মূর্তি-ভাস্কর্য-প্রতিমা : ঈদ মিছিলে, কোরান-হাদিসে ও মুসলিম ঐতিহ্যে - হাসান মাহমুদ - ০১ এপ্রিল ২০২৫
“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে- বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফিকাহ ও হাদিস চষে” - নজরুল।
দেশ যেখানে উগ্র ধর্মান্ধতার হুংকারে প্রকম্পিত, সেখানে ৩১শে মার্চ ২০২৫ ঈদে সরকার মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি সহ "ঈদ আনন্দ মিছিল" বের করেছে। এই অস্থির ও স্পর্শকাতর সময়ে ইসলামী বিধানের সাথে মূর্তির মিশেল প্রচন্ড প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই খিলাফতপন্থীরা সরকারের এই অপ্রয়োজনীয় ও হঠকারী কাজের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করছেন। তাই জাতিকে কোরান-হাদিস-সীরাত ও ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে জানানো দরকার, কেন বিশ্ব-মুসলিম চিরকাল ভাস্কর্য-বিরোধী হাদিসগুলোকে সম্পূর্ণ বর্জন করে ভাস্কর্যকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করেছে। 
বাংলায় পূজার প্রতিমা ও সম্মান-সৌন্দর্যের ভাস্কর্য দুটোই 'মূর্তি' শব্দে অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু ইংরেজিতে পূজার প্রতিমা "IDOL" এবং সম্মান-সৌন্দর্যের ভাস্কর্য "STATUE"। এবারে দেখা যাক
(ক) কোরান-হাদিসে ভাস্কর্য, এবং (খ) ভাস্কর্য : অতীত-বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতা।
(ক) আল্লাহ স্পষ্টভাবে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্যকে বৈধতা দিয়েছেন।
(A-) "যখন তুমি আমার আদেশে কাদামাটি দিয়ে পাখীর মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত" – মায়েদা ১১০। "কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতি" ১০০% ভাস্কর্য। সুতরাং আল্লাহর কালামে ভাস্কর্য বৈধ, পিরিয়ড!
(B-) “তারা সোলায়মানের (আ) ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, কুয়ার মতো বৃহদাকার পানির পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত” - সাবা আয়াত ১৩। সুতরাং আল্লাহর কালামে ভাস্কর্য বৈধ, পিরিয়ড!
ভাস্কর্য-বিরোধীরা বলেন ওটা নাকি ছিল নিষ্প্রাণ কিছুর মূর্তি, প্রাণীর নয়। দাবিটা ভিত্তিহীন কারণ ওটা কেউ দেখে আসেনি। তাছাড়া কোরানে স্ট্যাচু বৈধ, এমনকি প্রাণীরও (মায়েদা ১১০)। সেজন্যই মুসলিম বিশ্ব চিরকাল ভাস্কর্য-বিরোধী হাদিসগুলোকে অগ্রাহ্য করেছে, বর্জন করেছে।
হাদিসে "IDOL" অর্থাৎ পূজার প্রতিমা'র বিরোধিতা আছে। দেখা যাক STATUE অর্থাৎ সম্মান সৌন্দর্যের ভাস্কর্য নিয়ে সহি সিত্তা-তে কি আছে - https://sunnah.com
(C-) বুখারি - STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য শব্দটিই নেই, নিষিদ্ধ তো দূরের কথা। IDOL অর্থাৎ প্রতিমা'র বিরোধিতা আছে ৩৬টি হাদিসে,
(D-) নাসাঈ - STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য শব্দটিই নেই, নিষিদ্ধ তো দূরের কথা। IDOL অর্থাৎ প্রতিমা'র বিরোধিতা আছে ১০১টি হাদিসে
(E-) ইবনে মাজাহ - STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য শব্দটিই নেই, নিষিদ্ধ তো দূরের কথা। IDOL অর্থাৎ প্রতিমা'র বিরোধিতা আছে ৫৫টি হাদিসে,
(F-) আবু দাউদ - STATUE অর্থাৎ "ভাস্কর্য" শব্দটিই নেই, নিষিদ্ধ তো দূরের কথা। IDOL অর্থাৎ প্রতিমা'র বিরোধিতা আছে ১১টি হাদিসে,
