলা হয়েছিল যে, ‘‘যদি তোমরা দোকানে-বাজারে যেতে ভয় পাও তবে সংকোচ না করে আমাদেরকে বলো, আমরা করে দেব তোমাদের হাট-বাজার’’- জনপ্রিয় "নতুন দেশ" পত্রিকা, ঈদসংখ্যা, ০৮ই সেপ্টেম্বরে ২০১০। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ এমন আশাব্যঞ্জক বিবৃতি প্রকাশের জন্য।    

এরাই সভ্য মানুষ। এরাই আলোকিত মানুষ তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। এঁরা জানেন পুরো একটা জাতি নিজদেশে পরবাসী হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নির্যাতিত আহত নিহত হয়ে চলেছে সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। বিষয়টা মুসলিম-অমুসলিমের নয়, দানবের হাতে মানবের রক্ত ঝরছে সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। বিশ্বময় ইসরাইল-বিরোধী বিন্দু বিন্দু শক্তির উদাহরণ অজস্র, যেমন গাজায় হত্যা বন্ধে জাতিসংঘ মহাসচিবের জরুরী হস্তক্ষেপ চেয়ে প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়েছে লণ্ডন ভিত্তিক "ভয়েস ফর জাষ্টিস" সংগঠন।         

এ তো গেল সাধারণ মানবিক মানুষ ও তাদের সংগঠন। ইসরাইল-বিরোধী খোদ ইহুদী সংগঠন ও ইহুদী স্কলারদের কি খবর? তাঁদের মধ্যে ফিলিস্তীন-বান্ধব ও ইসরায়েল-বিরোধী কেউ আছেন কি? হ্যাঁ, আছেন এবং তাঁদের সংখ্যাও অজস্র। তাঁরা জানেন ইহুদী ধর্ম অর্থাৎ "জুদাইজম" ও ইহুদীবাদ অর্থাৎ “জায়োনিজম” এক তো নয়ই বরং পরস্পর বিরোধী। তাঁরা জানেন ইহুদী ধর্ম হযরত মুসার (আ) ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এবং ইহুদীবাদ হিংস্রতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক স্বার্থে হযরত মুসা'কে (আ) অপব্যবহারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্মর্তব্য, চার্চ-শাসিত খ্রীষ্টান রাজত্বে ইহুদীরা শত শত বছর অত্যাচারিত হয়েছে, তারা কখনোই পরস্পরের বন্ধু ছিলনা। অতি সংক্ষেপে, বিশেষ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদী-খ্ৰীষ্টানের রাজনৈতিক চক্রটি “পরস্পরের বন্ধু” হয়ে বিশ্ব-নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। এই “একে অপরের বন্ধু" ইহুদী-খ্ৰীষ্টান জুটির কথাই কোরান বলেছে - "হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা “পরস্পরের বন্ধু” - সূরা মায়েদা ৫১। এদের সাথে কোটি কোটি সাধারণ কৃষক শ্রমিক, চাকরীজীবী বা ব্যবসায়ী ইহুদী-খ্ৰীষ্টানকে জড়িয়ে ঢালাওভাবে "মুসলিম বিদ্বেষী" দাবী করে ঘৃণা ছড়ানোটা আত্মপ্রতারণা মাত্র। দুনিয়াটা এমনিতেই সংঘাতে ভরে গেছে, এবারে সখ্যের সন্ধানে যাওয়া যাক।  

যাওয়া যাক মধ্যপ্রাচ্যের তৈল-সম্রাটদের কাছে কারণ ফিলিস্তীনে মুসলিম রক্তস্রোতের বিরুদ্ধে তাঁদেরই বলিষ্ঠ দাঁড়ানোর কথা। রসূল (স) বলেছেন “মুমিনদের পরস্পরের ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার উদাহরণ একটি দেহের মতো। যখন ইহার কোনো অঙ্গ ব্যাথা পায় তখন সারা দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরগ্রস্ত হইয়া ব্যাথা পায়" - সহি মুসলিম ৬২৫৮, সহি বুখারী ৮ম খন্ড ৪০ ইত্যাদি।   

