বাংলার কথা কই - গল্পচ্ছলে বাংলার ইতিহাস - বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ - ২০২৪ সালে প্রকাশিত

বাংলার কথা কই - গল্পচ্ছলে বাংলার ইতিহাস - বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ - ২০২৪ সালে প্রকাশিত 

হাসান মাহমুদ 

COVER.png

 প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, MRM - মুসলিম রিফর্ম মুভমেন্ট অফ নর্থ আমেরিকা

  • উপদেষ্টা বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য, ওয়ার্লড মুসলিম কংগ্রেস
  • প্রাক্তন জেনারেল সেক্রেটারী, মুসলিমস ফেসিং টুমরো – ক্যানাডা
  • প্রাক্তন ডিরেক্টর, শারিয়া আইন, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস

বাংলার কথা কই

হাসান মাহমুদ

সম্পাদনা:

হাসান মামুন

প্রথম প্রকাশ :  মে, ২০১১

প্রকাশক :

বর্ণ বিন্যাস : এ. এস. মণ্ডল, টরণ্টো, অণ্টারিও, ক্যানাডা

                           

                           উৎসর্গ                 

                      

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের একমাত্র যুদ্ধ যেখানে আমাদের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শত্রুর হাতে বন্দী।  একটা সামরিক অস্ত্রসজ্জিত পরাক্রান্ত সৈন্যবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও গণধর্ষণের বিরুদ্ধে একটা অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর যুদ্ধ ছিল সেটা। শুধুমাত্র প্রধান সেনাপতির নাম ও ছবিটা সামনে রেখে সেই পরাক্রান্ত শত্রুকে বিধ্বস্ত ও পরাস্ত করে পরাধীন আমাদেরকে কে বিজয় ও স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন?    

ঘরে বাইরে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার নাওটাকে কুলে ভেড়ানোর মত অবিশ্বাস্য সাফল্যই শুধু নয়, নেতাকে শত্রুর কারাগার থেকে মুক্ত করে জাতিকে কে উপহার দিয়েছিলেন?

                        তিনিই তাজউদ্দীন আহমদ

মুখবন্ধ

যে গল্প বিস্তৃত উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, যার উচ্চতা হিমালয় আর গভীরতা অতলান্তিক, সেই গল্প বলতে বসেছি। জার্মানরা বলে “ডয়েস ল্যাণ্ড উইলবার অ্যালেস”, পিতৃভূমির জয় হোক। বাকীরা বলে মাদারল্যাণ্ড অর্থাৎ মাতৃভূমি। মাতার জঠরে মানুষের জন্ম কিন্তু মাতৃভূমির জঠরে তার যাপিত জীবন ও সর্বতাপের শেষ আশ্রয়। এই সেই হ্যামিলনের মোহনবাঁশী যার ঐশীশক্তিতে জলদগম্ভীর উচ্চারিত হয় - দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ হে মাটির মানুষ !

লক্ষ ঊষার কিরণধন্য,

কোটি গোধূলিতে ম্লান বিষণ্ণ,   

অগণ পুষ্পে অলিপুঞ্জিত,

মগন কোয়েলে কুহু-কুঞ্জিত,

কোটি পুর্ণিমা জ্যোৎস্না প্লাবিত,

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ধাবিত,

আলো ঝলমল স্বর্ণবরণী,

স্নেহময়ী মাতা হৃদয়হরণী,

আমাদের অনন্যা মাতৃভূমি।

শত-সহস্র ঘটনা দেখেছে এ পবিত্র মাটি। দেখেছে হাজার আলীমুদ্দীন-সূর্য্য সেন আর মীর জাফর। দেখেছে আদি সভ্যতা, দেখেছে অজস্র রক্তপাত, দেখেছে কখনো হতমানে অপমানে বাঙালির ন্যুব্জদেহ আর কখনো তার অভ্রভেদী উন্নতশির। দেখেছে মগ-বর্গীদের অধীনে দাসত্ব, আবার দেখেছে চট্টলা থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বর্ণাঢ্য শাসনকর্তৃত্ব। দেখেছে ধনাঢ্য সময় যেখানে এক জগৎশেঠের অর্থসম্পদ পাল্লা দিয়েছে ব্যাংক অব্ ইংল্যাণ্ডের সাথে, আবার কখনো দেখেছে দু’টো অন্নের অভাবে তিন কোটি বাঙালির উদ্বাস্তু বা না-খেয়ে-মরে-যাওয়া এক কোটি মৃতদেহ পথেঘাটে ছড়ানো ছিটানো।

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি” এ-কথা জানতো প্রাচীন পৃথিবীর মানুষ। গলাভরা গান আর গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর ফলেভরা গাছের এমন দেশ বেশি নেই দুনিয়ায়। তাই কোনমতে এর মাতব্বরিটা কব্জা করতে পারলেই কেল্লাফতে। এই হল কাল; আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। নিজের শরীরের সম্পদই হরিণের শত্রু, সেজন্যই সে মারা পড়ে। নিজের সম্পদের জন্যই বারবার মারা পড়েছে বাংলাও।

সে-জন্যই “আমি বাংলার গান গাই”। জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে সস্নেহ আলিঙ্গনে দু’হাত বাড়িয়ে আছে বাংলার যে বিপুল বৃহৎ গভীর মহৎ প্রবাহ তার কিছু অস্ফুট কলধ্বনি শোনাই। সেটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে গুরুগম্ভীর শব্দচয়নে গুরুগম্ভীর বাক্যবিনাসে শোনানোর অনেক পণ্ডিত আছেন দেশে। আমি শোনাই বাচ্চাদের। ইতিহাসে এমন কিছু নেই যাতে বিতর্ক নেই কিন্তু মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সূত্রের ভিত্তিতে এগুলো লেখা। সূত্রগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন গ্রন্থে, হাত বাড়ালেই গল্প শোনানোর জন্য তৈরি হয়ে আছে। তাই সেগুলোর বিশদ উল্লেখ এখানে না-ই বা থাকল। এই “গল্পিতিহাস”গুলোতে সন-তারিখ আর লব-কুশের বিশদ কণ্টকারণ্যে আমাদের পূর্বপুরুষদের অশ্রু হাহাকার আর খুশি-উল্লাস না-ই বা হারাল। মূল রসটা পেলেই হল।

জন্মভূমির বুকে অনুপম জীবন-ধারা পানের শেষে ক্লান্ত ঘুমের শান্তি আছে, আছে ধরণীর খেলা সাঙ্গ করে ধূলিধূসরিত দেহে তার কোলে ফিরে আসার সুপ্তি। কিন্তু সেই সাথে আছে প্রাণ দিয়ে তাদের রক্ষা করার দায়িত্বও। আছে তার সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করার আর্ত আহ্বান যা আমরা সাফল্যের সাথে করেছি ইতিহাসে। তারপর দেশের কর্তৃত্ব প্রথম হাতে তুলে নিয়েছি আমরা সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এই গবির্ত ঘোষণার সাথে - “আমার হাতেই নিলাম তুলে আমার যত বোঝা, তুমি আমার জলস্থলের মাদুর থেকে নামো”। আমাদের সমস্যা আছে অনেক কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে আমাদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণের প্রচেষ্টা। আমাদের যেমন পেছনে টেনে নেবার দানব আছে যে আলোয় দেখে অন্ধকার আর অন্ধকারে দেখে জীবন, তেমনি আমাদের আছে সামনে যাবার শক্তি, তুখোড় নূতন প্রজন্ম, জাতির প্রবল আধুনিকায়ন, আলোকিত সুশীল সমাজ, শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রবাহ, বর্ধমান শিক্ষার হার আর আছে উদীয়মান নারী-শক্তি যা অন্য সব শক্তির মাতৃশক্তি।

মানসিক শক্তির জন্য প্রতিটি জাতিকে তার শেকড়ে যেতে হয়। সেই শেকড় প্রোথিত থাকে তার ইতিহাসে। জাতির ‘আজ’ দাঁড়িয়ে থাকে তার গতকালের ওপর, তার ‘আগামীকাল’ দাঁড়িয়ে থাকে তার আজ-এর ওপর। আমাদের সেই আগামীকালের মালিক এখন আমরাই, বাইরের কেউ নয়। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ইতিহাসের সেই টার্নিং পয়েণ্ট, শতাব্দীর অত্যাচারিত একটা মহান জাতির মহামুক্তির দিন। এই পবিত্র দিন থেকে আমাদের “মুক্তিসন” শুরু। আমাদের প্রতিটি প্রজন্ম বারবার এই দিনের কাছে ফিরে যাবে শক্তির খোঁজে এবং এ-দিন কখনো তাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেবে না। কোটি টাকা লাগবে না, দশ মাইল দৌড়াতেও হবে না বা বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে না। অফিস আদালত সংসদে যদি জায়গা না-ও পায়, জাতির অজস্র লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীর কলম থেকে নিঃসারিত শুধুমাত্র এই একটা শব্দ “মুক্তিসন”- এ শব্দের বারবার ব্যবহার পুরো জাতিকে প্রতিটি দণ্ডেপলে প্রবল ও নির্ভুল মনে করিয়ে দেবে আমরা কি ছিলাম, কি থেকে কোন্ রক্তাক্ত পথে কি হলাম এবং কি আমাদের হতে হবে।

সেদিন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে কিন্তু আমার বিপুল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-সুম্ম-পুণ্ড্র-সমতট-হরিকেলের পরিশ্রমী, হাস্যোজ্জ্বল, সরল সহজ মানুষগুলো ও তাদের প্রজন্মের জন্য ॥

ধন্যবাদ

হাসান মাহমুদ

২৬শে মার্চ, ৪১ মুক্তিসন (২০১১)

Website:- https://hasanmahmud.com

Email:- This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.

সূচি

স্বর্ণমৃগ

এ নহে তোমার

আলাদীনের প্রদীপ

আর হাতে রণতুর্য

জোব্বা

মাসী

পণ্য

তালে ঠিক!

সেই তিন ঘণ্টা

নীলিমা

ধ্রবতারা

নাটের গুরু

মেশিন

নম্বরের চোরাবালি - অখণ্ড বঙ্গ ? 

বৃহত্তর বাংলা ও স্লিপ অব্ টাং

পাক-ভারতের স্বাধীনতা : ধামাচাপা অধ্যায়

বাংলার একুশ - একুশের রাণী 

বাংলার একুশ - টার্নিং পয়েন্ট

ভাই

একাত্তরের রক্তবীজ

বাংলার মুক্তিসন

অজানা একাত্তর

রঙ্গভরা বঙ্গবর্ষ

স্বপ্ন

বাংলার মাতুব্বর

বাংলার গুরু

বিশ্ব-একুশ!

অ-তে অতুলপ্রসাদ, আ-তে আলতাফ মাহমুদ! 

২১শে, ২৬শে, ১৬ই ও জন্মদিন উদযাপন কি শির্ক?

নববর্ষ বরণ - মৌলবাদের চক্ষুশূল কেন ? 
দেশে আরেকটা আইন প্রণয়নকারী ও শাস্তি প্রদানকারী সংসদ ?     

একাত্তরেই ছিল

একাত্তরের চিত্রকল্প

স্বর্ণমৃগ

অসম্ভব।

থাকবো না, কিছুতেই না। আর পড়ে থাকবো না এই শীতজর্জর রুক্ষ মাটির দেশে। বছরে সাতমাস শীতকাল, একটা পাতা থাকে না গাছে। শিকারের জন্য বেরুলেই তীব্র হিংস্র ঠাণ্ডা চোখের পলকে হাড় অবধি বসিয়ে দেয় তার ধারালো দাঁত। তিন মাসের গরমকালে প্রচণ্ড পরিশ্রমেও বন্ধ্যা মাটি দিতে চায় না অন্ন। কেন পড়ে থাকব এ পোড়া দেশে ? চলে যাবো, চলে যাবো অন্য কোনোখানে। সমস্ত পৃথিবীটাই নিশ্চয় এমন নয়। যেখানেই, যত দূরেই হোক, সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা দেশ একটা আছেই কোথাও। ফল খেয়ে আঁটিটা ছুড়ে ফেললে পরদিন দেখা যাবে ছোট্ট দু’টো নধর সবুজ পাতা। এরকম হিংস্র ঠাণ্ডা থাকবে না, নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু জড়িয়ে জড়িয়ে রাখবে মাতৃগর্ভের নিরাপত্তায়। অন্নপূর্ণা মাটি চাইবার আগেই ভরে দেবে প্রসারিত দু’হাতের ভাণ্ড। ঘাইহরিণী আর টিপজোনাকীর সেই মনোহর দেশ নিশ্চয়ই আছে কোথাও। চলো, চলো যাই। গাঁঠরি বাঁধো মুসাফির।

উঠে দাঁড়ালো আর্যরা। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে, বাংলা থেকে কত হাজার মাইল দূরে রাশিয়ার সেই ভলগা নদীর তীরে। শস্য-শ্যামল স্বর্ণমৃগের হাতছানি হ্যামিলনের বাঁশির মতো ডেকেছে তাদের, রওনা হয়ে গেল তারা। সাথে সাথে এশিয়া ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অগণিত ভবিষ্যৎ মানবজাতির ধর্মীয় ও সামাজিক রূপরেখার ভিত্তি রচিত হয়ে গেল চিরকালের জন্য। কি সুন্দর, কি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল সেটা।

পথ জানা নেই। দিক জানা নেই। মঞ্জিলের চেহারা স্বরূপ কিছুই জানা নেই। শুধু আছে দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। স্বর্গাদপি গরীয়সী মায়ের মতো মাটি চাই। কে জানে কোথায় আছে সেই সোনার দেশ। একদল চললো উত্তরে। একদল দক্ষিণে। পথ দুর্গম। শত শত মানবগোষ্ঠী পড়ে পথে। দেখা হলেই লড়াই। কিন্তু আর্যদের সাথে পারবে কে ? শুধু উন্নততর ধাতব অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রতিভাই নয়, শুধু উন্নততর সামাজিক ব্যবস্থা, পশুপালন ও কৃষির অভিজ্ঞতাই নয়, অতিন্দ্রীয় আরো একটা শক্তি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে আর্যরা। তা হলো দর্শন। স্রষ্টা দর্শন। ব্রহ্ম, বিষ্ণু, মহেশ্বরের ধর্মীয় দর্শনে যা পরিণত হয়েছে পরবর্তীকালে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানবগোষ্ঠী তখনো গাছ পাথর, চন্দ্র সূর্যের আরাধনা করছে। অনেকের ভাষা, পরিধেয় বলে কিছু নেই। পাথরের অস্ত্র সম্বল। সাত-সমুদ্দুর-তেরো-নদী পার হয়ে রূপকথার রাজপুত্রের মতো এগিয়ে চলেছে আর্যরা ভুবন ভোলানো মাটির টানে।

এক হাজার বছর লেগে গেল আফগানিস্তান পৌঁছুতে। তারপর রণে ভঙ্গ দিয়ে একদল স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধল ইরাণে গিয়ে। অন্যদল চললো দক্ষিণে। বিষ-পিঁপড়ের মতো জেদী তারা। একবার কামড় দিয়ে ধরলে যতই টানো কামড় ছাড়বে না সে। বেশি টানলে মাথা থেকে শরীর বরং ছিঁড়ে চলে আসবে, ছেঁড়া মাথাটা কামড় দিয়ে পড়ে থাকবে তবু। ক্লান্তিহীন পথ চলার বিরাম নেই। আরো দু’শ বছর পর পাঞ্জাব। সেখান থেকে গঙ্গার ধার ধরে এগোতে এগোতে একেবারে বিহারের ভাগলপুরে এসে থামলো আর্যরা। চোখ তুলে দেখল সামনে বিস্তীর্ণ বদ্বীপ। সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা।

মনে ঝড়, চোখে অশ্রু। এই সেই দেশ, সেই মাটি। যার হাতছানিতে দেড় দু’হাজার বছর আগে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল পূর্বপুরুষেরা। কত জন্ম-জন্মান্তর পার হয়ে গেছে তার পর। কত বংশ, প্রজন্ম পথে পথে ঝরে গেছে শুধু এই অন্নপূর্ণা মাটির খোঁজে। অজস্র রক্তক্ষয়, অসংখ্য যুদ্ধ যার জন্য, সেই মাটি ঐ সামনে। এবার মহাযাত্রার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ লড়াইয়ের জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল চিরকালের অপরাজিত আর্যরা।

ঝাঁপিয়ে পড়ল, এবং সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ছিটকে ফিরে এল। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে আর্যরা। যা ঘটে গেছে তা কল্পনাতীত। হাজার হাজার বছরে সংখ্যাতীত বিজয়ের পর এই প্রথম তাদের কপালে পড়েছে পরাজয়ের কলঙ্কতিলক। সামনে পুণ্ড্রনগরে মাথা উঁচু করে রক্তচোখে তাকিয়ে আছে দেশের সন্তান। আর্যদের মতই ধাতব অস্ত্রহাতে সবল, সুঠাম, বলদৃপ্ত বাঙালি। জীবনের প্রথম পরাজয়ের কশাঘাতে পাগল হয়ে উঠল আর্যরা। সমস্ত শক্তি, অভিজ্ঞতা আর জেদ একত্রিত করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আবার, আবার এবং আবার। তারপর হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল বিহারের মাটিতেই। সামনে তখনো মাথা উঁচু করে রক্তচোখে দাঁড়িয়ে আছে দেশের সন্তান। সবল, সুঠাম, বলদৃপ্ত বাঙালি।

তাকানো যাক দলিলের দিকে। কোন্ দলিল ? কার লেখা দলিল ? আর কারো নয়, সেই আর্যদেরই লেখা। অন্য কখনো নয়, সেই আড়াই-তিন হাজার বছর আগেই। অন্য কোথাও নয়, সেই বিহারে বসেই লেখা :-

পুণ্ড্রদেশের অধিবাসীরা ক্ষত্রিয়। [মানব ধর্মশাস্ত্র। ক্ষত্রিয় শব্দটার মানে হল যোদ্ধা ]

পুণ্ড্রদেশের প্রধান শহর পুণ্ড্রনগর। পুণ্ড্রজাতিরা দস্যু এবং শত্রু। [ঐত্তরিয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থ]

প্রাচ্যদেশের লোকদের তারা (আর্যরা) ‘অচ্ছ্যুৎ’, ‘খুনেডাকাত’ এসব তো বলেছেই, এমনকি ‘অসুর’ বলতেও ছাড়েনি। [ডাঃ নীহার রঞ্জন রায়]

অতি অস্পষ্ট একটা ছবি।

কি মনে হয় ? একটু স্পষ্ট হয়ে আসছে না ছবিটা ?

পুণ্ড্রদেশ হলো রাজশাহী, দিনাজপুর বগুড়া নিয়ে উত্তরবঙ্গ। দু’টো ধ্বংসাবশেষ আছে সেখানে -  পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড় (পুণ্ড্রনগর) একটা উন্নত নগর-সভ্যতার সবকিছু সেখানে আছে - ধাতব অস্ত্রশস্ত্র, মুদ্রা, পশুপালন ও কৃষিকাজ এবং প্রাচীন সভ্যতার সর্বজনস্বীকৃত মাপকাঠি পয়ঃপ্রণালী। সময় ? আজ থেকে তিন সাড়ে-তিন হাজার বছর আগে, ঠিক যে সময়টায় বিশ্ববিজয়ী বন্যা রাশিয়ার ভলগা থেকে বিহার পর্যন্ত ছুটে এসে পাথরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছিল।

তারপর ?

বিদেহ (উত্তর বিহার) হলো পূর্বদিকে আর্য বসতির শেষ সীমা। [শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থ - আর্যদের]

আর্যরা বিজয়ী রূপে বাংলার কোনও অঞ্চলে বসতি স্থাপন করিতে পারে নাই।

[ডাঃ নীহার রঞ্জন রায়ের সূত্রের ‘পিতৃভূমি ও স্বরূপ অন্বেষণ’ - ফারুক হাসান ]

আরো একটু স্পষ্ট হয়ে এল না ছবিটা ?

কি মনে হয় ?

এ নহে তোমার !

আজ থেকে ঠিক দু’হাজার তিনশো বছর আগের কথা।

বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরে পঞ্চ আব অর্থাৎ পঞ্চনদীর দেশ পাঞ্জাবের বিপাশা নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন সুদূর গ্রীসের বিশ্বজয়ী শক্তিশালী সম্রাট। কোথায় কত দূরে সেই গ্রীস ! সেখান থেকে শুরু করে কত রাজ্য, কত দেশ, তুর্কিস্থান, ইরাণ, আফগানিস্থান হয়ে পাঞ্জাব। জয়ের পর জয়। শক্তিশালী তাঁর বাহিনীর সামনে মাথা নত করেছে শত শত রাজ্য। কিংবদন্তীর নায়ক বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের সম্রাট দারায়ূস পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেনি তাঁর সামনে। মানুষের ইতিহাসে এত বিজয় কখনও দেখেনি কেউ। সম্রাটের চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। ওটা তাঁকে মানায়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অধিকারী তিনি। সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ বিশারদ তাঁর সেনাপতি। বারবার প্রমাণ হয়েছে সেটা।

ঝিলমিল করছে বিপাশার ঢেউ। ওই দেখা যায় বিপাশার ওপারে ভারতের মূল ভূখণ্ড। আর মাত্র কটা দিন। তারপরেই গোটা ভারতবর্ষ তাঁর হয়ে যাবে। সেই সাথে পূর্বÑভারতের গঙ্গার সেই বদ্বীপ। সেই চির সবুজ সুজলা সুফলা দেশটি। দেবার জন্য তৈরি হয়েই আছে যে মাটি। আম খেয়ে আঁটিটা ছুড়ে ফেললে পরদিন দেখা যাবে নধর দু’টি ছোট্ট সবুজ পাতা। আশ্চর্য ! এমন মাটিও আছে দুনিয়ায় !

খবর এল, নদীর ওপারে বিপক্ষ দলেও সেনাবাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছে। তাতো ঘটবেই। নিজের রাজ্য সহজে ছাড়তে চায় না কেউ। মনে মনে তৈরি হয়ে গেলেন সম্রাট। তৈরি হয়ে গেল বিপাশাও। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দুটো শক্তি তার এধারে ওধারে। যুদ্ধ শুরু হলে পানির চেয়ে বেশি রক্ত বয়ে যাবে বিপাশা দিয়ে। সেটা তো একরকম অবধারিতইকিন্তু সেনাপতির মুখ গম্ভীর কেন ? গম্ভীর এজন্য যে বিপক্ষ দলের শক্তির খবর এসেছে। এবং সে শক্তিটা কল্পনা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

“ক’হাজার ওরা ?” প্রশ্ন করলেন সম্রাট।

“দু’শো, সম্রাট।”

“মাত্র ?”

“দু’শোটা এক হাজার, সম্রাট। অর্থাৎ দু’লক্ষ।”

কপালে ভাঁজ পড়ল সম্রাটের।

“আরো আছে, সম্রাট। দু’দশ নয়, কুড়ি হাজার অশ্বের একটা সুসজ্জিত বাহিনী আছে।”

ভুরু কুঁচকে গেল সম্রাটের। কু-ড়ি হা-জা-র ঘোড়া। অনুমান করতে লাগলেন, কুড়ি হাজার ঘোড়ায় কতগুলো ঘোড়া হয়।

“আরো আছে, সম্রাট। কমপক্ষে তিন হাজার হাতির আলাদা একটা স্বয়ংসম্পুর্ণ বাহিনী আছে।”

চোয়াল ঝুলে পড়ল সম্রাটের। অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য ! দু’চারশো নয় তিন তিন হাজার হাতির যুদ্ধ বাহিনী ! এ যে অবিশ্বাস্য ! এরকম শক্তি নিয়ে লোকটা ভারতবর্ষে বসে করছে কি ? সমস্ত পৃথিবীটাতো ওরই জয় করার কথা ! সম্রাটের মনে হলো তিন হাজার হাতির ওজন তার মাথায় চেপে বসেছে। মনে হলো, পুরো হিমালয় পর্বতটা উঠে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে গেছে। সারা জীবনে অসংখ্য যুদ্ধের যোদ্ধা তিনি, কখনও পরাজিত হননি। কিন্তু হিমালয়ের সাথে কি যুদ্ধ করা যায়? ব্যাকুল হয়ে তাকালেন তিনি সেনাপতির দিকে।

‘স্রেফ আত্মহত্যা করা হবে, সম্রাট’। জানালেন অভিজ্ঞ যুদ্ধ বিশারদ, রণ নিপুণ সেনাপতি।

গল্প মনে হচ্ছে ? রূপকথা ? বুঝি রূপকথা সৃষ্টি করার অসম্ভব ক্ষমতাই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। দিগি¦জয়ী বন্যা ঠেকিয়ে দেবার ক্ষমতা ছিল। রূপকথা নয়, বাস্তব। বিদেশি ঐতিহাসিকদের সপ্রশংস লেখনীর ইতিহাস। সেই লেখনীর দিকে তাকানো যাক একবার।

“ধননন্দ গঙ্গারিডি জাতির রাজা ছিলেন। আলেকজাণ্ডারের বিপক্ষে তাঁর বাহিনীতে প্রায় দু’লক্ষ পদাতিক, বিশ হাজার অশ্বারোহী এবং তিন থেকে চার হাজার যুদ্ধ হস্তী ছিল” - কুইণ্টার্স কার্টিয়াস।

“ভারতবর্ষের সমুদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডির রাজার বিশাল হস্তীবাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজাণ্ডার তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না” - ডায়াডোরাস।

কিন্তু তাতে বাংলার কি ? বাঙালির কি ? কোথাকার এক গঙ্গারিডি জাতির রাজা বিপাশা পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেনই বা। ‘অপরিসীম শক্তির অধিকারী’ হলেনই বা। তাতে আমাদের বাঙালিদের কি আসে যায় ?

আবার তাকানো যাক বিশ্ববরেণ্য ঐতিহাসিকদের দিকে।

“গঙ্গা নদীর মোহনায় সমুদয় এলাকা জুড়িয়া গঙ্গারিডিদের রাজ্য” - টলেমি।

“গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের ভিতর দিয়া গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হইয়াছে” - প্লিনি।

... আর কিছু বলার আছে ?

আলাদীনের প্রদীপ

ঘটনাটা আকর্ষণীয় নয় খুব। নাটকীয় তো নয়ই। সেজন্যই আমরা তা চট করে ভুলেও গেছি। আর আজকাল যে পশ্চিমারা ইতিহাসের ফসিল খুঁড়ে তত্ত্ব ও তথ্য বের করেন তাঁরা বোধহয় ইচ্ছে করেই চেপে গেছেন। অথচ ঘটনাটা পশ্চিমে ঘটলে সেটা সোনার অক্ষরে লিখে আইফেল অথবা সি. এন. টাওয়ারের ডগায় টাঙিয়ে দেয়া হতো। দুর্ভাগ্য, হতভাগা বাংলায় ঘটেছিল সেটা।

যত নীরসই হোক, ঘটনাটা আমাদের জানা দরকার। কারণ আমাদের শরীরের শিরা উপশিরায় রক্ত নামক যে লাল পদার্থটি বইছে তা আকাশ থেকে হঠাৎ আসেনি। আমাদের পূর্বপুরুষরাই সেটা দিয়ে গেছেন। আমাদের সেই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের (৯ বার) অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহরা আজ থেকে প্রায় ১২৬০ বছর আগে এই বাংলায় একটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁদের দিকে তাকানো যাক এক পলক।

প্রাচীন, অতি প্রাচীন বাংলা। গোলায় উপচে-পড়া ধান আর পুকুর-ভরা মাছের দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের সন্তান, আমাদের পূর্বপুরুষ। সবল, সুঠাম, বলদৃপ্ত বাঙালি ও বাঙালিনি। শির নেহারি তাঁর, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির। পৃথিবীর বিস্ময়। সুদূর ইউরোপ থেকে ছুটে আসা দিগি¦জয়ী বন্যা ঠেকিয়ে দিয়েছেন দু’দুবার।

কিন্তু এবার বাংলা পরাজিত হলো। কনৌজ (আধুনিক লখনৌ)-এর রাজা যশোবর্ম বাংলা জয় করলেন। “বিজয়ীর কাছে আনুগত্য স্বীকার করে নেবার সময় ওদের মুখমণ্ডল ম্লান হয়ে গিয়েছিল, কারণ ওরা এজাতীয় কাজে অভ্যস্ত নয়”, লিখে গেছেন যশোবর্মের সভাকবি বাকপতিরাজ তাঁর “গৌড় বহো” গ্রন্থে। কিন্তু কিছুদিন পরই যশোবর্ম পরাজিত হলেন কাশ্মীর রাজ লালিত্যমোহনের কাছে। শুরু হলো বিপর্যয়। ৭৩৫-৭৪০ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা।

ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বাংলা। অতদূর থেকে শক্ত হাতে বাংলার শাসন-ব্যবস্থা নিতে পারলেন না লালিত্যমোহন। ব্যাঙের ছাতার মতো কয়েকশ’ রাজা মহারাজা গজিয়ে উঠল বাংলায়। নিজেদের মধ্যে লড়াই আক্রমণ লেগেই আছে। মানসিক ও সামরিক শক্তি কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে দ্রুত। সুযোগ পেয়ে গুটিগুটি এগিয়ে এল বহিঃশত্রু। বাংলা আক্রমণ করে লুটে নিয়ে গেল তিব্বতীরা। কিছুদিন পর কামরূপ সৈন্য। আবার কিছুদিন পর কনৌজ সৈন্য। লুটে নিয়ে গেল কাশ্মীরের সৈন্যরাও। নাভিশ্বাস উঠে গেল বাংলার রাজাদের। বিদেশি লুটেরাদের বাধা দেবার এতটুকু শক্তি তখন তাদের বাকি নেই।

কিন্তু চেতনা বাকি ছিল। বাকি ছিল অন্তর্দৃষ্টি। ভুল বুঝতে সময় লাগল না। প্রতিকারের পথ একটাই, ঐক্য। বড় কঠিন সে পথ। স্বার্থত্যাগের আহ্বান সে পথে পদে পদে। ভূস্বামীদের জন্য আরো কঠিন। কিন্তু সমস্ত বাধাই অতিক্রম করে ইতিহাস রচনা করলেন তাঁরা। এমনই হয়। জননী জন্মভূমির হাহাকার আর্তনাদ যদি শুনতে পাও, সহস্র কঠিন গ’লে পানি হয়ে যাবে এক দণ্ডে। প্রমাণ আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। প্রমাণ আছে সেই ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের সভায়। ঐক্য চাই। এক বাংলার এক রাজা চাই। কে হবে রাজা ? কে ধরবে হাল এই ভাঙ্গা নৌকোর ? কেন, ঐ তো আছে ! রাজশাহীর (প্রাচীন নাম বরেন্দ্র) রাজা গোপাল। ধর্মে বৌদ্ধ, দক্ষিণরাজের কন্যা তাঁর স্ত্রী। উত্তরে দক্ষিণে সবাই ভালো বলে তাঁকে।

“স্বদেশকে আরো অধিক অরাজকতার হাত হইতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, সকলে একত্র মিলিত হইয়া (বাংলার) জনগণের পক্ষ হইতে গোপালকে তাঁহাদের একচ্ছত্র নেতা বা রাজা নির্বাচিত করিয়াছিলেন। এভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচিত করিয়া আজ হইতে বারো শত বৎসর পূর্বে ... মানসিক উৎকর্ষ, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচায়ক। ... সংক্ষিপ্ত সময়ে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করিয়া তিনি সে দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন” (পিতৃভূমি ও স্বরূপ অম্বেষণ - ফারুক হাসান)।

তারপর ? শুধুমাত্র ‘শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত’ করেই কি গোপালের শক্তি ফুরিয়ে গেল ? তাই কি হয় ? ঐক্যবদ্ধ বাংলা যার পেছনে, তার হাতে তো আলাদীনের প্রদীপ ! সেই প্রদীপের শক্তিতে কি না হয় ! যতবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বাঙালি, কোনও অসম্ভবই অসম্ভব থাকেনি আর। প্রমাণ আছে একাত্তরে। আক্রমণকারী শত্রুরা লেজ গুটিয়ে পালালো বেত্রাহত কুকুরের মতো। বাড়ছে বাংলার রাজ্যসীমা। এক এক ক’রে বৃহত্তর বাংলাকে সংহত করে শক্তিশালী করে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম নির্বাচিত নেতা গোপাল। হাল ধরলেন পুত্র ধর্মপাল।

পরের ঘটনা সহজ, সরল। আলাদীনের প্রদীপ ধর্মপালের হাতে। সে প্রদীপ হলো ঐক্যবদ্ধ বাঙালি। বন্যার মতো সে শক্তি ছুটে গেল দিকে দিকে। সারা ভারতবর্ষ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। দাবাগ্নির মতো ধেয়ে আসছে বাঙালি। ছুটে আসছে ক্ষ্যাপা ঐরাবতের মতো। বাধা দেবার কথা বুঝি কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বাস হচ্ছে না ? তাকানো যাক দলিলের দিকে।

“কনৌজ (লখনৌ) জয় করার পর এক দরবারের আয়োজন করেন। ঐ দরবারে ভোজ, মৎস, মুদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তী, মালব, বেরার, গান্ধার, পেশোয়ার, কীর প্রভৃতি প্রাচীন রাজ্যগুলির রাজগণ উপস্থিত হইয়া বাঙালি ধর্মপালকে অধিরাজ বলিয়া স্বীকার করেন” (খালিমপুর তাম্রশাসন)।

“ধর্মপালের সময় বাঙালির রাজ্যসীমা বঙ্গোপসাগর হইতে পাঞ্জাবের জলন্ধর এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল” (তিব্বতি ঐতিহাসিক তারানাথ)।

ধর্মপাল মারা গেলেন। রাজা হলেন পুত্র দেবপাল। তখনো অনেক বাকি। বাঙালি তখনো ঐক্যবদ্ধ। দেখতে দেখতে আসাম আর উড়িষ্যা জয় হয়ে গেল। তাড়া খেয়ে ফিরে গেল তুর্কি জাতির পূর্বপুরুষ হুন সৈন্যরা। যুদ্ধে নিহত (মতান্তরে পরাজিত) হলেন দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় রাজা আমোঘবর্ষ। বিশাল সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু শাসনের জন্য পিতা ধর্মপাল রাজধানী সরিয়ে নিয়েছিলেন পাটালিপুুত্রে (পাটনা)। সেখানে বসে বাঙালি দেবপাল শাসন করলেন চট্টগ্রাম থেকে জলন্ধর, আসাম থেকে দক্ষিণ ভারত। ৮২০ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা। মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে এসে ভারতবর্ষের মাথায় চড়ে বসতে বাঙালির সময় লাগল মাত্র ৭০ বছর।

বাঙালির সামরিক বীরত্বের কথা ঘটা করে বলবার জন্য এ লেখা নয়, যদিও সে-সময়ে বাঙালির কাছাকাছি সামরিক শক্তি ভারতবর্ষে কারো ছিল না। এতবড় সুবিশাল সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মতো অতি উঁচুস্তরের মেধা ও পারদর্শিতা বাঙালির ছিল এ-কথা প্রমাণ করবার জন্যও এ লেখা নয়, যদিও সেটা অতি সত্য।

লড়াই, ঝগড়া, খুনোখুনি ক’রে নয়, আলাপ আলোচনা যুক্তি পরামর্শের সভায় সবাই একসাথে বসে বাঙালি যখন ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচিত করে অধুনা ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার’(!) ইংল্যাণ্ড তখন স্যাক্সনদের উপনিবেশ হিসেবে ধুঁকছে, এ-কথা প্রমাণ করবার জন্যও এ লেখা নয়, যদিও সেটাও সত্য।

আমি শুধু এক আশ্চর্য প্রদীপের কথা বলছি। ঐক্য। যা দিয়ে নিকষ অন্ধকার দূর করা যায়। আমাদের রক্তে যা দিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা, এবং ইতিহাসের ওপার থেকে আমাদের দেখছেন।

কি ভাবছেন কে জানে !

 

 

আর হাতে রণতুর্য

“শ্রীহট্টের পূর্বদেশ নাম গোয়ার

একখানি দেশ সেই বড়ই বিস্তার

একদিকে জৈন্তা, হেড়ম্ব একদিকে,

মধ্যদেশে মুকুন্দ আকাক্সক্ষা কৈলা তাকে।

সমুদ্র তনয় গৌড় গোবিন্দ নামেতে

শ্রীহট্ট দেশের রাজা ছিলেন পর্বতে।” - পাগল ঠাকুর

“পুনির বিল ছাড়িয়া রাজা ছিলটেতে গেল,

অট্টনাথের পূজা দিয়া ঠাকুরালি পাইল।” - হট্টনাথের পাঁচালী

দেবতা হট্টনাথের দেশ শ্রীহট্টের রাজা গৌড় গোবিন্দ। গোঁয়ার গোবিন্দও বটে। গোঁয়ার না হলে এতটুকু রাজা পুরো বাংলার নবাব ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায় ? আসলে একের পর এক যুদ্ধে জিতে তার আস্পর্ধা বেড়ে গেছে।

“গড়–ল রাজার কথা শুন মন দিয়া

সিংহের লগে যুদ্ধ করে তলোয়ার লইয়া।

বিদেশিয়া রাজার যত লোক লস্কর ছিল,

পুনি বিলের মধ্যে গড়ুল সবই ডুবাইল।

যুদ্ধ করি খাই (খাসিয়া) রাজারে বান্ধিয়া আনিল

পণ দিয়া খাই রাজা ফিরিয়া দেশে গেল।

জৈন্তা আর লাউড় গেলা আগে আগে ভাগি,

শত্রু শূন্য হৈল দেশ ডরাইব কার লাগি।” - পাগল ঠাকুর

খাসিয়া রাজ, জৈন্তা রাজ, লাউড় রাজ, সবাই পরাজিত। হবে না-ই-বা কেন ? রাজ্য জুড়ে বালক-বৃদ্ধ সবাই জানে গোবিন্দর পোষা আছে দুটো অদৃশ্য দৈত্য। যাদুটোনারও রাজা গৌড় গোবিন্দ। অলৌকিক মন্ত্রতন্ত্রের অমোঘ মারণাস্ত্রের অধিকারী। তাছাড়া, এমন সুদক্ষ তীরন্দাজ ত্রিভুবনে নেই। চোখ বন্ধ করে শুধু শব্দ শুনেই তীরের লক্ষ্যভেদ এক মহাভারতের অর্জুন ছাড়া আর কে করেছে ? সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে সে গড়ে তুলেছে বাংলার ইতিহাসে প্রথম তীরন্দাজ বাহিনী। ক্ষিপ্র ও দুর্দান্ত। সবচেয়ে দুর্দান্ত রাজা নিজেই। শাসনে নির্মম। সুকঠিন হাতে রাজ্যময় জনমনে কঠিন একটা মানসিক ত্রাস প্রতিষ্ঠায় সফল। সফল ও নিঃশঙ্ক।

“বাঘে গরুয়ে এক ঘাটে পানি খাইছে ডরে।” ... “দুই যুগ রাজত্ব কইরল মনের সুখেতে।”

তা করুক। তাতে বুরহান উদ্দিনের কি আসে যায় ? বহু জায়গা ঘুরে এসে সিলেটে সুখের নীড় বেঁধেছেন। দুঃখ শুধু একটাই। সন্তান নেই কোনো। চোখের জলে, প্রার্থনায়, জায়নামাজে কাটে সারারাত। যদি করুণাময়ের করুণা হয়। একটি যদি সন্তান আল্লাহ্ দান করেন, একটা গরু কোরবানী দেবেন বুরহান। হোক না গোবিন্দর রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ।

কি আশ্চর্য ! করুণাময়ের করুণা সত্যি সত্যিই পুত্র সন্তান হয়ে নেমে এল বুরহানের দুঃখের ঘরে। সুখে আনন্দে বুরহানের চোখের পানি আর থামতে চায় না। গোপনে দিলেন গরু কোরবানী। সাথে সাথে ইতিহাসের দিক নির্ধারিত হয়ে গেল। গোমাংসের খবর পৌঁছে গেল রাজদরবারে। হিংস্র পশুর মতো ছুটে এল সেপাইয়ের দল। টেনে হিঁচড়ে বুরহানকে নিয়ে এল ক্রুদ্ধ গোবিন্দর সামনে। নিয়ে এল দুধের বাচ্চাটাও। হাত-পা নেড়ে সে বাচ্চা তখন নিশ্চয় খেলা করছে।

আহা !

তারপর সবার সামনে অসহায় পিতার সামনে একটা ছোট্ট শরীর থেকে একটা ছোট্ট মাথা দ্বিখণ্ডিত হলো। বাচ্চাটা বোধহয় কিছু বুঝতেও পারল না। শোকে পাগল-প্রায় বুরহানের ডান হাত দ্বিখণ্ডিত করা হলো শরীর থেকে। সুকঠিন এ নাটকের অন্য অঙ্ক তখন অভিনীত হচ্ছে পাশের তরফ রাজ্যে, মোটামুটি একই সময়ে। সম্ভ্রান্ত মুসলমান কাজী নুরুদ্দীন ছেলের বিয়েতে জবাই করলেন গরু। প্রাণী হত্যার ঘোর বিরোধী বৈষ্ণব তরফরাজ আচক নারায়ণ গৌড় গোবিন্দর সম্বন্ধি। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলেন নুরুদ্দীন।

শোকার্ত দুটো মানুষ। বুরহান আর নিহত নুরুদ্দীনের ভাই হেলিমুদ্দিন। হাহাকারে তাঁরা ভেঙে পড়লেন বাংলার নবাব ফিরোজ শাহের দরবারে। নবাব বিচলিত হলেন। যে কেউই হবে। বঙ্গবাহিনী নিয়ে সেনাপতি সেকান্দার শাহ্ বীরদর্পে ময়মনসিংহের পথে সিলেটের পাহাড় জঙ্গলে পৌঁছালেন এবং গৌড় গোবিন্দর দক্ষ তীরন্দাজ বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে এলেন। এ হেন আক্রমণের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। ওদিকে বিজয়োল্লাসে নেচে বেড়াচ্ছে গৌড় গোবিন্দ। তীর জিনিসটাকে পশুশিকার থেকে উন্নীত ক’রে যুদ্ধে ব্যবহার করছে সে। মহাভারতের পরে ব্যাপারটা এই প্রথম। এরপর থেকেই তীরের ব্যবহার আমরা দেখি বাংলার বিভিন্ন যুদ্ধে। ক্রোধ চরমে উঠল বঙ্গ সুলতানের। কিছুতেই এটা মেনে নেয়া যায় না। অতএব আবার সাজ-সাজ রব। প্রচুর আয়োজন। বিপুল বাহিনী। আবার সেই ময়মনসিংহের চেনা পথ। কিন্তু সিলেটে পৌঁছাবার আগেই পুরো আকাশ তোলপাড় হয়ে ভেঙে পড়ল সেকান্দার বাহিনীর মাথায়। বৃষ্টি তো নয়, যেন নদ-নদী-সমুদ্রের যাবতীয় পানি হুড়মুড় করে নামছে বিরাম-বিহীন। হ্যাঁচ্চো শব্দে প্রকম্পিত ধরণী। সর্দি-জ্বর। এবং নিমোনিয়া। এবং ডায়রিয়া। প্রায় অর্ধেক সৈন্য মরেই গেল।

ততদিনে ছোট্ট খবরটা সাপের মতো কিলবিলিয়ে ঢুকে গেছে সৈন্যদের মাথার ভেতর। বর্ষা-জ্বর-মহামারী এসব আর কিছুই নয়, সবই ওই গৌড় গোবিন্দর মন্ত্রবাণ। তার অদৃশ্য দৈত্যের অদৃশ্য আক্রমণ। মধ্যযুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বঙ্গবাহিনী ভয়ে সিটিয়ে গেল। সেই শঙ্কিত তালপাতার সেপাইগুলো নিয়ে গৌড় গোবিন্দর মুখোমুখি হলেন সেকান্দার শাহ্। এবং আবার চিৎপটাং হলেন।

চোখে ঘুম নেই নতুন সেনাপতি নাসিরুদ্দীনের। আবার বঙ্গবাহিনী তৈরি হয়েছে কিন্তু গৌড় গোবিন্দের মন্ত্রের ভয়ে কুঁকড়ে আছে সৈন্যরা। এ-রকম আধমরা একটা বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে যাবার মানে হয় না। এই মানসিক যুদ্ধটাই জিততে হবে প্রথমে। মন্ত্র-ভীতিকে পরাস্ত করতে হবে। রাজা ফেরাউনের দরবারে রাজ্যের যাদুকরদের বাঘ ভাল্লুক যখন হযরত মুসা (আ.) খেয়ে ফেলতে উদ্যত, তখন তাঁর হাতের লাঠি বিরাট সাপ হয়ে যাদুর সব বাঘ ভাল্লুককে গিলে ফেলেছিল। সেরকম একটা লাঠি চাই। যাদুসংহার লাঠি।

পাওয়া গেল। নাসিরুদ্দীন সোজা চলে গেলেন সাতগাঁও-এর কাছে ত্রিবেণীতে। এসে দাঁড়ালেন ভারত বিখ্যাত দরবেশের সামনে। জন্মসূত্রে অমিতবিক্রম শারীরিক শক্তির অধিকারী, তার চেয়ে বেশি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান। লোকের মুখে মুখে ফেরে তাঁর অসাধারণ মোজেজার কাহিনী। বিশাল, বিপুল, সুউচ্চ পুরুষ। হযরত শায়খ জালাল উদ্দীন কুনাইবি। আমাদের শ্রদ্ধা পুরুষ হযরত শাহ্জালাল (রাঃ)। যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর পায়ে সমর্পিত করলেন নাসিরুদ্দীন। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দরবেশের প্রচুর। শিষ্যেরা সবই দুর্মুখ যোদ্ধা। তাদের এক হাতে তসবিহ্ অন্য হাতে তলওয়ার। মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন তীক্ষèধী দরবেশ। পরাজয়ের কারণ বুঝতে দেরি হলো না। নতুন গ’ড়ে ওঠা তীরন্দাজ বাহিনী সাথে নিয়ে তাঁর বঙ্গবাহিনী দক্ষিণের ঘুরপথে চলে এল কুমিল্লা। শাহ্জালালের মোকাম জায়গায় রাত কাটিয়ে হবিগঞ্জের দক্ষিণ থেকে উত্তরমূখী অভিযান চালালেন দরবেশ।

টনক নড়ল গৌড় গোবিন্দর। দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসছে দরবেশের বাহিনী। তীরন্দাজ বাহিনীর জন্য ওদিকে জঙ্গলের আড়াল বলতে কিছু নেই। মারাত্মক অসুবিধেটা বুঝতে দেরি হলো না বুদ্ধিমান রাজার। তড়িৎগতিতে সরিয়ে ফেলল তিনটে নদীর প্রত্যেকটি নৌকা। খবর এল, একের পর এক নদী ফকিরের বিরাট বাহিনী জায়নামাজে বসে পার হয়েছে। ততদিনে ফকিরের বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তির সামনে রাজার যাদুটোনা লোকের মুখে মুখে তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বুলন্দ দরবেশের বলিষ্ঠ ‘আল্লাহু আকবর’ গিলে ফেলেছে যত মন্ত্রশক্তি আর অদৃশ্য দৈত্যের মায়াত্রাস। থরহরি কম্পিত গোবিন্দর তীরন্দাজ বাহিনী খোলা ময়দানে এসে প্রচণ্ড ধরা খেল তলোয়ারের কাছে। নিয়তির ইঙ্গিত বুঝতে সময় লাগল না রাজার। খবর পাঠাল পারিবারিক বিশাল ধনুকটায় যদি কোনো বঙ্গসৈনিক তীর লাগিয়ে ছুড়তে পারে, তবে আর যুদ্ধ নয়, রক্তক্ষয় নয়। রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন তিনি। ফকির কি রাজী আছেন ?

অবশ্যই রাজী আছেন দরবেশ। চিরশত্রুর দেশ মক্কা কিভাবে রক্তপাতহীন জয় করেছিলেন মহানবী (দঃ) তা জানা আছে তাঁর। হাতির পিঠে পৌঁছে গেল শতাব্দী-প্রাচীন বৃহৎ অস্ত্রটা। দরবেশের দোয়া নিয়ে সর্বশক্তিমানের নাম নিয়ে বিশাল ধনুকে বিরাট তীর জুড়ে ছুড়লেন নাসিরুদ্দীন। বিজয় সম্পূর্ণ হলো। গোবিন্দর সেনাপতি মনা রায় নিহত হলো। বিজয়ী দরবেশ প্রবেশ করলেন সিলেটে।

গাজী সাহেবের নাম শেখ সেকান্দার

১৪ বছর যুদ্ধ করিল কুড়লির ভিতর

অগ্নিবাণ খাইয়া ব্যাটা শেখ সেকান্দার গেল পলাইয়া,

কুবাইস্তানে শাহ্জালালরে লইয়া আইল গিয়া।

এইবার হইল ল্যাটা গোড়ল রাজার,

ছড়াছড়ি পাড়াপাড়ি সুরমা গাঙের পাড়

অগ্নিবাণের ভটটানি দৈত্য জানা ভাগে,

কোমর বান্ধিয়া রাজা খাড়া হইল আগে।

আচম্বিতে শুনিল রাজা মনা রায় মৈল

আশা ছাড়িয়া তখন জঙ্গলেতে গেল।

১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা। ব্যাপার-স্যাপার দেখে আচক নারায়ণ গাট্টি বোঁচকা বেঁধে তৈরি হলেন এবং বঙ্গবাহিনী তাঁর দিকে রওনা হতেই মথুরার দিকে ‘দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়’।

আবদুল মান্নান তালিবের “বাংলাদেশে ইসলাম” ইত্যাদি গ্রন্থে যে তথ্য পাওয়া যায় সেখানে আমরা দেখতে পাই যে এই একই ঘটনা ঘটেছিল সেই সময় বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই।

হজরত শাহ জালাল পরাজিত করেন গৌড় গোবিন্দকে, সিলেট।

হজরত শাহ মাহমুদ পরাজিত করেন বিক্রমকেশরীকে

হজরত জাফর খাঁ গাজী পরাজিত করেন মান-নৃপতিকে-দিনাজপুর।

হজরত পীর বদরুদ্দীন পরাজিত করেন রাজা মহেশকে, দিনাজপুর।

হজরত শাহ বদরুদ্দীন পরাজিত করেন মগ দস্যুদের, চট্রগ্রাম।

হজরত সুলতান বলখী পরাজিত করেন রাজা বরামকে হরিরামপুর এবং রাজা পরশুরামকে, - মহাস্থানগড়, বগুড়া।

হজরত কাত্তাল পীর পরাজিত করেন মগ দস্যুদের, চট্টগ্রাম।

হজরত বড়খাঁ গাজী পরাজিত করেন মুকুট রায়কে, যশোহর।

হজরত শাহ নেকমর্দান পরাজিত করেন ভীমরাজকে, দিনাজপুর।

হজরত চিহিল গাজী পরাজিত করেন হিন্দু জমিদারদেরকে, দিনাজপুর।

হজরত গাজী বাহাদুর পরাজিত করেন হিন্দু জমিদারদেরকে, সিরাজগঞ্জ।

এবং হজরত শাহ মখদুম জয় করেছিলেন রামপুর - বোয়ালিয়া (রাজশাহী)।

লক্ষ্য করার মতো আরো একটা ব্যাপার আছে এখানে। এই সব সুফি সাধকরা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হবার পরেও রাজা হয়ে সিংহাসনে বসেননি একজনও। কারণ তাঁরা জানতেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোন্দলে ষড়যন্ত্র ও হিংস্রতা থাকবেই। যার সাথে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার সাংঘাতিক একটা মৌলিক বিরোধ থেকেই যায়। ইতিহাসে তাই প্রথম চার খলীফা ও ব্যতিক্রমী দু’একজন শাসক ছাড়া স্রষ্টার আরাধনার মাধ্যমে আত্মিক শুদ্ধতা বজায় রেখে কুটিল রাজনীতির রাজ্য-শাসন প্রায় কেউ করতে পারেননি। বরং ইতিহাসে ধর্মের আর স্রষ্টার নামে যত রাজ্য-শাসন হয়েছে তার সিংহভাগ অংশ হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতা আর মানুষের ওপর অত্যাচার, আর্তনাদ-হাহাকারে ভরা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী বিশেষজ্ঞ ইউসুফ হামজা’র কথাই ঠিক। তিনি বলেছেন, শুধুমাত্র নবীরা ছাড়া কেউই রাজনীতি ও ধর্মের মিশ্রণ করার ক্ষমতা রাখে না। সূত্র - (ইসলাম অ্যাণ্ড ডেমোক্র্যাসি-ভিডিও)

শাসকদের সাথে ধর্ম প্রচার কিম্বা ধর্মের রক্ষকদের বিরোধ চিরন্তন। যেমন  খলিফা আল মনসুর হজরত ইমাম আবু হানিফা (রা.)-কে বাগদাদের কারাগারে বন্দি করে কারাগারেই তাঁকে দিনের পর দিন প্রচণ্ড বেত্রাঘাতের পর পরবর্তী ৭৬৭ সালে তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন।

* খলিফা আল্ মনসুর-এর অবাধ্য হওয়ায় মদিনা শাসক জাফর বিন সুলায়মান রাস্তায় সবার সামনে বেত্রাঘাত করতে করতে শরীরকে মুচড়িয়ে ভেঙে দিয়েছিল ইমাম মালিক (রা.)’র এক হাত।

* খলিফা মামুনুর রশীদের সময় হজরত ইমাম শাফি (রা.)-কে বন্দি করে লোহার ভারী শেকল পরিয়ে ইয়েমেন থেকে বাগদাদে পাঠানো হয়।

* হজরত ইমাম আহমেদ হাম্বল (রা.)-কে লোহার শেকলে বেঁধে কোর্টে আনা হয়। খলিফা মামুনুর রশীদ আর খলিফা মু’তাসিম তাঁকে বহু বছর জেলখানার এক চির-অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছিল যেখানে এমনকি দিনের বেলায়ও কখনো কোনো আলো প্রবেশ করেনি। হাত বেঁধে বেত মেরে মেরে তাঁকে অজ্ঞান করা হ’ত। মুতাসিমের আদেশে সৈনেরা ইমামের শরীরকে পায়ের নিচে ফেলে এমনভাবে থেঁতো ক’রে দিয়েছিল যে তাঁর শরীরের অনেক হাড় ভেঙে যায়।

* হজরত ইমাম তাইমিয়া (রা.)-কে বহু বছর কারাগারে বন্দি রেখে কারাগারেই তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান কাজান খান।

* এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিস সংগ্রহকারী হজরত ইমাম বোখারি (রা.)? কারো সাথে যেন কোনো কথা বলতে না পারেন সে জন্য যুগশ্রেষ্ঠ এই ইমামকে আজীবন নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করেছিল আব্বাসীয় খলিফা মুতা’জ ও খলীফা মুহাতাদী। সমরখন্দের কাছে এক গ্রামে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিঃসঙ্গে অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন এই কালজয়ী ইমাম।

কি বলতে চেয়েছিলেন হজরত ইমাম বোখারি (রা.)?