(G-) তিরিমিযী - IDOL অর্থাৎ প্রতিমা'র বিরোধিতা ৮টি হাদিসে, STATUE অর্থাৎ ভাস্কর্য আছে হাদিস ২৭৬৪-এ - কারো সম্মানে অন্যেরা স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে থাকলে সে যদি খুশি হয় তাহলে সে জাহান্নামে যাবে - এটা এ নিবন্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়,
(H-) মুসলিম - ভাস্কর্য বিরোধী হাদিস ৫২৫০ - বাসায় কুকুর বা স্ট্যাচু (STATUE)থাকলে ফেরেশতা ঢোকেনা। কিন্তু এই হাদিস সহ কোরান-বিরোধী সব হাদিস বাতিল কারণ কোরান সুস্পষ্ট ভাষায় ভাস্কর্য বৈধ করেছে এবং কোরান-বিরোধী কথা নবীজি (সা) বলতে পারেন না - সূরা আরাফ ২০৩, আম্বিয়া ৪৫, আহযাব ২, আহকাফ ৯, ইউনুস ১৫ ও ১০৯ এবং আনাম ৫০ ও ১০৬।
সহি মুসলিম কতটা সহি? দুনিয়া জানে নবি (স) মক্কায় ছিলেন ১৩ আর মদিনায় ১০ বছর। কিন্তু সহিঃ মুসলিম বলছে উনি মক্কায় ১৫ বছর ছিলেন ! হাদিস ৫৮০৫ সংশ্লিষ্ট অংশ :- "আম্মার বলছেন - ভালো করে মনে রেখো নবী (সা) মক্কায় ১৫ বছর ছিলেন"। আরেকটি হাদিস, - সহিঃ মুসলিম 2353e:-https://sunnah.com/search?q=stayed+in+Mecca+for+15+years

সহিঃ মুসলিম কতটা সহিঃ? হাদিস ৩৪২৪ - হুদায়ফার স্ত্রী সালহাকে তিনি নাকি অশ্লীল আদেশ করেছিলেন যুবক সলিম’কে ১০ ঢোক স্তন্যপান করাতে এবং সালহা প্রথমে প্রশ্ন তুললেও পরে নাকি সেটা করেও ছিল। না - অশ্লীল আদেশ নবীরা দেন না, শয়তান দেয় - বাকারা ১৬৯। কেউ বলেন ওটা ওয়ান টাইম হুকুম ছিল। না, ওয়ান টাইম হলেও সেটা অশ্লীল, নবীরা অশ্লীল আদেশ দেন না। অর্থাৎ সহিঃ মুসলিম ততটা সহি নয় যতটা আমাদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক প্রশ্নবিদ্ধ হাদিস আছে:- সংশ্লিষ্ট:-
**- অশ্লীল, উদ্ভট ও প্রশ্নবিদ্ধ হাদিসের ৩৭টি উদাহরণ:- https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/291-2024-06-14-15-58-25
**- ক্রিমিন্যাল-বান্ধব হাদিস:- https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/296-2024-07-09-14-28-29
(খ) ভাস্কর্য : অতীত-বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতা 
মুসলিম দেশগুলো সহ সারা বিশ্ব চিরকাল ভাস্কর্যে প্লাবিত কারণ ওটা মানুষের ফিতরা, স্বভাবজ।
(I-) খলিফা দ্বিতীয় মুহাম্মদের যুগের একটি ব্রোঞ্জের মুদ্রা, ১৪৮১:- 
https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%89%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF
(J-) আমাদের ইতিহাস ভাস্কর্য্যে ও চিত্রকর্মে সয়লাব – সার্চ - “Sculpture in Muslim history”-(নিচের লিংক পুরোটা কপিপেস্ট করলে অজস্র মুসলিম ভাস্কর্য দেখা যাবে)-
https://www.google.com/search?sca_esv=9f58efb118f0a45e&rlz=1C1CHBF_enCA911CA911&sxsrf=ACQVn0_mdY9JzfcGZyz1esnRDKHOqVuDCw:1711143555083&q=sculpture+in+Muslim+history&tbm=isch&source=lnms&prmd=ivsnmbtz&sa=X&ved=2ahUKEwj4mYq-6oiFAxWaHTQIHU3cAV8Q0pQJegQIChAB&biw=1360&bih=607&dpr=1
(K-) সার্চ - STANDING CALIPH DINAR | Ashmolean Museum 
(L-) ভাস্কর্য আমাদের ঐতিহ্য, মুসলিম ইতিহাস ভাস্কর্য্যে সয়লাব - ইসলামী সিটি'র ওয়েবসাইটে (মসজিদ প্রাঙ্গনে?) বিখ্যাত বিজ্ঞানী মুসা খারিজমি'র ভাস্কর্য - ৭৮৩ সাল উজবেকিস্তান:- https://www.islamicity.org/20587/islams-prohibition-of-drawing-images-and-erecting-statues/

(M-) :-মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্কে মৎস্যকন্যার ছবি - "Mermaid Statues in Fethiye Harbor, Turkey" - https://mermaidsofearth.com/mermaid-statues-mermaid-sculptures/public/mermaid-in-fethiye-harbor-turkey/
