আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আক্রান্ত হবার মূল কারণ
হাসান মাহমুদ ২০ এপ্রিল ২০২৩
২০১৭ সালে য়াশিংটনের "রিজলভ নেটওয়ার্ক" থেকে আমেরিকার ড. আলী রীয়াজ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সৈয়দা সেলিনার জরিপে দেখা গেছে ৮০+% লোক শারিয়া সমর্থক - “গণতন্ত্র ও শরিয়াহ আইন: জনমত দুটিরই পক্ষে" - প্রথম আলো ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭। ২০২২ সালের রিপোর্টেও আছে জনমত শারিয়া আইনের পক্ষে বেশি - দৈনিক প্রথম আলো ২৬ জানুয়ারি, ২০২২। অর্থাৎ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবল ঝুঁকির মধ্যে আছে। দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সহ এর অনেক কারণের একটা হল দেশে অগণিত আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ ও সংঘাত থাকলেও তাঁরা সবাই ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক ও গণতন্ত্র বিরোধী।
১।"ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের শাহাদা পড়া সম্পূর্ন হইবে না" - (অর্থাৎ উনাদের মুসলমানিত্ব অসম্পূর্ন থাকবে) - ‘উইটনেস টু ম্যানকাইণ্ড’পৃষ্ঠা ৩২, মওলানা মওদুদি। মুখোশ-বিরোধীরা মওদুদীপন্থী হন বা না হন, ইসলামী রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেপথে যে কোনো বাধাকে যে কোনো উপায়ে পরাজিত করা তাঁদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। "মারি অরি পারি যে কৌশলে" - মেঘনাদ বধ।
২। সেপথে তাঁদের প্রধান বাধা আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যার শেকড় বাহান্ন'র ভাষা আন্দোলন। সেটাকে ধ্বংস করতে ইসলামকে আমাদের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। ব্রিটিশের পলিসি ছিল - "গিভ দি ডগ এ ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাং হিম"। একুশকে বদনাম করতে গোলাম আজম বলেছিলেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল "মারাত্মক ভুল" (দৈনিক আজাদ, ২০ জুন ১৯৭০)। দাবি শুরু হলো একুশের ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া, ফুল দেয়া, লক্ষ মা-বোনের লঙ্ঘিত সম্ভ্রম এবং লক্ষ নিরপরাধের আর্তনাদ মেশানো রক্তস্নাত ২১শে, ২৬শে, ১৬ই উদযাপন নাকি শির্ক ! https://bangla.bdnews24.com/opinion/feature-analysis/52949
৩। কেতাব লিখেও আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে "ইসলাম বিরোধী" প্রমানের ষড়যন্ত্র হয়েছে। যেমন –
(ক) "ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক জাহেলীয়াতের পরিণতি", লেখক ভারতের আলেম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী, অনুবাদ আবদুল মান্নান তালিব, প্রকাশক সিন্দাবাদ প্রকাশনী, ২ কাজী আলাউদ্দীন রোড, ঢাকা। এ বইতে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন একাত্তরে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছি, সেটা নাকি আমাদের "ভাষা-পূজা" ইসলামের তৌহিদকে পরাজিত করেছে - পৃষ্ঠা ৯। আলেম বটে!
