পোহালে শর্বরী !! হযরত ওসমানের (র) শাহাদত

পোহালে শর্বরী !!  হযরত ওসমানের (র) শাহাদত - হাসান মাহমুদ

উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য, আদিগন্ত ধু-ধু বালু। মাঝেমধ্যে সবুজ পাতার কাঁটাভরা কিছু বাবলা গাছ, তৃণগুল্ম, কিছু কীট-পতঙ্গ। আশ্চর্য্য! চতুর্দিকে এই উত্তপ্ত মৃত্যুর মধ্যেও প্রবল বিদ্রোহে ওরা ধরে রেখেছে প্রাণ!

চলেছে কাফেলা, মদিনা থেকে মিশরের দিকে। খেলাফতের সরকারি স্ট্যাম্প লাগানো, খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ)-এ সই করা নিয়োগপত্র ফরমান নিয়ে মিশরের নতুন গভর্নর হিসেবে চলেছেন হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর ছেলে মুহাম্মদ বিন আবু বকর (রাঃ)। সময়টা সুবিধের নয়। মিশর থেকে ইরাক, সিরিয়া থেকে ইয়েমেন, খলিফার বিরুদ্ধে অসন্তোষের এখানে ওখানে ঘনীভূত হচ্ছে কালোমেঘ, আকাশে জমে উঠছে সর্বনাশা বজ্র। এর কথাই কি বলে গিয়েছিলেন পয়গম্বর (দঃ) ? হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন ? সাবধান ! কক্ষনো নিজেদের মধ্যে হানাহানি করবে না!

দূরে কে ঐ যায় ? একটা উটে একা এক লোক ! মরুভূমিতে তো একা কেউ যাতায়াত করে না - পথ হারাবার ভয়, অসুস্থ হবার ভয়। ধরে আনা হলো তাকে, তার কাছে পাওয়া গেল মিশরের বর্তমান গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সাদ-এর প্রতি লেখা আরেকটা ফরমান। তাতে লেখা আছে, পৌঁছামাত্র মুহম্মদ বিন আবু বকরকে যেন খুনকরা হয়, যে কোন প্রতিবাদকারীকে যেন বন্দি করা হয়।

এটাতেও খলিফার সরকারী স্ট্যাম্প, এটাতেও তাঁর সই !!

পুরো কাফেলা আকাশ থেকে পড়ল, তারপর পুরো আকাশটাই যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাদের মাথায়। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলেন খলীফা! পৌঁছামাত্র মুহম্মদ বিন আবু বকরকে খুন করা হবে? আগুন জ্বলে গেল রক্তে। ‘প্রতিশোধ’ ‘প্রতিশোধ’ গর্জনে মদিনার দিকে ছুটল কাফেলা। পথে যারাই পড়ছে সবাইকে দেখাচ্ছে দু-দু’টো উল্টো সরকারি ফরমান। যে-ই দেখছে, উন্মত্তের মতো যোগ দিচ্ছে কাফেলায়। ক্ষুব্ধ সে সাইক্লোন আছড়ে পড়ল মদিনার পথে। ত্রস্তে বেরিয়ে এলেন নেতৃবৃন্দ - আলী (রাঃ), যুবায়ের (রাঃ), তালহা (রাঃ) এবং অন্যান্যরা।

হাজার কণ্ঠের হুঙ্কার, হাজার তরোয়ালের বিদ্যুৎ চমকে ‘বিশ্ব রহিল নিঃশ্বাস রুধি, নিভায়ে সূর্য্যতারা।’

চিৎকার করে উঠলেন নেতৃবৃন্দ, "দাঁড়াও ! লজ্জা করে না ? জানো কার বিরুদ্ধে কথা বলছ ? পয়গম্বর (দঃ)-এর দু-দু’জন কন্যার স্বামী যুন্নুরাইন তিনি ! দুর্ভিক্ষে অনাহারক্লিষ্ট মুসলমানের মুখে এক হাজার উটের বয়ে আনা খাবারের দাতা তিনি, । বদর যুদ্ধে যোগ না দিয়েও গণিমতের অংশীদার তিনি। বেঁচে থাকতেই শহীদের মর্য্যাদাপ্রাপ্ত বেহেশতি তিনি। বহু জিহাদের খরচ-বহনকারী, লক্ষ লক্ষ দিনার হাজার হাজার উট হুজুর (দঃ)-এর পায়ে রেখে দেয়া সর্বত্যাগী ধনী সওদাগর। লজ্জা করে না?"

পলকের জন্য থমকে গেল সাইক্লোন। তাইতো ! ওসমান তো অনেক আছে, কিন্তু যুন্নুরাইন তো ঐ একজনই ! গনি তো ঐ একজনই !

