হাসান মাহমুদ ২৯ জুন ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)
হায় হায় এ কি হল? মাত্র চার বছর আগেও তো তুঙ্গে ছুটছিল ময়ুরপংখী, ভুস করে ডুবে যাচ্ছে কেন এখন? ইনকিলাবীদেরকে এত আদর সোহাগ করার পরেও কলসি'র কানা খেতে হল ! হেফাজতকে দুধ-কলা দেবার পরেও ছোবল খেতে হল !! ক’বছর আগে আ-লীগ কোনঠাসা করার জন্য জামাতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল ইনকিলাবী দলকে। সাথে সাথে দৈনিক ইনকিলাব ধুমসে শুরু হয়েছিল জামাত-পিটাই আর আওয়ামী বন্দনা। রাজনৈতিক স্বার্থে সংসদে অনুমোদন হয়ে গেল ইনকিলাবী-দাবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে বাংলাদেশে একটা বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ওদিকে জামাত তখন আড়ালে অট্টহাসি হাসছে; তার এজেন্ডাই তো হল যত বেশী সম্ভব সংগঠন বানানো, সরকারী হলে তো কথাই নেই।
ক্ষমতায় যে-ই থাকুক সংগঠনগুলো একদিন শারিয়াপন্থীদের হাতে আসবেই এবং ওগুলো থেকে মৌদুদী'র লক্ষ লক্ষ তাত্ত্বিক নাতিপুতি বেরুবে। তাতে সমাজের শারিয়াকরণ এগিয়ে যাবে - একদিন মিসরের মত গণভোটেই শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে যাবে বাংলাদেশ। ধুরন্ধর জামাতের হিসেবের এ কড়ি বাঘে খায় না PEW রিপোর্ট সেটা প্রমাণ করছে (এখানে দেখুন)। আর এখন হাওয়া বদলের সাথে সাথে খেতে হচ্ছে ইনকিলাবী ছোবল। ওদিকে হেফাজত-প্রধান মওলানা শফি কওমী মাদ্রাসার কেন্দ্রীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান। কওমী সিলেবাস আমি দেখেছি, ও দিয়ে জাতির মারাত্মক ক্ষতি হবে। জাতির ক্ষতি করে আ-লীগ সেটা পাশ করেছে, তাতে হেফাজতের ইচ্ছেপূরণ হয়েছে আ-লীগের হাত দিয়েই কিন্তু এখন আ-লীগই হেফাজতের প্রধান শত্রু।
আ-লীগ ও বিএনপি চিরকাল পাল্টাপাল্টি জিতেছে-হেরেছে কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচন বাদ দিলে একের পর এক এমন ভরাডুবি কারো হয়নি। রাজশাহী-বরিশালের গত মেয়র অভূতপূর্ব উন্নতি করেছিলেন, তার পরেও হেরেছেন। অর্থাৎ উন্নয়ন এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচার, এ দুটো প্রচারণা আর কাজ করছে না। কেন করছে না তার অনেক কারণ দেখাচ্ছেন অনেকে, কিন্তু আমি মনে করি প্রধান কারণ প্রতিপক্ষের ইসলামী কার্ড। নৌকোতে সবচেয়ে বড় ফুটো করেছে এটাই, এ কার্ডের প্রভাব প্রচণ্ড। “গাজীপুর নির্বাচন” - দৈনিক আমার দেশ ০১ জুলাই ২০১৩।
এর সাথে যোগ করুন - "গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসলামের দুশমন দুর্নীতিবাজদের প্রত্যাখ্যান করুন - জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের ১০০০ মুফতি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ইসলামের দুশমনদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করুন"- দেশের বিশিষ্ট ৫০ হাজার আলেম - দৈনিক সংগ্রাম - ২৮ জুন ও ০২ জুলাই ২০১৩। এগুলো এখন ক্রমাগত বন্যার মতো বাড়তে থাকবে। দিগন্ত টিভি, সংগ্রাম-নয়া দিগন্ত-আমার দেশ-এর তারস্বরে অপপ্রচার, ওরকম পোশাকে দেশজুড়ে অসংখ্য মিছিল, কোটি কোটি মসজিদে খুতবায় "নাস্তিক সরকার" ঘোষণা, এগুলোর সম্মিলিত শক্তি প্রচণ্ড। বিস্তীর্ণ গ্রামগঞ্জের কোটি কোটি সাধারণ ভোটার অর্ধশিক্ষিত দরিদ্র। তাদের আত্মবিশ্বাস কম, ধর্মীয় ব্যাপারে তারা ইমাম-মওলানাদের ওপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, তাদের অনেকেই ওসব কথা বিশ্বাস করবে, অনেরকেই আবার আ-লীগকে ভোট দিলে গুনাহ হয় কিনা ভেবে সে রিস্ক নেবে না। এটাই বাস্তব এবং শক্তিশালী বাস্তব। আ-লীগের সমর্থকদের চিৎকার-শ্লোগান ওটা ঠেকাতে পারবে না, যেটা দরকার তা হল পাল্টা কৌশল । কিন্তু ওই পাল্টা কৌশল বের করার মেধা তার আছে বলে মনে হয় না।
আ-লীগ হয়ত ব্লাণ্ডারটা বুঝতে পারছে। জামাতের বিরুদ্ধে যেসব "ইসলামী শক্তি"-কে সে শক্তিশালী করেছে তারা ওই জামাতেরই "শরিয়া-ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র"-এর দর্শনে বিশ্বাসী। অথচ "শরিয়া-ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র"-এর বিরোধী ইসলামী সংগঠন আছে দেশে, যেমন মীরপুরের হাক্কানী মিশন। তাঁদের নিজস্ব মসজিদ-মাদ্রাসা আছে, দেশজুড়ে অসংখ্য মাজার-মসজিদের সাথে বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক আছে, ছাপানো ও ইন্টারনেটে সাপ্তাহিক আছে, ফেসবুক আছে, লাইব্রেরী আছে, ইসলামিক গবেষণা আছে, নিয়মিত আলাপ-আলোচনা-কনফারেন্সের ব্যাপক কর্মকাণ্ডও আছে।
জামাতি-ইসলাম কেন ইসলাম-বিরোধী, কোথায় কোথায় সে কোরান-রসুল ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, ওই তত্ব বিশ্ব-মুসলিমের বিশেষ করে নারীদের কি সর্বনাশ করেছে সেসব দলিল গবেষণা করে বের করেছেন অতীত-বর্তমানের প্রগতিশীল ইসলামী-বিশেষজ্ঞদের দল। সেসব দলিল দিয়ে হাক্কানীর মত ইসলামী সংগঠনের মাধ্যমে জনগনকে শিক্ষিত করার বিকল্প নেই। মিসরের নাসের, পাকিস্তানের জিন্নাহ, ইরাণের ড: মোসাদ্দেক, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, তুর্কীর মোস্তফা কামাল এই গুরুত্বপূর্ন মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র বা সেনাবাহিনী দিয়ে। আজ ওরা সবাই জামাতি-ইসলামের খপ্পরে কাতরভাবে গোঙ্গাচ্ছে। অথচ কসোভো-তাতারস্থানে জনগনই জামাতি-ইসলামের বিরুদ্ধে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারণ ওখানকার মুফতিরা জনগনকে জামাতি-ইসলামের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষিত করেছেন।
বাংলাদেশে এর বিকল্প নেই। সমাজের শারিয়াকরণ এত গভীরে পৌঁছেছে এবং সেটা এতই বেড়ে চলেছে যে অন্য কোনভাবেই দেশকে শরিয়া-রাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে না।