এসব অত্যাচার করার পরে কোন কোন খলীফা ইমামদের কাছে মাপ চেয়েছেন কিন্তু খুন করার পর কিংবা হাড়গোড় ভাঙার পর মাপ চাইবার অর্থ জনগণের কাছে কিঞ্চিৎ সাফ-সুতরো হওয়া ছাড়া আর কিই বা হতে পারে।

সূত্র:-

১। উমদাত আল্ সালিক - ইমাম শাফি

২। দ্য ফোর ইমামস্ - মোঃ আবু যাহরা

৩। পলিটিক্যাল থ’ট অব্ ইবনে তাইমিয়া -প্রফেসর কামরুদ্দীন খান

সুফী দরবেশরা বাংলায় এলেন এবং শুধুমাত্র চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বাংলায় মুসলিম মেজরিটী করে ফেললেন, কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। নজরুলের ভাষায় (তাঁদের অনেকেরই) “এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর অন্য হাতে রণতূর্য”। একই কাহিনী বগুড়ার বিখ্যাত সুফী মাস্তান শাহ্ (রা.) কিংবা রাজশাহীর শাহ্ মখদুম (রা.)-এরও।

ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের হাতেও কি অস্ত্র ওঠেনি একাত্তরে ?

 

জোব্বা

‘সেলামালেকুম!’

‘কে’?

চারজন বাঙালি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।

“আপনি ইবনে বতুতা ? মূর দেশের পর্যটক” ?

“ওয়ালেকুম সালাম। হ্যাঁ, কেন”?

“পীরবাবা আমাদের পাঠিয়েছেন আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে। পীর শাহ জালালুদ্দিন শেখ। আপনি ওঁর ওখানেই যাচ্ছেন তো ? দু’দিনের পথ এখান থেকে”।

বাকরোধ হয়ে গেল আমার। এ যে অসম্ভব ব্যাপার! সুঁদকাও (চট্টগ্রাম) বন্দর হয়ে এদেশে আসার পর বহুজনের মুখে বহুবার এই শাহ জালালুদ্দিন দরবেশের নাম শুনে তাঁর কাছেই তো যাচ্ছি আমি। সহর-উল-আজরক (মেঘনা) ধরে উত্তরে উজান বেয়ে এই হবংক (হবিগঞ্জের কাছে, এখন আর নেই) জায়গাটায় আমি সেজন্যই এসেছি ! কিন্তু সেটা তো জানে না কেউই ! আশ্চর্য হলাম, কিন্তু তখনো কি জানি এই বাঙ্গাল মুলুকে আরো কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

ঘরবাড়ি নয়, পাহাড়ের একটা গুহার মধ্যে থাকেন হালকা গড়নের বৃদ্ধ দরবেশ। কোথায় ইরাণের সেই তাব্রিজ ! অতদূরের একটা মানুষ পাণ্ডুয়া হয়ে এই দেশে এসেছেন শুধু শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার করতে। অপলকে চেয়ে আছি। শান্তি আর স্নিগ্ধতা শব্দ দু’টো যেন মানুষের অবয়ব ধরে ফুটে রয়েছে। প্রতি ১১দিনে ১০দিন রোজা রাখেন। সম্পত্তির মধ্যে একটি গরু মাত্র। উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। জীবনের জটিলতায় শতধা খণ্ডিত আমার টুকরোগুলো মুহূর্তে সংহত হয়ে উঠল। যে উৎস থেকে ছিটকে পড়েছি দূরে, সেই বিরাটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন যেন। মাথা নত হয়ে এল আমার।

আমি ইবনে বতুতা যাযাবর মানুষ। লক্ষ্য চমৎকারের অভিজ্ঞতায় ভরা আমার ঝুলি, আমাকে আকৃষ্ট করা সহজ নয়। কিন্তু ছাগলের চামড়ার ঐ যে জোব্বাটা প’রে আছেন দরবেশ, তার যেন তুলনা নেই। দুনিয়ার দালান-কোঠা রত্ন-মাণিকের প্রতি নির্লোভ নিরাসক্ত এই মনে একটা লোভ গজিয়ে উঠল। হাসিও পেল। এত ছেড়ে ঐ চামড়ার জোব্বা ! বাইরে বেরুলে একজন বলল –

“জোব্বাটা দারুণ, না ? আপনাকে দেবার জন্যই গত সপ্তাহে ওটা বানানো হয়েছে। এমনিতে পীরবাবা জোব্বা-টোব্বা পরেন না কখনো”।

বলে কি! এ যে কিছুই বুঝতে পারছি না।

“পিকিন (পিকিং) শহরে পীরবাবার বন্ধু আছেন বুরহানউদ্দীন সাগরজী। এঁর মতো উনিও ইসলাম

    প্রচারে বেরিয়েছেন। জোব্বাটা সাগরজীর জন্যই বানানো হয়েছে। আপনি ওদিকেই যাবেন তো,

    তাই আপনার হাতে দেয়া হবে ওটা”।

“কিন্তু আমার চীনে যাবার কথা নিয়ে তো কারো সাথেই কথা হয়নি। যদি আমি পিকিনে না

    যাই? যদি সাগরজীর সাথে দেখা না হয়”?

সহাস্যে জবাব এল “আপনি না গেলেও চলবে। জোব্বা নিজেই তার মালিক খুঁজে নেবে। পীরবাবা

    বলেছেন”।

প্রতিজ্ঞা করেছি আর কিছুতে অবাক হব না। মাথাটাকে এত ভোঁতা মনে হয়নি কখনো। এ পৃথিবী দেখছি অন্য জিনিস। এখানে কোথা থেকে কি জন্য কেমন করে কি ঘটে কিছুই বোঝা যায় না। বিশ্ববিখ্যাত জ্ঞানী পর্যটক ইবনে বতুতার অগাধ জ্ঞান তীক্ষè বুদ্ধি আর বিশাল অভিজ্ঞতা এখানে চোখে দেখে সর্ষেফুল। এখানে খবর ছাড়াই আমার হাতে সুদূর চীনে পাঠাবার জন্য জোব্বা বানানো হয়। খবর ছাড়াই দু’দিনের পথ এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করে লোক। খবর ছাড়াই খবর হয়ে যায়  মরক্কো থেকে ইবনে বতুতা বেরিয়েছে আরব, ভারত, বাংলা, পারস্য হয়ে চীনে যাবার জন্য। কি আশ্চর্য !

যাযাবর পূর্ব-পুরুষদের রক্তের ধাক্কায় জন্মভূমি মরক্কোর তাঞ্জিয়ার থেকে ২১ বছর বয়সে প্রথম গিয়েছিলাম মিশরে, আলেকজান্দ্রিয়ার বিশাল লাইব্রেরিতে। ১৩২৫ সালের কথা সেটা। তারপর মক্কায় হজ্বে গেলে দরবেশ বুরহান-আল-আরাজ বলেছিলেন- “পেছনে আর নয়। ঐ চলে গেছে তোমার পথ সামনে থেকে আরো সামনে, আরব থেকে ভারতবর্ষ-বাংলা, পারস্য হয়ে চীন। যাও, এগিয়ে যাও”। স্বপ্নে দেখি বিরাট পাখির ডানায় ঝড়ের মতো ছুটেছি দক্ষিণে, তারপর পূর্বে, তারপর আবার দক্ষিণে। তারপরের জায়গাটা ভয়াবহ অন্ধকার। স্বপ্ন শুনে দরবেশ আব্দুল্লা আল মুর্শিদী বললেন একই কথা। আরব-ভারতবর্ষ, বাংলা, পারস্য, চীন। যাও, দেখে নাও। দেখে নাও এই সুন্দর পৃথিবীতে কি আশ্চর্য বিচিত্রতায়, জ্ঞানে, মূর্খতায়, উদারতা, নিষ্ঠুরতায় বাস করছে মানুষ নামের অস্থির প্রাণীটা। আর ভারতবর্ষে গেলে নাবিকদের মুখে শোনা সেই সবুজ গালিচার দেশে নিশ্চয়ই যাবে। রওয়ানা হয়ে গেলাম। শেখ মুহম্মদ আব্দুল্লা হয়ে গেলাম ইবনে বতুতা। ১৩৪৬ সালে সুদকাঁও বন্দর হয়ে পৌঁছলাম সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বদ্বীপে।

রূপকথার মতো আশ্চর্য সম্পদশালী দেশ। সে প্রাচুর্যের শেষ নেই কোথাও। সুনুরকাঁও  (সোনারগাঁও, প্রাচীন বাংলার রাজধানী) গিয়ে দেখলাম জগৎবিখ্যাত মসলিন। দুনিয়াজোড়া রাজা-বাদশাহ্দের পোষাক অসম্পূর্ণ মসলিন ছাড়া। শ্রেষ্ঠতম মসলিন ‘জঙ্গলখাপ’। ‘আবে রেওয়ান’ অর্থাৎ ‘পানির স্রোত’ এত মিহি যে পানির স্রোতে রাখলে দেখাই যায় না। সুরমা, বৈরাতী, ভোগ্য, ফটি প্রভৃতি কার্পাস দিয়ে তৈরি হয়। ফটি শ্রেষ্ঠতম কার্পাস। প্রাচুর্য উপচে পড়ছে সারা দেশে। জমছে গিয়ে বিদেশি শাসকদের হাতে। সম্পদের মালিক বাঙালি জাতি অত্যাচারিত, দরিদ্র। সুঁদকাও বন্দরে দেখেছি লড়াই চলছে বিদেশির সাথে বিদেশির। বাঙালির হাড়মাংসে অধিকারের লড়াই। আর দেশের মালিক বাঙালি শুধু পশুর মতো মারই খাচ্ছে না, বাংলারই হাটে ক্রীতদাস হয়ে বিক্রীও হচ্ছে। অথচ সাধারণভাবে জাতটা দৈহিক বলশালী এবং সাহসী। (১৮২৫ সালে পর্যটক বিশপ হেবের ছবি এঁকেছিলেন সাধারণ বাঙালি, অত্যন্ত বলিষ্ঠ, সুঠাম এবং সবল দেহ ছিল বাঙালির- লেখক)। ভাগ্যের পরিহাস !

দরবেশকে দেখে ভুলে গেলাম সব। তারপর গভীর রাত্রে গাছপালা-পাহাড় আর পানি-মানুষ আর প্রকৃতি সবকিছু নিঃশব্দ নিথর নিস্পন্দ নীরব। ‘শুধু তুমি একবার, খুলিয়া দক্ষিণ দ্বার, বাহিরেতে চাহ, অসীম আকাশ হতে বহিয়া আসুক স্রোতে, বৃহৎ প্রবাহ’। শান্তিময় লোকটা যার কেন্দ্রবিন্দুতে। রওনা হবার সময় গা’ থেকে জোব্বাটা খুলে আমার গায়ে পরিয়ে দিলেন। আশীর্বাদ নিয়ে পথিক পথে নামল আবার।

পরের ঘটনা তো মোটামুটি জানাই ছিল আগে থেকে। চীনের খানসা শহরে পৌঁছলে সেখানকার রাজাকে জোব্বাটা দিতে বাধ্য হই। সে অন্য কাহিনী। দীর্ঘ এক বছর পর পিকিনে সাগরজীর কাছে গেলাম নাটকের শেষ দৃশ্য দেখতে। দেখলাম অজানা এক নিখুঁত হিসেব মতো জোব্বা তার মালিকের কাছে ঠিকই পৌঁছে গেছে ॥

সূত্র। ইবনে বতুতার ডায়েরি।

মাসী

ছুটে চলেছে সৈয়দ। সুবিশাল ভারতবর্ষের, দিল্লীর তখ্ত-এর গোপন প্রতিনিধি।

কখনো আলো, কখনো, অন্ধকার। ধূলি-ধূসরিত প্রান্তর, শস্যশ্যামল বসতি, গহন বন। ভ্রƒক্ষেপ নেই সৈয়দের। তার উপায়ও নেই। প্রাণ হাতে ক’রে ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছেন তিনি বাংলার দিকে, সুদূর জোয়ানপুর (জৌনপুর?) থেকে। শতশত মাইল পথ, কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ নেই। কারণ ওদিকে রওনা হয়ে গেছে জোয়ানপুরের নবাবের লোকেরাও। ছুটছে তারাও। লক্ষ্য ওই একই, বাংলা। এই একটি মাত্র সুতোর ওপরে ঝুলছে সুবিশাল ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ। কে আগে পৌঁছোয়। দুই প্রবল বিরোধী পক্ষ ছুটে চলছে মরণপণ করে বাংলার দিকে সামরিক-রাজনীতির গোপনতম কাজ হাতে। গল্প নয়। আমাদেরই পূর্বপুরুষের অসাধারণ ইতিহাস।

বিদ্রোহী জোয়ানপুরের সাথে লড়ছেন ভারত সম্রাট দিল্লীশ্বর সুলতান। জয় পরাজয়ের সাথে জীবন, মান-সম্মান, দিল্লীর মসনদ, অনেক কিছুই জড়িত। মরণ কামড়ে লড়ছে জোয়ানপুরও। একদিকে বাঁচার লড়াই, অন্যদিকে দিল্লীর মসনদ। কিন্তু দু’দলেই এখন হতাশা আর ক্লান্তি। শুরু হবার পর চব্বিশটা বছর কেটে গেছে, যুদ্ধ চলছেই। কত আর পারা যায়। দু’দলই হন্যে হয়ে খুঁজছে একটা কিছু, একটা অলৌকিক কিছু, যা দিয়ে অন্তহীন একঘেয়ে যুদ্ধটা স্ফূলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে হঠাৎ বিজয়ে শেষ হবে। অসম্ভব একটা আশা।

বিস্ফোরণ হলো একটা। বাংলায়। ফিরে তাকাল ভারতবর্ষ। চমকে তাকালেন ভারত সম্রাট। চমকে তাকালেন জোয়ানপুরের নবাব। অবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ালেন দু’দলের সেনাপতি। পাওয়া গেছে ! রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশের মতো বহু বহু সামরিক প্রতিভায় ঝিকমিক আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষ। তার মধ্যে পূর্ণচন্দ্র নয়, একেবারে দোর্দণ্ড মার্তণ্ড প্রতাপে জ্বলে জ্বলে উঠছে কে ও ? শক্তির সম্ভারের, সমরনীতির সমস্ত হিসেব পায়ে দ’লে উঠে দাঁড়িয়েছে এ কোন্ কালাপাহাড় ! এই তো সেই অলৌকিক ! চির বিজয়ের গর্বতিলক খচিত উদ্ধতললাট। একেই তো চাই ! ছুটল জোয়ানপুরের দূত। ছুটলেন ভারতসম্রাটের দূত সৈয়দ।

বাংলার চিরকালের রাজশাহী, মান্দা এলাকা। তখনো ছিল, এখনো আছে। সেখানেই জন্মেছিল জেদি ছেলেটা। কালাচাঁদ রায়, ডাকনাম রাজু। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, ছোটখাটো জমিদারবংশ। মা-মাসী মিলে কত আদরে বড় করেছে বাপহারা কন্দর্পকান্তি ছেলেটাকে। চলনে বলনে গঠনে রঙ্গে রূপে, শাস্ত্রজ্ঞানে, অস্ত্রশিক্ষায় অতি অসাধারণ সুকণ্ঠ সেই তরুণ বাংলার অধিপতি বুরবক শাহ-এর দরবারে চাকরি নিয়েই তরতর করে উঠে গেল উপরে। তারপরে এল সেই বাঁক। যেখানে ঘটনা ঘটে। টলমল করে ওঠে জীবনের পা। বিধবা মিসেস সিম্পসনকে বুকে জড়িয়ে অবহেলায় অর্ধ-পৃথিবীর সিংহাসন ত্যাগ করে যান ইংল্যাণ্ডের সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড। সুবিশাল চীন সাম্রাজ্য পায়ে ঠেলে নামহীন পতিতাকে নিয়ে গ্রামে সুখী জীবন কাটান সম্রাট শু-চি। প্রকাশ্যে, গোপনে, গড়ে ওঠে লক্ষশত ছোটবড় তাজমহল, সর্বদেশে, সর্বকালে।

প্রতি সকালে মহানন্দায় স্নান সেরে “সুকণ্ঠে স্তোত্র আবৃত্তি করিতে করিতে” ঘরে ফেরে সুদর্শন কালাচাঁদ। জানে না, ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের বাতায়নে, গবাক্ষে নির্ভুল এসে দাঁড়ায় কেউ। প্রতিদিন। সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ। দেবলোকে নৃত্যছন্দে মনোহর পেখম তুলে ধরে কার্তিকের ময়ূর। অতনু শরবিদ্ধা হন সপ্তদশী রাজকন্যা। খবর চলে গেল রাজা-রাণীর কানে। খুশিই হলেন তাঁরা। কালাচাঁদের তুলনা নেই। তাছাড়া, যোগ্য হিন্দু পাত্র ইসলাম  গ্রহণ করে রাজপরিবারে বিয়ে করছে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

ঘটল সেটাই যা আগে ঘটেনি। বিয়ের প্রস্তাবে কালাচাঁদের খুশি এবং কৃতজ্ঞ হাসি আশা করেছিলেন বঙ্গেশ্বর বুরবক শাহ। উল্টে বঙ্গেশ্বরের মুখের ওপর তেলেবেগুনে ফেটে পড়ল দৃঢ়চেতা জেদী কালাচাঁদ। রাজ্য, রাজকন্যার লোভ দেখিয়ে ধর্মত্যাগ ! প্রশ্নই ওঠে না। অপমানে কালো হয়ে গেল বঙ্গেশ্বরের মুখ। বাধল বিরোধ। কথায় কথা বেড়ে গেল। সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা চলল, কিন্তু না। ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু মচকাবার পাত্র নয় কালাচাঁদ। ক্রোধে ক্ষিপ্ত অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন অপমানিত বুরবক শাহ্। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দিলেন। জনসমক্ষে প্রস্তুত করা হলো মৃত্যুবেদী। প্রস্তুত হলো ঘাতক। প্রস্তুত হলো কালাচাঁদও। থমকে গেল সময়। ঠিক তখনই অন্তঃপুরের পর্দা ছুড়ে ফেলে হাহাকারে ছুটে এলেন রাজকন্যা। দেহ পেতে দিলেন ঘাতকের খড়গের নিচে। গল্প নয়, স্বপ্ন নয়। স্তম্ভিত চেয়ে রইল কালাচাঁদ।

“ফুলশরের আঘাতে ধর্মবেদী বিদীর্ণ হইল, কালাচাঁদ বিবাহে সম্মত হইলেন।”

বিয়ের পরই অবধারিতভাবে ধর্মীয়-সামাজিক স্টীম রোলারের সামনে পড়ে গেল কালাচাঁদ। সব ধর্মের ফতোয়াবাজরা চিরকালই নিপীড়নের মাত্রাকেই সওয়াবের মাত্রা মনে করে। কত পণ্ডিত-মহাপণ্ডিতের কাছে ধর্ণা দিল, সবাই কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিল। দিশেহারা কালাচাঁদ ছুটে গেল উড়িষ্যায়, বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরে। মুখের ওপর দরজা বন্ধ হলো। ধর্মের বেদীমূলে ভালোবাসার আশ্রয় হলো না। মানবতার আশ্রয় হলো না জগন্নাথের কাছে। জেদী কালাচাঁদ মন্দিরের দ্বারে অনশন করে পড়ে রইল সাত-সাতটা দিন। অনাহারক্লিষ্ট সেই দুর্বল শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল পণ্ডিত পাণ্ডার দল।

তারপর। নিয়তির ক্রৌঞ্চমিথুনে মহাদস্যু রতœাকর হয়েছিলেন মহাঋষি বাল্মিকী। এখানে ঘটলো উল্টো। স্বধর্মের অত্যাচারে হারিয়ে গেল কালাচাঁদ রায়, রাজু। প্রতিশোধের রক্তচক্ষু মেলে উঠে দাঁড়াল ভয়াবহ কালাপাহাড়। ‘হিন্দু’ জিনিসটাকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলবে সে। এ নামে না থাকবে কোনো মূর্তি, না থাকবে পণ্ডিত-পাণ্ডা। রাজ্যবিস্তারের আশায় সৈন্য দিলেন বুরবক শাহ্। এরপর যে চিত্র ফুটে উঠল তা একদিকে যেমন উন্মাদ ধর্মবিকার, অন্যদিকে তেমনি শক্তির ভারসাম্যের সমস্ত হিসেব পায়ে দলে ক্রমাগত বিজয়ের অসাধারণ সামরিক প্রতিভা। কালাচাঁদ ততদিনে মুসলমান হয়েছে, নাম নিয়েছে মুহম্মদ ফরমুলি। সে বজ্র প্রথমেই ভেঙে পড়ল উড়িষ্যার সেনাবাহিনীর ওপর। জগন্নাথ মন্দিরের ওপর। পুরুত-পাণ্ডার ওপর। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সবকিছু। এরপরের কাহিনী, ক্রুদ্ধ এক কালবৈশাখীর সামনে একের পর এক রাজ্য, সেনাবাহিনীর উড়ে যাবার কাহিনী। হিন্দুর বিরুদ্ধে বল্গাহীন এক সৈন্যদল আর তার উন্মত্ত অলৌকিক প্রতিভাবান সেনাপতি। ত্রাসিত জনগণের মুখে মুখে কালাচাঁদ হয়ে গেল কালাপাহাড়। খবর পৌঁছে গেল ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে, জোয়ানপুরের রাজার কাছে। দিল্লীশ্বরের কাছে। ছুটল জোয়ানপুরের দূত। ছুটলেন সৈয়দ। জোয়ানপুরের ওপর টেক্কা মেরে চিরবিজয়ের বরপুত্রকে বগলদাবা করে সম্রাটের সামনে হাজির করলেন সৈয়দ।

পত্রপাঠ প্রধান সেনাপতির পদ। আর, চব্বিশ বছরের যুদ্ধ ? পত্রপাঠ বিজয়ে সমাপ্ত। অবিশ্বাসের চোখে বাঙালির দিকে তাকিয়ে আছে গোটা ভারতবর্ষ। কি করে সম্ভব হলো এ অসম্ভব !

‘জোয়ানপুর হইতে আসিবার মুখে তিনি সেই প্রদেশের নিকটবর্তী সমস্ত দেবতা ও দেবমন্দির ভগ্ন করিয়াছিলেন।’ ফেরার পথে কাছেই পড়ল মন্দির নগর কাশী। আর যায় কোথায়। হিংস্র ঐরাবতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল কালাপাহাড়। ‘পাণ্ডারা ত্রাহি ত্রহি ডাক ছাড়িল...।’ রক্তাক্ত হয়ে গেল মন্দির নগর আর হিন্দু জনসাধারণ। আর তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই বিয়োগান্ত নাটক। স্বপ্ন নয়। গল্পও নয়। পাগলিনীর মতো ছুটে আসছে স্খলিত বসনা স্ত্রীলোক। ভারত-ত্রাস মহাবিদ্রোহী কালাপাহাড় উঠে দাঁড়াল বিদ্যুতাহতের মতো। কম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে চাইল – “মা-সী” !!

আশৈশব বালকের সেই চিরনির্ভয় নির্ভর, সে আশ্রয় হাহাকারে ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। হাতের বিষ ঢেলে দিল গলায়। কয়েকটা তীব্র মোচড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল দেহ। আদরের রাজুর সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত লাঞ্ছিত অপমানিত আদরের মাসীর দেহ। দু’হাতে মুখ ঢাকা বিশাল কালাপাহাড়ের সমস্ত শরীর তখন যেন একের পর এক বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

মরণ ছোবলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত কালনাগ, তার মনিবের ওপরেই।

অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত। সব-রকম অত্যাচার বন্ধ করবার অপ্রত্যাশিত আদেশে বিস্মিত বিহ্বল গোটা সেনাবাহিনী। সবার অলক্ষ্যে নিশ্চুপে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল কেউ। আকাশ থেকে তারারা দেখল, সাগর গিরি অরণ্যানী সবাই দেখল, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের বিস্ময়, চির অপরাজিত তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিদ, রাজশাহীর মান্দা এলাকার ছেলেটা ভারসাম্যহীন উদভ্রান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে অন্ধকারে একা, গন্তব্যহীন।

এরপর তাকে আর কখনো দেখেনি কেউ, জীবিত বা মৃত ॥

(সূত্র : বৃহৎ বঙ্গ -  ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন)

পণ্য

হাট বসেছে, হাট।

লোকে লোকারণ্য। সদ্য-ধরা সাদা চকচকে মাছ সাজিয়ে বসেছে জেলে, ক্ষেত থেকে লাউ শশা কাঁচামরিচ ডালায় সাজিয়ে বসেছে গেরস্ত। ও পাশটায় দড়িবাঁশের বিরাট দাঁড়িপাল্লার পাশে বস্তাবন্দি ধান চাল নিয়ে বসেছে বড় ব্যবসায়ী। বস্তাভর্তি গরু মোষের গাড়ি নামিয়ে রাখা আছে, জাবর কাটছে গাছে বাঁধা গরু মোষ। ছোট্ট দোকানে আলতা, মেহেদি আর সিঁদুর নিয়ে বসেছে মনোহারী, - গামছা-লুঙ্গি, ধুতি, কেরোসিন তেল আর লবণ নিয়ে বসেছে ছোট ব্যবসায়ী। থলি হাতে আসছে লোক. বাচ্চার হাত ধরে আসছে কেউ। ভেঁপুবাঁশি আর ল্যাবেঞ্চুষও আছে হাটে। আছে মাটির বাসন, খেলনা। হাজার পায়ের আঘাতে বাতাসে উড়ছে গ্রাম-বাংলার ধূসর ধুলো। সোঁদা একটা চিরপরিচিত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। হাট বসেছে বাংলার গ্রামে, আজ থেকে মাত্র সাড়ে তিনশ’-চারশ বছর আগে।

সঙ্গীসাথী নিয়ে যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গঞ্জালেস্, ভীত সন্ত্রস্ত চোখে সরে যাচ্ছে লোক। জলদস্যুদের কোর্তাপোশাক, কোমরে ঝোলানো বিরাট তরওয়াল আর পিস্তল নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে গঞ্জালেস্। দক্ষিণ বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সিবাস্তিন গঞ্জালেস্। বাংলা থেকে কোথায় কতদূরে সেই পর্তুগাল। সেখানে না জানি কোন্ বাবা-মা’র কোলে জন্মেছিল এক ছোট্ট শিশু। না জানি কিভাবে কেটেছে তার শৈশব, কি খেলা খেলত সে বন্ধুদের সাথে। উঠতি বয়সের রোমাঞ্চকর আবিষ্কারগুলো কিভাবে এসেছিল তার জীবনে। সেই সুদূর পর্তুগালে ছেলেটা যখন বড় হচ্ছিল, বাংলার মানুষ ভাবতেও পারেনি ঐ অতদূরে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ছোট্ট একটা মেঘ ঘনীভূত হয়ে উঠছে বাংলার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলবার জন্য, বাঙালির অশ্রু, আর্তনাদ আর রক্তস্রোতের ইতিহাসে অগ্নিস্বাক্ষর রেখে যাবার জন্য। সেই মেঘ যখন বাংলায় এল, ঝড় হয়েই এল। প্রচণ্ড জলদস্যু সর্দার হিসেবে বাংলায় পা রাখল গঞ্জালেস্, এবং আর ফিরে গেল না। সাথে রইল তার শক্তিশালী নৌবহর আর দুর্ধর্ষ ছোট একটা দল।

দৃঢ় গর্বিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে গঞ্জালেস্ হাটের বিশেষ দিকটায়। সাধারণ হাটুরে মানুষ ওদিকে পা মাড়ায় না কখনো। ওখানে যা আছে, দেখলে চোখে পানি আসে। কাছে দূরে বাংলার অনেক ঘরে তখন কান্নার আওয়াজ গুমরে উঠছে। অস্ফূট গোঙানিতে কাঁদছে বাঙালি মা বাবা, ভাই বোন, স্বামী বা স্ত্রী। ঘরের পাশ দিয়ে হাঁটাপথে যেতে যেতে সে কান্না শোনে মানুষ। বুঝে যায় এবারে এ বাড়িতে মরণছোবল দিয়েছে সিবাস্তিন গঞ্জালেস্ নামের ভয়ানক দানবটা। এরপরে আবার কার পালা কে জানে ! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলছে এ আর্তনাদ। কে শুনবে ? কে রক্ষা করবে ? কে বাঁচাবে গ্রাম বাংলার মানুষকে এ দানবের হাত থেকে ? দিল্লী থেকে নিয়োগ করা বাংলার অবাঙালি সুবাদারের তো সময়ই নেই এ নিয়ে মাথা ঘামানোর। সময়ও নেই, শক্তিও নেই।

হাটের যে অংশটায় ভয়ে যায় না কেউ, গঞ্জালেস্ এসে দাঁড়ালো সেখানে। সারি সারি রাখা আছে বিক্রীর পণ্য। যুদ্ধপোশাকে ঘোড়ায় চড়ে পাহারা দিচ্ছে প্রভুভক্ত অনুচরের দল। তৃপ্তির হাসি গঞ্জালেসের ঠোঁটে। এ পণ্য উৎপাদন করতে তার একটি পয়সাও খরচ হয়নি। সময়ও লাগেনি দু’দিনের বেশি। এখান ওখান থেকে নিয়ে এলেই হ’ল। সারি সারি রাখা আছে বিক্রীর পণ্য। যে পণ্য নড়ে চড়ে কথা বলে। সময়ে ক্ষুধার্ত হয়, সুখে সুখী হয়, দুঃখে দুঃখী হয়। সুযোগ-সুবিধে পেলে স্বপ্নও দেখে।

ও পাশটায় গনগনে কয়লার হাপর চালাচ্ছে কামার। লোহার শিক রাখা আছে জ্বলন্ত কয়লার ওপর। গনগনে লাল হয়ে আছে শিকগুলোর মাথা। ব্যবসা করতে গেলে সবরকম সুবিধেই ক্রেতাকে দিতে হয়, ভাবল গঞ্জালেস্। সে জন্যই তো তার ব্যবসা এত জমাট। অবশ্য এর জন্য প্রচুর আয়োজনও করতে হয়েছে তাকে। সশস্ত্র লোকজন রাখতে হয়েছে, যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র কিনতে হয়েছে। তৈরি করতে হয়েছে শক্তিশালী নৌবহর। যার সামনে দাঁড়াবার স্বপ্নও দেখে না কেউ। সাহস পায় না দিল্লীর মোহর-প্রাপ্ত বাংলার অবাঙালি সুবাদার।

গ্রামবাংলার হাটে বাংলার মাটিতে সারি সারি বসে আছে হাত-পা বাঁধা বাংলারই হতভাগ্য মানুষগুলো। আতঙ্কে দুমড়ে গেছে চেহারা। অশ্র“র দাগ শুকিয়ে আছে গালে। আতঙ্কে ত্রাসে প্রায় জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা কমবয়সী ছেলেমেয়েগুলো। ঘোড়ায় চড়ে পাহারা দিচ্ছে গঞ্জালেসের বাঙালি অনুচর। গনগনে কয়লায় হাপর চালাচ্ছে বাঙালি কামার। বিদেশি ব্যবসায়ী একটু আগে বেছে বেছে কিনেছে স্বাস্থ্যবান কিছু পণ্য। নিয়তির কি ঘোর অভিশাপে নিজেরই দেশে বসে বিদেশির হাতে ক্রীতদাস হয়ে গেছে বাঙালি। ওদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঐ ওদিকে যেখানে গনগনে কয়লায় রক্তচোখে তাকিয়ে আছে লাল লোহার শিক। এবারে এসে দাঁড়ালেন মা হুয়েন। বিশ্ববিখ্যাত চীনা পর্যটক এবং ঐতিহাসিক। দেশে বিদেশে সম্মানিত জ্ঞানী লোক। কৌতূহলী অনুসন্ধিৎসু চোখে পরিমাপ করলেন পরিবেশটা। নোটবইতে কিছু লিখলেন। মনে পড়ল, ১৩৪৬ সালে মরক্কোর বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা (শেখ মুহম্মদ আব্দুল্লা) কিনেছিলেন বাঙালি কন্যা আশুরাকে এক দিনারে। তাঁর সঙ্গী দুই দিনারে কিনেছিলেন লুলু নামের ছেলেটাকে। মা বাবার কোল থেকে কেড়ে নেয়া সেই ছেলে সেই মেয়ে আজ কোথায় !

আকাশ ফাটানো চিৎকার ভেসে এল কামারশালা থেকে। গনগনে লাল শিকের সাথে মিশে গেছে বাঙালির রক্ত। ফুটো করে দেয়া হয়েছে হাতের তালু। যার ভেতরে লোহার শিকল পরিয়ে সারি সারি বাঙালিকে বসিয়ে দেয়া হবে জাহাজের খোলের ভেতরে। কাতর আর্তনাদ ছাপিয়ে উঠবে বাঙালির রক্তাক্ত হাতে বাওয়া সারি সারি দাঁড়ের শব্দ। পাল তুলে বিদেশির জাহাজ রওনা হবে নির্দোষ হতভাগ্য মানুষগুলোকে নিয়ে। খোলের ওপরের ছিদ্রপথে দিনে মাত্র একবার ফেলে দেয়া হবে কিছু অন্ন। কুড়িয়ে খাবে হতভাগ্য বন্দিরা। কল্পনা নয়। বিদেশির লেখা ইতিহাস।

ভালো করে খুব ভালো ক’রে তাকাও। বহু শতাব্দীর অন্ধকারের ওপারে অস্পষ্ট একটা ছবি। শতাব্দীর নৈঃশব্দ ভেদ করে ক্ষীণ ভেসে আসছে অনেকগুলো দাঁড়ের ঝপাঝপ শব্দ। আমাদের বড় আদরের পূর্বপুরুষ ঐ চলে যাচ্ছে বিদেশির ক্রীতদাস হয়ে চিরকালের জন্য, বড় কষ্টে, বড় যন্ত্রণায়। নিকষ অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে জাহাজটা।

আন্তর্জাতিক বাঙালি ব্যবসায়ী চাঁদ সওদাগরের বারোশ’ দাঁড়ের গর্বিত ময়ূরপঙ্খী ‘মধুকর’ নয় সেটা ॥

পাদটীকা - ১৬২৫ সালে মগরাজ থিরি থুডামার ঢাকা পর্যন্ত জয় করেছিল, এবং ব্যাপকহারে গণহত্যা করে বিপুলসংখ্যক বাঙালিকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাস করে রেখেছিল। ১৬৩৮ সালে থুডামারের মৃত্যুর পর মগদের মধ্যে গৃহযুদ্ধজনিত বিশৃঙ্খলার সুযোগে যে সব বাঙালি চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে আসে, তার সংখ্যাই ছিল কমবেশি দশ হাজার।

তালে ঠিক !

সর্বনাশ !

তড়িঘড়ি মিটিংয়ে বসল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৯৩ সালে। বাংলায় নয়, সেই লণ্ডনে। দু’শো বছর ধরে বাংলার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আকাশে উড়ে বেড়ানো অনেক ঘুড়ির লাটাই যেখান থেকে ঘোরানো হতো, সেখানে। কত কূটনীতি করে, বিশ্বাসঘাতকতা ষড়যন্ত্র করে, ওয়াদা খেলাফ খুনজখম করে বাংলার সিংহাসনটা হাতানো গেছে (‘পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য দেশে প্রভুত্ব করার সৌভাগ্যে ইংল্যাণ্ড ভাগ্যবান’ - লর্ড কার্জন)। ঐশ্বর্য্যময়ী লক্ষ্মীর স্বর্ণশকট যখন একেবারে ঘরের দরজায় ঠিক তখনই লক্ষ্মীমন্ত বাংলাটা হাত থেকে প্রায় ফসকে যাবার জোগাড়। না না, বাঙালিরা নয়। বাঙালিরা ঠিকই আছে। আসলে বহুশত বছর পরাধীন থেকে থেকে জাতটা মোটামুটি বোকা হয়ে গেছে। ব্যবসা করার সরকারি লাইসেন্সটা রিনিউ করার সময় হয়ে এসেছে। (সেই সময়ে প্রতি ২০ বছর অন্তর)। রুটিন একটা ব্যাপার। লাইসেন্স নবীকরণের দরখাস্ত করতে গিয়েই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির চক্ষুস্থির। ব্যাপারটা চিন্তা করা উচিৎ ছিল আগেই, অথচ চিন্তায় আসেই নি। বাংলার উপচে পড়া সম্পদের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি আদিকাল থেকেই, কাজেই লাইসেন্স অফিসে বাংলার পরিমল লোভে অনেক অলিই এসে জুটেছে। বাঘা বাঘা কোম্পানি সব। নামে, প্রতিপত্তিতে, পয়সায় এবং আকারে সুবৃহৎ রাঘব বোয়াল, দু’চারটে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পনিকে পাঠানদের নেশোয়ার-এর মতো দাঁতের ফাঁকে গুঁজে রাখতে পারে। “যাদের মূলধন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির চেয়েও অনেক বেশি এবং যাদের সমগ্র বিশ্বব্যাপী শাখা অফিস রয়েছে” (কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী - এম. আর. আখতার মুকুল)।

‘নো প্রবলেম। লাইসেন্স আমরাই পাব।’

‘কি-ঈ ??’ ঘুরে তাকালো সভার সদস্যরা বাংলার বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিসের দিকে।

‘লাইসেন্স আমরাই পাব। অবশ্যই পাব।’

‘কিন্তু কিভাবে ? আইন অনুযায়ী তো ওদেরই পাবার কথা।’

‘লিখিত আইন অনুযায়ী। যেটা সর্বদাই অলিখিত আইনের কাছে পরাজিত হয়।’

‘কিন্তু নানাদিক দিয়ে ওদের এত জোর।’

‘সে জোরগুলো সাধারণত মামার জোরের কাছে পরাজিত হয়। প্রাইম মিনিস্টার উইলিয়ম পিট আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পিট-এর সাথে কথা হয়ে গেছে আমার।’

হলোও তাই। মামাই জয়ী হল। খিড়কি দরজা দিয়ে সংসদে ঢুকে সবার ওপর টেক্কা মারল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি।

বাংলার রঙ্গমঞ্চে তখন ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল-এর খেলা সবে শুরু হয়েছে। রাজ্যটা সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে কাড়া হয়েছে। তাই অন্তত কিছুকাল মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখা, কোণঠাসা করে রাখা খুব দরকার। (যেন বিস্তীর্ণ গ্রাম-বাংলার তাবৎ মুসলমান সিরাজউদ্দৌলার জ্ঞাতিগুষ্ঠি ছিল আর কি !)। অন্যদিকে মুসলমানের চিরকালের শান্তিময় প্রতিবেশী হিন্দুদের দুধকলা দিয়ে কোলে টেনে নেবারও সময় এখন। সন্তর্পণে, অতি সন্তর্পণে, সাম্রাজ্যবাদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তখন। এক মাত্র ভরসা হিন্দুরা। ওদের চটানো তো দূরের কথা ওদের মানসিক শান্তি, ইংরেজের প্রতি বন্ধুত্বের তিলমাত্র ব্যাঘাত ঘটে, তা থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে হবে। যে দামেই হোক না কেন।

পরীক্ষা এসে গেল। পাদ্রী উইলিয়ম কেরি মহা গণ্ডগোল বাধিয়ে দিলেন লণ্ডনে। তাঁর দাবি ওদের বাণিজ্য ওরা করুক, আমি শান্তির ধর্ম বাইবেল প্রচার করব বাংলায়। অনুমতি চাই। মাথায় বাড়ি পড়ল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির। বলে কি পাদ্রীটা ! সবেমাত্র সিংহাসনটা বাগানো গেছে, পায়ের নিচে মাটি এখনো শক্তই হয়নি, এরই মধ্যে বাইবেল কেন রে বাপু ! এখনই পাদ্রী-টাদ্রী দেখলে হিন্দুদের ভুরু কুঁচকে উঠবে সেটা যে একেবারে ভারি নিশ্চয় ! আগে লক্ষ্মী তো ঘরে উঠুক, যীশু-টিশু পরে দেখা যাবে।

‘তাহলে লক্ষ্মীর জন্য যীশুকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে ?’ জ্বলন্ত চোখে প্রশ্ন করলেন কেরি।

মাথা চুলকিয়ে কোম্পানির কর্তারা বলল, ‘না, না, তা কেন ? ঠিক তা নয়। আসলে যীশু তো যীশুই, সাক্ষাৎ প্রভু। কিন্তু টাকা-পয়সার ব্যপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিনা...।’

‘ধুত্তোরি গুরুত্বপূর্ণ ! এই আমি চললাম বাংলায়। তোমাদের ভণ্ডামী তোমরা কর, প্রভুর বাণী আমি প্রচার করবই।’

জাহাজে ক’রে কেরি এসে নামলেন বাংলায়। হৈ চৈ পড়ে গেল কোম্পানির দপ্তরে। বেচারি পাদ্রী চালান হয়ে গেলেন বৃটিশ বাংলার বাইরে শ্রীরামপুরে, ডেনমার্কের সওদাগরদের আস্তানায়। আর লণ্ডনের সরকারি সংসদ ? প্রস্তাব পাশ হলো খ্রীষ্টান দেশের খ্রীষ্টান সংসদে, প্রভু যীশু তো ধৈর্যের অবতার, সহিষ্ণুতার প্রতীক। বছর বিশেক অপেক্ষা করতে তাঁর নিশ্চয়ই বিশেষ কষ্ট হবে না। আর এদিকে লক্ষ্মীর বেজায় অস্থির স্বভাব, এই আসেন আর এই উধাও হন। কাজেই হাতে ছাই মেখে তাঁকেই আগে জাপটে ধরা দরকার যাতে পিছলে বেরিয়ে যেতে না পারেন। কাজেই ২০ বছরের জন্য বাইবেল প্রচার বন্ধ করা হলো।

লম্বালম্বি নয়, একখানা সাগরকলা আড়াআড়ি খাওয়া যাবে এমন দু’কান-ছোঁয়া মধুর হাসি ফুটে উঠল কোম্পানির মুখে। ওগো হিন্দুরা, দেখ দেখ আমরা তোমাদের কতবড় বন্ধু। দেখ না বছরে ৫৩ দিন সরকারি ছুটির তালিকা বানিয়েছি ১৭৮৭ সালে। পঞ্জিকা খুলে দেখ সেখানে দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে রটন্তী অমাবস্যা, মৌনী সপ্তমী বা উত্থান একাদশী যেখানে যা কিছু ছিল সব ঢুকিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমাদের খুশি রাখবার জন্য। আর আমাদের ক্রিসমাস ? গুড ফ্রাইডে ? কোনো দরকার নেই। বড় ঈদ ? কোরবানী ঈদ ? দূর দূর ! ওগুলো আবার ছুটির দিন হবার যোগ্য নাকি ?

হতভম্ব হয়ে গেলেন কেরি। একি অন্যায় ! এরা নিজেদের খ্রীষ্টান বলে দাবি করে ! জুড়ে দিলেন চিৎকার। (প্রমথনাথ বিশী-র বিখ্যাত ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’ উপন্যাসে উইলিয়ম কেরির মুন্সী রামরাম বসুর বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিত্র চমৎকারভাবে ধরা আছে। গ্রামের মানুষের কাছে প্রিয় হবার জন্য জনসভায় কেরি সাহেব লেডিজ-অ্যাণ্ড জেণ্টলম্যান সম্বোধনটার বাংলা করে “উপস্থিত মাগী-ও-মিনসেবৃন্দ” দিয়ে বক্তৃতা শুরু করায় মহা হট্টগোল হয়েছিল)। কাদায় পড়ল কোম্পানি। এই চিৎকার দুনিয়ার কানে গেলে ইউরোপের খ্রীষ্টান পাড়ায় নাক কাটা যাবে। হুঁকো-নাপিত বন্ধ হয়ে যাবে। ল্যাঠা বাধালো দেখছি পাদ্রীটা। কি করা যায় ! চলল কূটনীতি। হাতজোড় করে কোম্পানি এসে দাঁড়াল সেই কেরিরই দরজায়।

‘এত খরচাপাতি করে কষ্ট করে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজটা বানালাম। ছাত্ররা ভর্তিও হচ্ছে কিন্তু বাংলা সংস্কৃত চালাবার লোক পাচ্ছি না। আপনি এসে একটু হাল না ধরলে বন্ধই হয়ে যাবে কলেজটা। প্লিজ !’

‘তা না হয় ধরব। কিন্তু প্রভুর বাণী প্রচারের কি হবে ?’

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, তা আর বলতে। তবে কিনা সংসদে পাস হয়ে গেছে তো বিশ বছরের আইনটা ! তাছাড়া কয়েকটা বছর তো চলেই গেল। বাংলা ভাষাটা রপ্ত করতে, বাংলায় বাইবেল অনুবাদ করতেও তো কয়েক বছর যাবে। তারপর নম নম করে ১৮১৩ সালটা পার হলেই আর কোনো সমস্যা হবে না। কথা দিচ্ছি। যীশুর কিরে।’

রাজি হলেন পাদ্রী উইলিয়ম কেরি। যীশুর কিরের প্রতি আস্থায়, নাকি বাধ্য হয়ে, কে জানে ! ১৮১৩ পর্যন্ত চলল শেখা ও বাইবেলের বঙ্গানুবাদ। তারপর শুরু হলো বাংলায় খ্রীষ্টধর্মের ব্যাপক প্রচার। যা মোগল আমলেও কিছুটা চালু ছিল এবং পলাশীর পরে কোম্পনি যা বন্ধ ক’রে দেয়। স্বার্থহানির ভয়ে।

জাতটা জাতে যীশু হলেও তালে ছিল লক্ষ্মী। স্বার্থের জন্য নিজের ধর্মকে যারা ঠেকিয়ে রেখেছিল তাদের হাতেই আমাদের ভাতকাপড় ছিল ১৯০ বছর ॥

সেই তিন ঘণ্টা

বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়। চিরকালই হয়েছে। কিন্তু একবার একটা হঠাৎ বৃষ্টি এসে আমাদের ভাগ্যকে চিরদিনের মত উল্টোদিকে টেনে নিয়ে গেছে। সেটাও হয়তো সামলানো যেত যদি তিন ঘণ্টা সময় পাওয়া যেত।

ভাবতে অবাক লাগে। মাত্র তিন ঘণ্টা সময় পাওয়া গেল না বলে আমাদের ভাগ্য চিরদিনের জন্য বদলে গেল। সে গল্পই আজ আপনাদের শোনাব। আজ হয়ত এটা গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিন যা ছিল জীবন, উন্মত্ত ঘটনার ঘনঘটায় আমাদের স্বাধীনতা-পরাধীনতা, উন্নতি-অবনতির নিয়ামক, আজ তা গল্প হয়ে গেছে।

মস্তবড় এক ময়দান। নাম পলাশী। মাঝখানে এক আমবাগান। নাম লক্ষবাগ। লক্ষবাগ আমবাগানের দক্ষিণ ধারে ছাউনি ফেলেছেন লর্ড ক্লাইভ তাঁর মোট তিন হাজার (মতান্তরে একত্রিশ শ’) সৈন্য নিয়ে যায় ৮০০ জন ইংরেজ ও পর্তুগীজ, বাকী সবাই মাদ্রাজি, পাঠান, রাজপুত, আফগান, রোহিলা, জাঠ, এবং কিছু বাঙালি। বিশাল পুরুষ লর্ড ক্লাইভ, তীক্ষè ধীশক্তিবলে যিনি সামান্য কেরানি থেকে হয়ে উঠেছেন একটি জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা। স্বজাতি এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু যাঁর পৃথিবীতে নেই তাঁর জীবনে আজ, ১৭৫৭ সালের ২২শে জুন, এই সন্ধ্যার মতো অস্থির সময় আর আসেনি। কাল যুদ্ধ হবে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পঞ্চাশ হাজার (মতান্তরে ত্রিশ হাজার) সৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে। ওদের ৩২, ২৪, আর ১৮ পাউণ্ডের ৫৩টি কামানের বিরুদ্ধে তাঁর আছে ছোট্ট ৬ পাউণ্ডের মাত্র ৮টি কামান। পারবেন কি তিনি ?

