শারিয়া আইনের উদাহরণ

শারিয়া আইনের উদাহরণ

হাসান মাহমুদ

মনে করুন বাজারে মাথাব্যথার একটা ওষুধ আছে যা বানাতে হাজারো বৈজ্ঞানিকের লক্ষ পৃষ্ঠার সুবিশাল গবেষণা লেগেছে। কিন্তু ওটা খেলে মাথাব্যথা তো সারেই না, বরং পেট খারাপ হয়ে যায়। এমন ওষুধকে কি করে মানুষ?  যে শারিয়ার পেছনে এত প্রতিষ্ঠান এত কর্মী এত অর্থ, যার জন্য শারিয়া-জঙ্গীরা এত নিরীহ মানুষ খুন করল, এত বিধবা হল, এত এতিম হল, জঙ্গীরা যদি সেই আইনগুলো জানতো তাহলে তাদের বেশীরভাগই এই হিংস্র পথ থেকে সরে আসত। তাছাড়া জাতি যদি সেই শারিয়া আইনগুলো না-ই জানে তবে এর ওপরে সিদ্ধান্ত নেবে কি করে? তাই এবারে চলুন তাহলে ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু শারিয়া কেতাব থেকে কিছু শারিয়া-আইন দেখি। কাউকে কিছুই বলতে হবে না, আইনগুলো নিজেরাই আমাদের বলে দেবে আসলেই তারা কি। নীচের উদাহরণগুলো প্রায় সবই আমাদের কাছে আছে, কেউ কোন পৃষ্ঠার ফটোকপি দেখতে চাইলে ফ্যাক্স নম্বর পাঠিয়ে দেবেন, আমরা ফ্যাক্স করে পৃষ্ঠাটা দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় পাঠিয়ে দেব।

** এ নিবন্ধে 'বি-ই-আ' হল বাংলাদেশ ইসলামি ফাউণ্ডেশন কর্তৃক বাংলায় প্রকাশিত ৩ খণ্ডের 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন'।

** কিছু মতভেদ আছে, কিন্তু মোটাদাগে 'হুদুদ অপরাধ' বলতে বোঝায় খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মানহানী, মদ্যপান ও ইসলাম ত্যাগ। পরে আলেমরা এতে ধর্ষণ যোগ করেছেন যেমন পাকিস্তানের হুদুদ অর্ডিন্যান্সের ১৯৭৯ সালের ৭, ১৯৮০ সালের ৮বি দ্বারা সংশোধিত আইনে ধর্ষণের প্রমান চারজন পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষ্য।        

এবারে 'বি-ই-আ' থেকে আইনের উদাহরণ :-

১। গণহত্যাকারী, গনধর্ষণকারী, লুন্ঠনকারী, আগুন লাগিয়ে সম্পত্তি ধ্বংসকারীরা শারিয়া আদালতে তওবা করলে তাদের কোনোই শাস্তি হবেনা - বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৩।   

২।  হুদুদ মামলায় নারী-সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় -  বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩ ও ২য় খণ্ড, ধারা ৫৭৬, হানাফি আইন হেদায়া পৃঃ ৩৫৩; শাফি আইন উমদাত আল সালিক Law #o.24.9, ক্রিমিন্যাল ল’ ইন্ ইসলাম অ্যাণ্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড পৃঃ ২৫১, মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরাণ পৃঃ ২৩৯, পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৪।

৩।  হুদুদ মামলায় নারী-বিচারক অবৈধ - বি-ই-আ ২য় খণ্ড ধারা ৫৫৪।

৪।  শাস্তি তো দূরে থাকুক রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে হুদুদ অপরাধের মামলাই করা যাবে না - বি-ই-আ ৩য় খণ্ড নং ৯১৪গ এবং হানাফি আইন হেদায়া পৃঃ ১৮৮।

৫।  কোনো অমুসলমানকে খুন করার অপরাধে কোন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না - পেনাল ল অফ ইসলাম পৃঃ ১৪৯।

৬। হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (circumstantial evidence) চলবে না (চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে - বি-ই-আ ২য় খণ্ড ধারা ৬০০। অথচ হুদুদ মামলায় চাক্ষুষ প্রমাণ প্রায়ই পাওয়া যায় না, পারিপার্শ্বিক প্রমাণেই অপরাধীর শাস্তি হয়। এ-আইন হলে বহু অপরাধীরই শাস্তি হবে না।

৭।  মদ্যপানের সাক্ষী হতে হবে শুধুমাত্র দু’জন পুরুষ মুসলমান। মেয়েদের বা পুরুষ-মেয়েদের মিলিত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় - বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৭৪।