(খ) মওদুদীর লিখেছেন ইসলামী জাতীয়তাবাদ ছাড়া বাকী সব জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল প্রধানত: বংশ, স্বদেশ, ভাষা, বর্ণ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও শাসন ব্যবস্থার ঐক্য। এই ভিত্তিগুলো নাকি - "গোটা মনুষ্যজাতির পক্ষে এক কঠিন ও মারাত্মক বিপদের উৎস হয়ে রয়েছে, তাও কেউ অস্বীকার করতে পারে না" - "ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ" - মওলানা মওদুদী, পৃষ্ঠা ১০ ও ১১। (মওদুদীকে বলতে চাই, ‘অবশ্যই অস্বীকার করতে পারি এবং করছি, মওলানা!’) একই কথা তিনি তাঁর বুকলেট "ইউনিটি অফ দি মুসলিম ওয়ার্ল্ড"- এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই বলেছেন- 'দি কার্স অফ ন্যাশনালিজম' অধ্যায়ে।
অর্থাৎ "গোটা মনুষ্যজাতির পক্ষে কঠিন ও মারাত্মক বিপদের উৎস" আমাদের বাংলা ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করে "গোটা মনুষ্যজা তি"কে এই "কঠিন ও মারাত্মক বিপদ" থেকে রক্ষা করাটা উনাদের “ঈমানী দ্বায়িত্ব”। প্রচন্ড প্রশ্ন - বাংলাদেশের জন্মদর্শনকে হত্যাকামী এই প্রচণ্ড রাষ্ট্রবিরোধী বইটা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইটে কেন?
https://jamaat-e-islami.org/publication/file/292_islam_o_jatiotabad.pdf
https://www.icsbook.info/read-full-book/305
৪। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত উনাদের মুসলমানিত্ব অসম্পূর্ন, তাই এ উদ্দেশ্যে তাঁরা যা কিছু দরকার তাই করবেন। এজন্য তাঁরা মিথ্যা বলাকেও শুধু উৎসাহিতই নয় বরং বাধ্যতামূলক করেছেন। কাজেই তাঁদের মন-মগজে কি ঘুরছে তা তাঁদের মুখের কথা থেকে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। শারিয়া আইনে আছে:- "উদ্দেশ্য বাধ্যতামূলক হইলে সে উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা বাধ্যতামূলক" - আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা সত্যায়িত শারিয়া কেতাব ‘উমদাত আল সালিক’ আইন নং r.8.2। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো "তাকিয়া" পদ্ধতিতেও তিন ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাকে ইসলামের নামে বৈধ করা আছে। দুনিয়ায় বোধহয় একমাত্র তাঁদের “ধর্ম”টাই মিথ্যাকে উৎসাহিত ও বাধ্যতামূলক করেছে। মিথ্যা কথার প্রতারণায় আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ধ্বংসের দাবি করে এই কোরআন বিরোধী কণ্ঠ - কারণ কোরানের নির্দেশ - "তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না”- বাকারা ৪২।
তাঁরা খেয়াল করেন না শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র নামগুলোও এসেছে হিন্দু মাইথলজি (পৌরাণিক কাহিনী) থেকে কিন্তু এখন ওগুলো বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত এবং ধর্মনিরপেক্ষ। "মঙ্গল" নিয়ে আপত্তি হলে শনি রবি বুধ বৃহস্পতি শুক্র-কে কি করবেন তাঁরা? তাঁরা সন্তানের মঙ্গল কামনা করবেন না? তাঁদের দাবী, "মঙ্গল" শব্দটা এবং শোভাযাত্রার কিছু মুখোশ হিন্দুয়ানী, কাজেই ওগুলোর ব্যবহার আমাদেরকে “ইসলাম-ভ্রষ্ট করার সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র”। এই "সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র" তাঁরা কবে কার কোন গবেষণায় পেয়েছেন? মুখোশের কারণে কোন মুসলিম কোথায় কবে ইসলাম-ভ্রষ্ট হয়েছে? নামধাম সহ তার তালিকা দিন। দিতে পারবেন না কেননা ওই দাবিটাই মিথ্যে এবং ষড়যন্ত্র।