নিশ্চয়ই পারবেন। তাঁর আসল শক্তি তো সেনাবাহিনী নয়। তাঁর আসল শক্তি হলো মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম, নন্দকুমার, ইয়ার লাতিফ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণবল্লভ। তরুণ উচ্ছৃঙ্খল মদ্যপায়ী অত্যাচারী উদ্ধত নবাবের প্রতি এরা আহত কেউটের মতো রাগে ফুঁসছে, ষড়যন্ত্রের বিষে ভরে তুলেছে আকাশ বাতাস। আর সেই সাথে ক্ষমতার লোভ তো আছেই। এইতো সেদিন, অস্থির ক্রুদ্ধ স্বভাবের নবাব ভরা রাজদরবারে জগৎশেঠকে প্রচণ্ড চড় মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন, বর্ষীয়ান প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন সবার সামনে। তরুণ মোহনলালকে প্রধান সেনাপতি বানিয়ে সবাইকে সবার সামনে তাকে কুর্ণিশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিদারুণ অপমানে জর্জরিত এইসব রাঘব বোয়ালরা ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে কেউটে সাপের মতো ছোবল দিতে তৈরি। এইসব শক্তি নিয়ে রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতির দাবাখেলায় সর্বস্ব বাজি রেখেছিলেন লর্ড ক্লাইভ।

এই হলো ইতিহাস। আমাদের মাতৃভূমির কর্তৃত্ব এক তুর্কো-আরবের হাত থেকে ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার সর্পিল পথে ইংরেজ বেনিয়াদের হাতে যাবার কলঙ্কিত ইতিহাস।

যাক সে কথা। ফিরে আসি পলাশীতে।

২৩শে জুনের সকাল। আটটায় যুদ্ধ শুরু হল। মীরমদন এবং কাশ্মীরী মোহনলালের বারো হাজার সৈন্য ও গোলাবর্ষণের মুখে ইংরেজ বাহিনী আমবাগানে লুকিয়ে পড়ল। অবিরাম গোলাবর্ষণ এবং অগ্রসরমান মীরমদন ও মোহনলালকে বাধা দেবার শক্তি লর্ড ক্লাইভ আর অ্যাডমিরাল ওয়াট্সনের তখন নেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে এল সেই বৃষ্টি। সব গোলা বারুদ গেল ভিজে। সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল মীরমদন, মোহনলাল এবং ফরাসি সৈনাধ্যক্ষ সিনফ্রে। কিন্তু এই আধঘণ্টার যুদ্ধেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ইংরেজের পরাজয় আসন্ন। পরমুহূর্তে এল আঘাত। মীরমদন মরণাহত হলেন। তাঁকে নবাবের তাঁবুতে আনা হল। মারা যাবার মুহূর্তে তিনি নবাবকে জানিয়ে গেলেন যদিও বাকি সব সেনাপতি এবং তাদের সৈন্যদল দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, তবু শুধু মোহনলালই ইংরেজদের জন্য যথেষ্ট।

ওদিকে মোহনলাল আমবাগানে ইংরেজদের ঘিরে এনেছেন। মাত্র সময় আধঘণ্টা, তাহলেই ইংরেজদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটবে। কিন্তু এই আধঘণ্টা সময় তিনি পেলেন না। নবাবের আদেশ এল যুদ্ধ বন্ধ করতে। মনে পড়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডানকার্কের কথা। লর্ড গর্টের অধীনে তিন লক্ষ বৃটিশ সৈনিক যখন সর্বহারা হয়ে শুধুমাত্র পরনের কাপড়টি নিয়ে ডিঙ্গি নৌকা, স্পিডবোট, ছোট্টজাহাজ, মাছধরা জাহাজ, প্রমোদতরী যুদ্ধ জাহাজে শুধু প্রাণটা নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স থেকে ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসতে ব্যস্ত, যখন জার্মান বিমানগুলো অনায়াসে ওপর থেকে বোমা ফেলে তাদের ধ্বংস করতে পারে, ঠিক তখনই হিটলারের আদেশ এসেছিল ‘বন্ধ কর’। দিশেহারা জার্মান সেনাপতিরা ছুটে গিয়েছিলেন হিটলারের কাছে। লাভ হয়নি। চূড়ান্ত বিজয়ের মুখে লাগাম টেনে ধরা দিশেহারা উ™£ান্ত মোহনলাল ছুটে গিয়েছিলেন নবাবের কাছে। লাভ হয়নি। ততক্ষণে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ আর রায়দুর্লভ নবাবকে বুঝিয়েছেন বিজয় তো সুনিশ্চিতই, সৈন্যরা ক্লান্ত হয়েছে, কাল আবার যুদ্ধ হবে।

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। মোহনলালের সৈন্যরা অস্ত্র সংবরণ করে তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে। মীরজাফরের ইঙ্গিতে ক্লাইভ, ওয়াট্সন আর মেজর কিলপ্যাট্রিক পালটা আঘাত হানল। রায়দুর্লভ ইয়ার লতিফের সৈন্যরা খামাকা ছুটাছুটি করে নবাবের সৈন্যদের মধ্যে পরাজয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। রাজবল্লভ নবাবকে নানা কুকথায় ক্রমাগত আতঙ্কিত ও উ™£ান্ত করে তুলল, মীরজাফর সসৈন্যে ইংরেজদের পক্ষে যোগ দিল, দিশেহারা নবাব রণাঙ্গন ছেড়ে মুর্শিদাবাদের দিকে পালালেন। নবাবহীন মোহনলাল ও সিনফ্রে হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। বিকেল পাঁচটায় নবাবের তাঁবুতে উড়ল ইউনিয়ন জ্যাক। বিলেতের পতাকা।

নবাব মুর্শিদাবাদ মহল থেকে স্ত্রী লুৎফুন্নেছা আর শিশুকন্যা জহুরাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন পাটনা। ভগবানগোলা পার হয়ে গোদাগাড়ি থেকে নৌকা নিয়ে মহানন্দা নদীতে উজানে চললেন পাটনার দিকে। পাটনা কেন ? কারণ পাটনায় তখন নবাবের অনুগত পঞ্চাশ হাজার সৈন্য রাখা ছিল। কেন ? কারণ কিছুদিন আগে পারস্য সম্রাট আহমদ শাহ্ আবদালী দিল্লী দখল করেন। বাংলার দিকে আসতে পারেন এই ভেবে নির্ভীক নবাব ঘরে বাইরে শত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আহমদ শাহ্ আবদালীর মতো শক্তিশালী সম্রাটকে বাধা দেবার জন্য নিজের অর্ধেক সৈন্যকে এগিয়ে রাখেন পাটনায়। এদিকে পলাশীর ঘটনা চতুর্দিকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। শুনে ভাগলপুর (বিহার) থেকে মঁসিয়ে লালী সসৈন্যে এগিয়ে আসছেন মহানন্দার দিকে। নবাবকে উদ্ধার করে পাটনা পৌঁছে দেবেন অনুগত পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের কাছে। এই সেই ফরাসি মঁসিয়ে লালী, ইংরেজদের কুমন্ত্রণায় ভুলে যাঁকে নবাব কিছুদিন আগে সসৈন্যে নির্বাসিত করেছিলেন ভাগলপুরে। যাবার আগে অশ্রুসজল নেত্রে বলেছিলেন ‘নবাব, আপনি রাজনীতির ভুল পথে পা বাড়ালেন।’

অগ্রসরমান দু’পক্ষের মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধান। তার পরেই মঁসিয়ে লালীর শক্তিশালী আশ্রয়ে পৌঁছবেন নবাব। পাটনায় গিয়ে মিলিত হবেন অনুগত হর্ষোৎফুল্ল পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের সাথে। ফিরে আসবেন উন্মত্ত কালবৈশাখীর তাণ্ডবে। পালটা আঘাতে গুঁড়িয়ে দেবেন মীরজাফর-ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের দুর্গ। আর ভুল হবে না। কারণ ততদিনে শত্র“র মুখ চেনা হয়ে গেছে তাঁর। বাংলার মাটি থেকে মুছে দেবেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নাম। বাংলা ইংরেজদের উপনিবেশ হবে না। ভারতবর্ষ হবে না পরাধীন একশ’ নব্বই বছরের জন্য। নীলচাষ হবে না। আঙুল কাটা হবে না মসলিন তাঁতীদের।

শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেছে। সেই তিন ঘণ্টা এখনও স্তব্ধ হয়ে মহানন্দার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ॥

নীলিমা                                                  

“অতএব ভদ্রমহোদয়গণ ! বুঝতেই পারছেন যে আরো একবার সোনার বাংলা থেকে প্রভূত ফায়দা লুটতে যাচ্ছি আমরা। বৃটিশ নৌ ও বিমান বাহিনীর ইউনিফর্ম নীল হবে এই সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে সাথে কাপড়ের বাজারে পাকা নীল রঙের আকাশ-ছোঁয়া চাহিদা হয়েছে। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী চষে ফেলে ওই সোনার বাংলাতেই নীলের স্বর্ণপ্রসবিনী রাজহাঁস পেয়ে গেছি আমরা। তুঁতের মতো এমন পাকা নীল আর কোথাও নেই। বিজ্ঞানীরা যতদিন রাসায়নিক নীল আবিষ্কার না করছেন, ততদিন বাংলা সত্যিই ক্রমাগতভাবে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ভাণ্ডারে সোনা তুলে দেবে। এখন, ব্যাপারটা আয়ত্তে রাখবার জন্য চটপট কিছু কোম্পানী-আইন পাশ করা দরকার, এবং স্থানীয়ভাবে কিছু নীলকর নিয়োগ করা দরকার। বলাই বাহুল্য, নীলকররা হবেন বৃটিশ।”

হয়ে গেল। বাংলার চাষির পর্ণকুটির থেকে অর্ধ-গোলার্ধ দূরে সুদূর লণ্ডনে লাল-সাদা ব্যবসায়ীদের সভায় সুপ্রচুর খাদ্য পানীয় সহযোগে নির্ধারিত হয়ে গেল বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষকেরা কিভাবে বাঁচবে, অথবা আদৌ বাঁচবে কি না। মনুসংহিতায় আছে জমি তারই, যে জঙ্গল পরিষ্কার ক’রে চাষ করে। জন্মান্তরের সে অধিকার কোন শুভঙ্কররের আইন গলে উধাও হয়েছে আগেই। লিখিত অলিখিত হরেক রকম খাজনা ও বাঙালি নায়েব-গোমস্তার অমানুষিক অত্যাচারে ইতিমধ্যেই সে ন্যুব্জদেহ। এবার সরল অসহায় কৃষকের জীবনে দুর্বোধ্য জটিলতা নিয়ে কেয়ামতের মতো নেমে এল নীল।

১৮০০ সালের গোড়ার কথা সেটা। বাপ-দাদার আমল থেকে যে জমি শুনে এসেছিল দু’বিঘা সেটা প্রভুভক্ত আমিন সাহেব মেপে লিখছে দেড় বিঘা। দেড় বিঘার আগাম গুঁজে দিচ্ছে হাতে। ফসল গুনে বারো কুড়ি আঁটি নিয়ে যাচ্ছে নীলকুঠিতে। নায়েব লিখছে দেড়শ’। নায়েব যা বলে তাই শুনে কাগজে টিপসই দিতে বাধ্য হয় চাষি। সবচেয়ে সেরা জমিগুলোকে দাগ দিয়ে গেছে বাঙালি আমিন। নীল ছাড়া আর কিছু সেখানে চাষ করলেই বেআইনী। ধরে নিয়ে হাতে কিছু টাকা গুঁজে জোর করে টিপসই নিয়েছে নীলের দাদন। আগাম। হাতে এসেছে বিশ, কাগজে লেখা থাকল পঞ্চাশ। চাষি পড়তে লিখতে পারে না। আরো লেখা আছে নীলের দাদন নীল দিয়েই শোধ দিতে হবে, অন্য কিছু দিয়ে নয়। এমনকি নগদ দিয়েও নয়। বাবা যদি হঠাৎ মারা যায়, ছেলের ঘাড়ে বর্তাবে দাদন। আগাম না নিতে চাইলে অবর্ণনীয় অত্যাচার। কান্নায় ভেঙে পড়ে চাষি-বৌ, শিশু সন্তান আতঙ্কে জড়সড় হয়ে সিটিয়ে থাকে দাওয়ার বেড়ায়। চোখের সামনে বাবাকে পেটাতে পেটাতে ধরে নিয়ে যায় সাহেবের প্রভুভক্ত বাঙালি অনুচর। দিনের পর দিন নীলকুঠি থেকে ভেসে আসে করুণ আর্তনাদ।

কে এই সহজ সরল বুকভাঙা চাষি ? কে ওই আঙিনার মাটিতে হাহাকারে ভেঙে পড়া-চাষি-বৌ ? কারা ওই আতঙ্কে-ত্রাসে বিস্ফারিত চোখ, মানসিক জগত লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া শিশুর দল ? আর কেউ নয়। তোমার আমার পূর্বপুরুষ। যার শরীর থেকে শরীর নিয়ে, যার স্নেহসিক্ত লালনপালনে আজ তোমার আমার সামগ্রিক অস্তিত্ব।

মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে অর্ধভুক্ত কৃষক পরিবার। কোথায় মুক্তি ? কোথায় পরিত্রাণ ? সরকার ? হ্যাঁ, তা অবশ্য আছে। সেই যে নবাব সিরাজোদ্দৌলার কাছে ওয়াট্সন সাহেব মিনতিমাখা চিঠি লিখেছিল‘আমাদের মতো ন্যায়পরায়ণ জাতি পৃথিবীতে আর নেই...’, সেই ‘ন্যায়পরায়ণ’ জাতির বানানো সরকারি আদালত ও জজসাহেবরা তো আছেনই। রক্ষা করবার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত। তবে কিনা, সাদা চামড়ার জজসাহেব এবং সাদা চামড়ার নীলকর সাহেব পিরিতের সাথে একত্রে সখ্যতা ও মদ্যপান করেন। তাই দু’চারবার ঠকাস হবার পর কোনো ন্যাড়াই আর বেলতলায় যেতে চায় না। তাছাড়া, বিস্তীর্ণ গ্রাম্য অঞ্চলে সাধারণ আদালত নেই তো কি হয়েছে, পাক্কা আইন অনুযায়ী সেখানে নীলের ব্যাপারে বিশেষ আদালত তো আছেই, একেবারে হাতের কাছেই। শুধু হাতের কাছেই নয়, একেবারে মাথার ওপরে, কালনাগিনীর মতো। কারণ, স্বয়ং নীলকর সাহেবই সে আদালতের বিচারক, তাই নীলকর সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে স্বয়ং নীলকর সাহেবের আদালতে গেলেই তো হয় !

ভ্যালা রে নন্দলাল !

মহা একটা তোগলকী কাণ্ড। মানবজাতির সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার ব্যাপারে মহাপুরুষরা তর্জনী তুলে পইপই করে বলে গেছেন নিরানব্বই জন অপরাধীকে যদি শাস্তি দিতে না-ও পারো, খবরদার, খবরদার, যেন একজনও নিরপরাধ শাস্তি না পায়। সেটা অনেক বড় ব্যর্থতা এবং কলঙ্ক। অন্য অনেক মূল্যবোধের জনক এই উপদেশের গালে এমন সশব্দে চপেটাঘাত মানবজাতির ইতিহাসে অনেকবারই পড়েছিল, ওই ‘ন্যায়পরায়ণ’ জাতি দ্বারা।

তারপর পেট যখন পিঠে ঠেকল আর পিঠ ঠেকল দেয়ালে, মরিয়া হয়ে একবার শেষ চেষ্টা করল অর্ধমৃত নীলচাষি। ঠিক সেই সময়টাতেই নারকেলবেড়িয়ায় তীতুমীরের প্রাথমিক দু’টো সামরিক জয়লাভে উৎসাহ পেল নীলবিদ্রোহ। নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন হাজী শরিয়তউল্লাহ্ পুত্র দুদু মিয়া, দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ ঘোষ। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত নেতৃত্বে চাষার লাঙল চালানো কঠিন হাতে উঠে এল সড়কি বল্লম। তাই দেখে পিতৃনাম ভুলে সাহেবগিরি পেছনে ফেলে উল্কাবেগে কলকাতায় ছুটলেন নীলকর সাহেবরা। সামরিক বাহিনীর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লেন। নায়েব-গোমস্তারা একাত্তরের আলবদরের মতো সুড়–ৎ করে গর্তে ঢুকে পড়ল। দাড়িওয়ালারা দাড়ি কেটে ধুতিতে, আর ধুতিওয়ালারা লুঙ্গি পরে দাড়িতে লুকোল। কিছু খুনখারাপিও হল।

বাংলা সংস্কৃতির পাদপীঠ কলকাতায় তখনো চিরকালের মতোই ফুল পাখি চাঁদ আর প্রেমিকার মুখ নিয়ে বিস্তর ধ্বস্তাধ্বস্তি করছেন কবি লেখকরা। নেতা, পাতিনেতা আর উপনেতারা প্রতিযোগিতামূলকভাবে জিহ্বা দিয়ে প্রভুদের বুটগুলোকে আরো চকচকে করে তুলছেন। আঁতেলরা কচু আলু আদা মিলে ক্বচাল্লাদা কিংবা পাত্রাধার তৈল নাকি তৈলাধার পাত্র তার বিশ্লেষণে খুব ব্যস্ত। শুধু জননীর নিঃশব্দ অশ্রু দেখে না কেউ। জাতির মুখে যে অন্ন তুলে দেয় সেই কৃষকের সশব্দ আর্তনাদ কানে যায় না কারো।

শুনলেন শুধু একজন। এমন কিছু মহাপ্রতিভাবান মহাপণ্ডিত নন, নন সুপ্রচুর লেখার লেখক। তবু হাতে তুলে নিলেন কলম। গোর্কির ‘মা’ লেখা হয়েছিল বিপ্লবের পরে - মাতৃহৃদয়ের শাশ্বত আর্তনাদ এখনো ধারণ করে আছে সেটা। ‘নীলদর্পণ’ নাটক লেখা হল পরিবর্তনের পথিকৃৎ হিসেবে। লেখক দীনবন্ধু মিত্র নামের মান রাখলেন। দীনের বন্ধু হলেন, মিত্র হলেন। ঘাড় ধরে কলকাতার পুরো বাঙালি সমাজটাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের আঙ্গিনায়। ১৮৬১ সালে ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনীত হলো কলকাতায়। আঁতকে উঠল কলকাতা। নীলের দর্পণে কৃষকের ভগ্ন মেরুদণ্ড আর নিজের কদাকার চেহারাটা ফুটে উঠল। বিচলিত হলেন আরেকজন। সাদা চামড়ার লং সাহেব। পাদ্রী মানুষ। নিজের জাতের শয়তানী চেহারা দেখে আর থাকতে পারলেন না। ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজীতে অনুবাদ করে ছুড়ে দিলেন লণ্ডনের জনতা আর মন্ত্রীসভার মুখের উপর। মুচকি হাসিটি মনে লুকিয়ে গম্ভীর মুখে মিটিংয়ে বসল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বড়কর্তারা। বাইরে তখন জনতা আর পত্রিকাগুলো প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে নীলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সব জাতেই ভালোমন্দ মানুষ আছে।

আশ্চর্য্য এই জাত। মহারাজ নন্দকুমারের অন্যায় ফাঁসির পর এরাই উল্লাসে ফেটে পড়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার পর এরাই পদকভূষিত করেছে গণহত্যাকারী জেনারেল ডায়ারকে। সাইপ্রাসে শুধু দৃষ্টি-সুখের উল্লাসে শিশুহত্যার পর এরাই বরফ থেকে বিড়াল শিশু বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়েছে (মধ্যরাতের অশ্বারোহী, ফয়েজ আহমেদ)।

মিটিংয়ে সদস্যরা যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। সর্বনাশ ! নীলের নামে একি হচ্ছে বাংলায় ! শুধু চাষ করারই তো কথা ছিল, অত্যাচার করার তো কথা ছিল না ! না না এ হতেই পারে না। সাধারণ কৃষকের মঙ্গলই তো সরকারের দায়িত্ব। কাজেই নীলচাষ বন্ধ ঘোষণা করা হল।

ধন্য ধন্য পড়ে গেল দীনবন্ধু মিত্রের নামে যা অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য ছিল। ওদিকে মিটিং শেষে মুচকি হেসে গবেষণাগারের রিপোর্টটা দেরাজ বন্ধ করলেন দপ্তর সম্পাদক। রাসায়নিক নীল আবিষ্কার হয়ে গেছে। দামও খুব সস্তা। কাজেই, তুঁতের আর দরকারই নেই।

নীলাম্বু জলধিমণ্ডিত সসাগরা ধরিত্রী। নীলাঞ্জনা ঢেউ খেলে তার সর্ব অঙ্গে নিরন্তর।  নিঃশব্দ নিথরে, নিস্পন্দ নীরবে সতৃষ্ণ মাতৃমুখের মতো  ধরণীর মুখের ওপরে নুয়ে থাকে নিঃসীম নীলাকাশ। নীল পাপড়ির ফুল, নীল পালকের পাখি আর নীলাভ মাছের উৎসবে প্রকৃতি ভরপুর। নীলাদ্রী বরফের ওপর দিয়ে ধীরে বয়ে যায় নীলমেঘ। নীলনবঘনে রবীন্দ্রকাব্যের বর্ষণে আচ্ছন্ন হয়ে আসে নদীর ওপারের গ্রাম। শরীরের, মনের কষ্টে নীল হয় মানুষের মুখ। সমুদ্রমন্থনের গরল কণ্ঠে ধরে নীলকণ্ঠ হন মহাদেব। সাপে কাটা মৃতদেহ নীল হয়ে পড়ে থাকে। নীলকুঠি থেকে ভেসে আসা আর্তনাদের স্মৃতি আজো বাংলার পথে-প্রান্তরে হাহাকার করে ওঠে বাউকুড়ানির বাতাসে। নীলের নীলমণিহার কণ্ঠে ধারণ করে স্তব্ধ হয়ে থাকে বাংলার ইতিহাস। “মিথ্যেই, নীল খোঁজা মন চায় উপমা। নেই, নেই।”

হেমন্তের দরাজ গলায় বেজে ওঠেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।

না, এ নীলের উপমা সত্যিই নেই কোথাও ॥

                                  ধ্রুবতারা

                       

                       

রাত।

শুধু সূর্য ডুবে যাবার ভৌগোলিক ব্যাপারটাই নয় ; অভ্যাসের, চেতনার, চরিত্রের আমূল পরিবর্তনের নিয়ামক। ‘নিশীথের কত পরম সত্য, ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় প্রাতে’ (হাফিজ)। কত রকমেই যে এ রাত কাটে ! নিদ্রায়, তন্দ্রায়, জাগরণে। গবেষণাকারীর রাত, রুগ্ন সন্তানের মায়ের রাত, সান্ন্যাসী-নামাজীর রাত, চোরের রাত, প্রবঞ্চিত প্রেমিকের রাত, শিশুর রাত, বৃদ্ধের রাত, ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিকের রাত, সংখ্যাহীন। নিকষ কালো আকাশ ঢেকে রাখে বিশ্বচরাচর। ঝিকমিক করে অসংখ্য ছোট-বড় তারা।

পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যখনই তারাভরা রাতের দিকে তাকিয়েছি, মনে হয়েছে বাংলায় দাঁড়িয়ে আছি। মুখ নামালেই দেখতে পাবো সেই খাল, বিল, নদী, গ্রাম, সেই গাছপালা আর কল্জের টুকরো সেই মুখগুলো। মিটিমিটি হাসে লক্ষ তারার দল। কিছু বলতে চায় বুঝি ! মানুষ মরলে নাকি তারা হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। রাতের আকাশে খুঁজতে ইচ্ছে করে প্রপিতামহদের, আর খুঁজতে ইচ্ছে করে তাঁদের, যাঁরা রক্তমাংস উৎসর্গ করে গড়ে গেছেন আমাদের বর্তমান ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কাঠামো। আমাদের দু’শো বছরের ক্রীতদাসের জীবন, যাঁদের ব্রহ্মাস্ত্রে দানবের সে বজ্রমুষ্ঠি শিথিল হয়ে এসেছিল। না হলে, রাজনৈতিক গোলটেবিল তো চলছিল সেই ১৮৮৫ কিংবা ১৯০৬ থেকেই, যখন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল বোম্বে আর ঢাকায় দুই বাঙালি দ্বারা সুরেন্দ্রনাথ ও স্যার সলিমুল্লা। নাহয়, সেটা আরো দু’শো বছর চলত। দিচ্ছি-দেব’র খেলা চলতেই থাকত যদি না দধিচীর হাড়ে গড়া অস্ত্র হাতে বুকে স্বাধীনতা আগলে দাঁড়াত সেই শস্ত্রপাণির দল।

    ‘ওরা বিদ্রোহী, ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়

    ওদের কাহিনী বিদেশির খুনে,

    গুলি বন্দুক বোমার আগুনে আজো রোমাঞ্চকর।’

মিটিমিটি তারারা হাসে আকাশে। ব্যাকুল হয়ে খুঁজি। ঐ তো, ঐ দপদপে উজ্জ্বল, ওটা নিশ্চয়ই সূর্য সেন ! আর ওই ছোট্ট দুটো বারো বছরের ক্ষুদিরাম আর বারো বছরের ফুলেশ্বরী ! ঐ তো বিনয়, বাদল, দীনেশ প্রীতিলতা, লোকনাথ, ট্যাগরা...

‘কি হল? থমকে গেলে কেন ?’

‘খটকা লেগেছে। তুমি কে ?’

‘ওদেরই একজন। খটকাটা কি ?’

‘ওদের আত্মত্যাগের কথা ভাবলে আমার সব অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যায়, বলেছেন গান্ধীজি। সমস্ত

     জাতি নতমস্তকে স্বীকারও করে তা। কিন্তু এই নামগুলোর মধ্যে মুহম্মদ অমুক কিংবা অমুক

     রহমান নেই কেন ?’

‘কে বললে নেই ? বাহান্ন উনসত্তর একাত্তরে যারা স্বাধীনতার জন্য কালনাগিণীর ফণা জাপটে

       ধরবে, বিশ ত্রিশ দশকের তারা কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে কখনো ?’

‘কিন্তু দলিল দস্তবেজে ওদের সামনে বিশেষ পাই না।’

‘তা অবশ্য সত্যি। মা কালীর সামনে নিজের রক্ত দিয়ে শপথ গ্রহণটাই এর জন্য দায়ী। সেটা

     একটা ভুল তো বটেই, কিন্তু তাই বলে সে অনাদি ধ্বনি কি স্তব্ধ হয় কখনো ? হয় না।’

অন্ধকার তারাভরা রাত। ইন্দ্রিয়-অতীন্দ্রিয়ের সীমানায় দুলছি। ‘পারিনে ভাসিতে কেবলি মূরতি স্রোতে, তুলে নাও মোরে আলোকমগন মূরতি ভূবন হতে’- সুরদাসের এ প্রার্থনা যেন পূর্ণ হয়েছে। অবয়বের সীমা পার হয়ে সবাই যেন কোন মায়ার রাজ্যের চলে গেছে, দেহ থেকে দেহাতীত, শব্দ থেকে সুরের ভুবন। সীমার রাজ্যে ধীরে ধীরে ঢুকছে অসীমের প্রবাহ, উল্টে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতা। অস্পষ্ট ধূসর একটা ছায়া ধীরে ধীরে কায়া হয়ে ফুটে উঠছে। একটু স্পষ্ট হয়ে এসেছে চেহারাটা। মাথায় তুর্কি টুপি, ঘন দাড়িতে আচ্ছন্ন নূরানী চেহারা, তীক্ষ্ণ দুটো হাস্যময় উজ্জ্বল চোখ, শেরোয়ানী-আচকানে দিব্যি এক কোরানের মাস্টার।

কিন্তু চেহারাটা এখন গম্ভীর। পাশে বসা বাল্যবন্ধুর মুখও গম্ভীর।

“এ ছাড়া উপায় নেই কোনো। তুই ছাড়া উপায় নেই”।

শেরোয়ানীর দিকে তাকালেন বেঙ্গল ভলাণ্টিয়ার্স প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিনায়ক মহাবিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ। সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের মতো শতশত বিপ্লবীর মহাগুরু। বললেন:-

“পাঁচ বছর জেল খেটে বেরোলাম। এ মুহূর্তে আঘাতের দিকে যাবো না আর। পাঁচ থেকে সাত

    বছর শুধু প্রস্তুতি নেবো। শুধু রিক্রুটিং আর ট্রেনিং। কারণ আমরা সবাই চিহ্নিত। হাঁচি

    দিলেও পুলিশ টের পায়”।

“চিহ্নিত। অর্থাৎ বিখ্যাত। হা হা হা। বিখ্যাত হবার এই শাস্তি। হাঁচি দিলেও লোকে টের পায়।

    তা, কি করতে হবে ?’

“নিউক্লিয়াসটা টিকিয়ে রাখতে হবে। এবং বাড়াতে হবে”।

“অর্থাৎ বসে বসে বিপ্লবের ডিমে তা’ দিতে হবে। মাপ কর দোস্ত, ঘরে বসে বিপ্লব করার ম্যালা

     লোক আছে। আমার দ্বারা হবে না”।

“হবে। মাত্র পাঁচ বছর”।

হেমচন্দ্রের আবাল্যের সাথী, ঢাকার বেচারাম দেউড়ি স্কুলের সতীর্থ, বি.ভি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, একই অগ্নিবীণার দুই বাদক, একই অসাধ্য সাধনের দুই সাধক।

“তুই কোরাণের মাস্টার, কেউ তোকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না। এ সুবিধেটুকু তোর আছে”।

তা আছে। কাজে লাগল সেটাই। পুলিশ-ভোলানো সংসারী হয়ে পড়লেন নেতৃবৃন্দ, বিপ্লবের সাথে সম্পর্কই রাখলেন না আর। ডিম কিন্তু পচল না। আরো সম্পৃক্ত, আরো পরিপক্ক হতে থাকল, আকারে এবং প্রকারে। অমুক চক্রবর্তী, তমুক সেনদের সাথে এগিয়ে এল নঈমউদ্দিন আহমদ, সালেউদ্দিন, আব্দুল জাব্বার, সালাহউদ্দিন-এর দল। নিভৃতে নিশ্চুপে এগিয়ে গেল বিপ্লব। কার হাতে? ভবিষ্যতের সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের পায়ের নিচের ভিত্তি শক্ত করে গড়ে দিল কার দুটো হাত? লোম্যান, কামাখ্যা সেন, পেডি, আহসানুল্লাহ, ডগলাসের মতো গণশত্রুদের মৃত্যু নির্ধারিত করে বাংলার দামাল বিদ্রোহের রূপরেখা আঁকলেন কোন্ সে রূপকার ?

‘সঙ্গোপনে মুসলিম তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম ও বিপ্লবের বাণী প্রচার করে গোপনতম সংস্থা-নিউক্লিয়াসকে অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব অবশ্য তাঁর ছিলই’- (ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব - ভুপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী)।

“এক ধ্রুবতারা দেখে মানুষ চিরকাল পথের সন্ধান পেয়েছে। তোদের আকাশে এত ধ্রবতারা, তবু তোরা পথভ্রষ্ট কেন ?”

মুহম্মদ আলীম উদ্দিন।

যাঁর নামে আলীমুদ্দীন স্ট্রিট আছে কলকাতায়। হিন্দুদের এক অংশ যাঁর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উল্লেখই করতে চায় না। মুসলিমদের একটা অংশ যাঁর গৌরবময় অবদান নিষ্ঠুর উদাসীনতায় ভুলে গেছে।

আমরা কেউ তাঁকে মনে রাখিনি॥

                                             

                               নাটের গুরু !

                  

অ-তে অজগর, আ-তে আম, ই-তে ইঁদুর, ঈ-তে ঈগল...।

ধুমসে চলছে বাংলা ক্লাস। বৃটিশ রাজত্বের রাজধানী কলকাতায়। ১৯১৫ সালে দিল্লীতে স্থানান্তরের আগে পর্যন্ত কলকাতাই ছিল রাজধানী। প্রচুর পরিশ্রম করছেন বৃটিশÑভারতের মিলিটারি সেক্রেটারি অর্থাৎ সমর সচিব। খোদ বড়লাটের পরেই পদটার দায়িত্ব ও মর্যাদা। জনমানস চিনতে ভাষা জানা দরকার। তা ছাড়া বেঙ্গল প্রদেশটা তাঁর মাথাব্যথার কারণও বটে। সুজলা সুফলা হলেও এরকম অগ্নিগর্ভ প্রদেশ ভারতে আর নেই। ভবিষ্যতের সূর্য সেন, আলীমুদ্দীন, ক্ষুদিরামের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন তিনি। তাই এ চেষ্টা। কপালগুণে মাস্টারও পেয়েছেন চমৎকার - বাঙালি এবং প্রতিভাবান, আর প্রচণ্ড বিপ্লবী-বিদ্বেষী। সব উচ্চপদের সাহেবরা তাই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিপ্লবী-দমনের গোপন শলা-পরামর্শ তাঁর সাথেই করেন সমর সচিব। ধীরে ধীরে তেতে উঠছে বাংলা। অঘটন-ঘটনপটিয়সী জাত, কবে আবার কি করে ফেলে !

করে ফেললও। পৃথিবী কাঁপানো সংবাদ ২৩শে জুন ১৯১২ সালে। বোমা পড়েছে স্বয়ং বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর ওপরে - তিনি ভাগ্যগুনে বেঁচে গেছেন। ক্রোধে উন্মাদের মতো ইণ্টেলিজেন্স বিভাগের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমর সচিব। বোমা মেরেছে কোনো পালোয়ান নয় একটা কিশোরী মেয়ে ! ফুটফুটে মেয়েটা, লীলাবতী, কিভাবে পালালো ? কে সে ? কোথাকার মেয়ে ? এত বড় একটা ঘটনা, কেন কেউ আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না ? ইণ্টেলিজেন্স কি ঘোড়ার ঘাস কাটছে বসে বসে ?

প্রাণপাত করল ইণ্টেলিজেন্স। দীর্ঘ দু’বছর পর তদন্ত রিপোর্ট হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বড়লাটের কাছে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলেন স্বরাষ্ট্র সচিব। রিপোর্ট পড়ে চোখ কপালে উঠে গেল হার্ডিঞ্জ সাহেবের। লীলাবতী আদপে মেয়েই নয় ! শাড়ি প’রে এসেছিল বসন্ত বিশ্বাস। বাংলারই দামাল কিশোর। আর এ নাটকের নাট্যকার ? নেপথ্যের সর্বাধিকারী নির্দেশক ? আর কেউ নয়, প্রবল বিপ্লবী-বিদ্বেষী ইংরেজের সুহৃদ সেই বাংলার মাস্টার যে কিনা বোমা বর্ষণের পর দেরাদুনের প্রকাশ্য জনসভায় অনলবর্ষী বক্তৃতায় বিপ্লবীর ফাঁসি দাবি ক’রে কেঁদে রুমাল ভিজিয়ে ফেলেছিল ! “বোমা নিক্ষেপের ব্যাপারে ওই লোকটাই ছিল নাটের গুরু” (মাই ইণ্ডিয়ান ইয়ার্স, ১৯১০-১৯১৬ - লর্ড হার্ডিঞ্জ)। ধর, ধর ব্যাটাকে। পুলিশ, মিলিটারি সব একসাথে ছুটল তাঁর আস্তানায়।

গুরু হাওয়া হয়ে গেলেন চোখের পলকে। যেন মন্ত্রবলেই। লাটে উঠে গেল বাংলার ক্লাস আর লোক-দেখানো বিপ্লবী-দমন পরামর্শ। শুরু হলো লুকোচুরির বিশ্বরেকর্ড। বিশাল ভারতবর্ষ। আজ বাংলা তো কাল পাঞ্জাব, আজ মাদ্রাজ তো কাল আসাম। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ভানুমতির খেল খেলে চলেছেন গুরু ! আর পেছনে ছুটছে ঘর্মাক্ত সেপাই-শান্ত্রীদল। নাম বদলের, বেশ বদলের, রূপ বদলের, ঠিকানা বদলের ইয়ত্তা নেই। অস্থির হয়ে উঠল বৃটিশ শাসন ব্যবস্থা। কখনো টিকি বাঁধা উড়ে বাবুর্চি, কখনো বিষ্ঠার টিন মাথায় ব্যস্ত মেথর, কখনো বিয়ে পড়ানো পণ্ডিতজী, কখনো শব-মিছিলে আরামে শায়িত মৃতদেহ, কখনো রাগ-রাগিণীর আত্মহারা বেহালা বাদক সেই মাস্টার-অব-অল-ট্রেডস জ্যাক অব্ নান। বছরের পর বছর কেটে গেল, কানামাছি ভোঁ ভোঁ চলছেই।

কিন্তু এই বিপজ্জনক লুকোচুরির মধ্যেই পালটা আঘাত হানলেন সেই আশ্চর্য্য কর্ম-দানব। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শত্রুকে আঘাত হানার এই তো সময় ! কাবুলে গড়ে উঠেছে মহেন্দ্র প্রতাপ, অজিত সিং অম্বাপ্রসাদ আর মওলানা বরকত উল্লার নেতৃত্বে প্রবাসী স্বাধীন ভারত সরকার (জার্মানি, তুরস্ক তাকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল)। কাবুল থেকে থাইল্যাণ্ড পর্যন্ত লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে আবার সিপাহী বিপ্লবের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। পুরো ভারতবর্ষের আয়োজনে আছে পাঞ্জাবি কর্তার সিং, মারাঠি পিংলে, আর বাংলার এই নাটের গুরু। ব্যস্ত, ব্যস্ত, ব্যস্ত !!

হলো না। কতিপয় মীর জাফর এখানো আছে, তখনো ছিল। মীরজাফরদের গোপন খবরে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক দানব, একাত্তরের বাংলাদেশের মতো। ব্যর্থ হয়ে গেল লক্ষ লক্ষ মুক্তিসেনার বুকের রক্ত। ধরা পড়ল, মারা পড়ল প্রায় সবাই। আর সেই বাঙালি অধিনায়ক একেবারে রাজবেশ পরে সোজা গিয়ে হাজির পাসপোর্ট অফিসে। “আমি রাজা পি. এন. ঠাকুর। নোবেল-লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়। জাপান সম্রাটের আমন্ত্রণে কবি জাপান যাচ্ছেন তো, আমাকে তাঁর আগে যেতে হচ্ছে ওখানকার আয়োজন তদারক করতে, এমিসারী হিসেবে।”

‘ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার ট্যাগোর-এর জাপান যাবার কথা জানি আমরা। আপনি প্লিজ একটু বসুন, এই পাঁচ মিনিট।”

পনেরো মিনিটের মাথায় পাসপোর্ট। ২২শে জুন হারুকিমারু জাহাজের বারান্দা থেকে শেষবারের মতো দেখে নিলেন স্বদেশের মাটি। অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ওয়ান ফাইট মোর, দ্য লাস্ট অ্যাণ্ড দ্য বেস্ট।’

জাপানে পৌঁছানোর খবরটা যেন চড় হয়ে চটাশ করে পড়ল বৃটিশের গালে। সাথে সাথে শুরু হলো অপমানিত সিংহের গর্জন। সাঁড়াশীর মতো চেপে ধরল জাপান সরকারকে – ‘আমাদের বিদ্রোহী ফিরিয়ে দাও, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে। ওদিকে জাপানের সরকার-বিরোধী পার্টি জনগণকে বোঝাচ্ছে, দেশপ্রেমিক লোকটাকে খুন হবার জন্য বৃটিশের হাতে তুলে দেবে ভাই !

না ! প্রতিবাদের ঝড় তুলে ফেলল জনতা আর সংবাদপত্রগুলো, ও আমাদের অতিথি। জাপানি আতিথেয়তার শতাব্দী-প্রাচীন ঐতিহ্যে কলঙ্ক লাগতে দেব না। ততদিন আন্তর্জাতিক অদৃশ্য রাজনীতিতে আর জাপানের ভেতরে এই নিয়ে মহা হুলুস্থুল বেধে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সদ্য বিজয়ী ইংল্যাণ্ড চাপ দিয়ে চলেছে লীগ অব্ নেশন্স (জাতিসঙ্ঘের পূর্বসুরী)-এর মাধ্যমে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা জাপান সরকারের নেই। দিনে দিনে ভেঙে পড়ল তার মেরুদণ্ড। বিদ্রোহীকে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল সংসদে। দিনক্ষণও ধার্য্য হয়ে গেল। পাশবিক উল্লাসে ফাঁসির দড়ি পাকাতে শুরু করল বৃটিশ। পলকের জন্য থমকে গেল বহমান ইতিহাস - বিশ্ব রহিল নিঃশ্বাস রুধি, নিভায়ে সূর্যতারা।

“হল না”। দীর্ঘশ্বাসে বন্ধু সোমার দিকে তাকালেন বিরোধী দলের নেতা তোয়ামা। “লোকটাকে বুঝি আর বাঁচানো গেল না হায়েনার হাত থেকে।”

“একটা উপায় আছে। মাত্র একটা।” বাসায় ফিরে সোমা তাঁর স্ত্রীকে বললেন, “মাত্র একটা উপায় আছে।”

স্ত্রী তাকালেন কন্যার দিকে, “মাত্র একটা উপায় আছে মা।”

নতস্বরে বললেন কন্যা তোশিকো, “আমি জানি। আমি, আমি রাজি আছি।”

ব্যস্। দূর-দ্বীপবাসিনীর এক মধুর সম্মতিতে বাংলার তথা ভারতবর্ষের ভবিষ্যত ছুটল তার অনির্ধারিত পথে, নির্ধারিত হয়ে গেল নিয়তি। বিশাল একটা জাতির নিয়তির ওপর যে কে কোথায় কিভাবে অবদান রেখে যায়, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ধন্য। ধন্য তোশিকো। ভবিষ্যতের আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য তৈরি হয়ে গেল ইষ্ফল-বার্মা, মণিপুর, কোহিমা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যাণ্ড। কলকাতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল নেতাজীর গ্রহ-নক্ষত্ররা। মহাকালের ডাক এসেছে ঐ, মাভৈঃ! মাভৈঃ! এদিকে বিয়ের উৎসব উল্লাসে ফেটে পড়ল সমস্ত জাপান। এ এখন আমাদের জামাই ! দেখি, কোন্ শালা গায়ে হাত দেয় !

লেজ গুটিয়ে নিল জাপান সরকার। উদ্যত কালফণা গুটিয়ে নিল বৃটিশ। ক্রোধে ক্ষোভে হাত কামড়াতে লাগল। বড়লাটের গায়ে হাত তোলা লোক, এভাবে পার পেয়ে যাবে !

ধনী দেশ, বড়লোক শ্বশুর, পারিবারিক মাধুর্য্যরে হাতছানি। তবু, মনের মধ্যে কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে ! মনের সৈকতে বার বার এসে আছড়ে পড়ে বহু পুরোনো একটা ঢেউ। সারি সারি মুখ, বেশির ভাগই খুন হয়ে গেছে বৃটিশের হাতে। অগণিত সেই মৃতদেহ কি শুধু ইতিহাসের ডেস্ক্রিপ্শন হয়েই থাকবে ? মহামুক্তির প্রেস্ক্রিপশন হবেনা কখনো? কত লক্ষ মুক্তি-পাগল মানুষ দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গেছে শুধু দেশটিকে স্বাধীন করবার চেষ্টায়। সে চেষ্টা আর কি হবে এই এতদূরে, এই বয়সে ! শুরু করেছিলেন কত বছর আগে বাংলার সেই দামাল কিশোর। আজ পেরিয়ে গেছে মাঝ বয়স। তবু উঠে দাঁড়ালেন। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিলেন আহ্বান - এসো ভাই, আর একবার চেষ্টা করে দেখি।

ফিরে তাকাল ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরের লক্ষ লক্ষ ভারতীয়। কে ! কে কথা বলছে ! আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে কার উদাত্ত আহ্বান, এসো ভাই, আর একবার চেষ্টা করে দেখি ! প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে দু’দুটো সিপাহী বিপ্লবও। কিন্তু সাফল্যের ভিত্তি গড়ে গেছে তারা নিজেদেরই হাড়ে গড়া ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে। এসো ভাই, একবার চেষ্টা করি।

এক থেকে দুই, দুই থেকে চার। অবাক বিস্ময়ে সারা পৃথিবী দেখল, ধীরে ধীরে প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো লক্ষ লক্ষ বুকে জেগে উঠছে শতাব্দীর ক্ষুধিত দেশপ্রেম। বন্যার মতো এগিয়ে এল মানুষ, জাপান থেকে বার্মা পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ। ত্যাগের পর ত্যাগ, সারা দূরপ্রাচ্য জুড়ে গঠিত হয়ে গেল সেনাবাহিনী ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ। কেন্দ্র তার টোকিও, গুরু তার কর্ণধার। বিরাট সেনাবাহিনীকে গুছিয়ে তুলছেন মোহন সিং, সাথে আছেন মেজর শাহ্নেওয়াজ, মেজর ধীলন। ওদিকে সুদূর বার্লিন থেকে ভেসে আসছে মহাকালের বরাভয় - “আমি সুভাষ বলছি। মনে রেখো, পরাধীনতার চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই...।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল তরঙ্গের দুই প্রান্তে দুই বাঙালি কর্ণধার নিজেদের ছোট্ট মনপবনের নাওটাকে কিনারায় ভেড়াবার জন্য ব্যাকুল। ইউরোপে গঠিত হয়ে গেছে আজাদ হিন্দ ফৌজ। এদিকে ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ। পৃথিবীর দু’ধারে দুটো মত্ত আবেগ পরস্পরকে আলিঙ্গন করার তাগিদে ফুলে ফুলে উঠছে। গল্প নয়। তোমার আমার ইতিহাস, বিদেশের মাটিতে।

সুদূর ইউরোপের চেয়ে দূরপ্রাচ্য থেকে আক্রমণটাই বেশি সুবিধেজনক। তাছাড়া সমগ্র এশিয়ার একমাত্র স্বাধীন দেশ জাপান। জেনারেল তোজো সরকার গঠন ক’রে প্রথম থেকেই বলছেন, “এশিয়া র্ফ এশিয়ান্স, গো হোম হোয়াইট্স্।” তাঁর কাছে দাবি গেল- “আমার বয়স হয়েছে। সুভাষকে এনে দাও। তাঁর অধীনে শেষ ক’টা দিন কাজ করতে চাই।” ওদিকে বার্লিনেও তাই। “আমাকে জাপান পাঠাও। তার অধীনে সেপাই হলে গর্ববোধ করব আমি সুভাষচন্দ্র বোস।” (হায়! আমাদের আজকের নেতারা!) কিন্তু ততদিনে হিটলারের পরাজয়ের ঘণ্টা বেজে উঠেছে। রাশিয়া আক্রমণ ক’রে নিজের পায়ে কুড়ল মেরেছে প্রায় বিশ্বজয়ী জাতটা। তবু, হিজ এক্সেলেন্সি চন্দ্র বোসের অনুরোধের একটা দাম আছে। জোগাড় হলো সাবমেরিন। মেজর আবিদ হাসানকে নিয়ে তিনমাসের সাবমেরিনে জাপান।

যেন শতাব্দীর সাথে শতাব্দীর দেখা হলো। মানবাধিকারের দুই অতন্দ্র প্রহরী, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একজন নবীন, একজন প্রবীণ। নবীনর সুভাষের হাতে সমস্ত রাজনৈতিক-সামরিক দায়িত্ব তুলে দিয়ে তৃপ্তির ছুটি নিলেন অর্ধশতাব্দীর কর্মচঞ্চল মহাবিদ্রোহী নাটের গুরু। তারপর নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজলেন। শ্রদ্ধাবনত মহামান্য জাপান সম্রাট পাঠিয়ে দিলেন রাজশকট সে মরদেহ বইবার জন্য। জাপানের ইতিহাসে রাজপরিবারের বাইরে ওই একবারই ব্যবহার হলো সেটা। ইউরোপে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজ সুভাষ ডিজল্ভ্ করেছেন আগেই। সেই একই আজাদ হিন্দ ফৌজ নাম নিয়ে স্বাধীনতার দিকে পা বাড়াল ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ।

তাঁর নাম স্বাধীনতা। তাঁর নাম দেশপ্রেম। জাতি-ধর্মের বিভেদের বহু ঊর্দ্ধে মহামুক্ত মহানন্দ বিশাল মহাপুরুষ তাঁর নাম রাসবিহারী বসু ॥

মেশিন

“লুক ডক্টর রায় !’

আব্দুর রহিম। বিশাল ভারতবর্ষের মুসলমানদের প্রথম সারির নেতা স্যার আব্দুর রহিম। মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী, প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। কলকাতায় ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকার অফিসে ১৯২৮ সালে সর্বদলীয় আলোচনা সভায় বিখ্যাত নেতাদের সামনে ডক্টর বিধান রায়ের দিকে তর্জনী তুলেছেন স্যার আব্দুর রহিম।

“লুক হেয়ার ডক্টর রায়। আপনারা হিন্দুরা একটি মাত্র প্রতিপক্ষ বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়ছেন। অথচ আপনারা ভুলে যান যে, আমাদের মুসলমানদের একসাথে লড়তে হচ্ছে সামনে বৃটিশ, ডানে হিন্দু আর বামে মোল্লারা, এই তিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে” (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরআবুল মনসুর আহমদ)।

আশ্চর্য ! ইসলাম ধর্মের কাণ্ডারী মোল্লাদের ‘দুশমন’ বলা হচ্ছে কেন ? তাও আবার মুসলমান জাতির মুসলমান নেতার মুখে এমন কথা ! ভার্সিটিতে রসায়ন অর্থনীতি গণিত পড়ে আমরা যখন বড় বড় বস্ হচ্ছি, তখন ওরাই তো কষ্ট করে ধর্মের পড়াশুনা করে বিস্তীর্ণ দেশে ইসলামের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। আমদের জন্মের আজান, মৃত্যুর মিলাদ, মৃতদেহের জানাজা, বিয়ের কলমা, আকিকার কোরবানী, মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্তের আরাধনা ওরাই তো জিইয়ে রেখেছে।

এদিকে আরো নাটক। ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে যখন আনন্দের তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে ভারতের সাড়ে সতেরো কোটি মুসলমানের ঘরে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে মাহমুদাবাদের নবাব বিবৃতি দিলেন - “এইবার আমরা মনের সুখে নূতন দেশটায় ইসলামি শরীয়াত মোতাবেক ইসলামি রাষ্ট্র বানাবো।” চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যেকটি খবরের কাগজে ধমকে উঠলেন জিন্না -“পাকিস্তান হবে একটা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।” অর্থাৎ রাজনৈতিক দল থাকবে, নির্বাচন হবে, সংসদ বসবে।  ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, ক্যানাডার মতো। অনেক আগেও ১৯৪১ সালেও একই ব্যাপার। লাহোর প্রস্তাবের পর কংগ্রেস নেতা কে. এম. মুন্সী যখন বক্তৃতা দিলেন - “পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা কোরানের নির্দেশভিত্তিক হবে” তখনি আলিগড়ে জিন্না দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন - “পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হবে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা” (পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি - কমরুদ্দিন আহমদ)।

কেন ? ধর্মীয় নেতাদেরকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জড়িয়ে নিতে নাক কোঁচকায় কেন ? তাও সে নাক কোনো অমুসলমানের নয়, কোটি কোটি মুসলিমের একমেবাদ্বিতীয়ম্ সর্বোচ্চ নেতার ? কোথাও কোনো গড়বড় আছে। মুসলমান নেতার জাতিরা স্বার্থরক্ষায় মরণপণ লড়াই করবেন। জাতির অধিকার আদায়ে জেলজুলুম অত্যাচারে, ত্যাগে, হাড়ভাঙা পরিশ্রমে জীবনপাত করবেন। অথচ মাদ্রাসা-পাস মোল্লা দেখলেই ‘বাদ দাও বাদ দাও’ বলবেন, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো বড়ধরনের গড়বড় আছে। সেটা কি ? কত গভীর ? কত বিশাল ? কত ষড়যন্ত্রময় ? জানতে হলে চলুন ১৮৩০ সালে।

হাজী মুহম্মদ মহসীন। এই দানবীরের নাম কে না শুনেছে। মহাভারতের দধিচী নিজের হাড় দিয়ে বানানো অস্ত্র দান করেছিলেন অসুর নিধনে। দাতা কর্ণ দানের রাজ্যে প্রবাদ পুরুষ। কিন্তু তাঁরা মিথলজির চরিত্র। মানুষের ইতিহাসে হাতেম তাই ছাড়া আমাদের হাজী মুহম্মদ মহসীনের মতো দাতা কমই আছে। ১৮০৬ সালে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল তখনকার এক কোটি টাকা (পিতৃভূমি ও স্বরূপ অন্মেষণ-  ফারুক হাসান)। বর্তমানে সেটা কত হবে তা হিসাবের বাইরে। ১৮৩০ সালে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ৫১,০০০ টাকা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ  বদরুদ্দিন উমর)। কলজের টুকরো ভাইকে এ বিশাল সম্পত্তি দান করে মারা গেছেন বোন মন্নুুজান (যাঁর নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্নুুজান হল)। আর অকৃতদার মহসীন ? মৃত্যুকালে সমস্ত সম্পত্তি দান করে গেলেন জনশিক্ষার জন্য। সরকারি তত্ত্বাবধানে বানানো হলো স্কুল কলেজ। সে স্কুল-কলেজের চিত্র দিচ্ছি:-

হুগলী কলেজ ১৮৩৬ সাল    হুগলী স্কুল ১৮৫০ সাল

হিন্দু ছাত্র - ১০৮৬ জন     হিন্দু ছাত্র - ৫২৭ জন

মুসলিম ছাত্র - ১১২ জন     মুসলিম ছাত্র - ১২ জন

(বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস ও সমস্যা- স্যার আজিজুল হক)।

অর্থাৎ মুসলিম ছাত্র খুবই কম। হবে নাইবা কেন ? বরং ১৮৫৫ আর ১৮৫৬ সালে কলকাতা ও হুগলীর দু’টো স্কুলে মুসলিম ছাত্র ভর্তি হল একেবারে রসগোল্লা অর্থাৎ শূন্য। কারণ ? কারণ ভর্তি-পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে সীতাবৌদ্ধ শকুন্তলা, বেতলা পঞ্চবিংশতি আর সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে। সুতরাং মুসলিম ছাত্ররা ভর্তির পরীক্ষা থেকে প্যাঁচার মতো মুখ করে ফিরে এসেছে (কলকাতা-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী  এম. আর. আখতার মুকুল)।

একি কাণ্ড ! এ যে একেবারে উল্টাপূরাণ ! বিচলিত হলেন ফরিদপুরের নবাব স্যার আব্দুল লতিফ। মুসলমানের স্বার্থরক্ষায় কর্মচঞ্চল নেতা। জোর দাবি জানালেন সরকারের কাছে  মুসলমানের দানে মুসলমানের শিক্ষার নামে যা হচ্ছে তা মস্তবড় একটা ঘোড়ার ডিম ছাড়া আর কিছু নয়। এ অন্যায়। এর বিহিত করো।

তা তো বটেই, তা তো বটেই। তড়িঘড়ি এগিয়ে এল সরকার। পয়সা তুলে নেয়া হলো স্কুল-কলেজগুলো থেকে। বসলো কমিটি। মুসলমানি শিক্ষার জন্য নীতি নির্ধারণ কমিটি। দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার ক’রে মোমেন মুসলমান বানাতে হবে। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে সেটা অনেক বেশি দরকারি। কোরান, হাদিসের তত্ত্ব, তথ্য, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা, তফসীর মারেফাতই তো মুসলমানের আসল জীবন। কাজেই সাধারণ স্কুল-কলেজ বানিয়ে লাভ সেই। আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিখবার দরকার নেই। মাদ্রাসা বানাও হুগলী, চট্টগ্রাম, ঢাকা আর রাজশাহীতে। টাকার জন্য নো প্রবলেম। এতকাল ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেসব মক্তব চলেছে ওগুলোর স্ট্যাণ্ডার্ড বলতে কিছু আছে নাকি ? কেন্দ্রীয় কোনো বোর্ড নেই, সিলেবাস নেই, কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেই। এভাবে খুঁড়িয়ে চলছে বলেই তো জাতটার কোনো উন্নতি হলো না। নো প্রবলেম। এবার আমরা খ্রীষ্টান সরকার ব্যাপারটা হাতে নিচ্ছি। সব ঠিক করে দেব। ধাঁই ধাঁই করে উন্নতি হবে তোমাদের। সিলেবাসটা শুধু বানাতে দাও।

হ্যাঁ, শুধু সিলেবাসটা বানাতে দাও। ওটাই তো মেশিন। ওটার ডিজাইনের ওপরই নির্ভর করবে কারখানা থেকে কি বের হবে। পাঠক, খেয়াল করুন। বিষয়টা হচ্ছে শিক্ষায়তন। যেখানে জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি হয়। ভবিষ্যতের মানুষ তৈরি হয়। বাচ্চাগুলোকে যা শেখাবেন তাই শিখবে ওরা। তার নীতি নির্ধারণে বসেছেন আপনি। আপনার দেয়া সিলেবাসে পঁচিশ ত্রিশ বছর পর ওরা প্রত্যেকে মুক্ত বুদ্ধির মানুষ হয়ে বেরুবে। জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অথবা, আপনারই দেয়া সিলেবাসে পঁচিশ ত্রিশ বছর পর ওরা জড়বুদ্ধি কুসংস্কারী হয়ে বেরুবে, জাতির সর্বনাশ করবে।

গড়বার বা ভাঙবার এমন নির্ধারণে বসেছেন কে ? কোনো মুসলিম আলেম ? হাঃ, ভুলে যান। কমিটির চেয়ারম্যান কে ? কোনো জ্ঞানী মওলানা ? হাঃ, ভুলে যান। জাতের নাম বৃটিশ। ওই দেখুন ঘুম নেই সরকারি কমিটির বৃটিশ চেয়ারম্যানের চোখে। মাদ্রাসার সিলেবাস বানাবার কাজটা বাইরে থেকে বড়ই নিরীহ। কিন্তু তিনি তো জানেন কতবড় কূটনৈতিক যুদ্ধ এটা। যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, ঘরে বসে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমানকে (যার ৩৯% বাস করে বাংলায়) পঙ্গু করবার যুদ্ধ এটা। এমন একটা মেশিন বানাতে হবে যার উৎপন্ন দ্রব্য বৃটিশের জন্য হবে নিরাপদ। দেশপ্রেম থেকে, ইতিহাস ভূগোল অর্থনীতি বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে পরস্পরের সাথে কামড়া-কামড়ি করে মরবে এককালের মুসলিম সিংহ। আর সেই সাথে হবে, “দাস্যসুখে হাস্যমুখে বিনীত জোড়কর, প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর”। সেজন্য টোপটাকে হতে হবে বড়ই মনোহর আর সুস্বাদু।

নিশ্চিন্তে টোপ গিললো মাছ। আধুনিক বিজ্ঞান অর্থনীতি প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিকাহ্ হাদিস ফির্কা তরিকার জটিল ঘূর্ণাবর্তে ঢুকে পড়ল মাদ্রাসার সিলেবাস। মনেই পড়ল না, এতদিন বহু রাজা নবাবের ওয়াক্ফ্ লাখেরাজ জমির দানে মাদ্রাসাগুলো চলতো, সে-সব জমি এই সরকারই হজম করেছিল আইন বানিয়ে। অর্থাভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল মক্তবগুলো।

ফলাফল ? ভয়াবহ। প্রথম ইসলামি যুগের খলিফা প্রথা কবে কোথায় পথভ্রষ্ট হয়ে রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছে তার ঠিক নেই। তারই সমর্থনে স্মরণাতীত কালের দুর্বার আন্দোলন খেলাফত আন্দোলনে মেতে উঠল ভারতের মুসলমান। জন্মভূমির পরাধীনতার খবর নেই, খেলাফত বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল ভারতের মুসলমান। তারপর আতাতুর্ক কামাল পাশা শেষ খলিফা আব্দুল মজিদকে ১৯২৪-১৯২৬ সালে নির্বাসনে পাঠিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানালেন, ঘোষণা করে দিলেন তুরস্কের ঘরোয়া ব্যাপারে বাইরে থেকে কেউ যেন তার নোংরা নাক না গলায়। ব্যাস। সবকিছু বিলকুল ঠাণ্ডা। ইরাণের ভূমিকম্পে কোটি টাকা চাঁদা উঠে গেল মুসলমানের হাতে, দেশের বন্যায় উঠল একটুখানি। কেন ? দেশের পরাধীনতা চোখে পড়ে না ? দেশের লোকের, প্রতিবেশীর হক কোথায় গেল ?

