সংগীতে হার্মোনাইজেশন (হার্মোনাইজেশন-ম্যাথে আগ্রহীদের জন্য)  

সংগীতে হার্মোনাইজেশন (হার্মোনাইজেশন-ম্যাথে আগ্রহীদের জন্য)  

হাসান মাহমুদ - ০৬ এপ্রিল ২০২৩

‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ’ অর্জুন যখন জানলেন জঙ্গলে বালক একলব্য তাঁর চেয়েও ভালো তীর চালাচ্ছে তখন তিনি তাঁর গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে অভিযোগ করলেন -"আপনি তো বলেছিলেন আমাকে ছাড়া আর কাউকে শেখাবেন না। কিন্তু ওই ছেলে আমার চেয়েও ভালো তীর চালাচ্ছে, ওকে কেন শেখালেন?"। দ্রোণাচার্য অবাক হয়ে বললেন -"আমি তো আর কাউকে শিখাইনি”! দুজনে জঙ্গলে এসে দেখলেন বালক একলব্য তীর চালানো প্র্যাকটিস করছে তার না-পাওয়া গুরু দ্রোণাচার্যের একটা মূর্তি সামনে রেখে।

আমিও আজীবন আমার না দেখা না-পাওয়া গুরু সলিল চৌধুরীর ছবি সামনে রেখে সংগীতের বিভিন্ন আঙ্গিক ও সমীকরণ বুঝবার চেষ্টা করেছি। আমাদের এই উপমহাদেশে তাঁর মতো তীক্ষ্ণ ও বহুমাত্রিক আধুনিক সংগীতজ্ঞ বিরল।

একাধিক কন্ঠ একসাথে একই শব্দ-বাক্য বিভিন্ন নোটে গাইলে সেটা হার্মোনাইজেশন। হর্মোনাইজেশনকে আমরা ভাগ করতে পারি :- (১) সমান্তরাল (Parallel), (২) বিপ্রতীপ (Anti-Parallel) (৩) ক্রস (Cross) ও (৪) স্থির (Standing)। উদাহরণ :-

(১) সমান্তরাল (Parallel) হার্মোনাইজেশন:- এতে একাধিক কন্ঠ একই শব্দ বাক্য একই দূরত্ব বজায় রেখে সমান্তরালভাবে গাইতে থাকেন। সলিল চৌধুরীর "ও আলোর পথযাত্রী" গানে দুই দলই একসাথে মোটামুটি সমান্তরালভাবে ওপরে যাচ্ছেন ও নীচে আসছেন। অর্থাৎ এক দলের কণ্ঠগুলো যখন একসাথে “গা-মা-পা - - - - - ধা র্স পা" গাইছেন তখন অন্যদলটা একই সাথে “সা-রে-গা - - - - - মা মা গা" গাইছেন। (নানারকম এটা সেটা যোগ করে গানটার এত বেশি ভার্সন ইন্টারনেটে ছড়ানো হয়েছে যে আসলটা খুঁজেই পেলাম না)।

(২) বিপ্রতীপ (Anti-Parallel) হার্মোনাইজেশন:- এই হার্মোনাইজেশন এক সুর যখন নিচ থেকে ওপরের নোটে যায় তখন অন্য সুরটা ওপর থেকে নিচের নোটে যায়। কিন্তু সুর দুটো কখনো কাছাকাছি আসেনা কিংবা পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে বিপরীত দিকে এগিয়েও যায়না যা হয় ক্রস হর্মোনাইজেশনে। যেমন "ও আলোর পথযাত্রী" লাইনের "যা" অক্ষরটা তিনটে বৃন্দকণ্ঠের দুটোতে নিচ থেকে ওপরের নোটে গেছে (পা থেকে ধা এবং গা থেকে মা) কিন্তু তৃতীয় সুরটা ওপর থেকে নিচের নোটে গেছে (সা থেকে উদারার ধা)। এতে সুরটা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর হয়েছে।

(৩) ক্রস (Cross) হার্মোনাইজেশন:- এতে দুটো সুর বিপরীত দিক থেকে এসে পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে বিপরীত দিকে চলে যায়। এটা শুনেছি ১৯৮৩ সালের বিপুল জনপ্রিয় "হিরো" মুভিতে বিপুল জনপ্রিয় "ডিং ডং, ও বেবী সিং সং" গানে। এ গানে একটা কণ্ঠ যখন “র্সা নি ধা পা মা গা রে সা” করে ওপর থেকে নিচে নামছে, একই সময়ে অন্য কণ্ঠটা “সা রে গা মা পা ধা নি র্সা” করে নিচ থেকে উপরে উঠছে। মাঝখানে তারা মা এবং পা নোটে পরস্পরকে ক্রস করে গেল। ডিং ডং গান:- https://www.dailymotion.com/video/x38nssi (এই লিংকে ২য় সুরের সা থেকে শুরুটা অস্পষ্ট কেন বুঝলাম না। তখন এতো টেকনোলজি ছিলোনা সেজন্য হয়তো)।

(৪) স্থির (Standing) হার্মোনাইজেশন :- সলিল চৌধুরীর "ও আলোর পথযাত্রী" গানের “জয় পতাকা তুলে সূর্য্য তোরণ” লাইন গাইবার সময় প্রধান দুটো সুর যখন “পা-ধা-নি-র্সা” অঞ্চলে ঘুরে ফিরে এসে “মা”-তে দাঁড়াচ্ছে, তখন পেছনের সুরটা প্রথম থেকে পুরো সময়টা ধরেই “রে” তে স্থির হয়ে আছে। প্যারিসের আরিফ রানাও একই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নিউইয়র্কের কবি জহিরুল ইসলামের লেখা "ধুল পবনের গাঁও" গান সহ তাঁর তৈরী অনেক গানে। রানার স্ত্রী কুমকুম যখনই গানটার - "ধুল পবনের গাঁও ও আমার ধুল পবনের গাঁও, কোন খেয়ালে উড়াল দিয়ে সুদূরে পালাও" গেয়েছেন তখন পুরো সময়টাতেই দ্বিতীয় কণ্ঠটা তারা সপ্তকের "র্সা"-তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মিউজিক ডেভেলপমেন্টে আরিফ রানার সৃষ্টিশীলতা ও সূক্ষ্মতা অত্যন্ত উপভোগ্য, “ধুল পবনের গাঁও” তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি:- https://www.youtube.com/watch?v=wzuF2p7veNI

***********************************

Print