কিন্তু চোখের সামনে হাতের মুঠোয় দু-দু’টো বিপরীত ফরমান আগুনের মতো জ্বলছে, সেটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। খলিফার দরবারে ছুটল বিদ্রোহী দল, খলিফার সামনে খুলে ধরল ফরমান দু’টো।

কি বলবেন ওসমান (রাঃ) ? এত বড় বিস্ময়ের জন্য কি প্রস্তুত ছিলেন সেই নম্রভাষী, বিনয়ী খলিফা? হতভম্ব হয়ে গেলেন, নির্বাক দু’চোখে তাঁর ফুটে উঠল অপার বিস্ময়। আমি? আমি করব এই জঘন্য প্রতারণা? নাউজুবিল্লাহ ! রসুলুল্লাহ্ (দঃ)-এর দু-দু’টো মেয়ের জামাই হয়ে, ইসলামের জন্য সর্বত্যাগ করে, ইসলামের খলিফা হয়ে? ছি ছি ছি - নাউজুবিল্লা মিন জালেক্ !

    

যা বুঝবার বুঝে গেল সবাই। আগে থেকেই টগবগ করে ফুটছিল রক্ত, এবার হাজার তলোয়ার, হাজার বজ্রমুষ্ঠি উঠে গেল আকাশে। কে সে? কে সেই ষড়যন্ত্রকারী যে খলিফার সই জাল করে, সরকারী স্ট্যাম্প চুরি করে লাগিয়ে সর্বনাশা ফরমান মিশরে পাঠাচ্ছিল, উম্মা’র মধ্যে আত্মঘাতি রক্তস্রোতের চেষ্টায়? বসল তদন্ত কমিটি। ওই, ওই যে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে ষড়যন্ত্রকারীর চেহারা।

প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে অবশেষে প্রমাণিত হয়ে গেল সে চেহারা।

মারোয়ান। মারোয়ান বিন হাকাম।

খলিফার চাচাতো ভাই, সরকারী উপদেষ্টা এবং তাঁর জামাইও বটে। খলিফার বাড়িতেই তার বসবাস, সেটার পুরো সুযোগ নিয়েছে এই ঘরজামাই। খলিফার সই জাল করেছে, সরকারি স্ট্যাম্প চুরি করে লাগিয়েছে, মুসলমান সমাজে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছে।

বিদ্রোহীরা সগর্জনে অবরোধ করল খলিফার বাড়ি। হাজার কণ্ঠে চিৎকার উঠল "মারোয়ানকে দাও"।’ নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ চেষ্টা করলেন সে ঝড় শান্ত করতে কিন্তু বন্দী হবার ঝড় সে নয়। নেতাদের লাগাম ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল সেই কালবৈশাখী তার অনিবার্য ধ্বংসের দিকে। উন্মত্ত বিদ্রোহীদের দাবি, "হয় মারোয়ানকে দাও, নতুবা সরে দাঁড়াও খলিফা পদ থেকে"।’

তাদের নেতৃত্বে মুহম্মদ বিন আবুবকর, সাথে কেনানা, সওদান, এবং হোমক।

এইখানে এসে থমকে গেছে ইতিহাস। ওসমান (রাঃ) মারোয়ানকে বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দিলেন না, বিচারও করলেন না, শাস্তিও দিলেন না। কেন ? আমি জানিনা, আলেমরা বলবেন।

এদিকে ক্ষিপ্ত বিদ্রোহীদল দ্বারা ঘরবন্দি অনড় খলিফা, ওদিকে মক্কায় চলছে হজ্জ্ব। ভবিতব্য এড়াল না আলী (রাঃ)-এর চোখে। মদিনার খবর পৌঁছে গেছে মক্কায়। হজ্জ্ব শেষ হলেই লক্ষ হাজীর বন্যা খলীফাকে বাঁচাবার জন্য ক্ষিপ্ত টর্নেডোর মতো ছুটে আসবে, হাতির পায়ের নিচে পিঁপড়ের মতো পিষে যাবে বিদ্রোহীরা। এটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধি তারা রাখে, সেক্ষেত্রে তাদের সামনে খুব সম্ভব একটাই খোলা পথ - অনতিবিলম্বে খলিফার খুন।

শিউরে উঠলেন আলী (রাঃ), দুই ছেলে হাসান-হোসেনকে পাঠিয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ। খলিফার বাড়ির দরজায় তরবারি হাতে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন সিংহ-তনয়রা। জোঁকের মুখে নুন পড়ল। সংখ্যায় মাত্র দুই কিন্তু ওজনে অসীম। বিশ্বের শুদ্ধতম রক্ত বইছে ওই দুই শরীরে, ওখানে হাত দিলে কেয়ামত হয়ে যাবে। সাথে যোগ দিল তালহা (রাঃ) যোবায়ের (রাঃ)-এর ছেলেরাও।

প্রমাদ গুনল বিদ্রোহীরা। মক্কার বন্যা মদিনায় পৌঁছে গেছে প্রায়। আর সময় নেই। অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসল নিয়তি। বিদ্রোহীরা পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ল ভেতরে। নীচের তলায় তখন একা কোরাণ শরীফ পড়ছেন কোরাণ সঙ্কলনকারী ওসমান গণি (রাঃ)। বাকি সবাই ওপরের তলায়। বৃদ্ধ খলিফার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন মোহাম্মদ বিন আবু বকর (রা)।

শিশুকালে ওই সস্নেহ দুই বাহুতে ওই কোলে কত না খেলা করেছেন তিনি!