আসলে এগুলো সব বাহানা। মুখোশ-বিরোধী কাউকে কখনো একুশের মিছিলে দেখেছেন? ওতে তো মুখোশ থাকে না !! শোভাযাত্রার মিছিলে যখন মুখোশ ছিল না তখনো তারা এর বিরোধিতা করেছেন। আয়োজকেরা আগামী বছর শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার করবেন না ঘোষণা দিয়ে দেখতে পারেন, মুখোশ-বিহীন শোভাযাত্রায় তাঁরা যোগ দেন কিনা। এতে প্রমান হবে আসলে তাঁদের গাত্রদাহ মুখোশ নিয়ে নাকি ওটা বাহানা যা তাঁদের করতে হয় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।
তাঁরা জাতিকে কি মনে করেন? জাতির ইসলামী ঈমান এতই ঠুনকো যে কয়েকটা মুখোশ দেখেই তা ভেঙে যাবে? ওই প্রাণীদের অস্তিত্ব হিন্দু ধর্মের বাইরেও ব্যাপক। দুনিয়ার সব রাজহাঁস সরস্বতীর বাহন নয়, সব ময়ূর কার্তিকের বাহন নয়, সব প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন নয়। ওগুলোকে টেনে হিঁচড়ে হিন্দুধর্মের সাথে জুড়ে দেয়াটা প্রমান করে, উম্মতের জন্য নবীজীর (স) উদ্বেগ:- "উম্মতের জন্য আমার সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারী ইমামদের লইয়া" - সুনান ইবনে মাজাহ ৫ম খন্ড হাদিস ৩৯৫২। কেউ কেউ বলেন ওই "ইমাম" আসলে শাসক। কথাটা মতলবি কারণ শাসক (মুজিব-জিয়া-হাসিনা-খালেদা ............) আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা রাখেন না, আলেমরা রাখেন। এই পথভ্রষ্টকারী আলেমরা এদেশে জন্মে এদেশের ভাষাভিত্তিক জাতীয়বাদকে আঘাত করবেন এটাই তো স্বাভাবিক!
সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়। এক সময় নববর্ষে হালখাতা ছিল মিছিল ছিলনা। পরে মিছিল এল, নাম “আনন্দ-শোভাযাত্রা” পরে “মঙ্গল-শোভাযাত্রা” হয়েছে, মুখোশহীন শোভাযাত্রায় মুখোশ এসেছে, অনেক কিছু আবারও বদলাবে। এ নিয়ে এতো হৈ হৈ করে "ইসলাম গেল গেল" করার কি আছে?
*************************
**_ RELATED:- ২১শে, ২৬শে, ১৬ই, জন্মদিন ও নববর্ষ উদযাপন - বিরোধিতার মূল কারণ কি?- https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/151-2019-09-26-14-09-17
**- BENEWS24.COM মূল নিবন্ধ - "আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা বনাম আগ্রাসী মৌলবাদ":- https://bangla.bdnews24.com/opinion/bmke2kg6hq
**- INTERVIEW - ধর্মের সত্যাসত্য অনুসন্ধানেই বাঙালীয়ানার মাসিক প্রয়াস “ধর্মকথা” । আজকের প্রসঙ্গ: শারিয়া নিরীক্ষণ-২: মঙ্গল শোভাযাত্রায় মৌলবাদী থাবা’ - https://www.youtube.com/watch?v=4jz5LLXd_uA&t=741s
জীবনে দুর্ঘটনা বলে কিছু নেই। যা ঘটেছে তা এজন্যই ঘটেছে যে কার্য্য-কারণ সমীকরণ মোতাবেক সেটা ছাড়া আর কিছুই ঘটতে পারতোনা। কয়েক দশক আগে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশগুলো যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে, যেমন জিন্নাহ'র পাকিস্তান, নাসেরের মিশর, ড. মোসাদ্দেকের ইরান, সুকর্ণ'র ইন্দোনেশিয়া, পরে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের বাংলাদেশ। তুরস্ক তো ১০০ বছর আগে থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু এখন ওই প্রত্যেকটি দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী শারীয়াপন্থীরা শক্তিশালী। এ বিবর্তনের কারণগুলো বাংলাদেশেও বিদ্যমান, বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও সেদিকে এগিয়েছে।