৮।  স্বামী তার স্ত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে পুরো তালাক দিতে পারবে। কোনো কোনো কেতাবে আছে অত্যাচারের চাপে, নেশার ঘোরে বা হাসি-ঠাট্টাতে ‘তালাক’ উচ্চারণ করলেও পুরো তালাক হয়ে যাবে - হানাফি আইন ৮১ ও ৫২৩; শাফি’ই আইন #n.3.5; বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৭, ৩৪৯ ও ৩৫১।

৯। “(স্বামীর) বৌ-তালাকে সাক্ষ্য শর্ত নহে” - বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৪। এবারে খুলুন কোরাণ, সুরা ত্বালাক, আয়াত ২ - “তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিতে চাও তখন দুইজন সাক্ষী রাখিবে।” অর্থাৎ এই শারিয়া আইন কোরানকে লঙ্ঘন করেছে।

১০। কেউ আত্মীয়ের বাসা থেকে চুরি করলে চোরের কোনোই শাস্তি হবেনা -  বি-ই-আ ১ম খণ্ড ধারা ১৫৬।

১১। বোবা, গায়িকা, দাস-দাসী এবং সমাজের নীচু ব্যক্তির (মেথর, শৌচাগারের প্রহরী, ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়" - হানাফি আইন হেদায়া পৃঃ ৩৬১; শাফি’ই আইন উমদাত আল সালিক Law #o.24.3.3; পেনাল ল’ অব্ ইসলাম পৃঃ ৪৬; বিইআ ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬৩।

১২। বাবা-মা, দাদা-দাদি, বা নানা-নানিকে খুন করলে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু বাবা-মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না। (বি-ই-আ ১ম খণ্ড, ধারা ৬৫ ক ও খ; শাফি’ই আইন Law# o.1.2.4।

১৫। "যে কর্মটি করিলে অথবা না করিলে অপরাধ হয় তাহা বাস্তবে সংঘটিত হইতে হইবে" - বি আ ই ১ম খণ্ড ধারা ২খ। এর সাথে যোগ করুন - “কোন ব্যক্তির অপরাধ প্রকাশ্য আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে গ্রেপ্তার বা আটকের মাধ্যমে তাহার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাইবে না" - বি-ই-আ ৩য় খণ্ড ধারা ১২৮২।

এ ভয়াবহ আইনদুটো চালু হলে এ-আইন হলে অপরাধীদের পোয়াবারো কারণ অপরাধের প্ল্যানিংয়ের সময় অপরাধী ধরা পড়লে তাকে শাস্তি দেয়া দূরে থাকুক গ্রেপ্তারই করা যাবেনা। অনেক সময় গুপ্তচরের সাহায্যে পুলিশ চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করো বোমাবাজী-খুন-গণহত্যা এমনকি প্লেন-হাইজ্যাকের পরিকল্পনা আগে থেকেই জেনে ফেলে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। এতে জনগণের জানমালের সুরক্ষা হয়, এবং অপরাধীরা ভয় পায়।

১৬। “বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ট্রাক ও বাস অ্যাক্সিডেণ্টে নিরীহ মানুষ মরিতেছে। তাহাদের সন্তানসন্ততির করুণ দশার পূর্ণ ও যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণের দিকে পাশ্চাত্য আইন কোন দৃষ্টি দিবার পর্যাপ্ত বিধান রাখে নাই। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিপূরণের বিধান ইসলামি আইনের সর্বকালীন আধুনিকতা প্রমাণ করে” - বি-ই-আ ১ম খণ্ড পৃঃ ১০।

কথাটা ডাঁহা মিথ্যা। পাশ্চাত্য আইনে নিহতের পরিবারকে যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ-বীমার ব্যবস্থা আছে। পরিমাণটা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট, কমবেশি করার উপায় নেই। এ বীমা ছাড়া গাড়ি চালালে এমন হিংস্র আইন প্রয়োগ করা হয় যে খুব কম লোকই বীমা-ছাড়া গাড়ি চালাতে সাহস করে।

এ-রকম শত শত আইন আছে যা দিয়ে দেশ চালানো অসম্ভব। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন আমরা “ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম” বলি তখন এ-সব অন্যায় আইনের জবাব দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দেশে-বিদেশে ইসলামের নামে বোমাবাজীর তপ্ত সন্ত্রাসের নিন্দা করেন সবাই তারস্বরে। কিন্তু যে বিধিবিধান প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত হত্যা করে মানুষের বিশেষ করে মুসলিম নারীদের জীবন সেই শীতল সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলাটাও অত্যন্ত জরুরি।

**লেখকের "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" বই-এর 'শারিয়া আইনের উদাহরণ' অধ্যায় থেকে সংক্ষেপিত। Free download of the book - http://hasanmahmud.com/index.php/books/sharia-ki-bole

Print