আরেকটা ভয়ঙ্কর কুৎসিৎ ব্যাপার শুরু হলো। ফতোয়াবাজি। ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। যা আজো গ্রামবাংলার মানুষকে সাপের ছোবল দিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ দিচ্ছি। সুন্নীরা বলছেন  শিয়াদের সাথে বিয়ে হারাম, তাদের জবাই করা গোশ্ত হারাম, তারা মুসলমান নয় (ফতোয়ার আন নজম এবং ফতোয়ায়ে আজিজি)। রাফেজীরা মুরতাদ, কাফের (শুবা তালিমাত দারুর উলুম-দেওবন্দ)। শিয়ারা বলছে - ১২ ইমামকে অস্বীকারকারীরা গোমরাহ (আস সাফী উরসুল কাফী)। শিয়ারা ছাড়া কেউ বেহেশতে যাবে না (হাদিয়ায়ে শুকাদা)। সুন্নীর জানাযায় শিয়া গেলে মনে মনে দোয়া পড়তে হবে - হে খোদা, তুমি তার কবর ও পেট আগুন দিয়ে ভরে দাও (ফুরুউল কাফী)। আসলে শিয়াদের এই তিনটি নির্দেশ একেবারে ডাঁহা মিথ্যে। শিয়াদের যে দু’টো বই কোরাণ শরীফের পরেই সার্বজনীন মান্য তা হলো ১৬ হাজার হাদিস সম্বলিত হাদিস আল কাফী এবং নাহজুল বালাগা। বই দু’টো পড়লেই বোঝা যাবে ওপরের ফতোয়াগুলো কত নির্লজ্জ মিথ্যে।

তারপর, বেরেলভীরা সবাই কাফের (রাদ্দু তকফীর)। দেওবন্দ আলেমরা ও তাদের অনুসারী সবাই কাফের (লক্ষেèৗ থেকে ৭৭ জন আলেমের ফতোয়া)। জোরে ‘আমিন’ বললে, রাফেইয়াদাইন করলে, নামাজে বুকে হাত বাঁধলে, ইমামের পেছনে আলহামদু পড়লে সুন্নত থেকে খারিজ-গোমরাহ (জামেউশ শাওয়াহিদ থেকে ৭০জন আলেমের ফতোয়া) আরবের আব্দুল ওহাব কাফের (মজমুয়া ফতোয়া)। আহলে হাদিস, হানাফী, দেওবন্দি বেরেলী, শিয়া সুন্নী প্রভৃতি ফিরকা জাহেলিয়াতের উৎপাদন (মওলানা মওদুদী)। মওদুদী জামাত গোমরাহ। এরা সুন্নত ও কোরাণ হাদিসের খেলাফ (মওলানা হোসেন মদনী)। আসল দজ্জালের আগে যে ৩০জন দজ্জাল আসবে মওলানা মওদুদী তাদের একজন (মওলানা রেজওয়ান)। মওদুদীদের পেছনে নামাজ পড়া মাকরুহ তকরীমা (মওদুদী জামাতের স্বরূপ ২০০০ আলেমের স্বাক্ষরিত)। এ কাফের, সে কাফের। চারদিকে শুধু কাফের আর কাফের। অথচ খ্রীষ্টান বা হিন্দুদের সামনে বলা হচ্ছে - জানো, আমরা কিন্তু পৃথিবীতে ১৬০ কোটি মুসলমান। সেখানে কিন্তু গুনতিতে সবাইকেই ধরা হচ্ছে। এমন কি কাদিয়ানীদেরও। আর এদিকে কোনো-না-কোনো মোল্লার ফতোয়ায় আমরা সবাই কাফের। কি জঘন্য অবস্থা ! (সূত্র: ‘ফির্কাবাজী কুফুরী ফতোয়া ও ইসলাম’ - আহমেদ তৌফিক চৌধুরী, এবং ‘আত্মকথা’ - আবুল মনসুর আহমদ)।

তাহলে ? কোথায় গেল জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, অঙ্কশাস্ত্র, চিকিৎসা-রসায়ন-জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণা ? কোথায় গেল ইবনে সিনা, ইবনে খাল্দুন, আল-বেরুণীর শিক্ষা ? কোথায় গেল, ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’, ‘লা ইকরাহা ফিদ্বীন’, ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ ?

ফুটপাত ভরে গেছে রঙ-বেরঙের ’ইসলামি’ বইতে। ‘খোয়াব নামা’ থেকে শুরু করে তাবিজ ও পানি পড়ার বই। প্রেমিকা বশীকরণের দোয়া। উদাহরণ ? মন শক্ত করে শুনুন। দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পডুন চেয়ারে, নতুবা ধপাস করে মাটিতে পড়ে যেতে পারেন। “আল্লাহ্ ও রসুলের উপর যাদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস আছে তারা কিছুৃতেই গ্যালিলিওর এ ভ্রমাত্মক থিওরিকে (পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে) বিশ্বাস করতে পারে না” (বৈজ্ঞানিক মুহম্মদ (দঃ), মুহম্মদ নুরুল ইসলাম)। অর্থাৎ মুসলমান হতে হলে বিশ্বাস করতে হবে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।

“মানুষ ওদিকে চলিয়াছে চাঁদে, আমরা এদিকে বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি কোরান হাদিস চষে”  বড় দুঃখে বলে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কেন ? জাতি হিসেবে আমাদের ‘আই-কিউ’ তো খুব ভালো। এখানে কেন টেলিভিশন নাটকের নায়কের ফাঁসিতে গায়েবী জানাজা হয় ? কেন সিরাতুন্নবী-মিলাদুন্নবী হয়ে হাঙ্গামা হয় চট্টগ্রামে ? এই হলো সেই ঘোরতর মেশিনের উৎপাদিত মাল। যে মেশিনে নজরুলের মতো মানবদরদি হয়ে যান কাফের, ইসলামে নারী-অধিকার সমর্থন করলে আমাদের কপালে গালি জোটে “ইহুদীর এজেণ্ট”। গণহত্যাকারী ধর্ষককে যে নির্লজ্জ সমর্থন দেয় খোদা রসুলের নামে। ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’ হাদিসটাকে যে পৈশাচিক অট্টহাসিতে পরিহাস করে নিরন্তর। একুশে ছাব্বিশে আর ষোলই যার দরজায় ব্যর্থ করাঘাত করে ফিরে যায়। ত্রিশ লক্ষ লাশের আর্তনাদ যার কানে পৌঁছায় না। এবং কথায় কথায় মুসলমানদের যে ‘কাফের’ বানায়।

এই সেই মেশিন, বৃটিশের বানানো মাদ্রাসার সিলেবাস ॥

নম্বরের চোরাবালি - অখণ্ড বঙ্গ ?

১৯৩৭ সাল।

কলকাতায় ডক্টর জে. সি. গুপ্তর বাসা বাদশাহী রান্নার সুগন্ধে ভরপুর। খুশি মনে টেবিলে বসেছেন প্রজা পার্টি আর বাংলা কংগ্রেসের হাই কমাণ্ড। ইতিহাস তৈরি হবে আজ রাতে। নির্বাচন সবেমাত্র সম্পন্ন হয়েছে, ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি নির্বাচনে জিতেছে। ফজলুল হক দয়া করে যার সাথে কোয়ালিশন করবেন, তার বরাত ফিরে যাবে। হক-এর সাথে কোয়ালিশন করতে পেরে কংগ্রেস তাই উৎফুল্ল। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভাকে এক লাঠিতেই ঘায়েল করা যাবে এবার। সে লাঠি হলেন বাংলার মুকুটহীন সম্রাট ফজলুল হক। তাই কংগ্রেস বলেছিল, কোয়ালিশনে প্রধানমন্ত্রীত্ব চায় না তারা। বাংলার বাঘকে সাথে রাখতে ওটা দরকার। ওদিকে বোম্বেতে বসে হাত কামড়াচ্ছেন জিন্না সাহেব। খাজা-গজাদের নিয়ে মুসলিম লীগ গড়ে মহাভুল করেছেন তিনি। স্পষ্ট হয়ে গেছে, হক ছাড়া বাংলা পাওয়া যাবে না। আর বাংলা ছাড়া পাকিস্তানের দাবি হাস্যকর। শুধুমাত্র পশ্চিম ভারত নিয়ে পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নটা এজন্যই রিকেটে ভুগছে। অস্থির হয়ে উঠেছেন দিব্যদৃষ্ট ঝানু রাজনীতিক মুহম্মদ আলী জিন্না। হক-কংগ্রেস সমঝোতা হয়ে গেলে বাংলায় মুসলিম লীগের কবর হয়ে যাবে। শিকেয় উঠবে সাধের পাকিস্তান।

কিন্তু সমঝোতা তো হয়েই গেছে। কংগ্রেস-প্রজা পার্টি একসাথে বসে সমস্ত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক শেষ করেই তো সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত কয়েকটি প্রস্তাব ঠিক করেছে। এমনকি, দলিলপত্র টাইপও করা হয়েছে। শুধু সই-দস্তখত করা বাকি। তাহলেই বাংলার ভবিষ্যত রওনা হবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথে, মুসলিম লীগের হবে ভরাডুবি।

অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিয়তি।

কেউ জানে না কিন্তু নিয়তি জানে, আগামী দু’ঘণ্টার মধ্যে বদলে যাবে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ, বদলে যাবে চিরদিনের জন্য। সুদূর বোম্বে থেকে ভারতীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র মুসলিম মেজরিটি বাংলার উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছেন জিন্না। পাকা খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর জানাই আছে, ব্যর্থ চালের পরও মোক্ষম একটা মুহূর্ত এসে পড়তে পারে। চিনে নিতে হবে সেটা। তাঁরই নির্দেশে রাত জেগে নাজিমুদ্দীনের দল অপেক্ষা করছেন ডক্টর জে. সি. গুপ্ত’র বাড়ির কাছাকাছি আরেকটি বাড়িতে। কখন কি হয়।

কাগজ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডঃ গুপ্ত। কংগ্রেস ও প্রজা পার্টির ঐক্যের ওপর বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভর করছে, তার ওপর আবেগময় বক্তৃতা দিলেন। কারো দ্বিমত নেই ব্যাপারটায়। তারপর পড়ে শোনালেন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবগুলো (১) স্বরাজ দাবি, (২) দেশে ও আন্দামানে নির্বাসিত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি, (৩) প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করা, (৪) মহাজনী আইন সংশোধন, ইত্যাদি। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মুসাবিদা। কোথাও কোনো ভুল নেই। খুশি মনে শুনছেন ফজলুল হক, ডাঃ বিধান রায়, শরৎ বসু, সৈয়দ নওশের আলী ও আরো অনেকে।

এসে পড়ল ক্রান্তি মুহূর্ত। আস্তে উঠে দাঁড়ালেন বিনয়াবতার প্রজা পার্টির আবুল মনসুর আহমদ। না না, কোনোরকম তর্ক-বিতর্ক নয়, সংশোধনীও নয়, সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু দু’নম্বর দাবিটা তিন এবং চার নম্বরের পরে রাখতে হবে। কারণ ? কারণ এর মধ্যে একটা রাজনৈতিক অঙ্ক আছে। বাংলার ইংরেজ লাটসাহেব মন্ত্রীসভার প্রস্তাবগুলো একের পর এক অনুমোদন করে আইনে পরিণত করবেন, এটাই নিয়ম। কোনো প্রস্তাবে লাটসাহেব রাজি না হলে প্রচলিত নিয়ম মাফিক মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করবে, এটাই নিয়ম। কাজেই, প্রথমেই যদি বন্দিমুক্তির দাবিতে লাটসাহেব নাখোশ হন, তবে তো প্রজাস্বত্ব এবং মহাজনী আইনের ব্যবস্থার আগেই মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। অন্যদিকে, প্রজাস্বত্ব ও মহাজনী আইন পাশ করার পরে বন্দিমুক্তির দাবিতে পদত্যাগ করলে মন্ত্রীসভা আরো পপুলার হবে, সেটা নিশ্চয়। তাতে নাজিমুদ্দীন গ্রূপের জোঁকের মুখেও পড়বে হুঁকোর পানি। রাজনীতির জটিল বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ বক্তা আবুল মনসুর আহমদ পরিষ্কার করে তুললেন, বন্দিমুক্তির দাবিতে মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করতে পারে নিশ্চয়ই। কিন্তু তা পারে শুধু প্রজাস্বত্ব ও মহাজনী আইন সংশোধনের পরেই, আগে নয়।  মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন প্রজা পার্টির নেতারা, কংগ্রেসেরও কয়েকজন।

সাজানো বাগান বিপর্যস্ত হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। অনেক কথাবার্তা বাদবিসম্বাদ হল। লাভের লাভ কিছুই হল না। আবেগতাড়িত কংগ্রেস রাজি হল না। আর প্রজা পার্টির পক্ষে তো সম্ভবই ছিল না। সুস্বাদু খাবার এল প্রচুর, গলা দিয়ে নামল না কারো। শেষরাতে যখন সবাই বেরোলেন, বাইরে তখন অন্ধকার। বাংলার হাজার বছরের ভবিষ্যতের ওপরও নেমে এসেছে রাতের অন্ধকার। আকাশ থেকে লক্ষ তারারা দেখছে বাংলার ভাগ্য বিধাতাদের অসহায় ব্যর্থতা।

অপ্রত্যাশিত একটা মুহূর্ত। চোখের পলকে সেটাকে বগলদাবা করে ফেললো খাজা-দল। ডঃ গুপ্তের বাসা থেকে বের হবার সাথে সাথেই প্রজা-পার্টির সেক্রেটারি মোঃ শামসুদ্দীনকে পুরনো বন্ধুত্বের দাবিতে হাইজ্যাক করে এনে তোলা হল খাজা-দলের আখড়ায়। ততক্ষণে বোম্বে থেকে জিন্নার নির্দেশ এসে গেছে। “গিভ হিম অল হি  ওয়ান্টস”! ফজলুল হক যা কিছুই চায়, তাই তাকে দাও। দাও এখনই, কাল পাশা উলটে যেতে পারে আবার। প্রজা পার্টির পায়ে নুয়ে পড়ল মুসলিম লীগ।  প্রধানমন্ত্রীত্ব? চাই না, চাই না। ছোটখাট দু’একটা মন্ত্রীত্ব দিলেও দিতে পার। প্রজাস্বত্ব? মহাজনী-ভূমি সংস্কার আইন? জমিদারি উচ্ছেদ? তোমাদের সবগুলো দাবিকে মুসলিম লীগের দলীয় দাবি হিসেবে গ্রহণ করা হল। আর কি চাই ?

আর আবার কি চাই! হয়ে গেল কোয়ালিশন, সেই রাতেই। কংগ্রেসের সাথে নয়, মুসলিম লীগের সাথে। বাংলায় প্রজা পার্টি-কংগ্রেসের মিলিত সরকার হলে মুসলিম লীগ হাজার বছরেও বাংলায় ঢুকতে পারত না।  

নীরব বিপ্লব একেই বলে। প্রজাপার্টির দলীয় দাবিগুলোকে মুসলিম লীগে অন্তর্ভুক্ত করে জিন্না সাহেব প্রজা পার্টির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। ভবিষ্যৎ ছিল তাঁর কাছে স্পষ্ট। তিনি ভালো করেই জানতেন মুসলিম মেজরিটির বাংলায় হিন্দু-সমাজ কিছুতেই থাকতে চাইবে না, তাদের রাজনীতি অনতিবিলম্বে গিয়ে আশ্রয় নেবে সর্বভারতীয় হিন্দু মেজরিটির প্ল্যাটফর্মে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলিম বাংলার রাজনীতিও সর্বভারতীয় রূপ নিতে বাধ্য এবং সেটাই মুসলিম লীগের প্রাণ-ভোমরা। ফজলুল হক চেষ্টা করলেও তা ঠেকাতে পারবেন না। শুধু শুরুটা করতে হবে অতি বিনয়ের সাথে। জিন্না করলেনও তাই। বাংলা কংগ্রেসের একটি আবেগজনিত ভুলের সুযোগ নিয়ে সেই ঐতিহাসিক রাতে বাংলার রাজনীতিতে সুঁচ হয়ে ঢুকলেন জিন্না, কুড়ুল হয়ে বেরুলেন ক’বছর পর। ততদিনে বাংলার ডাল-ভাতের চাবিকাঠি হকের বরিশাল থেকে জিন্নার বোম্বেতে চলে গেছে।

হিন্দু মুসলমানের স্বাধীন অখণ্ড বাংলার ভবিষ্যৎ পরাজিত মলিন মুখে নীরবে চিরকালের জন্য বিদায় নিল দুই নম্বর চার নম্বরের গোলক ধাঁধায় সেই অসম্ভব অন্ধকার রাতে, ১৯৩৭ সালে ॥

বৃহত্তর বাংলা ও “স্লিপ অব্ টাং”

১৯৪৬ সাল। অস্থির, চঞ্চল অখণ্ড ভারতবর্ষ। পরাধীনতার অন্ধকারে কেটে গেছে প্রায় একশ নব্বই বছর। কোটি কোটি মানুষ অন্ধকারে জন্মে অন্ধকারে জীবন কাটিয়ে অন্ধকারেই বিলীন হয়ে গেছে অনন্তে। যেন আলো বলে কোনকিছু ছিল না কোনদিন। যেন স্বাধীনতার সূর্য ঝলমলে আকাশে দীপ্তমান ছিল না কখনো। শতাব্দীর সেই অভিশপ্ত অচলায়তন ভেঙে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস, মুসলিম লীগের পক্ষে চল্লিশ কোটি ভারতবাসী চাপের পর চাপ দিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপ শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। সেই সাথে যোগ হয়েছে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয় নেতাজী সুভাষ বোসের মরণ আঘাত। আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের বন্দি রেখেও ‘বিচার’ করবার সাহস হচ্ছে না ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের বিচারকদের। হঠাৎ বাতাসে হাত থেকে খৈ উড়ে গেলে যেমন ‘উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমঃ’ মন্ত্র পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ, ঠিক তেমনি হাত থেকে প্রায় ফসকে  যাওয়া ভারতবর্ষকে স্বাধীন করে দেবার ইচ্ছেটা উদারতার সাথে প্রকাশ করেছেন ইংল্যাণ্ডের অ্যাটলি-মন্ত্রীসভা।

কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর হলো না ! জিন্না সবুজ স্বাধীনতা চান তো কংগ্রেস চায় হলুদ। কংগ্রেস চারকোণা স্বাধীনতা চায় তো জিন্না চান গোলাকার। জিন্না পাকিস্তান চান তো কংগ্রেস চায় অখণ্ড ভারত। এইসব গোলক ধাঁধায় ল্যাজে-গোবরে হয়ে কিছুদিন আগেই ব্যর্থ মিশন নিয়ে ফিরে গেছেন ক্রিপ্স্ সাহেব। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্, ইউরোপের চাণক্য। যুদ্ধের সময় সমস্ত ইউরোপ যখন হিটলারের ব্লিৎসক্রিগ আর প্যান্থরের আঘাতে ভেসে যাচ্ছে খড়কুটোর মতো, প্রতিদিন নুয়ে আসছে চার্চিলের মেরুদণ্ড, ঠিক তখনই ক্রীপ্স্কে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়েছিল মস্কোতে। পারলে ঐ লোকটাই পারবে। সমস্ত অসম্ভবের মধ্যে এই এতটুকু আশা। যদি কোনরকমে রাশিয়া আর জার্মানির মধ্যে যুদ্ধটা বাধানো যায় ! না হলে আর কোনো উপায় নেই হিটলারকে ঠেকানোর। পর্দার আড়ালে কি ঘটে গেল, জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করল, মোড় ঘুরে গেল বিশ্বযুদ্ধের। খুশিতে ফেটে পড়ল মিত্রশক্তি। ক্রিপ্স্ পেয়ে গেলেন ইংল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ খেতাব ‘নাইটস্’। হয়ে গেলেন স্যার ক্রিপ্স্। গতবারের ব্যর্থতায় অভিজ্ঞ ক্রীপ্স্ এবার এসেছেন স্যার প্যাথিক লরেন্স-এর কেবিনেট মিশনের সদস্য হয়ে।

কিন্তু এমন কত মিশন তো এল আর গেল। কাজের কাজ কিছুই হয় না। সবাই শুধু বাক্য-নবাব। মিটিং, প্রস্তাব, মিশন চলছেই চলছে। কিন্তু স্বাধীনতাটা কবে আসবে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এই এল ব’লে। আশায় বুক বাঁধে চল্লিশ কোটি লোক। আবার নিরাশায় আঁধার ছেয়ে আসে। অবশ্য, কাজটা অসম্ভব জটিলও বটে। গত ক’বছরে লীগ কংগ্রেস আর বৃটিশ মিলে স্বাধীনতার পথটাকে সমস্যায় সমস্যায় এতই পিছলে করে দিয়েছে যে বেচারা স্বাধীনতা দু’পা এগিয়েই হয় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অথবা তিন-পা পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে, সে যে একদিন আসবেইআর সেদিন খুব দূরেও নয় তা স্পষ্ট। এছাড়া আছেন উপনেতা, পাতিনেতার দল। “তাঁরা নিশ্চয়ই চান দেশ স্বাধীন হোক, কিন্তু তাতে যদি তাঁদের মাতব্বরি না থাকে সে স্বাধীনতার কোনো দরকার নেই”- মওলানা আবুল কালাম আজাদ - ‘ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছিল।’

এরপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি, শতশত বছর পর। প্রথমে বিশ্বাস হতে চায় না। বারবার চোখ রগড়ে খবরের কাগজ দেখছে সবাই, বারবার ষ্টেশন বদল করে রেড়িও শুনছে। না, কোনো ভুল নেই। কেবিনেট মিশন সফল হয়েছে। মেনে নিয়েছে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ দু’দলই। অভূতপূর্ব খেলা দেখিয়েছেন রাজনীতির যাদুকর স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্। কংগ্রেসকে বলেছেন “অখণ্ড ভারত চাও ? এই রইল তোমার অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা।” জিন্নাকে বলেছেন “পাকিস্তান চাও তো ? এই রইল তোমার স্বাধীন পাকিস্তানের রূপরেখা।” মেনে নিয়েছে কংগ্রেস, মেনে নিয়েছে মুসলিম লীগ। এ কি হল ? কেমন করে হল ? অখণ্ড  ভারত আর স্বাধীন পাকিস্তান একই সাথে হয় কি করে ? নিশ্চয়ই হয়, নইলে কংগ্রেস মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা নেতারা এটা মেনে নিল কি করে ?

এই হলেন স্যার ক্রিপ্স্। জটিল সমস্যার জটিল সমাধানের চেষ্টা করে গতবার পারেননি। এবার একটা সহজ সরল স্বাভাবিক সমাধান বের করে দিলেন। তিনটে অঞ্চলে ভাগ হয়ে স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ। অঞ্চল তিনটে হল মোটামুটি এরকম - বর্তমান পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ। স্বভাবতঃই পূর্ব পশ্চিমে মুসলমান হবে মেজরিটি। বাংলা ও আসাম নিয়ে হবে আমাদের অঞ্চল। নিজেদের সম্পদের ওপর এ অঞ্চলগুলোর থাকবে অখণ্ড অধিকার। কেন্দ্র শুধু সামরিক, যোগাযোগ এবং পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। দশ বছর এভাবে চলার পর যদি মুসলমানরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, তা তারা করতে পারবে। তবে তাতে তাদের বিশেষ কিছু লাভ হবে না। কারণ অখণ্ড ভারতের ফেডারেল রূপরেখায় মুসলমানরা আর্থিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাদের অঞ্চলে মোটামুটি স্বাধীনতাই পাচ্ছে। ব্যাপারটা পাকিস্তান আমলে আমাদের ছয়দফার কাছাকাছি।

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে, বিশ্বাস হতে, সময় লাগল। তারপর আনন্দে যেন ফেটে পড়ল গোটা ভারতবর্ষ। স্বাধীনতা ! শত বছরের সহস্র শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা সেই পরম, চরম, সেই মোক্ষ ! সহস্র লেখক, কবি দার্শনিকের স্বপ্ন, কত সন্তানহারা পিতামাতার, মাতৃহীন এতিমের অশ্রু। কত রশীদ আলী, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, শাহনেওয়াজ, ভগৎ সিং, কত তিতুমীর, সুভাষ বোস, মঙ্গল পাণ্ডে, টিপু সুলতানের আত্মদানে গড়া সেই উজ্জ্বল সূর্য। কত প্রীতিলতা, বীনা দাস, মাতঙ্গিনী হাজরার রক্তস্রোত। কত ফাঁসি, কত আন্দামান, অন্ধকার টর্চার চেম্বারের কত মর্মভেদী আর্তনাদ। তার ফসল এবার উঠবে ঘরে ! অর্ধেক গোলার্ধ ওপার হতে শেয়াল শকুনরা এসে দেশটাকে ছিঁড়ে খাবে না আর। ডিভাইড রুল-এর খেলা হবে বন্ধ। সাদাদের ক্লাবের দরজায় ঝোলানো থাকবে না ‘ভারতীয় এবং কুকুরের প্রবেশ নিষেধ’।

আবার অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিয়তি। কেউ জানে না, ক’দিন পরই হিসাবের কড়ি বাঘে খেয়ে যাবে। মাত্র দু’তিনটে কথার আঘাতে চিরদিনের জন্য বদলে যাবে আমাদের সহ চল্লিশ কোটি লোক এবং তাদের সমস্ত উত্তরপুরুষদের ভাগ্য।

অবধারিতভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা। কেবিনেট মিশন গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ২৪শে মে কংগ্রেস দ্বারা, এবং ২৫শে জুন মুসলিম লীগ দ্বারা। ১০ই জুলাই বোম্বেতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস প্রেসিডেণ্ট নেহেরু বলে ফেললেন, কেবিনেট মিশন গৃহীত হয়েছে রাজনৈতিক দল দ্বারা, কিন্তু আমরা যেখানে গিয়ে বসবো তা হলো পার্লামেণ্ট, যা কিনা সার্বভৌম। সেখানে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আমাদের আছে।

বলে কি ! থ’ হয়ে গেল ভারতবর্ষের মুসলমান। পার্লামেণ্টে ওরাই যে মেজরিটি ! তবে ? তবে কি হিন্দুরা মেজরিটির জোরে সংসদে ইচ্ছেমত প্রস্তাব আর আইন পাশ করবে ? উম্মুখ হয়ে তাকাল সবাই জিন্নার দিকে। লীগের বিশেষ অধিবেশন শেষে ক্ষুব্ধ জিন্না ঘোষণা করলেন “পাকিস্তান অর্জনের জন্য মুসলিম জাতির প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সময় এসেছে। এবং সরকার প্রদত্ত সর্বপ্রকার খেতাব বর্জনের জন্য মুসলমানদের প্রতি এই কাউন্সিল আহ্বান জানাচ্ছে।” ১৬ই আগষ্ট ঘোষণা করা হল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। এবার এল খাঁড়ার ঘা। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আসলে কি, কিভাবে সেটা করা হবে তা আবেগাপ্লুত ক্ষুব্ধ ভারতীয় মুসলমানকে পরিষ্কার ক’রে কিছুই বলা হল না। কোটি কোটি মুসলমানের প্রচণ্ড রুদ্ধ আবেগ যখন প্রকাশের পথ খুঁজছে তখন খেতাবধারী বিচলিত খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করলেন “আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আসলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে।”

নিজের দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতার মুখে এহেন উস্কানীমূলক সাম্প্রদায়িক ঘোষণা শুনে বাংলার হিন্দুরা স্বভাবতঃই প্রথমে শঙ্কিত এবং পরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। ১৬ই আগস্ট কলকাতায় এবং পরে বাংলা বিহারে সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেমে এল কেয়ামতের মতো। শূন্যে মিলিয়ে গেল কেবিনেট মিশন।

নিজেদের সম্পদে সমস্ত অধিকার নিয়ে বৃহত্তর বাংলার স্বায়ত্বশাসনের সম্ভাবনা এভাবে আমাদের হাতের কাছে এসেও চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল, শুধু একটা মানুষের মুখ ফসকে (?) কয়েকটা কথা বের হবার জন্য ॥

পাক-ভারতের স্বাধীনতা : ধামাচাপা অধ্যায়

আবার আত্মানুসন্ধান। মুক্তিযুদ্ধের আগুনের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসা আমাদের প্রজন্ম বেঁচে থাকতেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়ে গেছে, বিক্রীত হয়ে গেছে। অনেক দেশেই এটা হয়েছে, পাকিস্তানী জাতটাকে স্কুল সিলেবাস থেকে মিডিয়ার সর্বত্র একাত্তরের ডাঁহা মিথ্যে ইতিহাস গেলানো হয়েছে ও হচ্ছে। এটাও মোটামুটি তেমনি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই কংগ্রেস তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। কয়েক দশক আগে গবেষকেরা এটা সামনে এনেছেন, সেটাই তুলে ধরছি মোটা দাগে।

• ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলা ও ক্রমান্বয়ে ভারত দখল করে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে।

  • ১৯৪৬ সালে বৃটিশ অখণ্ড স্বাধীন ভারতের পরিকল্পনা (ক্যাবিনেট মিশন) পেশ করে, সেটা মেনে নেয় কংগ্রেস ২৪শে মে ও মুসলিম লীগ ২৫শে জুন। অর্থাৎ অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা অবধারিত। কিন্তু ১০ই জুলাই বোম্বে রেলওয়ে স্টেশনে নেহেরু সাংবাদিকদের বলেন কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন গ্রহণ করেছে রাজনৈতিক দল হিসেবে কিন্তু তাঁরা গিয়ে বসবেন পার্লামেন্টে যা সার্বভৌম। এতে জিন্নাহ ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যাবিনেট মিশন বর্জন করে পাকিস্তান প্রস্তাবে ফিরে আসেন কারণ তাঁর মতে পার্লামেন্টে মেজরিটি দল হিসেবে কংগ্রেস ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেবে।
  • ১৯৪৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ঘোষণা করেন বৃটিশ সরকার পরের বছর ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাবে। সেই মোতাবেক সব দলে প্রস্তুতি চলতে থাকে।
  • কিন্তু তাঁরা ১৯৪৭ সালের আগষ্টে পাক-ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যান।
  • কেন? এমন কি ঘটল যাতে “প্রবল পরাক্রান্ত অর্ধ পৃথিবীর অধীশ্বর” হঠাৎ লোটা কম্বল নিয়ে দৌড়??

    কারণ আছে। সমূহ কারণ আছে সেই ঐতিহাসিক ডিগবাজির যা ১৯৫৬ সালে জানিয়েছেন আর কেউ নন – ১৯৪৭ সালের বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলি নিজে।

    অবসর গ্রহণের পর মি. এটলি ১৯৫৬ সালে কলকাতা সফরে এলে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর বিচারপতি ফণিভূষণ চক্রবর্তী তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন কংগ্রেসের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তো ১৯৪৭ সালের কয়েক বছর আগে ১৯৪২ থেকেই স্তিমিত, তারপরে আর কোন আন্দোলনের চাপ ছিলনা। তাছাড়া মি. এটলি নিজেই তো ভারত ছেড়ে যাবার তারিখ ঘোষণা করেছিলেন ১৯৪৮ সালের জুন। কিন্তু তাঁরা ১৯৪৭ সালেই ভারত ছেড়ে গেলেন কেন? স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের অবদান কতখানি সে প্রশ্নের জবাবে মি. এটলি- উদ্ধৃতি:- “তাচ্ছিল্যের হাসিতে ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিলেন ‘মিনিম্যাল’"।

অর্থাৎ “ইট্টুখানি” !

হোয়াট?? স্বাধীনতা অর্জনে সুবিশাল কংগ্রেসের প্রভাব “ইট্টুখানি”?? এবং সেটা বলছেন সেই সময়ের সর্বোচ্চ নেতা! তাহলে তো ছোট দল মুসলিম লীগের প্রভাব নিশ্চয় আরও "ইট্টুখানি"! তাহলে পাক-ভারতের স্বাধীনতাটা আনলো কে? তাহলে এতদিন আমরা কি ঘোড়ার ডিম ইতিহাস পড়লাম ? ঘটনা কি?

মি. এটলি আরও বলেছিলেন, তাঁদের তড়িঘড়ি ভারত ছেড়ে যাবার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী যার অংশ ছিল ভারতে বৃটিশ নৌবাহিনীর ভারতীয় নৌসেনাদের বিদ্রোহ।

আসলে ঘটনাটা এই।

১৯৪৫ সাল। নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত স্বাধীন করার জন্য জাপানের সাহায্যে বিপুল বিক্রমে দূরপ্রাচ্য থেকে যুদ্ধ করে বিভিন্ন দেশ জয় করতে করতে ভারতের দোরগোড়ায় এসেছিল। কিন্তু জাপান পরাজিত হবার পরে রসদের অভাবে তারা বৃটিশ সৈন্যদলের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। নেতাজী কোথাও নেই। অনেকে বলেন তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, অনেকে বলেন তিনি স্বেচ্ছানির্বাসনে গেছেন। ফৌজের প্রায় পঁচিশ হাজার বন্দী সৈন্যদের পাহারায় আছে বৃটিশ আর্মীর হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য। বন্দীরা ও প্রহরীরা পরস্পরের সাথে কথা বলছে নিজেদের ভাষায়।

প্রহরীরা রুদ্ধশ্বাসে শুনছে যেন রূপকথার গল্প, শুনছে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য নেতাজীর ও ফৌজের সৈন্যদের প্রানান্ত প্রচেষ্টার গল্প। এদেরই গর্বিত পদভরে টলমল করেছে বার্মা থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, ইম্ফল, কোহিমা। অথচ বৃটিশ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদেরকে বলা হয়েছিল জাপান ভারত আক্রমণ করেছে, তাই তারা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে জাপানি বাহিনী মনে করে যুদ্ধ করে তাদেরকে বন্দী করেছে। আহা ! তারা যদি জানতো আক্রমণকারীরা জাপানি নয় তারা নেতাজির কম্যাণ্ডে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ হিন্দ ফৌজ তাহলে তখনই তারা বিদ্রোহ করে বৃটিশকে কচুকাটা করে ভারতবর্ষ স্বাধীন করে ফেলত।

বন্দীরা বলে যায় তাদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কাহিনী, নেতাজীর কাহিনী, জলে জঙ্গলে পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের "দিল্লী চলো"-র মরণপন যুদ্ধের কথা, প্রহরীরা গালে হাত দিয়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে শুনতে থাকে। ধীরে ধীরে বন্দীদের বুক থেকে প্রহরীদের বুকে চক্রবৃদ্ধিহারে সংক্রমিত হয় দেশপ্রেম - এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে ষোলো, ষোলো থেকে দুই’শ ছাপ্পান্নো……. লক্ষ প্রহরীর বুকে প্রাগৈতিহাসিক বিশাল প্রাণীর মতো রক্তচোখে উঠে দাঁড়ালো শতাব্দীর ক্ষুধিত দেশপ্রেম। ব্যারাকগুলোতে শুরু হল:-

"চা বানাও"।
"বানাবো না'।
"জুতো পালিশ করো”।
"করবো না"।
"বন্দুক সাফ করো"।
"করবো না"।

আতংকে আঁৎকে উঠল ব্রিটিশ। আর্মীতে চেইন অফ কম্যাণ্ড ভেঙে পড়ছে!! প্রতিটি সৈন্যদল টিকেই থাকে তার চেইন অফ কম্যাণ্ড-এর ওপর, কোনো সৈন্য তার বসের হুকুম মানবেনা এ তো কল্পনাই করা যায়না ! কবি টেনিসন লিখেছেন :-
Theirs not to make reply,
Theirs not to reason why,
Theirs but to do and die…..
তাদের অধিকার নেই তর্ক করার, তাদের অধিকার নেই প্রশ্ন করার, তারা শুধু আদেশ পালন করবে ও মরবে।

ভারতে তখন চল্লিশ হাজার বৃটিশ সৈন্যের দিকে রক্তচোখে তাকিয়ে আছে পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য। এই সাদারা সাগরের ওপার থেকে এসে প্রায় দু’শ বছর পায়ের নীচে পিষেছে তাদের মাতৃভূমিকে - খুন করেছে ফাঁসি দিয়েছে অগণিত ভারতীয়কে। সেই পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় সৈন্যের যে কেউ একজন - ভুল করে হলেও - একটা গুলি ছুঁড়লেই চেইন রিএকশনে তৎক্ষণাৎ বৃটিশদের ওপরে গর্জে উঠবে লক্ষ বন্দুক। এবং সেটা ভারতে সীমাবদ্ধ থাকবেনা - সে দাবানল মুহূর্তে ছড়িয়ে যাবে এশিয়া আফ্রিকায় প্রতিটি বৃটিশ উপনিবেশে। এবং সেটা দেখে বসে থাকবেনা ফ্রেঞ্চ স্প্যানিশ সহ অন্য উপনিবেশগুলোর শতাব্দী লাঞ্ছিত মানুষগুলোও। প্রতিটি উপনিবেশে পোকামাকড়ের মতো মারা পড়বে লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় ‘প্রভু’রা, লণ্ডভণ্ড রক্তাক্ত হয়ে যাবে এশিয়া আফ্রিকা।

কল্পনা নয়, হিসেবের কড়ি। এবং সে হিসেব করার বুদ্ধি বৃটিশ রাখে। উদ্বিগ্ন হল লণ্ডনের মন্ত্রীসভা - উদ্বিগ্ন হলেন হার এক্সেলেন্সি কুইন।

এই মারাত্মক স্পর্শকাতর সময়ে ৫ই নভেম্বর ১৯৪৫ দিল্লীর লালকেল্লায় "বিচার" শুরু হল আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল শাহনেওয়াজ খান, কর্নেল সায়গল আর মেজর ধীলনের। সাথে সাথে আত্মকলহে শতধা বিভক্ত ছত্রিশ কোটি ভারতবাসী আমাদের একাত্তরের মতো দেশপ্রেমের বিনিসুতোর মালায় বাঁধা পড়ে গেল। আসমুদ্র হিমাচলে বিস্ফোরিত হল জনতার ভৈরব গর্জন - "বিচার বন্ধ কর"। বাংলা-বোম্বে-এলাহাবাদ-বেনারস-করাচী-পাটনা-রাওয়ালপিন্ডি সর্বত্র বিস্ফোরণ, এক কলকাতাতেই নিহত ৩২ আহত ২০০ জন - বৃটিশ পক্ষেও নিহত ১ আহত ১৮৮।

“জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে, ধুমায়ে শূন্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে, লুপ্ত করিছে সূর্যচন্দ্রে - বিশ্বব্যাপিনী দাহনা" - কবিগুরু। ভাতের হাঁড়ির মতো টগবগ করে ফুটছে ভারতবর্ষ, অন্তরীক্ষে সাফল্যের হাসি হাসছেন নেতাজী। অদৃশ্য থেকে তিনি তাঁর শালপ্রাংশু সহস্রবাহুতে প্রচণ্ড চেপে ধরেছেন বৃটিশের গলা।

"কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে" –(কবিগুরু)।

কোথায় পড়ে রইলেন জিন্না-নেহেরু-গান্ধী, কোথায় পড়ে রইল কংগ্রেস-মুসলিম লীগ। তাঁদেরকে ছাড়িয়ে আকাশচুম্বী হয়ে উঠল নেতাজী ও ফৌজের মহিমা, তাঁরাই হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রতীক। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা ড. পট্টভি সীতারামাইয়া লিখেছেন - "আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দীরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মেঘাবৃত করিয়া ফেলিয়াছে। মনে হইতেছে যেন তাহারা গোটা কংগ্রেসকেই সূর্যগ্রহণের মতো ঢাকিয়া দিয়াছে"।

ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল টুকার লিখলেন - "ভবিষ্যৎ অত্যন্ত বিপদজনক। আজাদ হিন্দ ফৌজ আমাদের সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করিবার হুমকি হইয়া উঠিয়াছে"।

ঐতিহাসিক হিউ টয় লিখলেন - "হিন্দ ফৌজকে কেন্দ্র করিয়া যে গণদাবী মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল ভারতীয় সেনাবাহিনীও তাহার প্রতি সহানুভূতিশীল হইয়া পড়িল ………তাহাদের ভিতর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হইল যাহা আগে ছিলনা"।

ভাষ্যকার ফিলিপ মেসন লিখলেন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, জাতি আজাদ হিন্দ ফৌজকে স্বাধীনতার বীর যোদ্ধা হিসেবে অভিনন্দিত করে ফৌজের "পতাকা দিবস" পালন করেছে।

ঘটনা অজস্র, সংক্ষেপ করি।

(১) ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় নৌ-সেনারা ৭৮টি যুদ্ধজাহাজে বৃটিশ অফিসারদেরকে বন্দী করে নেতাজীর বিশাল ছবি টাঙিয়ে কানফাটা ভোঁ ভোঁ হর্ন বাজিয়ে বিদ্রোহে ফেটে পড়লো, বিভিন্ন বন্দরে অসহায় দাঁড়ানো বৃটিশ সৈন্যদের ও সরকারের চোখের সামনে লক্ষ জনতা মাছধরা নৌকো সাম্পান যা কিছু ছিল তাই দিয়ে বিদ্রোহী জাহাজগুলোতে খাবার ও পানি পৌঁছে দিল।

“নরনারী সবে আনিয়া তূর্ণ, প্রাণের পাত্র করিয়া চূর্ণ, বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ, জীবন আহুতি ঢালিয়া”!- কবিগুরু। 

(২) আদালত মেজর জেনারেল শাহনেওয়াজ খান, কর্নেল সায়গল আর মেজর ধীলনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিলে ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ক্লড অকিনলেক লণ্ডন সরকারকে লিখলেন (পরে সেগুলো প্রকাশ পেয়েছে) - "(এই) শাস্তিকে কার্যে পরিণত করিবার চেষ্টা করিলে সেনাবিদ্রোহ অবধারিত",

(৩) তিনি তাঁর “বিশেষ ক্ষমতাবলে” আদালতের রায় বাতিল করে সবাইকে মুক্তি দিলেন ০৪ জানুয়ারি ১৯৪৬। বুদ্ধিমান বৃটিশ এরপর ফৌজের আর কোন সৈন্যের বিচার করার সাহস করেনি কারণ ততদিনে তারা বাতাস টের পেয়ে গেছে,

(৪) বৃটিশ এয়ারফোর্সের ভারতীয় পাইলটরা ফৌজের সমর্থনে কর্মবিরতি হরতাল করলেন ও মামলার জন্য প্রকাশ্যে চাঁদা তুললেন,

(৫) বড়লাট লর্ড ওয়াভেল লণ্ডন সরকারকে লিখলেন - "ভারতীয় সৈন্যদের দ্বারা দেশবাসীকে দমন করার চেষ্টা করিলে বিস্ফোরণ অনিবার্য্য",

(৬) ভারত জুড়ে তখন আর্মী ব্যারাকগুলোতে ভারতীয় সৈন্যদের আদেশ অমান্য ও অসন্তোষের ধোঁয়া।

বৃটিশ একদিকে খুব চাতুর্য্য ও সাফল্যের সাথে লীগ-কংগ্রেসের নেতাদেরকে সাথে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছিল ও অন্যদিকে পাততাড়ি গোটানোর আয়োজন করছিল। নেতারা জাতিকে বোঝালেন, যে স্বাধীনতার জন্য এতো আত্মত্যাগ এতো সংঘর্ষ এতো মৃত্যু সেই স্বাধীনতা একেবারে সুনিশ্চিত ও দ্বারপ্রান্তে, এখন আর হিংসা খুনোখুনির দরকার নেই। এতে কাজ হল। নেতারা নৌবিদ্রোহীদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলেন, বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করল।

গণমানস শান্ত করতে বৃটিশ ১৯৪৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঘোষণা করেছিল তারা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাবে পরের বছর ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন। তারা হয়তো ভেবেছিল স্বাধীনতা দেবার জটিল আয়োজন সম্পন্ন করতে ওরকম সময় লাগবে। কিন্তু যেহেতু তার অনেক আগেই সেটা হয়ে গেল, সম্ভবতঃ তাই তারা আর ঝুঁকির মধ্যে না থেকে ১৯৪৭ সালের আগষ্টেই চলে গেছে। গবেষক ধনঞ্জয় ভাট, অনিন্দ্য রায় বর্মন, খ্যাতনামা লেখক ও রাজ্যসভার সাংসদ প্রফুল্ল গোরাদিয়া সহ অনেক গবেষক, বিশেষ করে অর্ধেন্দু বোস ও মেজর জেনারেল গগনদীপ বকশী (অব) এ বিষয়ে অজস্র লিখেছেন, সেগুলোতে বিস্তারিত পাওয়া যাবে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে লীগ-কংগ্রেসের অবদান আছে। কিন্তু তথ্য-বিশ্লেষণে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে এতে নেতাজী ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদানই সর্বোচ্চ।

১। প্রধান সূত্র - "আমি সুভাষ বলছি" - শৈলেশ দে, ৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪০১ - ৪৪৬।
২। ইন্টারনেটে "British Archives, Secret Letters Reveal Netaji, not Gandhi gave us freedom" বা এ ধরণের শব্দাবলী সার্চ করলে এর সমর্থনে অজস্র তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে।

০১ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলার একুশ - একুশের রাণী 

 

 

সেই স্কুল আজও আছে, নেই শুধু এক অসাধারণ শিক্ষয়িত্রী যিনি মাতৃভাষাকে দানবের গ্রাস থেকে  রক্ষা করার জন্য ধ্বংসের করাল গর্জন শুনেছিলেন সংগীতের মতো

 

নারায়ণগঞ্জ।

২১শে  ফেব্ররুয়ারী ১৯৫২।

ফুঁসে ফুঁসে উঠছে শীতলক্ষার ঢেউ। অগ্নিগর্ভ অগ্নিগিরির মতো বিস্ফোরোন্মুখ হয়ে আছে সুজলা সুফলা দেশটা। একটা ক্রোধ আর ক্ষোভের ঢেউ ছেয়ে দিয়েছে সারাটা দেশ। কিভাবে পাকিস্তান হল, কে পাকিস্তান বানাল তা সবার স্পষ্ট মনে আছে। ১৯৩৭ সালে পাকিস্তান-রেফারেন্ডামের নির্বাচনে পাঞ্জাবে সেকান্দার হায়াত খানের ইউনিয়নিস্ট পার্টি আর অকালি দলের কাছে, আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সর্দার বাহাদুর খানের লালকোর্তা পার্টির কাছে পরাজিত হয়েছে মুসলিম লীগ, শুধু সিন্ধুতে জিতেছে, তাও টাই করার পর স্পীকারের ভোটে।  আর বাংলায়? বাংলায় মুসলিম লীগের ৫৯ আর কৃষক প্রজা পার্টির ৫৫ নির্বাচিত সদস্য মিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের দাবি।

সেই অবদানের এই পরিণাম ! সারাদেশের শতকরা ৫৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে, নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত বাংলাভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা নয়, অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সম্মান দিতেও এত আপত্তি ! এতই আপত্তি যে তার জন্য বরকত, জব্বার, সালাহউদ্দীন, শফিউর রহমান, আব্দুস সালামের মতো ছাত্রকে, ব্যবসায়ীকে, চাকুরিজীবী এবং রিকশাচালকের মতো সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা যায় !

ঝড় উঠেছে সারাদেশে। যে মুহূর্তে শহীদের রক্ত স্পর্শ করেছে মাটি, বিদ্রোহ চারিদিকে। বিদ্রোহ আজ নারায়ণগঞ্জেও। প্লাবনের মতো পথে নেমে এসেছে জনতা। দিনে-রাত্রে বিরামহীন চলছে মিছিল। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত আকাশ বাতাস। ছাত্র, মজুর, কৃষক, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, শিক্ষক, দশ থেকে সত্তর বছর বয়সের পুরুষ মহিলা কে নেই সেখানে ! এতবড় একটা আন্দোলন, কিন্তু কোথাও কোনো হিংস্রতা নেই। জ্বালানো পোড়ানো নেই। এমনি শক্ত হাতে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন ডক্টর মুজিবুর রহমান, শামসুজ্জোহা, সফি হোসেন খান আর...

আর ?

স্তম্ভিত বিস্ময়ে নারায়ণগঞ্জবাসী দেখল তাদের এত বছরের চেনা, এত পরিচিত মমতাজ বেগমকে আজ আর চেনা যাচ্ছে না। মর্গান গার্লস হাই স্কুলের চিরপরিচিতা প্রধান শিক্ষয়িত্রীর হাতে আজ বই-পুস্তকের বদলে উড়ছে বিদ্রোহের পতাকা। কেতাবি শিক্ষা ছুড়ে ফেলে দিয়ে জীবনের অন্য এক ব্রত শেখাবার জন্য পথে নেমেছেন শিক্ষয়িত্রী। যেমন নেমেছিলেন লিবিয়ার ওমর মুখতার তাঁর গাছতলার মাদ্রাসা পেছনে ফেলে, আশি বছর বয়সে। মিছিলে-শ্লোগানে-বিদ্রোহে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছেন মমতাজ বেগম, সমস্ত নারায়ণগঞ্জের উত্তাল বন্যা তাঁর পেছনে। প্রমাদ গুনলেন পাকিস্তানী এস.ডি.ও. ইমতিয়াজী। ২৯শে ফেব্রুয়ারী তাঁকে গ্রেপ্তার করে আনা হল থানায়। ক্ষোভে দুঃখে নারায়ণগঞ্জ তখন উন্মত্তপ্রায়। জামিন আনা হল তৎক্ষণাৎ, কিন্তু জামিন পাওয়া গেল না। পরদিন কোর্টে নগদ দশ হাজার টাকার জামিন এল (৫২ সালের দশ হাজার)। তা-ও নাকচ হল। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতার চাপে কোর্ট তখন পর্যুদস্ত। পুলিশের ভ্যানে মমতাজ বেগমকে ঢাকা পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। বাধা দিল জনতা। আবার সেই লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাসের পুরনো কাহিনী। নিরস্ত্র ছত্রভঙ্গ জনতা এবার বন্ধ করে দিল চাষাড়া রেলক্রসিংয়ের রেলগেট। আরেক দফা সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস। জনতাও তখন মরিয়া। চাষাড়া থেকে পাগলা পর্যন্ত ছ’মাইল রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ ততক্ষণে কেটে ফেলে রেখেছে দশ-বিশ-পঞ্চাশটা নয়, একশো-ষাটটা বড় বড় গাছ। নিরস্ত্র জনতার প্রতিরোধ। নেত্রীর প্রতি সাধারণ ‘অশিক্ষিত’ দেশবাসীর বুকভরা ভালোবাসা উপঢৌকন। পুলিশ ভ্যানে বসে সব দেখছেন মমতাজ বেগম। কি ভাবছেন কে জানে !

সংঘর্ষে আহত হয়ে হাসপাতালে চলে গেলেন ইন্সপেক্টর দেলোয়ার হোসেন। এবং তখনি আশেপাশের গ্রাম থেকে বন্যার মতো ছুটে এল গ্রামবাসীরা। জনতার কারাগারে পুলিশ বন্দি হয়ে বসে রইল। ডাক পড়ল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্সের। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে স্মরণাতীতকালের প্রথম কারফিউ জারি হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১৫জনকে, দু’জন ছাত্রীসহ। এতবড় সংঘর্ষ, পুলিশ একবারও গুলিবর্ষণ করেনি। সম্ভবত ইমতিয়াজীর নির্দেশ ছিল এটা।

পরদিন ঢাকার থানায় অন্য নাটক। মুক্তি চাই ? আমরাও তো তোমাকে ছেড়ে দিতেই চাই। এই কাগজটায় একটা সই করে দাও। এক্ষুণি ছেড়ে দিচ্ছি। কিসের কাগজ ওটা ? ওটা হল মুচলেকা। ‘যাহা কিছু করিয়াছি, ভুল করিয়াছি, আর কদাপি করিব না।’ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন মমতাজ বেগম। মুশকিলে পড়লেন পুলিশ কর্তারা। একে মহিলা, তার ওপর আবার শিক্ষয়িত্রী। শেষে একটা কেলেঙ্কারী হয়ে না যায়। পুলিশ গিয়ে পড়ল মমতাজ বেগমের স্বামীর কাছে। ঘরের বৌ থানা হাজতে আছে ক’দিন থেকে, একি ভালো কথা ? একটু বুঝিয়ে দেখো না ! তাই তো ! টনক নড়লো স্বামী প্রবরের। ছুটে এলেন থানায়। যা হবার হয়েছে, এখন কাগজটায় সই করে ঘরে ফিরে চল।

হতবাক হয়ে গেলেন মমতাজ বেগম। পঞ্চাশ দশকের বাংলায় রক্ষণশীল সমাজের সম্মানিতা শিক্ষয়িত্রী হয়ে তিনি রাস্তায় নেমেছেন। থানা হাজতে আটক আছেন দিনের পর দিন শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য। আগ্রাসন থেকে প্রিয় মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য। সহযোগিতা আর উৎসাহ তো তাঁর দরকার স্বামীর কাছ থেকেই সর্বপ্রথম। তার বদলে এই !