কি করে যে দিন বদলায় !

আক্রমণের মুখে বেদনার্ত খলিফা শুধু বলতে পারলেন, “ভাতিজা ! আজ তোমার বাবা বেঁচে থাকলে তুমি কি আমার সাথে এরকম করতে পারতে ?”

“শুনিয়া মুহম্মদ লজ্জা পাইয়া চলিয়া গেলেন।”

“শুনিয়া মুহম্মদ লজ্জিত হইয়া খলিফাকে ছাড়িয়া পিছু হটিয়া আসিলেন।”

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। কেনানা, হোমক এবং সাওদান অস্ত্র দিয়ে বৃদ্ধ খলিফার শরীর ছিন্নভিন্ন করতে থাকল, তাঁর স্ত্রী নায়লা (রাঃ) চিৎকার করে ছুটে এলে তাঁর একটা আঙ্গুল কেটে মাটিতে পড়ল।

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন……….    

সামনে তখন খোলা রয়েছে কোরাণ, কোরাণ-সঙ্কলনকারী যুন্নুরাইন-এর রক্ত ভিজিয়ে দিয়েছে - ‘শুধুমাত্র আল্লাহ্-ই তোমার জন্য যথেষ্ট। তিনি শ্রোতা এবং বিজ্ঞ।’ May be an image of text

দিগন্ত বিস্তৃত মধ্যপ্রাচ্যে তখন ঘূর্ণিবায়ে হাহাকার করে ফিরছে লু হাওয়া। মরুভূমির প্রতিটি বালুকণা জেনে গেছে, এ তো সবে শুরু। এরপর অন্তর্দ্বন্দ্বের কালনাগ একের পর এক বিষাক্ত ছোবলে ছিন্নভিন্ন করবে মুসলিম উম্মাকে। এদিকে মারোয়ান, ওসমান (রাঃ)-এর রক্তাক্ত জামা আর নায়লা (রাঃ)-এর কাটা আঙুল সিরিয়ায় পৌঁছে গেছে। সেগুলো আগুন জ্বালালো সিরিয়ায় - আগুন জ্বলল ইরাকে, মিশরে, ইয়েমেনে। ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির মতো টগবগ করে ফুটতে লাগল মুসলিম বিশ্ব।

তারপর ?

ব্রিটিশরা বাংলায় এসেছিল বণিক হিসেবে। পলাশী যুদ্ধে ব্রিটিশের বিজয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - “বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী, দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।”

ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম উম্মা’র অষ্টম খলিফার নাম মারোয়ান বিন হাকাম !!

সূত্র : –

1. "মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা" - মওলানা আবুল কালাম আজাদ, অনুবাদ নুরুদ্দিন আহমেদ - পৃষ্ঠা ৮৯ –১০১,

2. “আশারা মোবাশ্শারা” - মওলানা গরীবুল্লাহ ইসলামাবাদী ফাযেলে দেওবন্দ, এমদাদিয়া লাইব্রেরী - পৃষ্ঠা ১৩৯ - ১৪২।

*********************

** - উদ্ধৃতি- "উহা একটি ঘটনা যাহা ইসলামের ইতিহাসের ধারা পরিবর্তন করিয়া দিয়াছে........ এরপরে বনি হাশেম এবং বনি উমাইয়ার মধ্যে বংশ-কলহের আগুন পুনরায় জ্বলিয়া উঠিল। ইসলাম এই দুনিয়ায় একটি নবতম আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিদ্যুৎ বেগে অভিযান শুরু করিয়াছিল, উহা এমন একটি প্রচন্ড আঘাত প্রাপ্ত হইল যে, উহার ধাক্কা সে আর সামলাইয়া উঠিতে পারিল না" - উদ্ধৃতি শেষ।

**- পরে উমাইয়ারা "ওসমান হত্যা"-র প্রতিশোধ নেবার জন্য হযরত আবু বকরের (রা) ছেলে মুহাম্মদ বিন আবু বকর-কে গাধার চামড়ার ভেতরের সেলাই করে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল।

বই "শারিয়া কি বলে আমরা কি করি":- https://hasanmahmud.com/index.php/books/sharia-ki-bole

Print