সংক্ষেপে আরো কিছু :-
স্বয়ং রসূলের (স) বাড়িতে বিবি আয়েশা (র) প্রাণীর পুতুল নিয়ে খেলেছেন এবং নবীজি (সা) তাতে বাধা দেননি অর্থাৎ অনুমোদন করেছেন – বুখারি ৮ম খণ্ড ১৫১, আবু দাউদ ৪৯১৪, মুসলিম ৩৩১১, ৫৯৮১:- Sahi Bukhari – free download:- https://futureislam.wordpress.com/wp-content/uploads/2012/11/summarized-sahih-al-bukhari.pdf

হাদিসের শেষে অনুবাদক ব্র্যাকেটে লিখেছেন আয়েশা (রা) ছোট ছিলেন বলেই নবীজি এটা নিষেধ করেননি। সমস্যাটা এখানেই, নবীজির মনের কথা অনুবাদক কিভাবে জানলেন? তিনি তো নবীজির সাথে কথা বলেননি! অরিজিনাল হাদিসে তো সেটা নাই! এই সেই ক্রাইম - তফসির বা ফুটনোটে না দিয়ে কোরান হাদিসের অনুবাদে টেক্সট এর ভেতরে ব্র্যাকেটে নিজের কথা ঢোকানো - যাতে মনে হয় কথাটা আল্লাহ-রসুলের!! এরই নিন্দা করেছে সূরা ইমরান ৭৮, বাকারা ৭৯ – লোকেরা নিজের কথা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছে !! ওটা ইহুদিরাও করেছে মুসলিমরাও করেছে। প্রমাণ সুনান ইবনে মাজাহ পঞ্চম খণ্ড হাদীস ৩৯৫২ ("উম্মতের জন্য আমার সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারি ইমামদের লইয়া), প্রমাণ সহি বুখারী ৯ম খন্ড হাদিস ১৭৪ - আমার ভাষায় বলছি:- নবী (সা) বলেছেন আমি রোজ হাশরে মানুষকে কাউসারের পানি খাওয়াবো, কিছু লোক আসবে যাদেরকে আমি চিনি তারাও আমাকে চেনে কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা বাধা রাখা হবে। আমি বলবো এরা তো আমার লোক !! তখন আমাকে বলা হবে:- "আপনি জানেন না আপনার পরে এরা কি বদলে দিয়েছে এবং নতুন জিনিস এনেছে" -তখন আমি বলব - দূর হয়ে যাও আমার রহমত থেকে দূর হয়ে যাও যারা আমার পরে ধর্মকে বদলে দিয়েছো” !! এটা এখানেও আছে Bukhari 7051 in Sunnah.com:-

কত ক্রোধে কত বেদনায় একথা বলেছিলেন নবীজি (সা) তা কি আমরা কল্পনাও করতে পারবো?
(খ) কাবার দেয়ালে ছিল হযরত ঈসা (আ) ও মাতা মেরির ছবি, কাবার ভিতরে ঢুকে "রাসুল (সা) হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবি বাদে বাকি সব ছবি মুছিয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন"- সিরাত – ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক-এর পৃষ্ঠা ৫৫২:- 
(গ) প্রাচীন সভ্যতা আছে এমন দেশ সহ বহু দেশ জয় করেছিলেন মুসলিমরা, সেখানেও অনেক মূর্তি-প্রতিমা-ভাস্কর্য ছিল। কিন্তু সাহাবীরা কোথাও কোন ভাস্কর্য ভাঙেননি। যেমন মিশরের প্রাচীন মনুষ্য-মূর্তিগুলো - Search - Ancient statues in Egypt
শেষকথা - ইসলাম মানুষের ফিতরাত অর্থাৎ স্বভাবজাত ধর্ম, এবং ভাস্কর্য মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি। সেজন্যই প্রাচীন মানবের গুহার দেয়াল থেকে বর্তমান বিশ্ব ভাস্কর্যে সয়লাব, সেজন্যই ভাস্কর্যহীন সমাজ পৃথিবীতে কখনো ছিল না এখনো নেই। অতীতে মানুষ ভাস্কর্যের পূজো করতো, তাই ভাস্কর্য নিষিদ্ধ হয়ে থাকলেও সেটা তখনকার প্রজ্ঞা, এখনকার নয়। যেমন জিজিয়া কর বা দাসপ্রথার ওপরে ইসলামী হুকুমগুলো তখনকার প্রজ্ঞা, এখনকার নয়। বর্তমানে ভাস্কর্য দেখে কোন মুসলিম তার ইবাদত শুরু করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাই দাবি করা যেতে পারে এখন ভাস্কর্য-বিরোধিতায় প্রজ্ঞা নেই। অযথা কুতর্ক করা যেতে পারে কিন্তু সবমিলিয়ে ভাস্কর্য বিরোধিতার পেছনে কোন প্রজ্ঞা নেই।