ক্ষেপে উঠলেন স্বামীপ্রবর। এত বড় আস্পর্ধা। হতচ্ছাড়া মেয়েমানুষ কথা শোনে না দেখি ! এক্ষুণি করে দাও সই, নইলে বের করে দেব বাড়ি থেকে। তালাক দিয়ে দেব ! কিন্তু তাই কি হয় ! জননী জন্মভূমি একবার যাকে ডাকে, ‘সে অনাদি ধ্বনি’ যে একবার শুনতে পায় তার পথ বড় বন্ধুর। স্বাভাবিক আরামের পুরনো জীবনে কখনো ফিরে আসতে পারে না সে। পারলেন না মমতাজ বেগমও। হয়ে গেল তালাক, নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের ব্রহ্মাস্ত্র।

অন্য সব কষ্ট নিতে পারতেন কিন্তু স্বামীর প্রবঞ্চনা সহ্য করতে পারলেন না, দীর্ঘ আঠারো মাস কারাগারে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে এল তাঁর শরীর। ঢাকার আনন্দময়ী গার্লস স্কুল আর বাওয়ানী একাডেমীতে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেন।  তারপর কেউ জানলনা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১৯৬৭ সালের ৩০শে মার্চ নিভে গেলো তাঁর মৃত্যুহীন প্রাণ। কেউ জানলনা একান্ত অনাড়ম্বরে আজিমপুর গোরস্তানে তিনি চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে, তাঁর কবর কোথায় তাও আজ কেউ জানে না। একমাত্র সন্তান খুকু তখন বিদেশে।

একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে বাংলাদেশ হয়েছে। ইতিহাস থেকে, দলিল থেকে মুছে গেছেন মমতাজ বেগম। মুছে গেছেন প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রতিষ্ঠা থেকে, স্বামী-সন্তানের মাধুর্যময় পারিবারিক জীবন থেকে। আমরা কেউ তাঁকে মনে রাখিনি, একুশে পদক তাঁর পদস্পর্শ করে ধন্য হতে পারেনি।

মর্গান গার্লস হাই স্কুল আজও আছে। নেই শুধু এক অসাধারণ শিক্ষয়িত্রী। দেশের জন্য, মাতৃভাষার জন্য যিনি ধ্বংসের করাল গর্জন শুনেছিলেন সঙ্গীতের মতো ॥

   

(এ নিবন্ধ লেখার অনেক পরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেছে। সেই সাথে তাঁর সম্মানে নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের সামনের সড়কটির নাম 'ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’রাখা হয়েছে)।

 

 

বাংলার একুশ - টার্নিং পয়েণ্ট

 

২০শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২।

মহাকালের ক্রান্তিলগ্নে এসে দুলছে বাংলার ইতিহাস। “টু বি অর নট টু বি, দ্যাটস দ্য কোশ্চেন”। ৯৪ নবাবপুরে রোডে বসেছে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা। আগামীকাল ২১শে ফেব্র“য়ারি মিছিল করতে দেবে না নুরুল আমিন সরকার। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। সে নির্দেশ কি মেনে নেয়া হবে, নাকি মিছিল হবে, চলছে আলোচনা, বক্তৃতা। নানারকম বাক্য-চাতুরিতে পানি ঘোলা করে সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে আসছে সংগ্রাম পরিষদ। মনসা পূজোয় সাপ তাড়ানোই ভালো। লাঠালাঠির মধ্যে আমরা নেই। রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহের সাঁওতাল, নানকার ও হাজং বিদ্রোহে সরকারের চণ্ডমূর্তি তো আগেই দেখা গেছে। সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাকে মাত্র সেদিন দেশের বাইরে ছুড়ে ফেলেছে। ফজলুল হকের মতো ‘শেরে বাঙাল’কে আছাড় মেরেছে। এ হেন উন্মাদ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা দেন-দরবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই ভালো। দেশপ্রেমের জন্য পুলিশের ডাণ্ডা খেতে চাই না বাপু। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। দেখছ না, ঢাকার এতকালের বাঙালি ম্যাজিস্ট্রেট বর্ষিয়ান হায়দার সাহেবকে সরিয়ে ফরিদপুর থেকে বদরাগী কোরেশী সাহেবকে মাত্র পরশুদিন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট করা হল। কে জানে ওর মনে কি আছে। তাই আগামীকালের ১৪৪ ধারা আমরা লক্ষ্মীছেলের মতো মেনে নেব। আমরা মানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, তমুদ্দুন মজলিশ এরা। মেজরিটি ভোটে পাস হয়ে গেল নতজানু সিদ্ধান্ত। মিছিল হবে না।

‘না ! এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না।’ অবাধ্য ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল যুবলীগের অলি আহাদ, ফজলুল হক হলের আর মেডিকাল কলেজের সংসদের ভিপি যথাক্রমে শামসুল আলম ও গোলাম মওলা, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন। মেজরিটির সিদ্ধান্তের বিপক্ষে এবং ইতিহাসের পক্ষে অমোঘ উচ্চারণ করে গেল ‘একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে দু’শো চুয়াল্লিশ খণ্ডে পরিণত হবে। কাল নয়, আজই।’ ততক্ষণে বিশ পেরিয়ে একুশের আঙিনায় পা রেখেছে ঘড়ি। স্তম্ভিত মেজরিটির চোখের সামনে চারটে অগ্নিকণা মাঝরাতের অন্ধকারে রওনা হয়ে গেল আলোকিত সূর্যের সন্ধানে। সুদূর ভবিষ্যতে একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ আর ষোলই ডিসেম্বরের চোখে তখন ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি। আর ভয় নেই।

ইতিহাস এভাবেই তৈরি হয়। মুক্তিপথের হে অগ্রদূত ! কণ্টকপথের হে তীর্থযাত্রী ! তোমাদের শতকোটি সালাম ॥

ভাই

তুমি বাপু আমাদের... বলবার কে ? তুমার খেয়েপরে হাসতিছি মোরা ?’

খেঁকিয়ে উঠলো রেঙ্গুনগামী জাহাজের বাঙালি খালাসিরা শ্রীকান্তের উপর। অপরাধ ? বিনাদোষে খামাকাই জাহাজের বৃটিশ ডাক্তার ওদের গালাগাল করে বুটের লাথি দিচ্ছিল, আর ওরা হি হি করে হাসছিল, তখন রাগ সামলাতে না পেরে খালাসিদের বকেছিল শ্রীকান্ত। বিদেশির প্রতি আমাদের মনোভাব চমৎকার ফুটে উঠেছে শরৎচন্দ্রের “শ্রীকান্ত” উপন্যানের এ অংশটায়।

 ২৯শে ডিসেম্বর, ১৯৩০। মহা উৎসাহ উদ্দীপনায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন চলছে এলাহাবাদে। ভাষণ দিচ্ছেন মহাকবি ‘আল্লামা’ ইকবাল। সভাপতি কবি মানুষ।  শব্দচয়নে, বাক্যবিন্যাসে ললিত, কাব্য মাধুর্যে ভরপুর মহাকবির বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো উৎকর্ণ হয়ে শুনছে ভারতের কোটি কোটি মুসলমান, যার ৩৯% অংশ বাস করে বাংলায়। শতাব্দীর পরাধীনতা ও মেজরিটি হিন্দুর পটভূমিতে ভারতীয় মুসলমানের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ ও অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ও সমস্যা স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন মহাকবি। তারপর সমাধানের পথও বাতলে দিলেন। পথটা হল:-

I would like to see the Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single State”.

পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে মুসলমানদের একটা স্বাধীন দেশ বানালেই ভারতের সব মুসলমানদের তাবৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! অর্থাৎ প্রস্তাবের মধ্যে ভারতবর্ষের মুসলিমদের ৩৯% আমরা বাঙালীরাই নাই!    

মারহাবা!

তিন বছর পর ১৯৩৩ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী পাকিস্তান নামটি প্রস্তাব করেন, পরে মুসলিম লীগ এই নামটিই গ্রহণ করে  :

P = পাঞ্জাব

A = আফগানিস্তান

K = কাশ্মীর

S = সিন্ধু

TAN = বেলুচিস্তান।  

     

অর্থাৎ আবারও, এই নামের মধ্যে ভারতবর্ষের মুসলিমদের ৩৯% আমরা বাঙালীরাই নাই!

সাত বছর পর। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের জেনারেল কনভেনশনে প্রস্তাব গৃহীত হলো - ওটাই "পাকিস্তান প্রস্তাব" নামে বিখ্যাত।  নিয়তির পরিহাস!  "পাকিস্তান প্রস্তাব" নামে বিখ্যাত ওই লাহোর প্রস্তাবে "পাকিস্তান" শব্দটাই নাই।  তাহলে প্রস্তাবে আছেটা কি ?  মোদ্দাকথায় :-

"North-Western and Eastern Zones of India, should be grouped to constitute ‘Independent States’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign".

অর্থাৎ ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বের মুসলিম প্রধান অঞ্চল গুলো একত্রিত করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস অর্থাৎ স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করা হবে - গবেষক রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দিন আহমেদের "পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি" - পৃষ্ঠা ৭২।

আরো ৬ বছর পর, ১৯৪৬ সাল।  দিল্লিতে মুসলিম লীগের দলীয় আইনসভার সদস্যদের সভায় সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে লাহোর প্রস্তাবকে বদলে দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে "রাষ্ট্রসমূহ"এর জায়গায় একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়।

অর্থাৎ ১৯৪০ সালে লক্ষ লক্ষ জনগণের সামনে উন্মুক্ত জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবকে মুসলিম লীগের আইন পরিষদ ড্রয়িংরুমে বসে অত্যন্ত অন্যায় ভাবে বদলে দিলেন এই অধিকার তাদের ছিলনা এবং এ নিয়ে বিরোধিতাও হয়েছে কারণ জেনারেল কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাব বদলাতে হলে জেনারেল কনভেনশনেই বদলাতে হবে।  এ ব্যাপারে জিন্নাহকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে  তিনি বলেন দ্যাট ওয়াজ এ টাইপিং মিস্টেক!

এইসব ঠকবাজির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম। সত্যিকথা বলতে কি, ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি সে ওই ১০৮০ সালের লাহোর প্রস্তাবেই ছিল। চলুন আরেকটু অতীতে যাই।      

উনিশশো’ নয়, একেবারে আঠারোশো’ কুড়ি সালের কথা। শিখ রাজা রণজিত সিংহের কব্জায় পিষে যাচ্ছে পাঞ্জাবের মুসলমান। এমনকি, আজান দেয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। বিদ্রোহী হয়ে জেহাদের ডাক দিলেন সৈয়দ আহমদ (পরবর্তীকালের স্যার সৈয়দ আহমদ নন)। জেগে উঠল সারা ভারতের এবং বাংলার মুসলমান। দলে দলে ছুটল পাঞ্জাবের দিকে। রক্তস্রোতে ভাসতে থাকল পাঞ্জাব। কিন্তু সেই রক্ত কার রক্ত ? পরিষ্কার লেখা আছে উইলিয়াম হাণ্টার সাহেবের চিরস্মরণীয় বই ‘দি ইণ্ডিয়ান মুসলমানস্’-এর পাতায় পাতায়। প্রাণ দিচ্ছে পাঠান, প্রাণ দিচ্ছে বাংলা-বিহারের মুসলমান সুদূর পাঞ্জাবে গিয়ে, তাদেরই মুক্তির জন্য।

শুধু ঐ দেখ, পাঞ্জাবি গুজর খান চারজন বাঙালি জেহাদী তরুণদের ধরিয়ে দিচ্ছে শত্রুর হাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হবার জন্য। খেয়াল কর, বাঙালি ভ্রান্ত প্রচেষ্টার কথা। নিজের জননী জন্মভূমির স্বাধীনতায় জীবন না দিয়ে হাজার মাইল দূরের ‘ভাই’দের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে তাদেরই হাতে নিহত হয়েছে সে। নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে ‘ভাই’দের স্বার্থরক্ষার ইতিহাস এটা। এই আমরাই সেই আমরা। এই ওরা, সেই ওরাই। পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ নয়, শাসক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য।

আসা যাক ১৯৪৭ সালে। আনন্দ, কি আনন্দ ! এধারে সাড়ে চার আর ওধারে তিন, একুনে সাড়ে সাতকোটি মানুষের মুখে হাসি আর ধরে না। চিরকালের অপমানিত মাতৃভূমিটা হঠাৎ গর্বিতা অপ্সরা হয়ে উঠেছে। কি মূল্যে এটা কেনা হয়েছে, ব্যথাভরা সে ইতিহাস আজ থাক। আজ শুধু আনন্দ হোক, হাসি হোক। হাসিখুশি গাঁয়ের ফোকলাবুড়ি হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করছে –

“ও বাবারা, এখন তো তাহলে পুলিশ, জেলখানা কিছু থাকবে না, তাই না”?

“কেন রে বুড়ি, পুলিশ জেলখানা থাকবে না কেন”?

"বাহ্ ! এখন যে পাকিস্তান হয়ে গেল। এখন তো আর চোর ডাকাত বলে কিছু থাকবে না। তাহলে আর পুলিশ জেলখানা দিয়ে কি হবে"?

হায়রে আশা ! গাঁয়ের ফোকলাবুড়ি কি জানে ওদিকে সুদূর পশ্চিমে তার মুসলমান ‘ভাই’ বসে আছে শুভঙ্করের খাতা খুলে ! বিনা বাতাসেই নিঃশব্দে নিশ্চুপে অতি ধীরে নড়ে উঠছে অধর্মের কল। এদিকে গোটা ভারতবর্ষে তখন রেশ চলছে, ‘হাত মে বিড়ি, মুহমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’ (এটাই তো চমৎকার পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত হতে পারতো ! পঁচিশ বছরের পাকিস্তানী রাজনীতির ক্যারিকেচারের সাথে মিলতো ভালো ! হরদম রেডিও টিভিতে, স্কুল কলেজে উড্ডীন পতাকার সামনে গাওয়া হতো, ‘হাত মে বিড়ি...’)।

এত আনন্দের মধ্যেও ভুরু কুঁচকে আছে দু’একজনের। হিসাবটা মিলছে না কেন। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে যা হবার তা হচ্ছে না কেন ! ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, দু-দু’জনের আছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসনীয় অভিজ্ঞতা, তবু কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রীত্বে অভিজ্ঞতাহীন লিয়াকত আলী কেন ? নোবেল সম্মানিত ৫৬% অংশের ভাষাকে অস্বীকার করে কিছুই না জানিয়ে হঠাৎ ‘পাক সার জমীন’ জাতীয় সঙ্গীত হলো কেন ? পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা কাউন্সিলে ভারতের বিপক্ষে সুদূর উত্তর প্রদেশের মিঃ ওয়াসীম কেন ? মুসলিম মেজরিটির মুর্শিদাবাদ, মালদহ কোথায় ? কোথায় গেল ভাঙ্গর, করিমগঞ্জ, বশিরহাট, ব্যারাকপুর ? জন্মের পর সুদীর্ঘ ছয়-সাত মাসেও ৫৬% পাকিস্তানীর চেহারা দেখার ফুরসৎ জাতির পিতার হচ্ছে না কেন ? পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ কমিটি অক্ষত রেখে শুধু বাংলার মুসলিম লীগ কমিটি বিভক্তির অজুহাতে অন্যায় ও নির্লজ্জভাবে ভেঙে সেখানে স্বাধীনচেতা সোহরাওয়ার্দীকে বরখাস্ত করে ধামাধরা নাজিমুদ্দীনকে বসান হলো কেন ? আর, ঐ দেখ ১৯৪৬ সালের অখণ্ড ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুসলিম লীগের মন্ত্রীপরিষদ। সেখানে পাঁচ পাঁচজন মন্ত্রীর মধ্যে একজনও বাঙালি মন্ত্রী নেই কেন ? স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকেই মুসলিম লীগের ফর্ম শুধু পূর্ব পাকিস্তানে উধাও হয়ে গেল কেন ? কেন ? কেন ?

চুপ ! চুপ ! কোনো প্রশ্ন নয় এখন। প্রশ্ন করে আনন্দের ব্যাঘাত করো না। আনন্দ, ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো আনন্দ করে যাও শুধু। ছাগলের দু’টো বাচ্চা দুধ খায়, জায়গা হয় না বলে তিন নম্বরটার কপালে কিছুই জোটে না। তবু তার তিড়িং বিড়িং দেখে কে ! নেতাদের কাজ নেতারা তো করছেনই। ঐ দেখ, মুখ্যমন্ত্রী হয়েই নাজিমুদ্দীন ‘কিপ ক্যালকাটা’ আন্দোলন থেকে সরে পড়েছেন। কলকাতা পাকিস্তানে এলে প্রাদেশিক তো বটেই, কেন্দ্রীয় রাজধানী হবারও সম্ভাবনা। তাহলে নাজিমুদ্দিনের বাপ-দাদার ভিটে ঢাকা বা জিন্না’র জন্মস্থান করাচীটার কি হবে ? তার চেয়ে কলকাতার ক্ষতিপূরণ বাবদ যে তেত্রিশ কোটি টাকা পাব, তা দিয়ে ঢাকাটা একেবারে লণ্ডন করে ফেলব আমরা। টাকাটা পাবার জন্য মার্কেট ভ্যালুতে দেনা-পাওনার সিদ্ধান্ত হওয়ার দরকার। (বিশ বছর আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বানানো বাড়িটার এখন মার্কেট ভ্যালু পাঁচ লক্ষ টাকা, কিন্তু বুক-ভ্যালুতে ডেপ্রিসিয়েশন ধরে ওটার মূল্য হাজার পাঁচেকের বেশি নয়)।

এ নিয়ে কেন্দ্রীয় বাঁটেয়ারা কাউন্সিলে কথা তো চলছেই, কাজেই উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। সেখানে ‘ভাই’রা আছে না ! লিয়াকত আলী চৌধুরী, মুহম্মদ আলী এরা আছেন। এদিকের অবশ্য কেউ নেই। কিন্তু তাতে কি ! তাতে এই যে ন্যাড়া মাথায় ঠকাস্ ক’রে বেল পড়লো, যখন ’৪৭-এর ৯ই ডিসেম্বর সর্দার প্যাটেল ঘোষণা করলেন, অতি আনন্দের সাথে বুক ভ্যালুতে সম্পত্তির মূল্য স্থির করেছে মুসলিম লীগ। হায় হায় ! একি হলো ! এতগুলো টাকা গচ্চা গেল ! দু-দুটো আলী মিলেও লড়াইটা জেতা গেল না !

জেতা যাবে না কেন ! যার জিতবার সে-ই জিতেছে। মার্কেট ভ্যালু হলে পূর্ব পাকিস্তান তেত্রিশ কোটি টাকা পাবে ঠিকই কিন্তু তাহলে ওদিকে যে লাহোর-কোয়েটা বাবদ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে ম্যালা পয়সা গুনতে হয়। তাই বুক ভ্যালুই ভালো।

মুহূর্ত মুহূর্ত ক’রে গড়ে উঠেছে ইতিহাস। দেখে যাও শুধু। অনেক কিছু ঘটবে আরো। লিয়াকত আলীর হুঙ্কার শোনা যাবে ‘শির কুচাল দেঙ্গে’। উর্দুতে ছাপা হবে ‘আগার বাঙালি ইনসান হ্যায় তো ভূত কহুঁ কিসকো।’ বিদেশি মার্কিনী সাংবাদিক কালাহানের সাক্ষ্য-বিবৃতিতে প্রাণের নেতা ফজলুল হককে বরখাস্ত করা হবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অন্যতম সৈনিক সোহরাওয়ার্দীকে লিয়াকত আলীর মুখ থেকে শুনতে হবে ‘ভারতের লেলিয়ে দেয়া পাগলা কুকুর’, যে লিয়াকত আলী কোথাও পায়ের নিচে মাটি না পেয়ে ফজলুল হকের দয়ায় পটুয়াখালী (বা পিরোজপুর) থেকে নির্বাচনে জিতেছিল। কলকাতা থেকে এসে ঢাকা বিমানবন্দরেই ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণায় বিতাড়িত হতে হবে সোহরাওয়ার্দীকে খাজা নাজিমুদ্দীন দ্বারা, যে নাজিমুদ্দীনকে ঐ সোহরাওয়ার্দীই কলকাতার আসনটি উপহার দেন নির্বাচনে নাজিমুদ্দীন পরাজিত হবার পর। এখনো অনেক বাকি। হঠাৎ করে সরকারি কর্মচারী গোলাম মুহম্মদ হয়ে যাবেন বড়লাট ! আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মুহম্মদ আলী উড়ে এসে হয়ে যাবেন প্রধানমন্ত্রী ! পল্টনে লেফ্ট্-রাইট্ করতে করতে প্রেসিডেণ্ট হয়ে যাবেন ইস্কান্দর মীর্জা ! নির্বাচিত না হয়ে যেসব পদে যাবার অধিকার কারো নেই।

শুধু দেখে যাও। ব্যস্ত হয়েছে শুভঙ্কর। অনেক কিছু ঘটবে আরো। মাকড়সা যেমন পোকাটা ধরে ওপরের খোলসটা ঠিক রেখে ভেতর থেকে রক্ত-মাংস চুষে খায়, তেমনি শুধু ছোবড়া পড়ে থাকবে সুজলা সুফলা দেশটার। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে উনিশশো বাহান্নো, আটান্নো, পঁয়ষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর। দেখে যাও শুধু।

        

কিন্তু সুজলা সুফলা দেশটার সম্পদে আমরা অধিকার হারিয়েছি মধ্যযুগেই। ততদিনে বাংলায় পরিমল লোভে অনেক অলিই এসে জুটেছে। বাংলারই মাটিতে বাংলার মসনদ নিয়ে মরণ-কামড়ে লড়েছে মারাঠি-তিব্বতি, আরাকানি, মোগল-পাঠান, আফগানী, তুর্কি আফ্রিকার হাবশি, ইংরেজ ফরাসি, পর্তুগজি, আরমেনিয়ান, ওলন্দাজ, কর্ণাটকী, কে নয়। কিন্তু ওরা ‘ভাই’ ছিল না। ‘ভাই’রা এল ১৯৪৭ সালে। তারপরের ২৪ বছরের ইতিহাস, শুধু ঠকবাজী, মিথ্যাভাষণ, বঞ্চনা, এবং নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। সবারই তা মোটামুটি জানা। কিছু সংখ্যার হিসাব তুলে ধরব।

তার আগে, মানসিকতা নিয়ে, অ্যাটিচ্যুড নিয়ে কিছু বলা যাক, যে মানসিকতায় স্বাধীনতার প্রথম কাতারের সৈনিক সোহরাওয়ার্দী হয়েছিলেন ‘ভারতের লেলিয়ে দেয়া পাগলা কুকুর’ এবং প্রাণের নেতা, ‘লাহোর প্রস্তাব’-এর ঘোষক ফজলুল হক হয়েছিলেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, সেই পথ ধরে একাত্তরের লক্ষ লক্ষ বাঙালি হয়েছিলেন খুন, লক্ষ বাঙালিনী হয়েছিলেন লঙ্ঘিতা।

১.   ‘পূর্ব পাকিস্তানের মূর্খ জনগণ ভোট দিতে জানে না। ... এদের শুধু ডাণ্ডাপেটা করে শাসন করা দরকার’ - প্রেসিডেণ্ট ইস্কান্দার মীর্জা। স্মর্তব্য, ১৯৩৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর নির্বাচনে এক সিন্ধু ছাড়া (স্পীকারের দেয়া ১ ভোটের মেজরিটি) সারা পশ্চিম পাকিস্তানে যখন মুসলিম লীগ হেরে গিয়েছিল, তখন এই ‘মূর্খ’ জনগণের ভোটেই পাকিস্তান আলো-বাতাসের মুখ দেখতে পেয়েছিল। মুসলিম লীগ ৫৯ ও কৃষক প্রজা পার্টি ৫৫ সিটে বিজয়ী হয় ও এই দুই দল মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে ("দুই নম্বর চার নম্বর" অধ্যায় দেখুন")।

২.   বাংলার মুসলমানরা খৎনা করায় না। সন্তানের নামকরণের জন্য তারা হিন্দু বাড়ি যায় (ফিরোজ খান নুন)।

৩.   পূর্ব-পাকিস্তানীরা দেশের শাসনভার গ্রহণের অনুপযুক্ত (আইয়ুব খান)।

৪.   পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেন্দ্রীয় ‘সার্ভে অব্ পাকিস্তান’ দপ্তরটি পাকিস্তানের যে সরকারি ম্যাপ প্রকাশ করতেন, যা বিভিন্ন দেশে পাকস্তানী দূতাবাসগুলিতেও ঝুলানো থাকতো, সে ম্যাপে বড় করে দেখানো হতো শুধু পশ্চিম পাকিস্তান। ম্যাপের কোণায় ইনসেট করে খুব ছোট আকারের পূর্ব-পাকিস্তান, জুনাগড় এবং মানভাদার দেখানো হতো। এ ম্যাপটাই ছিল ‘ভাই’দের মনের ম্যাপ।

এবার আসা যাক হিসাবের কড়িতে, যা নাকি বাঘেও খায় না।

১. ১৯৭০ সালে - কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ সরকারি পদ :

সেক্রেটারি  -   পশ্চিম ৪২, পূর্ব ০

জয়েণ্ট সেক্রেটারি  -   পশ্চিম ২২, পূর্ব ৮

ডেপুটি সেক্রেটারি  -   পশ্চিম ৬০, পূর্ব ২৩

সেকশন আফিসার  -   পশ্চিম ৩২৫, পূর্ব ৫০

প্রতিরক্ষা বাহিনীতে -   পশ্চিম ৯০%, পূর্ব ১০%

২.   রাজস্বের :-

    ৬২% প্রতিরক্ষা বাহিনীর খরচ (৯০% পশ্চিমে)

    ৩২% কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ (অর্থাৎ পশ্চিমে)

    ৩% করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান

৩.   ১৯৪৭-১৯৬১: উন্নয়নমূলক প্রকল্প

    পশ্চিম ১২৯৮ কোটি টাকা - পূর্ব ৩০ কোটি টাকা।

৪.   ১৯৪৭-১৯৮০ : সার্বিক উন্নয়ন

    পশ্চিম ৮৮%, পূর্ব ১২%

৫.   ১৯৪৭-১৯৭০ : বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়

    পশ্চিম ১৭০০ কোটি / ৩৭০০ কোটি

    পূর্ব ২২০০ কোটি / ১৫০০ কোটি

৬.  ১৯৬০-১৯৭০ : মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি

    পশ্চিম ১৩৭ টাকা - পূর্ব ৩৯ টাকা।

৭.   ১৯৬৪-১৯৬৯ : উন্নত বীজ বিতরণ

    পশ্চিম ৩৪২ হাজার টন - পূর্ব ৪০ হাজার টন

    এবারে দেখা যাক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অঞ্চলে সংখ্যায় কত বেড়েছে :

    মাধ্যমিক বিদ্যলয়

    পশ্চিম ১৯৭৪ - পূর্ব ৪৮৩

    কলেজ

    পশ্চিম ২৩১ - পূর্ব ১২৩

    বিশ্ববিদ্যালয়

পশ্চিম ১৭ - পূর্ব ৫

অজস্র উদাহরণের তালিকা। সে তালিকাও অসম্পূর্ণ। বিশ্লেষণে বসলে একটা তথ্যই বেরিয়ে আসে। চোর ডাকাতকে দোষ দিয়ে লাভ কি। ঘরে সম্পদ রেখে দরজা খুলে ঘুমাই কেন আমরা। এ দোষ আমাদেরই। সিংহভাগ দোষ আমাদের নেতাদের। উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি।

১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় গণপরিষদের পূর্বের ৪৪ এবং পশ্চিমের ২৫টি আসন ছিল। পশ্চিমে ৮০ লক্ষ মোহাজেরের বাহানায় (পূর্বেও মোহাজের এসেছিল, কিন্তু তাতে কি) ২৫ বেড়ে হলো ৩৫। তারপর লিয়াকত আলীর হুকুম মেশানো অনুরোধে পূর্বের মূখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন নিজের ৪৪টি আসন থেকে ৬টি আসন ‘ভাই’দের উপহার দিলেন। ফলে ৫৬% জনসংখ্যার আমাদের ৪৪টি আসন কমে দাঁড়ালো ৩৮টিতে, আর ৪৪% জনসংখ্যার ‘ভাই’দের ৩৫টি আসন বেড়ে দাঁড়ালো ৪১টিতে। আমরা মেজরিটি হয়ে গেলাম মাইনরিটি, ‘ভাই’দের স্বার্থরক্ষায়। সে স্বার্থের লক্ষণরেখা শ্রীকান্তের টগর বৈষ্ণবীর হেঁসেলের মতোই অলঙ্ঘ্য। হাজার ইসলামের নামে, ভ্রাতৃবন্ধনে, ন্যায়নীতিতে বা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও তা পেরোবার উপায় নেই।

কাজেই একাত্তরকে আসতেই হল ভৈরব গর্জনে ॥

 

 

 

 

 

 

 

একাত্তরের রক্তবীজ

সৃষ্টির আদি থেকে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ কষ্ট পেয়েছে রোগে, শোকে, বার্ধক্যে জরায়, বন্যা, খরায়, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্পে, শীতে উত্তাপে ধ্বসে পড়া পাহাড় বা বাড়ির নিচে, দুর্ঘটনায়, হিংস্র জন্তুর আক্রমণে। কিন্তু এ সুন্দর গ্রহটায়, ফুল পাখি চাঁদ আর রঙিন মাছ প্রজাপতির ধরণীতে মানুষের হাতেই মানুষ কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সংখ্যাতীত মৃতদেহ, আর্তনাদ আর পাঁজর কাঁপানো দীর্ঘশ্বাসে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে মানুষের ইতিহাস।

সে ছলনা এসেছিল ১৯৪৭ সালে। প্রথমে চমৎকার লেগেছিল। পরে ভুল ভাঙলো। এখন অবাক হয়ে দেখি, চারদিকে শুধু ফাঁকি আর ফাঁকি। বন্দি ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তি সনদ পৃথক বাসভূমি, কে স্বপ্নদ্রষ্টা ? মহাকবি ইকবাল ? ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে মুসলিম লীগ অধিবেশনের ঘোষণায় ? ফরগেট ইট ! ছ’বছর আগে ১৯২৪ সালে খোলাখুলি ঘোষণায় লালা লাজপৎ রায় করেননি প্রস্তাবটা ? তারও চার বছর আগে ১৯২০ সালে বাদাউন থেকে প্রকাশিত ‘জুলকারনাইন’ (চোখের আলো) পত্রিকায় গান্ধীজির কাছে খোলা চিঠিতে এ প্রস্তাব করেননি আব্দুল কাদের বিলগ্রামী ? সেটাও প্রথম নয়। তারও আগে দু’জন ভারতীয় ছাত্রনেতা ইতিহাসে সর্বপ্রথম স্টকহলমের (সুইডেন) ছাত্র-কনভেশনে এ প্রস্তাব করেন। নিরেট সত্য দলিল এসব। এতগুলো সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অন্যের হালুয়া নিজের পাতে টানা কেন ?

অন্য কথায় চলে গেলাম। রক্তবীজের কথায় ফিরে আসি। শুভঙ্করের ফাঁকি জমে জমে ডাইনির সুন্দরী চেহারার আড়ালে রাক্ষসী রূপ যখন প্রকাশ পেল, তখন একাত্তরকে আসতেই হল এই বাংলায়। যে দানবকে যুগ যুগ ধ’রে মনে হচ্ছিল অপরাজেয়, তাকে ধরাশায়ী করতে সময় লাগল মাত্র নয় মাস। পূর্ণ এ বিজয়ের আগে অনেকবার পরাজয় ঘটেছে একাত্তরের। মুক্তি পাগল মানুষের হাড়মাংস দিয়ে গড়া অনন্য কাহিনী সেসব। অভূতপূর্ব সে মৃত্যু-মিছিল। এক যায় আর এক আসে। ছবির পর ছবি।

১৯১৫ সালের প্রথমদিক। শীতের রাত। বাইরে ঝুরঝুর বরফ আর বন্ধ ঘরের ভেতরে ম্লান আলোয় টেবিলের কাগজে ঝুঁকে পড়া অবিস্মরণীয় কয়েকটি মুখ। বাক্সময় চোখ, রুদ্ধ আবেগে কম্পিত কণ্ঠ, গভীর নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ইতিহাসের ছিন্ন একটা অধ্যায়, স্বাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষের একটা রেখাচিত্র অস্পষ্টে ফুটে উঠছে সেখানে।

মহেন্দ্রপ্রতাপ, বরকতুল্লা, অম্বাপ্রসাদ, অজিত সিং। গড়ে উঠছে স্বাধীন সরকার ও পতাকা। সুদূর কাবুলে গোপনে। কাবুল থেকে পুরো ভারতবর্ষ হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত তৈরি হয়ে আছে লক্ষ লক্ষ রাসবিহারী, হাফিজ আব্দুল্লা, মদনলাল ধিংড়া, মঙ্গল পাণ্ডে, অরবিন্দু বসু (ঋষি অরবিন্দ পরবর্তীকালে), ডাণ্ডি খান, কর্তার সিং। রুদ্ধশ্বাসে প্রহর গুনছে মহাকাল। অস্থির ঢেউ খেলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের বুকে। তীক্ষè চোখে তাকিয়ে আছেন বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয়, বার্লিন থেকে মানবেন্দ্র রায়ের পাঠানো অস্ত্রভর্তি জাহাজটা কখন এসে পৌঁছবে। আর যে দেরি নেই। দিন আগত ঐ ! ১৯১৫ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি (একুশে ফেব্র“য়ারি!)। এক লহমায় জেগে উঠবে লক্ষ লক্ষ মুক্তিসেনা। কাবুল থেকে সিঙ্গাপুর। স্বাধীনতা চাই। জন্মগত অধিকার চাই। টিক-টিক চলছে ঘড়ি। সুদূর লণ্ডনে পরাক্রমশালী বৃটিশ জাতির মক্ষিরাণী কুইন তখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পালঙ্কে নিদ্রিতা।

ধীরে, খুব ধীরে মাথা তুলে উঁকি দিল মীর জাফরের পূর্বপুরুষ, কৃপাল সিং, নবাব খান। খবর চলে গেল রাজশক্তির সামরিক কেন্দ্রে। একুশের আগেই একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ঝাঁপিয়ে পড়ল ১৯১৫ সালে। মারণাস্ত্রে সজ্জিত বিশাল বাহিনী। গণহত্যা, ধর্ষণ। দাউদাউ জ্বলে গেল পথের পাঁচালীর নিশ্চিন্দিপুর। লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে লক্ষ লক্ষ বিকৃত বীভৎস মৃতদেহে “কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি, নিভায়ে সূর্যতারা”। জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল মুক্তিপাগল মানুষগুলো। অমৃতের শিশুরা ধরণীর খেলা শেষ করে ধূলোমাখা দেহে ঘরে ফিরে গেল। বাসাংসী জীর্ণানী যথা বিহায়, নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি...।

ইতিহাসের জঠরে গড়ে উঠছে একাত্তরের ভ্রƒণ, নড়ে উঠছে যন্ত্রণায়।

গল্প নয়, কল্পনা নয়, সেই দুর্গম পথযাত্রীদল। পরাধীন দেশের রাজবিদ্রোহী, মুক্তিপথের অগ্রদূত। অগ্নিগিরির শতধা বিস্ফোরণে লক্ষ লক্ষ মাতৃভক্তের সুকঠিন আত্মোৎসর্গ। “চারিদিকে মিলি যতেক ভক্ত, স্বর্ণবরণ মরণাসক্ত, দিতেছে অস্থি দিতেছে রক্ত, সকল শক্তি সাধনা, জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে, ধূমায়ে শূন্যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, লুপ্ত করিছে সূর্য্যচন্দ্রে, বিশ্বব্যাপিনী দাহনা”। শরীর চলে যায়, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, স্বপ্ন বেঁচে থাকে। এবার সে স্বপ্ন গিয়ে উঠল পাহাড়-অরণ্যানীর আসামে। আবার ঝলসে উঠল স্বাধীন সরকার। মুকুন্দ কাওতি, কনকলতার হাতে স্বাধীন পতাকা। আবার সেই ‘মওলানা’ মান্নান টিক্কা-নিয়াজীর পূর্বপুরুষ। আবার সেই সশস্ত্র বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব। রক্তাক্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে গেল, পিষে গেল হাজার হাজার যতীন মাঝি, হাজার মুক্তিযোদ্ধার লাশ।

স্বপ্ন ততদিনে পৌঁছে গেছে বোম্বের সিতারা প্রদেশে, বিহারের ভাগলপুরে, যুক্তপ্রদেশের বালিয়ায়। টগবগ করে ফুটছে সারা ভারত, বিশেষ করে বাংলা। “এ যেন বিপুল যজ্ঞকুণ্ড, আকাশে আলোড়ি শিখার শুণ্ড, হোমের অগ্নি মেলিছে তুণ্ড, ক্ষুধার দহন জ্বালিয়া, নরনারী সবে আনিয়া তূর্ণ, প্রাণের পাত্র করিয়া চূর্ণ, বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ, জীবন আহুতি ঢালিয়া।” আবার সেই স্বাধীন সরকার, সেই প্রলয়ের তাণ্ডব। “মরণ আলিঙ্গনে কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে।” আবার সেই হাজার মৃতদেহ, ধর্ষিতা রমণী। স্বপ্ন গিয়ে উঠল সিঙ্গাপুরে। ক্যাপ্টেন ডাণ্ডি খাঁর হাতে উড়ছে স্বাধীনতার পতাকা। আবার স্বাধীন জাতীয় সরকার, থাইল্যাণ্ডে, ইন্দোনেশিয়ায়। আবার টিক্কা-নিয়াজী, আবার গোলাম আযম। মাটির সাথে মিশে গেল অগণিত স্বাধীনতা সৈনিক।

স্বপ্ন ফিরে এল বাংলায়, মেদিনীপুরে। আবার উঠল ঝড়। “দংশন ক্ষত শ্যেন বিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ সনে।” স্বাধীন বেতারকেন্দ্রে তখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. লোহিয়া। গল্প নয়, নয় কল্পনা। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ সেই স্বাধীন সরকার, জীবন ও মৃত্যু শব্দ দু’টো যেন মিলেমিশে একাকার। সমস্ত মেদিনীপুরের জনতা তখন একাত্তরের বাংলাদেশের মতো মরিয়া। আগুন, আগুন চারিদিকে। “বায়ুদলবল হইয়া ক্ষিপ্ত, ঘিরিঘিরি সেই অনল দীপ্ত, কাঁদিয়া ফিরিছে অপরিতৃপ্ত, ফুঁসিয়ে উষ্ণ শ্বসনে।” স্বাধীনতা চাই, চাই জন্মগত অধিকার। নরকের মতো সামরিক বাহিনী আর রাজাকার দলের সাথে হাত মিলিয়ে এবার পুরো মেদিনীপুর জুড়ে নেমে এল প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়। ঘরবাড়ি ক্ষেত ভেঙে একাকার। বিন্দুমাত্র খাবার বা সাহায্য আসতে দেয়া হল না বাইরে থেকে। রক্তাক্ত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল স্বাধীন সরকার ও স্বাধীনতা সৈনিক দল। মচকাল না একবিন্দু। শির নেহারি তার সম্ভ্রমে নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির।

অলক্ষে গড়ে উঠছে একাত্তরের বিশাল দেহ।

সামরিক বাহিনীর ওপর অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে পড়ে রইল তিয়াত্তর বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা ও তাঁর দল। বুলেটে বুলেটে ধুলোর মতো উড়ে গেল বারো বছরের বিদ্রোহিনী ফুলেশ্বরী। এই কেয়ামতের মধ্যে চট্টগ্রামে কোন্ সে অঙ্কের মাষ্টার সূর্য সেন অন্ধকারের গহ্বর থেকে উপড়ে নিয়ে এল স্বাধীনতার সূর্য ! ঝলমল করে উঠল রিপাব্লিকান আর্মি। আবার, “জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে।” বিশ্বাস হয় না, ১৪ বছরের ছেলে ট্যাগরা মাস্কেট্রি রাইফেল দিয়ে ঠেকিয়ে রাখছে গোটা একটা সৈন্যবাহিনী। তারও আগে কে ওই মজনু শাহ্, ভবানী পাঠক, একলক্ষ সন্ন্যাসী ফকির নিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে কলকাতার ওপর !

অমানিশার এই তাণ্ডবের মধ্যে কে ওই ছুটে বেরিয়ে গেল বাংলা থেকে। পায়ে হেঁটে পার হয়ে গেল পাহাড় সমুদ্র আর ইতিহাসের সীমানা। খাইবার, কাবুল, রোম, বার্লিন হয়ে তিনমাসের সাবমেরিনে জাপান ! সিনর অরল্যাণ্ডো ম্যাজোট্টা ওরফে সুভাষ বোস ! কিংবদন্তীর অগ্নিপুরুষ রাসবিহারী ওই কার হাতে তুলে দিচ্ছে স্বাধীন সরকারের সশস্ত্র সামরিক বাহিনী, জেনারেল মোহন সিং, ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ মেজর ধীলন ! কার গর্বিত পদভরে টলমল করছে বার্মা থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং। সুভাষ চন্দ্র বোস ! হিজ এক্সেলেন্সি চন্দ্র বোস ! গহীন অরণ্যে ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ দিল লক্ষাধিক মুক্তিবাহিনী। তবু স্বাধীনতা চাই, জন্মগত অধিকার চাই। কে এরা ? এরাই কি সেই মহাবিদ্রোহী ভৃগু, রাগে দুঃখে বিরাট পিতার বুকে এঁকে দেবে পদচিহ্ন !

ইতিহাসের জঠরে যন্ত্রণায় জন্ম নিচ্ছে ভবিষ্যতের শেখ মুজিব। জন্ম নিচ্ছে মানচিত্র ভাঙাগড়ার সুদক্ষ কারিগর বাংলার তাজ, তাজউদ্দিন। জন্ম নিচ্ছে একাত্তরের হাজার কাদের সিদ্দিকী, জাহাজ মারা হাবীব, আনোয়ারুল আলম শহীদ, আর তারামন বিবি।

স্বপ্ন নয়, গল্পও নয়। মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি মানুষের ইতিহাস। চব্বিশ ঘণ্টায় নয় সে ইতিহাসের দিনরাত। কয়েক শতাব্দী লেগে যায় এক রাতের আঁধার কাটতে। মানব ও দানব, দুই প্রবল প্রতিপক্ষ সৃষ্টির আদি থেকে লড়ে যাচ্ছে পরস্পরের সাথে। রক্তবীজের বংশ দু’জনেই। এক মরে তো একশ’ গজিয়ে ওঠে চোখের পলকে। স্বপ্ন শুধু স্বাধীনতার। স্বপ্ন নয় শত বছরের লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের বিভীষিকা, জ্বলন্ত গ্রাম, লক্ষ বিদ্রোহিনী। গল্প নয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত সাত বছরের বালক মেজবাহউদ্দিন। গল্প নয় শূন্যে ছুড়ে দেয়া শিশুর নেমে আসা আদরের দেহ বেয়নেটের ওপরে। একজন নয়, সংখ্যাতীত। আর, বাংলাদেশের একাত্তরে ? ... “হাত পা চোখ কষে বাঁধা, হুমড়ি খেয়ে পড়লাম কিছু লোকের ওপরে, সবাই বন্দি। শুরু হলো প্রহার। সবাই চিৎকার করে কাঁদছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর। ওপর তলা থেকে ভেসে এল মেয়েকণ্ঠের আর্তনাদ। প্রহারের চোটে সবাই প্রায় অজ্ঞান। কে আমার বাঁধন খুলে দিল। কচি কণ্ঠ, আট-নয় বছরের একটি বাচ্চা ছেলে। দু’হাতের চামড়া কাটা, হাত ফোলা...।”

আর লিখতে ইচ্ছে করে না। লেখা যায়ও না ॥

 

 

 

 

বাংলার মুক্তিসন

১৯৪৭ সাল। ভারত ভাগের সময় তখনকার রাজনীতিবিদরা আমাদের শিখিয়েছিলেন আমাদের একমাত্র পরিচয় ‘আমরা মুসলমান’। পাকিস্তান-রেফারেণ্ডামের নির্বাচনে এই এক মন্ত্রেই মুসলিম লীগ বাংলায় পেয়ে গেল শতকরা ৯2 ভাগ ভোট। তাই ঐতিহাসিকেরা বলেন যে বাংলার মুসলমানেরাই এনেছিল পাকিস্তান।

“পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ” প্রথম জাতীয় সঙ্গীত লিখলেন বাংলার বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা, কিন্তু বাতিল হয়ে গেল সেটা। নেওয়া হল ভারতীয় কবি গীতিকার হাফিজ জলন্ধরী’র ফার্সিতে লেখা “পাক সার জামিন সাদ বাদ”। কেন ? দু’জনেই তো মুসলমান ! বাংলার কবি গোলাম মোস্তফা বাতিল হয়ে গেলেন কেন ? বাঙালি বলে ? মুখ্যমন্ত্রীত্বের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ফজলুল হক আর সোহরওয়ার্দীকে পাশ কাটিয়ে অভিজ্ঞতাহীন অসহিষ্ণু লিয়াকত আলীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হল। কেন ? ডাক টিকিটে, মুদ্রায়, কাগজের নোটে কোনো জায়গায় একটাও বাংলা হরফ নেই সবই উর্দু। কেন ?

২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮। করাচীর গণ পরিষদ অধবেশনে পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিষদে বাংলা ভাষাকে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব করলে তা অগ্রাহ্য করে উর্দু এবং ইংরেজির প্রস্তাব গৃহিত হলো। কেন ? ভুরু কুঁচকে গেল অনেকের।

২৪ শে মার্চ ১৯৪৮। ঢাকায় কার্জন হলে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। এরপর আর কারো বুঝতে বাকি থাকলো না মেজরিটির ভোটটা নেয়ার জন্য “আমরা সবাই মুসলমান” বলে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ওরা বোকা বানিয়েছে আমাদের। এটা একটা পরিষ্কার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। স্বপ্নভঙ্গ হলো সবার। সেই মুহূর্তে গর্জে উঠেছিল বাংলার মানুষ। গীতিকার-সুরকার-গায়ক আবদুল লতিফের অবিস্মরণীয় কথায় এবং সুরে লেখা “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়” গানের মত বহু গান কবিতায় সংস্কৃতি সাহিত্যে বহু শতাব্দীর অবনত জাতি যেন হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

২০ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২। ৯৪ নম্বর নবাবপুর রোডে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা চলছে। সর্বদলীয় সেই সভায় রাজনীতির জটিল এবং কুটিল অঙ্কের লাভ লোকসানের হিসাব মিলিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো ১৪৪ ধারা মেনে নিয়ে মিছিল না করার।

পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারী। মহাকালের ক্রান্তিলগ্নে এসে দুলছে তখন বাংলার ইতিহাস।

মেজরিটির নেওয়া সিদ্ধান্তের বিপক্ষে এবং ইতিহাসের পক্ষে অবাধ্য ঘোড়ার মতো ঘাড় শক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন যুব লীগের অলি আহাদ, ফজলুল হক হল আর মেডিকেল কলেজ সংসদের ভিপি যথাক্রমে শামসুল আলম ও গোলাম মওলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহবায়ক আবদুল মতিন। অমোঘ উচ্চারণ করে গেলেন তাঁরা “একশ’ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে দু’শ চুয়াল্লিশ খণ্ডে পরিণত হবে। কাল নয়, আজই।”

রাত বারোটা পার হয়ে ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে বিশ ডিঙিয়ে একুশের আঙিনায় পা রেখেছে। স্তম্ভিত মেজরিটির চোখের সামনে দিয়ে চারটে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মাঝরাতের অন্ধকারে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে গেল আলোকিত সূর্যের সন্ধানে। ইতিহাস এভাবেই তৈরি হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলের সিদ্ধান্ত ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত ঢাকা শহরে। মিছিলের শহরে পরিণত হলো ঢাকা। মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবির সে মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো জব্বার, রফিক, সালাম, বরকত, আউয়াল, মতিউর। পরদিন ২২ তারিখে শহীদ হলেন শফিউর।

মেডিকেল কলেজের মর্গে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া লাশ, অনেক লাশের কোনও পরিচয় নেই, অনেকের লাশের কোনো হদিসও নেই। প্রচণ্ড হাহাকারে দেশের মানুষ স্তব্ধ। আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখলেন “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি ?” আর তাতে প্রাথমিক সুর দিলেন গায়ক আবদুল লতিফ, পরে সেই একই গানে কালজয়ী সুর দিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ।

অতঃপর, পশ্চিমের শাসকেরা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল এবং ২১শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। বাঙালি পেল রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে, তাদের প্রথম সাংস্কৃতিক বিজয়।

এরপর বাংলার মানুষকে আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার হয়নি যে তাদেরকে রাজনৈতিক অধিকারে, অর্থনীতিতে, শিক্ষায়, চাকরিতে সবদিক দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সমান অধিকার না পেলে নিজেদেরকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে “ওয়ালেকুম সালাম”-এর সরাসরি হুমকি দিলেন মওলানা ভাসানী। অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে থাকল বাংলার মানুষ। রাজনীতির যুদ্ধ কখন যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ হয়ে সবার অলেক্ষ্যে সামরিক যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে সেটা কেউ টের পায়নি।

দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের শিখিয়েছে, বাংলা শুধু আমাদের ভাষাই নয়, আমরা বাঙালিও। আমাদের আছে রবীন্দ্র, নজরুল, মাইকেল, জসিমউদ্দিন, আছে লালন, হাসন রাজা, মুকুন্দ দাশ, আছে কামরুল হাসান, জয়নুল আবেদীন, আছে দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর, শিক্ষাগুরু অতীশ দীপংকর আর শীলভদ্র, আর আছে হাজার বছরের পুরানো সভ্যতা-সংস্কৃতি, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি আর সোনারগাঁয়ের মাটি খুঁড়লে এখনো তার নিদর্শন পাওয়া যায়। আমাদের নিজস্ব সম্পদ নিয়েই তো আমরা পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি। দরকার শুধু নিজের দেশটাকে নিজের করে পাওয়া। শুধুই নিজের। যেটা ছিলও একসময়। হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আর চেতনায় নজরুল, এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য নিয়ে শুরু হল আমাদের নতুন করে পথ চলা।

১৯৫২ থেকে ৬৯। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে মঞ্চে তত দিনে চলে এসেছেন সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী’র যোগ্য শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন। আন্দোলন সংগঠিত হয়ে ধাপে ধাপে এগোতে থাকল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করার পরও বাঙালিকে সরকার গঠন করতে দেয়া হল না। অত্যাচার চরম আকার ধারণ করল। প্রতিদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আমাদের কেউ-না-কেউ মরছে, গোটা জাতটাকে শুধু বন্দুকের পাশবিক শক্তিতে পঙ্গু ক’রে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলার মতো অবস্থা।

সমস্ত জাতি যখন অস্থির হয়ে আছে কিছু একটা করার জন্য, ঠিক তখনি, ৭ই মার্চ ১৯৭১ সেই কাক্সিক্ষত মুহূর্তে শেখ মুজিবের কন্ঠে উচ্চারিত হল ইতিহাসের সেই অমোঘ বাণী, গর্জে উঠলো সেই বজ্রকন্ঠ “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা”।

বজ্রপাত হলো যেন রেসকোর্স ময়দানে। যেন হাজার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো এক সাথে। আর সেই আলোয় কেটে গেল সমস্ত অন্ধকার। জাতি এক নিমিষে বুঝে গেল তাদের লক্ষ্য এখন চব্বিশ বছরের অর্থহীন পাকিস্তান জিন্দাবাদকে নর্দমায় ছুড়ে ফেলে বাংলার বুকে অভ্রভেদী মাথা তুলে দাঁড়ানো। বাংলার মানুষের চেতনায় ফিরে এল তাদের আসল পরিচয়। সমস্ত হৃদয় জুড়ে একটা কথাই বার বার ধ্বনিত হতে থাকল, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ।

মার্চের ৭ থেকে ২৫ এই ১৯ দিন দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে দেশের মানুষের লড়াই হতে থাকল। রাজনৈতিক আলোচনার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে ২৬শে মার্চ মাঝরাতে তারা একসাথে আক্রমণ চালাল পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স্, ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের উপর। হত্যা করল হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে। নিরস্ত্র করল সেনাবাহিনীর বাঙালি সিপাহী এবং অফিসারদের। বন্দি হলেন শেখ মুজিব। তার আগেই তিনি চূড়ান্ত স্বাধীনতা এবং যুদ্ধ ঘোষণার টেলেক্স পাঠিয়ে দিলেন সবখানে। সময় হিসাবে যার তারিখ ২৬শে মার্চ। পরদিন ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেডিও ষ্টেশন থেকে প্রথমে জনাব আবদুল হান্নান এবং পরে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেণ্টের মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠে দেশবাসী আবার শুনল সেই বজ্রকন্ঠের প্রতিধ্বনি - স্বাধীনতার ঘোষণা। 

ইতিহাস বোধহয় তার নিজস্ব নিয়মেই তার গৌরব পুনরুদ্ধার করে। ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১। যে মেহেরপুরের আমঝুপি কুঠিতে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল, ২৩শে জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে পরবর্তী ১৯০ বছরের জন্য বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠিক সেই মেহেরপুরেই সেই ষড়যন্ত্রের কলঙ্ক মুছে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন সরকার, “মুজিবনগর সরকার”। বাংলার-তাজ তাজউদ্দিন তার প্রধানমন্ত্রী, ইতিহাসের সেই ঘোরতর সাইক্লোন-টাইফুন উত্তাল সমুদ্রে টলায়মান বাংলা-তরীর সুদক্ষ কর্ণধার। এ গৌরবের তুলনা আছে ? তুলনা আছে এ দায়িত্বের ? অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক করে শুরু হয়ে গেল সশস্ত্র লড়াই, আমাদের বিশাল বিপুল রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ।

নয় মাসের মরণপণ যুদ্ধের পর অবশেষে অনেক হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু ফিরে পাওয়া আনন্দের সংজ্ঞাহীন এক বিচিত্র সুখ নিয়ে বিজয় এল। লক্ষ লাশ আর লক্ষ লাঞ্ছিতা মা-বোনের অশ্র“সিক্ত মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা।

আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে চিরকাল মিশে থাকবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আর্তনাদ। আমাদের জাতীয় পতাকায় মিশে থাকবে তিন লক্ষ ছেঁড়া শাড়ি আর জাতির বুকে চিরকাল অনেক আদরে খেলা করবে পাঁচ হাজার যুদ্ধশিশু।

অন্য আর সব জাতির মতো আমাদেরও ‘অনেক আছে, অনেক নেই’। কিন্তু আমদের আছে দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আমাদের দেয় অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহস আর শক্তি। সেই সাহস আর শক্তিতেই আমরা অর্জন করেছি আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐশ্বর্যময় ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভূখণ্ড শুধু বিদেশিরাই শাসন করে গেছে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা এই বঙ্গভূমি।

১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর। ২৮ পৌষ, বাংলা ১৩৭৮। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। আজ থেকে ৩৬ বছরে আগের এই দিনে অঙ্গ-বঙ্গ-সুম্ম-পুণ্ড্র্র-সমতট-হরিকেল প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই মায়াময় মাটির গর্বিত সন্তানেরা উদ্ধার করল তাদের প্রিয় মাতৃভূমি বিদেশিদের হাত থেকে। সেই পবিত্র মাটির সন্তান, বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় অভ্যস্ত এবং অভিজ্ঞ এই মাটির নতুন প্রজন্ম, এই আমরা, শুধু আমরাই এখন আমাদের ভাগ্যের একমাত্র নির্ধারক, আর কেউ নয়। এমন কোনো বিজয় আছে কি পৃথিবীতে যা এই মহান বিজয়কে অতিক্রম করতে পারে ?