অবাক কাণ্ড! তাঁরা তো দেখছি ফিলিস্তীনদের রক্তস্রোতে মোটেই "নিদ্রাহীনতা ও জ্বরগ্রস্ত হইয়া ব্যাথা" পাচ্ছেননা!  তাঁরা বরং ইসরায়েলের সাথে নব নব রাজনৈতিক অনুরাগে উৎফুল্ল। ওদিকে সৌদি বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মুসলিম দেশ ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষে অনেক উদ্বিগ্ন অমুসলিম সংগঠন "নিদ্রাহীনতা"-য় ভুগে বিশ্ববাসীর কাছে চাঁদা ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। আর এদিকে জাতিসংঘে সাতান্নটি মুসলিম-প্রধান দেশের শক্তিশালী "অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন" কুম্ভকর্ণ সংক্রমিত সুখনিদ্রামগ্ন।  

শত্রুমিত্র চিনলি না রে মন !    

ফিলিস্তীনদের পক্ষে এতো বছরের কোটি মুসলিমের বুকভাঙা দোয়া কেন কবুল হচ্ছেনা সেটাও একটা রহস্য। প্রচেষ্টাহীন প্রার্থনা স্রষ্টাকে শুধু বিরক্তই করে বুঝি! কিন্তু তাহলে? তাহলে "ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে, হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে" - কবিগুরু। এবারে ইসরায়েল-বিরোধী খোদ ইহুদী ব্যক্তি ও সংগঠনের খোঁজে চলুন অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। 

(ক) ইসরাইলের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্তর্জাতিক ইহুদী সংগঠন "নিউট্রি কার্টা"র ধর্মগুরুরা (Neturei Karta): -

কি মনে হয় ?

(খ) "বিশেষ করিয়া ইহুদীবাদ ও ইহুদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ১৯৪২ সালে ইহুদী সংগঠন ‘আমেরিকান কাউন্সিল ফর জুডাইজম’ প্রতিষ্ঠিত হয় (“An organization specifically created to fight against both Zionism and a Jewish state)”।

কি মনে হয় ?

(গ)ইংল্যাণ্ডে লেবার পার্টির সাংসদ জেরাল্ড কফম্যান (উনি ইহুদী) দাবী করেছিলেন গাজাতে ইসরায়েল (হিটলারের) নাৎসী পার্টির মতো নিষ্ঠূরতা করছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র-অবরোধ (Arms embargo) প্রয়োগ করা হোক- সিএনএন ১৬ জানুয়ারী ২০০৯।

এগুলো অসংখ্য উদাহরণের মাত্র কয়েকটা। বিশ্বে ফিলিস্তনের শত্রুরা সামরিক শক্তিশালী কিন্তু তারা সংখ্যায় কম। ফিলিস্তীনের বন্ধুরা সামরিক দুর্বল কিন্তু তাদের সংখ্যা অগণিত। সংখ্যাও একটা পরাক্রান্ত শক্তি, বিশ্বময় ছড়ানো ছিটানো এই বিন্দু বিন্দু পরাক্রান্ত শক্তিকে একত্রিত করলেই দানব দমন করা যাবে।

কাজটা রাজনৈতিক ও ইসলামী নেতাদের।

বটমলাইন, ইহুদী-খ্রীষ্টান-অমুসলিমদের একটা চক্র মানবতার শত্রু, আমাদের উচিত তাদেরকে চিনে নেয়া। বাকি সাধারণ ইহুদী-খ্রীষ্টান-অমুসলিমেরা আমাদের শত্রু নয়। কোরান তো আমাদেরকে ইহুদী-খ্রীষ্টান নারীকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে - সুরা মায়িদা ৫। ওদিকে হাদিসে দেখি পাথর মুসলিমদেরকে ডেকে বলছে তার পেছনে ইহুদী লুকিয়ে আছে তাকে হত্যা কর। তার মানে কি এই, আমি কোরান মেনে ইহুদী প্রেমিকাকে বিয়ে করব, তারপর হাদিস মেনে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, শালা-শালী সম্বন্ধী সবাইকে খুন করে বৌ নিয়ে হানিমুনে যাব ?   

Print