অজানা একাত্তর

একাত্তরের সেই বিশাল বিপুল মুক্তিযুদ্ধ। চোখের সামনে দেখা সেই অসহ্য গণহত্যা, গণধর্ষণ। “যে দেখেনি বুঝবে না সে, এমন কেয়ামত ছিল।” চল্লিশটা বছর কেটে গেছে এখনো শুনতে পাই জাতীয় সঙ্গীতে ত্রিশ লক্ষ আর্তনাদ, জাতীয় পতাকায় দেখতে পাই তিন লক্ষ রক্তাক্ত ছেঁড়া শাড়ি আর এ বুকে অনেক আদরে খেলা করে পাঁচ হাজার যুদ্ধশিশু। কি কথায়, কি শব্দে লিখব সেই একাত্তরের সেই অজানা অন্ধকার অধ্যায় ?

মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানী সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণে ছিন্নভিন্ন বাংলা, রক্তে আর্তনাদে ভেসে যাচ্ছে দেশ। বহু মাইল স্রেফ পায়ে হেঁটে সীমানা পেরোচ্ছে আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে, বাচ্চা কোলে নিয়ে। গ্রামবাংলার ধূলিধূসরিত পথে হাতে মাথায় ঘটি-বাটি নিয়ে গরু-ছাগলের রশি ধ’রে হাজার হাজার পথযাত্রীর ভিড়ে রাস্তায় বৃদ্ধার মৃত্যু, রাস্তায় জন্মানো বাচ্চা। কে বিশ্বাস করবে সেই দাবানলের মধ্যে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শরণার্থী শিবিরে এক কাপড়ে উপস্থিত আনোয়ার শাহিদ, এক পাঞ্জাবী তরুণ ! চারদিকে তুমুল হৈ হৈ, ছুটে এসেছে ভারতীয় সৈন্যেরা। কি ? না, আমার বাড়ি লাহোর কিন্তু আমি শরণার্থী, আমাকে খেতে দাও থাকতে দাও। ভাঙা বাংলায় কথা বলছে সে। ততক্ষণে চোখ কপালে উঠে মুখ হাঁ হয়ে গেছে ভারতীয় সেনাধক্ষ্যের, পড়িমরি ক’রে টেলিফোন ছুটল মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে একেবারে দিল্লীর প্রতিরক্ষা দপ্তরে। পাকিস্তানী পাঞ্জাবী এসেছে উদ্বাস্তু শরণার্থী হয়ে, একে নিয়ে এখন কি করি ?

সাথে সাথে গ্রেপ্তার, সাথে সাথে হাজত। তদন্তের পর তদন্ত, জেরার পর জেরা। এ ছেলে কি পাকিস্তানের গুপ্তচর ? এগিয়ে এল তার বাঙালি বন্ধু যার বাবা-মা ভাই-বোনের সাথে রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদ পৌঁছেছিল সে। অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির পর প্রমাণিত হল সে গুপ্তচর নয়। ঠাঁই মিলল শরণার্থী-শিবিরে, বাঙালির সাথে একত্রে বসে ডালভাত। রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক দপ্তরে ততদিনে শুরু হয়েছে তার মা-বাবার চিৎকার - “আমাদের ছেলে কোথায় কেমন আছে, তার খবর এনে দাও” – “আমাদের ছেলে এনে দাও - এনে দাও এখনি”!! চাপ এসেছে তার আত্মীয়স্বজন থেকেও যারা সৈন্যদলে চাকরি করছে।

“তারপরে কেটে গেছে কত শত কাল, তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল।” সাঁইত্রিশ বছর আগে ঘটনার ঘনঘটায় উন্মুক্ত জীবন আজ গল্প হয়ে গেছে। বয়সের সব ঝড় বোধহয় এভাবেই থেমে যায় একদিন।

১৯৬৭ সাল। কাঁচা সোনা রঙের কটা বেড়াল-চোখ সুঠাম সুদর্শন তরুণ আনোয়ার শাহিদ খান। যেন সিনেমার নায়ক ভুল ক’রে ইণ্টারউইং স্কলারশীপ নিয়ে লাহোর থেকে ফিজিক্সে অনার্স পড়তে এসেছে। কাব্যময় সংবেদনশীল মন, শের শায়েরি আর গজলের আধার। থাকত ফজলুল হক হলে। আমি তখন ছাত্রলীগের চির-দুর্ভেদ্য দূর্গ ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সব-সভাপতি আর হল্ সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক রশীদ আর সভাপতি মুশতাক এলাহী (আহা ! ওরা আজ কোথায়!)। অন্য সহ-সভাপতি ফিজিক্সের শাহজাহান, ঢাকা কলেজ থেকেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগেরও আমরা দুই সহ-সভাপতি।

(হায় ! পাকিস্তান ভাঙ্গার সেই উত্তাল বছরগুলোর প্রতিটি দিন আমার সর্বক্ষণের যোদ্ধাসঙ্গী শাহজাহান আজ নিউইয়র্কের এক ওল্ড হোমে বন্দী! ওর শরীর ভালো কিন্তু স্মৃতি হারিয়ে গেছে। ও আজ কাউকেই চিনতে পারে না, এমনকি আমাকেও না - শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে)।

পুরো আন্দোলনটাই ছিল ছাত্র-পরিচালিত। দেশ জুড়ে আমাদের মত লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে নেমে মোটামুটি রাস্তায় বসবাস করেছে বলেই জনগণ পরে এতে অংশ নিয়েছে, বাংলাদেশটা হয়েছে। আনোয়ার শাহিদের সাথে কি ক’রে যেন বন্ধুত্ব হল নিবিড়, নিবিড় থেকে নিবিড়তর। খেয়াল করতাম আমার খুব কাছে কাছে থেকে অনুসন্ধিৎসু চোখে সে নিরীক্ষণ করছে আমাদের ওপরে পশ্চিমের নিপীড়ন আর শোষণ। সে বুঝতে পারছে কেন ওদের এত উন্নতি আর আমাদের এত অবনতি, কেন আমাদের ছয় দফা। তার শের-শায়েরীর কাব্যিক মন ঠিকই ধরেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানী রাজনীতির বীভৎস ঠকবাজী। তারপর সত্তরের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে এলে যেন অগ্নিগিরি বিস্ফোরিত হল। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে আমি আওয়ামী লীগের পোলিং এজেণ্ট, সাথে উপস্থিত থেকে আনোয়ার স্বচক্ষে দেখল জনতার ভৈরব গর্জন। মৃদু হেসে পরিহাস ক’রে বলল, “আব হামলোক আপকো অওর রোক্ নেহি সাক্তে” (আর আমরা আপনাদের ঠেকাতে পারব না)।

তারপর সে স্বচক্ষে দেখল পঁচিশে মার্চের তাণ্ডব, দেখল আমাদের ওপরে পাকিস্তানী সৈন্যদলের গণহত্যা, গণধর্ষণ। সময়ের জঠরে তখন জন্ম-যন্ত্রণায় পাকিস্তানের মাটিতেও নড়ে উঠছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য ভ্রূণ। পঁচিশে মার্চে সামরিক বাহিনীর হঠাৎ নিরস্ত্র জনতার ওপরে অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণের গণহত্যা - বাজপাখীর আক্রমণে মুরগির বাচ্চার মতন জাতি ছিটকে উঠে ছুটল গ্রাম-জননীর সুবিশাল আশ্রয়ে; জননীও আগ্রহী হাত বাড়িয়ে কোটি সন্তানকে তুলে নিল তার সøেহ কোলে। কিন্তু আনোয়ার যাবে কোথায়? এখানে তো ওর কেউ নেই, দেশটা ওর চেনাও নেই। এক বন্ধুর সাথে কোনমতে রাজশাহী পৌঁছুল আনোয়ার, তারপরে ঘাতক সৈন্যদলের ধাক্কায় সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে শরণার্থী শিবির। মে মাসে সেনাপ্রহরায় রাজশাহী ফেরা, সেনাপ্রহরায় ঢাকা ও জুনে সটান লাহোরে বাবা-মায়ের কোলে।

আটত্রিশ বছর পর আজ কে বিশ্বাস করবে, বাংলাদেশের জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় শুরু হল পাকিস্তানেও। “পদ্মা সুরখ হ্যায়” (রক্তাক্ত পদ্মা) নামে পশ্চিমা প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের পঁচিশ বছরের ঠকবাজী ও একাত্তরের গণহত্যা-গণধর্ষণের ওপর আনোয়ারের চাক্ষুষ নিবন্ধ ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন একসাথে লাহোরের দৈনিক মুসাওয়াত ও করাচীর দৈনিক ডন-এর গুজরাটি সংস্করণে, ক্রমাগত তিরিশ দিন। হৈ হৈ পড়ে গেল দেশে। জামাতিরা সগর্জনে ছুটল ভারতের দালাল ব’লে বাড়ি জ্বালিয়ে ওকে কতল করার খোলাখুলি ঘোষণায়। নেকড়ের মতো ছুটে এল হিংস্র পুলিশ আর গোয়েন্দা, নিজ দেশে পরবাসী আনোয়ার লুকিয়ে গেল আণ্ডারগ্রাউণ্ডে।

আমাদের তবু দেশ ছিল গ্রাম ছিল, স্বাধীন বাংলা সরকার ছিল, বেতার ছিল, চারদিকে সংগ্রামী জাতি আর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল, শেষ সম্বল হিসেবে ভারতে আশ্রয় ছিল, ওর কি ছিল চতুর্দিকে অগণিত শত্র“ ছাড়া ? আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে আমাদের তো যুদ্ধ ছাড়া উপায় ছিল না, কিন্তু ওকে তো কেউ বাধ্য করেনি স্বজাতিরই বিরুদ্ধে এ-যুদ্ধে নামতে ! এমনকি আমাদের সাথে ওর তো যোগাযোগও ছিল না! তবু লড়ল আনোয়ার, পাকিস্তানের বুকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিঃসঙ্গ একা। জাতির সামনে এভাবে পঁচিশ বছরের ষড়যন্ত্র তুলে ধরা, হিংস্র সরকারের গণহত্যা-গণধর্ষণ তুলে ধরা, বাবা-মা ভাইবোন থেকে দূরে লুকিয়ে বাঁচা, চাকরি নেই, উপার্জন নেই, খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই, একে আমি “পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” বলব না তো কি বলব ?

এ হল লাহোর, আর করাচীর মখ্দুম ?

একাত্তরের প্রথম দিকে জাহিদ মখদুম করাচীর প্রাণবন্ত তুখোড় ছাত্রনেতা, তখন কেবলমাত্র নির্বাচন শেষ হয়েছে, সারা পাকিস্তানে মেজরিটি জিতেছে বাঙালির আওয়ামী লীগ। আমাদের বিজয়ের বিরুদ্ধে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়েই সে ছাত্রসমাজকে নিয়ে যুদ্ধে নামল। মিটিং-মিছিলে, স্লোগানে-হুঙ্কারে, দেয়ালে দেয়ালে হাজারো পোষ্টারে, সংসদের সামনে বিক্ষোভে আর চিৎকারে কাঁপিয়ে তুলল করাচী। একের পর এক বিদ্রোহী নিবন্ধ লিখতে লাগল সিন্ধী দৈনিক “ইবারত”-এ। খুনে সেনা-সরকারের মুখের ওপর ছুড়ে দিল তার বক্তব্য, “নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তান জিতেছে, লক্ষ্মী ছেলের মতো তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাও। কোন ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। দেশ-শাসন করার জন্য তোমাদের সৈন্যদলে নেয়া হয়নি, জনগণের পয়সায় হাতে অস্ত্র দেয়া হয়নি।”

প্রমাদ গুনল ভুট্টো, প্রমাদ গুনল সরকার। এদিকে শুরু হয়ে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আক্রমণ, ধীরে ধীরে কাদায় পড়ছে নাপাক বাহিনী। ওদিকে সমন জারী হল গ্রেপ্তারের, পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল মখদুম। তারপর লারকানা, জেকোবাবাদ, শুক্কুর আর হায়দ্রাবাদ কারাগারে তার শরীরের ওপর নেমে এল কেয়ামত। স্বীকার করো তুমি ভারতের গুপ্তচর, টাকাপয়সার লেনদেন আছে। স্বীকার করো তোমার সাথে বাংলার “মুক্তি”দের গোপন যোগসূত্র আছে। লোহার রডের প্রহার, ইলেক্ট্রিক শক, অন্ধকার সলিটারি কন্ফাইনমেণ্টে ঘুমহীন, কখনো খাবারহীন, পানিহীন বন্দী জাহিদ মখদুম। কতদিন? মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাসের পরও কিছুদিন। অথচ “ভুল করেছি”র মুচলেকা সই করলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হতো, তবু তার উঁচু মাথা সে কখনো নোয়ায়নি।

একে আমি “পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” বলব না তো কি বলব ?

ওরা এখন ভালো আছে, আমার সাথে কথা হয় এখনো। মিঃ জাষ্টিস জাহিদ মুখদুম এখন ক্যানাডার কোর্টে আলুচেরা-চোখে গম্ভীর বিচারক, এবং উত্তর আমেরিকা সিন্ধু-সমিতির হাস্যমুখ পরিচালক। আনোয়ার করাচী ষ্টীল মিলে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। শুধু ওরাই নয়, খুঁজলে কাশ্মীরের হাশিম আর আশরাফ, করাচীর গোলাম মুহাম্মদ লু’ন কিংবা মকবুল বাট-এর মতো অনেক নামই পাওয়া যাবে। একাত্তরে আমাদের সমর্থন ক’রে চাকরি হারিয়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা শাফা’য়াত হাসনায়েন। স্বাধীনতার পরে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন ওদের কিংবদন্তী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ক্ষমা চেয়ে গেছেন। ওদের লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সুশীল সমাজ অনেকবারই ক্ষমা চেয়েছে আমাদের কাছে। সেদিনও চাইলেন টরণ্টো আন্তর্জাতিক শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে ক্যানাডা লেখক-সংস্থার কর্তাব্যক্তি মুনীর সামী। বললেন, “যে দানবের হাত-পা’ ভেঙে তোমরা বেরিয়ে গেছ সেই একই দানবের যাঁতাকলে আমরা এখনও পিষ্ট হচ্ছি। জানি না পাকিস্তানের কপালে কি আছে।”

“মানুষের মন চায় মানুষেরই মন” - কবিগুরু। তাইতো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এত দেয়া-নেয়া, তাইতো বোম্বের সিনেমায় অভিনয় করেন পাকিস্তানী সালমা আগা, “শত্রুর দেশে” কনসার্ট করেন মেহদি হাসান আর তাঁর স¤পর্কে সে-দেশের উচ্চতমা পদ্মশ্রী বলেন, “উন্কো গলে মে ভাগওয়ান ঝরতা হ্যায়” (উনার কণ্ঠে স্রষ্টা উৎসারিত হন)-  লতা মুঙ্গেশকর। তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন গানে গানে টাকা তোলেন, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণাসভা বসে এলিফ্যাণ্ট রোডে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক উপাধিপ্রাপ্ত বাটা’র ম্যানেজার অডারল্যাণ্ড সাহেবের বাসায়। তাইতো বাংলার গায়ক সুমন চ্যাটার্জী সুদূর নিকারাগুয়া’র স্যান্দিনিস্তা গণযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেয় উদ্যত বন্দুক হাতে ; রবিশঙ্করের সেতারে ক্যারিবিয়ান পল্লীসঙ্গীত আর পশ্চিমা কর্ড ; হলিউডের ছবিতে জাকির হূসেন আর চীনা ভাষায় গেয়ে ওঠেন বাঙালিনী সাবিনা ইয়াসমিন। এত আগুনের মধ্যেও পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইসরাইলী ডিরেক্টার অ্যামস্ গিতাই-এর অভিনয় করেন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্যালেষ্টাইনী অভিনেতা ইউসুফ আবু ওয়ার্দা ; ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনের নাট্যকর্মীরা একসাথে নাটক করেন। তাইতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম “বৌদি” আর হিন্দু “মা”য়ের সম্ভ্রম রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে হিন্দু আর মুসলিম যুবক ইতিহাসে রেখে যায় মহামিলনের আর্ত আহ্বান।

এরই নাম মানবতার শক্তি। তাইতো ইতিহাসের প্রতিটি বার্লিন-প্রাচীর এত ভঙ্গুর, এত ক্ষণস্থায়ী। এপারে এক ফোঁটা রক্তের পাশপাশি ওপারে এক ফোঁটা অশ্র“ গড়ায় এটা ইতিহাসের সত্যতা সে বার্লিনই হোক, ইংল্যাণ্ড-আয়ার্ল্যাণ্ডই হোক, বিভক্ত বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীরই হোক, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনই হোক, বা পাকিস্তান-বাংলাদেশই হোক।

পিণ্ডি’র অলিগলির ঠেলাগাড়িতে ফল-সব্জী নিয়ে যে ঘর্মাক্ত লোকটা হাঁক দিয়ে বিক্রী ক’রে বেড়ায় সে আমাদের শত্র“ নয়। কোহাটের পাহাড়ে যে লোকটা পাথর ভাঙে, যে নারীরা বাচ্চার হাত ধ’রে ঝিলাম-চেনাব-বিয়াস-শতদ্রু আর সিন্ধু থেকে কাঁখে কলসভরা পানি টানে তারা আমাদের শত্রু নয়, শত্র“ নয় করাচীর রাজনৈতিক উস্কানীতে যে তরুণকে খুঁচিয়ে খুন করা হল তার বাবা-মা। পাকিস্তানের মসজিদে নামাজে ব্রাশফায়ারে যারা রক্তাক্ত মরে পড়ে থাকে তাদের সাথে আমাদের নয়শ’ কুড়িটি বধ্যভূমির তফাৎ সামান্যই। আমাদের সবার শত্রু এক, এবং তারা কারা তা আমরা ভালো ক’রেই জানি। এবং একাত্তরে তাদের পদলেহী “হাস্যমুখে দাস্যসুখে বিনীত জোড়কর, প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর”- (কবিগুরু) - বাংলাদেশি পিশাচরা কারা তা এদিকে আমরাও জানি, ওদিকে আনোয়ার-মখদুমরাও জানে।

এ দানবকে পরাস্ত করা কঠিন। আজ যখন দানবের হাতে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মানবের সংগ্রামও তাই আন্তর্জাতিক না হয়ে উপায় নেই। সুদূর নিউজিল্যাণ্ডের এডমণ্ড হিলারি’র সাথে সুদূর নেপালের তেনজিং নোরপে’র মিলন ছাড়া এ-দুর্গম হিমালয়-বিজয় অসম্ভব। সুদূর পর্তুগালের ভাস্কো-ডা গামা’র সাথে সুদূর ইয়েমেনী সমুদ্র-এক্সপার্ট আবদুল মজিদের মিলন ছাড়া এ-দুর্দান্ত সমুদ্র-বিজয় অসম্ভব। তাই যখন আমাদের সাথে পাকিস্তানের দাবি ওঠে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই তখন মনে পড়ে সেই একাত্তরেই কয়েকজন পাকিস্তানী বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল ওই পাকিস্তানের মাটিতেও, কেউ জানে না।

অগ্নিবীণার অদম্য বাদক !

অসাধ্যসাধনের দুর্দম সাধক !

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান তোমাদের কপালে জোটেনি কিন্তু তোমাদের প্রতি এই গর্বিত বাংলাদেশির লক্ষ সালাম ॥

[১৬ই ডিসেম্বর ৪০ মুক্তিসন (২০১০ সাল)-এ খবর পেয়েছিলাম যেসব বিদেশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন-সহায়তা করেছেন তাঁদের বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী ২৬শে মার্চ (২০১১)-এ ঢাকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ডেকে এনে বিশেষ সম্মাননা দেবেন। সেই তালিকায় আনোয়ারও আমাদের রাষ্ট্রীয় দাওয়াত পেয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে আসতে পারেনি]

রঙ্গভরা বঙ্গবর্ষ

আজকাল পয়লা বৈশাখে পত্রিকা খুললেই নববর্ষের উৎপত্তি নিয়ে ব্যুৎপত্তির বিপত্তি, অসংখ্য জটিল সূত্র তত্ত্ব আর তথ্যের ভীড়ে পালাই পালাই করতে হয়। ফসল, ফসলের খাজনা, গ্রহ-তারার নামে মাসের নাম, সৌরাব্দ ও চন্দ্রাব্দ বা শশাংকাব্দ, শশাংক ও আকবর, কবে মুহররম ও বৈশাখের ক্রৌঞ্চমিথুন হয়েছে, বাংলা-সন আর বাংলা-সাল এসব নিয়ে প্রচণ্ড সব জটিল অঙ্কের বিপুল প্রবাহ, শেকড়ের সন্ধানে বড়ই প্রাজ্ঞ ও অস্থির সময়। “বাংলা নববর্ষ” নামটা কে প্রথমে দিল, কে কবে কোথায় এ নিয়ে বিপুল গবেষণা করে কি উদ্ধার করেছে তার লম্বা খতিয়ান। আমরা নববর্ষের দিনে নাচ-গানে ভরপুর বিচিত্রানুষ্ঠান দেখে “তরঙ্গ-ভঙ্গে উঠি, অনঙ্গ অঙ্গে লুটি, সহস্র রঙ্গে টুটি” আনন্দ করি দেশে-বিদেশে।

জীবনে অনেক আনন্দই হারিয়ে গেছে ছোটবেলার সেই হালখাতার মতন। সেই যে, দেশের হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উৎসব ছিল দোকানগুলোতে, মুফৎ মিষ্টি মিলত সব দোকানেই। দিনটা ছিল পয়লা বৈশাখ, পুরনো বছরের হিসেবের খাতা শেষ করে নতুন খাতা শুরুর উৎসব। কবে যেন কি কারণে জাতি খুব বুদ্ধিমান হয়ে সেই অসাম্প্র্রদায়িক উৎসবটা বাতিল করে দিয়েছে।

আমাদের ছায়ানট ষাট দশকের শুরুতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে প্রভাতী অনুষ্ঠান দিয়ে। তাঁরা তখন হয়ত কল্পনাও করেননি শীগগিরই সে অনুষ্ঠান শহীদ মিনারের মতো সংস্কৃতিক চেতনার আরেক কেন্দ্রবিন্দু হবে। এ দু’টোর একটা হল জায়গা আর অন্যটা হল তারিখ। ঠিক যেমন ১৫৮৫ সালে আকবরের সভাসদ আবুল ফজল ও আমির সিরাজীও এ-দিনটাকে খাজনা-আদায়ের নববর্ষের দিন ঠিক করার সময় কল্পনাও করেননি এইদিন একদিন হয়ে উঠবে একটা জাতির আত্মজিজ্ঞাসার দিন। দু’দলের কেউই ভাবতে পারেননি, সুগভীর এক কারণে এইদিন ঢাকার সীমা পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পালিত হবে পৃথিবীর প্রত্যেকটি শহরে যেখানে কিছু বাংলাদেশি আছে। কারণ, এটা শুধুমাত্র একটা দিন নয়, শুধুমাত্র একটা নূতন বছরের শুরু নয়। এদিন একটা জাতির সাংস্কৃতিক সেনাপতিও বটে যে জাতির সংস্কৃতির ওপরে আঘাত করে পরাজিত হয়েছিল বাইরের দানব। সে দানব অন্য ছদ্মবেশে আবার হেনেছে বোমার আঘাত উদিচী ও ছায়ানটের অনুষ্ঠানে। সুযোগ পেলেই সে আবারও হানবে আঘাত এ দিনের ওপরে।

রাজা যায়, রাজা আসে। নতুন নতুন অব্দ যায় অব্দ আসে। বঙ্গাব্দ, মৌর্যাব্দ, হুনাব্দ, কনিষ্কাব্দ, ত্রিপুরাব্দ, হর্ষাব্দ, হোসেনি অব্দ (সুলতান হুসেন শাহ), চৈতন্যাব্দ, বৈষ্ণাব্দ, দানেশমন্দ সন, কত কত অব্দ দেখল অঙ্গ-বঙ্গ-পুণ্ড্র-সুহ্ম-সমতট-রাঢ়-গৌড়-হরিকেল-এর এই পবিত্র মাটি। রাজা শশাঙ্কের বানানো তখনকার চলতি বঙ্গাব্দকেই আকবরের সভাসদ গ্রহণ করেছিলেন নাকি বঙ্গাব্দ নামটা তাঁরাই দিয়েছিলেন কে জানে !

এ দিন কি শুধুই আমাদের ? তাহলে দক্ষিণ ভারতে এই একই দিনে কি উৎসব করে ওরা ? সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ১৪ রকম নববর্ষ থাকলেও প্রধানতঃ এই একই দিনে কি উৎসব করে ওরা ? আর বাংলা থেকে সুদুর পাঞ্জাবে সে উৎসবের নাম ‘নয়া সাল’ বা ‘বিছাখী’ কেন ? আর, ওদের মাসগুলোর নাম ?

০১।  বিছাখ (আমাদের বৈশাখ)

০২।  জেঠ  (আমাদের জৈষ্ঠ্য)

০৩। আ’ঢ় (আমাদের আষাঢ়)

০৪।  শাওন (আমাদের শ্রাবণ)

০৫। ভাদো (আমাদের ভাদ্র)

০৬। আশুন (আমাদের আশ্বিন)

০৭।  কাত্তাক (আমাদের কার্তিক)

০৮। মা’আঘার (আমাদের অগ্রহায়ণ)

০৯। পো’হ (আমাদের পৌষ)

১০।  মাঘ  (আমাদের মাঘ)

১১।  ফাগুন (আমাদের ফাল্গুন)

১২।  চেত  (আমাদের চৈত্র)

এ শুধু নামের আশ্চর্য মিলই নয়, আসলে একই উৎসব করি পাঞ্জাব থেকে আসাম পর্যন্ত আমরা সবাই। এই সময়টাতেই কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠে বলে সম্ভবত খাজনা আদায়ের জন্য সর্বভারতীয় পর্যায়ে এই সময়কে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা শুরু করা হয়েছিল। অঞ্চল বিশেষে প্রত্যেক জাতি তাদের নিজস্ব বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক সম্ভার নিয়ে এই দিনে উৎসবে মেতে ওঠে। অন্য সব জাতির মত এদিন আমাদেরও উৎসবের দিন। আর সেই সাথে উৎসবের প্রতিরোধ আর প্রতিরোধের উৎসব দুই’ই। কারণ এদিন আমাদের সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড, একে ধ্বংস করার জন্য ওত পেতে বসে আছে এক দানব। যে দানব দিগন্ত বিস্তৃত সোনালী ধানের মাঠ দেখতে পায় না, দেখতে পায় ধু-ধু মরুভূমির বুকে কয়েকটা খেজুর গাছ। এ দানব দূরের মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে যাওয়া গরুর গাড়ির কিম্বা প্রমত্ত পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় পাল তোলা নৌকার বহর দেখতে পায় না। সে দেখে মরুদ্যান আর উটের কাফেলা। এ দানব আলোয় দেখে অন্ধকার আর অন্ধকারে দেখে জীবন। ভয়ঙ্কর এ দানবের ষড়যন্ত্র ও হামলা থেকে বৈশাখের এই প্রথম দিনকে আমাদের বুক দিয়ে আগলে রাখতে হয়, রক্ত দিয়ে রক্ষা করতে হয়।

অন্য জাতিরা ভাগ্যবান, ওদের সে সমস্যা নেই ॥

১ বৈশাখ, ৩৫ মুক্তিসন (২০০৫)

 

স্বপ্ন !

                     আবুধাবী বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল

যেন জন্ম-জন্মান্তর পার হয়ে গেছে তারপর।

পঁয়ত্রিশ বছর আগের আবুধাবী। আজকের মত দীপাম্বিতা সৌধশ্রেণী সঙ্কলিতা নয়, ধু-ধু মরুভূমির মধ্যে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ছোট ছোট কুঁড়েঘরে ঢাকা উপসাগর ঘেরা দ্বীপাম্বিতা শহরে কয়েকটা মাত্র দালান। দুই-কামরার এমনি এক কুঁড়েঘর ভাঙাবাড়ি নামে বিখ্যাত, কিছু তরুণ-কিশোর বাঙালিদের ব্যাচেলার মেস। তার একটি কামরায় খাটে দু’জন আর মেঝেতে একজন, এইভাবে থাকে বাড়ির ভাড়াটে তিন কিশোর। বাকি ঘরটা রাখা আছে রাজ্যের অনাথ-আতুর, অধম-পতিতদের জন্য যাদের চাকরি নেই, ভিসা নেই, কারো আবার পাসপোর্টই নেই। সেই বাসায় একদিন সান্ধ্য আড্ডা বসেছে। আড্ডা জিনিসটা সবদিন জমাট হয় না, কিন্তু সেদিন আড্ডা জমেছে তুমুল। মরুভূমির ভাঙাবাড়ি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে বাঙালি কিশোরদের প্রাণবন্ত কন্ঠে কামাল, বিনয়, শান্তি, আলো, মমতাজ, কাজী, রিজওয়ান…….. ঘরের চুন-ওঠা দেয়ালে বয়সহীন মরচেধরা এয়ার কণ্ডিশনার কাজ করে চলেছে প্রভুভক্ত ভৃত্যের মতন আশ্চর্য্য নিঃশব্দে অবিরাম, বাইরে গরম কিন্তু কুলকুল ঠাণ্ডায় চমৎকার ঘরের ভেতরটা।

ধড়াম করে দরজা খুলে ঢুকল কেউ, ধড়াম করে দরজা বন্ধ করল। রুদ্ধশ্বাসে দু’চোখ তার বিস্ফারিত। আনন্দে নয়, আতঙ্কে। একটু আগে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে সে। সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে রাস্তা পার হতে গিয়ে কানের কাছ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেছে মাইক্রোবাস, একটু এদিক-ওদিক হলেই মাথা ফেটে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ত রক্তাক্ত মগজ।

তারপর আড্ডায় এই রকম কথা হল।

“জাপানী স্কুলের মাইক্রোবাস, নাম লেখা আছে গায়ে। স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছিল বাসায় বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য”।

“জাপানী ছাড়াও বৃটিশ, অ্যামেরিকান, পাকিস্তানি, ইণ্ডিয়ান সবাই নিজেদের স্কুল বানিয়েছে এখানে। স্কুলগুলোর নিজস্ব মাইক্রোবাসে ওরা বাচ্চাদের আনা-নেয়া করে”।

“কিন্তু আমাদের বাংলাদেশিদের স্কুল নেই”।

“আমাদের বাংলাদেশিদের স্কুল নেই কেন ?

“আমাদেরও স্কুল চাই”।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদেরও স্কুল চাই...”।

সারা রাত ধরে মরুতামসের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল কিছু কিশোরের স্বপ্ন - “আমাদেরও স্কুল চাই.. আমাদেরও স্কুল চাই.. আমাদেরও স্কুল চাই..। সারারাত ধরে গুরুত্বপুর্ণ সভা করল আকাশের গ্রহ তারা ফিসফিস করে। তারপর অলক্ষ্যে কোথাও কিছু একটা সিদ্ধান্ত হল।

পরদিন সেই উচ্চশিক্ষাহীন উচ্চ-চাকরিহীন ছেলেগুলো তাদের স্বপ্ন নিয়ে হাজির জালাল ভাইয়ের বাসায়। সিলেটের সুদর্শন যুবক, পাওয়ার-হাউসের ইঞ্জিনিয়ার। কি ? না-আমাদেরও স্কুল চাই। মন দিয়ে তিনি শুনলেন কথাগুলো, যেন দিব্যচোখে দেখলেন এবং স্পর্শ করলেন স্বপ্নটা। তার কিছুদিন পর সদলবলে সবাই গিয়ে পড়লেন গোলাম রহমানের অফিসে, স্কুল প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেবার জন্য।

গোলাম রহমান। কিছু লোক থাকে যাদের বয়স অনুমান করা অসম্ভব। ছিপছিপে এ বুড়ো বয়সেও দেবানন্দের মতো রূপবান সরস, যেন আঙুর থেকে কিসমিস হয়েছেন। সিলেটের লোক, পুর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। রিটায়ার করতেই বাঙালি ধনকুবের জহুরুল ইসলাম তাঁকে হাইজ্যাক করে এনে বসিয়ে দিয়েছে তাঁর আবুধাবীর বিখ্যাত কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বেঙ্গল ডেভেলপমেণ্ট কর্পোরেশনের কর্ণধার হিসেবে। কিন্তু এই কর্ণধার বলতে গেলে সবাইকে কর্ণ ধ’রেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। বড় কাজ করতে চাও, শুরুতেই ভজঘট ? যাও, ফিরে যাও আজ। তারপর আমার সেক্রেটারিকে ফোন করে অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট বানাও, সেই মোতাবেক এসে দেখা কর। বিল্ডিং-এর বাইরে এসে বিনয় ভুরু কুঁচকে সন্দেহে বলল –

“বুড়া হালায় আমাগো অপমান করল নাকি রে”?

কামাল দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে জবাব দিল, “বুঝতাছি না দোস্ত। হালায় বৃটিশের সি-এস-পি আছিল তো, সিস্টেম ছাড়া কিছুই বুঝে না”।

দু’দিন পরে অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট মাফিক যখন তাঁর অফিসে যাই সবাই, তখন রাজকীয় নাস্তায় ভরপুর টেবিল আর তার সুগন্ধে মৌ-মৌ অফিস ঘর। সেই থেকে প্রায় দু’বছর যেভাবে নেতৃত্ব দিলেন তিনি, তাতে সাংগঠনিক ট্রেনিং আর বাস্তব অভিজ্ঞতায় ভরে উঠল আমাদের ঝুলি। সেজন্য তাঁর কাছে আজও আমি কৃতজ্ঞ। সেদিন তিনি প্রথম কাজ দিলেন, কত ছাত্র আমরা জোগাড় করতে পারব, শিক্ষক কোথায় পাব, স্কুল কোথায় হতে পারে এসব রিপোর্ট দিতে। সপ্তাহ ধরে ঘোরাঘুরি ক’রে সন্ধান পাওয়া গেল এক রতœখনির। আমাদের কাজী ওবায়েদ ভাই কারো জন্য অপেক্ষা করেননি, বন্ধু-বান্ধবের বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে নিজের উদ্যোগে অনেক আগেই এক বাসায় ক্লাশ শুরু করেছেন বাচ্চাদের বাংলা শেখানোর।

কেউ কি কোনদিন মনে রাখবে আবুধাবীর মরুতে সেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল অ-তে অজগর, আ-তে আম, ই-তে ইঁদুর, ঈ-তে ঈগল...! কাজী ওবায়েদ ভাই সেই পথিকৃৎ। আমাদের জাতি তার নায়কদের মনে রাখে না, নাহলে আজ ওবায়েদ ভাইয়ের নাম জাতির ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকত। এমন কত নিঃস্বার্থ নেতা-কর্মী হারিয়ে গেছে আমাদের ইতিহাস থেকে যাঁরা নিজের জন্য কিছুই চাননি কিন্তু জাতি তাঁদের দানে ধন্য হয়েছে। জাতি তার বর্তমান নায়ক-নায়িকাদের যোগ্য সম্মান না দিলে কি করে জন্ম নেবে ভবিষ্যতের দিশারী ?

যেন সুরমা-কুশিয়ারা মিলে বিশাল মেঘনার জন্ম হল মরুভূমিতে, এখন আর কে তাকে ঠেকায় ! মিলন হল আমাদের মতো মাঠকর্মী আর ওবায়েদ-ভাইয়ের চেষ্টা যার ফলে আটাশ জনের মতো বাচ্চা নিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলা শেখানো। সেই দুর্দিনে আটাশ জন মনে হলো আটশ’ বাচ্চা, আমাদের বাংলাদেশিদের বড় আদরের ধন। পরের মিটিং-এ গদ গদ খুশিতে গোলাম রহমানকে রিপোর্ট দিলাম, আটাশ জন ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেছে। যেন হাতে চাঁদ পাওয়া গেছে ! আর ভাবীরা সবাই বড় বড় পরীক্ষা পাশ করে এসে কেবল ঘণ্টা ধ’রে ফোনে আড্ডা দেন আর দাওয়াত খান, তাঁরা খুশি মনে রাজি হয়েছেন বিনে পয়সায় মাষ্টারী করতে।

ভেটো দিয়ে বসলেন নেতা। বিনামূল্যের মাষ্টার দিয়ে শিক্ষা হয় না। ওসব ফাঁকিবাজী চলবে না, মাষ্টারদের বেতন দিতে হবে। মাথায় বাড়ি আমাদের। বলে কি লোকটা ! আটাশ জন ছাত্র দিয়ে বেতন কিভাবে দেব ? এমন বোকামির কোনো মানে হয়, বিশেষ করে ভাবীরা নিজেরাই যখন পয়সা ছাড়া রাজি ! জালালভাই মাথা চুলকাতে শুরু করলেন। বেরিয়ে এলাম সবাই, ভাবীদের বললাম উপায় নেই, নামমাত্র হলেও কিছু বেতন নিতেই হবে। ভাবীরা অগত্যা রাজি হলেন, মাসে পাঁচশ’ দিরহাম করে নেবেন তাঁরা প্রত্যেকে। পরের সপ্তাহের মিটিং-এ আবার ভেটো দিয়ে বসল বুড়ো, অন্যান্য স্কুলে সর্বনিম্ন কি বেতন দেয় সে খবর নিয়ে এসো। হুবহু সেই বেতনই দিতে হবে, তোমরা নিশ্চয়ই চাও না যে আন্তর্জাতিক সমাজে বাঙালি স্কুলকে কেউ মিসকিন বলুক ?

এ কথা তো ভাবিনি ! না, নিশ্চয়ই সেটা চাই না আমরা। উপস্থিত সস্তার লোভে এই জরুরি কথা ভোলেননি আমাদের দূরদর্শী নেতা। অন্যান্য স্কুলে খবর নিয়ে আবার আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত হল। ইউরোপ-আমেরিকা-জাপানের কথা থাক, পাকিস্তানী স্কুলের মাষ্টারদের বেতনটাই বারো-তেরোশ’ দিরহাম মাসে। অত পয়সা আমরা কোথায় পাব ? পরের মিটিংয়ে রিপোর্ট দিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইলাম আমরা, কিন্তু উৎফুল্ল হয়ে উঠল বুড়ো। সিদ্ধান্ত লেখা হল, আমাদের মাষ্টাররা মাসে ওই বেতনই পাবেন। কে যেন খুশি হয়ে বলল, তার মানে আপনার কোম্পানি এ টাকাটা দেবে ? শুনে হাই-পাওয়ারের চশমার ভেতর থেকে জ্বলজ্বলে আলুুচেরা চোখে তাকালেন তিনি। বললেন, দয়ার দান নেবে না বাংলাদেশের স্কুল, আর উপহার নিতেও যোগ্যতা চাই, ওটা এখনো নেই আমাদের।

তাহলে ? জালালভাই ওবায়েদভাই সহ আমাদের চোখে তখন হাজার সর্ষেফুল। টাকাটা আসবে কোত্থেকে ? নেতাই সমাধান দিলেন। আপাততঃ অর্ধেক বেতন ক্যাশ নেবেন মাষ্টাররা, বাকি অর্ধেক খাতায় লেখা থাকবে দেনা হিসেবে। যদি কোনদিন স্কুল নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তবে সে দেনা শোধ করতে হবে সর্বপ্রথম, অন্য কোনকিছু করার আগে। এটা আদপেই কোনো সমাধান কিনা তা ও-বয়সের মাথায় ঢুকল না, কিন্তু গিঁট্টিটা তো খুলল। চিঠি লিখে দিলেন তিনি, মদিনা জায়েদের আরবি স্কুলের হেডমাষ্টারের কাছে। সকাল আটটা থেকে বেলা দু’টো পর্যন্ত তোমাদের আরবি স্কুল, তার পরে পুরো দালানটা খালি পড়ে থাকে। আমাদের অনুমতি দাও, আমরা বাংলাদেশ স্কুল খুলব চারটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। তখনো আবুধাবীতে স্কুল-বোর্ডের আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠেনি, হেডমাষ্টারই স্কুলের সর্বেসর্বা। এ হেন অনুরোধ হেডমাষ্টারের জীবনে এই প্রথম, আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল লোকটা। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, এ আর বলতে ! তালিমই মানুষকে মানুষ বানায়, না হলে মানুষ জামাল (উট) থেকে যায়। যাও, বিকেল থেকে স্কুল তোমাদের সম্পত্তি। পানি বিজলী সব ফ্রি করাই আছে সরকার থেকে, দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি সে সব দেখাশোনা করবে, সম্ভব হলে ওকে দু’চার দিরহাম “বাখশিস্” দিও। দারোয়ানটা ইয়েমেনী, বাসা তার স্কুলের পাশেই।

সেই একটা আশ্চর্য দিন এসেছিল মরুভূমিতে, সেই এক মাহেন্দ্রক্ষণে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ স্কুল। সুস্মিত বিস্ময়ে সেদিনের সূর্য দেখেছিল, স্কুলের আঙিনায় বালুর মধ্যে আনন্দে ছুটোছুটি করছে আমাদের আটাশজন বাঙালি বাচ্চা। বাংলায় হাসছে বলছে, খুনসুটি করছে, দৌড়াদৌড়ি ক’রে খেলছে, আর স্কুলের ক্লাসে বাংলায় পড়া শেখাচ্ছেন বাঙালি শিক্ষয়িত্রী, অ-তে অজগর, আ-তে আম...! মরুর বালুতে যেন অদৃশ্য এক শহীদ মিনার ফুটে উঠছে, হাজার মাইল সুদূরে ঢাকার শহীদ মিনারের মুখে তখন তৃপ্তির মৃদুহাসি। হাসি তখন জালালভাই ওবায়েদভাইয়ের মুখেও, আর আমাদের তো কথাই নেই। আজ এত বছর পরেও এসব স্মৃতি মনে হলে চোখে পানি এসে যায়। এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন কিছু উৎসাহিত অভিভাবক। সবচেয়ে উল্লসিত সেই ইয়েমেনী দারোয়ান, মহা উৎসাহে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে, ওদের ফেলা ময়লা হাসিমুখে পরিষ্কার করছে। আজ মনে হয় লক্ষ দিরহামেও শোধ হতো না ওই বিদেশি লোকটার সেই অযাচিত স্নেহ, সেই সহাস্য পরিশ্রম। ক’টা দিরহামই বা ওকে আমরা দিতে পেরেছি !

ফয়জুল্লা ভাবী (পতির নামে সতির নাম হল বিদেশে বাঙালি সংস্কৃতি) হলেন হেড মিষ্ট্র্রেস, স্কুলের নামও ঠিক হল, আবুধাবীতে চালু হয়ে গেল বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল। সাথে রইলেন অন্যান্য ভাবীরা, যেন উৎসবের বন্যা বয়ে গেল সারা শহরে। এতদিন যাঁরা পড়াশোনার অসুবিধের জন্য বৌ-বাচ্চাদের দেশ থেকে আনতেন না, এবার তাঁরা ইমিগ্রেশন অফিসে ছুটলেন পরিবারের ভিসার জন্য। চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গোলাম রহমানের বশবিদ্যা জানা ছিল, বশ হলেন জনতা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আর রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশ এমব্যাসি আর জনতা ব্যাঙ্কে অনতিবিলম্বে শুরু হয়ে গেল চাঁদাবাজী। ওখানে পা’ ঠেকালেই দিতে হচ্ছে পাঁচ দিরহাম করে স্কুল-চাঁদা। ব্যাপারটা বেআইনী কিনা জানি না, কিন্তু গরজ বড়ই বালাই। পদ্মার কূলভাঙ্গা প্রবল বন্যা না হোক, ছোটখাট খাল-প্রবাহে আসতে থাকল দিরহাম, অনতিবিলম্বে শোধ হয়ে গেল ভাবীদের বকেয়া বেতন।

সেই শুরু। এরপরে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী বাড়ল, স্কুল-কমিটি বানানো হল, সম্ভবতঃ জালালভাই কিংবা ওবায়েদভাই প্রেসিডেণ্ট হলেন আর আমরা মাঠকর্মী। পরে কি এক কারণে মদিনা জায়েদ থেকে রোদা ক্লিনিকের পাশের আরবি স্কুলে চলে গেল আমাদের স্কুল। সেখানে শুধু বাচ্চাদের নিয়ে করা হলো বিচিত্রানুষ্ঠান, সাথে রইলেন এম্ব্যাসীর কমার্শিয়াল অ্যাটাচি হেলালভাই আর রেহানাভাবী। লেবার অ্যাটাচি সুগায়ক বোরহানভাই আর তাঁর সুগায়িকা স্ত্রী স্কুলের একটি মর্মসঙ্গীতও তৈরি করলেন। সাথে রইলেন আমাদের গ্রেট লালাদা’ (সরিৎ কুমার লালা) ও তাঁর স্ত্রী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনন্যা গায়িকা বুলবুল মহলানবীশ, যাঁর একক কনসার্ট হতো মিলনায়তনে, যাঁর পরিশীলিত সুকন্ঠের রাগভিত্তিক গান সারা রাত ধরে শোনার মতো। এদিকে প্রেসিডেণ্ট শেখ জায়েদ জানালেন আমরা যত টাকা তুলব তিনি তত টাকা দেবেন। কালক্রমে অনেক টানাহ্যাঁচড়ার পর শেখের এক বাঙালি বন্ধুর মাধ্যমে সরকার থেকে স্কুল তার নিজস্ব জমি পেল মরুর নামের এলাকায়, বিল্ডিং তৈরির নক্শা কম পয়সায় করে দিল শামসুল আলমভাইয়ের আর্কিটেকচার কোম্পানি, তালপাতার সেপাই শরীর নিয়ে সিন্হাদা’ দিনরাত খাটলেন এ নিয়ে। তারপরে একের পর এক স্কুলের প্রেসিডেণ্ট হয়েছেন কারা যেন, তারপরে টেলিফোনের পদস্থ অফিসার ফজলুর রহমান। আর তার পরে একই সাথে স্কুলের প্রেসিডেণ্ট, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেণ্ট আর বাংলা নাট্যগোষ্ঠির নেতা হলেন সকলের প্রিয় ডঃ জাফর সাদিক, অনন্য এক বাঙালি দশভুজ।

বর্ষার পুকুরে প্রাণবন্ত কলমী শাকের মতো স্কুল বেড়ে উঠল দেখতে দেখতে। এতটাই বেড়ে উঠল যে পেশাগত শিক্ষাবিদের দরকার হল। বাংলাদেশ থেকে ভিসা দিয়ে আনানো হল ঢাকার শাহীন স্কুলের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ (প্রতিষ্ঠাতা?) মিঃ শাহীনকে। তাঁর অভিজ্ঞ হাতে একেবারে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলল বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল। দুঃখের কথা, প্রায় দু’বছর পর হজ্ব করতে গিয়ে তিনি পোশাক পাসপোর্ট পেছনে রেখে লুঙি-চপ্পল প’রে এমনই হারিয়ে গেলেন যে বহু চেষ্টাতেও আর কোনদিনই তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেক হাত বদলের পর কমিটির জি-এস হিসেবে শক্ত হাতে হাল ধরলেন নাসরুল ওয়াহিদভাই, এক অসাধারণ নেতা। কয়েক বছরের প্রচণ্ড পরিশ্রম আর তীক্ষè নেতৃত্বে স্কুলকে একেবারে তুঙ্গে পৌঁছিয়ে তিনি বিদায় নিলেন ক্যানাডার নাগরিকত্ব নিয়ে।

আজ কয়েক একর জমির ওপরে সে স্কুলের সুবিশাল দালান। যে স্কুলের মাষ্টারের অর্ধেক বেতন খাতায় বাকি লিখতে হয়েছে, আজ সে স্কুলের অ্যাকাউণ্টে ফিক্সড্ ডিপোজিট আছে আ-ট ল-ক্ষ দিরহাম। আগে যে বাংলাদেশিরা পাকিস্তানী বা ভারতীয় অ্যাসোসিয়েশনের মিলনায়তনে বিচিত্রানুষ্ঠান করতে বাধ্য হতো, এখন তারা নিজেদের স্কুলে শক্তিশালী শব্দ-যন্ত্রের সুবিশাল মিলনায়তনে একুশে, ছাব্বিশে আর ষোলই উদ্যাপন করে। আটাশ দিয়ে শুরু হয়েছিল যার, আজ সে স্কুলে প্রায় চার শ’ ছাত্র-ছাত্রী ! ছোট্ট কিছু ক্লাস নিয়ে জন্ম হয়েছিল যার আজ সে স্কুলে ঢাকা বোর্ডের এস-এস-সি পরীক্ষা হয়, ইণ্টারমিডিয়েট পরীক্ষাও হয় !! ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্র আসে, ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে পরীক্ষার খাতা ঢাকা বোর্ডে ফেরৎ যায়। এম্ব্যাসীর অফিসারেরা পরীক্ষা হলে টহল দেন। এত সাফল্য, এত সুখ আমরা রাখব কোথায় !

আর ? আর আজ বাচ্চাদের আনা-নেয়া করে স্কুলের নিজস্ব দুটি বিশাল আকৃতির বাস। তার সাথে ভাড়া করা আছে আরো পাঁচটি মাইক্রোবাস।

মাইক্রোবাস ! সেই মাইক্রোবাস যা থেকে দীর্ঘ তিরিশ বছর আগে এই স্কুলের স্বপ্ন দেখেছিল কিছু নাম-না-জানা পরিচয়হীন বিত্তহীন কিশোর, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসাধ্য সাধনে আর সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেতারা !!

কিছু ব্যর্থতাও আছে, আছে কিছু বেদনা। কিন্তু সে কথা থাক। সুখের প্লাবনে আজ ঢাকা পড়ে যাক সবকিছু। সেই স্বাপ্নিক কিশোরের দল এখন জীবনের ধাক্কায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে চারিদিকে, কারো চোখে আজ নতুন কোনো স্বপ্ন ঝিকমিক করে কিনা জানি না। চাকরি শেষ করে দেশে ফিরে গেছে বিনয়, কামাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্লোরিডায়, রিজওয়ান থাকে ক্যানাডায়, আলো এখন দুবাইয়ের এক কোম্পানির কর্ণধার, শান্তি নামের সবচেয়ে নরম ছেলেটা দেশে ফিরে জাহাজ কাটার ব্যবসা করছে। আর মমতাজ ? আমাদের সেই প্রাণবন্ত সহাস্য বন্ধু সম্প্রতি চলে গেছে পরপারের অনন্ত যাত্রায়। ফয়জুল্লাহভাই, শামসুল আলমভাই, বজলুর রহমানভাই, ফজলুর রহমানভাই কোথায় আছেন জানি না। হেলালভাই ঢাকায় ব্যবসা করেন, বুলবুল মহলানবীশ দেশে ফিরে লেখালেখি ও সংস্কৃতির জগতে ব্যস্ত ছিল, সে ১৪ জুলাই ২০২৩ ঢাকাতে এ দুনিয়া ছেড়ে গেছে।  বোরহানভাই বাংলাদেশে পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল হয়েছিলেন, তিনিও এ দুনিয়ায় নেই।  জাফর ভাইও নেই।  দুই যুগ পরে এসে নিজের গড়া স্কুলের প্রেসিডেণ্ট হয়েছিলেন জালালভাই। বৃত্তাকার জীবন ! ওবায়েদভাই হয়তো এখনো আবুধাবীতে, এখনো তাঁর প্রাণের স্কুলের সাথে নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত। নিজের স্বপ্ন-সন্তানকে ছাড়তে পারে কেউ ?

আর গোলাম রহমান ? আমাদের সেই কট্টর অথচ স্নেহময় এবং দুরদর্শী অভিজ্ঞ নেতা ? ওবায়েদভাই জালালভাইয়ের কথা বাদ দিলে আমাদের মতো একপাল ছন্নছাড়া অনভিজ্ঞদের নিয়ে এক অনন্য প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়ে গেছেন যিনি অবিশ্বাস্য নেতৃত্বে, তাঁর দান কি করে ভুলবে বাংলাদেশ ! তিনি নশ্বর দেহ রেখেছেন ক’বছর আগে। আজ তিনি নেই, স্কুলে তাঁর একটা ছবিও নেই। কেউ খেয়াল করেনি কথাটা দীর্ঘ সাতাশ বছরে।

পৃথিবীতে শতকরা নিরানব্বই জন মানুষের শতকরা নিরানব্বইটা স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়িত হয় না। তবু স্বপ্ন থাকতে হয়, কারণ স্বপ্নই জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি। সবার জীবনে কিছু অন্ধকার থাকে যাতে মনে হয় কোথাও কোনো আলো নেই, আবার কিছু আলোও থাকে যাতে মনে হয় কোথাও কোনো অন্ধকার নেই। মরুভূমির ওপরে গর্বিত দাঁড়ানো ওই বিশাল স্কুল, সারি সারি ওই ক্লাসরুম, ওই ল্যাব, ওই মিলনায়তন, ওই বাংলা-বিদ্যাপিঠ আমাদের সেই আলো, সেই দিকবর্তিকা। না-ই বা থাকল কোনো ফটোগ্রাফ সেই স্বাপ্নিক কিশোরদের, না-ই থাকল কোনো দলিল। না-ই বা মনে রাখল কেউ। ব্যাপারটা বিশাল, আরো অনেকের অবদান আছে নিশ্চয়ই। এ নিবন্ধে কোন কোন নাম নিশ্চয়ই বাদ পড়ে গেছে আমার অনিচ্ছায় বা স্মৃতিভ্রংশে, তাঁরা আমাকে ক্ষমা করবেন আশা করি।

এই হলো সেই স্বপ্ন যেখানে কেউ আওয়ামী লীগ বিএনপি নয়, জামাতি বা জামাত-বিরোধী নয়। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী - এখানে সবাই মাতৃভূমির সন্তান, মাতৃভাষার সন্তান। সবাই যে যা পারে করেছে, যে যা পারে দিয়েছে। নিজের দু’কড়ি দিয়ে সবাই মাতৃভূমির আর মাতৃভাষার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছে। তাই তো বিদেশের বালুতে গ’ড়ে উঠতে পেরেছে জাতির মর্মর বিদ্যাকেন্দ্র ! আবুধাবীতে যদি হতে পারে, হতে পারে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যদি চোখে স্বপ্ন থাকে। স্কুল যদি হতে পারে, হতে পারে যে-কোনো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান যদি চোখে স্বপ্ন থাকে। তখন যদি হতে পারে, হতে পারে এখনও, এবং সর্বদা, সর্বত্র।

বুকে জড়িয়ে ধরলে অনেক স্বপ্নকেই বাস্তব মনে হয়, অনেক বাস্তবকেই স্বপ্ন মনে হয়। আবুধাবীর ওই বিশাল বাংলাদেশ স্কুলের বাস্তবকে যেন স্বপ্ন বলে মনে হয় আজ এই পঁয়ত্রিশ বছর পরে। ওখানে ছিলাম আমি ... মরুভূমির সেই মায়াময় ভাঙাবাড়িতে ... আমাদের সেই সন্ধ্যার আড্ডায় ... জাপানি স্কুলের সেই মাইক্রোবাস ... আর সেই নাম-না-জানা কিশোরদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ॥

বাংলার মাতুব্বর

“উপায় নাই” !!

বলেছিলেন এক সাহিত্য-ঋদ্ধ, বহু বছর আগে যখন আমি মধ্যপ্রাচ্যে ছিলাম। শুনে আমি অবাক। কিসের উপায় নাই ? উনি বলেছিলেন, “একটা বই বেরিয়েছে দেশে, পড়লে আর উপায় নাই”। কথাটা শুনে শ্রীকান্ত-র বার্মা যাত্রার সময় জাহাজ-ঘাটের “পিলেগ কা ডগ্দরি”-র মতন ব্যাপারটা দুর্বোধ্য থেকে আরো দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ালো। গ্রন্থকীট বাবা-মা’র প্রভাবে আমরা ভাইবোন সবাই আবাল্য গ্রন্থকীট, আমরা জানি “উপায় নাই” বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। তড়িঘড়ি বইটা দেশ থেকে এনে পড়লাম। ছোট বই। পড়তে লাগলো কয়েক ঘণ্টা, হজম করতে লাগলো বহু বছর। অনেকের দেখেছি সারাজীবনেও ওটা হজম হয়নি, অনেকের বদ-হজমের পাল্লায় পড়ে অন্যদের জান লবেজান।

কোনো বিখ্যাত সাহিত্যিক নন, নন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বরিশালের গভীরে বাংলার কোনো এক মায়াময় গ্রামের লোকের লেখা বই। বইটা ছোট বটে, কিন্তু দুর্ধর্ষ। দুর্ধর্ষ বই অনেক আছে যা বুঝতে হলে অনেক বই পড়ে আসতে হয়। এ বই তার উল্টো, এ বই পড়লে যেন অনেক বই পড়া হয়। প্রথমে তিনি বিজ্ঞানের অতি সাধারণ কিছু প্রমাণিত সত্য, মহাশূন্যের তত্ত্ব-তথ্য ইত্যাদি দিয়ে পাঠককে করেছেন বাস্তবমুখী, তারপর পাঠকের হাত ধরে ধীরে প্রবেশ করেছেন ধর্মবিশ্বাসের বিশাল জগতে। প্রাচীনকাল থেকে কতই না বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস করেছে মানুষ, সে বর্ণনা অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে করেছেন তিনি। তিনি উপলব্ধি করেছেন ধর্মবিশ্বাস আর বাস্তবের সংঘাত বড় সর্বনাশা, সে সংঘাত জীবন আর সমাজের অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। আঘাতটা তিনি করেছেন ঠিক সেখানেই, এবং করেছেন মমতার সাথে। কারণ তিনি জানেন “শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে গো”।

নিজেকে বোকা বানানোর, নিজেরই বুদ্ধি-বিবেকের সাথে প্রতারণা করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে একটা বিশেষ জায়গায়। তা হলো ধর্মের নামে অসম্ভব অলীকের প্রতি অখণ্ড বিশ্বাস। অখণ্ড বিশ্বাস ধর্মের নামে অত্যাচারের প্রতিও। অসংখ্য বুদ্ধিমান শিক্ষক-লেখক, সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, চালাক ব্যবসায়ী, চতুর রাজনীতিক ও ধূর্ত কোটিপতি এই একটা জায়গায় এসে বুদ্ধু বনে যায়। জীবনের অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে ধর্ম যা বলেনি, বলতে পারে না, তা বিশ্বাস করে। তাদের আত্মপ্রবঞ্চনাও কম নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ প্রশ্নের জবাব তাদের ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু বিশ্ব-মানবের অগ্রগতির জন্যই বাস্তব ও ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে সংঘাতের এ কারাগার থেকে মানুষকে বের করে আনা অত্যন্ত দরকার। সে চেষ্টাই করেছেন তিনি। সচেতন সংবেদনশীল পাঠক আর নূতন প্রজন্মকে ধর্মতত্ত্বের দিক দিয়ে এই নির্মোহ লেখকের মতো এত প্রবলভাবে আর কেউ প্রভাবিত করেন নি।

নির্মোহ কেন বলছি ? কঠিন এবং সংবেদনশীল বিষয়ের আলোচনা তিনি করেছেন গভীর জড়িতভাবে অথচ আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকভাবে। যেন এক দরবেশ বা ঋষি ধ্যানের মধ্যে একান্তে নিজেরই সাথে কথা বলে চলেছেন, যেন তাঁর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। এই শুষ্কং কাষ্ঠং বিষয়ের ওপর তাঁর প্রকাশভঙ্গী আশ্চর্য বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয়। কাউকে কোনো অপমান-আঘাত করা নেই, নেই কোনো পণ্ডিতি হুঙ্কার বা ব্যঙ্গ বা কারো ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়া। শুধু দেখিয়ে যাওয়া, আর দেখিয়ে যাওয়া। শুধু পাঠকের এ অভিজ্ঞতার সাথে ও অভিজ্ঞতার যোগ-বিয়োগের অঙ্ক যা পাঠক ইচ্ছে করলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। তারপর পাঠক ইচ্ছে করলে তার নিজের অঙ্ক মেনে নিক, না নিলে না নিক ! উপলব্ধির অভিব্যক্তিতে এমন আঙ্কিক অথচ নান্দনিক উপস্থাপনা বিরল, অত্যন্ত বিরল।

কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন “লোক-দার্শনিক”। যেমন লালন শাহ আর হাছন রাজাকে বলা হয়েছে “লোক-দার্শনিক”। কিন্তু এটা ভুল, খুব ভুল। কারণ লোক-দার্শনিক শব্দটায় সাধারণতঃ গ্রাম-বাংলার “গ্রামীণ” অর্থ বোঝায়। আমাদের বাউল-ফকিরের দল ভাববাদী জগতের মানুষ, তাঁরা গ্রামীণ-শেকড় থেকেই উঠে এসেছেন বলে তাঁরা অবশ্যই গ্রামীণ। কিন্তু মাতুব্বরকে গ্রামীণ পরিসরে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বাউল-ফকিরের দল ভাববাদী কিন্তু তিনি কঠিন বাস্তববাদী। বাস্তবের সাথে যার সংঘাত তাকে আঘাত করার ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি। তিনি স্বভাবজ, তিনি স্বাভাবিকতার ফসল, কোনো প্রতিষ্ঠিত স্কুল অব্ থট-এর প্রডিউস নন। সেদিক দিয়ে তিনি সার্বিক অর্থেই দার্শনিক। বলার ভঙ্গীতে তাঁকে মনে হতে পারে তথাকথিত “গ্রামীণ পণ্ডিত” কিন্তু সেটাই তাঁর আশ্চর্য ও অসাধারণ মৌলিকত্ব ও নিজস্ব ভঙ্গী। সেটাই তাঁকে বহু বহু “শহুরে পণ্ডিত’-এর চেয়ে ওপরে স্থান দিয়েছে। তা ছাড়া তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে কাউকে আঘাত না করে অন্ধ ধর্ম-বিশ্বাস ও বাস্তবের সংঘাতকে বিশ্লেষণ করতে হয়। এখানেই তিনি গ্রামীণ বাউল-ফকিরের মতই চির-আধুনিক কিন্তু অন্য আঙ্গিকে। কারণ ধর্ম-বিশ্বাস ও বাস্তবের সংঘাত কোনদিন পুরনো হবে না। তিনি অতিক্রম করে গেছেন যা আমরা দেখি। ঠিক যেমন, চিরকাল বিদেশগামী পিতাকে ছোট্ট কন্যা যেতে দিতে চায় নি। এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে কেউ কোনদিন কিছু ভাবেন নি। কিন্তু সেটাই যখন রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন তখন আমরা পেয়েছি বিশ্ব-জগতের এক চিরন্তন শক্তিশালী সত্য “যেতে নাহি দিব” কবিতায়।

তিনিও সেরকম। দেয়ালের টিকটিকিকে বাড়ি দিতেই সে দৌড়ে পালালো তার লেজ ফেলে রেখে, আর লেজটা লাফাতে থাকলো অনেকক্ষণ, এটা হাজার বছর ধরে সবাই দেখেছে কিন্তু কোনোদিন কেউ কিছু ভাবে নি। অথচ এ নিয়ে তিনি শুধু ভাবেনই নি, এ থেকে নিরেট সত্য তুলে এনে সবাইকে হুলুস্থুল ভাবিয়ে ছেড়েছেন। কারণ নিষ্প্রাণ জিনিস তো নড়ে না। তাহলে টিকটিকি’র প্রাণটা নিশ্চয়ই দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল, তার একভাগ নিয়ে লাফাতে লাফাতে লেজটা মরে গেল। কিন্তু অন্য যে ভাগটা নিয়ে টিকটিকিটা দিব্যি আগের মতই বেঁচে থাকলো, ওটা কি আংশিক প্রাণ ? আংশিক প্রাণ দিয়ে তাহলে পুরো প্রাণের মতই বাঁচা যায় ? তাহলে আংশিক প্রাণ আর পুরো প্রাণের সম্পর্ক কি ? গাছের কথাই ধরা যাক। গাছের তো প্রাণ আছে। হাজার বছর ধরে সবাই দেখেছে এক গাছের ডাল থেকে কলম ক’রে অন্য গাছ তৈরি হতে। তাহলে এক প্রাণ থেকে দু’টো প্রাণ হলো নিশ্চয়ই ! তাহলে প্রাণ আসলে কি ?

এগুলো জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা, লক্ষ কথার মারপ্যাঁচে কিংবা অন্ধ ধর্মবিশ্বাস দিয়ে এগুলো অস্বীকার করা সম্ভব নয়। বোঝাই যাচ্ছে ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রাণকে চিরকাল যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে আর চলছে না, ওই ধর্মগ্রন্থ থেকেই নূতন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আনতে হবে। রোজ হাশরের কথাই ধরুন। ওখানে আমাদের সবাইকে জড়ো করা হবে বিচারের জন্য, বিচারের পরে বেহেশ্ত্ বা দোজখে যেতে হবে। সেখানে যাব আমরা এই শরীর নিয়ে, নাকি অন্য কিছু ? যাঁরা বলেন রক্তমাংসের দেহ নিয়ে নয় অন্যভাবে যাব, তাঁদের সমস্যা বিরাট। কেননা পরকালের শাস্তি ও পুরস্কার দু’টোই দেহ-নির্ভর, যেমন আগুনে পোড়া বা চমৎকার খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি। শরীর না হলে ওগুলো কিভাবে প্রয়োগ হবে ? অন্যদিকে, যাঁরা বলেন মানুষ বেহেশ্ত্-দোজখে এই শরীর নিয়েই যাবে তাঁদের সমস্যা আরো জটিল।

আমাদের শরীর ছোটবেলায় ছোট ছিল। সেটা বেড়েছে গাছপালা ও মাছ-মাংস খাবার মাধ্যমে শরীরে কোটি কোটি পরমাণু জমে জমে। মরে যাবার পর সেগুলো আবার মাটিতে ফিরে যাবে এবং মাটি থেকে গাছপালা, গাছপালা থেকে হাঁস-মুরগী মাছ ও গরু-ছাগলের দেহ তৈরি হবে। সেগুলো খেয়ে আবার মানুষের ছোট বাচ্চার শরীর বড় হবে। অর্থাৎ পরমাণুগুলো পৃথিবীতে একের শরীর থেকে অন্যের শরীরে রি-সাইক্ল হয়ে চলেছে। আমাদের আগে সেগুলো দিয়ে না জানি কত কোটি শরীর তৈরি হয়েছে, আমাদের পরে না জানি কত কোটি তৈরি হবে। যেমন কিছু ইঁট দিয়ে একটা দেয়াল বা স্তম্ভ বা বাড়ি বানানো যায়। কিন্তু একসাথে যে কোনো একটাই বানানো যায়, একের বেশি বানানো যায় না। তাহলে ? তাছাড়া আজকাল একজনের রক্ত হার্ট কিডনি ফুসফুস বোন ম্যারো অন্যের শরীরে লাগানো হচ্ছে, কি হবে যখন চোর-ডাকাতের অঙ্গ দরবেশের শরীরে বা দরবেশের অঙ্গ চোর-ডাকাতের শরীরে লাগানো হয় ? অন্যের সওয়াব ও গুনাহের ফল ওই অঙ্গগুলো ভোগ করবে। তাহলে ?

জটিল ব্যাপার, ব্যাপক জটিল ব্যাপার। মাথা চুলকিয়ে টাক করে ফেললেও এসব স্বাভাবিক প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারবে না, আর ওসব চুলচেরা বিশ্লেষণের কোনো শেষও নেই। তাই আমাদের ফিরে যেতে হবে আল্ কোরাণের কাছে, সুরা ইমরাণ আয়াত ৭, কোরাণের অনেকটা অংশই রূপক বা প্রতীকী।

কেউ কেউ বলেন তিনি নাকি নাস্তিক। মতভেদ হলেই নাস্তিক ঘোষণা করে হেনস্থা করা এমনকি খুন করা - কিছু মোল্লাদের এই ইসলাম-বিরোধী কৌশল আমরা অতীতেও দেখেছি হাজার বার, বর্তমানেও দেখছি বাংলাদেশ সহ মুসলিম বিশ্বে। সে-কথায় না-ই বা গেলাম। অনেক আঘাতই তিনি করেছেন বিশ্বাসের সাথে বাস্তবের অসঙ্গতি নিয়ে। আখেরের তিনি কি বলেছেন ধর্মের বৈধতা নিয়ে ? উদ্ধৃতি দিচ্ছি তাঁর জবানীতেই।

“ধর্মগুরুরা নীতিবাক্য প্রচার করিয়াছেন অজস্র। আর উহাতে কাজও হইয়াছে যথেষ্ট। অসংখ্য নর-নারী অসৎকাজ ত্যাগ করিয়া সৎকাজে ব্রতী হইয়াছেন ধর্মগুরুদের কথিত স্বর্গসুখের প্রত্যাশা ও নরকজ্বালার ভয়ে। মূলত পশুবৃত্তি বা স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করাইয়া মানুষকে সুসভ্য করিয়া গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারে ধর্মগুরু বনাম ধর্মের দান অপরিসীম” - তাঁর রচনাসমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ১৩৮। সবশেষে তিনি বলেছেন - “ধর্মীয় শিক্ষার ফলে আদিম মানবদের লাভ হইয়াছে যথেষ্ট। এবং বর্তমান যুগেও উহার আবশ্যকতা ফুরায় নাই।”

অর্থাৎ তিনি ধর্মবিশ্বাসের অবদান উপলব্ধি করেছেন সৎভাবে এবং অন্ধবিশ্বাসকে আঘাতও করেছেন সৎভাবেই। তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু একটাই, মানুষের মঙ্গল। তাই দেখি তিনি ধর্মদর্শন থেকে শুরু করে কিভাবে খরচ-বাঁচানোর ম্যাকগ্লেসান উনুন বানানো যায় তা’ও লিখে গেছেন ছবি এঁকে এঁকে।

জীবনের পথে কেতাব থেকে, জীবন থেকে ও মানুষের কাছ থেকে সবারই অভিজ্ঞতার সম্পদ জমে, সবাই অভিজ্ঞতার গুদামে পরিণত হই আমরা। কোটির মধ্যে মাত্র ক’জন সে অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান তুলে আনতে পারে, বাকি সবই অভিজ্ঞতার গুদাম থেকেই মরে যায়। যারা অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান তুলে আনতে পারে এমন কোটির মধ্যে মাত্র ক’জন সে জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞা তুলে আনতে পারে, বাকি সবাই জ্ঞানের গুদাম থেকেই মরে যায়। যারা জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞা তুলে আনতে পারে এমন কোটি’র মধ্যে মাত্র ক’জন সেই প্রজ্ঞাকে নিজের অস্তিত্বে আত্মস্থ ক’রে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেন, বাকি সবাই প্রজ্ঞার গুদাম থেকেই মরে যায়। যাঁরা প্রজ্ঞাকে নিজের অস্তিত্বে আত্মস্থ ক’রে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেন এরকম কোটি’র মধ্যে মাত্র ক’জন নিজের প্রজ্ঞাকে সমাজে ফিরিয়ে দিতে পারেন, বাকি সবাই প্রাজ্ঞ থেকেই মরে যান। যে প্রাজ্ঞরা নিজের প্রজ্ঞাকে সমাজে ফিরিয়ে দিতে পারেন তাঁরাই হন সত্যিকারের নেতা। এজন্যই প্রতিটি সমাজে দার্শনিকের সংখ্যা এত কম, যাঁরা সমাজকে এগিয়ে নেবেন। বাংলার দার্শনিক নেতা যিনি অর্থাভাবে পাঠশালার দ্বিতীয় শ্রেণীর পর আর আনুষ্ঠানিক পড়াশুনা করতে পারেন নি তিনি হয়ে উঠেছেন জাতির অন্যতম শিক্ষক, লাইব্রেরীকে বলেছেন তীর্থস্থান। তিনি সমাজকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রজ্ঞা, এখানেই তিনি বাংলার অনন্য নেতা।

তাঁর নাম আরজ আলী মাতুব্বর। আমাদের ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় সংঘাতময় পৃথিবীতে বারবার ফিরে যেতেই হবে তাঁর কাছে।

উপায় নাই !!

বাংলার গুরু

মহাস্থবির পণ্ডিত শীলভদ্র

(৫২৯ - ৬৫৪ সাল)

জ্ঞানের এই বিপুল বটবৃক্ষের কথা আমরা জানতে পারি বিশ্ববিখ্যাত চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং-এর লেখা থেকে। তিনি তাঁর সরাররি ছাত্র ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অতিশ দীপঙ্করের মতো এই গুরু’র জন্মও আমাদের বিক্রমপুরে। শীলভদ্র জমিদারের ছেলে ছিলেন, অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। শিক্ষাদীক্ষা শেষ করে ভারতের বিভিন্ন জায়াগায় ভ্রমণ করার পর মাত্র ৩০ বছর বয়সে দক্ষিণ ভারতের এক বিখ্যাত পণ্ডিতকে বিতর্কে পরাজিত করার পর তাঁর এত সুনাম ছড়িয়ে পড়লো যে তাঁকে উপাধি দেয়া হলো “দণ্ডদেব”। মগধের রাজা তাঁকে অনেক পুরস্কার দিলেন, সেটা তিনি ব্যয় করলেন এক বৌদ্ধবিহারের পেছনে। অতিশ দীপঙ্করের মতো তিনিও চিকিৎসা ও দর্শন সহ বিভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। বিহারে তৎকালীন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আচার্য্য ধর্মপালের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। প্রথমে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ পদ ও অবশেষে ৬৩৫ সালে অধ্যক্ষপদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তাঁকে তখন “স্বধর্মনিধি” উপাধি দেয়া হয়। ৬৩৭ সালে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক হুই লী সেখানে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে নিয়ে বেশ কিছু লিখেও গেছেন। পণ্ডিত শীলভদ্রের লেখা কোনো বই তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে আছে কিনা জানি না তবে তাঁর “আর্যবুদ্ধভূমিব্যাখ্যান” এখনো অনেক সম্মানের সাথে তিব্বতের তেঙ্গুর-এ লাইব্রেরীতে রাখা আছে।

বাঙালি শুধু সামরিক শক্তিতেই ভরত জয় করেনি, জ্ঞানের অঙ্গনেও বাঙালি ভারত-গুরু ছিল সাফল্যের সাথে। মুন্সীগঞ্জ ভুলে গেছে মুন্সীগঞ্জের মহারত্নদের কিন্তু ইতিহাস তাঁদের ধরে রেখেছে সম্মানের সাথে। খুব মোটা দাগে এগুলো লেখা হলো শুধু মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।

বাংলার এখনকার টালমাটাল অবস্থা দেখে হতাশ হবার কিছু নেই। কারণ সেই মেধাবী রক্ত এখনো বইছে বাংলারই কোথাও, আবার সে ফিরে আসবেই কখনো ॥

অতিশ দীপঙ্কর

(৯৮০ - ১০৫৩ সাল)

অনেকদিন আগের তিব্বত,

লোকটার গতিবিধি তো বড়ই সন্দেহজনক !

আসলে কে সে ? আসলেই কি সে ? পেছনে লেগে গেল তিব্বত সরকারের চর, লোকটার মতলব জানা দরকার। তিব্বতে বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি তুমি চট্টগ্রামের শরৎচন্দ্র দাস, জ্ঞানী বলেও কিছুটা খ্যাতি আছে তোমার, ডিপ্লোম্যাটিক কাজকর্ম নিয়ে রাজধানী লাসা-তেই ব্যস্ত থাক না বাপু ! কেন তুমি প্রায়ই রাজধানী থেকে উধাও হয়ে যাও ? কোথায় যাও ? কিসের খোঁজে প্রাণ হাতে করে গহন দুর্গম জঙ্গল দুর্গম পাহাড় পাড়ি দিয়ে দূর দূরান্তরে বিভিন্ন গহন গ্রামের বৌদ্ধমন্দিরে মন্দিরগুলোতে ঘুরে বেড়াও ?

কোন্ সে রাজকন্যার সন্ধানে জ্ঞানপিপাসু রাজপুত্রেরা প্রাণ হাতে করে দুর্গম সাগর-পাহাড় মরু-অরণ্যানী পাড়ি দেয় তা বেতনভুক সরকারি লোকের বোঝার কথা নয়। শরৎচন্দ্র দাসের মতলব প্রকাশ পেলো লণ্ডনে ১৮৯৩ সালে যখন এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ ইণ্ডিয়া থেকে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রমাণভিত্তিক বই “ইণ্ডিয়ান পণ্ডিত্স্ ইন্ দ্য ল্যাণ্ড অব্ স্নোস” আর বৃটিশ জিওগ্র্যাফিক্যাল সোসাইটি থেকে “ট্র্যাভেল অ্যাকাউণ্ট্স্ অব্ টিবেট”। ঘুরে তাকালেন বিশ্বের জ্ঞানীগুণী জন। কার কথা বলছেন শরৎচন্দ্র দাস ? আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের অবিসম্বাদিত সর্বশ্রেষ্ঠ কে সেই মহাজ্ঞানী ? সুবিশাল উপমহাদেশ আলোকিত করে রেখেছে কোন্ সে বিশাল প্রদীপ ? কোন্ সে আমন্ত্রিত অতিথি দরবারে প্রবেশ করা মাত্র “চীন-সম্রাট সম্মানের সহিত সিংহাসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন” ??

আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গেছে বিক্রমপুরও। বাংলা চিরচেনা মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর, ঢাকার কাছেই। সেখানে “নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা” তখনো ছিল, এখনো হয়তো আছে। সেখানে ৯৮০ সালে বাবা কল্যাণশ্রী আর মা প্রভাবতী’র কোলে জন্ম নিলেন আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। প্রথম শিক্ষা এলো বিদূষী মা প্রভাবতী’র কাছ থেকে। বাবা’র উৎসাহে একের পর এক খ্যাতনামা পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষা নিলেন তিনি অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। যা শিখতে অন্যদের লেগে যায় পাঁচ বছর সেটা ক’মাসের মধ্যেই শুধু শেখা নয়, একেবারে আত্মস্থ করলেন সেই সর্বভুক। বিভিন্ন বিষয় দ্রুতবেগে আত্মস্থ করলেন দক্ষিণ ভারত সহ ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার অনেক গুরুর কাছে। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর যখন গুরুরা প্রথমে তাঁর উপাধি দিলেন “গুহ্যজ্ঞান বজ্র” এবং পরে সর্বোচ্চ ধাপ “শ্রীজ্ঞান”। বৌদ্ধ ধর্মের সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসে এত কম বয়সে এই সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছিলেন ঐ একজনই। মাত্র ৩০ বছর বয়সে আচার্য্য শীলারক্ষিত-এর হাতে সর্বোচ্চ সম্মান “বোধিস্বত্ব” পেয়েছিলেন ঐ একজনই।

স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ বাধল কিছু পণ্ডিতের সাথে, তর্কযুদ্ধে এক বিখ্যাত পণ্ডিতকে পরাস্ত করার সাথে সাথে তাঁর সুনাম তড়িৎগতিতে ছড়িয়ে পড়লো দশদিকে। এরপর দশ বছর ধরে বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে শিক্ষা শেষ করে তিনি গেলেন সুবর্ণদ্বীপে যা আজ ইন্দোনেশিয়া’র সুমাত্রা দ্বীপ বলে পরিচিত। কিন্তু শিক্ষার কি শেষ হয় ? দু’বছর শিক্ষাশেষে ফেরার পথে তিনি আরো শিক্ষা নিতে গেলেন শ্রীলঙ্কায়, অর্থাৎ সিংহল দ্বীপে।

শিক্ষার পালা কারো শেষ হয় না। কিন্তু এক পর্যায়ে শিক্ষক হতে হয়। বাংলার রাজা নবপাল তাঁকে বিক্রমশীল মহাবিহারের (তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়) চ্যান্সেলার নিয়োগ করেন। আজ থেকে হাজার বছর আগে কেমন ছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয় ? মধ্য ষাট দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। কল্পনা করা যায়, হাজার বছর আগে এই বঙ্গসন্তান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৮,০০০ ছাত্রছাত্রী ও খ্যাতনামা ১০৮ জন শিক্ষকের সেই  বিশ্ববিদ্যালয় ! (তখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা স্তিমিত)। প্রদীপের আলোর মতো তাঁর দর্শনভিত্তিক গভীর বাগ্মীতার খবর ছড়িয়ে গেল চতুর্দিকে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর আমন্ত্রণ আসতে থাকলো বক্তৃতার জন্য। সুদূর তিব্বতেও তাঁর রাজকীয় অভ্যর্থনা হলো।

অসামান্য প্রতিভাধর তিনি দ্রুত শিখে নিলেন তিব্বতিদের ভাষা এবং তাকে অলংকৃত করলেন অনেক সংস্কৃত ও পালি বইয়ের অনুবাদ দিয়ে। পরে সেগুলোর কিছু আবিষ্কার করেন বাঙালি পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও ইতালিয়ান পণ্ডিত তুচি। ভাবা যায়, সেই আমলে তিনি চিকিৎসা-বিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছিলেন ১৭৫-টা বই ! এরপর তিব্বত পার হয়ে চীন-সম্রাটের আমন্ত্রণ। এই বিক্রমপুর-সন্তানকে “অতিশ” অর্থাৎ “শ্রেষ্ঠ” উপাধি দেন চীনের রাজাই। মানুষের ইতিহাসে একসাথে ৫১ আচার্য্য ও ১০৮টি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গের এই অনন্য কর্মদানব। এর ক’টা তুলনা আছে মানুষের ইতিহাসে ? তিনি একাধারে ছিলেন ভাষাবিদ, শব্দবিদ ও প্রকৌশলী। থল নামে জায়গায় তিনি বন্যা-নিরোধক বাঁধ বানিয়ে, ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পানি প্রবাহিত করিয়ে কৃষিকাজের প্রভূত উন্নতি করে এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের বই লিখে গণজীবনে এনেছিলেন বৈপ্লবিক উন্নতি। একটা মানুষের মধ্যে একাধারে ধর্মীয়, চিকিৎসা-বিজ্ঞান, সামাজিক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের এই বিরল সমন্বয় আর কোথায় পাওয়া যাবে ?

আমরা আমাদের রত্নের খবর রাখি না কিন্তু হাজার বছর পেরিয়ে বাংলার এই মহীরুহের দেহভস্ম এখনো অনেক সম্মানের সাথে রাখা আছে সুদূর তিব্বতের রাজধানী লাসা-তে, তাঁর “গ্রোম” সমাধিতে। আমরা জানি না কিন্তু এখনো চীনদেশে তাঁকে “জভো” অর্থাৎ “প্রভু” বলে সম্বোধন করা হয়। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকালে অনেকের বিশ্বাস হতে চাইবে না বিক্রমশীল ও নালন্দা’র মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান দু-দু’টো বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রধান ছিলেন দুই বঙ্গসন্তান, অতিশ দীপঙ্কর ও পণ্ডিত শীলভদ্র।

বিশ্ব-একুশ !

 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বাপ্নিক ও রূপকার রফিকুল ইসলাম (বামে) ও তাঁর সহযোগী আবদুস সালাম (ডানে)

১৯৯৭ সালের দিকের কথা। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে রফিকুল ইসলামের সুখের সংসার। সমাজে সম্মানিত মানুষ তিনি। কিন্তু সব সুখের মধ্যেও একটা কাঁটা বিঁধে থাকে মনে। মানুষের সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড তার ভাষা, ভাষা নেই তো জাতি নেই, কিছুই নেই। দুনিয়া জুড়ে মানুষের কত রকমই না মুখের বুলি, কত রকমের ভাষা ! কত রকমের বর্ণগন্ধ আকার প্রকারের অজস্র ফুলে ফুলে সুসজ্জিত মানুষের ভাষার বাগান। কিন্তু অলক্ষ্যে ভাষার বাগানের অনেক ফুল চিরতরে ঝরে গেছে, আরো অনেক ফুল ঝরে যাবার পথে। একাত্তরের বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা তিনি ঘাতক অস্ত্রের আঘাতে ঘাতক অস্ত্রকে পরাজিত করেছেন। এবারে তিনি সিন্ধান্ত নিলেন মানব ইতিহাসের অন্য এক ক্ল্যাসিক যুদ্ধের, ফুলের আঘাতে ঘাতক অস্ত্রকে পরাজিত করার যুদ্ধ।

অলক্ষ্যে ধ্বনিত হলো ইঙ্গিত, নির্ধারিত হয়ে গেল বিশ্ববাসীর প্রতি বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশের অসামান্য উপহার - আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। নিচে তালিকা দেয়া হলো এই অভাবিত সাফল্যের ঘটনাপঞ্জীর।

১।   ০৯ জানুয়ারী ১৯৯৮। লম্বা পথের প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হলো ; এ তারিখটা বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে সোনার অক্ষরে লিখে রাখার মত তারিখ। রফিকুল     ইসলাম চিঠি লিখলেন জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারেল কফি আনান-কে, একুশে ফেব্র“য়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হোক। দিনটির পটভূমিও জানালেন তিনি, আমাদের বাহান্ন’র একুশের পটভূমি।

২।   ২৩শে জানুয়ারী ১৯৯৮। নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশী হাসান ফেরদৌস জাতিসঙ্ঘে ডিপার্টমেণ্ট অব্ পাবলিক ইনফর্মেশন-এ চাকরি করেন। তাঁর কাছ থেকে চিঠি এলো প্রস্তাবটা জাতিসঙ্ঘের কোনো এক সদস্য দেশ উত্থাপন করুক।

৩।  ২৩শে জানুয়ারী ১৯৯৮। কথা বললেন বাংলাদেশী বন্ধু আবদুস সালামের সাথে, তিনিও ভ্যাঙ্কুভারেই থাকেন। যে কাফেলায় শিগগীরই বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি বিশ্ববাসী যোগ দেবে, বিভিন্ন দেশের সরকার যোগ দেবে তাতে সেদিন একজন   থেকে দু’জন হলো।

৪।   ২৪শে জানুয়ারী ১৯৯৮। আমেরিকায় বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মাননীয় এ. এফ. এম.     সেহাবুদ্দীন-এর সাথে টেলিফোনে কথা হলো। তিনি বললেন তাঁকে জাতিসঙ্ঘের চিঠিটা পাঠিয়ে দিতে, সেটা তিনি জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব আনোয়ারুল করিম চৌধুরীকে পাঠাবেন। যেহেতু রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম     ক্যানাডার নাগরিক তাই জাতিসঙ্ঘে ক্যানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত মাননীয় রবার্ট ফওলার-এর সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হলো কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায় নি।

৫।  ২৪শে জানুয়ারী থেকে ২৮ মার্চ, ১৯৯৮। রফিকুল ইসলামকে প্রেসিডেণ্ট ও আবদুস     সালামকে ডিরেক্টর করে “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব্ দ্য ওয়ার্ল্ড” নামে একটি     সংগঠন তৈরি করা হলো যাতে ইংল্যাণ্ড, চীন, ফিলিপাইন, জার্মান, ভারত ও কাচী দেশ থেকে আসা দশজন অভিবাসীরা থাকলেন।

৬।  ২৯ মার্চ ১৯৯৮। এই দশজনের স্বাক্ষরিত নূতন একটা চিঠি জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারেল কফি আনান-কে পাঠানো হলো।

৭।   ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, প্রায় এক বছর পর। নিউ ইয়র্কের হাসান ফেরদৌস-এর কাছ   থেকে চিঠি এলো প্যারিসে ইউনেস্কো’র সাথে যোগাযোগ করার পরমর্শ দিয়ে।

৮।  ১৯ ফেব্র“য়ারী ১৯৯৯। জাতিসঙ্ঘে পাঠানো চিঠিটা আবার দশজনের স্বাক্ষরসহ ইউনেস্কোতে পাঠানো হলো এবং ভাষা-শাখার আনা মারিয়া মাজলফ-এর সাথে টেলিফোনে কথা হলো।

৯।  ০৩ মার্চ ১৯৯৯। আনা মারিয়া’র প্রাথমিক চিঠি এলো তিনি শিগগীরই যোগাযোগ করবেন।

১০।  ০৮ এপ্রিল ১৯৯৯। আনা মারিয়া’র চিঠি এলো। তিনি লিখেছেন এ-ব্যাপারে ওই

    বছরের নভেম্বর মাসে যে ৩০তম সাধারণ সভা হবে তাতে ইউনেস্কো’র সদস্য হিসেবে ক্যানাডা, ফিনল্যাণ্ড, হাঙ্গেরী, ভারত বা বাংলাদেশ এ-প্রস্তাব তুলতে পারে।

১১।  জুন ও জুলাই ১৯৯৯ সংগঠনের তরফ থেকে টেলিফোনে ও চিঠিপত্রে বাংলাদেশের     শিক্ষামন্ত্রী জনাব এ.এস.এইচ.কে. সাদেক, শিক্ষাসচিব জনাব রকিবুদ্দিন আহমেদ     এবং ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের ন্যাশনাল কমিশনের সচিব জনাব কফিলুদ্দিন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলো যাতে ওই প্রস্তাবটা নভেম্বর মাসে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় উপস্থাপন করা হয়। একই চেষ্টা করা হলো ক্যানাডা, ফিনল্যাণ্ড, হাঙ্গেরী ও ভারত সরকারের সাথেও।

১২।  ২৪ জুলাই ১৯৯৯। জনাব কফিলুদ্দিন আহমেদ দেখা করে কথা বললেন শিক্ষামন্ত্রী জনাব সাদেক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র সাথে।

১৩। ১৫ আগষ্ট ১৯৯৯। হাঙ্গেরী সর্বপ্রথম ইউনেস্কোকে চিঠি দিয়ে এ প্রস্তাব সমর্থন করলো। ফিনল্যণ্ড জানালো আর কোনো দেশ যদি সমর্থন দেয় তবে তারাও সমর্থন    দেবে। ভারত ও ক্যানাডা তখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

১৪।  জুলাই-আগষ্ট ১৯৯৯। জনাব রফিকুল ইসলাম ও জনাব আবদুস সালাম বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যক্তির সাথে নিরন্তর যোগাযোগে ব্যস্ত থাকলেন    যাতে সময়মতো প্রস্তাবটা তোলা যায়।

১৫।  আগষ্টের শেষদিকে ১৯৯৯। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেন, বাংলাদেশ ওই     প্রস্তাব তুলবে।

১৬। ০৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯। ইউনেস্কো’র লিঙ্গুইষ্টিক ডাইভার্সিটি অ্যাণ্ড মাল্টিলিঙ্গুয়াল এডুকেশন বিভাগের গুডউইল রাষ্ট্রদূত মিসেস ভিগদিস ফিনবোগাদোতির-এর কাছে চিঠি পাঠানো হলো যাতে তিনি বাংলাদেশের প্রস্তাবকে সমর্থন ও সহায়তা করেন।

১৭।  ০৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯। প্রস্তাব পৌঁছানোর নির্ধারিত শেষ দিনের মাত্র একদিন আগে     বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এসে পৌঁছায়।

১৮। ১৯ অক্টোবর ১৯৯৯। সমর্থনের জন্য ভ্যাঙ্কুভারের সংগঠনের তরফ থেকে ইউনেস্কো’র ১৮৮ সদস্য দেশকে চিঠি পাঠানো হলো।

১৯। ২৬ অক্টোবর ১৯৯৯। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ইউনেস্কো’র ১৫৮তম     সভার কার্যকরী পরিষদে খসড়া প্রস্তাব পেশ করা হলো।

২০।  ২৬ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯। শিক্ষামন্ত্রী জনাব এ.এস.এইচ.কে.সাদেক-  এর নেতৃত্বে ডেলিগেশনে শিক্ষাসচিব জনাব রকিবুদ্দিন আহমেদ, ইউনেস্কো’তে বাংলাদেশে ন্যাশনাল কমিশনের সচিব জনাব কফিলুদ্দীন আহমেদ, ইউনেস্কো’র   ডিরেক্টর জেনারেলের বিশেষ উপদেষ্টা জনাব তোজাম্মেল হক (টনি হক), ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি, প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলার জনাব ইখতিয়ার মোমেন চৌধুরী সহ আরো অনেকে এই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন অর্জনে অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন। প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টার জেনারেল মিঃ     কলিন পাওয়ার (অষ্ট্রেলিয়াবাসী) পদ্ধতিগত সাহায্য করলেন।

২১।  ১২ নভেম্বর ১৯৯৯। ২১শে ফ্রেব্র“য়ারীকে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রাথমিক

   প্রস্তাবের পক্ষে পাকিস্তান সহ ইউনেস্কো’র কার্যকরী পরিষদের ২৯টি দেশ সমর্থন জানালো।

২২।  ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯। ১৮৮ সদস্যদেশের সম্মতিক্রমে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে “আন্তর্জাতিক

        মাতৃভাষা দিবস” ঘোষণার পক্ষে প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল।

কোন্ সুদূরে ঢাকার শহীদ মিনারের মুখে তখন ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি, কোথায় কোন্ সুদূর থেকে তা দেখছেন বাহান্নোর বরকত, রফিক, সালাম, জাব্বার .........

রফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের এই ব্যতিক্রমী গৌরব-ব্যক্তিত্ব কুমিল্লায় জন্মেছিলেন ১৯৫৩ সালে বাবা আবদুল গণি ও মা করিমুন্নেসা বেগম-এর কোলে। নিজের সম্বন্ধে তাঁর প্রিয় পরিচয়, তিনি একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা। কুমিল্লা হাইস্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কমার্স-এ মাষ্টার্স করেন। সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্রশিকা-য় দীর্ঘদিন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সপরিবারে ক্যানাডায় অভিবাসী হিসেবে পাড়ি দেন ও একটি স্বাস্থ্য-সংস্থায় কাজ করেন। নিজের চোখে তিনি একজন মাতৃভাষা-প্রেমিক। তাঁরই নেতৃত্বে ইউনেস্কো’র কাছে ২১শে ফেব্র“য়ারীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষণা করার প্রস্তাব যায় এবং সেটি বাস্তবায়ন হয়। বর্তমানে তিনি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব’ দ্য ওয়ার্ল্ড সংগঠনের প্রেসিডেণ্ট, এবং ভ্যাঙ্কুভারে-এ বসবাস করছেন। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব্ দ্য ওয়ার্ল্ডকে একুশে পদক প্রদান করে। এখনো মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব্ দ্য ওয়ার্ল্ড বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষাকে সম্মান দেবার প্রবণতা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। তাঁর নূতন আরেকটি সংগঠনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধা এই সংগঠনের নাম “ঘুষ এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ”।

আবদুস সালাম

জনাব আবদুস সালামের জন্ম ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে এক আলোকিত পরিবারে। তাঁর বাবা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডাঃ শামসুল আলম চৌধুরী ও মা কোলকাতার বেগম সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষয়িত্রী সুরতুন্নেসা। তাঁর বংশগত শেকড় হলো রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাসান চৌধুরী বাড়ি। পাঁচ ভাই ও চার বোনের তিনি সবার বড়ো। চট্টগ্রামের সেণ্ট প্ল্যাসিড স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে, তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অনার্সে। ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেরিন অ্যাকাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে একই সাথে কলাবিভাগ ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ১৯৮৩ সালে তিনি প্রধান মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন। পেশাগত জীবনে তিনি প্রথমে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন সহ বিভিন্ন কোম্পানীতে। ইংল্যাণ্ডের নিউক্যাস্ল-এ সাউথ শীল্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করেন। ইমিগ্রেশন নিয়ে আসার পর ক্যানাডাতে তিনি বর্তমানে গ্রেটার ভ্যাঙ্কুভার-এর বার্নবী শহরে স্ত্রী ও ২ পুত্রসহ বাস করছেন এবং বৃটিশ কলম্বিয়ার এক শিপিং কোম্পানীতে গত ১৫ বৎসর যাবৎ প্রধান প্রকৌশলী (মেরিন) হিসেবে কর্মরত আছেন ॥

বিশ্ব-একুশের মর্মসংগীত
কথা ও সুর - হাসান মাহমুদ
কণ্ঠ: - ড: মমতাজ মমতা ও তাঁর ছাত্রছাত্রীবৃন্দ
ভিডিয়ো - https://www.facebook.com/projonmoblog/videos/4641811157268/

দিগন্তরে,
অমর একুশে যুগ যুগান্তরে,
ছড়িয়ে গেলো আজ কি মন্তরে,
মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে ।।
ওই একুশে - একুশে - একুশে !!

রফিক সালাম,
দেশ বিদেশে ছড়িয়ে গেলো নাম,
দেশ বিদেশে সবে জানালো সালাম ।।
রক্তরাগে,
শহীদ মিনার কি অলক্ত রাগে
বিশ্ব বীণায় বাজে সপ্ত রাগে !
ওই একুশে - একুশে - একুশে !!

কি ঝংকারে
বিশ্ব ললাটে জ্বলে অহংকারে,
একুশে রক্তক্ষতের অলংকারে ।।
ওই একুশে - একুশে - একুশে !!

এসো সবে,
বিশ্ব মাতৃভাষার এ উৎসবে,
বাংলার দানে ধরা ধন্য হবে ।।
এসো এসো ভাই,
অমর একুশের জয়গান গাই,
মায়ের ভাষার বড় নাই কিছু নাই ।।
ওই একুশে - একুশে - একুশে !!

অ-তে অতুলপ্রসাদ, আ-তে আলতাফ মাহমুদ

                      "বর্ণে-বর্ণে-বাঙালি" - বইয়ের প্রচ্ছদ               

"মি: স্পীকার !  আজ আমি আপনার সম্মুখে দন্ডায়মান হয়ে ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুলের তখনকার ছাত্রছাত্রীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি" - ক্যানাডার সংসদে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের বক্তৃতার অংশ, ১১ই জুন ২০০৮।  

দেশ, জাতি ও সরকারের পক্ষ থেকে সংসদে ক্ষমা চাইতে হল প্রধানমন্ত্রীকে। ১৮৭০ সালের দিকে ফরাসি ও ব্রিটিশ শক্তি ক্যানাডা দখল করার পর আদিবাসী সব শিশুকে আবাসিক স্কুলের হোস্টেলে বন্দী করে  তারা নিজেদের বানানো সিলেবাস ছাড়া অন্য সব শিক্ষা অবৈধ ঘোষণা করে।  ইংরেজীতে ছাড়া নিজেদের ভাষায় কথা বলার অধিকার পর্য্যন্ত বাচ্চাদের ছিলনা।  সিলেবাস বদলের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক গণহত্যার সেই অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন হ্যালিফ্যাক্সের গবেষক ফারহানা নাজ শম্পা - "আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসিক স্কুল : কানাডার ইতিহাসে কালিমাময় এক অধ্যায়" - প্রথম আলো ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮।  

একটা জাতিকে তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেয়া তাকে খুন করার সমান, তার চেয়েও আত্মঘাতী হল বাচ্চাদেরকে উল্টো ইতিহাস শেখানো।  ওই স্কুলগুলোর অধ্যক্ষেরা কোনো স্যুট-টাই পড়া ‘ভদ্দন্নোক’ ছিলেন না - তাঁরা ছিলেন ধর্মগুরু পাদ্রী।  গণহত্যার মধ্যে হিংস্র ধর্মগুরুরা স্বর্গের সিঁড়ি খোঁজেন, এ থেকে শান্তিময় ধর্মগুরুরা জাতিকে রক্ষা করতে পারেন। আরেক উদাহরণ পাকিস্তান যার সাথে আমাদের রাজনৈতিক-ধর্মনৈতিক অতীত বর্তমান প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। আজ হাতে গোনা কিছু পাকিস্তানী ছাড়া সবাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে:-

উদাহরণ ১ – একাত্তর আমাদের স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধ ছিলনা, ওটা ছিল ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ।  

উদাহরণ ২ - মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ভারতের মুসলিমেরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে। 

দুটোই ডাঁহা মিথ্যে। এমন উল্টাপুরাণ তোগলকি কাণ্ড কিভাবে সম্ভব হল? পুরো জাতিকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার মুণ্ডু কিভাবে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব হল? ইতিহাস থেকে এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই জাতটা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাই নেবার সুযোগ পায়নি, এখনো মৌলবাদের খপ্পরে রক্তাক্ত হচ্ছে আর বেলুচিস্তানে আমাদের মতোই শোষিত বঞ্চিত স্বাধীনতাকামী বেলুচদের ওপরে ক্রমাগত গণহত্যা করছে। আর আমরা? আমরা ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর লক্ষবাগ আমবাগানের যুদ্ধে মীরজাফরের ইতিহাস জানি বলেই পঁচাত্তরের মুশতাককে চিনতে আমাদের সময় লাগে এক সেকেণ্ড বা তারও কম।

জাতিকে ইতিহাস ভোলানোর অব্যর্থ অস্ত্র হল শিক্ষা-সিলেবাস। বাচ্চারা তাদের প্রাইমারি থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত যদি একই তথ্য শেখে, সেটা আবার পিতামাতা, শিক্ষক, টিভি-রেডিও, ম্যাগাজিন খবরের কাগজ,  রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের সভা সমিতির বক্তৃতায় ক্রমাগত শুনে বড় হয় তখন তাদের কাছে সেটাই মোক্ষ সত্য হয়ে দাঁড়ায়,  এর বাইরে কিছু তারা চিন্তাও করতে পারেনা। কি শিখেছে পাকিস্তানীরা ছোটবেলা থেকে? 

উদাহরণ ১ - মুক্তিযুদ্ধের ওপরে তরুণ বলিষ্ঠ গবেষক আরিফ রহমানের “ত্রিশ লক্ষ শহীদ : বাহুল্য নাকি বাস্তবতা” বইয়ের ‘কেন আজও পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে হয়’ - অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে পাকিস্তানি শিশুরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে পড়ছে - সূত্র - আজাদী, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮।  সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি:-

“১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ভারত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সহযোগিতায় সেখানকার অধিবাসীদের পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে……….১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে।  ভারতের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হয়ে যায়…..পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু সংখ্যক হিন্দু শিক্ষক ছিলেন..হিন্দু শিক্ষকেরা বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে…….ভারত তাদের স্বার্থ বাস্তবায়নে এই হিন্দুদেরকে ব্যবহার করে…. অনেক হিন্দুই ভারতের চর হিসেবে কাজ করে ….মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ….. .ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়।  স্থানীয় জনগণের সমর্থনের অভাব, সামরিক বাহিনী ও সরঞ্জামাদি সরবরাহের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানের সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণে বাধ্য হয়” - উদ্ধৃতি শেষ।  

২য় উদাহরণটাও মিথ্যে।  ১৯৪৬ সালে ভারতে “ইনফরম্যাল রেফারেণ্ডাম” নির্বাচন হয়েছিল। র্অথাৎ মুসলিম লীগ যদি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে জেতে তাহলে প্রমাণ হবে ভারতীয় মুসলিমেরা পাকিস্তান চায়।  সে নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাঞ্জাবে ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হেরে গিয়েছিল, শুধু সিন্ধু প্রদেশে সমানে সমান ভোট পেয়েছিল।  সাংবিধানিক ক্ষমতায় স্পিকার তাঁর ভোটটা মুসলিম লীগকে দিলে তবেই সেখানে সে সরকার গঠন করতে পেরেছিল।  আর বাংলায় মুসলিম লীগ ভূমিধ্বস জিতে সরকার গঠন করেছিল।  অর্থাৎ পাকিস্তানের বেশীর ভাগ জনগণই পাকিস্তান চায়নি, পাকিস্তান এনেছিলাম আমরাই।  অথচ ওখানকার বাচ্চারা সিলেবাসে উল্টো ইতিহাস শিখে বড়ো হয়েছে।

নিজের মা-বোন ধর্ষিতা না হলে নাকি অপরাধটা ধর্ষকের মাথায় ঢোকেনা।  সিলেবাস বাংলাদেশেও বদলানো হয়েছে।  ধর্মীয় শিক্ষার জন্য দেশে অসংখ্য মাদ্রাসা থাকার পরেও যাঁরা সাধারণ শিক্ষা-সিলেবাসে ধর্ম ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাঁরা ভুলে যান যে বাংলাদেশের বাইরে বিশাল বিস্তীর্ণ দুনিয়া আছে, সেখানে এক ধর্মের উগ্রতা অন্য ধর্মের উগ্রতাকে শক্তিশালী করে।   তাঁরা খেয়াল করেন নি যে তাঁদেরকে অনুসরণ করে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্ব সিলেবাসে বেদ-পুরান-উপনিষদ-বাইবেল ঢুকিয়ে দিলে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের কি ভয়ানক অবস্থা হবে।  পাকিস্তানের স্কুল কলেজে বাচ্চাদের ওপরে রাষ্ট্রের এই হিংস্রতা বহু আগে থেকেই চলছে।   

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে যদি সত্য হয় তাহলে যে প্রকৃতির শিক্ষাঙ্গন সেই প্রকৃতির সিলেবাস হওয়াই দরকার।  আমাদের সিলেবাসের ঐতিহ্য ছিল সরকারী সিলেবাসে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষাঙ্গনের সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষা। পরে শুরু হয় সিলেবাসে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা।  সেই আটচল্লিশ বাহান্নতেই আরবী অক্ষরে বাংলা লেখার মতো উদ্ভট ও উৎকট চেষ্টা হয়েছিল, সম্ভবত: সরকারী অর্থায়নও করা হয়েছিল। ফ্রন্টাল লাইনে সেই অপচেষ্টা বিফল হবার পর সেই একই উদ্দেশ্যে এখন সাইড লাইনে শুরু হয়েছে নুতন আক্রমণ।

"অ"-তে 'অজগর' এগুলো উবে গিয়ে হয়েছে - উদ্ধৃতি:- “অ”-তে ‘অজু করে পাক হও’, “আ”-তে ‘আজান শুনে জামাতে যাও’, “ই”-তে ‘ইসলাম চায় শান্তি’, “ঈ”-তে ‘ঈমান বাড়ায় শক্তি’, “এ”-তে ‘এক হও মুসলমান’, “ঐ”-তে ‘ঐশী বাণী আল কোরআন’….‘গ’-তে ‘গান শোনা ভালো নয়’…‘জেড’ বর্ণ দিয়ে শব্দ গঠন করা হয়েছে ‘জু’ আর বাক্য গঠনে লেখা হয়েছে, ‘চিড়িয়াখানাতে আল্লাহর কুদরত দেখো’……৫০টি বর্ণের মধ্যে ২৯টি দিয়ে ধর্মীয় বাক্য গঠন করা হয়েছে। - কালের কণ্ঠ - কিন্ডারগার্টেনে কী পড়ানো হচ্ছে! ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আয়াতুল্লাহ খোমেনি, মাওলানা আবদুর রহিম এমনকি মাওলানা মওদুদীর জীবনী ও দর্শনচিন্তা। অথচ মওদুদীর চিন্তাধারা পাকিস্তানে ধর্মীয় ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে খুনোখুনির ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং এ চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই একশ্রেণীর তথাকথিত ধার্মিক আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে হানাদার বাহিনীর দালালিতে লিপ্ত হয়েছিল। এ দেশের আল বদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনীর উৎপত্তি মওদুদীর চিন্তাধারারই ফসল - সমকাল সম্পাদকীয়, ২৪ জুন ২০০৮।

সিলেবাস পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। ত্রিশ চল্লিশ বছর পরে এর প্রভাব অনুভূত হবে যখন আমাদের বাচ্চারা বড়ো হয়ে দেশ-জাতির হাল ধরবে। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায় জাতির ইতিহাস স্কুল সিলেবাসে ঠিকমত অন্তর্ভুক্ত না করার ফলে তরুণ প্রজন্ম ইতোমধ্যেই ভয়াবহ জগাখিচুড়ী করে ফেলেছে শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসের মধ্যে। অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে বাংলাদেশের নিয়তি, ধ্বনিত হচ্ছে ইঙ্গিত - আমরাও কি অসাম্প্রদায়িকতার শেকড়চ্যুত হয়ে পাকিস্তান মার্কা ভবিষ্যতের দিকে হাঁটছি?

দেশে এই সাংস্কৃতিক গণহত্যার বিরুদ্ধে আজ সোচ্চার অনেক মেধা, চিন্তা, কণ্ঠ ও লেখা, এর মধ্যে উঠে এসেছে মৌলিক এক অনন্য প্রতিরোধ।  কলমের বিরুদ্ধে চাপাতির হিংস্রতা নয়, কলমের বিরুদ্ধে কলম এবং বইয়ের বিরুদ্ধে বই।  এ বইয়ের নাম "বর্ণে বর্ণে বাঙালী"।  ২৪ পৃষ্ঠার এ বইতে প্রায় ৬০ জন বাঙালি মনিষীর মুখচ্ছবির সাথে রয়েছে ছড়া যাতে  বাচ্চারা অক্ষরের সাথে সাথে আমাদের আলোকিত বাতিঘরদের সাথেও পরিচিত হয়, তাঁদের মতো হবার উৎসাহ পায়।

"অ"- অতুলপ্রসাদ সেন:-                      

বাংলা ভাষার গুণী শিল্পী, গানের মানুষ তিনি,

দেশের গান মানুষের গান গজল লিখেছেন যিনি।   

"আ"- আলতাফ মাহমুদ :-   

 আলতাফ মাহমুদ গানের পাখী, দেশ রক্ষায় বীর, 

ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ, উন্নত তার শির।  

“এ” - এস এম সুলতান

রঙ তুলিতে আঁকতেন ছবি, আঁকতেন দেশের মুখ,

বাংলাদেশের শিল্পী তিনি, গর্বে ভরে বুক। 

   

“ঋ- ঋত্বিক ঘটক

বাঙালির পরম বন্ধু সিনেমা অন্ত:প্রাণ,

সিনেমার মাঝে গেয়ে গেছেন মানুষের জয়গান।

প্রকাশক রাকিবুল হাসানের ভাষায় - “যে বই শিশুকে তার শিক্ষাজীবনের সূচনায় 'অজ' বা ছাগল চেনাবে না, অজগরের ভয় দেখাবে না বা শিশুমনে ঢুকিয়ে দিবে না সাম্প্রদায়িকতা। এই বই শিশুদের পরিচয় ঘটাবে বাঙালি মনীষীদের সাথে। শিশুরা চিনবে কাজী নজরুল, লালন, ক্ষুদিরাম, সুলতান, মেঘনাথ সাহা প্রমুখকে। ওরা জানবে ভাষাশহীদ এবং বীরশ্রেষ্ঠদের সম্পর্কে। ওদের মনে তৈরি হবে অদম্য কৌতুহল এবং নানান প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে ঘটবে শিশুর স্বতঃস্ফুর্ত আত্মবিকাশ”।

হোক পথ দু:সহ, দুর্গম, ভয়াবহ - দু'এক পথিক পথ চলবেই,

বোধের বন্ধদ্বারে, নিকষ অন্ধকারে - বিদ্রোহী কিছু দীপ জ্বলবেই !!

মাভৈ ! 

২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

২১শে, ২৬শে, ১৬ই ও জন্মদিন উদযাপন কি শির্ক?

রক্তক্ষতের অলংকারে সজ্জিত আমাদের তিনটে অভ্রভেদী দিবস, একুশে, ছাব্বিশে আর ষোলোই। এই তিনটে দিন উদযাপন জাতির এক অংশের কাছে চেতনা ও অস্তিত্বের গর্বিত মেরুদণ্ড, অন্য এক অংশের কাছে সেটা আল্লাহর প্রতি সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ যা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয়। এর নেতৃত্বে আছেন আমাদের ইসলামী নেতৃত্বের একটা অংশ। তাদের ওয়াজ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁরা জাতিকে (প্রধানত: গ্রামগঞ্জের গণমানসকে)  কী বিষয়ে, কোন দিকে ও কী পদ্ধতিতে প্রভাবিত করছেন।

তাঁরা বলেন শির্ক হতে পারে বিশ্বাসে, মুখের কথায়, আচার ব্যবহারে, ইবাদতের মধ্যে এমনকি ভাষার মধ্যেও যেমন আল্লাহকে ‘খোদা’ বলা, বান্দার কিছু নাম যেমন বন্দে আলী, গোলাম নবী, গোলাম মোস্তফা, গোলাম রসুল, গোলাম হোসেন ইত্যাদি।  অনেকের শির্কের তালিকায় আরো আছে রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা, মজহাব না মানা, ঘরে ছবি বা মূর্তি রাখা,  যে কোনো দিবস পালন যেমন জন্ম-মৃত্যুদিবস, বাংলা ইংরেজি নববর্ষ, ভ্যালেন্টাইন ডে সহ একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর ইত্যাদি।

 কিছু বক্তা শান্তভাবে এবং কিছু বক্তা উন্মত্তভাবে হাত ছুঁড়ে কোরানের কিছু আয়াত ও কিছু হাদিস বর্ণনা করে তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।  শির্কের কিছু ব্যাপার নিয়ে তাঁদের মধ্যে তুমুল বিরোধ আছে যেমন পীর-মুরীদি, মাজারপন্থিদের কার্যকলাপ, ওরসে কারো জন্য কিছু মানত করা, ঝাড়ফুঁক-তাবিজ-পাথর, কবরে ফুল দেয়া বা গোলাপ পানি ছিটানো,  ‘রসুল (সা) গায়েব জানতেন’ বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি।  এ বিরোধ এতই তীব্র যে একে অপরকে ‘মুশরিক’ বলে দাবি করে থাকেন।

এ নিবন্ধের বিষয় একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর উদযাপন/পালন শির্ক কিনা। শহীদ মিনারের প্রতি দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল জামাতের বিরোধিতা সবাই জানেন এবং তাঁরাও সেটা স্পষ্টই বলে থাকেন। যেমন, – ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়: ‘আইয়ুব খানের গভর্নর আজম খান ছাত্রদের খুশি করার জন্য যে শহীদ মিনার তৈরি করলেন তাকে পূজামণ্ডপ বলা যেতে পারে, কিন্তু মিনার কিছুতেই না’ – চ্যানেল আই অনলাইন ২১ ফেব্রুয়ারি২০১৮

জামাত শিবিরের বাধার জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি দীর্ঘ তিরিশ বছর – কালের কণ্ঠ  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১।

শির্কের বিষয়ে তাঁরা বলেন:-

১. আল্লাহ বাকি সব গুনাহ ক্ষমা করতেও পারেন কিন্তু শির্ক সেই কবীরা গুনাহ যা আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না – সুরা নিসা: ৪৮, ১১৬, মায়িদাহ:৭২, আনাম:১৬৩, কাহফ : ১১০, ইমরান: ৬৪, আল জিন: ২৬, আনাম: ৫৯ ইত্যাদি।

২. সহি মুসলিম-৯৩, আবু দাউদ:৩২৩৬(ইফা), ফতহুল বারী ৭/৪৪৮, আবু দাউদ:৪০৩৩, ইবনে মাজাহ ৫২০৪ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু আল্লাহর প্রতি সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ যা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয় সেই ‘শির্ক’টা আসলে কি?  তাঁরা বলেন ‘শির্ক’ শব্দটা এসেছে “শরিক” থেকে, অর্থাৎ কোন কিছুর ওপরে অংশীদার বা যৌথ-মালিকানা।  সম্পত্তি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন অংশীদার থাকে সেরকম।   উদাহরণ – আদি মুসলিম সমাজে  দাস-দাসীর ওপরে যৌথ মালিকানার প্রথা ছিল:-

(ক) হানাফি আইন হেদায়া- পৃষ্ঠা ২৩১:- ‘অংশীদারগণ পরস্পরের সম্মতিক্রমে ক্রীতদাসীকে দৈহিক উপভোগ করিতে পারিবে’।

(খ) সহি বোখারী – মদীনা বিশ্ববিদ্যায়ের ডঃ মুহম্মদ মহসীন খান,-  ভল্যুম ৩, হাদিস নং ৬৯৮ –  “আলাহ’র নবী (দঃ) বলিয়াছেন, যদি কেহ কোন এজমালি দাস-দাসীকে নিজ অংশ হইতে মুক্ত করে এবং তাহার কাছে পুরা মুক্তি দিবার মত যথেষ্ট অর্থ থাকে তাহা হইলে তাহার উচিত কোন ন্যায়পরায়ণ লোক দ্বারা সেই দাস-দাসীর উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করা এবং অংশীদারদেরকে তাহাদের অংশের মূল্য দিয়া সেই দাস-দাসীকে মুক্ত করিয়া দেওয়া।  তাহা না হইলে সে শুধু সেই দাস-দাসীকে আংশিক মুক্ত করিল”।  এটা আছে হাদিস ৬৯৭, ৬৯৯, ৭০১, ৭০২ ইত্যাদিতেও।

মাওলানারা বলেন – আল্লাহ’র সাথে শরীক করা মানে একমাত্র আল্লাহ’র যা প্রাপ্য তাতে অন্য কিছুকে বা কাউকে অংশীদার করা।   সে অংশীদার হতে পারে কোনো বস্তু যেমন, গাছ-পাথর-মাজার-প্রতিমা, বা অন্য কোন জীবন্ত বা প্রয়াত মানুষ যেমন পীর আউলিয়া মুর্শিদ এমনকি নবী মুহম্মদ (স) পর্যন্ত।

সব মিলিয়ে শির্কের সংজ্ঞা আছে কোরানের বাংলা অনুবাদে, মওলানা মুহিউদ্দীন খান পৃষ্ঠা ২৫৪ থেকে উদ্ধৃতি:-

“আল্লাহ তাআলার সত্বা ও গুণাবলী সম্পর্কে যেসব বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, তেমন কোন বিশ্বাস সৃষ্ট বস্তুর ব্যাপারে পোষণ করাই হল শেরক।

এরই কিছু বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:

(ক) জ্ঞানের ক্ষেত্রে শরীক সাব্যস্ত করা:  অর্থাৎ, (১) কোন বুজুর্গ বা পীরের ব্যাপারে এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, আমাদের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে তিনি অবহিত। (২) কোন জ্যোতিষ পণ্ডিতের কাছে গায়বের সংবাদ জিজ্ঞেস করা কিংবা (৩) কোন বুজুর্গের বাক্যে মঙ্গল দেখে তাকে অনিবার্য মনে করে নেয়া অথবা (৪) কাউকে দূর থেকে ডাকা এবং সাথে সাথে এ কথা বিশ্বাস করা যে, সে আমার ডাক শুনে নিয়েছে অথবা (৫) কারো নামে রোজা রাখা।

(খ) ক্ষমতার ক্ষেত্রে শরীক করা: অর্থাৎ, কাউকে হিত বা অহিত তথা ক্ষতি-বৃদ্ধি সাধনের অধিকারী মনে করা। কারো কাছে উদ্দেশ্য যাঞ্চা করা।  কারো কাছে রুজি-রোজগার বা সন্তান-সন্ততি প্রার্থনা করা।

(গ) এবাদতে শরীক সাব্যস্ত করা: কাউকে সেজদা করা, কারো নামে কোন পশু মুক্ত বা জবাই করা, কারো নামে মানত করা, কারো কবর কিংবা বাড়িঘরের তাওয়াফ করা, আল্লাহ তাআলার কোন হুকুমের তুলনায় ওপর কারো কথা কিংবা কোন প্রথাকে প্রাধান্য দেয়া, কারো সামনে রুকু করার মতো অবনত হওয়া, কারো নামে জীব কোরবানি করা, পার্থিব কাজ-কারবার কিংবা বিবর্তনকে নক্ষত্রের প্রভাব বলে বিশ্বাস করা এবং কোন কোন মাসকে অশুভ মনে করা প্রভৃতি।”

উদ্ধৃতি শেষ। এখন দেখা যাক আমরা আল্লাহ’র কাছে কি প্রার্থনা করি:-

  • জানা অজানা সব অপরাধের ক্ষমা,
  • পরকালে বেহেস্ত প্রাপ্তি ও দোজখ থেকে নাজাত,
  • রোগ শোক বলা মুসিবত থেকে পরিত্রাণ,
  • সন্তান লাভ,
  • পরীক্ষায় ভালো ফল, বিয়ে বা ব্যবসায়ে সাফল্য ইত্যাদির লম্বা তালিকা

ইসলাম তো সিরাতুল মুস্তাকিম অর্থাৎ সহজ সরল ধর্ম। তাই এবারে একটা সহজ সরল অংক করা যাক। আমরা যে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর, বর্ষবরণ বসন্তবরণ ইত্যাদি উদযাপন করি তাতে:-

(১) ওপরের কোন কিছু প্রার্থনা করি?  জবাব : না !  প্রশ্নই ওঠেনা।

(২) আমরা কি দিনগুলোকে ইবাদত করি?  জবাব: না, অবশ্যই করিনা।

(৩) আমরা কি দিনগুলোর কাছে অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করি?  জবাব: না, নিশ্চয়ই করিনা।

(৪) আমরা কি দিনগুলোর কাছে বেহেস্ত প্রার্থনা করি?   জবাব:- না, প্রশ্নই ওঠেনা।

(৫) আমরা কি দিনগুলোর কাছে দোজখ থেকে নাজাত প্রার্থনা করি?  জবাব: না, অবশ্যই করিনা।

(৬) আমরা কি দিনগুলোর কাছে রোগশোক, বালামুসিবত থেকে রেহাই প্রার্থনা করি?  জবাব: না, করিনা।

(৭) আমরা নি:সন্তান হলে দিনগুলোর কাছে কি সন্তান প্রার্থনা করি?  জবাব: না, কখনোই করিনা।

(৮) আমরা কি দিনগুলোর কাছে পরীক্ষায় ভালো ফল, বিয়ে বা ব্যবসায়ে সাফল্য প্রার্থনা করি?  জবাব: না, প্রশ্নই ওঠেনা।

(৯) আমরা কি শহীদ মিনারে, বিজয় স্তম্ভে বা স্মৃতিসৌধে রুকু সেজদা করি?  জবাব: না, করিনা।

তাহলে?  উনাদের সংজ্ঞা মোতাবেকই ওই দিনগুলো পালনে শির্কের লেশমাত্র নেই।

উনাদের বলার অধিকার আছে, উনারা বলতে থাকুন। দিনগুলো উদযাপনের অধিকার জাতির আছে, জাতি উদযাপন করে যাবে। বছর ধরে উনারা ‘গান হারাম’ "ভাস্কর্য্য হারাম', "টিভি হারাম', "ছবি তোলা হারাম" ইত্যাদি হাজারো কিছু হারাম বলে চিৎকার করেছেন, জাতি মানেনি এমনকি মুসলিম বিশ্বও মানেনি। সংগীত এখন বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে, হাজারো মেধার সৃষ্টিধর্মী বিশাল কর্মকাণ্ড চলছে, হাজারো লোকের সংসার চলছে, চলবে। প্রায় নব্বই বছর আগে এই বাংলায় ‘বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলন’ সংগঠন থেকে ইসলামের নামে অনাচারের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন করেছিলেন ‘শিখাগোষ্ঠী’ যাতে জড়িত ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ কাজী আনোয়ারুল কাদীর থেকে বয়োকনিষ্ঠ আবুল ফজল ও কাজী মোতাহার হোসেন পর্যন্ত – যার প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হোসেন ও কাজী আবদুল ওদুদ।  তাঁরা জাতিকে সতর্ক করেছিলেন ‘আদেশের নিগ্রহ’, ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’ ইত্যাদি নিবন্ধে। বলেছিলেন, জাতিকে ইসলামের নামে এতো এতো শেকলে শৃঙ্খলিত করা হচ্ছে যার পরিনাম হবে ভয়াবহ – ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ – আবুল হোসেন’ প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা।

চিন্তার সংঘাত সামাজিক অগ্রগতির চাবিকাঠি।  কিন্তু সেই সংঘাতে কেউ কেউ কতল করা পর্য্ন্ত নেমে এসেছে। ভলটেয়ার বলেছেন – “তোমার বক্তব্যের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষায় আমি জীবন দেব। আজ কলুষিত রাজনীতির ছত্রছায়ায় বিভিন্ন আদেশের নিগ্রহ ও নিষেধের বিড়ম্বনায় ছেয়ে গেছে দেশ, জাতি হয়েছে বিভ্রান্ত। কিন্তু ইতিহাসের অটল অমোঘ ধারা বয়ে চলেছে ধীরে, অলক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়তি। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড প্রশ্নাতীত অভ্রভেদী, ইতিহাসে বারবার প্রমাণ হয়েছে সেটা। তাকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা যেতে পারে কিন্তু আখেরে তাকে পরাজিত করার সাধ্য কারো নেই।

দেশের নাম বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান নয়।

এবারে কোরান মোতাবেক জন্মদিন ও বড়দিন (খ্রিষ্টমাস) পালন এবং খ্রিস্টানদেরকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানানো:-

সুরা মরিয়ম আয়াত ৩৩ :- "(হযরত ইসা আঃ বলছেন) "আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব"।

সুরা মরিয়ম আয়াত ১৫:-
"তাঁর (হযরত ইয়াহিয়া আঃ) প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর জন্মদিনে, এবং মৃত্যুদিনে ও জীবিত পুনরুত্থান দিনে।

সুতরাং আমরা অবশ্যই কোরান মোতাবেক জন্মদিন সহ যে কোনো দিবস উদযাপন করতে পারি, খ্ৰীষ্টানদেরকে খ্রিস্টমাসের শুভেচ্ছা জানাতে পারি।

২৫শে মার্চ ২০০৮

 

নববর্ষ বরণ - মৌলবাদের চক্ষুশূল কেন ? 

জীবনে দুর্ঘটনা বলে কিছু নেই। যা ঘটেছে তা এজন্যই ঘটেছে যে কার্য্য-কারণ সমীকরণ মোতাবেক সেটা ছাড়া আর কিছুই ঘটতে পারতোনা। কয়েক দশক আগে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশগুলো যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে, যেমন জিন্নাহ'র পাকিস্তান, নাসেরের মিশর, ড. মোসাদ্দেকের ইরান, সুকর্ণ'র ইন্দোনেশিয়া, পরে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের বাংলাদেশ। তুরস্ক তো ১০০ বছর আগে থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু এখন ওই প্রত্যেকটি দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী শারীয়াপন্থীরা শক্তিশালী। এ বিবর্তনের কারণগুলো বাংলাদেশেও বিদ্যমান, বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও সেদিকে এগিয়েছে। ওয়াশিংটনের "রিজলভ নেটওয়ার্ক" ২০১৭ সালে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড শরিয়াহ ইন বাংলাদেশ: সার্ভেইং সাপোর্ট’ শিরোনামে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৫০% পুরুষ ও ৫০% নারীর ওপর জরিপ করেছে যাদের ৭৫% গ্রামবাসী। এই প্রবন্ধটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিকস অ্যান্ড গভর্নমেন্টের অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী সৈয়দা সেলিনা আজিজ। সেখানে দেখা যায় ৮০% এর বেশি উত্তরদাতা মনে করেন, শারিয়া আইন মৌলিক সেবা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সহায়ক এবং শারিয়া আইন থাকলে দেশে দুর্নীতি কমবে” – “গণতন্ত্র ও শরিয়াহ আইন: জনমত দুটিরই পক্ষে" - প্রথম আলো ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭। এর ৫ বছর পর ২০২২ সালের রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে জনমত শারিয়া আইন তথা ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে ঝুঁকেছেন - দৈনিক প্রথম আলো ২৬ জানুয়ারি, ২০২২।

অর্থাৎ একাত্তরে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের জঠরে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এখন প্রবল ঝুঁকির মধ্যে আছে। দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সহ এর অনেক কারণের একটা হল দেশে অগণিত আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ ও সংঘাত থাকলেও তাঁরা একাগ্রভাবে পাকিস্তান আমল থেকেই জনগণকে ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থনে টেনেছেন। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের "ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা"র যুদ্ধে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনেকগুলো ফ্রন্টের একটা।      

আরো অজস্র শব্দের মতো শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র নামগুলো এসেছে হিন্দু মাইথলজি (পৌরাণিক কাহিনী) থেকে কিন্তু এখন ওগুলো বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত এবং ধর্মনিরপেক্ষ। "মঙ্গল" নিয়ে আপত্তি হলে বাকী শনি রবি বুধ বৃহস্পতি শুক্র-কে কি করবেন তাঁরা? মঙ্গলবারের নাম দেবেন "ভুট্টুবার"? মঙ্গলগ্রহের নাম দেবেন "টুটটুগ্রহ"? তাঁরা সন্তানের মঙ্গল কামনা করবেন না? তাঁদের দাবী "মঙ্গল" শব্দটা এবং শোভাযাত্রার কিছু মুখোশ হিন্দুয়ানী, কাজেই ওগুলোর ব্যবহার আমাদেরকে “ইসলাম-ভ্রষ্ট করার সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র”। এগুলো তাঁরা কবে কাদের কোন গবেষণায় পেয়েছেন? মুখোশের কারণে ক’জন মুসলিম ইসলাম-ভ্রষ্ট হয়েছে নামধাম সহ তার তালিকা দিন।  দিতে না পারলে প্রমান হবে তাঁরা আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনা দরকার।

আসলে এগুলো সব বাহানা, তাঁদের আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। মুখোশ-বিরোধী পক্ষের কাউকে কখনো একুশের বা নববর্ষের মিছিলে দেখেছেন? দেখেন নি। শোভাযাত্রার আয়োজকেরা আগামী বছর শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার করবেন না ঘোষণা দিয়ে দেখতে পারেন, মুখোশ-বিহীন শোভাযাত্রায় তাঁরা যোগ দেন কিনা। এতে প্রমান হয়ে যাবে আসলে তাঁদের গাত্রদাহ মুখোশ নিয়ে নাকি ওটা আসলে বাহানা যা তাঁদের করতে হয় অন্য উদ্দেশ্যে। কি সেই উদ্দেশ্য?

১।"ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের শাহাদা পড়া সম্পূর্ন হইবে না" - (অর্থাৎ উনাদের মুসলমানিত্ব অসম্পূর্ন থাকবে) - ‘উইটনেস টু ম্যানকাইণ্ড’পৃষ্ঠা ৩২, মওলানা মওদুদি। মুখোশ-বিরোধীরা মওদুদীপন্থী হন বা না হন, ইসলামী রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেপথে যে কোনো বাধাকে যে কোনো উপায়ে পরাজিত করা তাঁদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। "মারি অরি পারি যে কৌশলে" - মেঘনাদ বধ।  

২। সেপথে তাঁদের সর্বপ্রধান বাধা বাংলাদেশের জন্মের উৎস আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, যার শেকড় বাহান্ন'র ভাষা আন্দোলন। সেই বাধাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইসলামকে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। ব্রিটিশের পলিসি ছিল - "গিভ দি ডগ এ ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাং হিম" (একটা বদনাম রটিয়ে কুত্তাটাকে ফাঁসি দিয়ে দাও)।  একুশকে বদনাম করার জন্য গোলাম আজম বলেছিলেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল "মারাত্মক ভুল" (দৈনিক আজাদ, ২০ জুন ১৯৭০)।  দেশে চিৎকার শোনা যায় একুশের ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া, ফুল দেয়া এগুলো নাকি শির্ক।  আঘাত হানা হল আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের ওপরেও। লক্ষ লক্ষ মা-বোনের লঙ্ঘিত সম্ভ্রম এবং লক্ষ লক্ষ নিরপরাধের আর্তনাদ মেশানো ওই রক্তস্নাত দিনগুলো উদযাপন করা যাবেনা, করলে নাকি জাহান্নামে যেতে হবে। কারণ জন্মদিন সহ যে কোনো "দিন" পালন করা নাকি "বেদাত", ইসলামে নুতন কিছু যোগ করা। দাবীটা কেন মতলবী তা ২১শে, ২৬শে, ১৬ই ও জন্মদিন উদযাপন কি শির্ক?” নিবন্ধে বিস্তারিত আছে। 

৩। কেতাব লিখেও আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে "ইসলাম বিরোধী" প্রমানের ষড়যন্ত্র হয়েছে। যেমন –

(ক) "ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক জাহেলীয়াতের পরিণতি", লেখক ভারতের আলেম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী, অনুবাদ আবদুল মান্নান তালিব, প্রকাশক সিন্দাবাদ প্রকাশনী, ২ কাজী আলাউদ্দীন রোড, ঢাকা। এ বইতে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন একাত্তরে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছি, সেটা নাকি আমাদের "ভাষা-পূজা" ইসলামের তৌহিদকে পরাজিত করেছে - পৃষ্ঠা ৯। আলেম বটে!    

(খ) মওদুদীর লিখেছেন ইসলামী জাতীয়তাবাদ ছাড়া বাকী সব জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল প্রধানত: বংশ, স্বদেশ, ভাষা, বর্ণ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও শাসন ব্যবস্থার ঐক্য। এই ভিত্তিগুলো নাকি - "গোটা মনুষ্যজাতির পক্ষে এক কঠিন ও মারাত্মক বিপদের উৎস হয়ে রয়েছে, তাও কেউ অস্বীকার করতে পারে না" - "ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ" - মওলানা মওদুদী, পৃষ্ঠা ১০ ও ১১।  (মওদুদীকে বলতে চাই, ‘অবশ্যই অস্বীকার করতে পারি এবং করছি, মওলানা!’)                     

অর্থাৎ আমাদের বাংলা ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদটা "গোটা মনুষ্যজাতির পক্ষে কঠিন ও মারাত্মক বিপদের উৎস", তাই সেটাকে ধ্বংস করে "গোটা মনুষ্যজাতি"কে এই "কঠিন ও মারাত্মক বিপদ" থেকে রক্ষা করাটা উনাদের “ঈমানী দ্বায়িত্ব”।  আমি বুঝতে পারিনা বাংলাদেশের জন্মদর্শনকে হত্যাকামী এই প্রচণ্ড রাষ্ট্রবিরোধী বইটা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইটে কেন? 


৪। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত উনাদের মুসলমানিত্ব অসম্পূর্ন, তাই এ উদ্দেশ্যে তাঁরা যা কিছু দরকার তাই করবেন। এজন্য তাঁরা মিথ্যা বলাকেও শুধু উৎসাহিতই নয় বরং বাধ্যতামূলক করেছেন। কাজেই তাঁদের মন-মগজে কি ঘুরছে তা তাঁদের মুখের কথা থেকে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। শারিয়া আইনে আছে:- "উদ্দেশ্য বাধ্যতামূলক হইলে সে উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা বাধ্যতামূলক" - আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা সত্যায়িত শারিয়া কেতাব ‘উমদাত আল সালিক’ আইন নং r.8.2। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো "তাকিয়া" পদ্ধতিতেও তিন ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাকে ইসলামের নামে বৈধ করা আছে। দুনিয়ায় বোধহয় একমাত্র তাঁদের “ধর্ম”টাই মিথ্যাকে উৎসাহিত ও বাধ্যতামূলক করেছে। শোভাযাত্রার বিরোধীতা উচ্চারিত হয় তাঁদের এই কোরান-বিরোধী কণ্ঠেই, - কারণ কোরানের নির্দেশ - "তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না”- সূরা বাকারা ৪২।   

তাঁরা জাতিকে কি মনে করেন? জাতির ইসলামী ঈমান এতই ঠুনকো যে কয়েকটা মুখোশ দেখেই তা ভেঙে যাবে? এই উদ্ভট কথাটা যুক্তি নয়, কুযুক্তি। গণেশের বাহন ইঁদুর এবং সাপ ইঁদুর খায়, তাই “সাপ হিন্দু বিরোধী" বলার মতোই কুযুক্তি। তাঁরা অবশ্যই জানেন যে ওই প্রাণীদের অস্তিত্ব হিন্দু ধর্মের বাইরেও ব্যাপক। দুনিয়ার সব রাজহাঁস সরস্বতীর বাহন নয়, সব ময়ূর কার্তিকের বাহন নয়, সব প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন নয়। ওগুলোকে টেনে হিঁচড়ে হিন্দুধর্মের সাথে জুড়ে দেয়াটা প্রমান করে, - ইবলিশকে যে অধিকার দেয়া হয়েছিল মানুষকে পথভ্রষ্ট করার তাতে সে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে (সূরা বনি ইসরাইল আয়াত ৬৪)। আরো প্রমান করে উম্মতের জন্য নবীজীর (স) "সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ" কি ছিল এবং কেন ছিল:- "উম্মতের জন্য আমার সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারী আলেমদের লইয়া"- সুনান ইবনে মাজাহ ৫ম খন্ড হাদিস ৩৯৫২।

এই পথভ্রষ্টকারী আলেমরা আমাদের সমাজেই লুকিয়ে আছে তা তাঁরাও জানেন বৈকি:-    

“রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন যে, শেষ যামানায় (কিছু সংখ্যক) মূর্খ ইবাদাতকারী এবং ফাসেক আলেম বের হবে। এ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দেদ আলফে সানী মাকতুবাত গ্রন্থে লিখেছেন যে, জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি একবার অভিশপ্ত ইবলিশকে দেখতে পায় যে, সে একেবারে খোশ মেজাজে ও বেকার বসে আছে। ওই বুযুর্গ ব্যক্তি ইবলিশকে তার এ হেন বেকার বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রত্যুত্তরে সে বলে যে, বর্তমান সময়ের আলেম সমাজ আমাদের কাজ সমাধা করছে, জনগণকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তারাই যথেষ্ট” – “আলেম-ওলামাদের সম্মান ও মর্যাদা (অংশ বিশেষ) - এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান, উপসম্পাদকীয় দৈনিক সংগ্রাম ০৩ জুন ২০১৩।  

এটাই তো স্বাভাবিক যে এদেশে জন্মে যাঁরা আমাদের নৃতাত্বিক শেকড়কে অস্বীকার করেন তাঁরা আমাদের ভাষা ভিত্তিক জাতীয়বাদকে আঘাত করবেন! এটাই তো স্বাভাবিক যে যারা তাঁদেরকে "মিসকিন" বলে অপমান করে তাদেরই পরিচয়ে তাঁরা গর্বিত হবার অপচেষ্টা করবেন! প্রমান এখানে :-

ক. "বাংলাদেশী জনগণ মূলত: সেমিটিক দ্রাবিড়। সেমেটিকদের আদিনিবাস আরব ভূখণ্ড থেকেই তারা এসেছে। সুতরাং এই মানবগোষ্ঠী যদি নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের মতেই দ্রাবিড় হয়, আর দ্রাবিড় যদি আরব হয় তদুপরি আরব যদি সেমেতিক হয়তবে এ অঞ্চলের জনগণ যে সেমেটিক আরবগোষ্ঠীরই অধ:স্তন পুরুষ তাতে আর সন্দেহ কি? ....... খোদ বাংলা শব্দটি আরবী শব্দমালার পরিবর্তিত রূপ”- দৈনিক ইনকিলাব ১২ নভেম্বর ২০০৭ - সম্পাদকীয় "ইসলামী দল নিষিদ্ধের বায়না ও যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গ"-এর অংশ।

খ.“নুহ (আ:)- এর এক পুত্র হ্যাম এশিয়া অঞ্চলে বংশবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। হামের পুত্র হিন্দ-এর নামানুসারে "হিন্দুস্তান", সিন্দ-এর নামানুসারে "সিন্দুস্থান" বা "সিন্ধু" এবং হিন্দ-এর পুত্র বঙ্গ-এর নামানুসারে বঙ্গদেশ।.... তাহলে বলতে আর বাধা নেই নুহ (আ:)-এর পুত্র বা নাতির নামানুসারে বঙ্গ বা বাংলাদেশ”- ইনকিলাব ২৫শে জুন ২০০৮ - "ফিচার" পৃষ্ঠায় নিবন্ধ - "বাংলার ইতিহাসের পটভুমি"-র অংশ বিশেষ।

নৃতাত্ত্বিকেরা বিস্তর গবেষণায় বিভিন্ন কথা বলেছেন যেমন প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোকরাই বাংলার প্রকৃত আদিবাসী ইত্যাদি, সৈয়দ শামসুল হক তাঁর 'আমার পরিচয়' কবিতায় আমাদের নৃতাত্ত্বির রূপরেখা তুলে ধরেছেন, ইত্যাদি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস থেকে নৃতত্ত্ব তুলে আনা? অভিনব বটে!

সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়। এক সময় নববর্ষে হালখাতা ইত্যাদি ছিল কিন্তু মিছিল ছিলনা। পরে মিছিল এল, নামহীন মিছিল পরে “আনন্দ-শোভাযাত্রা” হয়ে পরে “মঙ্গল-শোভাযাত্রা” হয়েছে, মুখোশহীন শোভাযাত্রায় মুখোশ এসেছে, অনেক কিছু হয়তো আবারও বদলাবে। এ নিয়ে এতো হৈ হৈ করে "ইসলাম গেল গেল" এই উদ্বাহু ধেড়েনৃত্য করার কি আছে?

আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ-বিরোধী ও কোরান-বিরোধী এই অপশক্তির কি করা উচিত তাহলে? তাঁরা কবি লুৎফর রহমান রিটন-এর বন্ধুসুলভ নিরীহ পরামর্শটা ভেবে দেখতে পারেন।                                  

সমস্যা যদি হয় বৈশাখী মঙ্গলে-- 

লুৎফর রহমান রিটন

সমস্যা যদি হয় বৈশাখী মঙ্গলে,

তুমি চলে যেতে পারো প্রিয় কোনো জঙ্গলে।

তুমি চলে যেতে পারো দূর মরু সাহারায়,

বাঙালি রইলো তার সংস্কৃতি পাহারায়।

সংস্কৃতিসনে তুমি মিশিও না ধর্ম, 

মেশাতে চাইলে সেটা হবে অপকর্ম।

ধর্ম ও সংস্কৃতি চিরকালই ভিন্ন, 

সভ্যতা-ইতিহাসে তারই দ্যুতি-চিহ্ন।

(না মানুক অন্ধরা না জানুক উকিলে, 

বসন্ত আসিবেই ডাকিবেই কুকিলে...)

বাংলা ও বাঙালির আনন্দ হর্ষ,

বৈশাখ সমাগত শুভ নববর্ষ... (১১ এপ্রিল ২০২৩)

২০ এপ্রিল ২০২৩

 

 

 

 

 

দেশে আরেকটা আইন প্রণয়নকারী ও শাস্তি প্রদানকারী সংসদ ?  

০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ - ভাতের হাঁড়ির মতো টগবগ করে ফুটছে বাংলাদেশ। নির্বাচন, গণহামলা-গণমামলা-গণগ্রেপ্তার, অজস্র টকশোতে বিভিন্ন দিকপালের চিৎকার, আমেরিকার স্যাংশন ও ভিসা-নীতি, বিদেশি কুতুবদের দৌড়ঝাঁপ - ড ইউনুসকে নিয়ে দড়ি টানাটানি - সকাল বিকাল উথাল-পাথাল ঘটনার ঘনঘটায় জাতির মন-মগজ অস্থির। ওদিকে চুপিসারে সবার অলক্ষ্যে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, দেশের ভেতরে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট ছোট্ট আংশিক স্বায়ত্তশাসিত আফগানিস্তান।

সাম্প্রতিক প্রমান ১:-   

হাজীপুর মসজিদের মাইক থেকে এই দুইটি "আইন" প্রচার করা হয়েছে, সার্চ –

“ধন্যবাদ জানাই এই মসজিদ কমিটিদের কে এমন সাহসী উদ্যোগ নেওয়ার জন্য!! । প্রত্যেক সমাজের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসা উচিৎ।“

লিংকটি  ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে ২২ শে আগস্ট ২০২৩, উদ্ধৃতি:-

"সম্মানিত এলাকাবাসী, সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে বৃহত্তর হাজিপুর পঞ্চায়েত কমিটির উদ্যোগে ৩ পঞ্চায়েত কমিটি ও মসজিদ কমিটির সকল সদস্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুইটি বিশেষ আইন জারি করা হয়েছে।  

এক নম্বর - যে কোন অনুষ্ঠানে গান-বাজনা ও ডিজে পার্টি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এই আইন কোন পরিবার অমান্য করলে পঞ্চায়েত থেকে সেই পরিবারকে বহিষ্কার করা হবে। উক্ত আইন অমান্যকারী ব্যক্তি যদি সমাজের কোন কমিটির দায়িত্বে থাকে তাকে তার পদ থেকে বহিষ্কার করা হবে। যে বিয়েতে গান-বাজনা ও ডিজে পার্টি হবে সেই বিয়েতে বা অনুষ্ঠানে তিন সমাজের কোন ইমাম খতিব ও স্থানীয় ইমাম কেউ ডিল করাবে না  এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করা হলো। 

দুই নম্বর - এলাকায় মাদক চালান ও মাদক সেবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কোন ব্যক্তি যদি মাদক সংক্রান্ত কোন বিষয়ে জড়িত আছে বলে প্রমাণিত হয় তাকে ৩ পঞ্চায়েত কমিটির ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হবে।      

উক্ত আইন হাজিপুর পঞ্চায়েত কমিটির পক্ষ থেকে এই আইন এলাকার জন্য এবং এলাকার সকল মানুষের জন্য জারি থাকবে ……..মেনে চলার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো"

উদ্ধৃতি শেষ।

বিশ্লেষণ:-

(১) যে কোনো দেশে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষমতা সংসদ ছাড়া আর কারো নেই। অথচ এই লোকগুলো "আইন" শুধুমাত্র প্রণয়নই করেনি বরং জনগণের ওপর প্রয়োগের স্পর্ধাও দেখিয়েছে। এটা সুস্পষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অনতিবিলম্বে এই রাষ্ট্রদ্রোহীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে এই বিষবৃক্ষ উৎসাহিত হয়ে দ্রুত বাড়বে ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। 

(২) এই প্রচারণার মধ্যে ধূর্তামি আছে। এতে জনগণকে আইন হাতে তুলে নেবার উস্কানী আছে যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তাছাড়া এতে সঙ্গীত ও মাদক একাকার করে দেয়া হয়েছে যেখানে মাদক সর্বসম্মত সামাজিক ব্যাধি কিন্তু সংগীত একটি ইখতিলাফী মাসালা। ওই লোকগুলো জানেই না (ক) উসমানিয়া খেলাফতের রাজদরবারে সংগীতের প্রচন্ড চর্চার কথা, জানে না খলীফা সুলতান তৃতীয় সেলিম সহ কয়েকজন সুলতান নিজেরাই শিল্পী ও সুরকার ছিলেন এমনকি নবী দাউদও (আ) সংগীতজ্ঞ ছিলেন। (খ) তারা এটাও জানেনা আল আজহার ইউনিভার্সিটির প্রয়াত গ্র্যান্ড মুফতি শেখ জাদ আল হক ও “ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলার্স” এর চেয়ারম্যান "গ্লোবাল মুফতি" ড. কারযাভীর মত অনেক বিশ্ব-আলেমরা বলেছেন শির্ক ও অশ্লীলতা না থাকলে ইসলামে সঙ্গীত অবৈধ হবার প্রশ্নই ওঠে না। ওই লোকগুলো এটাও জানেনা আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেছেন - "গান হারাম হওয়ার পর্য্যায়ে কোন একটি হাদিসও সহি নয়", ইবনে হাজম বলেছেন - "এই পর্যায়ের সব বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত", এবং কোরানের দুটো আয়াতের মতলবী অপব্যাখ্যা মাত্র। ইন্টারনেটে "বিশ্ব-আলেমদের মতে ইসলামে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র বৈধ" সার্চ করলে আমার ওয়েবসাইটের ওই নিবন্ধে বিস্তারিত দলিল প্রমান পাবেন। ড. কারযাভী’র "ইসলামে হালাল-হারামের বিধান" বইটি পাওয়া যাবে "জামায়াত  অনলাইন লাইব্রেরি" ও "শিবির অনলাইন লাইব্রেরি"-তে, দেখুন এর ৪০৬ - ৪১১ পৃষ্ঠা।

(৩) বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, অগণিত কমেন্টে সবাই হর্ষোৎফুল্লভাবে সারাদেশে এই আবহ কামনা করেছেন। অনেকেই লিখেছেন আগে থেকেই তাঁদের গ্রামে সঙ্গীত নিষিদ্ধ। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শারিয়া-শাসিত ছোট্ট ছোট্ট আফগানিস্তান তৈরি হয়েছে, এটা অবধারিতভাবে আরো বাড়বে।

সাম্প্রতিক প্রমান ২:-

সার্চ - "মানিকগঞ্জ যে গ্রামে কখনো গান বাজে না একমাত্র ওয়াজ চলে গোবিন্দর গ্রাম

       মানিকগঞ্জ"। 

মানিকগঞ্জের গোবিন্দল গ্রামের বেসরকারি নাম এখন মুসলিম নগর। ভিডিওতে গ্রামের মুরুব্বি বলেছেন গ্রামে শতভাগ মুসলিম, সবাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, সব নারী বোরখা পড়েন, যৌতুক নিষিদ্ধ, সবাই কোরান পড়তে পারে, গ্রামে ৩৫টি ছোট ছোট মসজিদ। 

লক্ষ্যণীয়, কমেন্টে অনেকেই লিখেছেন আগে থেকেই তাঁদের গ্রামে সঙ্গীত নিষিদ্ধ। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইতোমধ্যেই সবার অলক্ষ্যে শারিয়া-শাসিত ছোট্ট ছোট্ট আফগানিস্তান তৈরি হয়েছে, এটা আরো বাড়বে। অগণিত কমেন্টে সবাই হর্ষোৎফুল্লভাবে সারাদেশে এই আবহ কামনা করেছেন।

বিশ্লেষণ:-  

ওই গ্রামবাসী বা মুরুব্বীরা যদিও দৃশ্যতঃ কোনো আইন ভাঙেন নি কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণীই ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা যা জাতির পিতা বহুবার তাঁর ভাষণে বলেছেন, যেমন ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কলকাতা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের ভাষণ:- "আমি আপনাদের এই আশ্বাস দেবার পারি যে বাংলাদেশ চারটা স্তম্ভের ওপর চলবে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র"। সেই একাত্তরের ২৬শে মার্চেই আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন প্রচার করেছিল "Sheik Mujibur Rahman declares region Independent Republic" ABC, March 26, 1971- অথচ অসৎ কিছু লোক এগুলোকে অস্বীকার করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করার অপচেষ্টা করে। 

বাংলাদেশের এই ইসলামাইজেশন হবারই ছিল। জীবনে দুর্ঘটনা বলে কিছু নেই। যা ঘটে তা এজন্যই ঘটে যে, কার্য্যকারণের সমীকরণে অন্য কিছু ঘটা সম্ভবই ছিলনা। ইতিহাসের শিক্ষা কি? গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম-প্রধান দেশগুলো, মিশরের নাসের, পাকিস্তানের জিন্নাহ, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ এবং তাঁদের সাথে স্বাধীন ইরানের ড. মোসাদ্দেক, তুরস্কের আদনান মেন্দারেস ও পরে বাংলাদেশের শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন সবাই সেক্যুলার দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ওই প্রতিটি দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অবক্ষয় ও শারিয়া-পন্থীদের প্রবল উত্থান ঘটেছে। এই টানাপোড়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করে "ইসলামী দেশ” প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।

আমরা কোন পথ ধরে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি? গত দশকগুলোতে দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, বিচারহীনতা, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ইত্যাদিকে শারিয়া-পন্থীরা সফলতার সাথে আমাদের অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় আবেগপ্রবণ জাতির কাছে "গণতন্ত্রের দুর্বলতা" হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তার বেহেশতী বিকল্প হিসেবে "শারিয়া আইন" ও "ইসলামী রাষ্ট্র" জনপ্রিয় করে তুলেছে। 'আল্লাহর আইন সবকিছু ঠিক করে দেবে'– এই বিশ্বাসে অগণিত নাগরিক কোনো মওলানার ফতোয়া ছাড়াই নিজে থেকে "ইসলামী আইন" প্রয়োগ শুরু করেছেন। পিউ ও অন্যান্য জরীপে সেটা স্পষ্ট। লক্ষ্যণীয়, এঁদের অনেকেই কিন্তু বিশেষ কোনো ইসলামি দল করেন না। কিছু উদাহরণ:- 

  • রাস্তাঘাটে অপরিচিত নারীদেরকে "ইসলামী পোশাক' সম্বন্ধে নসিহত দেয়া শুরু হয়েছে।
  • আগে রমজানে চাদর-ঘেরা হোটেলগুলোতে সবাই খেত, এখন রমজানে কাউকে খেতে দেখলে অনেকে হিংস্র হয়ে ওঠে। যেমন, রমজানে দূরপাল্লার বাসে গরমের দুপুরে এক যাত্রী পানি খেয়েছে বলে ড্রাইভার বাস থামিয়ে তাকে অপমান করে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
  • ঢাকায় কন্যার আকিকায় পিতা তাঁর নানীকে গ্রাম থেকে আনার উদ্যোগ নিলে গ্রামবাসী তা হতে দেয়নি কারণ নানা সম্প্রতি মারা গেছেন, শারিয়া মোতাবেক নানীকে চার মাস ঘরে থাকতে হবে।
  • নববর্ষের উৎসবে এক কিশোর এক কিশোরীর সঙ্গে 'হ্যান্ডশেক' করেছে বলে গ্রামবাসী তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে।
  • কয়েক বছর শয্যাগত থাকার পর একজনের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ দাবি করেছে কাফফারা না দিলে তাঁর জানাজা হবে না কারণ তিনি এত বছর নামাজ পড়েননি।
  • এক কলেজের শিক্ষক ছাত্রীদের বোরখা পড়তে বাধ্য করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও হাইকোর্টকে এগিয়ে আসতে হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর নির্দেশ দিয়েছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। ('জনকণ্ঠ', ২৬ আগস্ট ২০১২)।
  • রংপুরে এক এসআই ১৯ জন মেয়েকে থানায় ধরে নিয়ে আসে বোরকা না পরে পার্কে গিয়েছিল বলে। সেখানেও কোর্ট এগিয়ে এসে সেই পুলিশকে তলব করে এবং এ ধরনের অপকর্ম নিষিদ্ধ করে। ('জনকণ্ঠ', ৩ মার্চ ২০১০)।
  • বাউলদের চুল কেটে দেয়া, সংগীতশিল্পীদেরকে বাড়ীভাড়া না দেয়া, দোকানে "দাঁড়ি রাখলে ডিসকাউন্ট" ইত্যাদি বিচিত্র রকমের (আইন-বিরোধী ও আইননানুগ) অজস্র ঘটনা শারিয়া আইনের প্রতি জনগণের ক্রমবর্ধমান অন্ধ সমর্থন প্রমান করে।

এবারে দেখা যাক কী পদ্ধতিতে সুধীরে ও সুদৃঢ়ে গণমানসে এই অকল্পনীয় বিবর্তনটা ঘটল।

(১) দেশে অগণিত মওলানাদের প্রত্যেকে প্রচণ্ড গণতন্ত্র-বিরোধী ও শারিয়া-সমর্থক। তাঁরা জনগণের ওপর সুগভীর প্রভাব রাখেন, তাঁরা জাতিকে ক্রমাগত "ইসলামী রাষ্ট্র-এর সমর্থক করে তুলছেন।

(২) তাঁরা দেশের অগণিত মাদ্রাসার অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গণতন্ত্র-বিরোধী করে গড়ে তোলেন। এগুলো থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শারিয়া-সমর্থক সমাজে যোগ হয়, সর্বত্র তাদের প্রভাব পড়ে। মওলানারা বহু লক্ষ যুদ্ধংদেহী মাদ্রাসা-তরুণকে রাস্তায় নামানোর ষ্ট্রীট পাওয়ারের অধিকারী। এ বাহিনী আগামীতে অনেক বাড়বে এবং সর্বত্র এর চাপ অনুভুত হবে।    

(৩) শারিয়া-সমর্থকদের হাতে আছে:- (ক) মসজিদ, ওয়াজ মাহফিল, অসংখ্য সংগঠন ও দলীয় পত্রিকা থেকে জনতাকে প্রভাবিত করার সুযোগ যা তাঁরা পুরোটাই নিয়েছেন এবং নেবেন, (খ) অসংখ্য কর্মতৎপর ও সংগঠন যেগুলো জাতির চোখের সামনে শুধুমাত্র তাদেরই ইসলামি ব্যাখ্যা ধরে রেখেছে, (গ) এবং সেগুলোতে ক্রমাগত শারিয়া প্রচার হচ্ছে, (ঘ) দুনিয়াজুড়ে 'ফেইথ-কাজিন' সংগঠগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক।  (ঘ) দেশে প্রতিটি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে ইসলামি অংশ থাকে যার প্রত্যেকটিই শারিয়াপন্থী। জনগণের ওপর এসবের প্রভাব সুস্পষ্ট। 

(৪) শারিয়াপন্থীদের আরেকটা বিরাট সাফল্য হল তাঁরা "ইসলাম বিরোধী" ট্যাগের ট্যাবু দিয়ে মিডিয়া সহ সারা জাতিকে ভয় পাওয়াতে সক্ষম হয়েছেন। বেশিরভাগ পত্রিকা তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু ছাপতে ভয় পায়।

(৫) পক্ষান্তরে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার বিপক্ষে বিশ্বজোড়া বিখ্যাত আলেমদের রচিত বিপুল গবেষণা জাতির কাছে পৌঁছায়নি।  সেগুলোতে রাজনৈতিক ইসলামের ভিত্তিহীনতা, কোরান-রসূল (স) বিরোধীতা, ও নারী বিরোধীতার অজস্র প্রমান আছে। সুফি ইসলামি বা ইসলামের অরাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের বইগুলো লেখা ও প্রচারের সংগঠন কম।   

(৬) দাবি এসেছে ন্যাশনাল ফতোয়া বোর্ড গঠনের। 

(৭) বায়তুল মোকাররমের খতিবকে প্রধান বিচারপতির মর্যাদা দিতে হবে এ দাবি আগে থেকেই ছিল।

(৮) বর্তমানে ফেসবুক ও ইউটিউবে শারীয়াপন্থীদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। সেখানে ভিন্নমতের কাউকে পেলে অপমান ও গালাগালির ঝড় বইয়ে দেয়া হয়।   

(৯) দেশে বোরখা বিপ্লবের সাথে ইসলামী বইয়েরও বিপ্লব ঘটে গেছে। অজস্র ইসলামী বই প্রকাশিত হয়, ইসলামী বই মেলাও হয়।

(১০) বাংলার যাত্রাপালার জায়গা দখল করেছে ওয়াজ মাহফিল। এখন ওয়াজের জন্য সরকারের অনুমতি পাওয়া সহজ কিন্তু যাত্রাপালার অনুমতি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের গণমানস গণতন্ত্র বিরোধী হয়ে উঠেছে, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা এখন সুস্পষ্ট হুমকির মুখে। এর মূল কারণ আমাদের পংকিল রাজনীতি। আমরা বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে নিজেদের সান্ত্বনা দিচ্ছি এই বলে যে সবকিছু ঠিকই আছে কিংবা কোনো এক মন্ত্রবলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।  

অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিয়তি - যুগের ওপার হতে অবিশ্বাসের চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ………….

এমন তো হবার কথা ছিলোনা !

০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ 

একাত্তরেই ছিল

হাসান মাহমুদ

আজকে তোদের যা কিছু চাই, একাত্তরেই ছিল

“বাংলাদেশী” নামের বড়াই একাত্তরেই ছিল।.

ঐক্যবোধের শক্ত জাতি, মুল্যবোধের ভক্ত জাতি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিবোধ, একাত্তরেই ছিল

ধর্মচোরার অধর্ম রোধ, একাত্তরেই ছিল।.

শিকল পরা পায়ের নাচন, শিকল ভাঙ্গার মরণ-বাঁচন

দীপ্ত ভবিষ্যতের বাণী, ক্ষিপ্ত ধরা কালনাগিনী

তৃপ্ত বিজয়-মগ্ন মানব, একাত্তরেই ছিল

ভগ্ন হত নগ্ন দানব একাত্তরেই ছিল

নষ্ট পাকি’র ভ্রষ্ট খোয়াব, বজ্রমুষ্ঠি পষ্ট জওয়াব

জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, মুক্তিপাগল প্রলয়-নৃত্য

জন্মসুখের যন্ত্রণা তোর একাত্তরেই ছিল

ক্ষণিক পাওয়া পরশপাথর একাত্তরেই ছিল।

মুক্ত দেশের সুস্মিতলোক, বিশ্ববাসীর বিস্মিত চোখ

দিব্যলোকের সেই বরাভয়, দিগ্বলয়ের মুক্ত অভয়

নিঃস্ব জাতির বিশ্ববিজয়, একাত্তরেই ছিল- 

অভ্রভেদী সেই পরিচয়, একাত্তরেই ছিল।

.

ঐ মহাকাল দিগ্বিদিকে, সেই ইতিহাস যাচ্ছে লিখে

রক্তস্নাত পবিত্র দেশ একাত্তরেই ছিল

ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশ একাত্তরেই ছিল।

.

ঐ যে জ্বলে একাত্তরের মরণজয়ী শিখা.

ঝড় তুফানে পথ দেখানোর আলোকবর্তিকা !!

একাত্তরের চিত্রকল্প

হাসান মাহমুদ

পূবের দিকে মিষ্টি মধুর এক মায়াময় দেশ ছিল,

চাষী, কামার-কুমোর জেলে, তাঁতি সেথায় বেশ ছিল।

বারো মাসের তেরো পাবণ, টাক ডুমাডুম ঢাক ছিল,

লক্ষ বনলতা সেনের চোখে নীড়ের ডাক ছিল।

কদম-কেয়া, শাপলা-শালুক, দোয়েল-কোয়েল শিস্ ছিল,

খুব গোপনে ওৎ পাতা এক কালনাগিনীর বিষ ছিল।

পাক নামে এক অশ্বডিম্ব দেশ বানাবার হাঁক ছিল,

পাকের ভেতর নাপাক কিছু শুভংকরের ফাঁক ছিল।

পশ্চিমেতে সুখের প্রাসাদ, পুর্বের ফুটপাত ছিল,

অপমানের অসম্মানের নিষ্ঠুর উৎপাত ছিল।

ওদের উদর ভরল যত, এদের ততই কম ছিল,

প্রতিবাদের উঠলে কন্ঠ অস্ত্র হাতে যম ছিল।

নষ্ট দেশের অষ্টপ্রহর যতই বৈরী হচ্ছিল,

বাংলাদেশের ভ্রূণ অলখে ততই তৈরী হচ্ছিল।

তারপর .....

একাত্তরের বিস্ফোরণে দোয়েল-কোয়েল পুড়ছিল,

আকাশ জুড়ে লক্ষ নাপাক কালশকুনী উড়ছিল।

চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ ফুলের কলি ঝরছিল,

মুনাফেকের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছিল।

লক্ষ লক্ষ ধর্ষিতা বোন, ধর্ষিতা মা কাঁদছিল,

চতুর্দিকে শুধুই রক্ত, লাশ ও আর্তনাদ ছিল।

যে দেখেনি বুঝবে না সে, এমন কেয়ামত ছিল,

কেয়ামতেই দেশের স্বাধীনতার নেয়ামত ছিল।

মানচিত্র ভাঙ্গার গড়ার প্রচণ্ড উত্তাপ ছিল,

সেই সাথে এক বজ্রকণ্ঠে আকাশ-বাতাস কাঁপছিল।

বিশাল বিপুল তূর্য্য হাতে বিশাল বিপুল শেখ ছিল,

বিষ্ময়ে সব বিশ্ববাসী মুগ্ধ চোখে দেখছিল।

জাতির মাথায় সোনার মুকুট তাজউদ্দিন তাজ ছিল,

তাজের হাতেই স্বাধীনতার প্রলয়শংখ বাজছিল।

জন্ম-সুখের উৎসবে দেশ মৃত্যুঝুঁকি নিচ্ছিল,

ষোলই ডিসেম্বর সুদুরে মিষ্টি উঁকি দিচ্ছিল।

যে দেখেনি বুঝবে না সে, এমনি কেয়ামত ছিল,

কেয়ামতের শেষে নাপাক দানব নাকে খৎ ছিল।

ওই যে জ্বলে একাত্তরের মরণজয়ী শিখা,

ঝড় তুফানে পথ দেখানোর আলোকবর্তিকা !

Print